গল্পকল্প/ভীমগীতা
ভীমগীতা
প্রথম দিনের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সন্ধ্যাবেলায় কুরুপাণ্ডব বীরগণ নিজ নিজ শিবিরে ফিরে এসে স্নান ও জলযোগের পর বিশ্রাম করছেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর খাটিয়ায় শুয়ে আছেন, দু জন বামন সংবাহক তাঁর হাত পা টিপে দিচ্ছে। এমন সময় ভীমসেন এসে বললেন, বাসুদেব, ঘুমূলে নাকি?
কৃষ্ণ কুন্তীপুত্রদের মামাতো ভাই। তিনি অর্জুনের প্রায় সমবয়সী সেজন্য যুধিষ্ঠির আর ভীমকে সম্মান করেন। ভীমকে দেখে বিছানা থেকে উঠে বললেন, আসতে আজ্ঞা হ’ক মধ্যম পাণ্ডব। আপনি বিশ্রাম করলেন না?
ভীম বললেন, আমার বিশ্রামের দরকার হয় না। চার ঘটি মাধ্বকী পান করেছি, তাতেই ক্লান্তি দূর হয়েছে, এখনই আবার যুদ্ধে লেগে যেতে পারি। কৃষ্ণ, তোমার বিশ্রামের ব্যাঘাত করছি না তো?
কৃষ্ণ। না না, আপনি এই খট্বায় বসুন। সেবকের প্রতি কি আদেশ বলুন।
ভীম। তোমার কাছে কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।
কৃষ্ণ। চোকমল্ল তোকমল্ল, তোমরা এখন যেতে পার, আর আমার সেবার প্রয়োজন নেই। আর্য ভীমসেন, বলুন কি জানতে চান।
ভীম। হাঁ হে কেশব, আজ যুদ্ধের পূর্বে অর্জুনের কি হয়েছিল? তুমি তাকে কিসব বলছিলে? আমি দূরে ছিলুম, শুনতে পাই নি, শুধু দেখেছি—অর্জুন তার ধনুর্বাণ ফেলে দিয়ে কাঁদছিল, হাত জোড় করছিল, পাগলের মতন ফ্যালফ্যাল ক’রে তোমার দিকে তাকাচ্ছিল, আবার বার বার নমস্কার করছিল। ব্যাপার কি? যদি গোপনীয় না হয় তবে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত কর।
কৃষ্ণ। বিশেষ কিছুই নয়। কুরু-পাণ্ডব দু পক্ষেই গুরুজন বয়স্য ও স্নেহভাজন আত্মীয়গণ আছেন দেখে অর্জুন কৃপাবিষ্ট হয়েছিলেন। বলছিলেন, যুদ্ধ করবেন না।
ভীম। অর্জুনটা চিরকাল ওইরকম, মাঝে মাঝে তার ভাব উথলে ওঠে। কৃপাবিষ্ট হবার আর সময় পেলেন না। তা তুমি তাকে কি বললে?
কৃষ্ণ। বললাম, তুমি ক্ষত্রিয়, ধর্মযুদ্ধে করা তোমার অবশ্য কর্তব্য। তাতে লাভও আছে, যদি জয়ী হও তো পৃথিবীর রাজ্য ভোগ করবে, যদি মর তো সোজা স্বর্গে যাবে।
ভীম। একবারে খাঁটী কথা। তাতে অর্জনের আক্কেল হ’ল?
কৃষ্ণ। সহজে হয় নি। তাকে অনেক রকমে বুঝিয়ে বললাম, তুমি নিষ্কাম হয়ে কর্তব্য কর্ম কর, ফলাফল ভেবো না। তার পর তাকে কর্মযোগ জ্ঞানযোগ ভক্তিযোগ প্রভৃতিও বোঝালুম। অর্জুনের মোহ দূর করতে আমাকে প্রায় দুটি ঘণ্টা বকতে হয়েছিল।
ভীম। দুর্যোধনের দল আমাদের উপর কিরকম অত্যাচার করেছিল অর্জুন তা ভুলে গেছে নাকি? তুমি সব মনে করিয়ে দিয়েছিলে তো?
কৃষ্ণ। মনে করিয়ে দেবার কথা আমার মনেই পড়ে নি।
ভীম। বল কি হে মধুসূদন! ছেলেবেলায় আমাকে বিষ খাইয়ে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিল, জতুগৃহে আমাদের সকলকে পুড়িয়ে মারবার চেষ্টা করেছিল, এসব কথা অর্জুনকে বল নি?
কৃষ্ণ। কই, না।
ভীম। আশ্চর্য, এর মধ্যেই তোমার ভীমরতি হ’ল নাকি? পাশা খেলায় শকুনির জয়োচুরি, দুঃশাসনের হাতে পাঞ্চালীর নিগ্রহ, এসবও মনে করিয়ে দাও নি! উঃ, দুঃশাসনের নাম করলেই আমার রক্ত টগবগ ক’রে ফুটে ওঠে। আচ্ছা, আমাদের কথা না হয় ছেড়ে দিলে, কিন্তু তুমি যখন ধর্মরাজের দূত হয়ে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে কৌরবসভায় গিয়েছিলে তখন দুর্যোধন তোমাকে বন্দী করতে চেয়েছিল। তার পর সেদিন শকুনির ব্যাটা উলূক এসে দুর্যোধনের হয়ে তোমাকে যাচ্ছেতাই গালাগাল দিয়ে গেল, এও তুমি ভুলে গেছ নাকি?
কৃষ্ণ। কিছুই ভুলি নি। কিন্তু যুদ্ধের আগে এসব কথা অর্জুনকে বলবার প্রয়োজন দেখি না। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যখন পাঁচটি মাত্র গ্রাম চেয়েছিলেন তখন তো কৌরবদের সমস্ত অপরাধ মন থেকে মুছে ফেলেছিলেন। দুর্যোধন আমার প্রস্তাবে সম্মত হন নি, তাই আপনাদের মন্ত্রণাসভায় যুদ্ধে করা স্থির হয় এবং সেজন্যই আপনারা যুদ্ধ করছেন। কৌরবদের অপরাধ স্মরণ করা এখন নিরর্থক।
হাতে হাত ঘষে ভীম বললেন, কৃষ্ণ, তোমার শরীরে কি কোধ ব’লে কিছুই নেই?
কৃষ্ণ। আছে বই কি। মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি তখন মানুষের সব দোষই আছে।
ভীম। ক্রোধকে দোষ বলতে চাও! তুমি তো একজন মস্ত পণ্ডিত—আমাদের ছটি রিপু আছে জান? তাতে আমাদের কত উপকার হয় ভেবে দেখেছ?
কৃষ্ণ। রিপু তো দমন করাই উচিত।
ভীম। দমনের মানে কি লোপ? রিপুর লোপ হ’লে মানুষ পাথর হয়ে যায়, যেমন আমাদের ব্যাসদেবের পুত্র শুকদেব হয়েছেন। মেয়েরা তাঁকে গ্রাহ্য করে না, সামনেই স্নান করে।
কৃষ্ণ। প্রথম তিন রিপুর দমন এবং শেষ তিনটির লোপ করতে পারলেই মঙ্গল হয়।
ভীম। এইবারে তুমি কতকটা পথে এসেছ। মদ মোহ মাৎসর্য—এই তিনটে প্রবল হ’লে মানুষের বুদ্ধিনাশ হয়, একবারে লোপ পেলেও বোধ হয় বিশেষ কিছু ক্ষতি হয় না। কিন্তু প্রথম তিনটি না থাকলে বংশরক্ষা হয় না, আত্মরক্ষা হয় না, ধনাগম হয় না।
কৃষ্ণ। সাধু সাধু! ভীমসেন, আপনি অনেক চিন্তা করেছেন দেখছি।
ভীম খুশী হয়ে বললেন, ওহে জনার্দন, তুমি হয়তো মনে কর যে মধ্যম পাণ্ডব শুধুই একজন গোঁয়ারগোবিন্দ দুর্ধর্ষ বীর, যুদ্ধ আর ভোজন ছাড়া কিছুই জানে না। তা নয়, আমি দর্শনশাস্ত্রেরও একটু আধটু চর্চা করেছি। যদি চাওতো কিঞ্চিৎ তত্ত্বকথা শোনাতে পারি।
আগ্রহ দেখিয়ে কৃষ্ণ বললেন, অবশ্যই শুনব, আপনি অনুগ্রহ ক’রে বলুন।
ভীম। ছয় রিপুর মধ্যে প্রথম তিনটিই আবশ্যক, আবার সেই তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি, কাম আর ক্রোধ, না হলেই নয়। কামতত্ত্ব তোমাকে বোঝানো বাহুল্য মাত্র, লোকে বলে তোমার নাকি ষোল হাজার কারা সব আছেন—
কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, লোকে বলে আপনি নাকি প্রত্যহ ষোল হাজার লড্ডু ভোজন করেন। উড়ো কথায় কান দেবেন না। কামতত্ত্ব থাক, আপনি ক্রোধতত্ত্ব ব্যাখ্যা করুন।
ভীম। কোনও বিষয়ের বাড়াবাড়ি ভাল নয়। বেশী খেলে মেদবৃদ্ধি হয়, উদর স্ফীত হয়, যদ্ধের শক্তি ক’মে যায়। কিন্তু উপযুক্ত আহার না হ’লে জীবনরক্ষাও হয় না। অত্যধিক ক্রোধও ভাল নয়, তাতে হাত পা কাঁপে, লক্ষ্যভ্রংশ হয়, যুদ্ধে নিপুণতার হানি হয়। কিন্তু ক্রোধ বর্জন করলে আত্মরক্ষা ও স্বজনরক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
কৃষ্ণ। ক্রোধ ত্যাগ ক’রেও তো আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করা যায়।
ভীম। যেমন কাম ত্যাগ ক’রে বংশরক্ষা করা যায়! কৃষ্ণ, বাজে কথা ব’লো না।
কৃষ্ণ। অনেক যোগী তপস্বী আছেন যাঁদের ক্রোধ মোটেই নেই।
ভীম। তাঁদের কথা ছেড়ে দাও। তাঁদের স্বজন নেই, আত্মরক্ষারও দরকার হয় না। সকলেই জানে তাঁরা শাপ দিয়ে ভস্ম ক’রে ফেলতে পারেন, সেজন্য কেউ তাঁদের ঘাঁটায় না, তাঁরাও নির্বিবাদে অক্রোধী অহিংস হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু আমরা তপস্বী নই তাই দুর্যোধন শত্রুতা করতে সাহস করে। অন্যায়ের প্রতিকার এবং দুষ্টের দমনের জন্যই বিধাতা ক্রোধ সৃষ্টি করেছেন। একাদশ রুদ্র আমাদের দেহে অধিষ্ঠিত আছেন, দেহীর অপমান হ’লে তাঁরা রক্তে রৌদ্ররস সঞ্চার করেন, তার ফলে মানুষ উত্তেজিত হয়ে শত্রুকে আক্রমণ করে, কোনও রকম বিচারের দরকার হয় না। বুঝেতে পারলে?
কৃষ্ণ। আজ্ঞা হাঁ, বুঝেছি।
ভীম। যদি তৎক্ষণাৎ অপমানের শাস্তি দেওয়া কোনও কারণে অসম্ভব হয় তবে ক্রোধ মন্দীভূত হয়, প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি ক্ষীণ হয়ে আসে। এই কারণেই বীরগণ যুদ্ধের পূর্বে নিজের বিক্রম ঘোষণা ক’রে এবং শত্রুকে কটুবাক্য ব’লে ক্রোধ ঝালিয়ে নেন। শত্রুও অশ্রাব্য ভাষায় পালটা গালাগালি দেয়, তা শুনে রৌদ্ররসের পুনঃসঞ্চার হয়, উত্তেজনা আসে, প্রহারশক্তি বৃদ্ধি পায়।
কৃষ্ণ। কিন্তু জ্ঞানীদের উপদেশ —অক্রোধ দ্বারা ক্রোধকে জয় করবে।
ভীম। গোবিন্দ, তুমি নিতান্তই হাসালে। কংসকে মেরেছিলে কেন? জরাসন্ধকে মারবার জন্য আমাকে আর অর্জুনকে নিয়ে গিয়েছিলে কেন? রাজসূয় যজ্ঞের সভায় শিশুপালের মণ্ডুচ্ছেদ করেছিলে কেন? তোমার অক্রোধ কোথায় ছিল? আজ রণক্ষেত্রে অর্জুনের অক্রোধ দেখেও তাকে যুদ্ধে উৎসাহ দিলে কেন? কৃষ্ণ, তুমি নিজের মতিগতি বুঝতে পার না, পাত্রাপাত্রের ভেদও জান না। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি শোন। বিপক্ষ যদি সজ্জন হয়, তার শত্রুতা যদি ভ্রান্ত ধারণার জন্য হয়, তবেই অক্রোধ আর অহিংসা চলতে পারে। ভদ্র বিপক্ষ যদি দেখে যে অপর পক্ষ প্রতিহিংসার চেষ্টা করছে না, শুধু ধীরভাবে প্রতিবাদ করছে, তবে তার ক্রোধ শান্ত হয়ে আসে, সে ন্যায়-অন্যায় বিচারের সময় পায়, নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়। হয়তো মার্জনা চাইতে সে লজ্জাবোধ করে, কিন্তু অপর পক্ষ যদি উদারতা দেখায় তবে সহজেই শত্রুতার অবসান হয়। বিরাট রাজা—আহা বেচারার দুই ছেলে আজ মারা গেল—কঙ্কবেশী যুধিষ্ঠিরকে পাশা ছুড়ে মেরেছিলেন, রক্তপাত করেছিলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির রাগ দেখান নি। বিরাট ভদ্রলোক, সেজন্য যুধিষ্ঠিরের অক্লোধে ফল হ’ল, ব্যাপারটা সহজেই মিটে গেল। আর দুর্যোধনকে দেখ। তার সহস্র অপরাধ আমাদের ধর্মরাজ ক্ষমা করেছেন, দুরাত্মাকে সুযোধন ব’লে আদর করেছেন, কিন্তু তার ফল কিছুই হয় নি। কারণ, দুর্যোধন ভদ্র নয়, স্বভাবত দুর্বৃত্ত। তার ভাইরা, শকুনি মামা, আর উচ্ছিষ্টভোজী সূতপত্র কর্ণও সমান নরাধম। ধর্মরাজের সহিষ্ণুতার ফলে এদের আস্পর্ধা বেড়ে গেছে। এই সব দেখেও কি তুমি বলবে যে অক্রোধ দ্বারা ক্রোধ জয় করতে হবে?
কৃষ্ণ। ভীমসেন, আপনার যুক্তি যথার্থ। অক্রোধ দ্বারা সজ্জনকেই জয় করা যায়, কিন্তু দুর্জনকে জয় করবার জন্য ধর্মযুদ্ধ আবশ্যক। আপনারা সেই ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছেন। ধর্মযুদ্ধে ক্রোধ ও প্রতিশোধের প্রবৃত্তি বর্জনীয়। যদি যুদ্ধই কর্তব্য হয় তবে রাগম্বেষ ত্যাগ ক’রে করতে হবে। এই কারণেই দুর্যোধনের অপরাধের কথা অর্জুনকে মনে করিয়ে দেওয়া আবশ্যক মনে করি নি।
ভীম। প্রকাণ্ড ভুল করেছ। সোজা উপায় ছেড়ে দিয়ে বাঁকা পথে গেছ, ধান ভানতে শিবের গীত গেয়েছ, দু ঘণ্টা ধ’রে তত্ত্বকথা শুনিয়ে অতি কষ্টে অর্জুনকে যুদ্ধে নামাতে পেরেছ। যদি তাকে রাগিয়ে দিতে তবে তখনই কাজ হ’ত, কর্মযোগ জ্ঞানযোগ ভক্তিযোগ কিছুই দরকার হত না। এই আমাকে দেখ,—বিধাতা শাস্ত্রজ্ঞান বেশী দেন নি, কিন্তু আমার জঠরে যেমন অগ্নিদেব আছেন তেমনি গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে রূদ্রগণ নিরন্তর বিরাজ করছেন। কেউ যদি আমাকে অপমান করে তবে একাদশ রুদ্র ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার দেহে শত হস্তীর বল আসে, বাহু লৌহময় হয়, গদা তৎক্ষণাৎ শত্রুর প্রতি ধাবিত হয়, তত্ত্বকথা শোনবার দরকারই হয় না।
কৃষ্ণ। আপনার কথা সত্য। কিন্তু সকল মানুষের প্রকৃতি সমান নয়, আপনারা পাঁচ ভ্রাতা সকলেই ক্রোধপ্রবণ নন। আপনাকে যুদ্ধে উৎসাহ দেওয়া অনাবশ্যক, কিন্তু ধর্মরাজ আর অর্জুনের উপর রুদ্রগণের প্রভাব অল্প, সেজন্য মাঝে মাঝে তাঁদের তত্ত্বকথা শোনাতে হয়। আর একটি কথা আপনাকে নিবেদন করি। ক্লোধে ক্ষিপ্ত হওয়া কি ভাল? পরিণাম না ভেবে প্রবল শত্রুকে আক্রমণ করলে অনেক সময় নিজের ও আত্মীয়বর্গের সর্বনাশ হয়।
ভীম। জন কয়েকের সর্বনাশ হ’লই বা। সাপের মাথায় পা দিলে সাপ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই ছোবল মারে। তার পর হয়তো সে লাঠির আঘাতে মরে, কিন্তু তার জাতির খ্যাতি বেড়ে যায়। লোকে বলে, সর্পজাতি অতি ভয়ানক, সাবধান, ঘাঁটিও না। বাঘ যখন বাছুরকে ধরে তখন গরু, প্রাণের মায়া করে না, ক্রোধের বশে শত্রুকে শৃঙ্গাঘাত করে। এজন্য সকলেই শৃঙ্গীকে সম্মান করে। যে লোক পরিণাম না ভেবে ক্রোধের বশে শত্রুকে আঘাত করে, সে হঠকারিতার ফলে নিজে মরতে পারে, তার আত্মীয়রাও মরতে পারে, কিন্তু তার স্বজাতির খ্যাতি ও প্রতাপ বেড়ে যায়। হৃষীকেশ, ক্রোধ বিধিদত্ত মনোবৃত্তি, নামে রিপু হলেও মিত্র, তার নিন্দা ক’রো না। ক্রোধের প্রভাবে আমি কি দারুণ কর্ম করব তা দেখতে পাবে। ধৃতরাষ্ট্রকে নির্বংশ করব, দুঃশাসনের রক্তপান করব, দূর্যোধনের ঊরু, চূর্ণ করব। আমার কীর্তি হবে কি অকীর্তি হবে তা গ্রাহ্য করি না; কিন্তু লোকে চিরকাল বলবে, হাঁ, ভীম একটা পুরুষ ছিল বটে, অত্যাচার সইত না, দুরাত্মাদের শাস্তি দিতে জানত।
কৃষ্ণ। বৃকোদর, আপনার মনস্কাম পূর্ণ হবে। আপনি যা বললেন তাও তত্ত্বকথা। কিন্তু কোনও বিধানই সর্বত্র খাটে না। অত্যাচারিত হলে যে রাগ করে না, প্রতিকারও করে না, সে অক্রোধী কিন্তু কাপুরুষ, অমানুষ, জীবনধারণের অযোগ্য। যে ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হয়ে পাপ ক’রে ফেলে, সে হঠকারী দুষ্কর্মা, কিন্তু তার পৌরুষ আছে। যে ক্রোধের বশে ধর্মাধর্মের জ্ঞান হারায় না এবং অন্যায়ের যথোচিত প্রতিকার করে, সেই শ্রেষ্ঠ পুরুষ।
ভীম সহাস্যে বললেন, যদুনন্দন, আমি কাপুরুষ অমানষে নই, ধর্মভীরু পুরুষশ্রেষ্ঠও নই, আমি মধ্যম পাণ্ডব, সকল বিষয়েই মধ্যম। আচ্ছা, এখন যাচ্ছি, তুমি বিশ্রাম কর।
কৃষ্ণ নমস্কার করে বললেন, ভীমসেন, আপনি বীরাগ্রগণ্য পুরুষশার্দূল। আপনার জয় হ’ক।
কৃষ্ণের দুই পরিচারক চোক্কমল্ল আর তোকমল্ল আড়ি পেতে সব শুনছিল। ভীম চ’লে গেলে তোক্ক বললে, দাদা, কার কথা ঠিক, শ্রীকৃষ্ণের না শ্রীভীমের?
চোক্ক বললে, ওসব বড় বড় লোকের বড় বড় কথা, তোর আমার মতন বেঁটেদের জন্য নয়। ক্রোধ অক্রোধ ধর্মযুদ্ধ সবই আমাদের নাগালের বাইরে। দুর্বলের মাত্র উপায় জোট বাঁধা। বোলতার ঝাঁক বাঘ-সিংগিকেও জব্দ করতে পারে।
১৩৫৭