কিশোর কিশোরী/৪

উইকিসংকলন থেকে
(৪)

আমি কেন ছুটে এ’নু? জানি না আপনি,
যখনি দেখি তোমা, আমিনু তখনি!
কোন ডাক শুনি নাই, তবু কে ডাকিল,
কে যেন ঘুমা'তেছিল—সে যেন জাগিল!
আমি ফিরে ফিরে চাই, দেখিতে ন পাই,
কোন ডাক শুনি নাই কেমনে বুঝাই,—
কেন যে আসিনু ছুটে?—তুমি কি বোঝনা,
এ নহে কথার কথা,—এ নহে ছলনা?

তুমি কি ভেবেছ মনে ঠিক করেছিনু,
আগে হ’তে?—আমি জেনে শুনে এসেছিনু,
মোহিনী মূরতি তব দেখিলার তরে
কৌতুহল-পরবশ বাসনার ভরে?
সামান্য তস্কর সম চুরি করি নিতে?
সৌন্দর্য্য-সম্পদে তব মোর দৃষ্টি দিতে?
চাও মোর আঁখি পানে, ও কথা ভেবনা,
এ নহে কল্পনা,—ওগো, এ নহে ছলনা।

কিসের কল্পনা বল, কিসের ছলনা?
কেমনে জাগিবে আজি বিহবল বাসনা
বিগত যৌবনে? মোর মাঝে নিরন্তর,
হাসিত কাঁদিত সেই যে চির-সুন্দরঃ—
বাসনায় পূর্ণ প্রাণ, বুকে রক্তরাশি,
আপনি উত্তাল হ’য়ে বাজাইত বাঁশী।
মাথায় ফুলের মালা, ফুলধনু হাতে,
ফুলের তরঙ্গ তুলি বসন্তের রাতে,

আপনি কাঁপিত আর মোরে কাঁপাইত।
আপনি ভাসিত, আর মোরে ভাসাইত!—
সে ফুল তরঙ্গে;–কোন্‌ অপারের পারে,
লয়ে যেত ভাসাইয়া মোরে বারে বারে?—
আঘাতি' হৃদয় মোর আছাড়িত তীরে!
আবার ভাসায়ে দিত, আসিতাম ফিরে!
জীবন ভরিয়াছিল তারি মহিমায়,
গরবে, গৌরবে তারি, সুখে, বেদনায়!

চাহিলে ফুলের পানে, ভাবিতাম ফুল,
এখনি ফুটিবে প্রাণে,—করিবে আকুল,
পরাণ মুকুল রাশি! ছুটিতাম তাই,—
হৃদয় মাঝারে মোর, যদি তারে পাই।
যদি কভু শুনিতাম, কোন সুন্দরীর
সৌন্দর্য্যের স্তুতিবাদ,—অমনি অধীর
বাসনার স্রোতে মোরে ভাসাইয়া নিত!—
তাহারি কল্পিত বুকে মোরে পরশিত।

আমি সেই কল্পলোকে মুদিয়া নয়ন
তাহারই লাবণ্যের কুসুম চয়ন
করিতাম মনে মনে;  মূরতি গড়িয়া,
প্রাণে প্রাণে সাজাতাম পরাণ ভরিয়া।
কত না সোহাগভরে মালা গাঁথিতাম,
সেই মালা তারি অঙ্গে জড়ায়ে দিতাম
মনে মনে! ছুটিতাম তারি অভিসারে,
ভাবিতাম, আসিবে সে, ধরিব তাহারে:—

সে চির-সুন্দর মোর, নাই আর নাই!
বিগত যৌবনে তারে খুঁজিয়া না পাই!
শিথিল হৃদয় আজি, নিষ্প্রভ নয়ন,
বক্ষমাঝে রক্তধারা ছুটে না তেমন,—
উত্তাল উন্মাদ হ'য়ে! কাঁপে না অন্তরে,
নির্ব্বোধ বাসনাপুঞ্জ, পাতার মর্ম্মরে,
পুষ্পের পরশে! সৌন্দর্য্যের কথা শুনে!
উন্মত্ত হয় না হৃদি স্বপ্ন-জাল বুনে।

তবু, কেহ আনে নাই তোমার বারতা,
আমার কাণের কাছে;–ওগো কোন কথা,
শুনি নাই অপরূপ, তোমার রূপের!
বাজে নাই কোন তন্ত্রী মোর মরমের,
তোমা দেখিবার আগে! তোমার লাগিয়া
ছিল না পরাণ মোর কাঁপিয়া, চাহিয়া!
সেই যে আসিলে সেই যে প্রথমবার,
ধূসর গগনতলে,—সাঁঝের মাঝার!–

তার আগে কেহ মোরে কহে নাই নাম,
কোন ঘর আলো কর,—কোথা তব ধাম!
ওই যে অধর তব সরলতা মাখা,
সকল মধুরী তার হাসি দিয়ে ঢাকা,
সুখসূয্য-কর-স্নাত কুসুম সমান;
করুণায় ভরাভরা ওই যে নয়ান!—
তার কথা শুনি নাই;—ওগো মর্ম্ম-লতা
আপনি আনিলে তুমি আপন বারতা!

তবে কেন ছুটে গে’নু দেখিতে তোমারে?
আপনি বুঝিতে নারি, নারি বুঝাবারে।
সুধু মোর মনে হয়, কে যেন ডাকিল,
তোমার সম্মুখে আনি জাগাইয়া দিল!
জ্বলন্ত প্রদীপ হ'তে যেমন জ্বালায়,
আর একটা প্রদীপ আনি তাহারি শিখায়,
তেমনি আমার লয়ে ধরিল যখনি,
তব রূপ-শিখাপরে জ্বলিনু তখনি!

কণ্ঠে মোর জড়াইনু গৌরবের মালা,
কাঁপিতে কাঁপিতে;–এই যে প্রদীপ জ্বালা,
সর্ব্ব প্রাণে, সর্ব্ব মনে, ওগো সব অঙ্গে,
ভাসিছি ডুবিছি তারি আলোক-তরঙ্গে।
এ আলো কাহার তরে?—কেবা জ্বালাইল?
কা’র পূজা লাগি বল প্রদীপ জ্বলিল?
কোন্‌ দেবতার কোন্‌ মন্দিরের গায়,
ঝুলে ঝুলে জ্বলিতেছি দিবস নিশায়?