বিষয়বস্তুতে চলুন

ক্রৌঞ্চ-মিথুনের মিলন-সেতু/ক্রৌঞ্চ-মিথুনের মিলন-সেতু

উইকিসংকলন থেকে

ক্রৌঞ্চ-মিথুনের মিলন-সেতু

 সুনীতি বন্ধুগৃহ হইতে যখন বাড়ি ফিরিল তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সারাদিনের পরিশ্রান্ত দেহমন লইয়া নিজের শয়ন-গৃহে চলিয়া গিয়া চুপে চুপে চোখ বুজিয়া কিছুক্ষণ অন্ততঃ বিছানায় তার পড়িয়া থাকার একান্ত ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তার ভাগ্যের সে ইচ্ছা মোটেই ছিল না, তাই সামনের বারান্দা দিয়া ভিতরের অনতিবৃহৎ বসিবার ঘরখানায় ঢুকিতেই যে দৃশ্য তার চোখে পড়িল, ইহার জন্য সে মনের মধ্যে সর্ব্বদা শঙ্কিত থাকিলেও আজকের সন্ধ্যাটায় একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। শুধু মনেই নয়, শরীরেও সে আজ আদৌ সুস্থ নাই। আঃ! এতটুকু, একটুখানি বিশ্রাম, অন্ততঃ খানিকটা সময়ের জন্যেও যদি সে চুপটি করিয়া পড়িয়া থাকিতে পারিত! অতীতের স্মৃতি আজ তাকে একান্তরূপেই যে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে। শারীরিক শ্রমও তাকে বড় কম করিতে হয় নাই, পয়সার অভাবে হাঁটিয়াছেও সে অনেকটাই।

 তার বাবা, এই বাড়ীর যিনি কর্ত্তা, চন্দ্রকুমার চক্রবর্তী দরজার দিকে মুখ করিয়া খাড়া দাঁড়াইয়া আছেন। চেহারা তাঁর মোটের উপর একদিন বেশ ভালই ছিল, এখনও তার সবটা ধ্বংস হইতে পারে নাই, নাক-চোখে তার সুস্পষ্ট চিহ্ন আজও জাগিয়া আছে, মুখের রঙটা তামার মত হইয়া গেলেও গায়ের রঙয়ে আজও সুবর্ণের আভাষ পাওয়া যায়, মাথার চুলের মধ্যভাগে টাক পড়িতেছে, চোখের দৃষ্টি বিস্ফারিত ও সদা-চঞ্চল, ঠোটের পাশে মৃদু মৃদু অর্থশূন্য মন্দ হাস্য। মেয়েকে দেখিতে পাইয়াই তিনি ফোঁস করিয়া একটা ছোবল মারিলেন, “কি? এতক্ষণে এলে! আজ আমার খেতে জোটেনি সে খবরটি রাখো কিছু?”

 সুনীতি অকারণেই অপ্রতিভ হইয়া পড়িল, ঈষৎ কুণ্ঠার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “কেন? রান্না কি ভাল হয়নি? পাঁড়েটাকে এত করে শেখাচ্ছি তবু—”

 চন্দ্রকুমার জিহ্বা-তালু সংযোগে একটা বিশেষরূপ ধ্বনি করিয়া ওর কথায় বাধা দিলেন, বলিলেন, “কোথায় তোমার পাঁড়ে? তাকে তো আমি গলা ধাক্কা দিতে দিতে বাড়ী থেকে বার করে দিয়েছি। রাঁধবে কে শুনি?”

 সুনীতি একটুক্ষণ স্তব্ধ থাকিল, পরে সচেষ্ট আত্মসম্বরণের সহিত কহিল, “নতুন ঝিকে দিয়ে কিছু করিয়ে, না হয় বাজার থেকে আনিয়ে খেলে না কেন? তুমি তো জানতে আমার ফিরতে একটু রাত হবে!”

 চন্দ্রকুমার এই কথায় যেন আত্মমর্যাদায় নিদারুণ আঘাত পাইলেন, অকস্মাৎ সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া সদর্পে ও সদম্ভে কহিয়া উঠিলেন, “তুমি কি মনে ভেবেছ পাঁড়েকে বিদায় দিয়ে আমি তোমার ঝি-মাগীকে বাড়ীতে থাকতে দিয়েছি? কেন? কেন দোব? মেয়েমানুষ বলে? কিসের জন্যে? মেয়েমানুষ কি পুরুষ মানুষের চাইতে কোন কিছুতে কম? ওরা কি পুরুষের চেয়ে কম খায়, না কম পরে? খাটতে পারে কম? চুরি করে না? মিথ্যের ঝুড়ি নয়? যত সব মন্দ কাজ সংসারে হয়, সব্বার মধ্যেই থাকে ওরা, ওরা—ওরা·····”

 “বাবা!”

 চন্দ্রকুমার সর্ব্বশরীরে একটা ঝটকা দিয়া আধফেরা হইয়া দাঁড়াইলেন, মুখে একটা তীব্র বিদ্রূপের কুটিল হাস্য তাঁর ফুটিয়া উঠিল, “হ্যাঁগো হ্যাঁ! তোমার গায়ে তো লাগতেই পারে, মেয়েমানুষ কি-না! কিন্তু সত্যি কথা বলবো, হ্যাঁ নিশ্চয়ই বলবো, তোমার ভাল না লাগলেও বলবো,—শুনতে পেলে?”

 সুনীতি অতি মৃদু একটা নিশ্বাস ভিতরে ভিতরে চাপিয়া ফেলিয়া সংযত-কণ্ঠে উত্তর করিল, “শুনেছি।”

 চন্দ্রকুমার নিজের খেয়ালেই যথাপূর্ব্ব বলিয়া চলিলেন, “হ্যাঁ শুনতেই হবে,—হবেই শুনতে, না শুনলে আমি ছাড়বো কেন? কেন, কেন, কেন ছাড়বো শুনি? আমার বাড়ীতে আমি কর্ত্তা নই?” চিরটা কাল ধরে শুনে আসছি, কর্ত্তার ইচ্ছায় কর্ম্ম! আজকের দিনে কিসের জন্যে তার ব্যতিক্রম হবে শুনি? হঠাৎ কি পৃথিবীটা সূয্যির আকর্ষণ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে? কিছুতেই না, কিছুতেই না, আমার যা খুসী হবে আমি করবো,—ঝি-চাকর, বামুনদিদি, বামুনঠাকুর যাকে ইচ্ছে হবে তাড়িয়ে দোব, দোবই দোব, কি করতে পারবে তুমি সুনীতি? পারবে কিছু করতে?”

 সুনীতি কি বলিবে? সে স্তব্ধ স্থির দাঁড়াইয়া রহিল, অথচ সে জানে তাকে এখনই রান্নাঘরের দিকে যাইতে হইবে, না গেলে রাত্রের আহার্য্য প্রস্তুত হইবে না। বাড়ীতে দ্বিতীয় প্রাণীটী পর্য্যন্ত নাই।

 চন্দ্রকুমার কিন্তু মেয়ের নীরব ঔদাস্য পছন্দ করিলেন না, আরও খানিকটা উত্তেজিত হইয়া কথার উপর জোর দিয়া দিয়া পুনশ্চ তাহাকে প্রশ্ন করিলেন, “কি গো! চুপ করে রৈলে কেন? মনে করচো—পারবে আমায় বাধা দিতে, না? কিন্তু এই আমি একটি কথায় বলে দিলুম তোমাকে, সে তুমি, তুমি তো তুমি, তোমার বাবা এলেও পারবে না। সে যা’ করবে সে শুধু আমি, আমিই করবো। বুঝতে পেরেছ? হ্যাঁ কি না শীগ্‌গির বলো, শীগ্‌গির—”

 এবার আর কথা না কহিলেই নয় দেখিয়া মৃদু নিক্ষিপ্তশ্বাসে অর্দ্ধস্ফুটস্বরে সুনীতি উত্তর করিল, “বুঝেছি বাবা, আমি এখন রান্না ঘরে যাচ্ছি···”

 সে পিছন ফিরিয়া চলিতে উদ্যত হইয়াই ফিরিতে বাধ্য হইল, চন্দ্রকুমার ডাক দিয়াছেন। সুনীতি ফিরিয়া দাঁড়াইলে মৃদু মৃদু হাসিতে হাসিতে কহিতে লাগিলেন, “ছাই বুঝেছ! যদি বুঝতেই পারতে তা’হলে কি আমায় বলতে না যে, ‘আমার বাবা তাে তুমিই, তবে আবার বলা হচ্ছে কেন যে তােমার বাবা এলেও পারবে না’! বাঃ কি লেখাপড়াই শিখলি এতদিন ধরে? একটা ‘হক’ কথা বলতে ভরসা রাখিস্ না! আরে, চল্লি কোথায়? শোন্, শোন্, রান্না আর করতে তােকে হবে না, না হয় আজ নাই বা খেলুম! কি, নাঃ যা, যা, রাঁধগে যা, নাই বা রাঁধবি কেন? কেন শুনি? খেতে দিচ্ছিনে তােকে? ও-সব কিনা অম্‌নি হয়? মাগ্‌না নাকি? একটা মেয়েছানা পােযা বড় চাট্টিখানি কথা কিনা! রাঁধবি নাতো কি করবি? মেয়েমানুষে তিন তিনটে পাশ করেছে বলে কি বাপকে কিং জর্জ্জ করে দিয়েছে নাকি? যা, যা,·····”

 সুনীতি এ অপমানের ঘায়ে মূর্চ্ছা গেল না, বৎসরাবধি এ সমস্ত কথা সে ত অহােরাত্রই উঠিতে বসিতে ক্রমাগতই শুনিতেছে। এর চেয়ে আরও কত কত মন্দ কথাও তাকে শুনিতে হইয়াছে, যে সব কথা অপর কেহ মুখে উচ্চারণ করিতে সাহস করিলে চন্দ্রকুমার হয়ত স্বহস্তে তাকে চাবুক-পেটা না করিয়া জলগ্রহণ করিতেন না, কিন্তু “তেহি নাে দিবসাগতাঃ” চন্দ্রকুমার আজতাে আর সে চন্দ্রকুমার নাই!

দুই

 ঝি নাই, ঠিকে ঝি হইলেও বাড়ীর মােটা কাজগুলি সে-ই দু’বেলা করিয়া দিয়া যায়, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, জল-বাটনা, ঝাঁট-পাট সমস্তই; পাঁড়ে শুধু রাঁধেই না—বাজারও করে, খামখেয়ালী গৃহস্বামীর ফাইফরমাস সমস্তই সে খাটে, এক রান্না সাতবার করিয়া গরম করে, চালে একটি ধান একটি কাঁকর থাকিলে রক্ষা থাকে না, রান্নায় ঝাল হইলে বাটীশুদ্ধ ব্যঞ্জন তার গায়ে গিয়া পড়ে, ঝাল নুন কম হইলে চারিদিকে ছড়াছড়ি হয়, তৎক্ষণাৎ নূতন তরকারী মাছ রাঁধিয়া দিতে হয়। অবশ্য সময় সময় নূতন করিয়া রান্না করিতেও যে হয় না, তাও নয়। সুনীতিরও তার নিজের অংশের জিনিষগুলিকে কখনও মশলা বাড়াইয়া, কখনও মশলা ধুইয়া নূতন মশলা দিয়া নবীন মূর্ত্তিতে সরবরাহ করিতে হইয়া থাকে। সুনীতি নুন লঙ্কা তেঁতুলগােলা দিয়া ভাত যেটুকু না খাইলে নয়, খায়; পাঁড়ে দই মিষ্টির পয়সা পায়। এরকম উপদ্রব বেশীদিন কে সহিবে? বামুন ঠাক্‌রুণ দুজন দুমাসও কাটাইতে পারে নাই, তারপর কতজনই আসিল গেল। প্রাদেশিকতার কোনই বাছবিচার করা হয় নাই। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব্বোত্তর-অংশের সমস্ত জেলার, উড়িষ্যা বিহারের দারভাঙ্গা, ভাগলপুর, পাটনা হইতে উত্তর-পশ্চিমের গােরখপুর কেহই এ বাড়ীর রান্নাঘরে পদার্পণ করিতে বাকি থাকে নাই, যে একবার আসিয়াছে, সে আর তাে আসে না এবং সাধ্যপক্ষে অপরকেও আসিতে বাধা দেয়। এক আধজন দুঃসাহসী মুখের উপর জবাব করিতে গিয়া মারও তো খাইয়াছে। লােক পাওয়া এ বাড়ীতে খুবই কঠিন।

 সুনীতি ভোরে উঠিয়া বাসি-বসন পােড়া-কড়া লইয়া মাজিতে বসিল। রান্নাঘর সে রাত্রেই রান্নার পর ধুইয়া রাখিয়াছে। উনান ধরিতে দেরি হইবে, চায়ের কেৎলি ও সমস্ত সরঞ্জাম সে তেলভরা প্রাইমাস ষ্টোভের কাছে সাজাইয়া রাখিয়া বাসনগুলি দ্রুতহস্তে মাজিতেছিল। রাসনমাজা কাজটাতেই বড় বেশী কষ্ট হয়, বাবা যদি ঝিটাকেও অন্ততঃ না তাড়াইতেন। কিন্তু একথা ভাবিয়া লাভ কি? তার বাবা যদি ‘বাবাই’ থাকতেন তবে এসব অস্বাভাবিক কাণ্ড করিবেনই বা কেন? একি তার পূর্ব্বাপর পরিচিত সেই পরম স্নেহময় পিতা? মাত্র তিনটি বৎসর, তিন বৎসর তার মা মরিয়াছেন আর এরই মধ্যে তাঁর এই অধঃপতন! সুনীতির মানস-নেত্রে ফুটিয়া উঠিল তার মায়ের মুখ, আপনার শক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ধৈর্য্য ও গাম্ভীর্য্যে অতি সংযত অথচ স্নিগ্ধ সহাস্য মুখে যেন পরম ঔদার্য্য মাখানাে, কি অপূর্ব্ব দর্শনাই যে ছিলেন তিনি! বছর চল্লিশের কাছাকাছি বয়স হইয়াছিল, শরীর মনে কোথাও এতটুকু ক্লান্তি দেখা দেয় নাই, তেমনি তাঁর স্বামী-প্রেমের পরিপূর্ণ সরােবরেও না। ঠিক সেই তরুণ বয়সের মতই চন্দ্রকুমার স্ত্রীর আশেপাশে মুগ্ধ মধুপের মতই প্রেমের গুঞ্জন গাহিয়া দুটি জীবনকে চিরশ্যামলতায় নবীন করিয়া ভরাইয়া রাখিয়াছিলেন। সংসার ছিল অভাবহীন, জীবন ছিল পরিপূর্ণ। সেবাকুশল শুচিতায় সমস্তই ছিল মধুরতম। হাস্যে-রহস্যে সুপ্রফুল্ল দিনগুলি ছিল ঠিক যেন অব্যাহত একটি অপূর্ব্ব ছন্দে গাঁথা।

 সহসা মেঘ না জমিতেই বাজ পড়িল। সুনীতির মা সুকুমারী অকস্মাৎ মারা গেলেন, সংসারে লাগিল আগুন, সে আগুন ধীরে ধীরে তাঁর সমস্ত সংসারকে, তাঁর পরিত্যক্ত পতি-পুত্রীকে ভস্মীভূত করিতেছে, ছাই হইয়া যাইতে বেশী আর বাকিও নাই। চন্দ্রকুমার পত্নীবিয়ােগে মেয়েদের বিধবা হওয়ার চেয়েও বড় বেশী শােকার্ত্ত হইলেন, তাদেরই মত আমিষ আহার ত্যাগ করিলেন, চাকরী ছাড়িয়া অসময়ের পেন্সনে যথেষ্ট অর্থ ক্ষতি স্বীকার করিলেন, গীতা পাঠে যােগবাশিষ্ট রামায়ণে চিত্ত ঢালিয়া দিলেন; কিন্তু বেশীদিন এভাবও তাঁর রহিল না, এটা শ্মশান-বৈরাগ্যের মতই মাসকতক চলিয়াছিল এবং সুনীতির পক্ষে তখনও ব্যাপারটা খুবই শান্তির ব্যাপার হয় নাই। স্নান নাই, আহার নাই, সারা দিনরাত্রি কাতর দীর্ঘশ্বাস, চাপা ক্রন্দনে অপগতাকে সকাতর আহ্বান, মাতৃশােকাতুরা নিজের দুঃখেই যথেষ্ট অভিভূত হইয়া আছে, তার উপর বাপের এতখানি কষ্ট সহ্য করা তার পক্ষে অসহনীয় মনে হইত। অথচ নিজের কষ্ট ভুলিয়া তাঁকেই একান্ত স্নেহে ও শ্রদ্ধায় নিবিড়ভাবে বেষ্টন করিয়া থাকিত। বি-এ পরীক্ষার পর এম-এ পড়িবার যে কল্পনা ছিল, সে ইচ্ছা তাঁর জন্য সে ত্যাগ করিল, অসহায় শােকাচ্ছন্ন বাপকে সে কার কাছে রাখিয়া দিয়া কলিকাতায় পড়িতে যাইবে!

 সকল দেশেই প্রবাদ আছে, ‘অতির গতি ভাল নয়’ ‘অতি দর্প হতা লঙ্কা’ ইত্যাদি, এক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিল! চন্দ্রকুমারের অতি শোক তাঁর অতিশয় পতনেরই কারণ হইয়া দাঁড়াইল। সহায়তা ভিন্ন শাস্ত্রাধ্যায়ন অতি সাধারণ বুদ্ধিতে তার সত্যমূর্ত্তিতে প্রকটিত হয় না, ঝোঁকের মাথায় পুঁথির পাতা উল্টাইয়া যাওয়াই চলে, চিত্তক্ষেত্রে ধর্ম্মের বীজ যথাযথ ভাবে অঙ্কুরিত হইয়া পল্লবিত ও পুষ্প-প্রসবিনী ফলপ্রসূ হইতে পারে না।

 কিছুদিন পরে একান্ত নিরসবােধে শাস্ত্রচর্চ্চা ছাড়িয়া দিয়া চন্দ্রকুমার সাইকীক সােসাইটিতে যাতায়াত আরম্ভ করিলেন। ‘লেড বিটার’, ‘অলিভার লজ’, ‘ম্যাডাম, ব্ল্যাভাটস্কি’ ও অন্যান্য কিছু কিছু পরলােকতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থাদি একান্ত আগ্রহে সংগ্রহ ও পাঠ করিতে লাগিলেন, মনে হইল বুঝি এইবার একটা শান্তির সন্ধান পাইয়াছেন! ইহলােকের ও পরলােকের মাঝখানে যে একটা অতি গুহ্য এবং অত্যন্ত সূক্ষ্ম মিলন-সেতু এই উভয় লােকের অধিবাসীদের একান্তরূপে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছে, এইবার সেই গুপ্ত পথের সন্ধান লাভ করিয়া তিনি বুঝি সেই সেতুটাকে পার হইতে পারিয়াছেন! আর কি? এখন তাঁর প্রবাসিনী-প্রিয়া আর তাঁর অনধিগম্যা রহিলেন না, তাঁর অন্তরের নাস্তিত্বের শূন্যতা এইবার সম্পূর্ণরূপে দূর হইয়া গেল!

 একদিন একান্ত আগ্রহভরে সুনীতিকে অসিয়া বলিলেন, “আজ একজন মিডিয়ামের আসবার কথা আছে, তাঁর কাছে তোমার মা’র খবর পাবো, তিনি নিশ্চয় আসবেন, তুমি যাবে?”

 সুনীতি তার বাবার পুরাণো সোয়েটারটা রিপু করিতেছিল, হাত হইতে ফেলিয়া দিয়া সচকিতে দাঁড়াইয়া উঠিল, বিস্ফারিত নেত্রে চাহিয়া আগ্রহ-ব্যাকুল কণ্ঠে বলিয়া ফেলিল, “যাবো বাবা, আমায় নিয়ে চলো।”

 “বেশ তৈরী হও,—” বলিয়া চন্দ্রকুমার স্ত্রীর জীবিতকালের মত কোঁচান মিহি ধুতি, হাতে গিলা-করা আদ্ধির পাঞ্জাবী ও পাতলা উড়ানী পরিয়া সাজিয়া আসিলেন; স্ত্রীর মৃত্যুর পর এসব আলমারী হইতে বাহির করা হয় নাই। এতকালের পরিত্যক্ত সোয়েডের পামশুজোড়া পায়ে ফোস্কা পড়াইয়া দিতে থাকিলেও তাদের মোহ ত্যাগ করিতে পারিলেন না, আজ বহুদিনের অদর্শনের সমস্ত বিরহ বেদনা প্রশমিত করিয়া, তপ্তনিদাঘের সমুদয় তাপদাহ জুড়াইয়া দিয়া নব বর্ষার স্নিগ্ধ সলিল সম্পাতের মত সুকুমারী আসিবে, সে তো তাঁর এমন অপরিচ্ছন্ন বিশৃঙ্খল বেশভূষা সহ্য করিতে পারিবে না!

 মিডিয়াম এদেশী নয়, একজন বিদেশী পুরুষ। তিনি প্রথমতঃ আর একজনের বিদেহী আত্মীয়ের সঙ্গে মিলন-সেতু বাঁধিয়া দিয়া তারপর চন্দ্রকুমারের প্রতি প্রশ্ন করিলেন:

 “কা’কে চান?”

 আবেগ বিগলিত বিচলিত কণ্ঠে চন্দ্রকুমার উত্তর করিলেন, “আমার স্ত্রীকে, আমার সুকুমারীকে—”

 “আমি বলে দেখি,—হ্যালো মিষ্টার স্মিথ! আপনি কি এঁর স্ত্রীকে ডেকে আনতে পারবেন?—”

 প্রসারিত ফুলস্কেপটিতে লিখিত হইল, আমি তো তাঁকে চিনি না, তবে এইখানে একজন লেডি দাঁড়িয়ে আছেন এবং ঐ ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছেন;—হতে পারে তিনিই ওঁর স্ত্রী।”

 “আপনি প্রশ্ন করুন—”

 চন্দ্রকুমার দু’তিনবারের চেষ্টার পর গলা সাফ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন:

 “সুকু? এসেছ?”—

 উত্তর হইল, “অনেকক্ষণ! আমি তো তোমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকি।”

 চন্দ্রকুমাবের চোখ দুইটা তার চশমার পরকলার মধ্য দিয়া চকচকে হইয়া উঠিল, আনন্দস্মিত মুখে তিনি কহিয়া উঠিলেন, “সত্যি থাকো? সমস্তক্ষণ? তবে আমায় দেখা দাও না কেন?”

 উত্তর হইল, “কি মজার কথাই বল্লে! দেখা দিই, আর তুমি ভূত দেখেছ বলে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করো আর কি! রোজা ডেকে আমায় সরযে-পড়া খাওয়াও।”

 চন্দ্রকুমারের সেই উজ্জ্বল দৃষ্টি সলিলার্দ্রতায় ঝাপসা হইয়া গেল, তিনি সক্ষোভে উচ্চারণ করিলেন, “আমায় তুমি তাই ভাবো!”

 “হয়েছে, আর রাগ করতে হবে না, আচ্ছা, অমন দশা করে থাকো কেন?”

 “কেমন দশা?”

 “বাঃ জানো না যেন! নাপিতকে ধোপাকে ভাতে মেবে দর্জ্জিকে বয়কট করে, কিম্ভূতকিমাকার মূর্ত্তি হয়ে, ও সব কি হচ্ছে?”

 চন্দ্রকুমার একটা প্রচণ্ড দীর্ঘশ্বাসে যেন সমস্ত মনটাকে একমুহূর্ত্তে হাল্কা করিয়া ফেলিলেন, তাঁর সমুদয় আত্মত্যাগ তা’ হইলে সার্থকতা লাভ করিয়াছে! বলিলেন, আগ্রহ মধুর কণ্ঠে বলিলেন, “তোমায় ছেড়ে কিছুই আমার ভাল লাগে না যে সুকু! তুমি কেন আমায় ছেড়ে গেলে রাণি?”

 অদৃশ্য সুকু উত্তরে লিখিল, “আমি কি ইচ্ছে করে চলে গেছি নাকি? নিয়তি আমায় টেনে এনেছে, কি কষ্ট, তাই বলে কি তোমায় অত কুড়ে হলে কখন চলে?”

 “কুড়ে!” সবিস্ময় অর্ধস্ফুট আর্ত্তনাদ। “কুড়ে!”

 “তা’ না তো কি! চাকরী ছাড়লে কি জন্যে? পুরুষ মানুষ। কাজকর্ম্ম ছেড়ে ঘরে বসে থাকলে শরীর মন ভাল থাকে কখন? কি চেহারা করেছ, আরসিতে কি চেয়েও দেখ না?”

 আবার মনটা প্রসাদ প্রসন্নতায় ভরিয়া উঠিল: “কি হবে শরীর নিয়ে, তোমার কাছে যত শীগ্‌গির যেতে পারি ততই তো ভাল।”

 “আহা কি কথাই বল্লেন! আর আমার মেয়েটার! ওর কি বিয়ে দেবে না? পড়া তো ছাড়িয়েই দিয়েছো?”

 ঠিক সুকুমারীরই চরিত্রগত পরিচয়! ঈষৎ অভিমানে চন্দ্রকুমার উত্তর দিলেন, “পড়া আমি ওর ছাড়াইনি সুকু! ও নিজেই ছেড়েছে। আর বিয়ের কথা তো একটা দুটো হচ্চে, ওই তো বিয়ে করতে রাজী হয় না।”

 “হ্যাঁ, সেও তোমারই জন্যে! তুমি যদি সহজ ভাবে থাকতে, ওকে তোমার জন্যে অতখানি ভাবতে বা কষ্ট পেতে হতো না! আচ্ছা আজ যাই, না না আর থাকতে পারছি না, কষ্ট হচ্চে।”

 সেই পতি-পত্নী, সেই মান-অভিমান, সেই কর্ত্তব্য-অকর্ত্তব্যের ঘরোয়া হিসাব-নিকাশ! তবে আর যায় কি? হারায় কোথায়? শুধু যদি একবার চোখের দেখাটা দেখা যাইত!

 চন্দ্রকুমার আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া যেখানে যত ছোট-বড় মিডিয়ামের খবর সংগ্রহ করিতে পারিল, ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিল, কিন্তু সত্যই তো আর ব্যাপারটা অত সহজসাধ্য নয়! টেবিল ঠোকা, প্ল্যানচেট নামান, অনেক কিছুই হইল, তত্রাচ এমন কিছুই মিলিল না যাহাতে অন্তর হইতে বিশ্বাস করিতে পারা যায় যে, সত্যই তার অপগতা প্রিয়-পত্নী বিদেহী সুকুমারীই তার সঙ্গে কথাবার্ত্তা কহিতেছে! সে রহস্যালাপ, সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তো কোথাও মিলিল না!

 প্রায় একটি বৎসর পরে আবার সেই পূর্ব্বতন মিডিয়াম তাদের “সাইকীক্যাল রিসার্চ সোসাইটীতে” দেখা দিলেন। চন্দ্রকুমার সুনীতিকে খবর না দিলেও সে তার বাবার সাজসজ্জার বহর দেখিয়া আন্দাজে ধরিয়া ছিল,—এবার সঙ্গ লইল।

 সুকুমারী এবার অন্য সুরে কথা কহিল, বলিল, “কেন তুমি অমন করে আমায় দিনরাত টানাটানি করছো? নিজেও দুঃখ পাচ্চো, আমাকেও দিচ্চো, আমায় ভুলে যাবার চেষ্টা কেন করছে না?”

 আহতের আর্ত্তস্বরে চন্দ্রকুমার উচ্চকণ্ঠে চীৎকার করিয়া কহিয়া উঠিলেন, “তোমায় ভুলে যেতে বলছো? বেশ! তাহলে আমায় তুমি আর চাও না? তোমায় আমি স্মরণ করে দুঃখ দিচ্চি? এমন নিষ্ঠুর হয়ে গেছ তুমি?”

 উত্তর দিল সুকুমারীর বিদেহী আত্মা,—না সূক্ষ্মদেহী সুকুমারী, আত্মা তো আর কথা কয় না, কহিল,—অর্থাৎ পেনসিলে ভর দিয়া লিখাইল—

 “হাঁ সব্বাই হয়, নিষ্ঠুর না হলে যদি পৃথিবীর দিকে শতচক্ষু হয়ে চেয়েই থাকতো,—উন্নতি করতো কেমন করে? তুমি আমায় আর ডেকো না, ডাকলেও আর আমি আসবো না।”

 “উঃ এত নিষ্ঠুর তুমি কেমন ক‘রে হ’লে সুকুমারী? আমার প্রতি এতটুকু টানও কি আর তোমার নেই? অথচ, আমি তোমার জন্যে অহর্নিশ কেঁদে ফিরছি!”

 অদৃশ্য হস্তের সবল অক্ষরে লিখিত হইল, “তা জানি, আর সেই জন্যেই আমি তোমার ডাকে সাড়া দোব না স্থির করেছি। মৃতের পিছনে ছুটে বেড়ালে ইহপরলোকের কোন উপকারই নেই। তার চেয়ে মেয়েটার ভাল বিয়ে,—তা’তে ভবিষ্যতে তোমারও মঙ্গল হবে।”

 চন্দ্রকুমার সুগভীর অভিমানভরে কহিয়া উঠিলেন, “তুমিই যদি আমায় ভুলে যাও, তবে ইহপরলোকে ভাল মন্দ কি হলো না হলো, কি আমার তাতে বয়ে গেল? চাই না আমার ভবিষ্যতের মঙ্গল! তুমি আমায় ত্যাগ করো না।”

 অতি দুঃখিত থামা থামা কলমে এই কথাগুলি লিখিত হইল,— “নিয়তি অখণ্ডনীয় হ’লেও তার নিমিত্ত কারণ আমিই তবে হলেম! কিন্তু কি করবো এ আমারও যে নিয়তি! এখনও শান্ত হ’বার চেষ্টা করো, গুরুমন্ত্র গ্রহণ করো, তাতে রুচি না হয় এই মন্ত্র জপো।”

 “এই মন্ত্র” সে লিখিয়া দিল।—“মন দিয়ে সর্ব্বদা জপ করো, না করলে দারুণ অমঙ্গল ঘটতে পারে। সাবধান করে দিচ্চি, এখনও আত্মস্থ হও। আমি চল্লেম,—আর ডেকো না। খুকি! তুই একটিও কথা বলতে পারলিনে মা? তোকে দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হচ্চে বিস্তর! আমি তোমায় আশীর্ব্বাদ করছি, তোমার শেষে ভালই হবে।”

 চন্দ্রকুমার উচ্চ চীৎকারে ডাকিয়া উঠিলেন, “সুকুমারী! সুকুমারী! সুকু! সুকু! সুকু!” তারপর আছড়াইয়া মাটিতে পড়িয়া গিয়া সম্পূর্ণ চেতনা হারাইলেন; যখন সংজ্ঞা ফিরিল, মস্তিস্ক তাঁর সম্পূর্ণরূপেই বিকৃত হইয়া গিয়াছে।

 সেই যে পরলোক হইতে গভীর ব্যথাহত চিত্তের নিগূঢ় সাবধানতার বাণী একটা নিদারুণ অমঙ্গলের নির্দ্দেশ দিয়াছিল, সে যে এমন মুখামুখি আগাইয়া আসিয়া আক্রমণোদ্যত হইয়াছিল, কে তাহা জানিত! মাসের পর মাস অতিবাহিত হইয়া চলিয়া গেল, এর কোনই ব্যতিক্রম ঘটিল না। চন্দ্রকুমার তাঁর চন্দ্রকিরণেরই মত পরম রমণীয় স্নিগ্ধ শীতলতা পরিহার পূর্ব্বক দিনের পর দিন ক্রমশঃই তপ্ত নিদাঘের উগ্রজ্বালা তাঁর চারিদিকে বিচ্ছুরিত করিতে থাকিলেন; ফলে নিজের ত যা’ হইল তা হইলই,—দগ্ধিয়া দগ্ধিয়া মরিতে লাগিল কন্যা সুনীতি। জ্বালার তার পরিসীমা রহিল না। কলেজ ছাড়িয়াছে, এম-এ পরীক্ষা না হয় নাই বা দিল, এমন কিছু বড় ব্যাপার এটা নয়, বাপের জন্য একটু ত্যাগ স্বীকার করা সে কিছু তার পক্ষে খুব বেশী কথা নয়; কিন্তু এই যে দিনের পর দিন সমস্ত মানসিক ব্যাপারের উপর এতখানি শারীরিক কষ্ট, অনভ্যস্ত শরীর যে আর এই ক্লেশভার বহন করিতে স্বীকৃত হইতেছে না। মাথা ঘুরিয়া কতদিন রান্নাঘরে পড়ে পড়ে হয়, কোনমতে সামলাইয়া লয়, বুক প্রায়ই ধড়ফড় করে, দেহ শীর্ণ, বর্ণ মলিন হইয়া যাইতেছে, তার আতঙ্ক-বিস্ফারিত সুন্দর দুটি চোখের কোলে অর্দ্ধবৃত্তাকারে কালির রেখা ফুটিয়া উঠিয়াছে, অথচ কতই বা তার বয়স! এই বয়সেই তো মেয়েরা খাইয়া পরিয়া পড়াশোনা করিয়া ভবিষ্যতের সুখময় সানন্দ জীবনের জন্য নিজেদের তৈরী করিয়া লয়। সুনীতির সকরুণ শান্ত মুখখানি দেখিলেই একটি আলোক-শিখা নেবা গৃহ-প্রদীপের কথা স্বতঃই মনে পড়ে।

 খিড়কীর দরজাটির বাহিরের দিকের কড়াটি খুট খুট করিয়া ঈষৎ নড়িল, কে যেন অতি মৃদু সঙ্কোচে সন্দেহ-ভীরু হস্তে সসঙ্কোচে আত্মপ্রকাশ করিতে চাহিতেছে। কে? সুনীতি ছাইমাখা হাত ধুইয়া উঠিয়া গিয়া দরজা খুলিয়া দিল। দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া নূতন-বিতাড়িতা ঝি শিবানীর মা। সুনীতির কাছে আসিয়া গলার স্বর নামাইয়া সে ফিস্ ফিস্ করিয়া কথা কহিল, বলিল, “মাইনেটা দেবে দিদিমণি? মাস কাবার ত আজ আটদিন হয়ে গেছে, বাড়ীউলি বড্ড তাগাদা করছে, দিয়ে দেবে?”

 সুনীতি যেন একটা পথ পাইল, বলিল, “তা’ দিচ্চি, তুই চলে গেলি কেন ভাই, জানিস্ তো বাবার কি অবস্থা, তোদের কি একটুও মায়া হয় না রে আমার ’পরে।”

 তার কথাগুলো শেষদিকে গাঢ় হইয়া কণ্ঠের মধ্যে জড়াইয়া আসিল। শিবানীর মা কহিল, “সে তো সবই জানি দিদি, কি করবো, আমি নিজে তো চলে যাইনি, শেষকালে ধাক্কা দিতে দিতে ‘বেরো মাগী, বেরো মাগী’ বলতে বলতে সদর রাস্তায় বার করে দিয়ে ফটক বন্ধ করে দিয়ে এলেন, আমি কি করবো বল? সত্যি বলছি, যে দিব্যি করতে বলো করতে পারি। সারারাতটা তোমার কথাই ভেবেছি। ঘুমুতে পারিনি তিলেকের জন্যেও।”

 সুনীতির আহতচিত্ত আর যেন আঘাত-ব্যথা সহিতে পারিতেছিল না, নিদারুণ গুমোটের পর এতটুকু হাওয়ার ছোঁয়াতেই তাই তার দু’ চোখ ফাটিয়া একরাশি উষ্ণ জলের ঝরণা ঝর ঝর করিয়া দু’গাল বহিয়া ঝরিয়া পড়িল। সে ব্যগ্র কাতরতার সহিত ঝিয়ের একটা হাত চাপিয়া ধরিল “আমি বড় একলা শিবুর-মা, তুমি আমার মুখ চাও, তুমি ফিরে এস ভাই, ফিরে এস।”

 এ-সব শ্রেণীর ভিতর স্বার্থান্ধতা যদিও খুবই প্রবল, তথাপি মানুষ মাত্রেরই মধ্যে সকলকারই একটা দুর্ব্বল স্থান আছে, দুর্ব্বল মুহূর্ত্তে সেখানে স্পর্শ লাগিলে তাকে এক মুহূর্ত্তেই উদারতর করিয়া তুলিতে তখন আর বাধে না। সে আজ যে মাহিনার ছুতা করিয়া আসিয়াছিল, এটা এই সুনীতির প্রতি অনুকম্পাতেই, নহিলে মাহিনা সে প্রয়োজন মত লইবে বলিয়া নিজেই সুনীতির কাছে জমা রাখিয়াছিল। তথাপি দ্বিধাগ্রস্থভাবে কহিল, “থাকলুম না হয়, কিন্তু বাবু যদি থাকতে না দেয়, দেখেছ তো, মানুষ জনের উপর আজকাল বড্ডই নারাজ। কেবলি বলে, ‘রাক্ষসের মতন গবগবিয়ে সব খাচ্চে,— কোন দিন আমায় খাবে, বিদায় করো, বিদায় করো’।”

 “লক্ষ্মী দিদি! তুমি খিড়কী দিয়ে এসে কাজ করে দিয়ে বেরিয়ে যেও, আমায় বাঁচাও, বাবা দেখতে পাবেন না।”

 ঝি এ প্রস্তাবে রাজী হইল।

তিন

 পরের দিন সকাল বেলায় চন্দ্রকুমার যখন নীচে নামিয়া আসিলেন, তখন তিনি আর সে মানুষই ন’ন। চোরের মতন পা টিপিয়া টিপিয়া ঘরে ঢুকিতেছিলেন, হঠাৎ সামনা-সামনি দেখা হইয়া গেল সুনীতির সঙ্গে। সে তখন ত্রস্তভাবে গরম জলের কেৎলী ঝাড়ন দিয়া ধরিয়া ভিতর দিকের দরজাটা দিয়া ঘরে ঢুকিতেছিল। চন্দ্রকুমার সুস্পষ্টরূপেই চমকাইয়া উঠিলেন, তাঁর ম্লান মুখ ম্লানতর হইয়া উঠিল, সঙ্কোচে দৃষ্টি নত করিয়া দরজার সামনেই দাঁড়াইয়া পড়িলেন, অগ্রসর হইতে আর পা উঠিল না। সুনীতি অতটা লক্ষ্য করে নাই, আর করিলেই বা কি, এরকম ঘটনা তো বৎসর কাটিতে যায়, তাদের নৈমিত্তিক নয়, নিত্যকারই ঘটনা। প্রচণ্ড রাগে জ্ঞানশূন্য হইয়া লোক তাড়ানো এবং তারপর অনুতপ্ত হইয়া মেয়ের কাছে মার্জ্জনা ভিক্ষা, এমন কি, সেই বিতাড়িত যদি তখন সম্মুখে থাকে, তাদের কাছেও হাতে ধরিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিতে কিছুমাত্র তাঁর বাধে না, আবার বিন নোটিশেই অকস্মাৎ মার মার শব্দে পূর্ব্বকৃত ব্যাপারেরই পুনরভিনয় করা। উঃ নিদারুণ,— নিদারুণ সে সব দৃশ্য, সহ্য করা সে-যে কি কঠিন!

 ছাকনী দিয়া চা ছাকিতে ছাকিতে সুনীতি ডাকিল, “এসো বাবা! ততক্ষণ মাখম-মিছরিটা খেয়ে নাও।” সে অন্য হাত দিয়া কাঁচের প্লেটে সাজানো মাখম-মিশ্রী, খোসা-ছাড়ানো বাদাম ও ভিজে মুগের সঙ্গে বাটা চিনি এবং ক্রীম-লাগানো টোষ্ট দুখানি বাপের চেয়ারের দিকে ঠেলিয়া দিল।

 চন্দ্রকুমার কবিরাজী মতের এবং পূর্ব্বাভ্যাস মতন ঠাণ্ডা ও গরম প্রেসক্রিপসন একসঙ্গেই ব্যবহার করিয়া থাকেন, আপত্তি করিয়া কোন লাভই ছিল না, তাই সুনীতি করে নাই। মেয়ের সহজ কণ্ঠস্বরে ও মুখভাবে চোখ তুলিয়া দেখিয়া তাঁহার একটু যেন সঙ্কোচ কাটিল, অগ্রসর হইয়া আসন গ্রহণ করিতে করিতে স্নেহ-করুণ কণ্ঠে কহিয়া উঠিলেন, “দেখিস্ মা! হাত পোড়াস্‌নি যেন, ঢের সময় আছে, তোকে অত ব্যস্ত হতে হবে না।”

 সুনীতির চাপা ঠোঁটের কোণের কাছে একটি বিন্দু দুঃখের হাসি অতি সন্তর্পণে ফোটে ফোটে হইয়াও সাহস করিয়া ফুটিতে পারিল না, সক্ষোভে সেটুকুকে সে ভিতরে চাপিয়া লইতেই মনে পড়িল এই কথাটাই—তার বাপ ইতঃপূর্ব্বে এক পেয়ালা তৈরি চা তার দিকে অগ্রসর করিয়া দিতে গেলেও কতবারই না তাকে আন্তরিকভাবেই বলিয়াছেন। “বাবা, কিচ্ছু খাচ্চো না যে, খাও—”

 চন্দ্রকুমারের যেন চট্‌কা ভাঙ্গিয়া গেল, “অ্যাঁ, খাচ্চি না! হ্যাঁ, হ্যাঁ, খাচ্চি নাই তো, নাঃ—খাবো না, তুই কি রকম রোগা হয়ে গেছিস্, আর আমি ভাল-মন্দ খেয়ে খেয়ে দিনকের দিন পেঁড়ো-সুর হচ্চি,—কেন? দেখছিস্ না? কত মোটা হয়ে গেছি। তোর মা যদি এখন আমায় দেখে, চিনতে পারে?—কক্ষনো পারে না।”

 সুনীতি প্রমাদ গণিল, তাড়াতাড়ি করিয়া বলিল, “নিশ্চয় পারেন। মা তোমায় কত রকম ভাল ভাল জিনিষ তৈরী করে করে খাওয়াতেন, সে কি রোগা হ’বার জন্যে? তুমি না খেলে তাঁর কষ্ট হবে না?”

 সর্ব্বনাশ! কেনই বা সে এমন কথাটা হঠাৎ বাপকে খুসী করিবার লোভে বলিয়া ফেলিয়াছিল? —উঃ কেন মরিতে বলিল?

 ঝন্ ঝন্ শব্দে হাতের প্লেটখানা টান মারিয়া মাটিতে আছড়াইয়া ফেলিয়া দিয়া চন্দ্রকুমার লাফাইয়া উঠিয়া দু হাত ঊর্দ্ধে তুলিয়া অকস্মাৎ কানফাটা চীৎকার আরম্ভ করিলেন:

 “কে বল্লে তোকে? কে বল্লে তোকে? তার কষ্ট হবে কে তোকে বলেছে? বল্? বল্? শীগগির করে বল্—বল্—না হলে আজ তোকে আমি আস্ত পুঁতে ফেলবো। মেয়ে বলে কিছু বলি না বলে। তার যদি আমার জন্যে এতটুকুও কষ্ট হতো, তাহলে সে বলতে পারতো, ‘ডাকলেও আর আসবে না’! নেমকহারাম! বেইমান কোথাকার! আর তুই, তুইও তো তারই গর্ভের মেয়ে, —কই, বলতে পারলি না তো, কি করে তুই জানলি যে তার কষ্ট হয়! বল কে তোকে এ-কথা বলেছে? বল্, না হলে তোকে। আজ আমি দু-খানা করে কেটে ফেলে ফাঁসি যাবো।”

 “আমিই তো ও-কথা বলেছি ওঁকে,—আপনি একটু ঠাণ্ডা হোন দেখি।”

 সুনীতির হাত কাঁপিয়া চায়ের পেয়ালার খানিকটা চা চল্‌কাইয়া টেবিল ক্লথের উপর পড়িয়া গেল, বাপকে দিবার জন্য সে পেয়ালাটা হাতে লইয়াছিল, নামাইয়া রাখিতে ভুলিয়া গিয়াছে।

 “কি? কি বল্লে? তুমি বলেছ? তুমি? তুমি? কে তুমি? তুমি কি জানো যে ও-কথা ওকে বলেছ? সুকুমারীর সঙ্গে তোমার কি দেখা হয়েছিল না কি যে, তুমি তার মনের খবর ওকে দিতে গিয়েছ? অস্পর্দ্ধ তো কম নয় তোমার? বেরোও— বেরোও, গেট-আপ, গেট-আপ”—চন্দ্রকুমার আগন্তুককে তাড়া করিয়া ছুটিয়া গেলেন।

 যে আসিয়া ঐ কথা বলিয়াছিল, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ প্রমাণ সাইজের বেশ একজন সুশ্রী যুবক সে, সাজসজ্জাও তার ভদ্রশ্রেণীর তারুণ্যদ্যোতক, মুখের ভাবটি ভারী স্নিগ্ধ ও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। সে তার স্বভাবমধুর কণ্ঠে ধীরস্বরে উত্তর করিল, “আমার চেনা একজন মিডিয়াম আছেন, আমি তাঁরই ‘থ্রু’তে সব্বার সঙ্গে কথাবার্ত্তা কইতে পারি কি না,— আপনার কন্যা আমাদের কলেজে পড়তেন, ডিবেটিং ক্লাবে আলাপও একটু-আধটু হয়েছিল, সেদিন হঠাৎ ট্রামে দেখা হ’তে উনি আমায় জিজ্ঞাসা করেন, কোন মিডিয়ামকে আমি চিনি কি না, তাই বাধ্য হয়েই একজনকার খবর ওঁকে আজ বলতে এসেছি। খুব ভাল মিডিয়াম, যাকে চাইবেন, তাকেই তিনি ডেকে দেবেন। চেনাশোনার অত শত উনি ধার ধারেন না। গ্ল্যাডষ্টোন বলুন, গ্ল্যাডষ্টোনকে পাবেন—চান যদি নেপোলিয়ানকে তাই তাই, সাজাহান বাদশাহকে পাওয়া যায় কি না অবশ্য আমি সেটা সঠিক বলতে পারছিনে,—কেন না সম্প্রতি পাকিস্থানে বাদশাহী করবার জন্যে যদি অবতার-টবতার হয়েই থাকেন, সেটা খোদা মালুম, নৈলে উপর মুল্লুকে থাকলে নিশ্চয়ই আসবেন। তবে নাদিরশা, তৈমুর আর চেঙ্গিস্‌খাঁ অথবা রঘুডাকাতের অবতার অনেকবারই হয়ে গেছে, এঁদের ক’টিকে শুধু মাথা খুঁড়লেও পাবেন না, যেহেতু সম্প্রতি তাঁরা রণরঙ্গে মেতে রয়েছেন।”

 চন্দ্রকুমার ধৈর্য্য ধরিয়া দাঁড়াইয়া এইসব কাহিনী শুনিতেছিলেন, অসহিষ্ণু হইয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, “ফক্কুড়ি রাখো, ধন! কোথায় থাকে তোমার সেই মিডিয়াম? নিয়ে চলো আমাকে সেইখানে, এক্ষুণি নিয়ে চল, না গেলে ওই ডাণ্ডা দিয়ে মাথাটি ফাটিয়ে দোব।”

 সুনীতির মুখখানা মরামুখের মত সাদা হইয়া গিয়াছে, সে তার কম্পিত ওষ্ঠাধরে কি যেন বলিতে গেল, কিন্তু বলা আর তা’ হইল না, হাতের ইঙ্গিতে উহাকে থামাইয়া দিয়া আগন্তুক সপ্রতিভ স্নিগ্ধ হাস্যে উত্তর দিল, “আপনাকে সেখানে কোন্ দুঃখে নিয়ে যাবো, তাঁকেই এখানে আজ রাত্রে আমি আনছি যে। এইখানে, এই তাঁর নিজস্ব বাড়ীঘরে, এইখানে এসেই না তাঁর মনটা পরিতৃপ্ত হবে। তা ছাড়া দেখুন, আপনি অত ভিড়ের মধ্যে ডাকতেন বলেই না তিনি ডাকলেও আসবেন না বলেছিলেন। নিজে যেচে এসে ওঁকে বল্লেন—“দেখুন, আমি হিঁদুঘরের বউ মানুষ, যতই হোক, সায়েবটায়েবের হাত-ধরা কি আর আমি পছন্দ করতে পারি!” এ রকম কেস্ ওঁর কাছে বিস্তর এসেছে কি না,—ওঁরই কাছে আমার সে-সব কাহিনী তো শোনা। তাই বলছি, দেখছেন তো, ঠিক হুবহু তাই এক্ষেত্রেও ঘটেছে, কথায় বলে, ‘স্বভাব যায় না মলে’। আচ্ছা, সুনীতি দেবি! দিন না ওঁর চা-টা ওঁকে এগিয়ে, আর যদি বেশী থাকে তো আমাকেও এক, না হয় তো আধ পেয়ালাটাক্—অবশ্য নিজের জন্যেও একটুখানি রাখবেন; না, না, সমস্তটা আমায় ঢেলে দিচ্ছেন কেন? আছে আরও? কই ঢালুন তো দেখি, আচ্ছা— তাহলে বিস্কুট দুটো চন্দ্রবাবু, না কি বলবো? জ্যাঠামশাই বলি? হ্যাঁ—খেয়ে নিন, আর বেশ করে তেলটি মেখে স্নান আহার করে একটুখানি নিদ্রা দিয়ে নেবেন, বৈকালে চা ইত্যাদি খেয়ে সম্পূর্ণরূপে তৈরী থাকবেন, সন্ধ্যে হলেই ওঁকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসবো। আর আপনি সুনীতি দেবি! একটা কাজ করবেন, একটি নির্জ্জন দেখে ঘর গঙ্গাজলে ধুয়ে মুছে ধূপ জ্বেলে, ফুল সাজিয়ে চন্দনের ছড়া দিয়ে একটি ছোট্ট চৌকিতে কাগজ পেনসিল রেখে দেবেন। নিজে স্নান করে একটি ক্ষৌম্যবস্ত্র পরবেন, কপালে দেবেন শ্বেত-চন্দনের প্রলেপ, চাই কি আপনারই হাত দিয়ে লেখা বার হ’তেও তো পারে। ওঁর সে রকম শক্তিও আছে। বেশ, সব ঠিক থাকলো। এখন প্রণাম জ্যাঠামশাই। নমস্কার সুনীতি দেবি। চল্লেম!”

 অদ্ভুত! ঝড়ের মত আসিয়া তেমনি করিয়াই চলিয়া গেল। কিন্তু কি অসাধ্য-সাধনই না সে করিয়া গেল, সে শুধু জানিল সুনীতিই। ক্ষুধিত একটা বাঘকে নিরীহ ভেড়া বানাইয়া দিয়া গেল! যে এ কাজটা করিল সে তার একান্তই অপরিচিত, অথচ এমন সব কথা যা অন্যের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, কেমন করিয়াই বা সে-সব কথা সে বলিয়া গেল?

চার

 দিনভোর ভাবিয়া ভাবিয়াও সুনীতি এই অপূর্ব্ব রহস্যের কোন সুমীমাংসা করিতে পারে নাই—যে সকল কথা এই অপরিচিত তরুণ তার মুখের উপর বলিয়া গেল—তার মধ্যের প্রায় সমস্তটাই তো মিথ্যা। কলেজে সে এর সঙ্গে কোনদিনও পড়ে নাই, কোন ডিবেটিং ক্লাবে যোগ সে কদাপি দেয় নাই, দিবার অবসর তার কোথায় যে দিবে, ইহাকে কোনদিন যে চোখে দেখিয়াছে, এমনও তার স্মরণ হইল না। অথচ এমন সব কথা এ চৌচাপটে বলিয়া গেল, যে-কথা বাহিরের কোন লোকেরই জানা কিছুতেই সম্ভব নয়। তবে কি সত্যসত্যই এ যা’ বলিল সবই সত্য? অর্থাৎ তার মা-ই মিডিয়ামের মুখ দিয়া সত্যসত্যই স্বামীর সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে এতদিনে সম্মত হইয়া ইহাকে পাঠাইয়া দিয়াছেন? তিনি তো সবই দেখিতে পাইতেছেন, তবে উপায় দেখিতে পাইলে প্রতিবিধান না করিবেনই বা কেন? তার সমস্ত শরীর আনন্দে আশ্বাসে কৃতজ্ঞতায় রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল, দুটি চোখ দিয়া অজস্র ব্যথা-বিজড়িত আনন্দাশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, অভিমানে, আনন্দে সংমিশ্রিত গদগদ-কণ্ঠে অর্দ্ধস্ফুটস্বরে সে ক্রমাগত উচ্চারণ করিতে লাগিল—“মা! মা! ওমা, মা! মাগো! মা আমার! আমার মা! আমার মা!”

 এতদিনকার সমুদয় দুঃখ অভিমান যেন নিঃশেষ হইয়া সেই অশ্রুজলের সঙ্গে তার মনের মধ্য হইতে মার্জ্জিত ও ধৌত হইয়া যাইতে লাগিল। অপরাধের কুণ্ঠায় মরিয়া গিয়া মনে মনে ক্ষমা চাহিতে চাহিতে পুনঃপুনঃ বলিতে লাগিল, “কত অন্যায় কথা তোমার উদ্দেশ্যে আমি বলেছি মা! স্বার্থপর বলে কত অনুযোগই যে করেছি, সে-সব তুমি নির্ব্বোধ বলে আমায় ক্ষমা করবে ত? আমি তো স্ত্রী নই, মা নই, কেমন করে তাঁদের মনের কথা বুঝতে পারবো? আমার বাবা এত দুঃখ পাচ্চেন, শুধু তোমার তাঁকে বৎসরান্তে একটি দিনের দেখা দেওয়া,—না তাও নয়, একটুখানি লিখে জানানো মাত্র, এইটুকুও তুমি কেন পারবে না বল্লে,—এই ভেবে কত রাগ করেছি, কিন্তু তুমি তো চুপ করে থাকতে পারোনি,—এই তো সুযোগ পেতেই আপনি ছুটে এসেছ,—একজন অপরিচিতের কাছে—”

 “সুনীতি!”

 বজ্র নির্ঘোযের মত আহ্বান আসিল। সচকিত সুনীতি উঠিয়া দাঁড়াইয়া দেখিল রুদ্র মূর্ত্তিতে চন্দ্রকুমার অদ্ভুত মুখভঙ্গী করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন।

 সুনীতির দুইচক্ষে তখনও শতধারা বহিতেছিল—সে তাহা মুছিতেও ভুলিয়া গেল, হঠাৎ আবার এ হইল কি! খুবই খোস মেজাজে আজ তো চন্দ্রকুমার পরিপাটিরূপে স্নান আহার করিয়া সুখে নিদ্রা যাইতেছিলেন, ঘুম ভাঙ্গিয়া সহসা এ মূর্তি কেন?

 কেন তাহা চন্দ্রকুমারই, বলিলেন, চীৎকার শব্দে ধমক দিয়া উঠিলেন, “আজকের দিনে তোর চোখে জল কিসের জন্যে শুনি? মা আসছে ঘরে,—নিজেরই মা সে তোর, তোর সৎমাকে তো আর ঘরে আনছিনে, তবে আবাগের বেটী! তুই কাঁদিস্ কি জন্যে শুনি? কেন? কলের জলের মতন চোখের জলে সরকার ট্যাক্স বসায়নি বলে? আমায় যদি কর্পোরেশনের মেয়র করে আমি তাই করবো,—হ্যাঁ, দেখিস তোরা ছিঁচকাদুনীরা—! নিশ্চয় করবো ওই আইনটি, বাছাধনদের কাঁদার সুখটি বার করছি,—এই দেখো না।”

 এই কথা! সুনীতি হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল, মনে এক রকম আর মুখে আর এক রকমের হাসি আনিয়া উৎসাহ প্রকাশ করিয়া কহিয়া উঠিল, “আমি তো কাঁদিনি বাবা! মা আসবেন, তাই সব ঝাড়া-ঝুড়ি করছিলাম কি না, ধুলো না পোকা কি একটা চোখে পড়েছিল, তার জন্যে অত জল পড়ছে। এখন তুমি চলো দেখি, চা করে আনিগে, আজ তোমার চায়ের সঙ্গে একটু গরম হালুয়া করে দিই কেমন? আর নিমকী ভেজেও রেখেছি, আগে সেগুলি পেট ভরে খেয়ে নাও,হয়ত অনেক রাত হয়ে যাবে খেতে।”

 খাবারের রেকাব টানিয়া লইয়াই চন্দ্রকুমার ঈষৎ মুখ বিকৃত করিলেন, “এ কি করেছিস্! হালুয়াতে কর্পূর দাওনি তো! জানিসনে নাকি, এত বড় ধেড়ে মেয়ে তুই, তোর মা কি কি পছন্দ করতেন?”

 সহাস্যে সুনীতি উত্তর করিল, “খেয়ে দেখেই বলো, না খেয়েই রাগ করছো কেন? কেমন? দিইনি?”

 “দিয়েছিস,—কিন্তু চিনেবাদাম—”

 “চামচ দিয়ে আর একটু ভাঙ্গো,—মৌরি, ছোট এলাচ, কিসমিস, চিনেবাদাম সব দিয়েছি। ভাল হয়নি?”

 “হুঁঃ! এ তোকে আর করতে হয় না, তোর মা এসে নিজে হাতে করে দিয়ে গেছে! খেয়েই দেখ না কেন? তোর দ্বারা, উনি চলে যাবার পর একটি দিনও কি ঠিক এমনটি হয়েছিল?—তবে হ্যাঁ,—নিজের কোলে যদি ঝোল টানো, সে অবশ্য আলাদা কথা!”

 সুনীতি এই অবমাননাজনক বিদ্রূপে আজ একটুও আহত হইল না, যেন সে গভীর অন্ধকারের মধ্যে এতটুকু একটুখানি আলোর সন্ধানই পাইল, সাগ্রহ কণ্ঠে কহিয়া উঠিল, “ঠিক বলেছ বাবা! এ মায়েরই হাতের করণ! আর শোন, একটা কথা বলি, তুমি হয়ত বিশ্বাস না-ও করতে পারো, যখন আমি হালুয়া করবার জন্যে ষ্টোভে কড়া চাপালুম না, অমনি লক্ষ্মীবিলাস তেলের গন্ধ পেলুম, তুমি তো জানো, মা ও ছাড়া কক্ষনো অন্য কোন তেলই মাখতেন না!”

 চন্দ্র কুমার হা হা করিয়া উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন,—“মনে আবার নেই, খুব আছে। তোর মা-টি কি কম দুষ্টু ছিল! ওর যত সব পুরোণ-চালের জিনিষের পছন্দ! গোলাপ জল, কেওড়া, অতির, কর্পূর, জর্দ্দা খেতেন, সেও মৃগনাভী আর কেশর দেওয়া। বিলিতী এসেন্স নিজে তো মাখতেনই না, আমি কখন মেখে এলে নাকে কাপড় গুঁজে বলতেন, ‘এ মাঃ! ঘরের মধ্যে সাতটা ছুঁচো চরে গেল কখন! সোজা দুষ্টু ও!”

 শেবের মন্তব্যটুকু হাসির পরিবর্ত্তে কান্নার মতই শুনাইল। আঃ ভগবান! এত ভালবাসার বস্তুকে এমন করিয়া কেনই বা তুমি কাড়িয়া লও? একটুও কি কষ্ট হয় না তোমার একাজ করতে? অথচ ‘ভাগ্যিমানের বউ মরে’ বলিয়া একটা প্রবাদ কথাও তো এই বাংলা দেশেই বহুকাল ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে!

 সুনীতি চন্দ্রকুমারের ধুতি পাঞ্জাবী আনিয়া তাঁকে পরাইয়া দিল, ঘরকন্না যতদূর সম্ভব গোছগাছ করিয়া রাখিল, ফুল আর আজকাল তার টবের গাছগুলিতে ফোটে না, কতকগুলা যত্নের অভাবে মরিয়াই গিয়াছে। ঝিকে দিয়া মালা ও ফুল বাজার হইতে কিনিয়া আনাইল, তাহা দিয়া ফুলদানী সাজাই:ল, কিন্তু ফুলের তোড়ার জোগাড় করিতে পারিল না, তখন মায়ের হাতের তৈরী-করা পশমের ফুলগাছটি চিত্রিত একটি মাটির ছোট্ট টব হইতে তুলিয়া তাহা দিয়াই টেবিলের উপরিভাগ সাজাইয়া রাখিল।

 প্রসন্নচিত্তে ঘুরিয়া ঘুরিয়া চারিদিক দেখিতে দেখিতে সহসা চন্দ্রকুমারের মেয়ের দিকে চোখ পড়িতেই চট্‌কা-ভাঙ্গা হইয়া উঠিয়া পরুষকণ্ঠে চেঁচাইয়া উঠিলেন:

 “এর মানে? বলি, হ্যাঁগো! এর মানে? ওঁর চোখে আমায় খাটো করে দেওয়া, এই তো? এমন না হলে আর বিদুষী কন্যা! বেইমান! বেইমান! যার খাবে তারই কুচ্ছো গাইবে।”

 ভয়ে সুনীতি শুকাইয়া উঠিল, এত পরিশ্রমে এত যত্নে সে সারা দিনে যে সমস্ত আয়োজন করিয়া তুলিয়াছে, হয়ত বা এখনই এক বিরাট লঙ্কাকাণ্ডে সে সমস্তই উৎসন্ন হইয়া যাইবে। শুষ্ক মুখে বিপন্নভাবে নীরবে তাকাইয়া রহিল, মনের প্রশ্ন মুখে ফুটাইতে ভরসা করিল না। কি বলিতে কি হইবে—কোন ঠিকানা আছে কি তার! চন্দ্রকুমার একটু পরেই ঈযৎ সুর নরম করিয়া আপনাআপনিই বলিলেন:

 “এ রকম মূর্ত্তি কেন? বলবে কখন সাজ-সজ্জা করবো? এই তো?—তোমার মা বলতেন, ‘যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না?’ শোননি কখন সে কথাটা? ভুদেববাবুর পারিবারিক প্রবন্ধ পড়েই দেখ না, কি বলেছেন বাংলার সেই মহান্ শিক্ষাগুরু? বলেননি কি, ‘একসঙ্গে যিনি বিবি ও বাঁদী হতে পারেন, লক্ষ্মী-চরিত্র তিনিই আয়ত্ত করেছেন।’ যাও যাও, ভাল করে চুল টুল বেঁধে, ভাল দেখে জামা কাপড় পরে এসে গো। শীগ্‌গির যাও, খুব শীগ্‌গির ফিরে এসো কিন্তু, ওই নিয়ে সাতজন্ম লেগে থেকো না বুঝলে?”

 সুনীতির এতক্ষণে মনে পড়িল, সত্য সত্যই সে নিজের কথা সম্পূর্ণরূপেই ভুলিয়া গিয়াছিল, সারাদিন ধরিয়া ঘর-দোরের ঝুলঝাড়া হইতে রাঁধাবাড়া পর্য্যন্ত করিয়া যে মূর্ত্তি তার এখন হইয়াছে, এই বেশভূষার সঙ্গে ঐ টোকা’ মাথা ও ঝুলকালি মাখা হাত-মুখ যে কোন লোকের সাক্ষাতেই বাহির করার মতন নয়! চট্ করিয়া তার মনে পড়িয়া গেল, সকাল বেলার সেই শুভ-সন্দেশবাহী সুশ্রী চেহারার যুবকটিকে। তার সাক্ষাতে সকালে যা হইয়াছে সেই তো যথেষ্ট, এ মূর্ত্তি লইয়া আবারও সে বাহির হইতে চাহে না। জীবনের বিষম ঘুর্ণীপাকে পাক খাইতে খাইতে যদিও তার জীবনের মধ্যে একমাত্র বজ্র-বিদ্যুৎ-ভরা মেঘাচ্ছন্ন বর্ষা ঋতু ভিন্ন অন্য কাহারও প্রবেশ পথ ছিল না, কিন্তু কালের ধর্ম্ম তো আর কোনই বাধা মানে না,—পথ না পাইলেও সে যে অবসরের প্রতীক্ষায় পথপ্রান্তে অপেক্ষা করিয়া উন্মুখ হইয়া থাকে। সহৃদয় সেই তরুণকে তরুণী হইয়া অন্ততঃ নির্লিপ্ততার দ্বারা অবমাননা সে কোনমতেই তো করিতে পারে না।

 যখন সে সাজসজ্জা করিয়া ঘরে ঢুকিল, চন্দ্রকুমার একটু অগ্রসর হইয়া আসিয়া সপ্রশংস বিস্ময়ে তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে দেখিতে মৃদু মৃদু হাসিয়া এইটুকু মাত্র বলিলেন—

 “নাঃ, তোমার চেহারা যতটা খারাপ হয়ে গেছে মনে করি, ততটা হয়নি। অবশ্য সুকুমারী ঠিকই ধরে ফেলবে!”

পাঁচ

 সন্ধ্যার অল্প পরেই ট্যাক্সি হইতে নামিয়া দুটি লোক ঘরে আসিয়া ঢুকিল, দ্বারের কপাট তাদের জন্যে খোলাই ছিল। এতক্ষণ পর্য্যন্ত পিতা-পুত্রী উভয়েই প্রতীক্ষ্যমান হইয়া সংশয়াচ্ছন্ন চিত্তে পুনঃ পুনঃ দেওয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িটার কাঁটার দিকে চাহিতেছিলেন। বিলম্ব দেখিয়া ততোক্ষণে ভয়ে সুনীতির বুক ঢিপঢিপ করিতে আরম্ভ করিয়াছে, যদি তারা না আসে, তখন কি যে হইবে, সে কথা ভাবিতেও তার গায়ে কাঁটা দিয়া উঠে।

 যারা দুজন ঘরে ঢুকিল, তাদের মধ্যের একজন সেই সকাল বেলার ছেলেটি,—আর একজন? সুনীতি সবিস্ময়ে দেখিল, মাথায় মস্তবড় পিঙ্গলবর্ণ জটা, মুখে ছাইমাখা ঈষৎ পীতাভ শ্মশ্রু সংযুক্ত এক গেরুয়া আলখাল্লা-পরা সাধু।

 সাধুদের তো একে বয়স বুঝাই যায় না—তার উপর মুখে ভস্মমাখা, মাথার উপর চূড়াকারে বাঁধা কপিসবর্ণের সেই প্রকাণ্ড জটার ছায়ায় মুখটি অর্দ্ধাবগুণ্ঠিত। চন্দ্রকুমার ভক্তিভরে প্রণত হইতে যাইতেই সাধুজী ত্রস্তে বেশ খানিকটা পিছু হটিয়া গিয়া দুই কর সংযুক্ত করিলেন, গম্ভীর নিঃস্বনে উচ্চারণ করিলেন, “নারায়ণ। নারায়ণ!” তাঁর সাথী সসম্ভ্রমে চন্দ্রকুমারকে প্রণাম পূর্ব্বক কহিল, “ওঁরা যে সর্ব্বভূতে নারায়ণের অধিষ্ঠান দেখেন কি না,—প্রণাম তো কারু কাছেই ওঁরা নেন না, জ্যেঠামশাই! শুধু বলবেন, “নমো নারায়ণায়ঃ।” চন্দ্রকুমার প্রীত হইয়া ঐ কথাই বারে বারে উচ্চারণ করিলেন।

 পূজার ঘরে আসিয়া চক্রে বসা হইলে, সাধুর হাত দিয়া লেখা বাহির হইল,—“কি, ব্যাপার কি! এমন করে রাষ্ট্র-বিপ্লব করছো কেন? আমার সাধের পাতা সংসারটাকে একেবারে লণ্ডভণ্ড ছন্নছাড়া করে ছাড়বে নাকি ভেবেছ?”

 চন্দ্রকুমার ঈষৎ আগ্রহান্বিত হইলেও বিষম অপ্রতিভভাবে একটু আমতা আমতা করিয়া উত্তর দিলেন, “তুমি কেন আমায় ভুলে মোক্ষলাভে মন দিতে গেলে, আমি তোমার কাছে যাবার জন্যে পথ চেয়ে দিন গুনছিলুম, কেন আমার সে স্বপ্ন তুমি এক আঘাতে ভেঙ্গে চূর্ণ করে দিলে?”

 “হুঁ, স্বপ্ন ভাঙ্গলে শিশুরাই তো হাত-পা ছুঁড়ে ককিয়ে কেঁদে ওঠে। তুমিও যে তাদেরই মধ্যে একটি,—সে কথা আমার মনে ছিল না। যা হোক খুব প্রতিশোধটাই নিলে! মোক্ষ তো চুলোয় চলে গেছে, এই একটি বছর ধরে প্রত্যেক মানুষের মনের দোরে দোরে উঁকি পেড়ে পেড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, একমাত্র চিন্তা—কার দ্বারা মহারাজের দরবারে গিয়ে হাজির হই! অবশেষে এই মহাত্মার, এই সাক্ষাৎ মহাপুরুষের দর্শন লাভ করে তবেই এই দুস্তর পারাবার পার হয়ে চরিতার্থ হতে পেরেছি। এখন প্রভুর আজ্ঞা হোক দাসীকে কি করতে হবে?”

 চন্দ্রকুমার আনন্দে ও অভিমানে অবরুদ্ধপ্রায় সজলকণ্ঠে কোনমতে কহিলেন—“কেন তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে সুকুমারি?”

 চটপট উত্তর হইল, “আমি কি সখ করে মরেছি না কি যে ওই প্রশ্নই করো? আত্মহত্যা করলে বরং ওকথাটা বলতে পারতে, আমারই কি তোমাদের ছেড়ে আসবার খুবই সাধ ছিল নাকি! নিজের কর্ম্মফলে যার ভাগ্যে যা লেখা আছে, কার সাধ্য তাকে রদ করে? কিন্তু এও বলি, তাই বলে এতটাও আবার ভাল নয়! একদিন তো আবার তোমার আমার মিলন হবেই, অনর্থক ওসব কাণ্ড করে এইটি করছো যে, এর ফলে চকা-চকীর মতন চিরকাল ধরে দুজনে দুর্লঙ্ঘ বাধার দুদিকে থেকে যাব, কিছুতেই মিলতে পারবো না।”

 চন্দ্রকুমার হা হা করিয়া ছেলেমানুষের মত কাঁদিয়া উঠিলেন। এদিকে তাঁকে আত্মস্থ হইবার অবসর প্রদান করিয়া কাগজের পেনসিল চালনা বন্ধ হইয়া রহিল।

 তিনি কোঁচার খুঁট তুলিয়া যেই চোখ মুছিলেন, অমনি আবার লেখা হইল—“ছিঃ, কেঁদো না, আমার ওতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আমি আর এখানে থাকতেই পারছি না, যাই।”

 ব্যগ্র ব্যাকুলতার সঙ্গে চন্দ্রকুমার আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিলেন— “সুকু! না না, এই দেখ আমি শান্ত হচ্চি, আমায় তুমি এক্ষুণি ছেড়ে যেও না।”

 সুকুমারী লিখিলেন, “আমি আবার যাই কোন্ চুলোয়? যাবার কি তুমি আমার কোন উপায় রেখেছ? যখন থেকে তোমায় ভূতে পেয়েছে, রাতদিন তোমার সঙ্গে সঙ্গেই তো ঘুরছি। জানো না তো, মেয়েটাও সাতটা জন-মজুরের খাটুনি খেটে খেটে প্রাণে না মরে, সেদিকেও তো অনেকটা আমায় শক্তি দিতে হচ্ছে। দেখতে দেখতে কত কাহিলই যে আমি হয়ে গেছি। তুমি না পাও, এই স্বামীজী তো আমায় দেখতে পাচ্ছেন, উনিই বলুন না।”

স্বামীজী নীরবে ঈষৎ সম্মতিসূচক মাথা ঝুঁকাইলেন।

 চন্দ্রকুমারের বহুক্ষণ বাঙ্‌নিষ্পত্তি হইল না। অবশেষে ক্ষীণস্বরে কহিলেন, “আমায় তুমি ক্ষমা করো।” তারপর সহসা আরও গাঢ়কণ্ঠে কহিয়া উঠিলেন, “আমি আবার মানুষ হবো, শুধু তুমি আমায় মধ্যে মধ্যে এসে দেখা দিও, কথা কয়ো, আমায় ত্যাগ করো না।”

 “তা’ তো করবো, কিন্তু করবো কি করে?”

 এমনি করে?”

 “তাই বা কি করে হবে, বল? স্বামীজী তো আর আমার হুকুমের চাকর ন’ন, তিনি তোমার জন্যে অত ত্যাগ স্বীকার করবেনই বা কেন? জগতে তুমি নিজের মেয়ের জন্যে পর্য্যন্ত এতটুকু দয়ামায়া করোনি, খালি দুঃখই দিয়েছ, আর অন্য লোকে তোমায় মাথায় তুলে নাচবে?”

 সুনীতি এই সকল কাণ্ডকারখানা দেখিয়া অবাক্ অভিভূত হইয়া গিয়া হাঁটুর উপর চিবুক রাখিয়া অদৃশ্য হস্তের লেখার মধ্যে আত্মহারা হইয়া ডুবিয়া ছিল, এই কথায় ঈষৎ চঞ্চল হইয়া উঠিল, যদি বাবা এই কঠিন অনুযোগ শুনিয়া ফের ক্ষেপিয়া যান! মনে মনে সে মিনতি করিয়া কহিতে লাগিল, “না মা, ওমা! আমার জন্যে বাবাকে তুমি কিছু বলো না মা! ওঁর যে মাথা খারাপ, আগে কত তো ভালই বেসেছেন, দেখেছ ত’ সবই? এই রকম কি ছিলেন? কি করবেন, আমারই কপাল।”

 চন্দ্রকুমার একটুও কিন্তু চটিলেন না এবং আরও বেশী নরম শান্ত স্বরেই কহিলেন, “আজ থেকে আমি কারুকে কোন দুঃখ আর দেবো না, তুমি যে আজ আমার সকল দুঃখ মিটিয়ে দিয়েছ সুকু! এইবার বলো কি করলে আমি মাঝে মাঝে তোমায় কাছে পাবো?”

 “এর একটিমাত্র উপায় দেখতে পাচ্চি,—আর কিছুই তো কোন দিকে খুঁজে পাচ্চি না; কিন্তু—”

 “বলো, বলো, তুমি যা বলবে আমি তাই করবো, হ্যাঁ করতে বলবে, যা’ করতে বলবে,—এই তোমার দিব্বি করে বলছি”— চন্দ্রকুমার পেনসিল ছুঁইয়া আগ্রহে হাঁপাইতে লাগিলেন। সুকুমারী বলিলেন,—“দেখ, হঠাৎ কিছু না ভেবে-চিন্তেই একটা পাকা কথা দেওয়া সঙ্গত নয়, এসব তো ঠিক তোমাদের পৃথিবীর ব্যাপার নয়, মিথ্যে বলা, ধোঁকা দেওয়া এসব এখানে বাতিল।”

 “কি বলবে বলতো সুকু! তুমি কি আমায় যা’ তা কথাই বলবে? সে কি আমি জানি না? ভুলে গেছি তোমার চরিত্র?”

 চন্দ্রকুমারের বহুদিন হাস্যাভাষ-বিস্মৃত ওষ্ঠাধারে গভীর নির্ভর প্রেমের স্নিগ্ধ-হস্তরেখা বিভাষিত হইয়া উঠিল।

 “এই ডক্টর প্রফুল্লকান্তি গাঙ্গুলীর সঙ্গে সুনীতির বিয়ে দিলে তাঁর দীক্ষাগুরু হিসাবে স্বামীজি অপ্রকাশানন্দ তোমার আমার মধ্যে মাসে একটি দিন করে এমনি একটি মিলন-সেতু রচনা করতে নীতির অনুরোধে হয়ত সম্মত হলেও হতে পারেন, এই কথাই আমি বলতে চাইছিলাম। এই আর কি!”

 সুনীতির বুকের মধ্যে দড়াম্ করিয়া ধাক্কা দিয়া একটা যেন অবরুদ্ধ দ্বার খুলিয়া গেল। ডক্টর প্রফুল্ল গাঙ্গুলী পুনা মেণ্টাল হসপিটালের জার্ম্মাণী পাশ-করা বড় ডাক্তার। প্রফুল্ল গাঙ্গুলী তার সহপাঠিনী একমাত্র অন্তরঙ্গ-প্রিয়সখী স্বাহা, যাকে সে তার জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনা জানাইতে কোনদিন দ্বিধামাত্র বোধ করে নাই এবং সে তাদের পারিবারিক সমস্ত কথাগুলোই এবং সাইকীক্-রিসার্চ্চ-সোসাইটির লিখিত পত্রাবলী সমুদয়ই খুঁটিয়া খুঁটিয়া শুধু জানাই নয়, স্বচক্ষে পড়িয়াও দেখিয়াছে,— তাহারই সহোদর ভাই এই ডক্টর গাঙ্গুলী,—তবে কি, তবে কি—

 সাগ্রহে চন্দ্রকুমার প্রশ্ন করিলেন, “তাঁকে কোথায় পাবো রে সুকু?” সুকুমারী সম্ভবতঃ যথেষ্ট উপহাসের হাসিই তাঁদের অলক্ষ্যে হাসিয়া থাকিবেন, তবে সে হাসি দর্শন করিবার মত পুণ্যবল তো পিতা-পুত্রীর ছিল না, তাই সেটা হয়ত একা স্বামীজীই উপভোগ করিলেন।

 “ইনিই তো সেই ডাক্তার গাঙ্গুলী, যিনি স্বামীজীকে আজ এখানে নিয়ে এসেছেন। নৈলে আর আনলে কে? মস্তবড় ডাক্তার উনি, আবার মস্ত দার্শনিক, নৈলে কি আর স্বামীজী এতটা কৃপা করেন!”

 চন্দ্রকুমার গদগদ দৃষ্টিতে ডাক্তারকে সসম্ভ্রমে নিরীক্ষণ করিতে ছিলেন, সুকুমারী লিখিলেন, “কি গো! কি মতলব? অমত নেই তো তোমার?”

 হঠাৎ ডাক্তারকে দুহাতে বুকের কাছে সজোরে টানিয়া আনিয়া গভীর আনন্দের শ্বাসগ্রহণপূর্ব্বক চন্দ্রকুমার হাসিতে হাসিতে কহিতে লাগিলেন, “একটুও না—এক্কেবারে না, ওরে সুকু! এই আমি তোমায় পাকা কথাই দিয়ে দিলুম, এখন তুমি নিজে থেকে যা’ যা’ করবার সবখানি করিয়ে নিও, আর মাসে একটিবার মাত্র, আচ্ছা তাই সই, আমায় দেখা দিও। কেমন না?”