গল্পের বই/মালতী পারুল

উইকিসংকলন থেকে

মালতী পারুল।

 বনের ধারে, ছােট্ট কুঁড়ে ঘরখানিতে মালতী আর পারুলের বাড়ী। বাড়ীতে শুধু তাদের বুড়ী মা আছেন। আর কেউ নেই। মালতী পারুল দুটি বােন বড় লক্ষ্মী। তাদের ঘরের সাম্‌নে একটি মালতী ফুলের গাছ আর একটি পারুল ফুলের গাছ। তাই তাদের মা তাদের নাম রেখেছেন মালতী আর পারুল। মালতী ঠাণ্ডা মেয়ে, সে ঘরের কাজ কর্‌তে ভালবাসে। পারুলের মুখখানি পারুল ফুলের মত টুকটুকে, সে দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করে। সকালে তারা বাড়ীর কাজ করে। দুপুরে দুই বােনে হাত ধরাধরি করে বনে যায়। সেখানে তারা কাঠ কুড়োয়, তার পর দুজনে ফুল তােলে, খেলা করে, সন্ধ্যা হলে বাড়ী ফিরে আসে।

 বনে তাদের খেলার সাথী অনেক। যত হরিণ যত ময়ুর আর যত রকম পাখী সকলেই মালতী পারুলকে চেনে। কেউ তাদের ভয় করে না। হরিণ ছানাদের সঙ্গে ছুটোছুটি কর্‌তে ময়ুরের সঙ্গে নাচ্‌তে, আর, শাদা শাদা খরগােসের বাচ্চাগুলিকে আদর কর্‌তে দুই বােনেই খুব ভালবাসে। কিন্তু তারা সকলের চেয়ে ভালবাসে সন্ধ্যার সময় ঘরের কোণে বসে মার কাছে গল্প শুন্‌তে।

 একদিন সন্ধ্যার সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে তারা বসে গল্প শুন্‌ছে। বাইরে অন্ধকার, ঝড় বৃষ্টি। এমন সময় কে যেন দরজায় ধাক্কা দিল। তাদের মা বল্‌লেন, “যাওত মালতী, দেখত কে বুঝি দরজা ঠেল্‌ছে।” তারা মনে করল হয়ত কোনও গরীব লোক বনে কাঠ কাট্‌তে এসেছিল বৃষ্টির জন্য বাড়ী যেতে পারেনি। মালতী তাড়াতাড়ি দরজা খুল্‌তে গেল। যেই সে দরজা খুলেছে অমনি এক প্রকাণ্ড কাল ভাল্লুক থপ্‌ থপ্‌ করে এসে ঘরে ঢুকেছে। সর্ব্বনাশ! কি হবে? মালতীও ভয়ে চীৎকার করে ছুটে তার মার পিছনে গিয়ে লুকল, আর পারুল গিয়ে বিছানার নীচে ঢুক্‌ল। তার মাও আগে খুব ভয় পেয়েছিলেন, কিন্তু ভাল্লুকটা বল্‌ল, “তোমাদের কোন ভয় নেই, আমি তোমাদের কিছু বল্‌ব না। বাইরে বৃষ্টিতে ভিজে আমার বড় শীত কর্‌ছিল, তাই দরজা ঠেলছিলাম।” সত্যি সত্যিই বেচারীর সমস্ত লোম একেবারে ভিজে গিয়েছে আর সে শীতে ঠক্ ঠক্‌ করে কাঁপছে। তা দেখে মালতী আর পারুল তাড়াতাড়ি এসে গামছা দিয়ে তার গা মুছিয়ে দিল। তাতে ভাল্লুক খুব আরাম পেয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়্‌ল!

 সে রাত্রে সেই ঝড় বৃষ্টিতে ভাল্লুক আর কোথায় যাবে? সে তাদের ঘরেই শুয়ে রইল। পরদিন ভোর হ’তেই সে বনে চলে গেল।

 তারপর থেকে রোজ সন্ধ্যার সময় সেই ভাল্লুক তাদের বাড়ী আসে। ক্রমে মালতী পারুলের সঙ্গে তার খুব ভাব হয়ে গেল। তারা তার লোম ধ’রে টানে, কান ম’লে দেয়, পিঠের উপর চড়ে। সে তাদের কিছু বলে না।

গাছে বুড়োর দাড়ি আট্‌কেছে।
 তারপর শীতকাল চলে গিয়ে গরম প’ড়ে এল, তখন একদিন যাবার সময় ভাল্লুক বল্‌ল, “এখন কিছুদিন আমি আস্‌তে পার্‌ব না।” মালতী পারুল জিজ্ঞাসা কর্‌ল, “কেন, কোথায় যাবে?” ভাল্লুক বল্‌ল, “বনের ভিতর আমার বাড়ী পাহাড়া দিতে যাব। সেখানে আধহাত লম্বা মানুষ আছে, তাদের বামন বলে। শীতকালে তারা মাটীর নীচে তাদের গর্ত্তে‌র ভিতর লুকিয়ে থাকে। গরম পড়্‌লেই বেরিয়ে আসে, আর যেখানে যা পায় চুরি ক’রে নিয়ে পালিয়ে যায়।”

 ভালুক চলে যাচ্ছে ব’লে মালতী আর পারুলের বড় দুঃখ হ’ল। সন্ধ্যার সময় আর তারা কার সঙ্গে খেলা কর্‌বে? দরজা দিয়ে বার হবার সময় দরজার হুড়কোতে লেগে ভালুকের গায়ের খানিকটা ছাল উঠে গেল। মালতী যেন দেখ্‌তে পেল যে তার কাল চামড়ার নীচে সোণার মত কি ঝক্‌ ঝক্ কর্‌ছে; কিন্তু ভাল ক’রে দেখ্‌বার আগেই সে দৌড়ে পালিয়ে গেল।

 কিছুদিন পর, মালতী পারুল একদিন বনে কাঠ কুড়তে গিয়েছে। সেখানে কতগুলো কাটা গাছ প’ড়ে ছিল। মালতী পারুল দেখ্‌ল তারি একটার গোড়ায় একটা কি যেন লাফাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখে একটি ছোট্ট বুড়ো বামন! তার চামড়া সব কোঁচকান, চোখ দুটি লাল লাল, আর এই লম্বা পাকা দাড়ি! সেই দাড়ির আগাটা কেমন ক’রে গাছের নীচে চাপা প’ড়েছে। বেচারা তা’ধ’রে কত টানাটানি কর্‌ছে আর লাফাচ্ছে, কিছুতেই পার্‌ছে না। তাদের দেখে সেই বুড়ো চোখ রাঙ্গিয়ে বল্‌ল, “ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি কর্‌ছিস্? দেখছিস্‌ না? এসে ছাড়িয়ে দেনা?”

 মালতী পারুল দুজনে মিলে গাছটা ধরে কত ঠেল্‌ল, কিন্তু কিছুতেই সেটাকে নাড়াতে পার্‌ল না। তারা বল্‌ল, “যাই, আর কাউকে ডেকে আনি গিয়ে।” বামনটা তা শুনে ভারি চটে বল্‌ল, “আবার ডাক্‌তে যাবি কাকে? হাতীপানা দুটো মেয়ে এই টুকু কাজ কর্‌তে পারিস্‌ না! আর কোন রকমে আমার দাড়িটা ছাড়িয়ে দিতে পারিস্‌ না?”

 তখন মালতার মনে হ’ল, তার কাছে কাঁচি আছে। সে বল্‌ল, “আচ্ছা দাঁড়াও, আমি দিচ্ছি।” বলে সে সেই কাঁচি দিয়ে বুড়োর দাড়ি আগাটা কেটে দিল। ছাড়া পেয়েই বুড়ো তাড়াতাড়ি গাছের নীচ থেকে একটা থলি টেনে বার কর্‌ল। সেই থলি ভরা মোহর। থলিটা ঘাড়ে করে সে তখন সেখান থেকে চ’লে গেল। যাবার সময় বল্‌তে বল্‌তে গেল যে, “দুষ্টু মেয়েগুলো! আমার এমন সুন্দর শাদা ধব্‌ধবে দাড়ির কতটা কেটে ফেলেছে।”

 আবার কিছুদিন পরে একদিন মালতী আর পারুল নদীতে মাছ ধর্‌তে গিয়েছে। সেখানে একটা ভাল জায়গা বেছে নিয়ে তারা সবে বস্‌তে যাচ্ছে, এমন সময় দেখে, ওটা কি কাদার উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নদীতে নাম্‌ছে। তারা ভাব্‌ল ফড়িং। কিন্তু এত বড় ফড়িং ত তারা কখনো দেখেনি, তাই ছুট্টে সেটা ভাল করে দেখ্‌তে গেল। কাছে গিয়ে দেখে, ওমা! এত ফড়িং নয়! এ যে সেই বুড়ো বামন! বুড়োকে দেখে তারা হেসে বল্ল, “কি বামন মশাই? কাদার মধ্যে লাফাচ্ছ কেন? নদীতে স্নান কর্‌তে যাচ্ছ বুঝি?” সে কথায় বুড়ো ভারি চটে চীৎকার ক’রে বল্‌ল, “আমি কি এমনি বোকা! দেখছিস্‌ না এই হতভাগা মাছটা আমায় নিয়ে যাচ্ছে?”

 বেচারী জলের ধারে বসে মাছ ধর্‌ছিল। এর মধ্যে কখন তার দাড়িটা ছিপের সুতোতে জড়িয়ে গেছে তা’সে বুঝ্‌তে পারেনি। কাজেই তারপর যখন এই বড় এক ফলুই মাছ বঁড়শীতে আট্‌কেছে তখন তার ভারি মুস্কিল লেগে গেছে। বুড়ো ছোট্ট মানুষ, অত বড় মাছটাকে সে কিছুতেই ধরে রাখ্‌তে পার্‌ছে না। আবার দাড়ি গেছে সুতর সঙ্গে জড়িয়ে, কাজেই ছাড়তেও পার্‌ছে না। মাছ তা’কে হিড়হিড় ক’রে টেনে জলে নিয়ে ফেলে আর কি! সে বেচারী খালি হাত পা ছুঁড়ছে আর দুপাশে ঘাস পাতা যা পাচ্ছে আঁকড়ে ধর্‌ছে। তখন মালতী আর পারুল দুজনে মিলে বুড়োর কোমরে ধ’রে তা’কে টেনে রাখ্‌ল। তার পর তার দাড়ি ছাড়াতে গেল। কিন্তু সে দাড়ি সূতোর সঙ্গে এমনি জড়িয়ে গেছে যে কিছুতেই তা’কে ছাড়ান যায় না। কাজেই আবার কাঁচি দিয়ে দাড়ির খানিকটা কেটে ফেল্‌তে হ’ল। আর অমনি বুড়ো ভয়ানক রেগে চীৎকার করে বল্‌ল, এ্যাঁ, এ্যাঁ, আবার আমার দাড়ি কাট্লি! তোদের মত দুষ্টু মেয়ে কোথাও দেখিনি। এখন আমি মুখ দেখাই কি ক’রে?” বলে সে ঘাসের ভেতর থেকে এই বড় এক থলিভরা মুক্ত বার কর্ল। তারপর সেই থলিটাকে টান্‌তে টান্‌তে নিয়ে চলে গেল। মালতী পারুলও তখন মাছ ধ’রে নিয়ে বাড়ী গেল।

 আরেকদিন তাদের মা তাদের বাজারে পাঠিয়েছেন। বাড়ী থেকে বাজার ঢের দুরে। সেখানে যেতে পথে এক জায়গায় বড় বড় পাথর। সেই খান দিয়ে মালতী আর পারুল যাচ্ছিল, আর সেই বুড়াে বামন তখন সেখানে বসে কি যেন কর্‌ছিল। এমন সময় এক চীল এসে বুড়ােকে ধরেছে,—আর ধর্‌বি ত ধর বুড়াের দাড়িতেই ধরেছে! মালতী আর পারুল দেখ্‌ল, যে বুড়ােকে ত নিয়েই যাবে; তাই তারা ছুটে এসে তা’র পা ধরে ফেল্‌ল। তখন চীল টান্‌ছে তার দাড়ি ধ’রে, তারা দু’ বােনে টান্‌ছে পা ধ’রে। সেই টানাটানিতে ফট্‌ করে বেচারার যে কয়টা দাড়, ছিল তাও ছিড়ে গেল, আর সে ধপাস্‌ করে মাটিতে প’ড়ে গেল। তাতে বুড়ো এমনি চট্‌ল যে তার মুখ দিয়ে কথাই বেরুল না। রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে একটা থ’লে কাঁধে তুলে নিল; তারপর সেই থলে নিয়ে একটা পাথরের নীচে এক গর্ত্তে গিয়ে ঢুক্‌ল। মালতী আর পারুল দেখ্‌ল যে সেই থলে ভরা মাণিক। তখন তারা বাজারে চ’লে গেল।

 বাজার থেকে তাদের ফির্‌তে রাত হয়ে গেল। ফিরে যাবার সময় যখন তারা আবার সেই পাথরগুলাের কাছে এসেছে, তখন বুড়ােও তার সেই মাণিকের থ’লে ঘাড়ে ক’রে আবার গর্ত্তের ভিতর থেকে বেরিয়েছে। সে ভাবেনি যে রাত্রেও আবার সেই পথে কেউ যাবে। তাই সে একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে নিয়ে থলে থেকে মাণিকগুলো সব মাটিতে ঢাল্‌ল। মাণিকগুলো ঝক্‌ ঝক্‌ কর্‌ছে; বুড়ো ভারি খুসী হয়ে দুই হাতে সে গুলোকে ঘাঁটছে, আর মালতী পারুল অবাক হয়ে তাই দেখ্‌ছে। এমন সময় বুড়োর চোখ তাদের উপর পড়্‌ল। অমনি রাগে তার মাথার চুল দাঁড়িয়ে উঠ্‌ল, আর সে চোখ মুখ লাল ক’রে দাত খিঁচিয়ে বল্ল, “ওখানে হাঁ করে দাড়িয়ে আছিস্‌ কেন? তোরা কি দেখ্‌ছিস?” এমন সময় একটা ভয়ানক শব্দ হ’ল, আর কোত্থেকে একটা ভাল্লুক এসে বুড়োর গালে এক চড় মার্‌ল। সে চড় খেয়ে বুড়ো ত মাথা ঘুরে মাটিতে প’ড়ে গেছে, আর মালতী পারুল ও প্রাণপণে সেখান থেকে ছুট দিয়েছে। কিন্তু তারা খানিক দূর না যেতে যেতেই শুন্‌ল যে ভাল্লুক তাদের পিছু পিছু ডাক্‌ছে, “মালতী পারুল যেও না। আমি যে তোমাদের বন্ধু।” তখন তারা বুঝ্‌ল যে এটি তাদের সেই চেনা ভাল্লুক। তাই তারা তাকে দেখ্‌বার জন্য ফিরে এল। কিন্তু ফিরে এসে আর তাকে দেখ্‌তে পেল না। তারা শুধু দেখ্‌ল যে একটা ভাল্লুকের চামড়া পড়ে আছে। তার উপর সোণার পোষাক পরা এক রাজার ছেলে দাঁড়িয়ে। সেই রাজার ছেলে তাদের বল্‌লেন যে, ঐ বুড়ো আমাকে ভাল্লুক বানিয়ে দিয়েছিল। ওর দাড়িতে সব যাদু থাক্‌ত। এখন দাড়ি ছিঁড়ে গিয়েছে, তাই আমিও ওর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি।”