গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড)

উইকিসংকলন থেকে
গোপীচন্দ্র


গোপীচন্দ্র

দ্বিতীয় খণ্ড



গোপীচন্দ্রের গান

উত্তর-বঙ্গে সংগৃহীত

২য় ভাগ

শ্রীবিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য্য

(গান সঙ্কলয়িতা)

শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন

এবং

শ্রীবসন্তরঞ্জন রায়

সম্পাদিত

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত

১৯২৪

PRINTED BY BHUPENDRALAL BANERJEE

AT THE CALCUTTA UNIVERSITY PRESS, SENATE HOUSE, CALCUTTA.

 Reg. No. 1052, August, 24.—250.


বিষয়-সূচী

 বিষয়
পৃষ্ঠা
গোপীচন্দ্রের গান
··· ···
১—৩১১
[“গোপীচন্দ্রের গান”
প্রথম খণ্ড দ্রষ্টব্য।]
৩১৩৩৯৪
৩৯৪৫০৩
টীকাটিপ্পনী—
৬১
৬২৯০
৯১১০১
১০২১৮৭

মুখবন্ধ

 ১৮৭৮ খৃঃ অব্দে সার জর্জ গ্রীয়ারসন সাহেব সর্ব্ব প্রথম “ময়নামতীর” এক পালা গান সংগ্রহ করিয়া এসিয়াটিক সোসাইটির জারনেলে প্রকাশিত করেন। ১৮৯৬ খৃঃ অব্দে “বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য” পুস্তকে আমি এই গানের কতকটা উদ্ধৃত করিয়া তৎসম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছিলাম। আজ প্রায় ১৬।১৭ বৎসর হইল শ্রীযুক্ত বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য্য মহাশয় রংপুর নীলফামারির সবডিভিসনাল আফিসরের পদে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া “ময়নামতীর গানের” আর একটি পাঠ সংগ্রহ করেন;—১৩১৫ বাং সনের “সাহিত্যপরিষৎ পত্রিকায়” উহার পরিচয় প্রকাশিত হয়। ভবানী দাস নামক কবি “গোপীচাঁদের পাঁচালী” নামে ময়নামতীর গানেরই বিষয় লইয়া অনুমান দুই শত বৎসর পূর্ব্বে একখানি কাব্য রচনা করেন। চারিখানি প্রাচীন পুথির পাঠ মিলাইয়া শ্রীযুক্ত আব্দুল করিম সাহেব চাটগাঁ হইতে এই ভবানী দাস বিরচিত “গোপীচাঁদের গানের একখানি খসড়া তৈরী করিয়া তাহা প্রকাশ করিবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদান করিয়াছিলেন। বর্তমান সংস্করণে শ্রীযুক্ত বসন্তরঞ্জন রায় মহাশয় মুন্সী সাহেবের পাঠ হইতে বহুল পরিমাণে সাহায্য গ্রহণ করিয়াছেন। দুর্লভমল্লিক নামক জনৈক কবি ময়নামতী সম্বন্ধে সম্ভবত সপ্তদশ শতাব্দিতে একটি গান রচনা করিয়াছিলেন, এবং প্রায় দুইশত বৎসর হইল সিন্দুর-কুসুমীগ্রামনিবাসী সুকুর মামুদ নামক আর এক কবি “যোগীর পুথি” নামে এই ময়নামতী-গোপীচন্দ্র সংক্রান্ত আর একটি সুবিস্তৃত গান রচনা করেন। মদ্‌রচিত “বঙ্গসাহিত্য পরিচয়ে” এই সকল পুস্তকের কোন কোনটি হইতে রচনার নমুনা উদ্ধৃত করা হইয়াছে। শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী ও শ্রীযুক্ত শিবচন্দ্র শীল ময়নামতীর প্রাচীন গানের নূতন সংস্করণ প্রকাশ করিয়াছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এ ক্লাসে “ময়নামতীর গান" পাঠ্য হওয়াতে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এই গান গুলির প্রতি বিশেষরূপে আকৃষ্ট হইয়াছে।

 হিন্দু এবং মুসলমান কবি ও শ্রোতারা প্রায় সাত শত বৎসর যাবৎ এই গোপীচন্দ্রের গান বাঙ্গলা দেশে রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন। এই গানের প্রভাব এক সময় এত বেশী ছিল যে আসমুদ্র হিমাচল পর্য্যন্ত এই মহাপ্রদেশের লোকবৃন্দ বঙ্গের রাজা গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস কাহিনী শুনিয়া করুণ রসে বিগলিত হইতেন। ভাগলপুর, পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি প্রদেশগুলিতে এখনও গোপীচন্দ্রের গান শোনা যায়;—এখনও মহারাষ্ট্র রঙ্গমঞ্চে গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস অভিনিত হয়,—এখনও উষ্ণীশধারী, গোপীযন্ত্র হস্তে শত শত উত্তর পশ্চিমের গায়ক “গোপীচন্দ্রের গান” গাইয়া জীবিকা অর্জ্জন করে। সেদিনও রাজ-চিত্রকর রবিবর্ম্মা “গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাসের” চিত্র আঁকিয়া বঙ্গাধিপকে ভারতবর্ষের সর্ব্বত্র পুনরায় সুপরিচিত করিয়া দিয়াছেন। উড়িষ্যা হইতে ময়নামতী গানের বিস্তৃত পুথি পাওয়া গিয়াছে। বঙ্গাধিপ গোবিন্দচন্দ্র সামান্য লোক ছিলেন না, যদিও গ্রাম্য কবিরা তাঁহাদের সংকীর্ণ ও অমার্জ্জিত কল্পনা দ্বারা ইহার অতুল ঐশ্বর্য্য আয়ত্ব করিতে না পারিয়া ইঁহাকে কেহ বা “বোল দণ্ডের” রাজা করিয়াছেন, কেহবা ইঁহার পৈত্রিক “সরুয়া নলের বেড়ার” প্রশংসা করিয়াছেন তথাপি ঐতিহাসিক গোবিন্দ চন্দ্র বা গোপীচন্দ্র যে ভারতবর্ষের একজন নৃপতি-শিরোমণি ছিলেন, তৎসম্বন্ধে সন্দেহ নাই। ত্রিপুরার ইতিহাস রাজমালা লেখক রাজা-ধন্যমাণিক্যের যে বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায় গৌড়াধিপ হুসেন সাহা বহুবার তাঁহার পাঠান সেনানায়কগণকে ত্রিপুর বিজয়ের অভিযানে পাঠাইয়াও ঐ রাজ্য দখল করিতে পারেন নাই, বারংবার পাঠানেরা ধন্যমাণিক্যের সেনাপতি চয়চাগের হস্তে পরাস্ত হইয়াছিলেন, এমন কি এক জন প্রধান পাঠান সেনাপতিকে চয়চাগ কালী মন্দিরে বলি দিয়া গৌরেশ্বরকে বিপর্য্যস্ত করিয়া ছিলেন। কিন্তু ছুটি খাঁ নামক পাঠান সেনাপতির স্তাবক-কবি শ্রীকরণ নন্দী তাহার মুরব্বির সম্বন্ধে লিখিয়াছিলেন:―

“ত্রিপুর নৃপতি যার ডরে এড়ে দেশ।
পর্ব্বত গহ্বরে গিয়া করিল প্রবেশ॥”

সর্ব্ব দেশের ইতিহাসেই জয়-পরাজয় লইয়া দুই পক্ষের এইরূপ সত্যবিরোধী বর্ণনা পাওয়া যায়। বঙ্গদেশ হইতে সুদূরে যাইয়া গোবিন্দ চোল স্বদেশে নিজ খ্যাতি বাড়াইবার উদ্দেশ্যে স্বীয় সভাকবির দ্বারা যদি বঙ্গজয় ঘোষণা করাইয়া থাকেন, তাহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কিছুই নাই। সুতরাং তিরুমলয়ের লিপিকারের উক্তি সম্বন্ধে আমরা আস্থাবান্ হইতে পারিতেছি না। বিশ্বেশ্বর বাবু, আমি এবং বসন্ত বাবু তিনজনে মিলিয়া গোপীচন্দের ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করিয়াছি―তাহার ফলাফল বিশ্বেশ্বর বাবু নিরপেক্ষ ভাবে তৎরচিত ভূমিকায় লিখিয়াছেন—নানারূপ গ্রাম্য সংস্কার, বিরুদ্ধ পাঠ ও ভ্রমপ্রমাদের মধ্য হইতে আমরা যে দুই একটি তথ্যকে ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গ্রহণ করিয়াছি, তন্মধ্যে প্রথমটি এই যে তিরুমলয়ের গোবিন্দ্রচন্দ্র এবং আমাদের এই গোবিন্দচন্দ্র বা গোপীচন্দ্র খুব সম্ভব এক ব্যক্তি। দ্বিতীয় কথাটি এই যে শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয় ধাড়িচন্দ্রকে টানিয়া বুনিয়া চন্দ্রবংশের জনৈক নৃপতির নামের সঙ্গে মিলাইবার জন্য উৎকট চেষ্টা করিয়াছেন, তাঁহার সেই সিদ্ধান্তের উপর আমরা কোনরূপ আস্থা স্থাপন করিতে পারিতেছি না। কিন্তু তথাপি মহারাষ্ট্র গীতে “ত্রৈলোক্যচন্দ্র” ও দুর্ল্লভ মল্লিকের গানে “সুবর্ণচন্দ্র”―তাম্রশাসনোক্ত চন্দ্রবংশের চারিজন রাজার মধ্যে এই দুই জনের নামের ঐক্য পাইয়া আমরা গোপীচন্দ্রকে বিক্রমপুরের শ্রীচন্দ্রদেবের বংশীয় বলিয়াই মনে করিতেছি। এই কথা ভট্টশালী মহাশয়ই প্রথম বলিয়াছেন, তজ্জন্য আমরা তাকে ধন্যবাদ দিতেছি। বংশলতাসম্বন্ধে গ্রাম্য গীতে গোলমাল থাকা কিছুই আশ্চর্য্যের বিষয় নহে, এমন কি সেদিনকার নিত্যানন্দ প্রভুর বংশাবলীতে তাঁহার পিতামহের নামের পূর্ব্বে যে সকল নাম তিনটি ভিন্ন স্থান হইতে পাওয়া যাইতেছে, তাহাদের কোনটিতে মিল নাই। তথাপি ভিন্ন ভিন্ন স্থান হইতে প্রাপ্ত অতি বিরুদ্ধ উপকরণের মধ্যেও চারিটি রাজার নামের মধ্যে যখন দুইজনের নামের মিল পাইতেছি, তখন আমরা গোপীচন্দ্রকে উক্ত চন্দ্রবংশীয় রাজা বলিয়া গ্রহণ করার পক্ষপাতী। নবদ্বীপের সুবর্ণ বিহার এই বংশের সুবর্ণচন্দ্র রাজার দ্বারা নির্ম্মিত হওয়াই সম্ভবপর। স্বর্গীয় মহামহোপাধ্যায় অজিতনাথ ন্যায়রত্ন মহাশয় সুবর্ণবিহারে একটা খোদিত ইষ্টক লিপির যে তারিখ পাইয়াছিলেন তাহাও এই সিদ্ধান্তেরই অনুকূল। চারিজনের মধ্যে এই যে দুই রাজার নামের মিল পাওয়া গেল, তাহাতে আমরা অনুমান করিতে পারি বহু দূরসময়াগত প্রাচীন সংস্কারকে নানা আবর্জ্জনা ও কল্পনা বিকৃত করিয়া দিলেও দেশবাসিগণ প্রাচীন স্মৃতির খেই একবারে হারাইয়া ফেলেন নাই। বিশ্বেশ্বর বাবু তাঁহার ভূমিকায় এটিও প্রমাণ করিয়াছেন যে গোপীচন্দ্রের অনেক কীর্ত্তি উত্তর বঙ্গে থাকিলেও ত্রিপুরা-মেহেরকুলেই তাহার রাজধানী ছিল।

 এই গ্রন্থের ভাষা সম্বন্ধে দুই একটি কথা লেখা দরকার। যদবধি গোবিন্দ্র চন্দ্র সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছেন, তদবধি এই গান চলিয়া আসিতেছে। কোন করূণ ঘটনার প্রথমোচ্ছ্বাসেই শোক সংগীত রচিত হইয়া থাকে। আজগবী কল্পনা অনেক সময় প্রথম হইতে সুরু হইয়া থাকে। এখনও বাঙ্গালী কয়েকজন সাধু ও মহাপুরুষ সম্বন্ধে তাঁহাদের জীবিতকালে বা মৃতুর অব্যবহিত পরে যে সকল জীবনী রচিত হইয়াছে, তাহাতে আজগবি কথার অন্ত নাই। সুতরাং আজগবী কথা সমসাময়িক হইতে পারে না, তাহা অনেক পরে লিখিত হয়—আমরা এ যুক্তির পক্ষপাতী নহি। রাজার জন্য প্রথম যে বেদনা গাথার আকারে প্রকাশিত হইয়াছিল, সেই বেদনাজাত কাব্য কথা এপর্য্যন্ত পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি হইয়া আসিতেছে। ইহা শুধু কাব্য নহে—ইহা গান, ইহা লেখা নহে—বাচনিক আবৃত্তি, সুতরাং ইহা যে গায়কের কণ্ঠে যুগে যুগে নূতন ভাষা পরিগ্রহ করিয়াছে তাহতে সন্দেহ নাই। তথাপি ইহা যে অতি প্রাচীন গানের অপেক্ষাকৃত নব সংস্করণ তাহাতে ভুল নাই। অনেক স্থলে প্রাচীন ভাষা পর্য্যন্ত অবিকৃত আছে, আর প্রায় সর্ব্বত্রই ইহাতে প্রাচীন সমাজ ও রীতিনীতির প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। দেব-বিগ্রহ যুগে যুগে নবকলেবর গ্রহণ করিলেও তাহাতে প্রাচীন আদর্শ অনেক সময় বজায় থাকে। এই গানও তদ্রূপ।

 কি কারণে তাহা বলা যায় না, খৃষ্টীয় একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে সমস্ত পৃথিবীময় তন্ত্র, মন্ত্র, পৈশাচিকী ক্ষমতা ও পুরোহিতগণের অদ্ভুত, অলৌকিক শক্তির প্রতি জনসাধারণের মধ্যে একটা অটল বিশ্বাস জন্মিয়াছিল। গ্যলদিগের ইতিহাসে ড্রুইড-পুরোহিতদের অদ্ভুৎ ক্ষমতার কথা লিপিবদ্ধ আছে। ড্রুইড-পুরোহিতগণ মন্ত্রবলে সমুদ্রের তিমি-তিমিঙ্গলকে ডাকিয়া ডাঙ্গায় আনিতে পারিতেন, তাঁহাদের আদেশে পর্ব্বতের মাথা হেঁট হইয়া যাইত, তাঁঁহারা অলৌকিক বুভুক্ষায় পীড়িত হইয়া অন্নকুট উদরস্থ করিয়া দুগ্ধের সবোবর পান করিতেন। এই সব গ্যালিক উপাখ্যানের সঙ্গে প্রায় তৎসময়ে বিরচিত “ময়নামতীর গান” পড়িলে উভয়ের সাদৃশ্য আশ্চর্য্যরূপে প্রতীয়মান হয়। হাড়িসিদ্ধার আদেশে ফলবন্ত বৃক্ষের শাখা নত হইয়া ফলের ডালি উপহার দিতেছে, হাড়ি সোণার খড়ম পায় দিয়া দরিয়া পার হইতেছেন, তাহার মুখের কথায় নদী-স্রোত বদ্ধ হইয়া যাইতেছে, স্বয়ং লক্ষ্মীঠাকুরাণী তাহাকে রাঁধিয়া খাওয়াইতেছেন[১]। ইহা ছাড়া আরও কত শত অদ্ভুত কাজ সে করিতেছে। গ্যালিক উপাখ্যানের গুইণবাচের পলায়নের চেষ্টা ও ময়নামতির হস্ত হইতে গোদা যমের উদ্ধারপ্রয়াস একরূপ। সেই উপাখ্যানে টুরিএন পুত্রগণেরও উক্তরূপ চেষ্টা বর্ণিত আছে। এই সাদৃশ্য এত স্পষ্ট—যে মনে হয় যেন পৃথিবীর দুই ভিন্ন প্রান্ত হইতে একই ভাবের গল্পরচকদ্বয় ডাকা ডাকি করিয়া কথা শুনাইতেছেন। “বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে” আমি এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছি[২]। গ্যালিক উপাখ্যানের পুরোহিতগণ “হাড়ে মাংসে জোড়া লাগুক”—বলিয়া মন্ত্র পড়িলে, খণ্ডখণ্ডকৃত মৃতদেহ জোড়া লাগিয়া পুনর্জীবিত হইত। আমাদের “ময়নামতী গানের” ন্যায় অনেক বাঙ্গলা কথাসাহিত্যে মন্ত্রের এইরূপ অদ্ভুত ক্ষমতার পরিচয় আছে। “গোপীচাঁদের পাঁচালীতে” এইরূপ মৃত দেহে জীবন সঞ্চারের কথা আছে (৩৭৪ পৃঃ)[৩]। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীর লৌকিক সাহিত্যে ডাইনী, পুরোহিত ও সিদ্ধাগণের এই অলৌকিক শক্তির কথা পৃথিবীর অনেক স্থলেই পরিদৃষ্ট হয়।

 “ময়নামতীর গান” যখন প্রথম বিরচিত হয়, তখন বঙ্গভাষার উপর সংস্কৃতের প্রভাব আদৌ পড়ে নাই। যদি কেহ মনে করেন, নিরক্ষর নিম্ন শ্রেণীর লোক যাহা রচনা করিয়াছে তাহাতে সংস্কৃতের প্রভাব থাকিবে কিরূপে? শুধু এই যুক্তি বলে “ময়নামতীর গানের” প্রাচীনত্ব নির্দ্ধারণ সমীচিন নহে।

 কিন্তু এই গান যে সংস্কৃত-প্রভাব চিহ্নিত যুগের পূর্ব্ববর্ত্তী তাহা অন্য প্রমাণাভাবে শুধু ভাষার প্রমাণেই স্থির করিতে পারা যাইত। সংস্কৃত যুগের নাপিত, ধোপা, মুচি, ডোম প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর বহু কবির রচনা পাওয়া গিয়াছে—তাহাদের লেখা সংস্কৃতের প্রভাব এড়ায় নাই। নিরক্ষর মূর্খ চাষীর রচিত গান পড়ুন—তাহার প্রমাণ পাইবেন। খুব উদ্ভট রকমের হইলেও সংস্কৃত উৎপ্রেক্ষা, উপমা ও যমক অলঙ্কারের বাহুল্য চাষীদের কাব্যেও পাওয়া যায়। সংস্কৃত যুগে লিখিত বঙ্গভাষাকে এতটা সংস্কৃতের অনুযায়ী গড়ন দিয়া তৈরী করা হইয়াছিল যে অশিক্ষিত কবিগণও সেই সংস্কৃত বহুল ভাষা ব্যবহার করিয়াছে। তিলফুলের সঙ্গে নাকের, গজগতির সঙ্গে পাদক্ষেপের, পক্ব বিম্বের সহিত অধরের উপমা চাষীরাও দিতে ছাড়ে নাই। কেষ্টামুচির গানেও বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ ও উপমার নৈপুণ্য দেখা যায়। “ময়নামতীর গান” পড়িলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে সংস্কৃত-যুগের বাঙ্গলা হইতে এই বাঙ্গলা ভিন্ন—ইহা পূর্ব্ববর্ত্তী যুগের প্রাকৃত-প্রধান বাঙ্গলা। এই ময়নামতীর গানের সঙ্গে গোরক্ষ-বিজয়, শূন্যপুরাণ, কতকগুলি প্রাচীন ব্রত-কথা, লক্ষ্মী ও সুষ্যের ছড়া, ডাক ও খনার বচন, ভাষা ও ভাব হিসাবে এক পংক্তিতে স্থান পাইবার যোগ্য। এই রচনাগুলিকে শুধু সময়ের পৌর্ব্বাপষ্য অনুসারে বিচার করা যুক্তিযুক্ত নহে। ফয়জুল্লা কিম্বা সুকুর মামুদের রচনা হয়ত দুই তিন শত বৎসরের অধিক প্রাচীন নহে। কিন্তু তথাপি তাহাদের রচনা সংস্কৃত পূর্ব্বযুগের অনুবর্ত্তী; তাহাদের ভাব, ভাষা ও গড়ণ সংস্কৃত যুগের নহে, তৎপূর্ব্ব যুগের। এখনও যেরূপ পাড়গেঁয়ে কবি গণেশ-বন্দনা মুখপাত করিয়া প্রহ্লাদ চরিত্র রচনা করিতে বসিয়া যায়—বঙ্কিম-রবীন্দ্র প্রতিভান্বিত বাঙ্গলার সে কোন ধার ধারে না, কাশীদাসের যুগই তাহার আদর্শ রহিয়াছে—যে পরিবর্ত্তন এই কয়েক শতাব্দী যাবৎ বাঙ্গলা ভাষার উপর খেলিয়া গিয়াছে, সেই গ্রাম্য কবি তাহার কোন খবরই রাখে না,—সেইরূপ এই ময়নামতী বা গোপীচন্দ্রের গান রচকগণের অনেকেই অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে জন্মিলেও তাহারা সেই প্রাচীন যুগের ভাব ও ভাষার আদর্শটা ধরিয়া বসিয়া আছে, সংস্কৃতের প্রভাব তাহারা অগ্রাহ্য করিয়াছে—পৌরাণিক হিন্দুধর্ম্মকে তাহারা গ্রহণ করে নাই, অথবা হিন্দু ধর্ম্মের নব উত্থান তাহাদের দোর পর্যন্ত পৌঁছায় নাই।

 সম্প্রতি যে ময়মনসিংহ গীতিকা গুলি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার আদর্শ ও সেই প্রাচীন যুগের। যদিও এই গীতিকাগুলি ৩।৪ শত বৎসরের ঊর্দ্ধকালের নহে, তথাপি ইহাদের ভাব ও ভাষা—সংস্কৃত-পূর্ব্ব যুগের।—ইহাদের রচনাকালে বঙ্গের নানা প্রদেশে ভাষার যুগ উল্টিয়া গিয়াছিল, “মুখরুচি কত শুচি”, “অগ্নি অংশু যেন প্রাংশু”, “বিলোলিত পতি আতিরসভাষে।”—প্রভৃতি সংস্কৃত শব্দের দীপ্তিতে যখন বঙ্গসাহিত্যের একদিক উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল, তখনও পূর্ব যুগের প্রভাব স্বীকার করিয়া এই গীতিকা লেখকগণ,

“গায়ের পাছে আন্ধ্যাপুকুর ঝড়ে জঙ্গলে ঘেরা।
চাইর দিকে কলাগাছ মান্দার গাছের বেড়া”॥

প্রভৃতি ভাষায় কবিতা লিখিতেছিলেন। ইঁহারা বঙ্গসাহিত্যের “পটো”,—এপর্য্যন্ত আর্টস্কুলের পড়ুয়াগণ পটোকে অগ্রাহ্য করিয়া আসিতেছিলেন। সম্প্রতি অবনীবাবুর চিত্রশালার নূতন চিত্রকরগণ যেমন “পটো” দিগকে খুঁজিতেছেন, আমরাও ভাষা-ক্ষেত্রে তেমনই এই হেলে চাষীদিগকে খুঁজিতেছি। বঙ্গভাষার এই সংস্কৃত পূর্ব্ব-যুগ, হেলে চাষী ও কামার কুমারের যুগ। আমরা কিন্তু ব্রাহ্মণ্য-যুগ অপেক্ষা এই হেলে চাষীর যুগের বেশী পক্ষপাতী।

 এই যুগে সাহিত্যের কয়েকটা লক্ষণ আছে, সেই পরীক্ষায় ফেলিয়া ইহাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সাহিত্যের সর্ব্বত্র এক ঘটনার পরে অপর এক ঘটনা বর্ণনা করিতে গেলে, “কোন্‌ কাম করিল” এই ছত্রটি থাকা চাই:—এই যুগের সমস্ত কাব্যে এই মুদ্র-দোষটি আছে। রূপবর্ণনা করিতে গেলে উপমা না দিয়া প্রায়ই জিনিষটা কেমন তাহা বুঝাইবার চেষ্টা আছে, “মেঘের বরণ কন্যার পায়েতে লুটায়” (মলুয়া)—মানে দীঘল চুল। এই সাহিত্যের অন্যতম শাখা গোপীচন্দ্রের গানে আছে—

“যেমন রূপ আছে রাজার পায়ের উপর।
তেমন রূপ নাই তোমার মুখের উপর”॥

রূপ-কথার একটিতে আছে,—

“আঝুরে ঘুমায় কন্যা আলু থালু বেশ।
সারাটি পালঙ্ক জুড়ি আছে কন্যার দীঘল মাথার কেশ॥”

সংস্কৃত-যুগে এই চুলের সমৃদ্ধি বুঝাইতে কালসর্প, “কলঙ্ক চাঁদার” প্রভৃতি

কত উৎপ্রেক্ষার ছড়াছড়ি পড়িত। তারপর,—কথা বলিবার একটা নির্দ্দিষ্ট ভঙ্গী এই সকল কবিতায় পাওয়া যায়, যদ্দ্বারা ইহাদের আদর্শের একত্ব প্রতিপাদিত হয়। কি গোরক্ষ বিজয়, কি ময়নামতীর গান, কি রূপ-কথা,—সর্ব্বত্র, “প্রদীপ নিবিলে তৈল দিয়া কি হইবে? জল চলিয়া গেলে আইল বাঁধিলে কি হইবে?—ইত্যাদি ধরণের আক্ষেপোক্তি আছে—অবশ্য সংস্কৃত উদ্ভট কবিতা খুঁজিলে “নির্ব্বাণ দীপে কিমু তৈল দানং” প্রভৃতি কথা পাওয়া যায়। কিন্তু আমার বিশ্বাস প্রাচীন বাঙ্গলা কবিতা হইতে এইরূপ সংস্কৃত উদ্ভট সৃষ্ট হইয়াছিল। তৃতীয়তঃ কোথায় গোপীচন্দ্রের গান আর কোথায় ময়মনসিংহ গীতিকা?—কিন্তু ইহারা দুই ভিন্ন জগতের কথা হইলে অনেক কথা ছত্রে ছত্রে মিলিয়া যায়—ময়মনসিংহ গীতিকার মলুয়ায় ৮০ পৃঃ (২১-২৬) পংক্তি ও আমাদের এই গোপীচন্দ্রের ৯৭ পৃঃ ৬৭৫-৭৬ পংক্তি মিলাইয়া পড়ুন। গোপীচন্দ্রের গানের সন্ন্যাস খণ্ডে ৫৫ পৃষ্ঠার সঙ্গে মনসার ভাসানে (বঙ্গসাহিত্য পরিচয়) ২৮৮ পৃষ্ঠার বর্ণনারও সেইরূপ বিশেষ ঐক্য দৃষ্ট হয়।[৪] তাহা ছাড়া এই যুগের প্রধান চিহ্ন ও যুগলক্ষণ এই যে এই কবিতা গুলির কোনটিই সংস্কৃত টোলের ধার ধারে না, ইহারা সহর বা নগরের সভ্যতাকে আমল দেয় নাই, ইহারা ভাষা-পল্লব দিয়া ভাবকে লুকাইবার ফন্দি জানেনা, যে কথার কাণাকড়ির মূল্য নাই তাহা গিল্টি করিয়া সাজাইয়া দেখাইবার চেষ্টা করে না—সাহিত্যের সভ্যতা-ভব্যতার ইহারা বড় ধার ধারে না,—জননী ও জন্মভূমি ইহাদিগকে যে ভাষা শিখাইয়াছে তাহা ছাড়িয়া দিয়া পুঁথি লিখিবার সময় অভিধানের বুলি আওড়ায় নাই—ইহারা যে ছবি আঁকে তাহা অতি স্পষ্ট, তাহা বাঙ্গলামায়ের ঘোমটা খুলিয়া তাঁহার স্নেহার্দ্র্য মুখ খানি দেখাইয়া প্রাণ জুড়াইয়া দেয়, পয়ার ও লাচাড়ি ছাড়া ইহারা আর কোন ছন্দের বড় খবর রাখে না। এইরূপ লক্ষণাক্রান্ত কবিতা গুলির শিরোভূষণ ময়মনসিংহের গীতিকা—জঙ্গলে ঢুকিয়া কাঠুরিয়া যেরূপ মাণিক পাইয়াছিল, আমার প্রাচীন সাহিত্যের জঙ্গলের মধ্যে তেমনই এই অমূল্য রত্ন কুড়াইয়া পাইয়াছি। বাঙ্গালার কুঁড়ে ঘরের যে কত দাম,—জগতের কোন রাজ-প্রাসাদের কাছে যে তাহা খাট নহে—এই গীত গুলি তাহা প্রমাণ করিবে।

 গোপীচন্দ্রের গান গুলি ততটা মার্জিত ও সুন্দর না হইলেও তাহা বঙ্গীয় কুটীর গুলির নিখুঁত ছবি আঁকিয়া দেখাইতেছে, তাহাতে সন্দেহ নাই—অন্ততঃ এই সকল গানের কথা মাঝে মাঝে এত স্পষ্ট, এত অন্তর-ছোঁয়া, যে আধুনিক কবিরা এত সংক্ষেপে ও এত জোর দিয়া একটা কথা বুঝাইতে পারেন কি না সন্দেহ, আমরা তাহার দুই একটি উদাহরণ দিতেছি—

 ১। রাজা গোপীচন্দ্র ও তাঁহার ভাই খেতুয়া যে এক মায়ের দুগ্ধ খাইয়া বড় হইয়াছে,—খেতুয়া হীন কাজ করে বলিয়া যে সে অশ্রদ্ধেয় নহে—রাজা তাহা রাণীকে বুঝাইতে যাইয়া বলিতেছেন,—

“এক থোবের বাঁশ রাণী নছিবেতে ল্যাখা।
কেও হয় ফুলের সাজি কেহ হাড়ির ঝ্যাঁটা॥”

 এক ঝাড়ের বাঁশ, তথাপি অদৃষ্ট গুণে কোনটাতে ফুলের সাজি তৈরী হয়, কোনটা দিয়া বা হাড়ি ঝাঁটা প্রস্তুত করে।

 ২। খেতুয়ার গর্ব্ব দেখিয়া এক নাপিত-প্রজা বলিতেছে,—

“ছোট লোকের ছাওয়া যদি বড় বিসই পায়।
টেড়িয়া করি পাগড়ি বাঁধে ছেঞার দিকে চায়॥”
“বাঁশের পাতার ন্যাকান ফ্যারফিরিয়া ব্যাড়ায়।”

ছোটলোকের ছেলে যদি হঠাৎ বড় বিষয়-সম্পত্তি প্রাপ্ত হয়, তবে পাগড়িটা তির্য্যক ভাবে রচনা করিয়া নিজের ছায়ার দিকে চাহিয়া দেখে কেমন দেখায়, এবং বংশ-পত্রের মতন ফর্ ফর্ করিয়া বেড়ায়।

 এইরূপ নানাবিধ গ্রাম্য কথায় বক্তব্য বিষয় গুলি এরূপ চোখা ও স্পষ্ট করিয়া বলা হয়াছে—যে আধুনিক ভাষাবিৎ তাহার সমস্ত শব্দ সম্পদ লইয়া ও তদপেক্ষা তীব্র ভাবে বক্তব্যটি পরের হৃদয়ঙ্গম করাইতে পারিবেন কিনা, সন্দেহ।

 এই সকল গাথায় প্রাচীন অনেক রীতি পদ্ধতির কথা জানা যায়। হিন্দুরাজত্বে যে প্রায়ই নরবলি দেওয়া হইত, তাহা শুধু গোপীচন্দ্রের গানে নহে, বঙ্গসাহিত্যের অন্যান্য স্থানেও দৃষ্ট হয়। ১৪৭৫ খৃষ্টাব্দে রচিত রাজমালা নামক ত্রিপুরার ইতিহাসে প্রায়ই এই নরবলির উল্লেখ দৃষ্ট হয়। ধন্য মাণিক্যের প্রধান সেনাপতি চয়চাগ যে হুসন সাহার জনৈক পাঠান সেনাপতিকে ত্রিপুরেশ্বরীর নিকট বলি দিয়াছিলেন, তাহা পূর্ব্বেই উল্লেখ করিয়াছি। মাণিকচন্দ্র রাজার মৃত্যু যে সকল অভিচার ক্রিয়ার ফলে ঘটয়াছিল বলিয়া কথিত আছে, রাজমালার কোন কোন স্থলে সেইরূপ অভিচার প্রক্রিয়ার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।

 প্রাচীন ব্রাহ্মণের দরবারের বেশ ভূষার একটা চিত্র এই গানে আছে, তাহার এখানে উল্লেখ না করিয়া পারিলাম না। ব্রাহ্মণ ননারূপ ধুতি পরিতেন, সেগুলির নাম—শালকিরাণি, চটক ও মটক। অবশ্য “মটক”টা আধুনিক “মটকা”র নামান্তর, এগুলি গরদের ধুতিরই প্রকার ভেদ হইবে। “শালবন পেটুকা”—কোমর বন্ধ, এবং “চল্লিশ পাগড়ি” অর্থ চল্লিশবার পাক দিয়া যে পাগড়ী বাঁধা হয়। তাঁহার এক হস্তে অঙ্গদ ও অপর হস্তে বলয় (কোড়া = কড়া) এবং কণ্ঠে স্বর্ণমালা। তিনি যাত্রাকালে জোড়া জোড়া পৈতা গলায় পরিতেন এবং কক্ষতলে একরাশ পাঁজিপুঁথি লইয়া চলিতেন। এ চিত্র বাঙ্গালী ব্রাহ্মণের হইলেও ইহা খোট্টার দেশের ব্রহ্মণ পণ্ডিতকেই বেশী মনে করাইয়া দেয়। হিন্দু-রাজত্বকালে রাজ-সভার পদ্ধতি রীতিনীতি ও বেশভূষা অনেকটা খোট্টার দেশের মতই ছিল, তবে ৪০টা বেড় দিয়া যে পাগড়ী তৈরী করিতে হয় তাহা এই উষ্ণদেশের লোকের মাথায় বেশী দিন টেকে নাই, প্রচুর ঘৃত-নবনী ও দুগ্ধপান করিয়া উদরে অতটা আঁটাআঁটি করিয়া কোমর বন্ধটা রাখাও সুবিধাজনক হয় নাই। পশ্চিমে বড় লোকের বামুনেরাও কোমরবন্ধটা ছাড়িয়া দিয়াছেন কিন্তু চল্লিশবেড় পাগড়িটি ছাড়েন নাই, তাঁহাদের স্বর্ণ বলয় ও অঙ্গদাদি পরিবার রাতিটা এখনও আছে। কেবল পৈতাটা দরবারী গোছের না হইয়া এখন অপরিহার্য্যরূপ অঙ্গীয় হইয়া উঠিয়াছে।

 মেয়েদের চুলের সৌষ্ঠবের কথা এই যুগের অনেক কাব্যেই পাওয়া যায়। ব্রহ্মদেশে ও উত্তরের পাহাড়ে দেশ যথা নেপাল, ভুটান প্রভৃতি স্থানে মেয়েদের চুল খুব ঘটা করিয়া বাঁধা হইত। এই কেশ-বন্ধন এককালে একটা উৎকৃষ্ট শিল্প ছিল। আজকালকার বঙ্গীয় চিত্রকরেরা মেয়েদের চুল-বাঁধাটার অনেক ব্যঙ্গচিত্র আঁকিয়া সংবাদপত্রে ছাপাইয়া থাকেন; কিন্তু বাঙ্গলা দেশ—এই চুল বাঁধার যে শিল্পটা হারাইয়াছে, তাহা এদেশের একটা বড় গৌরবের বিষয় ছিল। গোপীচন্দ্রের গানে চুল বাঁধিবার সেই শিল্পের প্রতি ইঙ্গিত আছে। গ্রাম্য কল্পনা এই শিল্পের বর্ণনা দিতে যাইয়া হয়ত অনেকখানি বর্বর কবিত্ব ঢুকাইয়া দিয়াছে; কিন্তু বাদ সাদ দিয়াও আমরা যে আভাষ পাই, তাহাতে মেয়েদের এই শিল্প যে একটা দর্শনীয় পদার্থ ছিল এবং ইহাতে অঙ্গনাদের কতটা ধৈর্য্যশীল মনোযোগ ও নিপুণতা প্রদর্শিত হইত, তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। সন্ন্যাস খণ্ডে ২৫৩।৫৪ পৃষ্ঠাতে এই চুল বাঁধিবার কথা আছে। হীরা নটী প্রথমত চিরুণী দিয়া চুল খুব ভাল করিয়া আঁচড়াইয়া লইল; কপাল তটে—সিঁথির গোড়ায় সে সারি সারি মুক্তা পংক্তি পরিল—সেই মুক্তার সারের নীচে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নয়টি তিলক রচনা করিল, তারপর—

 প্রথমতঃ “হাটে ট্যাংরা” নামক খোঁপা বাঁধিল, এই খোপার ভিতর যেন ছয় বুড়ি ছোট ছোট ছেলে খেলিতেছে—চুল বাঁধার কায়দায় এইরূপ দৃশ্য দেখা দিল; কিন্তু এ খোঁপা তাহার মনোনীত হইল না—আয়নার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সে খোঁপা ভাঙ্গিয়া ফেলিল এবং দ্বিতীয়বারে—

 “চ্যাং আর ব্যাং” নামক খোঁপা বাঁধিল। এই খোঁপা চুলের কায়দায় ঠিক ষোলখানি ঠ্যাং অর্থাৎ পা যেন (নায়কের দিকে) বাড়াইয়া দিল, কেহ কি জন্মিয়া এরূপ চুলের ঠ্যাং দেখিয়াছেন? কিন্তু আয়নার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া হীরার এ খোঁপাও পছন্দ হইল না, সে “চ্যাংব্যাং” খোঁপা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তৃতীয়বারে―

 “নাটি আর নটি” খোঁপা বাঁধিল, চুলের কায়দায় যেন ছয় বুড়ি পদাতিক সৈন্যের লাঠি খেলার দৃশ্য দেখা যাইতে লাগিল, কিন্তু এই লাঠিয়ালী খোঁপাও আয়নার দিকে চাহিয়া হীরা পছন্দ করিল না, সে তাহা এলাইয়া দিয়া চতুর্থবারে―

 “ভ্রমর গুঞ্জর” নামক এক অপূর্ব্ব খোঁপা বাঁধিল, এই খোঁপার তিনটি দ্বার, এক দ্বারে গায়ক গান করিতেছে, আর এক দ্বারে ব্রাহ্মণ তপস্যা করিতেছে এবং শেষ দ্বারে নর্ত্তক নাচিতেছে, প্রতিদ্বার নানা সুগন্ধি ফুলে সাজানো,―সন্ধ্যাকালে ভ্রমরের কলরবে একটা সুদৃশ্য প্রীতি-মুখরিত পুরার মত ইহা দেখাইতে লাগিল, এবার আয়নায় খোঁপা দেখিয়া হীরা খুসী হইল।

 বস্ত্রবয়ন কুশলতার নানারূপ কথা আছে। “বাঙ্গাল গাইয়া ভনি” নামক একরূপ বস্ত্রের উল্লেখ আছে (২৫৫ পৃঃ), ইহা খুব ভাল হইলেও এই শাড়ী হীরার পছন্দ হয় নাই, সে বান্দীকে ইহা বিলাইয়া দিয়াছিল―দ্বিতীয় শাড়ীর নাম “নিয়ব মেলানি” ইহার বয়ন এরূপ সূক্ষ্ম সূত্রের যে নিকটে মেলা (প্রসারিত) থাকিলেও রাতের বেলা এই শাড়ী দেখা যাইত না, কিন্তু দিনের বেলায় উহার কারুকার্য্য ও দীপ্তি জ্বলিয়া উঠিত। এই শাড়ী যখন হীরানটি পরিধান করিল, তখন “শাড়ি আর নটি গেইল মিলিয়া” অর্থাৎ নটি যে শাড়ী পরিয়াছে এরূপ বোঝা গেল না, উহা এত সূক্ষ্ম যে গায়ে মিলাইয়া গেল,―সুন্দরী বিবসনাবৎ প্রতীয়মান হইল। হায় সেই সূক্ষ্ম বয়নের দেশের কারিগরের সন্ততিরা খদ্দর দিয়া দেহের ভার দ্বিগুণ বাড়াইয়া “বাহবা” লইতেছেন!

 রাজ্য-শাসনে যে প্রজাদের কতকটা হাত ছিল, তাহা এই গানে এবং ময়নসিংহ গীতিকায় পাওয়া যায়। রাজা যখন অত্যাচারী, তখন প্রজারা নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া রহে নাই। মোড়লকে লইয়া পরামর্শ করিয়া তাহারা রাজাকে অভিচার দ্বারা বধ করিবার চেষ্টা পাইয়াছে। যখন রাজা গোবিন্দচন্দ্র “খেতু”র উপর শাসনভার ন্যস্ত করিয়া বনে যাইতে চাহিলেন, তখন খেতু ভয় পাইয়া রাজাকে বলিলেন, আপনি সহরে ঢেঁড়া দিয়া আমার প্রতিনিধিত্বের কথা প্রজাদিগকে জানাইয়া দিন―নতুবা তাহারা আমাকে মানিবে না, তদনুসারে ঢেঁড়া দেওয়া হইল, কিন্তু প্রজারা রাজার আদেশ অগ্রাহ্য করিল। “বান্দরিয়া রাইয়তের” মাথায় এই আদেশে “বজ্জর ভাঙ্গিয়া পৈল।” তাহারা এক বাক্যে বলিল “ওরে খেতুআ তোর আজাই মানি না”―(রে খেতু, তোর রাজত্ব আমরা স্বাকার করি না) “আমরা এই বার বৎসরের খাজনা মজুত রাখিব, রাজা ফিরিয়া আসিলে তাঁকে দিব, কিছুতেই তোমার শাসন মানিব না।” যখন খেতুয়া এই উক্তি শ্রবণ করিল, তখন―

“ষোল সের ছিল খেতু এক পোয়া হৈল।”

(খেতুর ওজন ষোল সের ছিল―সে এক পোয়া হইয়া গেল), অর্থাৎ সে এত বড়টা ছিল, এখন গৌরব হারাইয়া এতটুকু খানি হইয়া গেল।

 ময়মনসিংহ গীতিকাতেও প্রজাদের এই রূপ রাজ-শক্তির সঙ্গে বিরোধ মাঝে মাঝে দৃষ্ট হয়। কিন্তু ত্রিপুরার রাজমালা পাঠ করিলে এই প্রজা-শক্তি হিন্দু শাসন সময়ে যে কত বড় ছিল, তাহার ভুরি ভুরি নিদর্শন পাওয়া যায়। সেদেশে প্রজারা মাঝে মাঝে অত্যাচারী রাজার প্রাণদণ্ড পর্য্যন্ত করিয়াছে ও নূতন রাজাকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। রাজমালা একখানি বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস। কিন্তু যদিও গ্রাম্য কবিদের কল্পনাবিজড়িত হইয়া এই গানগুলি ইতিহাসের মর্য্যদা প্রাপ্ত হয় নাই, তথাপি সামাজিক ও রাজনৈতিক যে সকল আলেখ্য ইহাতে আছে―তাহাতে প্রাচীনকালের একটা প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে সন্দেহ নাই। প্রজাশক্তি যে হিন্দুরাজত্বে নিতান্ত উপেক্ষিণীয় ছিল না, বারংবার প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য হইতে আমরা তাহার নিদর্শন পাইতেছি।

 এই যুগে যে সকল নারী চরিত্র আমরা দেখিতে পাই, তাহাদের কেহ কেহ মহিলাগণের আদর্শ। রমণীরা যে ব্রাহ্মণ্য যুগের সতীত্বের আদর্শ মানিয়া চলিতেন, এমন বোধ হয় না। ময়মনসিংহ গীতিকায় দেখা যায় তাঁহারা প্রায়ই নিজের পতি নির্ব্বাচন করিতেন, সকল সময়েই যে তাহদের বিবাহ হইত, তাহা নহে। কঙ্কের ভালবাসার জন্য লীলা প্রাণ দিয়াছিল, অথচ তাহাদের পরিণয় হয় নাই। সখিনা ও ভেলুয়া সুন্দরী পিতামাতার বিরুদ্ধে নিজের মনোনয়নকে প্রধাণ্য দিয়া অপূর্ব্ব প্রেমের তপস্যা দেখাইয়াছে। শোনাই ও কমলা নিজেরা নিজের বর পছন্দ করিয়া লইয়াছিল―তাহারা বিবাহ বাসরে মন্ত্রপুঃত মিলনের প্রতীক্ষা রাখে নাই। রাজবাড়ীর প্রথা অনুসারে অদুনা অনায়াসে খেতুকে স্বামীর পদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইতে পারিত। ইহাদের সমাজে বিবাহ প্রথা একান্ত শিথিল ছিল। বিধবা বিবাহ প্রচলিত ছিল, রাজারা পর্য্যন্ত কন্যাদিগকে সময় সময় যৌতুক দিতেন, এবং দেবরেরা রাজ-বিয়োগে কি তাঁহার অনুপস্থিতিতে অনায়াসে রাণীদিগের কক্ষে যাতায়াত করিতেন। এই শিথিল সামাজিক প্রথার মধ্যে যে সকল মহিয়সী মহিলা একনিষ্ঠ প্রেমের দেবব্রত পালন করিয়াছেন, তঁহাদিগকে কি বলিব? যাহাকে সমাজ কড়াকড়ি করিয়া বিবাহ পীঠে বঁধে নাই, তাঁহারা একি অপূর্ব্ব বন্ধন স্বীকার করিয়া আত্মবলি দিয়াছেন; ইঁহারা দেখাইয়াছেন প্রেমের মত ধর্ম্ম নারীর আর নাই। স্বাধীনতা, মৈত্রী, আত্ম-নির্ভর প্রভৃতি যে কোন বড় বড় নীতি দেখাইয়া রমণীকে পুরুষ হইতে সরাইয়া লইয়া যাইতে চাও, তাহার কোনটিই রমণীকে সে গৌরব দিতে পরিবে না, যাহা প্রেম-সাধনা দ্বারা তিনি লাভ করিবেন। মলুয়া, মহুয়া, কমলা, শোনাই, মদিনা―আর তার পার্শ্বে এই অদুনা, ইঁহাদের প্রত্যেকে নারীকুলকে ধন্য করিয়াছেন। অবশ্য গোপীচন্দ্রের আর একশত স্ত্রী ছিলেন―তাঁহারা দেবর লইয়া ঘর করিয়াছিলেন―তাঁহাদিগকে স্বাধীনতা ও মৈত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়া তাঁহদের সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতি আপনারা সাধন করুন, কিন্তু অদুনা যেখানে আছেন তাঁহাকে সেই খানে থাকিতে দিন। এই সংসার সমুদ্রের দিশাহারা পান্থ,―পথভ্রষ্ট নাবিক যদি কোন আলোকস্তম্ভের উপর নির্ভর করিয়া পথ দেখিতে চায়, তবে অদুনা ও তাঁহার শ্রেণীরা সেইপথ দেখাইবেন। এই আলোকস্তম্ভ ভাঙ্গিলে দিশাহারা নাবিক অনির্দিষ্ট সমাজের অধ্রুব আদর্শের পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রেতলোকে পৌঁছিবে। দশটা লোক কুঠার লইয়া যাইয়া তাজমহলটি ভাঙ্গিয়া আসতে পারে, কিন্তু আর একটি গড়া সহজ নহে। এই নিরক্ষর কৃষকদের জড়িত ভাষা, প্রাকৃত শব্দ বহুল বাঙ্গলাকাব্য গুলিতে,―এই সর্ব্বপ্রকার অলঙ্কার লজ্জিত ছন্দোবন্ধ হীন অকুশলী রচনার মধ্যে আমরা অদুনার যে আলেখ্য পাইতেছি, তাহা এত দিন পরেও মলিন হয় নাই। সেকালের বাঁকমল ও মেঘ ডুম্বর শাড়ী পরিয়াছেন বলিয়া তিনি কোন অংশে বুট-পরিহিতা, গাউন বিলাসিনীদের কাছে মাথা হেঁট করিবেন না। তাঁহাকে আমরা ভগবতীর মন্দিরে তাঁহারই পাশে স্থান দিয়া পূজার অর্ঘ্য দিব। উনিশ বৎসরে রাজার মৃত্যু হইবে শুনিয়া অদুনা বলিতেছেন, তিনি যমকে পূজা করিয়া স্বামীর আয়ু বাড়াইয়া লইবেন, যমকে যে উপায়ে তিনি বশীভূত করিতে চাহিতেছেন তাহা সাবিত্রীর তপস্যা হইতেও বড় তপস্যা―

“নানা উপহারে আমরা যমকে পূজা দিব।
মস্তকের চুল কাটিয়া চামর ঢুলাইব।
জিহ্বা কাটিয়া আমরা সলতে পাকাইব।
পৃষ্ঠের চর্ম্মকাটি আমরা চাঁদোয়া টাঙ্গাইব।
দশ নখ কাটিয়া মোরা দশ বাতি দিব॥
পায়ের মালই কাটিয়া মোরা প্রদীপ জ্বালাব।
নানান পুষ্পজলে যমের সেবায় মানাব।
সেবায় মানিয়া আমরা স্বামী বর লিব।

ভারতবর্ষে রমণীর প্রেম কখনই উপন্যাসী অ্যামোদ-প্রমোদ নাহে―ইহা চিরকালই তপস্যা, আত্মোৎসর্গ ও সাধনা।

 উপসংহারে আমি অন্যতম সম্পাদকদ্বয়―বিশ্বেশ্বর বাবু ও বসন্ত বাবু সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলিব। মুন্সী আবদুল করিমের টীকা টিপন্নী সহিত প্রদত্ত গানটি যে আমাদের বিশেষ উপকারে লাগিয়াছে, তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। বিশ্বেশ্বর বাবু গোপীচন্দের গানের যে পাঠটি রংপুর নীলফামারি হইতে সংগ্রহ করিয়াছেন, তাহা অতি বিস্তৃত ও মূল্যবান। তিনি আজ ষোল সতের বৎসর যাবৎ একান্ত নিঃস্বার্থ ভাবে এই গানের জন্য খাটিয়াছেন―কোন পুরস্কারের আশা করেন নাই। তাঁহার এই মহার্ঘ-বহু-পরিশ্রমের ফল তিনি কোন প্রত্যাশা না রাখিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে দিয়াছেন। যে কল্পতরুমূলে বঙ্গভাষার সাধনা চলিতেছে সেই মহামান্য স্যার আশুতোষের পরিচালিত বিদ্যাপীঠে তিনি তাঁহার জীবনের এক তৃতীয় ভাগের যত্ন ও শ্রমের ফল অর্পণ করিয়া সন্তুষ্ট হইয়াছেন। তাঁহার এই মহাদানের জন্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হইতে তাঁহাকে কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি।

 বসন্ত রঞ্জন রায় মহাশয় আমাদের ঘরের লোক; তিনি এই গানের ভাষাতত্ত্ব লইয়া যতটা খাঁটীয়াছেন, তাহা আমাদের প্রাপ্য হইলেও আমরা তাঁহার প্রাণান্ত পরিশ্রমের গৌরব স্বীকার করিতে বাধ্য। আমি বঙ্গসাহিত্য পরিচয়ের একটা শব্দসূচী দিয়াছি, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কবিকঙ্কণের শব্দসূচী সঙ্কলন করিতেছেন, আমরা উভয়েই বিশ্ববিদ্যালয় হইতে সাহায্যকারী পণ্ডিত নিযুক্ত করাইয়া পরিশ্রমের ভার লাঘব করিয়া লইয়াছি; কিন্তু বসন্ত বাবু এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে ভাষাতত্ত্বের যে গুরুতর আলোচনা করিয়াছেন এবং ইহার যে বিরাট-শব্দসূচী প্রস্তুত করিয়াছেন, তাহা সমস্তই একক করিয়াছেন, তিনি পরিশ্রমী এবং লাজুক প্রকৃতির লোক সুতরাং প্রাণান্ত শ্রম স্বীকার করিয়াও বিশ্ববিদ্যালয় হইতে কোন পণ্ডিতের সাহায্য ভিক্ষা করেন নাই। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. ক্লাস পড়াইবার জন্য তাঁহার দ্বারা ইহার পূর্ব্বেই শব্দার্থের একটা সূচি প্রস্তুত ছিল, তাহা না হইলে অল্প সময়ের মধ্যে এতটা কাজ দেখাইতে পারিতেন না। কিন্তু শত শ্রম করিলেও প্রথম সংস্করণ সর্ব্ব বিষয়ে নিখুঁৎ হইতে পারে না। এই অক্লান্ত শ্রমের নিদর্শন শব্দ সূচীটিও যে একেবারে সম্পূর্ণ হইয়াছে তাহা বলা যায় না, দৃষ্টান্ত স্থলে বলা যাইতে পারে, গোপীচন্দ্রের ১৫৪ পৃষ্ঠায় যে “তিতি” শব্দটি আছে, তাহা বসন্ত বাবুর শব্দসূচী হইতে বাদ পড়িয়াছে। কিন্তু এসকল অতি ক্ষুদ্র অসম্পূর্ণতা ধর্ত্তব্যের মধ্যে নহে।

 শুকুর মামুদ প্রণীত যোগীর পুঁথি নামক এই গানের যে পাঠ মুদ্রিত হইল, তাহা রংপুরের প্রসিদ্ধ জমিদার শ্রীযুক্ত নলিনীমোহন রায় চৌধুরী মহাশয় আমাকে দিয়াছেন। যদিও মাত্র বাঙ্গলা ১৩১৯ সালে এই পুঁথি মুদ্রিত হইয়াছিল, তথাপি এখন ইহা একেবারে দুষ্প্রাপ্য হইয়া গিয়াছে। শুকুর মামুদ রাজসাহী জেলার রামপুর বেয়ালিয়ার ছয় মাইল উত্তর পূর্ব্বে স্থিত সিন্দুর কুসুমী গ্রামের অধিবাসী। এই পুঁথির প্রকাশক শ্রীযুক্ত মুন্সীগোলাম রছুল খোনকার। ঢাকা মিউজিয়াম হইতে শ্রীযুক্ত নলিনীক্ষান্ত ভট্টশালী মহাশয় এই দুর্ল্লভ পুঁথি প্রকাশ করিবেন বলিয়া আমাদিগকে লোভ দেখাইয়া রাখিয়াছেন, কিন্তু এপর্য্যন্ত তাহা প্রকাশ করিতে পারেন নাই। তিনি না ছাপাইলে যে এই পুঁথি আর লোকলোচনের বিষয়ীভূত হইবে তাহা হয়তঃ অনেকেরই মনে ছিল না, কিন্তু স্যর আশুতোষের আশীর্ব্বাদ ও কল্যাণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ইহার সটীক সংস্করণ প্রকাশ করিয়া ব্রাহ্মণের কার্য্য-ভার লঘু করিয়া দিলেন। আশা করি ইহাতে তিনি ক্ষুব্ধ না হইয়া বরঞ্চ আমাদের কার্য্যে প্রীতি প্রদর্শন করিবেন।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
১২ই মে, ১৯২৪

শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন

ভূমিকা

 গোপীচন্দ্রের গান স্মরণাতীত কাল হইতে রংপুর জেলায় প্রচলিত। গ্রীয়ার্সন সাহেব রাজকার্য্যোপলক্ষে রংপুরে অবস্থান-কালে উহা সংগ্রহ করেন গানের বিশেষত্ব এবং ১৮৭৮ খৃঃ অব্দে এসিয়াটিক সোসাইটির জার্ণালে “মাণিকচন্দ্র রাজার গান” নাম দিয়া প্রকাশ করেন। ইংরাজী জার্ণালে দেবনাগর অক্ষরে মুদ্রিত প্রাদেশিক গান সাধারণের নিকট বিশেষ পরিচয় লাভ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” প্রণয়ন কালে শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন উহা সাধারণের গোচরীভূত করেন এবং ইহার মৌলিকত্ব ও বিশেষত্বের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। দীনেশবাবু বলেন “এই গীতির ভাব বৌদ্ধ জগতের। অনেক স্থলেই বৌদ্ধগণের উপাস্য ধর্ম্মের উল্লেখ দৃষ্ট হয়।...মাণিকচাঁদের গান সলিলে সলিল-বিন্দুর ন্যায় প্রাচীন বঙ্গ-সাহিত্যের সঙ্গে মিশ্রিত হইয়া এক হইয়া যায় নাই, সলিলে তৈলবিন্দুর ন্যায় স্বতন্ত্র হইয়া পড়িয়া আছে। প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য খুঁজিলেই পক্ববিম্ব, দাড়িম্ব, কদম্ব, পদ্মপলাশ, খগরাজ, তিলফুল প্রভৃতি উপমার বস্তু দেখিতে পাই। গ্রাম্যগীতগুলিও এই উপমা হইতে মুক্ত নহে,......। কিন্তু মাণিকচাঁদের গীতের রূপবর্ণনায় বৃদ্ধ ব্যাস, বাল্মীকি কি কবি কালিদাসের কোন হাত নাই। সেগুলি সংস্কৃত প্রভাব শূন্য; এবং সংস্কৃতের প্রভাবের পূর্ব্ববর্ত্তী বলিয়া বোধ হয়।......স্থলে স্থলে দু’ এককথায় ছবিটি সুন্দর আঁকা হইয়াছে, রূপের একখানি প্রতিবিম্ব ভাসিয়া উঠিয়াছে, অথচ দাড়িম্ব-কদম্বাত্মক রূপবর্ণনা হইতে তাহা সম্পূর্ণ ভিন্ন।……স্ত্রীর বাক্যে পুত্র স্নেহময়ী মাতাকে উত্তপ্ত ৮০ মণ তৈলপূর্ণ সুবৃহৎ লৌহকটাহে নিক্ষেপ করিতেছেন এবং নয় দিন ধরিয়া অগ্নিকুণ্ডের উপর মাতৃদেহবিশিষ্ট উক্ত কটাহ সংস্থাপিত রাখিতেছেন। যে হিন্দুর গৃহে গৃহে রামায়ণী ও মহাভারতীয় নীতি, সেই হিন্দুর চক্ষে এই ঘটনা বিজাতীয়,—ইহা হিন্দু জগতের বলিয়া বোধ হয় না।” পুনশ্চ—“এই গীতে নানারূপ ভীষণ, অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক ঘটনার বর্ণনা আছে, তাহা আমরা আরব্যোপন্যাসের গল্পের ন্যায় পাঠ করিয়াছি। অনুবাদ-গ্রন্থগুলি ছাড়িয়া দিলেও কবিকঙ্কণ চণ্ডী হইতে ভারতের অন্নদামঙ্গল পর্য্যন্ত বাঙ্গালা কোন্ গ্রন্থে অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা নাই? সেই সব ঘটনা হইতে মাণিকচাঁদের গীতে বর্ণিত ঘটনা ভিন্নরূপ। সেগুলির পশ্চাতে দেবশক্তি, তাই সেগুলি হিন্দুর নিজস্ব বলিয়া পরিচিত, আর ইহার পশ্চাতে শুধু মন্ত্রশক্তি……। বৌদ্ধ জগতের এই সঙ্গীত বোধ হয় এতদিনে লুপ্ত হইয়া যাইত, কিন্তু প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিতে দেবদেবীর কথা সংযোজিত হওয়াতে ঐ গীতি ঈষৎ পরিমাণে হিন্দুত্বের আভা ধারণ করিয়াছে, এবং সেই হিন্দুত্বের আভাটুকুই বোধ হয় এই গানের পরমায়ু বৃদ্ধির কারণ।” গানটি বোধ হয় কোন কালেই সম্পূর্ণ বৌদ্ধজগতের ছিলনা, ইহা বহুকাল হিন্দুত্ব ও বৌদ্ধত্বের সংমিশ্রণে উৎপন্ন সম্প্রদায়-বিশেষের উপজীবিকা স্বরূপ হইয়া রহিয়াছে এবং ইহাই বোধ হয় গানটির পরমায়ু বৃদ্ধির প্রধান কারণ। যে সমাজে ইহা প্রচলিত সে সমাজ এখনও সংস্কৃত ও হিন্দুত্বের গণ্ডিদ্বারা আপনাকে প্রাচীনতর সমাজ হইতে সম্যক্‌রূপে স্বতন্ত্র করিতে পাবে নাই।

গাথা সংগ্রহ  এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত গান রংপুর জেলা হইতে সংগৃহীত। রংপুর জেলায় গোপীচন্দ্রের প্রাচীন গান কোথাও পুঁথিতে লিপিবদ্ধ আছে বলিয়া জানিতে পারি নাই। “যোগী” বা “জুগী” জাতীয় লোক মুখে মুখে ইহা অভ্যাস করে এবং আসরে বা ভিক্ষার সময় গোপীযন্ত্রের সাহায্যে নিজ নিজ শক্তি অনুসারে উহাদ্বারা শ্রোতার মনস্তুষ্টি জন্মাইবার চেষ্টা করে। লৌহ, বংশখণ্ড ও অলাবু দ্বারা এই গোপীযন্ত্র প্রস্তুত হয়। ভগিনী নিবেদিতা দীনেশ বাবুকে বলিয়াছিলেন, এই গোপীচন্দ্রের নাম হইতেই সম্ভবতঃ ‘গোপীযন্ত্রে’র নামকরণ হইয়াছে। বৃহৎ গানের সকল অংশ সকলে আয়ত্ত করিতে পারে না; সুতরাং গায়কের সামর্থ্য, রুচি ও প্রয়োজনানুসারে ভিন্ন ভিন্ন পালার সৃষ্টি হইয়াছে। কোথাও বা গানের কোন নির্দিষ্ট পরিচ্ছদ মাত্র গীত হয়, কোথাও বা শাখা প্রশাখা কর্ত্তন করিয়া মূল কাণ্ডটি স্থির রাখিয়া যথাসম্ভব একটি সম্পূর্ণ চিত্র উপস্থিত করার প্রয়াস দেখিতে পাওয়া যায়। গ্রীয়ার্সন সাহেবের সংগৃহীত গানটি শেষোক্ত শ্রেণীর, ইহা গোপীচন্দ্রের গানের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। বাবু শিবচন্দ্র শীল যে দুর্ল্লভ মল্লিক কৃত গোবিন্দচন্দ্রের গীত প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাও এই গানের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। শিব বাবু, চুঁচুড়াতে কোন বৈষ্ণবীর নিকট হইতে উহার পুঁথি প্রাপ্ত হন। দুর্ল্লভ মল্লিকের গোবিন্দচন্দ্র ও “যোগী” বা “জুগী” দিগের “গোপীচক্র” অভিন্ন ব্যক্তি। এরূপ হইতে পারে যে, নামটি বাস্তবিক গোপীচন্দ্র, গোবাচাঁদ, গোবাঁচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র সকল রকমেই উচ্চারিত হইত।

 দুর্ল্লভ মল্লিকের গান পুরাতন উপকরণের সাহায্যে নূতন ভাষায় রচিত, ইহাতে উপাখ্যান ভাগও কতকটা রূপান্তরিত হইয়াছে। গ্রীয়ার্সন সাহেবের সংগৃহীত গান, প্রক্ষিপ্ত অংশ বাদ দিলে, বাস্তবিকই প্রাচীন ভিত্তির উপর গ্রথিত, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বলিয়া মনে হয় না। বাস্তবিক মূল প্রাচীন গান কিরূপ ছিল, তাহা স্থির করা এখন বড়ই কঠিন। মুখে মুখে পুরুষপরম্পরায় চলিয়া আসায় গানের ভাষা অনেকস্থলেই পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছে এবং মূল গান যে অনেক স্থলে গ্রাম্য কবির হস্তযোজিত শাখাপল্লবে আবৃত হইয়া পুষ্ট কলেবরে পল্লীগ্রামের ভক্তি-পুষ্পাঞ্জলি গ্রহণ করিতেছে তাহা নিঃসন্দেহ।

 যোগিসম্প্রদায়ের লোক প্রায়ই নিরক্ষর। সম্পূর্ণ গাথা আবৃত্তি করিতে পারে এমন “যোগী” এখন দুর্ল্লভ। রংপুর জেলার ভিন্ন স্থানীয় দুইটি বৃদ্ধ যোগীর আবৃত্তি অনুসারে দুইটি সুবিস্তৃত পাঠ এবং অপর এক যোগীর নিকট হইতে একটি আংশিক পাঠ প্রায় ১৬/১৭ বৎসর পূর্ব্বে সংগ্রহ করা হয়, এবং ১৩১৫ সালে সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকায় উহার পরিচয় প্রকাশিত হয়।[৫] তাহার পর বাঙ্গালা দেশের কোন কোন স্থান হইতে গোপীচন্দ্রের গানের হস্তলিখিত বা মুদ্রিত পুঁথি আবিষ্কৃত হইয়াছে। তন্মধ্যে ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম জেলার সংগৃহীত ভবানীদাস-বিরচিত পুঁথি এবং উত্তর বঙ্গে সংগৃহীত মুসলমান কবি সুকুর মামুদের লিখিত পুস্তক বিশেষ উল্লেখ যোগ্য। ভবানীদাসের পুঁথি গোপীচন্দ্রের পাঁচালী নামে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে মুদ্রিত হইল। চট্টগ্রাম হইতে মুন্সী আব্দুল করিম চারিখানি পুঁথির সাহায্যে এই পাঁচালীর একটি পাঠ স্থির করিয়া পাঠান। উহার সঙ্গে উল্লিখিত পুঁথির একখানিও ছিল; ঐ পুঁথিকে আদর্শ করিয়া এবং মুন্সী সাহেব কৃত পাঠের সহিত মিলাইয়া অন্যতম সম্পাদক শ্রীযুক্ত বসন্তরঞ্জন রায় মহাশয় বিশেষ যত্ন পূর্ব্বক বর্ত্তমান পাঠ প্রস্তুত করিয়াছেন। সম্পাদকগণ এই অবসরে মুন্সী সাহেবকে তাঁহাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইতেছেন। মূলের নীচে আদর্শের বর্ণবিন্যাস ও পাঠান্তরাদি প্রদত্ত হইয়াছে। আদর্শ পুঁথি তুলট কাগজে উভয় পৃষ্ঠা লেখা: আকার ১৬×৫॥ ইঞ্চ্; আদ্যন্ত খণ্ডিত, পত্র সংখ্যা ২-২৪, প্রতি পৃষ্ঠায় ৯ পঙ্‌ক্তি; লিপিকর ‘শ্রীছৈঅদ ওারিশ মির’ বা ‘মের’ (পৃঃ ৬, ৮।২, ১১।২, ২২।২, ২৪।২): “হোক মালিক মন গাজী সাং পাণ্ডানগর” (পৃঃ ১২।২, ২৪।২)। ক পুঁথির মালিক “শ্রীহালাল গাজী ও তিতা গাজি পরগণে খামার ফুলতলি মৌজে কমলাপুর”; সম্ভবতঃ ১২৪২ বা ১২৪৪ সালের হস্তলিপি। খ পুঁথির লিপিকাল জানা যায় নাই। গ পুঁথি ১০।১২ বৎসরের প্রতিলিপি। শেষ তিন খানি পুঁথির লেখকও মুসলমান। চারি খানি পুঁথিই চট্টগ্রাম অঞ্চল হইতে সংগৃহীত।

 তৃতীয় খণ্ডে গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস নামে যে সুকুর মামুদ প্রণীত পুস্তক প্রকাশিত হইল, উহার এক মুদ্রিত সংস্করণ আমাদিগের হস্তগত হইয়াছে। অন্যতম সম্পাদক রায় বাহাদুর ডাঃ দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের চেষ্টায় এই দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগৃহীত হইয়াছে।

কাহিনীর ভারতময় ব্যাপ্তি  মাতা ময়নামতীর চেষ্টা ও উদ্যোগে হাড়িপা বা জলন্দরি গুরুর শিষ্যত্বে নবীন নৃপতি গোপীচন্দ্রের যোগী বা সন্ন্যাসী হইয়া গৃহত্যাগই এই সকল গাথার বর্ণনীয় বিষয়। গোপীচন্দ্র বাঙ্গালার রাজা ছিলেন। কিন্তু বাঙ্গালার বাহিরে ভারতের প্রায় সর্ব্বত্রই তাঁহার কাহিনী প্রচলিত। ৺ধর্ম্মানন্দ মহাভারতী মহাশয় তাঁহার “বঙ্গের ব্রাহ্মণ রাজবংশ” নামক পুস্তকে লিখিয়া গিয়াছেন ‘ভারতবর্ষের প্রায় সর্ব্বত্র প্রাচীন কাল হইতে গোপীচাঁদ নামক এক রাজার বিবরণ লিখিত ও কথিত হইতেছে। মহারাষ্ট্রদেশ, রাজপুতানা, অযোধ্যা, পাঞ্জাব, পশ্চিমোত্তর প্রদেশ, মধ্যভারত, মধ্যপ্রদেশ, বিহার প্রভৃতি বহুস্থানে রাজা গোপীচাঁদের কথা শুনিতে পাওয়া যায় .....অথচ বঙ্গদেশে এই রাজার নাম কেহ শুনে নাই” ইত্যাদি। মহাভারতী মহাশয়ের গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর গোপীচন্দ্র সম্বন্ধে বঙ্গদেশে বহু আলোচনা হইয়াছে। বাঙ্গালী আজ উল্লিখিত কলঙ্ক হইতে অনেকটা মুক্ত।

বংশ বিবরণে অনৈক্য  ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে গোপীচাঁদের গান প্রচলিত থাকিলেও তিনি যে বাঙ্গালাদেশের রাজা ছিলেন তাহা সর্ব্ববাদিসম্মত। উপাখ্যানাংশে ভিন্ন ভিন্ন স্থানের গাথায় অনেক স্থলে পার্থক্য লক্ষিত হয়। বাঙ্গালাদেশে যত গুলি গাথা আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহার সকল গুলিরই মতে গোপীচন্দ্র মাণিকচন্দ্র রাজার ও ময়নামতীর পুত্র, ময়নামতী তিলকচাঁদের কন্যা, হরিচন্দ্র বা হরিশ্চন্দ্র রাজা গোপীচন্দ্রের শ্বশুর। হরিশ্চন্দ্রের কন্যা অদুনা ও পদুনা গোপীচাঁদের প্রধানা মহিষী; ইহা ছাড়া অন্য স্ত্রীরও অভাব ছিল না।

 মহারাষ্ট্রদেশীয় গাথায় গোপীচন্দ্র ত্রৈলোক্যচন্দ্র ও মৈনাবতীর পুত্র, তিনি গৌড়-বঙ্গের রাজধানী কাঞ্চননগরে রাজত্ব করিতেন। জলন্দর গুরুর শিষ্যত্ব, তাঁহার সহিত ভারতের নানা দেশ ভ্রমণ, পরে সহস্র বৎসর রাজ্যশাসন ইত্যাদি বিবরণ লিখিত হইয়াছে।

 হিন্দী উপাখ্যানমতে ভর্ত্তৃহরির ভগিনী মৈনাবতীর পুত্র গোপীচন্দ্র ও কন্যা চন্দ্রাবলী; এবং এই “চন্দ্রাবলীকা বিবাহ সিংহল দ্বীপকা রাজা উগ্রসেন সে হুআথা”। এই মতে ভর্ত্তৃহরি ও মৈনাবতী উভয়েই গোরক্ষনাথের শিষ্য।

 লক্ষণদাস বিরচিত হিন্দী গাথার মতে ধারনগরের রাজা গন্ধর্ব্বসেনের কন্যা মৈনাবতী তিলকচন্দ্রের পত্নী এবং গোপীচন্দ্র ও চম্পা দেবীর মাতা।

 ৺রায় শরচ্চন্দ্র দাস বাহাদুর তিব্বতীয় গ্রন্থ হইতে যে বিবরণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তদনুসারে গোপীচাঁদের বংশে পরিচয় নিম্নরূপ:—

সিংহচন্দ্র
বালচন্দ্র
বিমলচন্দ্র
গোপীচন্দ্র

গোপীচন্দ্র এই মতানুসারে বালপাদ বা হাড়িসিদ্ধার শিষ্য এবং তাঁহার রাজ্যপাট চাটিগ্রামে ছিল।[৬]

 কৈলাসচন্দ্র সিংহ মহাশয় তাঁহার রাজমালা গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে, (ত্রিপুরা জেলার) লালমাই-ময়নামতী পর্ব্বতে গোপীচাঁদ রাজা বাস করিতেন। প্রবাদানুসারে ময়নামতী তাঁহার পত্নী, লালমাই তাঁহার কন্যা ছিলেন।

 উড়িষ্যায় প্রাপ্ত গাথা অনুসারে বংশ তালিকা নিম্নরূপ:—

সুরচন্দ্র
তারাচন্দ্র
ব্রহ্মাচন্দ্র
গোপীচন্দ্র
মেহুচন্দ্র
বিষ্ণুচন্দ্র
রূপচন্দ্র
গোবিন্দচন্দ্র

এই গাথার মতে গোবিন্দচন্দ্রের মাতার নাম মুক্তাদেবী, গুরু হাড়িপা, প্রধানা পত্নী রোদুমা ও পোদুমা।[৭]

 দুর্ল্লভ মল্লিক প্রণীত গোবিন্দচন্দ্রের গীতে পাওয়া যায়,—

“সূবর্ন্নচন্দ্র মহারাজা ধাড়িচন্দ পিতা।
তার পুত্র মানিকচন্দ ষুন তার কথা॥”

 এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে যে সুকুর মামুদ প্রণীত গাথা মুদ্রিত হইল, তদনুসারে বংশতালিকা এইরূপ,—

বাইলচন্দ্র
পালচন্দ্র
রুকচন্দ্র
মাণিকচন্দ্র
গোপীচন্দ্র

গানের ঐতিহাসিকতা  দেখা যাইতেছে গোপীচন্দ্রের পিতার নাম সম্বন্ধে বঙ্গের গাথা গুলি এক মত হইলেও বঙ্গের বাহিরে ভিন্ন মত প্রচলিত। আবার তাঁহার পিতার পূর্ব্বপুরুষ সম্বন্ধে কোন দুই গাথাই একমত নহে। গোবিন্দচন্দ্র বা গোপীচন্দ্রের গৃহত্যাগ ও সন্ন্যাস এবং হাড়িপা গুরুর শিষ্যত্ব সম্বন্ধে কোন মত-ভেদ নাই। তিনি বাঙ্গলাদেশের রাজা এবং অদুনা পদুনার স্বামী ইহাও একরূপ স্বীকৃত। তাঁহার কাহিনী যেরূপ ভাবে বিস্তৃত তাহাতে তাঁহাকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলিয়া স্বীকার করিতেও আমরা বাধ্য। কিন্তু তাঁহার পূর্ব্ব পুরুষের নাম ও আনুষঙ্গিক ঘটনা সম্বন্ধে উপাখ্যানের বিভিন্নতা এতই অধিক, সত্যের উপর কুহেলিকার আবরণ এতই গাঢ় যে, তাঁহাকে বহুপ্রাচীন কালের লোক বলিয়া গ্রহণ করিতেই হইবে। রংপুর জেলা হইতে সংগৃহীত ও এই গ্রন্থের ১ম খণ্ডে প্রকাশিত গাথায় মাণিকচন্দ্র রাজার পূর্ব্বপুরুষের কোনও পরিচয় নাই। গ্রীয়াসন্ সাহেবের সংগৃহীত গাথায় এবং ভবানী দাসের পুঁথিতেও নাই। রংপুরের উপাখ্যান সংক্ষেপতঃ এইরূপ:—

রংপুরের উপাধ্যান  বঙ্গে মাণিকচন্দ্র নামে এক “সতী” বা ধার্ম্মিক রাজা ছিলেন। তিলকচাঁদের কন্যা জ্ঞানসিদ্ধা ময়নামতী তাঁহার অন্যতমা ভার্য্যা। অন্দরমহলে “নও বুড়ী” রাণী সত্ত্বেও মাণিকচাঁদ আরও বিবাহ করিলেন এবং গৃহদ্বন্দ্ব হইতে নিস্তার পাইবার আশায় বর্ষীয়সী ময়নামতীকে পৃথক্ করিয়া ফেরুসা নগরে তাঁহার বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিলেন।

 মাণিকচন্দ্রের রাজ্যে প্রজার সুখের ইয়ত্তা ছিল না। প্রজা প্রত্যেক হালে দেড় বুড়ী মাত্র খাজনা দিত এবং বিপুল সমৃদ্ধির মধ্যে দিন কাটাইত। কিন্তু এ সুখ বেশী দিন টিকিল না। দক্ষিণ হইতে এক বাঙ্গাল আসিয়া রাজার দেওয়ান হইল এবং খাজনা দেড় বুড়ী স্থলে পোনর গণ্ডা করিল। ইহাতে প্রজার দুর্দ্দশার অবধি রহিল না। চাষা খাজনার জন্য হাল গরু বিক্রয় করিল, সওদাগর নৌকা বিক্রয় করিল, ফকিরকে ঝোলা কাঁথা পর্য্যন্ত বিক্রয় করিতে হইল। “নাঙ্গল”, “জোঙ্গাল”, “ফাল”, “দুধের ছোআল” পর্য্যন্ত বিক্রীত হইতে লাগিল। তখন প্রজারা পরামর্শ করিয়া মহৎ বা প্রধানের বাড়ীতে উপস্থিত হইল এবং নদীতীরে ধর্ম্মপূজা করিয়া রাজাকে অভিশাপ দেওয়া স্থির হইল। কোন মতে প্রধান স্বয়ংই এই পরামর্শ দিলেন, কোন মতে মহাদেবের নিকট হইতে পরামর্শটী গৃহীত হইল। পরামুর্শানুযায়ী কার্য্য অনুষ্ঠিত হইলে রাজার ১৮ বৎসরের পরমায়ু ৬ মাসে পরিণত হইল, “চিত্র গোবিন্দ” দপ্তর খুলিল। বিধাতা তলবচিঠি লিখিয়া গোদাযমকে রাজার প্রাণ আনিতে নিযুক্ত করিলেন। ময়নামতী সংবাদ পাইলেন এবং এই বিপদের সময় স্বামীকে রক্ষা করিতে আসিলেন। তিনি রাজাকে জ্ঞান দিয়া অমর করিতে চাহিলেন, কিন্তু মাণিকচাঁদ স্ত্রীর নিকট জ্ঞান গহণ করিতে একেবারে অসম্মত। অগত্যা ময়নামতী যমদিগকে নানা প্রকারে নিধারণ করিতে লাগিলেন,—কখন উপঢৌকন দ্বারা, কখন তাড়নাদ্বারা। কিন্তু বিধাতার হুকুম এইরূপে পণ্ড হইতে পারে না। যমেরা কৌশল কবিয়া রাজার দীপ নিবাইয়া দিল, তাঁহার স্ফটিকপাত্রের জল ঢালিয়া ফেলিল এবং তাঁহার বিষম তৃষ্ণা লাগাইয়া দিল। রাজা তৃষ্ণার্ত্ত হইয়া জল জল করিতে লাগিলেন এবং যমবিশেষের পরামর্শে ময়নামতী ভিন্ন অপর কাহারও হস্তে জল খাইবেন না সঙ্কল্প করিয়া বসিলেন। সুতরাং ময়নামতীকে জল আনিতে যাইতে হইল, রাজার জীবনও সেই অবকাশে অপহৃত হইল। ময়নামতী গঙ্গাদেবীর নিকট অবস্থা জানিতে পারিয়া (কোনও মতে ছদ্মবেশে) একেবারে যমপুরীতে হাজির। তাঁহার হস্তে যমেরা অশেষ নির্যাতন ভোগ করিল। কাজেই বিধাতার রাজত্ব ঠিক রাখিবার জন্য ময়নামতীর গুরু গোরক্ষনাথ আপোষের প্রস্তাব করিলেন, নারদের দ্বারা আশীর্ব্বাদলিপি লেখাইয়া ময়নামতীকে পুত্রবর দিলেন। ময়নামতী দেখিলেন আশীর্ব্বাদানুসারে পুত্রের বয়স ১৮ বৎসর মাত্র। তিনি ছানি হুকুম চাহিয়া বসিলেন। তাহা আর হইল না, কিন্তু বন্দোবস্ত হইল যে, হাড়িসিদ্ধার চরণ ভজনা করিলে ময়নামতীর পুত্র অমর হইবে। ময়নামতীর গর্ভে সন্তানের আবির্ভাব হইলে মাণিকচন্দ্রের শব ভস্মীভূত হইল। ময়নামতী শবের পার্শ্বে অনলে শয়ন করিলেন, কিন্তু অনল তাঁহার কেশও পোড়াইতে পারিল না। তিনি সুস্থ শরীরে পতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপনের পর এক পুত্র প্রসব করিলেন। এই পুত্রই গোপীচাঁদ। পুত্রকে গৃহে আনিবার সময় রাস্তায় আর একটি শিশু যুটিল, তাহাকেও কুড়াইয়া আনিয়া লালনপালন করিতে লাগিলেন; ইহার নাম হইল খেতুয়া। রাজকুমারের বিদ্যাশিক্ষা হইল; তাহার পর ৯ বৎসর (মতান্তরে ১২ বৎসর) বয়সে তাঁহার বিবাহের আয়োজন হইল। হরিচন্দ্র বা হরিশ্চন্দ্র রাজার কন্যা অদুনা ও পদুনা রাজার অঙ্কলক্ষ্মী হইলেন।

রদুনাক বিবাও কৈল্লে পদুনাক পাইল দানে।
এক শত বান্দি পাইল ব্যাবারের কারণে॥ (পৃঃ ৫৩)

 রাজকুমার ক্রমে রাজপাটে বসিলেন। তখন ময়নামতী ফেরুসা হইতে আসিয়া তাঁহাকে সিদ্ধা হাড়ির শিষ্যত্ব গ্রহণ করতঃ সন্ন্যাসী হইতে উপদেশ দিলেন। রাজা চমকিয়া উঠিলেন, হাড়ির প্রতি অবজ্ঞাসূচক বাক্য প্রয়োগ করিলেন, হাড়ির প্রসঙ্গে জননীর প্রতি কলঙ্ক পর্য্যন্ত আরোপ করিতে ত্রুটি করিলেন না। ময়নামতী ক্রোধে গুরু গোরক্ষনাথকে স্মরণ করিলেন। গুরু আসিয়া গোপীচাঁদের সন্ন্যাসাবস্থায় নানারূপ ক্লেশ নির্দ্দেশ পূর্ব্বক অভিশাপ দিয়া প্রস্থান করিলেন। ময়নামতী সেদিনকার মত ফিরিয়া গেলেন, কিন্তু পুনরায় আসিয়া পুত্রকে নানারূপ উপদেশ দিয়া সন্ন্যাসে যাইবার জন্য উৎসাহিত করিতে লাগিলেন। তিনি বিবিধ নারীচরিত্র বর্ণনা করতঃ স্ত্রীর প্রেমের অসারতা প্রদর্শন করিলেন এবং পুত্রের নানাবিধ জটিল আধ্যাত্মিক প্রশ্নের সমাধান করিলেন। রাজা সন্ন্যাস গ্রহণ করিতে সম্মত হইলেন, কিন্তু অন্দরমহলে আসিলেই অদুনা ও পদুনা রাণী অন্যরূপ মন্ত্রণা দিল, ময়নামতীর জ্ঞানের পরীক্ষা লইবার প্রস্তাব করিল। পরদিন রাজদরবারে রাজার প্রশ্নের উত্তরে ময়নামতী স্বীয় অনল প্রবেশের কথা বলা মাত্রই রাজা তাঁহার কথার সত্যতা পরীক্ষা করিতে অগ্রসর হইলেন। সুবৃহৎ লৌহ কটাহ আশী মণ তৈলে পূর্ণ করিয়া “সাত দিন নও রাত” অগ্নির উপর রাখা হইল। খেতুয়া ফেরুসা হইতে ময়নামতীকে আনিতে গেল, তিনি আসিতে অসম্মতি প্রকাশ করিলে তাঁহাকে গামছা দিয়া বান্ধিয়া ফেলিল। ময়নামতী পলায়ন করিবেন না প্রতিজ্ঞা করিলেন এবং বন্ধনমুক্ত হইয়া স্নানে নামিলেন ও গুরুর আশীর্ব্বাদ গ্রহণ করিলেন। তাঁহাকে তপ্ত তৈলে নিক্ষেপ করা হইল। ছয় দিন উত্তপ্ত তৈলের উপর থাকার পর তিনি সর্ষপরূপ ধারণ করতঃ তৈলে ভাসিতে লাগিলেন। রাজার ও খেতুয়ার তখন ভয় হইল যে, মাতা আর ইহজগতে নাই। লোহার কড়াই তেপথিয়া রাস্তায় ফেলিয়া দেওয়া হইল। রাজবধূগণের নিকট মৃত্যুসংবাদ প্রেরিত হইলে তাঁহারা আনন্দে অধীর হইলেন। কিন্তু ময়নামতী মরেন নাই, বধূগণও ক্রমে অবস্থা বুঝিতে পারিয়া বিষণ্ণ হইয়া পড়িলেন। ফলে এ পরীক্ষাও যথেষ্ট বিবেচিত হইল না। তুলাদণ্ড দ্বারা ময়নামতীকে ওজন করা হইল। পোস্তের দানা ও তৎপরে তুলসীপত্রের সহিত ওজনে ময়নামতী পাতলা হইয়া পড়িলেন, তুষের নৌকায় বৈতরণী পার হইলেন। গোপীচাঁদকে এবার সন্ন্যাস গ্রহণ স্বীকার করিতে হইল। তখন শুভদিন দেখিবার জন্য পণ্ডিতের তলব হইল। রাণীরা দাসীর হস্তে ৫০০ টাকা উৎকোচস্বরূপ পণ্ডিতের নিকট পাঠাইয়া দিলেন। পণ্ডিত উৎকোচ গ্রহণ করিতে অনিচ্ছুক, কিন্তু পণ্ডিতানীর যুক্তিতে পরাস্ত হইয়া অবশেষে গ্রহণ করিলেন এবং রাজদরবারে আসিয়া এযাত্রা সন্ন্যাসে কুশল নাই বলিলেন। গোপীচন্দ্র স্বয়ং গণনায় বসিয়া উৎকোচের ব্যাপার ধরিয়া ফেলিলেন। তখন খেতুয়ার প্রতি আজ্ঞা হইল “চণ্ডীর দ্বারে লইয়া ব্রাহ্মণকে বলি দাও”। আদেশ পালিত হইবার উপক্রম হইলে ব্রাহ্মণ কাতর কণ্ঠে ধর্ম্মের দোহাই দিয়া চণ্ডী মাতার করুণা ভিক্ষা করিলেন। চণ্ডীদেবী হৃদয়ে “মুনিমন্ত্র” জপ করিয়া শ্বেত মক্ষিকার রূপ ধরিয়া ব্রাহ্মণের কর্ণে উদ্ধারের উপায় বলিয়া দিলেন। ব্রাহ্মণ “কাতরায়” থাকিয়া রাজার দোহাই দিলেন এবং জানাইলেন যে, তাঁহার নাবালক পুত্র পঞ্জিকাখানিকে অশুদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছিল, তিনি স্নান করিয়া ঠিক গণিয়া দিবেন। পণ্ডিত এখন রাজদরবারে সমস্তই কুশল গণনা করিয়া দিলেন, এবং সন্ন্যাস গ্রহণ করিবার দিন ক্ষণ বলিয়া দিলেন। ব্রাহ্মণ দক্ষিণা পাইয়া গৃহে ফিরিলেন। তাহার পরই নাপিত আনিবার আয়োজন। রাণীদিগের বাধা ও উৎকোচ সত্ত্বেও নাপিতকে ক্ষুর লইয়া হাজির হইতে হইল। তাহার পর ময়নামতীয় তত্ত্বাবধানে দেব ও সিদ্ধাগণের সমক্ষে রাজাকে যোগী করা হইল। তাঁহার কর্ণচ্ছেদ হইল, ডোর, কৌপীন ইত্যাদি সাজ হইল; তিনি ময়নামতী কর্ত্তৃক গোরক্ষনাথের শিষ্য হাড়িপার হস্তে সমর্পিত হইলেন। হাড়ীর আদেশে রাজা জননীর মহলে ভিক্ষা করিতে গিয়া “কদুর পাতায়।” খাইয়া আসিলেন। ময়নামতী তাঁহার বুলিতে বার কাহন কড়ি দিলেন। অতঃপর হাড়ি রাজাকে রাণীদের মহলে গিয়া ভিক্ষা আনিতে আদেশ দিলেন। ইহাতে নির্ব্বাপিত অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল, অদুনা ও পদুনা রাণী অনেক কাকুতি মিনতি করিলেন, সঙ্গে যাইবার জন্য অস্থির হইলেন এবং বিদেশে তাঁহারা যেরূপ সেবা করিবেন, তাহা বিবৃত করিতে লাগিলেন। রাজা এ প্রলোভনে মুগ্ধ হইলেন না। তিনি পথে নানা বিপদের উল্লেখ করিলেন, কিন্তু রাণীরা তাহাও উপেক্ষা করিতে প্রস্তুত। তাঁহারা ডোর কৌপীন পরিয়া, সম্মুখের দুইটি করিয়া দাঁত ভাঙ্গিয়া, মস্তক মুণ্ডন করিয়া, ভিক্ষার ঝুলি লইয়া রাজার পশ্চাতে যাইবার জন্য অনুমতি চাহিলেন, হাড়িসিদ্ধার ভীষণ কাঁথার ভয়ও তাঁহাদিগকে নিবৃত্ত করিতে পারিল না। রাজা কিন্তু কিছুতেই স্ত্রীলোক সঙ্গে লইয়া যাইবেন না। রাণীদ্বয় একটি পুত্র চাহিলেন। রাজা বনে যাইতেছেন, পুত্র পাইবেন কোথায়? স্বয়ং পুত্র হইবার প্রস্তাব করিলেন। রাণীরা তখন ছুরিকা দ্বারা আত্মহত্যা করিলেন। রাজার মিনতিতে হাড়িসিদ্ধা ধূলাপড়া দিয়া রাণীদিগকে বাঁচাইয়া দিলেন। কোন কোন গায়কের মতে তিনি এই সময়ে একটু রসিকতা করিয়া অদুনার মুণ্ড পদুনার স্কন্ধে, এবং পদুনার মুণ্ড অদুনার স্কন্ধে চাপাইয়া দিলেন।[৮] রাণীরা এই অলৌকিক ঘটনার পর স্বামীকে হাড়ির হস্তে ছাড়িয়া দিলেন। নবীন রাজার বৈরাগ্যে রাজ্যময় সকলে কান্দিতে লাগিল। রাজার অনুপস্থিতি-কালে রাজপুরীর বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য বার জায়গায় চৌকী, ও তের জায়গায় থানা বসান হইল, “রামজাল” ও “ব্রহ্মজালে” পুরী বেষ্টিত হইল। বার বৎসর পর্য্যন্ত কোনও পুরুষ পুরীতে প্রবেশ করিতে পরিবে না, এই আদেশ প্রচারিত হইল। সত্যের অন্ন, সত্যের পাশা এবং দামামা গৃহে লম্বিত রাখিয়া গোপীচন্দ্র হাড়িগুরুর সহিত সন্ন্যাসে চলিলেন। খেতুয়া রাজ প্রতিনিধি হইল এবং বাজে রাণীগুলিকে (অদুনা ও পদুনা ব্যতীত) হস্তগত করল। হাড়ি গুরু রাজাকে রাস্তায় বিস্তর লাঞ্ছনা দিলেন। তাঁহার ঝুলির ভার বৃদ্ধি করিয়া দিলেন, বৃহৎ অরণ্য সৃষ্টি করিয়া রাজার পথশ্রমের মাত্রা বাড়াইয়া দিলেন। কণ্টকে রাজার শরীর বিদীর্ণ হইল, রাজা কাতর কণ্ঠে সূর্য্যদেবের মুখ দেখিতে চাহিলেন। হাড়িসিদ্ধা জঙ্গল উড়াইয়া দিয়া এক বালুকাময় প্রদেশের সৃষ্টি করিলেন এবং সূর্য্য ও ব্রহ্মাকে বালুকা উত্তপ্ত করিয়া দিতে বলিলেন। বালুকার ভীষণ উত্তাপে গোপীচাঁদ ছট্‌ফট্ করিতে লাগিলেন এবং গুরুর নিকট বৃক্ষচ্ছায়া প্রার্থনা করিলেন। হাড়ি এক বৃক্ষের সৃষ্টি করিলেন, কিন্তু রাজা যেমন হাড়িকে পশ্চাতে রাখিয়া বৃক্ষাভিমুখে ছুটিয়া চলিলেন বৃক্ষও অগ্রসর হইয়া অগ্রে অগ্রে চলিতে লাগিল এবং অবশেষে ভাঙ্গিয়া পড়িয়া গেল। রাজা আবার কান্দিতে লাগিলেন, আবার নূতন বৃক্ষের সৃষ্টি হইল; গুরু শিষ্য তাহার তলায় বসিলেন। রাজা ক্রমে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইলেন। হাড়ির আদেশে যমের মা পালঙ্ক ও পাখা লইয়া আসিলেন। নিদ্রিত রাজাকে পালঙ্কে শয়ন করান হইল, যমের মা বাতাস করিতে লাগিলেন। হাড়ি বিশ্বকর্ম্মা ও “গাড়া অন্যা” দ্বারা জঙ্গল পরিষ্কার করাইলেন, যমগণ দ্বারা দারাইপুর সহর পর্য্যন্ত রাস্তা প্রস্তুত করাইলেন, “কচ্ছপ মুনি” দ্বারা রাস্তা সমতল করিয়া লইলেন। হাড়িয়ানী রাস্তা লেপিয়া দিল, মালিনী গোলাপ ও চন্দন বর্ষণ করিয়া দিয়া গেল। লঙ্কা হইতে হনুমান ও বানরগণ আহূত হইয়া ফুলের গাছ ও পাথর আনিয়া দিল। গোদা ও আবাল যম হাড়ির আদেশে পাষাণ দিয়া দীঘির ঘাট বান্ধিল এবং ফুলের বাগান প্রস্তুত করিয়া দিল। হনুমানেরা রামের চর, তাহারা হাড়ির সহিত বল পরীক্ষা করিতে গিয়া তাঁহার হাত খানাও নাড়িতে পারিল না এবং “মুখপোড়া” হইয়া থাকিবার অভিশাপ লাভ করিল। রাজা এই বিচিত্র পথ দিয়া চলিবার সময় হাড়ির নিকট প্রকাশ করিয়া ফেলিলেন যে, প্রত্যাবর্ত্তন কালে রাণীদিগের জন্য গোটাকয়েক ফুল তুলিয়া লইতে তিনি ইচ্ছুক। হাড়ি মনে মনে কুপিত হইলেন এবং এই ধৃষ্টতার জন্য রাজাকে শিক্ষা দিতে ইচ্ছুক হইয়া চলিতে চলিতে গাঁজা সেবনের জন্য রাজার কাছে বার কড়া কড়ি চাহিলেন। রাজা গাঁজার নাম শুনিয়াই তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করিলেন এবং সগর্ব্বে বলিলেন “বার কড়া কেন, বার কাহনও দিতে পারি”। হাড়ি মন্ত্রবলে রাজার ঝুলি হইতে কড়িগুলি উড়াইয়া দিলেন এবং কড়ির জন্য রাজাকে পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। রাজা ঝুলিতে হাত দিয়া অপ্রস্তুত হইলেন এবং কড়ির জন্য নিজে বন্ধক থাকার প্রস্তাব করিয়া ফেলিলেন। হাড়ি বসুমতীকে সাক্ষী রাখিয়া রাজাকে লইয়া বন্দরে চলিলেন। বহু স্ত্রীলোক বন্দরে পসার সাজাইয়া বসিয়াছিল। তাহারা রাজার রূপ দেখিয়া তাঁহাকে একেবারে কিনিয়া ফেলিতে উদ্যত হইল এবং অনেকে রাজাকে ধরিয়া এমন টানাটানি আরম্ভ করিল যে, তাঁহার কোমর রক্ষা করা দায়। তখন হাড়ির আদেশে ইন্দ্রদেব শিলাবৃষ্টি আরম্ভ করিয়া দিলেন, “কালাইবেচীকে” নাছোড়বান্দা দেখিয়া এক প্রকাণ্ড পাথরে তাহার মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া দিলেন। ইহার পর রাজাকে লইয়া হাড়িসিদ্ধা হীরা নটীর বাড়ী গেলেন এবং দামামায় ভীষণ ঘা মারিয়া আগমন বার্ত্তা জানাইলেন। হীরা নটীর নিকট বার কড়া কড়ি লইয়া, রাজাকে তাহার নিকট বান্ধা রাখিয়া সিদ্ধা হাড়ি পাতালে প্রবেশ করিলেন, এবং “চৌদ্দ তাল” জলের তলে যোগাসনে বসিলেন। হীরা রাজাকে বিশেষ যত্ন করিয়া স্নানাহার করাইল। রাজার জন্য বিচিত্র শয্যা রচিত হইল। হীরা বিচিত্র বেশভূষা করিয়া রাজার প্রেমের জন্য লালায়িত হইয়া নিকটে আসিল। কিন্তু তাহার বিপুল আয়োজন ব্যর্থ হইল। রাজা তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিলেন, তাহার রূপে ভুলিলেন না। হীরার প্রেম ঘৃণায় পরিণত হইল, রাজার উপর অশেষ নির্যাতনের ব্যবস্থা হইল, ছিন্ন বস্ত্র তাঁহার পরিধেয় হইল, ছাগলের কক্ষ তাঁহার বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট হইল, তাঁহাকে জঘন্য খাদ্য দেওয়া হইল। তিনি প্রত্যহ করতোয়া নদী হইতে ১২ ভার অর্থাৎ ২৪ কলসী জল আনিতে আদিষ্ট হইলেন। জলের পরিমাণ কম হইলে প্রহারের ব্যবস্থা হইল। রাজার বক্ষের উপর হীরা নটীর কাষ্ঠপাদুকা সমেত গাত্রধাবন কার্য্য চলিতে লাগিল। “পাপের বিছানা” তোলা ও পাপের কড়ি গণা রাজার নিত্য কর্ম্ম হইল। হীরার অত্যাচারে রাজা মৃতকল্প হইলেন। তখন অদুনা ও পদুনা রাণীর নিষেধ বাক্য মনে পড়িল। তাঁহাদের নাম স্মরণ পথে আসায় রাজপুরীস্থ সত্যের পাশা “আউলাইয়া পড়িল”, রাণীদ্বয় ব্যাকুল হইলেন। রাণীদিগের রোদনে গৃহপালিত সারিশুক পাখী বিকল হইল এবং রাজার অন্বেষণে যাইবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করিল। বন্ধনমুক্ত হইয়া তাহারা নানাদেশে রাজাকে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল। কত অদ্ভুত দেশই তাহাদের নয়নে পড়িল—এক ঠেঙ্গিয়ার দেশ, কাণ ফাড়ার দেশ, মশা রাজার দেশ, মেচপাড়ার দেশ, ত্রিপাটনের দেশ ইত্যাদি। এই সকল দেশে এবং গয়া, গঙ্গা, কাশী, বৃন্দাবন, কোথাও রাজাকে না পাইয়া পক্ষিদ্বয় নদীতে পড়িয়া আত্মহত্যা করিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু তাহাদের সে চেষ্টাও ব্যর্থ হইল; কারণ গঙ্গাদেবী রাঘববোয়াল দিগকে সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন যে, ইহারা ময়নামতীর নাতি, ইহাদিগকে উদরস্থ করিলে আর নিস্তার নাই। শেষে সারিশুক গোপীচন্দ্রকে অন্য ঘাটে জল তুলিবার সময় দেখিতে পাইল এবং ক্রমশঃ পরিচিত হইল। রাজা স্বীয় রক্ত দ্বারা দুইখানি পত্র লিখিয়া পক্ষিদ্বয়ের হস্তে দিলেন। একখানি অদুনা রাণীর নিকট, সেখানি ব্যঙ্গোক্তি পূর্ণ; অপর খানি ময়নামতীর নিকট, তাহা করুণ বিলাপোক্তি পূর্ণ। পক্ষিদ্বয় যথাস্থানে পত্র প্রদান করিল। ময়নামতী ক্রুদ্ধ হইয়া ধ্যানে বসিলেন ও হাড়িকে মন্ত্রবলে বজ্রচাপড় মারিলেন। হাড়িসিদ্ধা চমকিয়া উঠিলেন ও অনুতপ্ত হৃদয়ে রাজাকে উদ্ধার করিতে চলিলেন। গোপীচন্দ্রকে নদীর ঘাটে পাইয়া হাড়ি তাহাকে রূপান্তরিত করিয়া ঝোলার মধ্যে রাখিলেন এবং হীরা নটীর বাড়ী গিয়া শিষ্যকে ফেরত চাহিলেন। হীরা রাজাকে না পাইয়া অনেক রকম মিথ্যা কথা বলিতে লাগিল। হাড়ি সবশেষে রাজাকে ঝোলা হইতে বাহির করিলেন ও হীরাকে তাহার কড়ি প্রত্যর্পণ করিলেন। হীরা নটীকে শাস্তি দেওয়া হইল। তাহাকে শাপ দিয়া “যোড় বগদুল” করিয়া ও তাহার ধন খাপড়ায় পরিণত করিয়া হাড়িসিদ্ধা চলিয়া আসিলেন।

 এইবার গোপীচন্দ্রের রাজধানীতে প্রত্যাগমন। পথে রাজার গুরুর নিকট জ্ঞান শিক্ষা হইল। জ্ঞানের পরীক্ষাও হইল। রাজা অনেক করিয়া জিজ্ঞাসাবাদের পর ছদ্মবেশে বাড়ীতে ফিরিলেন। তাঁহার উপর কুকুর লেলাইয়া দেওয়া হইল, কিন্তু কুকুরেরা তাঁহার পায়ে পড়িয়া কান্দিতে লাগিল। বান্দীগণ ভিক্ষা দিতে আসিল, কিন্তু তিনি তাহাদের হস্তে ভিক্ষা লইলেন না। অদুনা ও পদুনা ভিক্ষা দিতে আসিলেন, কিন্তু রাজা স্ত্রীলোকের হস্তে ভিক্ষা লইবেন না, তাহাদের “মাথার ছত্তর” অর্থাৎ স্বামীকে চাই। অবশেষে ছদ্মবেশী রাজা স্বীয় মৃত্যুকাহিনী প্রচার করিলে রাণীরা আত্মহত্যা করিতে উদ্যত হইলেন। তখন পরিচয় হইল। রাজা আবার ফেরুসা নগরে সোনার ভোমরা রূপে গিয়া মাতার চরকা উড়াইয়া দিয়া নিজের “জ্ঞান” দেখাইলেন। মাতাপুত্রে মিলন হইল। গোপীচন্দ্রের রাজধানীতে আনন্দস্রোত বহিতে লাগিল, হস্তী রাজাকে সিংহাসনে বসাইল, ময়নার হুঙ্কারে দেবগণ পর্য্যন্ত আসিয়া উৎসবে যোগ দিলেন। প্রজার খাজনা আবার দেড় বুড়ী হইল, তাহাদের সুখের দিন আবার ফিরিয়া আসিল।

উপাখ্যানে পার্থক্য  রংপুর অঞ্চলে প্রচলিত এই উপাখ্যানের সহিত এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে প্রকাশিত উপাখ্যানের মূল বিষয়ে ঐক্য থাকিলেও আনুষঙ্গিক বিবরণগত পার্থক্য অনেক। গোপীচন্দ্রের জন্মে মাণিকচন্দ্রের কর্ত্তৃত্বের অভাব সুকুর মামুদের গ্রন্থেও আছে। কিন্তু মাণিকচন্দ্রের মৃত্যুর পর গোপীচন্দ্রের গর্ব্ভে অবস্থান কেবল এই রংপুরের গীতেই দেখিতে পাওয়া যায়। শুকুর মামুদের মতে মাণিকচন্দ্রই গোপীচন্দ্রকে বিবাহ করাইলেন ও রাজপাটে বসাইলেন, ময়নামতী বা “মনী” তখন ধ্যানে। রংপুরের গাথায় গোপীচন্দ্রের রাণীদিগের মধ্যে কেবল হরিশ্চন্দ্র রাজার কন্যা অদুনা ও পদুনারই নামোল্লেখ আছে। ভবানীদাস অদুনা, পদুনা, রতনমালা ও কাঞ্চনমালা রাণীর নাম করিয়াছেন। সুকুর মামুদ পূর্ব্বদেশের মহেশচন্দ্র রাজার কন্যা চন্দনা, উত্তর দেশের নেহালচন্দ্র রাজার কন্যা ফন্দনা এবং পশ্চিমদেশের হরিশ্চন্দ্র রাজার কন্যা অদুনা ও পদুনার সহিত রাজার বিবাহ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। ভবানীদাসের গানেও মাণিকচন্দ্র রাজার সময় প্রজার সমৃদ্ধির বিবরণ দেখিতে পাই। তাঁহার মতে প্রজার করবৃদ্ধি মাণিকচন্দ্রের সময়ে নয়, গোপীচন্দ্রের প্রথম রাজত্বকালে। রংপুরের গানে ময়নামতীর পরীক্ষার পালা ও সন্ন্যাস গমনকালে পথিমধ্যে রাজার লাঞ্ছনা খুব বিস্তৃত রূপে বর্ণিত হইয়াছে। সুকুর মামুদের গ্রন্থে পরীক্ষার কথা আদপেই নাই; হাড়িফাকে বিষপ্রয়োগের কথা আছে। ভবানীদাস জতুগৃহে অগ্নিপরীক্ষা, সমুদ্র মধ্যে ছালায় বান্ধিয়া নিক্ষেপ ও ক্ষুরের ধারনির উপর ময়নামতীর হাঁটার কথা বলিয়াছেন। অধিকন্তু রাণীদিগের হস্তে ময়নামতীকে বিষ খাওয়াইয়া ও ঘোড়ার আস্তাবলে প্রোথিত করিয়া আরও দুই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছেন। বিদায়কালীন রাণীদিগের করুণরসাত্মক পালা সকল গ্রন্থেই আছে। কিন্তু ময়নামতীর প্রতি নৃশংস ব্যবহার বোধ হয় ভবানীদাসের গ্রন্থেই অধিক। রংপুরের গানে ও মহারাষ্ট্রীয় গ্রন্থে রাজার সন্ন্যাস হইতে প্রত্যাবর্ত্তনের পর পুনঃ রাজত্বের উল্লেখ দেখিতে পাই। সুকুর মামুদের গ্রন্থে তাহার উল্লেখ নাই। ভবানীদাসের গ্রন্থে তাহার আভাষ মাত্র আছে। দুর্ল্লভ মল্লিকের গ্রন্থে পাই, দ্বাদশবৎসর অন্তে রাজার দেশান্তর হইতে ফিরিবার পর হাড়িপা ও অন্যান্য যোগীদিগের উপর অত্যাচার এবং তৎপরে কানুপার সহিত সম্মিলন ও হাড়িপার মৃত্তিকাভ্যন্তর হইতে উঠিবার পর পুনরায় সন্ন্যাস।

 রংপুরের গানে ও ভবানীদাসের গ্রন্থে মূল বিষয়ে অনেক ঐক্য দেখিতে পাওয়া যায়। অনেক স্থলে ভাবেরও এত মিল যে, হয় একটী হইতে অপরটীর ভাব গৃহীত হইয়াছে অথবা উভয়েই কোন সাধারণ প্রাচীন গাথার নিকট ঋণী। ভাষায় ও যে মিলের সম্পূর্ণ অভাব একথা বলা যায় না। হাড়িসিদ্ধাকে গোপীচন্দ্রের মাটীর তলে পুঁতিয়া ফেলিবার কথা তিব্বতীয় গ্রন্থে, মহারাষ্ট্রীয় প্রবাদে, দুর্ল্লভ মল্লিকের গীতে ও সুকুর মামুদের গাথায় দেখিতে পাওয়া যায়। রংপুরের গাথায় ও ভবানীদাসের গ্রন্থে ইহার উল্লেখ নাই। হাড়িপার অদ্ভুত কর্ম্ম অবশ্য সকল গাথাতেই লিপিবদ্ধ; কোথাও বিস্তৃত ভাবে, কোথাও সংক্ষেপে। কোন কোন স্থানে এ বিষয়ে এক গাথার সহিত অন্য গাথার মিল আছে, কোথাও বা নাই। রাজার পারিষদবর্গের নামেও স্থানে স্থানে ঐক্য, স্থানে স্থানে অনৈক্য দৃষ্ট হয়। কিন্তু প্রধান পার্থক্য ঘটনাবলীর ভৌগোলিক সংস্থানে। রংপুরের জুগী কবিগণ ঘটনাগুলি নিজ নিজ বাড়ীর নিকট নির্দ্দেশ করেন। ত্রিপুরা জেলার কবি ভবানীদাসের মতে প্রধান ঘটনা গুলি সবই ত্রিপুরা অঞ্চলে। সুকুর মামুদের যে মুদ্রিত গ্রন্থ আমাদের হস্তগত হইয়াছে তাহাতে কবির বাসস্থানের কোন পরিচয় নাই; কিন্তু তাঁহার গ্রন্থের যে হস্তলিখিত পুঁথি ঢাকা মিউজিয়মের কিওরেটর বাবু নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয়ের নিকট আছে তদনুসারে কবির বাসস্থান সিন্দুরকুসুমী গ্রামে। এই পুঁথি দিনাজপুর জেলায় সংগৃহীত। সিন্দুর কুসুমী গ্রাম রাজসাহী জেলার রামপুর বোয়ালিয়া হইতে প্রায় ৬ মাইল উত্তরে বা উত্তর-পূর্ব্বে। ইহাতেও কিন্তু ঘটনা-স্থান প্রধানতঃ ত্রিপুরা জেলায়।

গানে জ্ঞাতব্য বিষয়  ১৩১৫ সনে (সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য) রংপুরে সংগৃহীত গান সম্বন্ধে আমি লিখিয়াছিলাম, “ইহা প্রহসন নহে; রামায়ণ ও মহাভারত খাঁটি হিন্দুর নিকট যতদূর সত্য, ময়নামতীর গাথাও যোগীদিগের এবং তাহাদের বহুসংখ্যক শ্রোতার নিকট ততদূর সত্য। বঙ্গভাষার সেবকের নিকট ইহাতে বিবিধ আবর্জ্জনার মধ্যে পুরাবৃত্ত আছে, রাজনৈতিক ইতিহাস আছে, ধর্ম্মজগতের একটী বিশাল প্রবাহের প্রতিবিম্ব আছে, ভাষাতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব আলোচনার নূতন উপাদান আছে। ময়নামতীর গাথা মার্জ্জিত কবির পাণ্ডিত্য-শূন্য হইলেও একেবারে কবিত্ব-শূন্য নহে। ইহাতে প্রসাদগুণ আছে, শ্লেষ আছে, অনেক স্থলেই মানব প্রকৃতির প্রকৃত আলেখ্য আছে। অতিপ্রাকৃত ঘটনার অতিরিক্ত সমাবেশ সত্ত্বেও কবিতা দেবীর অঙ্গ-সৌরভ দুরীকৃত হয় নাই।” এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হইবার পর বঙ্গের অন্য স্থান হইতে যে অন্যান্য গাথা আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহাতে এই সকল তত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্র প্রশস্ত বই সঙ্কুচিত হয় নাই। অনৈক্য ও অসামঞ্জস্য অধিকতর পরিস্ফুট হইয়া ঐতিহাসিককে অধিকতর সতর্ক করিয়া দিয়াছে, কিন্তু গবেষণার উপাদান অনেক বাড়িয়া গিয়াছে।

গোরক্ষানাথের সময়  এখন দেখা যাউক যাঁহারা এই গাথা গুলির নায়ক তাঁহারা কোন সময়ের লোক। গাথার প্রমাণানুসারে সাধারণতঃ ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে যে ময়নামতী “গোরক্ষনাথের শিষ্য, গোপীচন্দ্র হাড়িপার শিষ্য ছিলেন। ময়নামতী, গোপীচন্দ্র, গোরক্ষনাথ ও হাড়িপা কোন সময়ে বিদ্যমান ছিলেন এবং তাঁহাদিগের প্রবর্ত্তিত বা অবলম্বিত নাথধর্ম্মই বা কত দিনের? শ্রীযুক্ত অমূল্যচরণ বিঘাভূষণ মহাশয় নাথপন্থ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করিয়াছেন। তাঁহার মতে নাথপন্থ খৃষ্টীয় নবম শতকের শেষে প্রথমে বঙ্গদেশে প্রভুত্ব বিস্তার করে, তারপর ভারতের অন্যান্য প্রদেশে বিস্তৃতি লাভ করে।[৯] নাথদের মধ্যে গোরক্ষনাথের প্রতিপত্তি খুব অধিক, কিন্তু তাঁহার সময় সম্বন্ধে এত বিভিন্ন মত প্রচলিত যে, তাহা হইতে সত্য উদ্ধার করা যারপর-নাই কঠিন। খুব সম্ভবতঃ একাধিক গোরক্ষনাথ বিদ্যমান ছিলেন। নেপালের ইতিহাস প্রণেতা রাইট্ সাহেব স্থানীয় উপকরণ হইতে বলেন যে, নেপালরাজ বরদেবের সময়ে গোরক্ষনাথ নেপালে আগমন করেন। কথিত আছে কলির ৩৪০০ বৎসর গত হইলে বীরদেব নেপালের রাজমুকুট ধারণ করেন। বীরদেব হইতে চতুর্থ পুরুষে বরদেব। এই হিসাবে খৃঃ ৫ম শতকের প্রথম ভাগে গোরক্ষনাথের প্রাদুর্ভাব। আবার সিলভ্যা লেভি তাঁহার Le Nepal গ্রন্থে বলেন যে, খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে রাজা নরেন্দ্রনাথের সময়ে গোরক্ষনাথ বিদ্যমান ছিলেন। কচ্ছ প্রদেশের ধারণানুসারে গোরক্ষনাথ ধরমনাথ নামক সাধু পুরুষের সতীর্থ ছিলেন। ধরমনাথের শিষ্য দ্বাদশ শতকের শেষভাগে বা ত্রয়োদশ শতকের প্রথমে জাটদিগকে দূরীভূত করিয়া রায়ধনকে বরার রাজসিংহাসনে স্থাপিত করেন। এই হিসাবে গোরক্ষনাথ দ্বাদশ শতাব্দীর লোক হইয়া পড়েন। পক্ষান্তরে দলপতরাম প্রাণজীবন থক্কর তাঁহার প্রকাশিত প্রবন্ধে একটি উৎকীর্ণ লিপির উল্লেখ করিয়াছেন। তদনুসারে শিষ্যপরম্পরা নিম্নলিখিত রূপ:—

ধরমনাথ
গরীবনাথ
পন্থনাথ
ভিখারীনাথ
প্রভাতনাথ[১০]

 ভিখারীনাথের সময় ১৫৪৫ সংবৎ এবং প্রভাতনাথের সময় ১৬৬৫ সংবৎ বলিয়া কথিত হইয়াছে। এই হিসাবে গোরক্ষনাথ খৃঃ চতুর্দ্দশ বা পঞ্চদশ শতকের লোক হইয়া পড়েন। ১৫ শতকে বর্ত্তমান কবীরের সহিত গোরক্ষনাথের তর্কযুদ্ধের বিবরণ উত্তর ভারতে প্রচলিত আছে। ইহা সম্ভবতঃ কাল্পনিক। মহারাষ্ট্র-ভাষায় রচিত জ্ঞানেশ্বরী গ্রন্থে যে শিষ্য-পরম্পরার উল্লেখ আছে, তাহা হইতে সাধারণ নিয়ম অনুসারে হিসাব করিতে গেলে গোরক্ষনাথকে দ্বাদশ শতাব্দীর লোক বলিয়া মনে হইবে। শুনা যায় তিব্বতীয় গ্রন্থ নাড়াচাড়া করিলে গোরক্ষনাথকে দশম শতাব্দীর লোক বলিয়া স্থির করাও সম্ভব হইয়া পড়ে। শিষ্য-পরম্পরার হিসাব মুদ্রিত গ্রন্থে বা উৎকীর্ণ লিপিতে থাকিলেও নিরাপদ নহে। দলপতরাম প্রাণজীবন থক্কর প্রকাশিত প্রবন্ধেই এক শিষ্যের সময় ১৫৪৫ সংবৎ ও তাঁহার পরবর্ত্তী শিষ্যের সময় ১৬৬৫ সংবৎ বলিয়া লিখিত হইয়াছে। সিদ্ধাগণ যদি এতই দীর্ঘজীবী হন তাহা হইলে হিসাবের কাজটা বড়ই শক্ত হইয়া পড়ে। জ্ঞানেশ্বরীর প্রমাণে এরূপ হিসাব গোরক্ষনাথকে নবম শতাব্দীতে আনিয়া ফেলে। পালবংশীয় রাজা দেবপালের সময়ে গোরক্ষনাথের আবির্ভাব এরূপ মতও প্রচারিত হইয়াছে।[১১] এদিকে আবার গোরক্ষনাথকে অত্যন্ত প্রাচীন করিবার প্রবাদ এত অধিক যে, তাহা আলোচনা করিতে গিয়া ইতিহাস হতাশ হইয়া প্রত্যাবর্ত্তন করিতে বাধ্য হয়। গ্রীয়ার্সন এক নেপালীয় প্রবাদের উল্লেখ করিয়াছেন; তদনুসারে পঞ্চপাণ্ডবের মহা প্রস্থানকালে ভীমসেন ব্যতীত আর সকলেই প্রাণত্যাগ করিলেন। তখন গোরক্ষনাথ ভীমসেনকে নেপালের রাজা করিয়া দিলেন। পশ্চিম ভারতের প্রবাদানুসারে গোরক্ষনাথ সত্যযুগে পাঞ্জাবে, ত্রেতায় গোরখপুরে, দ্বাপরে হরমুজে এবং কলিতে কাঠিয়াগড়ে অবস্থিত। রসরত্নসমুচ্চয় নামক কবিরাজী রাসায়ণিক গ্রন্থে নিত্যনাথ, গোরক্ষনাথ প্রভৃতির নামোল্লেখ আছে। এই গ্রন্থের প্রণেতা আপনাকে বাগ্‌ভট বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়াছেন এবং তদনুসারে গ্রন্থের রচনাকাল খৃঃ ষষ্ঠ শতাব্দী বা তৎপূর্ব্ববর্ত্তী বলিয়া অনুমিত হইয়াছে।[১২] কিন্তু আচার্য্য ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায় নানারূপ যুক্তি দ্বারা প্রতিপন্ন করিয়াছেন যে, এই গ্রন্থ কখন অষ্টাঙ্গহৃদয় প্রণেতা বাগ্‌ভটের লেখনী-প্রসূত হইতে পারে না, ইহা খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ বা চতুর্দ্দশ শতাব্দীর গ্রন্থ।[১৩]

হাড়িপা  প্রচলিত মত অনুসারে হাড়িপা এই গোরক্ষনাথের শিষ্য ছিলেন। হাড়িপা সম্বন্ধেও নানা অদ্ভুত কাহিনী নানা দেশে প্রচার লাভ করিয়াছিল। ৺বাবু শরচ্চন্দ্র দাস বাহাদুর তিব্বতীয় গ্রন্থ হইতে তাঁহার যে বিবরণ ১৮৯৮ খৃঃ অব্দে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশ করেন, তাহার মর্ম্ম এইরূপ—

 বৌদ্ধ সিদ্ধা বালপাদ সিন্ধুদেশে নগরথটে কোন ধনবান্ শূদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বৌদ্ধধর্ম্ম গ্রহণ করেন এবং উদয়ন প্রদেশে (বর্ত্তমান স্বাত ও চিত্রন) গমন করতঃ যোগাভ্যাস করেন। সেখান হইতে জলন্দরে গিয়া বাস করেন, ইহাতে তাঁহার জলন্দরী আখ্যা হয়। তাহার পর নেপাল ও সেখান হইতে অবন্তী প্রদেশে গমন করেন। অবন্তীতে তাঁহার অনেক শিষ্য হয়, কৃষ্ণাচার্য্য তাহাদের অন্যতম। অবন্তী হইতে বালপাদ বাঙ্গালা দেশে আগমন করেন। বিমলচন্দ্রের পুত্র গোপীচন্দ্র তখন বাঙ্গালার রাজা, চাটিগ্রাম তাঁহার রাজধানী। গোপীচন্দ্র সৌখীন পুরুষ ছিলেন এবং অনেক সময়ে দর্পণে নিজ মুখ নিরীক্ষণ করিতেন।[১৪] উদ্যানে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য সিদ্ধা নারিকেল-জল পান করিতে ইচ্ছুক হওয়ায়, নারিকেল আপনি তাঁহার মুখের নিকট আসিল ও জলদান করিয়া স্বস্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করিল। রাজমাতা ইহা দেখিতে পাইয়া হাড়িবেশী সিদ্ধপুরুষকে আহ্বান করিতে রাজাকে অনুজ্ঞা করিলেন। রাজা তাঁহাকে ডাকিলেন, তিনিও রাজার কর্ণে মন্ত্র দিলেন। সিদ্ধা শূন্যবাদের প্রশংসা করিতে লাগিলেন এবং রাজা তাঁহাকে প্রতারক মনে করিয়া জীবিতাবস্থায় ভূপ্রোথিত করিয়া ফেলিলেন। হস্তী ও অশ্বের বিষ্ঠা সেই স্থানের উপরিভাগে নিক্ষিপ্ত হইল এবং তাহার উপরে কণ্টকপূর্ণ উদ্ভিদ জন্মিতে লাগিল। ইহার পর বার বৎসর পরে কৃষ্ণাচার্য্য কর্ত্তৃক তাঁহার উদ্ধার বর্ণিত হইয়াছে। ইহাতে হাড়ি সিদ্ধার অন্য যে কথাই থাকুক, তাঁহার সময় নিরূপণের উপযোগী কোন উপকরণই পাওয়া যাইতেছে না।

 দেখা যাইতেছে গোরক্ষনাথ ও হাড়িপার সময় নিরূপণ করতঃ তাহা হইতে গোপীচন্দ্রের সময় নিরূপণের চেষ্টা আমাদের বর্ত্তমান উপকরণের সাহায্যে সফল হইবার আশা নাই। অগত্যা আমাদিগকে অন্য স্থান হইতে সেই উপকরণ সংগ্রহের চেষ্টা করিতে হইবে।

রাজেন্দ্র চৌলের শিলালিপি  দাক্ষিণাত্যের রাজেন্দ্র চোল দেবের তিরুমলয়ে উৎকীর্ণ শিলালিপির মর্ম্ম অনেকেই জানেন।[১৫] এই লিপির মতে তিনি দণ্ডভুক্তিতে ধর্ম্মপাল, দক্ষিণ রাঢ়ে রণশূর, বাঙ্গলার রাজা গোবিন্দচন্দ্র ও উত্তর রাঢ়ে মহীপালকে পরাস্ত করেন। আমাদের গোপীচন্দ্রকে অনেক স্থলে গোবিন্দচন্দ্র বলা হইয়াছে, দুর্লভ মল্লিকের গ্রন্থে ও উড়িষ্যার গাথায় তিনি একেবারে গোবিন্দচন্দ্র। ১৩১৫ সালে আমি লিখিয়াছিলাম “তিরমলয়ের উৎকীর্ণ শিলালিপিতে যে গোবিন্দচন্দ্রের উল্লেখ দৃষ্ট হয় সে গোবিন্দচন্দ্র ময়নামতীর পুত্র বলিয়া ধরিয়া লওয়া কতকটা দুঃসাহসেব কাজ”।[১৬] গোপীচন্দ্র রংপুরের প্রাদেশিক রাজা বলিয়াই তপন ধরিয়া লওয়া হইয়াছিল। ভবানীদাস কবির ও শুকুর মামুদের গ্রন্থ তখনও আবিষ্কৃত হয় নাই এবং ত্রিপুরার ময়নামতী পাহাড়ে যে গোপীচন্দ্রের কীর্ত্তির ভগ্নাবশেষ বিদ্যমান তাহাও তখন সাধারণের অপরিজ্ঞাত ছিল। এখন ইহা বলা যাইতে পারে যে, গোপীচন্দ্র নিতান্ত ক্ষুদ্র রাজা ছিলেন না, বা রংপুরের অংশবিশেষে মাত্র তাঁহার শাসনদণ্ডের প্রভাব আবদ্ধ ছিল না। তিনি বঙ্গের রাজা ছিলেন, একথা অনেক স্থলেই উক্ত হইয়াছে। তাহার রাজধানী খাঁটি বঙ্গের মধ্যে থাকুক আর নাই থাকুক আমাদের বর্ত্তমান জ্ঞানে তাঁহাকে বঙ্গেশ্বর বলিয়া অনায়াসে গ্রহণ করা যাইতে পারে। শিলালিপিব গোবিন্দচন্দ্রের সহিত অভিন্নতা ও বিরুদ্ধ প্রমাণ উপস্থিত না হওয়া পর্য্যন্ত, স্বীকার করিয়া লইলে বোধ হয় ইতিহাসের মর্য্যাদা লঙ্ঘিত হইবে না। রাজেন্দ্র চোলের রাজত্ব কাল খৃঃ একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। প্রায় এই সময়ে পূর্ব্ববঙ্গে চন্দ্রউপাধিধারী এক বংশের রাজত্ব দেখিতে পাওয়া বঙ্গে চন্দ্রবংশ  যায়। এই বংশীয় শ্রীচন্দ্রদেবের তিন খানি তাম্রকলক আবিষ্কৃত হইয়াছে।[১৭] উহাতে সন তারিখ না থাকিলেও অক্ষরদৃষ্টে বিশেষজ্ঞেরা উহা দশম কি একাদশ শতাব্দীর লিপি বলিয়া মনে করেন। ইহাব দুইখানি ফরিদপুর জেলায় আবিষ্কৃত, অপর খানির প্রাপ্তিস্থান ঢাকা জেলার প্রাচীন রামপাল নগর। শিলালিপিতে শ্রীচন্দ্রদেবের পূর্ব্বপুরুষদিগের নাম এইরূপ পাওয়া যায়—

পূর্ণচন্দ্র
সুবর্ণচন্দ্র
ত্রৈলোক্যচন্দ্র

মহারাষ্ট্রীয় মতে গোপীচন্দ্রের পিতার নাম ত্রৈলোক্যচন্দ্র পূর্ব্বেই উক্ত হইয়াছে। দুর্ল্লভ মল্লিকের গানে মাণিকচন্দ্রের পিতা ও পিতামহের নাম সুবর্ণচন্দ্র ও ধাড়িচন্দ্র। দুইটী নামের মিল দেখিয়াই গোপীচন্দ্র বা গোবিন্দচন্দ্রের সহিত তাম্রফলকে উক্ত ব্যক্তিগণের সম্বন্ধ স্থির করিয়া ফেলা প্রকৃত ঐতিহাসিকের কার্য্য নহে। কিন্তু এই সকল তাম্রফলকের প্রমাণে ইহা স্পষ্টই দেখিতে পাওয়া যায় যে, যে সময়ে রাজেন্দ্রচোল তিরুমলয়ে বঙ্গাধিপ গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজয় করার গর্ব্ব অনুভব করিতেছিলেন তাহারই নিকটবর্ত্তী সময়ে বঙ্গদেশে চন্দ্রউপাধিধারী আরও রাজার অভাব ছিল না। ইহাতে গিরিলিপির গোবিন্দচন্দ্র যে তারলিপির শ্রীচন্দ্রের জ্ঞাতি, এই অনুমানই স্বাভাবিক। পরম্পরাগত প্রবাদ দীর্ঘকাল পরে অনেক সময়েই সম্বন্ধ বিপর্য্যয় ঘটাইয়া দেয়, কিন্তু বঙ্গের ভিতরের ও বাহিরের গাথার কোন কোন নাম যে তাম্রপট্টের কোন কোন নামের সহিত ঠিক মিলিয়া যাইতেছে, ইহাও গোপীচন্দ্রের এই বংশ-সম্ভূত হওয়ার অনুকূল প্রমাণ বলিয়াই মনে হয়। বঙ্গদেশে আবিষ্কৃত তাম্রলিপিতে গোপচন্দ্র নামে আর একটী রাজার পরিচয় পাওয়া যায়।<ref>Indian Ant: 1910</ref কিন্তু তাঁহার সময় খৃঃ ষষ্ঠ শতাব্দী বলিয়া অনুমান করা হইয়া থাকে। ডাঃ হর্ণলি এই গোপচন্দ্র ও আমাদের গোপীচন্দ্র অভিন্ন অনুমান করেন; কিন্তু বিভিন্ন দেশীয় প্রবাদ গোপীচন্দ্রের সময় যতই তিমিরাচ্ছন্ন করিয়া রাখুক, তিনি যে এত প্রাচীন কালের লোক এরূপ মনে করা কঠিন। অষ্টম শতাব্দী হইতে দশম শতাব্দী পর্য্যন্ত বঙ্গদেশের ইতিহাস গাঢ় কুহেলিকায় আচ্ছন্ন। ত্রিপুরা জেলার উত্তরাংশে আবিষ্কৃত দেবমূর্ত্তির পাদলিপি হইতে জানা যায়, দশম শতাব্দীর শেষভাগে মহীপাল দেবের রাজত্ব সমতট পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল।<ref>Vole J.A.S B 1915. ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন ১৩১১।</ref তৎপূর্ব্বে শূরবংশ বা পালবংশের গোপীচন্দ্রের আনুমানিক সময় প্রভাব নিম্নবঙ্গে কতদূর বিস্তৃত ছিল বলা যায় না। এই অন্ধকার যুগের কোন সময়ে মাণিকচন্দ্র ও গোপীচন্দ্রের বঙ্গদেশে রাজত্ব করা অসম্ভব নহে, তবে তাহার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নাই। পক্ষান্তরে রাজেন্দ্র চোলের অভিযানকালে যে ঝড়বৃষ্টিপূর্ণ ‘বঙ্গাল’ দেশে গোবিন্দচন্দ্র নামে এক রাজা রাজত্ব করিতেন তাহা নিঃসন্দেহ। ইণ্ডিয়া অফিসের পুস্তকতালিকায় (Catalogue no 2739 m.m. 138le) এক গোবিন্দচন্দ্রের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। শব্দপ্রদীপ-রচয়িতা সুরেশ্বর স্বীয় পরিচয়ে লিখিয়াছেন যে, তিনি ভীমপাল নৃপতির বাজবৈদ্য, তাঁহার পিতা ভদ্রেশ্বর রাজা রামপালের প্রধান চিকিৎসক এবং ভদ্রেশ্বরের পিতামহ দেবগণ গোবিন্দচন্দ্রের রাজসভায় “বৈদ্যগণাগ্রণী” ছিলেন। শব্দপ্রদীপের রাজা গোবিন্দচন্দ্র ও রাজেন্দ্রচোলের গোবিন্দচন্দ্র সম্ভবতঃ অভিন্ন। এই হিসাবে খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে গোপীচন্দ্র বা গোবিন্দচন্দ্রের আবির্ভাব ধরিয়া লইতে পারা যায়। তিনি আরও প্রাচীন কালের লোক হইতে পারেন, কিন্তু পরবর্ত্তীকালের লোক হওয়া সম্ভব নহে।

হরিশ্চন্দ্র, অদুনা ও পদুনা  গোপীচন্দ্রের শ্বশুর হরিশ্চন্দ্র বা হরিশ্চন্দ্র রাজা কোন্ স্থানের লোক ছিলেন, তাহাও জানিবার উপায় নাই। দুর্ল্লভ মল্লিক ইঁহার বাসস্থান কাঞ্চনানগর বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন এবং অদুনার মুখ হইতে নগরের গড় ও স্বর্ণহীরকাদি ঐশ্বর্য্যের বর্ণনা বাহির করিয়া গোবিন্দচন্দ্রকে (বা পাঠককে) চমৎকৃত করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। মহারাষ্ট্রীয় গাথায় কিন্তু গোপীচন্দ্রের নিজের রাজধানী কাঞ্চননগর। হয়ত কাঞ্চননগর বা কাঞ্চনা নগরের উল্লেখ প্রাচীন সুবিখ্যাত কর্ণসুবর্ণের স্মৃতির পরিচয় মাত্র। ইহার কোন ঐতিহাসিক মূল্য আছে বলিয়া মনে হয় না। রংপুর জেলায় ময়নামতীর কোটের অদূরে (ধর্ম্মপাল হইতে ৭।৮ মাইল ব্যবধানে) হরিশ্চন্দ্র পাট বিদ্যমান। গ্রামের নাম এবং স্থানীয় প্রবাদ ও ধ্বংসাবশেষ হরিশ্চন্দ্রের অতীত মহিমার সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। দুইটী বৃহৎ মৃত্তিকাস্তূপ এখনও পার্শ্ববর্ত্তী লোকের বিস্ময়োৎপাদন করিতেছে। একটীর মধ্যে রাজার সমাধি ছিল বলিয়া ডাঃ গ্রীয়ার্সন উল্লেখ করিয়াছেন। এই স্তূপ এখন বিপর্য্যস্ত ও ইহার উপকরণ স্থানান্তরিত, কিন্তু এক সুবৃহৎ প্রস্তর-খণ্ড এখনও বিস্তৃত সমতল ক্ষেত্রের মধ্যে আপনার একমাত্র অবস্থান জনিত গৌরব উপভোগ করিতেছে। এই গ্রামে গোপীচন্দ্রের সহিত অদুনা ও পদুনার প্রথম-প্রণয় সম্মিলন হইয়াছিল কিনা তাহা বিবেচনার বিষয়। ঢাকা জেলার সাভার গ্রামে হরিশ্চন্দ্র নামে এক বিখ্যাত রাজা ছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি তাঁহার পুত্র মহেন্দ্রের যে সংস্কৃত লিপি প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে তাঁহার সময়ের সহিত গোপীচন্দ্রের সময়ের সামঞ্জস্য রাখা কঠিন হইয়া পড়ে।[১৮] ইহা ব্যতীত ইহাতে হরিশ্চন্দ্রের যে বংশপরিচয় আছে তাহাতে তাঁহাকে গন্ধবণিক বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায় না।

গীতোক্ত অন্যান্য ব্যক্তি  অদুনা ও পদুনা ব্যতীত ভবানীদাস ও সুকুরমামুদ যে অন্য রাণীদের নামোল্লেখ করিয়াছেন, অন্য কোন গাথায় তাহার কোন সমর্থক প্রমাণ নাই। এই নামগুলি কতদূর ঐতিহাসিক তাহা সন্দেহের বিষয়। ভবানীদাসের গাথোয় গোপীচন্দ্রের বিবাহ সম্বন্ধে কয়েকটী ছত্র বিশেষ প্রণিধান-যোগ্য—

আর বিভা করাইলা খাণ্ডাএ জিনিয়া।
আর বিভা করাইলা উরয়া রাজার মাঁইয়া॥
দস দিন লড়াই কৈল উড়য়া বাজার সনে।
চৌদ্দ বুড়ি মনুষ্য কাটিলাম এক দিনে॥
চৌদ্দপন মনুষ্য কাটি সাতশত লস্কর।
হস্তী ঘোড়া কাটিলাম তেসট্টি হাজার॥
যুদ্ধেত হারিয়া নৃপ গেল পলাইয়া।
তার বেটী বিভা কৈলাম মহিম জিনিয়া।

—(৩১-৩২ পৃঃ) 

এই “উরয়া” বা উড়িয়া রাজা রাজেন্দ্রচোল বলিয়া অনুমিত হইয়াছেন। একথা ঠিক যে, তিরুমলয়ে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে রাজেন্দ্রচোলের বঙ্গাভিযানের সম্পূর্ণ বিবরণ নাই। তিনি প্রথমে বিজয় লাভ করিয়া থাকিলেও শেষে মহারাজ মহীপাল কর্ত্তৃক প্রতিহত হন, গঙ্গার অপর পারে যাইতে সমর্থ হন নাই। আর্য্য ক্ষেমীশ্বর রচিত চণ্ডকৌশিক নাটকে এই কর্ণাটক-নিপাতের উল্লেখ আছে। এই বহিঃশত্রু নিবাকরণে গোপীচন্দ্রের সহায়তা ও তৎকর্ততৃক যুদ্ধ-বিজয়ের পর চোলরাজের সঙ্গিত বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন অবশ্য অসম্ভব ব্যাপার নহে। কিন্তু সমস্ত অনুমানটা এতই সূক্ষ্ম সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, ঐতিহাসিকের পক্ষে ইহার মধ্যে জোর করিয়া বলিবার কোন কথাই নাই। “খাণ্ডাই” উড়িষ্যাদেশীয় খাণ্ডাইত হইতে পারে।

 রংপুরের গানের এই কয়েকটী নামও উল্লেখ যোগ্য—

 খেতুয়া—ময়নামতীর পালিত পুত্র এবং গোপীচন্দ্রের প্রধান কিঙ্কর ও সহচর। অন্য দুই গানেও উল্লেখ থাকায় ইহাকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।

 ভাট দুগ্‌গাবর—অন্য কোন গানে উল্লেখ নাই, ভবানীদাস ভাট দামোদর লিখিয়াছেন।

 হরি পুরন্দর—ইহাদের নামও অন্য কোথাও নাই।

 হেমাই পাত্র—সুকুর মামুদ মনোহর পাত্রের উল্লেখ করিয়াছেন।

 চান সদাগর ও বালা লখিন্দর—ভলানীদাসের গ্রন্থেও সাউধ লক্ষ্মীধরের নামোল্লেখ আছে। এক জাতীয় ও বিখ্যাত লোক বলিয়া এক সঙ্গে নামোল্লেখ আশ্চর্য্য নহে। গোপীচাঁদ ও চান্দসদাগর বা তাঁহার পুত্র লখিন্দর সমসাময়িক লোক মনে করিবার যথেষ্ট উপকরণ নাই।

 বামন সন্তিঘর—ভবানীদাসের গ্রন্থে ব্রাহ্মণ সন্ধিহর; লোকটী ঐতিহাসিক হইতে পারে। ভবানীদাস ইহার যে ব্রহ্মতেজের পরিচয় দিয়াছেন তাহা সকল সময়ে সকল দেশেই সম্মান-যোগ্য। “ব্রাহ্মণের ধড়ে কভু মিথ্যা বাক্য নাহি”, রাজার বিরুদ্ধে এমন তেজোগর্ভ বাক্যে সত্যের প্রতিষ্ঠা করিতে কয়জন সাহসী হয়?

 রাজা জল্পেশ্বর—অবশ্য জলপাইগুড়ী জেলার জল্পেশ্বর শিব মন্দিরের সংসৃষ্ট—ইঁহাকে গোপীচাঁদের সমসাময়িক মনে করিবার বিশেষ কারণ নাই।

 বিরসিং ভাণ্ডারী—অন্য কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। রংপুরের গাথা ও ভবানীদাসের গ্রন্থে হীরানটীর নামোল্লেখ আছে, সুকুর মামুদের মতে ইহার নাম সুলোচনী বেশ্যা।

রংপুর ও ত্রিপুরাজের গোপীচন্দ্রে বাসস্থানের প্রবাদ  পূর্ব্বে রংপুর অঞ্চলের গাথা আলোচনা করিয়া আমি গোপীচন্দ্রকে বাজবংশী জাতীয় বলিয়া অনুমান করিয়াছিলাম এবং তাঁহার রাজধানী রংপুর জেলার পাট্‌কাপাড়ায় ছিল, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলাম। পরে যে গ্রন্থগুলি আবিষ্কৃত হইয়াছে তদনুসারে তিনি ত্রিপুরা জেলার মেহেরকুল পরগণার রাজা। ভবানীদাস অনেক স্থলেই তাঁহাকে মেহারকুলের রাজা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন যথা—

“আমি বাড়ি বান্ধিয়াছি মেহারকুল সহর”

উত্তরবঙ্গের মুসলমান কবি সুকুর মামুদও মাণিকচন্দ্র ও গোপীচন্দ্রকে “মৃকুল” বা মেহেরকুলের রাজা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। এ অবস্থায় প্রবাদটী উড়াইয়া দেওয়ার নহে। রংপুরে সংগৃহীত গাথায় রাজার বাসস্থানের উল্লেখ নাই, তবে সেখানে “ময়নামতীর কোট,” “পাট্‌কাপাড়া,” “হরিশ্চন্দ্র পাট” প্রভৃতি স্থান এখনও প্রদর্শিত হইয়া থাকে। দুর্ল্লভ মল্লিক কৃত গোবিন্দচন্দ্রের গানে তাঁহাব রাজধানী “পাটিকানগর” বলিয়া লিখিত হইয়াছে। কিন্তু এই পটিকানগর কোথায় তাহার বিবরণ নাই। রংপুর নীলফামারী মহকুমার অন্তর্গত হরিণচরা ও আটিয়াবাড়ী গ্রামে ময়নামতীর কোট। গানে ময়নামতীকে ফেরুসা নগরে নির্ব্বাসিত করার কথা আছে। এই স্থান প্রাচীন ফেরুসা নগর কিনা তাহা বিবেচ্য। এই স্থান পরিদর্শনের পর ১৩১৩ সালের ভারতীতে আমি লিখিয়াছিলাম যে, এই কোটের “চতুর্দ্দিক্‌স্থ মৃন্ময় প্রাকার কালের নানা অত্যাচার সহ্য করিয়া ক্ষীণকায় হইলেও এখনও দীর্ঘকাল জীবিত থাকিবার আশা রাখে। প্রাকারের নিম্নস্থ পারখাও সম্পূর্ণরূপে পঞ্চভূতে বিলীন হয় নাই...”। পাট্‌কাপাড়া গ্রাম ময়নামতীর কোটের অদূরবর্ত্তী। এখানে প্রাচীন অট্টালিকার বহু ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়াছে। এক্ষণে ইহার সমৃদ্ধির কিছুই নাই। ইষ্টকস্তূপও নিষ্ঠুর হস্তে পড়িয়া লৌহ-বর্ত্ম নির্ম্মাণের সহায়তা করিয়াছে।

 ময়নামতীর কোটের অদূরে হাড়িপার বাসস্থানেরও প্রবাদ আছে।[১৯]

 যে স্থানে হীরা নটীর ধন খাপরায় পরিণত হইয়াছিল বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে, সেই স্থান সম্ভবতঃ বর্ত্তমান পার্ব্বতীপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের অনতিদূরবর্ত্তী খোলাহাটী।

 ১৩২৪ সনের বৈশাখের ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন পত্রে শ্রীযুক্ত কালিদাস রায় রংপুর সম্বন্ধে বলেন “এই জেলার পাটওয়ারী নামক স্থান গোপীচন্দ্রের পাট বলিয়া খ্যাত। তাঁহার দুই পত্নী অদিনা ও পদিনার সত্য জীবনের স্থতি স্বরূপ উদিনা পুদিনা নামক দুটী বিল এখানে বর্ত্তমান। রাণী ময়নামতীর স্থান নির্দ্দেশ সম্বন্ধে ঐতিহাসিকেরা নানা প্রকার মত প্রচার করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহারা এই দেশের প্রবাদ, প্রসঙ্গ ও প্রদর্শিত স্মৃতিস্থলগুলির বিষয় আলোচনা করিলে তাঁহার প্রকৃত স্থান নির্দ্দেশ করিতে পারিবেন।”

ত্রিপুর ময়নামতী পাহাড়ে মূল রাজধানী থাকার প্রমাণ  এই সকল নিদর্শন হইতে রংপুরের এই অঞ্চল যে ময়নামতী ও গোপীচন্দ্রের সহিত সংসৃষ্ট ইহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু ত্রিপুরা জেলায় যে সকল প্রবাদ ও অতীত কীর্ত্তির নিদর্শন ক্রমশঃ পাওয়া যাইতেছে, ভবানীদাস ও সুকুর মামুদ যে ভাবে মেহেরকুলের বর্ণনা করিয়াছেন, তাগতে মনে হয় যে, লালমাই পর্ব্বতের অংশ বিশেষ—যাহাকে এক্ষণে ময়মামতীর পাহাড় বলা হয়—সেইখানেই গোপীচন্দ্রের মূল রাজধানী অবস্থিত ছিল। এখানে ময়নামতী ও গোপীচন্দ্রের বাসস্থানের ধ্বংসাবশেষ, অদুনামুড়া, পদুনামুড়া এবং গোরক্ষনাথ ও ময়নামতীর মহাপ্রস্থানের সুড়ঙ্গ এখনও প্রদর্শিত হইয়া থাকে। অদূরে শালবানপুর গ্রামে হাড়িপার বাসস্থানের কিম্বদন্তী আছে। লালমাই পাহাড়ের টপ্‌কাম্‌ড়া নামক এক শৃঙ্গে বিনষ্ট ও ভূগর্ভে নিহিত এক ভগ্ন দেবালয়ে কৃষ্ণপ্রস্তর-নির্ম্মিত অতি ক্ষুদ্র একটা বুদ্ধমূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। এই মূর্ত্তির তলদেশে প্রাচীন বঙ্গাক্ষরে উৎকীর্ণ একটী পংক্তি আছে—তাহা “যুবরাজ শ্রীজয়চন্দ্রস্য” বলিয়া পঠিত হইয়াছে।[২০] কুমিল্লা হইতে শ্রীযুক্ত বৈকুণ্ঠনাথ দত্ত মহাশয় এই গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক ডাঃ দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের নিকট এক পত্রে লিখিয়াছেন, যে স্থানে এই মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে তাহা “মাণিকচন্দ্রের বিনষ্ট বাসভবনের ২০০ কি ৩০০ গজ দূরবর্ত্তী”। ময়নামতী পাহাড়ের তিন মাইল দূরবর্ত্তী ভারেল্লা গ্রামে একটি নটেশ মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে, তাহার পাদদেশে লয়হচন্দ্র নামক অপর একটী চন্দ্র-উপাধিধারী ব্যক্তির নাম উৎকীর্ণ। বৈকুণ্ঠ বাবু ডাঃ দীনেশচন্দ্র সেনের নিকট প্রস্তর-নির্ম্মিত ক্ষুদ্র একটী হর-গৌরী মূর্ত্তি পাঠাইয়া দিয়াছেন। ময়নামতী পহাড়ে যে বহু দেবালয়ের ধ্বংসস্তূপ বর্ত্তমান রহিয়াছে তাহার একটী স্তূপে ইহা পাওয়া গিয়াছে। এই মূর্ত্তিতে শিবের চারিটি হাত, তিনি গৌরীর চিবুকে হাত দিয়া আছেন, উভয়েই বাহনোপরি। লালমাই পর্ব্বতের নিম্নদেশে যুগী জাতীয় বহুলোকের বাস[২১]। শ্রীযুক্ত বৈকুণ্ঠনাথ দত্ত মহাশয় এই জেলার দিশানন্দ বাজপুর গ্রামের বৈরাগীবাড়ী হইতে নাথ সিদ্ধাগণের বৃত্তান্তমূলক ব্যাস নামক কোন কবিব ভণিতাযুক্ত ব্রহ্মযোগ নামক হস্তলিখিত এক খানি ক্ষুদ্র গ্রন্থ পাইয়াছেন; ইহাতে মৎসেন্দ্রনাথ, গোরক্ষনাথ, হাড়িপা, কানুপা, বিন্দুনাথ ও চৌরঙ্গীনাথ প্রভৃতির উল্লেখ আছে। এই সকল বৃত্তান্ত হইতে বুঝাযায় যে, এ অঞ্চলে একসময়ে যুগী জাতির বিলক্ষণ প্রভাব ছিল এবং গোপীচন্দ্র ও ময়নানতীর স্মৃতি-জড়িত লালমাই পাহাড়ই সেই প্রভাবের কেন্দ্রস্থল। এই পর্ব্বতে উনশত রাজার বাসস্থান বলিয়া প্রবাদ বহুদিন হইতে চলিয়া আসিতেছে।

 মেহেরকুল ও পাটিকারা ২টী পরস্পর সংলগ্ন পরগণা এখনও ত্রিপুরা জেলায় বর্ত্তমান। লালমাই পর্ব্বত এই দুই পরগণার প্রায় সন্ধিস্থলে অবস্থিত, কুমিল্লা হইতে ৪।৫ মাইল পশ্চিমে। মেহেরকুলে গোপীচন্দ্রের বাসস্থান সম্বন্ধে বিবরণ ঐ অঞ্চলে সংগৃহীত অন্য প্রাচীন গ্রন্থেও পাওয়া গিয়াছে। বর্ত্তমান কুমিল্লা সহর মেহেরকুল পরগণার অন্তর্গত।

 অনেক গ্রন্থের মতেই সিদ্ধাদিগের মধ্যে গোরক্ষনাথ মীননাথের শিষ্য, হাড়িপা গোরক্ষনাথেরশিষ্য, কানুপা হাড়িপার শিষ্য। ইঁহাদের সকলের এক সময়ে জন্মও গোরক্ষবিজয় বা মীনচেতন গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে। মুন্সী আবদুল করিম সম্পাদিত গোরক্ষবিজয় কাব্যে পাই—

বদনে জন্মিল শিব জোগিরূপ ধরি।
সিরেত উত্তম জটা শ্রবণেত কোড়ি॥
নাভিতে জর্ম্মিল মীন গুরু ধনন্ত্বরি।
সাক্ষাতে সিদ্ধার ভেস অনন্ত মুরারি॥
হাড়িফার জন্ম হইল হাড় হোতে।
সর্ব্ব অঙ্গে সিদ্ধার ভেস দেখিএ সাক্ষাতে॥ (পৃঃ ৬-৭)

কথিত আছে একবার দুর্গাদেবী সিদ্ধাদিগের মন পরীক্ষার জন্য তাঁহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া স্বয়ং ভুবনমোহিনী বেশে পরিবেশন করেন। তাঁহার রূপ লাবণ্যে সকলেরই (কোন মতে গোরক্ষনাথ ব্যতীত আর সকলের) মন টলিল। ফলে দেবী তাঁহাদিগকে অভিশাপ দিলেন। গোরক্ষবিজয় গ্রন্থে পাই—

তবে মনে চিন্তিলেক হাড়িফা সিধাই।
এমন সোন্দরি তবে আহ্মি যদি পাই॥
হাড়ি কর্ম্ম করি যদি থাকি তার পাশ।
পাইতে সোন্দরি মোর মনে হাবিলাস॥
হাসিয়া বোলেন দেবী পাইলে এহি বর।
হাড়িরূপ ধরি জাও মনামতি ঘর॥
হাতে ঝাড়ু লও (তুহ্মি) কাঁধেতো কোদাল।
চলহ আহ্মার আঙ্গাএ বর পাইলা ভাল॥ (পুঃ ১৯-২০)।

পাদটীকায় পাঠান্তরে পাই—

হাতে ঝাটা লও তুমি কান্ধেত কোদাল।
মেহারকুলেতে চল বর পাইলা ভাল॥

ইহার পর এক স্থানে কানুফাকে গোরক্ষ নাথ বলিতেছেন—

তোর গুরু বন্দী হইছে মেহারকুল দেশ।
নিশ্চয় জানম মই তাহার উদ্দেশ॥

মেহারকুলেত আছে জ্ঞানী এক জানি।[২২]
মৈনামতি নাম তার রাজার ঘরিণী॥
ঈশ্বরের হোতে সেই পাইল মহাজ্ঞান।
জ্ঞানী নাহি পৃথিবীতে তাহর সমান॥
বিধবা জে নারী পুত্র রাজরাজেশ্বর।
দৈবগতি হাড়িফা বঞ্চয়ে তার ঘর॥
তার পুত্রে গুরু তোর বান্ধিয়া রাখিল।
মাটীর করিয়া ঘর তাহারে থুইল॥
হস্তী যেন বান্ধি রাখে তাহার উপর।
নিরন্তর থাকে সিদ্ধআ মাটির ভিতর॥ (পুঃ ৪৩—৪৪)।

শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টাশালী সম্পাদিত মীনচেতন গ্রন্থে, দুর্গা দেবীর শাপ দেওয়ার পরে

তবে সিদ্ধা চলি গেলা যার যেই ঘরে।
প্রথমে হাড়িফা গেল মৈনামতির ঘরে॥
ত্বরিত গমনে গেল মৈনামতির পুরি।
তথা গিয়া রহিলেক হাড়িরূপ ধরি॥

গোর্ক্ষ নাথ চলি গেল বঙ্গ নিকেতন। ইত্যাদি (পৃঃ ৪)

অন্যত্র—

কানাইর বচনে গোর্ক্ষে আ (শ্বাস) বিশেষ।
তোমার গুরুর আমা হইতে শুনহ উদ্দেশ॥
বন্দী হৈছে তোমার গুরু মেহারকুলেতে।
নির্ণয়ে দেখিল আমি কহিল তোমাতে॥
মেহারকুলেত আছে বড়হি ডাকিনি।
মৈনামতি নাম তার রাজার ঘরিনী॥
বিধবা রমনী সে যে পুত্র রাজেশ্বর।
দৈবগতি হাড়িফাএ বঞ্চে তার ঘর॥

তার পুত্র গুপিচান্দে বান্ধিয়া রাখিল।
মাটির করিয়া গড় তাহাকে থুইল॥
হস্তি সব বান্দি থাকে তাহার উপর।
রাত্রি দিন বঞ্চে সিদ্ধা তাহার ভিতর॥ (পৃঃ ৯)

পাটিকারায় রাজবংশ সুকুর মামুদের গ্রন্থে মাণিকচন্দ্র ও গোপীচন্দ্রের রাজধানী “মৃকুল সহর” বলিয়া স্পষ্টই বর্ণিত হইয়াছে। এ সমস্তই ময়নামতী পাহাড়ে গোপীচা^দের রাজধানী থাকার পক্ষে অনুকূল প্রমাণ। দুর্ল্লভ মল্লিক দেবীর শাপের পরিবর্ত্তে “গুরু সাঁপ” এর উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহার পাটিকা নগর কোথায় তাহার পুনরালোচনা করার সময় আসিয়াছে। পূর্ব্বে ময়নামতীর পাহাড়ের সমীপবর্ত্তী পাটিকারা পরগণার উল্লেখ করা হইয়াছে। পাটিকারা যে একটী রাজ্য ও প্রসিদ্ধ স্থান ছিল তাহা ব্রহ্মদেশের ইতিহাস ও স্থানীয় কিংবদন্তী হইতে আমরা পাই।

 কৈলাসচন্দ্র সিংহ মহাশয় বলিয়াছেন, দশম শতাব্দীতে পাটিকারা কমলাঙ্ক রাজ্যের রাজধানী ছিল। ব্রহ্মদেশে ৯৭৯ শকাব্দে ধ্যানশিশা সিংহাসনারোহণ করার পর পাটিকারার রাজকুমার তাঁহার রাজ্যে গমন করেন এবং তাঁহার ঔরসে ব্রহ্ম রাজকুমারীর গর্ভে এক পুত্র জন্মে। এই পুত্র ও তাঁহার পরবর্ত্তী রাজগণ পাটিকারার রাজবংশের সহিত জ্ঞাতিত্ব ভাব রাখিতে যত্নবান্ ছিলেন।[২৩]

সরকারী সেটলমেণ্ট রিপোর্ট  ১৮০৩ খৃঃ অব্দে ময়নামতী পাহাড়ে ১১৪১ শকাব্দাঙ্কিত রণবঙ্ক মল্লের একটী তাম্র শাসন পাওয়া যায়। এই তাম্রশাসনে পট্টিকেবা বা পট্টিকেরা নগরের উল্লেখ আছে।[২৪] খুব সম্ভবতঃ পাটিকারা সংস্কৃতে পট্টিকেরা নগরে পরিণত হইয়াছে এবং ময়নামতী পাহাড়ের উপরেই এই রাজধানীর সংস্থান ছিল।[২৫] গভর্ণমেণ্ট কর্ত্তৃক প্রকাশিত পাটিকারা পরগণার সেটেলমেণ্ট রিপোর্টে লিখিত হইয়াছে যে, এক্ষণে পাটিকারা নামক কোন গ্রাম নাই, চান্দিনা গ্রামে জমিদারী কাছারীর উত্তবে এক পুষ্করিণী আছে, সম্ভবতঃ তাহার পাড়েই কমলাঙ্ক রাজ্যের রাজধানী ছিল। এই সকল প্রমাণ বা অনুমান হইতে পাটিকারা নামক একটা নগর যে কোন কালে এই অঞ্চলে ছিল এবং তাহাই দুর্ল্লভ মল্লিকের গ্রন্থে পাটিকানগরে পরিণত হইয়াছে এরূপ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক হইবে না। রাজার বাসগ্রহ-বর্ণনায় যে সবঙ্গা নলের বেড়ার উল্লেখ আছে, তাহাও যেন মুলী বাঁশের দেশের দিকেই অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিতেছে। রংপুর জেলার অন্তর্গত পাট্‌কাপাড়া গ্রামের পক্ষে যে দাবী আমি পূর্ব্বে উপস্থিত করিয়াছিলাম, নবাবিষ্কৃত প্রমাণে তাহা অত্যন্ত দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছে।

শ্রীচন্দ্রদেবের তাম্রশাসনে রোহিতাগিরি  পূর্ব্বে যে শ্রীচন্দ্রদেবের উল্লেখ করা হইয়াছে, তাঁহার তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে, চন্দ্রদিগের “রোহিতাগি[রি]ভুজাং” বংশে পূর্ণচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহার নাম দেববিগ্রহের পাদমূলে, জয়স্তম্ভ প্রভৃতি স্থানে পরিব্যাপ্ত ছিল। সুবর্ণচন্দ্র তাঁহার পুত্র, সুবর্ণচন্দ্রের পুত্র ত্রৈলোক্যচন্দ্র চন্দ্রদ্বীপের রাজা হন। তিনি হরিকেল-রাজের (বঙ্গেশ্বরের) প্রধান সহায় ছিলেন। তৎপুত্র শ্রীচন্দ্র একচ্ছত্র নৃপতি হইয়া পড়েন। এই “রোহিতাগিরি” লালমাই পর্ব্বতের সংস্কৃত নাম বলিয়া অনুমিত হইয়াছে। এই যুক্তিও চন্দ্রবংশীয় রাজাদিগের প্রথমাবস্থায় লালমাই-ময়নামতী পাহাড়ে অবস্থিতির সিদ্ধান্তের পক্ষেই অনুকূল এবং গোপীচন্দ্রের প্রধানতঃ মেহেরকুলে অবস্থানেরই পোষক, তবে গোপীচন্দ্রের রাজত্ব যে ময়নামতীর পাহাড়ের নিকটবর্ত্তী স্থানেই আবদ্ধ ছিল, ইহা হইতে এরূপ মীমাংসায় উপনীত হওয়া যায় না। রংপুর জেলায় যে সমস্ত পুরাতন স্মৃতিপূর্ণ স্থানের সংস্থান দেখিতে পাওয়া যায় তাহাতে সেখানেও যে তাঁহার বিলক্ষণ প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল এই মীমাংসাই স্বাভাবিক। সর্ব্বত্রই তিনি বঙ্গের রাজা বলিয়া কথিত হইয়াছেন। ময়নামতীর পাহাড় তখনকার বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা সন্দেহের বিষয়, করতোয়ার পূর্ব্ববর্ত্তী ভূভাগ কোন কোন মতে ছিল। করতোয়া তখন একটী বৃহৎ নদী, ইহার প্রবাহ স্বাভাবিক সীমা নির্দ্দেশক হইবারই কথা। ব্রহ্মপুত্রের প্রধান প্রবাহ এক্ষণে সিরাজগঞ্জের নিম্নদেশ দিয়া যমুন। নামে প্রবাহিত, কিন্তু তখন এখানে কোন বড় নদীই ছিল না। ব্রহ্মপুত্র ইহার বহু পূর্ব্বদিকে ছিল। পদ্মা নদীর অস্তিত্ব তখন থাকিলেও বর্ত্তমান স্থানে বা বর্ত্তমান ভীষণ আকারে ছিল না।রাজ্যের পরিমাণ  রংপুর হইতে ত্রিপুরা পর্য্যন্ত সমস্ত ভূভাগ গোপীচন্দ্রের শাসনদণ্ড স্বীকার করিত এরূপ অনুমান নিতান্ত অযৌক্তিক নহে। তিব্বতীয় গ্রন্থ হইতে ৺রায় শরচ্চন্দ্র দাস রায় বাহাদুর যে বিবরণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তদনুসারে গোপীচন্দ্রের পিতা বিমলচন্দ্র তীরভূক্তি, বঙ্গ ও কামরূপের রাজা ছিলেন, এবং চাটিগ্রামে গোপীচন্দ্রের বাজপাট ছিল। রংপুরের যোগীরা তাঁহাকে ২২ দণ্ডের রাজা বলিয়া বর্ণনা করিয়াছে। তাহারা আপনাদের ঐশ্বর্য্যের মানদণ্ড দ্বারা রাজার ঐশ্বর্য্যের পরিমাপ করিতে গিয়া তাঁহার গৌরব খর্ব্ব করিয়া ফেলিয়াছে বলিয়াই মনে হয়। দুর্ল্লভ মল্লিকের গানে তিনি “সোলো দত্তের” রাজা বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। ভবানীদাসের মতে গোপীচন্দ্রকে চল্লিশ রাজা কর দিত। সুকুর মামুদ বলেন, তিনি ষোল বঙ্গের রাজা ছিলেন। কথাগুলির যে পরস্পর মিল আছে তাহা বলিতে পারি না, তবে ভবানীদাস ও সুকুর মামুদের বর্ণনা হইতে মনে হয়, রাজাটী নিতান্ত ছোট ছিলেন না। এক রাজার বাড়ী অবশ্য একাধিক স্থানে থাকিতে পারে। করতোয়া হইতে চট্টগ্রাম পর্য্যন্ত সমস্ত ভূভাগের অধীশ্বর না হইলেও মাণিকচন্দ্র ও গোপীচাঁদের পাট ময়নামতী পাহাড় ও রংপুর জেলা উভয় স্থানেই থাকিতে পারে। ভবানীদাসের গানে পাওয়া যায়,—

বাপের মিরাশ এড়ি জাইমু গৌড়র সহর।
দাদার মিরাশ এড়ি জাবে কামলাক নগর॥
তুমি মাএর জত বাড়ি কলিকা নগর।
আমি বাড়ি বান্ধিয়াছি মেহারকুল শহর॥ (পৃঃ ৩২৫)

মেহারকুল বলিয়া বাস্তবিক কোন সহর ছিল বলিয়া মনে হয় না। কামলাক নগরকে বর্ত্তমান কুমিল্লা ধরিয়া লইলে উহা মেহেরকুলেরই অন্তর্গত। “বাপের মিরাশ” ও “দাদার মিরাশ” কি অর্থে প্রযুক্ত হইয়াছে বলা কঠিন। যে স্থানে ময়নামতী মাণিকচন্দ্র হইতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর অবস্থিতি করিতেন, সেই স্থানকেই রংপুরের গানে পুনঃ পুনঃ ফেরুসা নগর বলা হইয়াছে। ফেরুসা নগর কোথায় ছিল নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। রংপুর জেলার ময়নামতীর কোটকে বলা হইয়া থাকিতে পারে। রংপুরের প্রবাদানুসারে ময়নামতীর পিতা এই ফেরুসা নগরে রাজত্ব করিতেন। একটী অপেক্ষাকৃত আধুনিক গাথায় পাওয়া যায়,

ফেরুসা নগরে রাজা নামে তিলকচন।
রূপে গুণে কুলে শীলে ধর্ম্মপরায়ণ॥
পুত্র কন্যা নাই রাজার সদাই দুঃখ মনে।
হরগৌরী পূজা রাজা করে রাত্রিদিনে॥
সন্তোষ হইয়া বর দিলেন শঙ্করী।
জন্মিবে তোমার ঘরে উপের বিদ্যাধরী॥

ইহার পর ইন্দ্রের সভায় নৃত্যের সময় এক ঢুলী ও নর্ত্তকীর তাল ভঙ্গ হইল। ইন্দ্র কর্ত্তৃক শাপ-গ্রস্ত হইয়া ঢুলী মাণিকচাঁদরূপে এবং নর্ত্তকী তিলকচাঁদের কন্যা ময়নামতী বা ময়নামন্ত্রীরূপে জন্মগ্রহণ করিল। ক্রমে ময়নামতীর এক ভগিনী জন্মিল, তাহার নাম হইল সিন্দুরমতী। এই মতে ধর্ম্মপাল রাজার পুত্র মৌপাল, তাঁহার পুত্র মাণিকচন্দ্র। এই গাথাটীর কোন ঐতিহাসিক মূল্য আছে বলিয়া মনে হয় না, তবে এরূপ হইতে পারে যে, তিলকচাঁদ এই অঞ্চলের ভূম্যধিকারী ছিলেন এবং মাণিকচন্দ্র অপুত্রক শ্বশুরের বিষয় প্রাপ্ত হইয়া এই জনপদকে গোপীচন্দ্রের বাপের মিরাশে পরিণত করিয়াছিলেন। “দাদার মিরাশ’ গোপীচাঁদের দাদা সম্পর্কিত কাহারও জমিদারী হইতে পারে। ভবানীদাস প্রণীত গ্রন্থে পাই, একস্থানে গোপীচন্দ্র বলিতেছেন,—

‘বড় ভাই আছে মোর মাধাই তাম্বরী’ ইত্যাদি। (পৃঃ ৩৫৩)

যদি রংপুর অঞ্চলেই ময়নামতীর পিত্রালয় হয়, তাহা হইলে নির্ব্বাসিত অবস্থায় ফেরুসা নগরে ময়নামতীর কোটে তাঁহার অবস্থান বেশ সহজবোধ্য হইয়া পড়ে। সুকুর মামুদের মতে কিন্তু তিলকচাঁদের বাসস্থান সান্ত্বনা নগরে। সান্ত্বনা নগর কোথায় তাহা ঠিক করা যায় নাই। অবশ্য গোপীচাঁদ লালমাই পর্ব্বতে এবং ময়নামতী রংপুর জেলার ময়নামতীর কোটে অবস্থান করিলে উভয়ের দেখা শুনা অত্যন্ত কঠিন হইয়া পড়ে। কিন্তু মাণিকচন্দ্রের মৃত্যুর পরও ময়নামতীর সর্ব্বদা নির্ব্বাসিত অবস্থায় থাকা অনুমান করিবার কারণ নাই। আর গমনাগমনের সময় ও স্থানের দূরত্ব সম্বন্ধে যোগীদিগের গানে যাহা পাওয়া যায় তাহার উপর নির্ভর করা একেবারেই অসম্ভব।

ফা উপাধি  পার্ব্বত্য ত্রিপুরা অঞ্চলে “ফা” উপাধি সম্মান-জ্ঞাপক। পার্ব্বত্য ত্রিপুরার অনেক প্রাচীন স্বাধীন রাজার নামের শেষভাগে “ফা” দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাও হাড়িপা বা হাড়িফা গুরুর কার্য্যক্ষেত্র এই অঞ্চলে থাকার পক্ষে অনুকূল প্রমাণ।

গীতোক্ত স্থান সকল  রংপুরের গাথায় উল্লিখিত শ্রীকলার বন্দর রংপুর জেলার সুপ্রসিদ্ধ কাকিনা গ্রাম হইতে অনতিদূরে, স্থানটী প্রাচীন। ডারাইপুর সহর ও কলিঙ্কার বন্দর কোথায় তাহা স্থির করা যায় নাই। কোন কোন স্থানে দারাইপুর গ্রাম বিদ্যমান আছে। ভবানীদাসের কলিকা বা কনিকা নগর শ্রীহট্ট জেলায় অবস্থিত কোলীন্য নগর হইতে পারে।[২৬] ত্রিপুরা জেলায় নবিনগরের নিকটও এক কলিকা নগর বিদ্যমান। নএয়ানগর বা নয়ানগড় প্রভৃতি স্থানের সংস্থান নির্ণয় বড়ই দুঃসাধ্য। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার নিকট নয়ানগর নামে এক গ্রাম আছে। ভবানীদাসের গুমু বা গোমৈদ নদী এখনও গোমতী নামে পরিচিত। ক্ষীরা নামক নদী লালমাই পর্ব্বত হইতে নির্গত হইয়া পাটিকারা ও গঙ্গামণ্ডল পরগণার মধ্য দিয়া মেঘনায় পড়িয়াছিল; এক্ষণে উহা শুষ্ক। তাঁহার সুরিপুনগর শৌণ্ডিকপল্লী হইতে পারে; কিন্তু জনৈক লেখক অনুমান করিয়াছেন, ইহা ত্রিপুরা জেলার উত্তর পশ্চিমাংশে অবস্থিত স্বরূপ নগর।[২৭]

রাজার জাতি  গ্রীয়ার্সন সাহেবের প্রকাশিত “মাণিকচন্দ্র রাজার গানে” গোপীচন্দ্রের বেনিয়া জাতি ও ক্ষেত্রিকুল উক্ত হইয়াছি। সুকুর মামুদের গ্রন্থে মাণিকচন্দ্র রাজার পরিচয় স্থলে পাই “কূলে শীলে ছিল রাজা গন্ধের বণিক”। পূর্ব্বে আমি গোপীচন্দ্রকে রাজবংশী জাতীয় মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু উপরে লিখিত দুইটী বিভিন্ন গাথায় যখন মিল আছে এবং গোপীচন্দ্রের প্রধান রাজপাট যখন রাজবংশী জাতির প্রভাবের বহির্ভাগে পাওয়া যাইতেছে, তখন আমরা অন্য বিরুদ্ধ প্রমাণ না পাওয়া পর্য্যন্ত এই গ্রন্থোক্ত পরিচয় গ্রহণ করিতেই বাধ্য। চাঁদ বেনিয়ার সহিত জ্ঞাতিত্বের উল্লেখও এই মতেরই পোষক।

গোপীচন্দ্রের উত্তরপুরুষ  গোপীচন্দ্রের উত্তরপুরুষের পরিচয় সম্বন্ধেও মতভেদ আছে। ভবানীদাস লিখিয়াছেন:—

“ গুপিচান্দের বংশ নাহি ভুবন যুড়িয়া” (পৃঃ ৩৫৩)

রংপুর অঞ্চলের প্রবাদ অনুসারে কিন্তু তাঁহার পুত্রের নাম উদয়চন্দ্র বা ভবচন্দ্র। রংপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চলে বাগ্‌দুয়ার পরগণায় ভবচন্দ্রের বাস-ভবনের ধ্বংসাবশেষ এখনও প্রদর্শিত হইয়া থাকে এবং ভবচন্দ্রের বা হবচন্দ্রের নির্ব্বুদ্বিতার অনেক গল্প এখনও ঠাকুরমার ঝুলি অন্বেষণ করিলে প্রাপ্ত হওয়া যায়। কৈলাসচন্দ্র সিংহ মহাশয়ও ত্রিপুরা জেলার চৌদ্দগ্রাম ও তৎসন্নিহিত স্থানে ভবচন্দ্র নামে এক রাজার ও তৎসম্বন্ধে অলৌকিক গল্পের উল্লেখ করিয়াছেন। সম্ভবতঃ রংপুরের ভবচন্দ্র ও চৌদ্দগ্রামের ভবচন্দ্র অভিন্ন। মাণিকচন্দ্র ও গোপীচন্দ্রের ত্রিপুরা ও রংপুর জেলা উভয় অঞ্চলে রাজত্ব থাকিলে তদ্বংশীয় ভবচন্দ্রের না থাকিবার কথা কি?

 গ্লেজিয়ার সাহেব তাঁহার রংপুরের বিবরণে উল্লেখ করিয়াছেন যে, এ জেলায় খৃঃ অষ্টাদশ শতাব্দীতে পায়রাবন্দ নামক স্থানে কতকগুলি মুদ্রা পাওয়া গিয়াছিল এবং এক বৃদ্ধ তাঁহাকে বলিয়াছিল যে, তাহার একটীর উপর এক দিকে ভবচন্দ্র রাজার নাম ও অপরদিকে তাঁহার গৃহদেবী বাগীশ্বরী খোদিত দেখা গিয়াছিল। দুঃখের বিষয় গোপীচন্দ্র বা ভবচন্দ্রের কোন মুদ্রা বা খোদিত লিপির পরিচয় এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই। পাওয়া গেলে এই যুগের ঐতিহাসিক রহস্য উদ্ঘাটনের বিশেষ সহায়তা ঘঠিত।

পালরাজগণ সম্পর্কে বুকানন হ্যামিল্টন প্রভৃতির মত খণ্ডন  আমরা আপাততঃ গোপীচন্দ্রকে গন্ধবণিক জাতীয় এবং খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর লোক বলিয়া গ্রহণ করিলাম। তিনি যদি শিলালিপির গোবিন্দচন্দ্র না হন, তবে আরও পূর্ব্ববর্ত্তী হইতে পারেন, কিন্তু পরবর্ত্তী সময়ের লোক হওয়ার কোনই সম্ভাবনা দেখা যায় না। পরবর্ত্তী সময়ে বঙ্গে বর্ম্মবংশ ও সেনবংশের রাজত্ব দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার পর ত মুসলমান প্রভাব। গোপীচন্দ্রের যে বংশে জন্ম সেই বংশ সময়ে সময়ে রাজনৈতিক হিসাবে পালবংশের সহিত সংসৃষ্ট থাকা অসম্ভব নহে, কারণ শ্রীচন্দ্রের তাম্র শাসনে পালবংশের রাজমুদ্রা লক্ষিত হয়, কিন্তু সাহেবেরা মাণিকচন্দ্র ও ময়নামতীর সহিত রাজা ধর্ম্মপালের যেরূপ সম্বন্ধের অবতারণা করিয়াছেন তাহা নিতান্তই ভিত্তিহীন বলিয়া মনে হয়। তাঁহারা বলেন, মাণিকচাঁদ ধর্ম্মপালের ভ্রাতা, সুতরাং ধর্ম্মপাল গোপীচাঁদের পিতৃব্য ছিলেন, মাণিকচাঁদের মৃত্যুর পর রাজ্য লইয়া ধর্ম্মপাল ও ময়নামতীতে ঘোর যুদ্ধ হয়, তাহাতে ধর্ম্মপাল নিহত হইলে গোপীচাঁদ রাজ্য প্রাপ্ত হন। ডাক্তার বুকানন হ্যামিল্টন এই মতের প্রবর্ত্তক; গ্রীয়ার্সন, গ্লেজিয়ার প্রভৃতি অনেকে ইহার সম্পূর্ণ বা আংশিক পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন। বুকানন যোগিসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত কিংবদন্তীর দোহাই দিয়া এই মতের অবতারণা করিয়াছেন, গ্রীয়ার্সন কিংবদন্তীর অস্তিত্ব স্বীকার করিয়াছেন, কিন্তু তিনি ধর্ম্মপালকে মাণিকচাঁদের ভ্রাতা বলিয়া গ্রহণ করেন নাই, প্রতিদ্বন্দী বা সামন্ত নৃপতি মনে করিয়াছেন। প্রায় ১৫।১৬ বৎসর পূর্ব্বে এই অঞ্চলের বৃদ্ধ ও প্রৌঢ় যোগীদিগের মধ্যে তন্ন তন্ন অনুসন্ধান করিয়াও আমি এইরূপ কিংবদন্তীর বিন্দুমাত্র ভিত্তি আবিষ্কার করিতে পারি নাই। এই কিংবদন্তীর অভাবই বুকাননের মত প্রত্যাখ্যানের একমাত্র কারণ নহে। পূর্ব্বে মাণিকচাঁদের জন্ম সম্বন্ধে যে অপেক্ষাকৃত আধুনিক গাথার উল্লেখ করিয়াছি ঐ গাথাই দেখাইয়া দিতেছে, প্রাচীন যোগীদিগের মধ্যে অন্যরূপ কিংবদন্তী প্রচলিত ছিল। যদি ধর্ম্ম পাল রাজা মাণিকচাঁদের ভ্রাতা অথবা প্রতিদ্বন্দী বলিয়া যোগীদিগের মধ্যে প্রবাদ প্রচলিত থাকিত, তাহা হইলে কি এই গাথা-রচয়িতা ধর্ম্মপালকে মাণিকচাঁদের পিতামহরূপে সাধারণের সম্মুখে উপস্থিত করিতে সাহস পাইত? গোপীচাঁদের গানে মাণিকচাঁদের মৃত্যুর পর গোপীচাঁদের জন্ম, বিবাহ, সিংহাসনারোহণ, সন্ন্যাস প্রভৃতির বিবরণ আছে। যদি তাঁহার সিংহাসন পিতৃব্যের কঠোর হস্ত হইতে বলপূর্ব্বক উদ্ধারের কাহিনী গুণাংশেও সত্য হইত, তাহা হইলে কি ময়নামতীর বিস্তৃত গৌরব গাথার মধ্যে তাহার একটুকুও স্থান যুটিত না? ধর্ম্মপালের নামে প্রতিষ্ঠিত পরিখা-প্রাচীর বেষ্টিত ধর্ম্মপালের গড় ময়নামতীর কোটও পাট্‌কাপাড়া হইতে অল্প দূরে অবস্থিত। ২।১ মাইলের মধ্যে কি একজন প্রতিদ্বন্দ্বী নৃপতির অস্তিত্ব সম্ভবে? যে মৌজায় এই গড়টী অবস্থিত তাহার নাম এখনও ধর্ম্মপাল। যদি ধর্ম্মপাল মাণিকচাঁদের মৃত্যুর পর, রাজ্যশ্রী হস্তগত হইবা মাত্র, ময়নামতী কর্ত্তৃক তাড়িত বা নিহত হইতেন তাহা হইলে রাজধানীর নাম তাঁহার নামানুসারে না হইয়া ময়নামতী বা গোপীচাঁদের নামানুসারে হওয়ারই সম্পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল। সিংহাসন প্রাপ্তির পরই পলায়িত বা নিহত রাজার নাম নবপ্রতিষ্ঠিত রাজধানী আজীবন বহন করিবে কেন? মাণিকচাঁদের মৃত্যুর পর ময়নামতী কর্ত্তৃক তাড়িত বা নিহত হইলে পরিখা-প্রাচারযুক্ত রাজধানী স্থাপনের সুযোগই বা ধর্ম্মপাল কখন পাইলেন?

 আমাদের বিশ্বাস মাণিকচাঁদের সহিত ধর্ম্মপালের আত্মীয়তা কি বৈরিতাসূচক যে সমস্ত মত প্রচারিত হইয়াছে তাহা সমস্তই কাল্পনিক এবং ময়নামতীর কোটের সান্নিধ্যই সেই কল্পনার ইন্ধন যোগাইয়াছে। মাণিকচাঁদ বা গোপীচাঁদ যে পালবংশীয় রাজা ছিলেন, এরূপ বিশ্বাস করিবার কোন উপযুক্ত কারণই নাই। আমরা আমাদের বর্ত্তমান জ্ঞানে মাণিকচাঁদের ও গোপীচাঁদের যে সময় নির্দ্ধারণ করিয়াছি তাহাও পালবংশীয় বিখ্যাত রাজা ধর্ম্মপালের বহু পরবর্ত্তী।

ময়নামতী  গোপীচাঁদের মাতা ময়নামতী যে অত্যন্ত প্রভাবশালিনী রমণী ছিলেন তাহা নিঃসন্দেহ। গোপীচাঁদের বৈরাগ্য সিদ্ধার্থের বা নিমাইএর বৈরাগ্যের ন্যায় স্বেচ্ছা-প্রণোদিত নহে, ইহা শক্তিশালিনী মাতার ঐকান্তিক চেষ্টার ফল। ময়নামতীর পিতা তিলকচাঁদ কোন কোন স্থানে রাজা বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। রাজমহিষীর পিতা বলিয়া অজ্ঞ গাথালেখকের নিকট তিনি এই সম্মানের অধিকারী হইয়াছেন কিনা বলা কঠিন। তিব্বতীয় বিবরণ অনুসারে ময়নামতী মালবরাজ ভর্ত্তৃহরির ভগিনী এবং তাঁহার অপর পুত্র ললিতচন্দ্র ভর্ত্তৃহরির পরে মালবের রাজসিংহাসনারোহণ করেন। হিন্দী গাথার সহিত কিছু মিল থাকিলেও বাঙ্গালার কোন গাথাতে ইহার বিন্দুমাত্র আভাষ না থাকায় আমরা এই মত গ্রহণ করিতে সাহস পাইলাম না। রংপুরের গাথায় ময়নামতীর অন্য কোন নাম ছিল বলিয়া জানা যায় না। অন্য গীতি-লেখকগণ কেহ বলেন তাঁহার বাল্যকালের নাম শিশুমতি, কেহ বলেন সুবদনী। তিনি যে অতি অল্প বয়সে গোরক্ষনাথকে সন্তুষ্ট করিয়া তাঁহার নিকট দীক্ষা প্রাপ্ত হন ও অশেষ শক্তিশালিনী হইয়া উঠেন, ইহা সকলেরই মত। কালে এ দেশীয় অনেক ক্ষমতাশালী লোকের অদৃষ্টে যে সম্মান ঘটে, ময়নামতীর অদৃষ্টেও তাহা ঘটিয়াছে। ত্রিপুরা জেলা তাঁহার নামে একটী পাহাড়কে অভিহিত করিয়াছে। রংপুর জেলা কেবল তাঁহার কোট বা পরিখা-প্রাচীর বেষ্টিত বাসস্থানের স্মৃতি রক্ষা করিয়া ক্ষান্ত হয় নাই, ময়নাবুড়ী নামে তাঁহাকে দেবতায় পরিণত করিয়া রীতিমত পুষ্প-চন্দন-নৈবেদ্যাদির ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছে। কালে নৃমুণ্ডনালিনী দেবীর সহিত তাঁহার অভিন্নত্ব কল্পিত হইয়াছে। ময়নাবুড়ীর পুজা এখনও তাঁহার কোটের প্রাচীরের উপর সাদরে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। তিনি জীবিতাবস্থায় মাংসাহারিণী ছিলেন কিনা জানিনা, কিন্তু এখন তাঁহার তৃপ্তিরপূজার পুরোহিত জন্য ছাগ-শিশুর মস্তক অম্লান বদনে প্রদত্ত হইয়া থাকে। তাঁহার ব্রাহ্মণ নহে, রাজবংশী-জাতীয় দেওদা। পূজার মন্ত্র চণ্ডীপূজার মন্ত্রের রাজবংশী সংস্করণ। ডিমলা থানার অন্তর্গত আটিয়াবাড়ী গ্রাম-নিবাসী জাকইদাস দেওদার নিকট যে মন্ত্রটী সংগৃহীত হইয়াছিল নিম্নে তহো উদ্ধৃত হইল।[২৮]

চিয়াও[২৯] চিয়াও, বুড়ি মা কল যাত্রা নিনি।
কত নিদ্রা কর মা আবালের গোপনি॥
ছাড়ব পাট এড়ব পাট এড়ব সিংহাসন।
সর্গে থাকি চণ্ডি বুড়ির যা গ্রাম নড়ল আসন॥
সর্গতে থাকিলে মাতা সর্গে রাজা হব।
মঞ্চতে নামিয়া মা জল কুস্প[৩০] নিব॥
মোর সেবা ছাড়ি মা অন্যের সেবা যাব।
দোহাই নাগে ধর্ম্মকুর্ম্মে কাত্তিকের মুণ্ড খাব॥
ভরস না পাইয়া মা দিলাম তোমার দোহাই।
মোর সাধ্য আছে মাতা মঙ্গল চণ্ডি রাই॥
পুবে রাজা বন্দিব জানা ভালুং ভাসাং[৩১] কর।
উত্তরে কালিকা বন্দম মা দক্‌খিনে সাগর॥
তিন কোন পৃথিমি বন্দম মা আকাশে চরাচর।
আকাশে কামনি বন্দম পাতালের বাসুকি॥
জলের হস্তনি বন্দম মা থানের থানসিরি[৩২]
তাহাকে পুজিলে মা সুক্কে থাকে গিরি[৩৩]
কুলের পরধান বন্দম আদ্যের তুলসি।
জারে জলে দিলে মা তেসালি[৩৪] দেবতা হয় তুষ্টি॥
বর্থ[৩৫] মধ্যে বন্দোঁ মা বর্থ একাদশি।
তের্থ মধ্যে বন্দোঁ মা গয়া বানারসি॥
থান মধ্যে বন্দোঁ মা গৌর সোল থান।
পাটে রাজা নরপতি মহামুনি মুখাপাত্র বন্দিব জানা প্রতাব নারায়নি।
ধরম কুরম বন্দোঁ বসমতি রাই।
তোমার কথা কইলে নরে দুর্গতি এড়াই॥
মগ্রবানে[৩৬] গঙ্গা বন্দোঁ সিঙ্গে পারবতি।
প্যাচাবানে[৩৭] লক্‌খি বন্দোঁ কাকে সরস্বতি॥

ডাইনে লক্‌খি বন্দোঁ মা বামে সুরদাই।
বুদকে লাগিয়া মা পাএ গলাই॥
টানটোকারি[৩৮] যন্ত্রে মন্ত্রে বুড়ি তোর পূজা হছে অধে পারবতি।
আপনি মা সাক্‌খি হন নিলক্‌খের[৩৯] ভবানি॥
রথ মধ্যে বন্দঁ মা অথের সারথি।
পাথর কাটি সাজন করে মা ভোলা মহেশ্বর বাজা॥
সোমবার দিনকা মা এ সঞ্জম থাকিবে।
পুরে নও দণ্ড বেলা হ’লে মা তোমাকে সেবিবে॥
পিরে[৪০] পিরে কলা দিবে ঝোকে[৪১] নারিকল।
আরও ঘিত মধু দিবে রাজা আরও গঙ্গাজল॥
মহা যত্নে সেবা করিম মা চরণে তোমার।
জদি কালে মা তুমি দেখা দিবেন মোরে।
তিন বারং ছত্রিশ বস্র মা সেবা করিম তোরে॥
কালুয়া[৪২] গতে সেবা করি কালুয়া এড়িয়া।
জয়ধির সেবা করি আমার মালিয়া[৪৩]
বাবরি[৪৪] ঝড়ের সেবা করোঁ সত্যের নিধার[৪৫]
গোমা[৪৬] রতির সেবা করোঁ ভৈরব তাতিয়া[৪৭]
কি শুন্‌ব চণ্ডি বুড়ি ভৈরবের কথা।
ভৈরবের কথা শুনলে মা অন্তরে নাগবে ব্যাথা॥
সৎভক্ত ছিল মা ভৈরব তাতের কথা শুনেক মন দিয়া।
বুড়ির নাগাল কথা মা অদৃষ্টের নাগাল কথা।
আর টানটোকারি ব্যানা বাঁশি বুড়ির নাগাল তথা॥
বুড়ি বলে যাইতে পানু শুদু মোরলি[৪৮] আসিতে পানু বন।
বুড়ি বলে মন্তরি বাছা ঢেকুর[৪৯] কতদূর॥
সোগল ঢেকুর মা বাগতে[৫০] ভাঙ্গিল।
ভাঙ্গা ঢেকুরখান মা কুছাই[৫১] পাতিল॥

আর কুস্প ছিড়া মা বনমালা গাঁথিল।
গলাতে পরিল বুড়িমা গজমতি হার।
কমরে কিঙ্কিনি পইল মা চরনে পাউটি।
দশ নেঙ্গুল পইল মা আর কানে দুল।
নাট নটন কর মা দেখিতে মধুর।
ভক্তের হাতের জলকুস্প নিয়া মা সর্গের দেবতা সর্গে চলি জাবো॥

 স্থানে স্থানে পদটীকা সন্নিবেশিত হইয়াছে, কিন্তু সম্পূর্ণ মন্ত্রটী বোঝা আমাদের সাধ্যায়ত্ত নহে। মন্ত্রের শব্দ পবিত্র বলিয়া তাহা প্রায়ই পরিবর্ত্তিত হয় না, পুরোহিতের মুখে বিকৃত হয় মাত্র। এই বিকৃতিতে মন্ত্রের মাহাত্ম্য বাড়ে বই কমে না। এখানে বলা উচিত রংপুর জেলায় বুড়ীপূজা বিস্তৃতরূপে প্রচলিত। ময়নাবুড়ী ও বুড়ী পূজার মন্ত্র অভিন্ন।

 বুড়ীপূজায় কলায় যে সিন্দুর দেওয়া হয় তাহার মন্ত্রটী এইরূপ—

কপালনি চণ্ডি ভৈরো ভবানি অলুর নাশিনি।
সিঙ্গ বাহিনি আখণ্ড কলাতে সেন্দুর ফোটা।
নিলক্‌খে চণ্ডি বুড়ি গ্রামদেবতা দেবতায় নমঃ॥

নাথধর্ম্ম  যে নাথধর্ম্মের সহিত এই গাথাগুলি জড়িত তাহা এক সময়ে এ দেশে বেশ প্রভাবশালী ছিল। বর্ত্তমান কালের যুগীদিগের ন্যায় নাথপন্থিগণ চিরকালই সামাজিক জগতের এত নিম্নস্তরে ছিল না। বঙ্গদেশ নাথধর্ম্মের একটী প্রধান স্থান ছিল। মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তাঁহার “বৌদ্ধগান ও দোহা”য় মীননাথের রচিত বাঙ্গালা করিতা উদ্ধৃত করিয়াছেন। প্রাচীন নাথেরা কেহ বৌদ্ধধর্ম্ম হইতে, কেহ হিন্দু ধর্ম্ম হইতে আসিয়া নাথপন্থী হইয়া পড়েন; গোরক্ষনাথ বৌদ্ধধর্ম্ম হইতে আসেন। তারনাথের মতে তাঁহার পূর্ব্ব নাম অনঙ্গবজ্র, কিন্তু শাস্ত্রী মহাশয় বলেন প্রকৃত নাম রমণবজ্র। যিনি যেখান হইতেই আসুন, নাথদিগের প্রবর্ত্তিত পন্থায় সর্ব্বত্রই হঠযোগের আধিপত্য লক্ষিত হয়, তাঁহাদের ধর্ম্মমত হিন্দু এবং বৌদ্ধ মতের সংমিশ্রণে উৎপন্ন; তান্ত্রিকতা ইহাতে খুবই প্রবল। এই গ্রন্থেও অনেক স্থলে তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে হিন্দুর দেবগণকে সিদ্ধাদিগের নীচে আসন দেওয়া হইয়াছে। স্থানে স্থানে সিদ্ধাদিগের হস্তে দেবতাদিগের অনেক লাঞ্ছনা ভোগ করার কথাও আছে—ময়নামতীর হস্তে শিব লাঞ্ছিত। যুগীদিগের পূর্ব্বপ্রভাব এখন কিছুই নাই। ইহারা ক্রমশঃ খাঁটি হিন্দুত্বের মধ্যে বেশী রকম আসিয়া পড়িয়াছে এবং গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য বস্ত্রবয়ন, চুণবিক্রয় ও অন্যান্য ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছে। তাহাদের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানারূপ কিংবদন্তী প্রচলিত। সম্ভবতঃ তাহারা বিভিন্ন জাতি হইতে উৎপন্ন একটী প্রাচীন ধর্ম্ম সম্প্রদায়ের ভগ্নাবশেষ। এখনও রংপুরের যুগীদিগের ধর্ম্মই প্রধান উপাস্য দেবতা; গোরক্ষনাথ, ধীরনাথ, ছায়ানাথ, রঘুনাথ প্রভৃতি স্মরণীয় মহাপুরুষ। ভিক্ষাদ্বারা তণ্ডুল সংগ্রহ করিয়া বৈশাখ ও কার্ত্তিক মাসে ইহাদিগকে ধর্ম্ম পূজা করিতে হয়। এই পূজায় হংস পারাবতাদি উৎসর্গ করা হয়, কিন্তু নিহত করা হয় না। যে কোন সময়ে সন্ন্যাসি-পূজা করিবার প্রথা আছে, হরিঠাকুরের পূজাও প্রচলিত হইয়া পড়িয়াছে। ধর্ম্মর কোন প্রতিমা নির্ম্মিত হয় না। যুগীদিগের গুরু ও পুরোহিত স্বজাতীয়। পুরোহিতদিগকে অধিকারী বলা হয়; স্ত্রীলোকেরা অধিকারীর মধ্যস্থতা ব্যতীতই পূজার কার্য্য নির্ব্বাহ করে। জন্মের পর ক্ষৌরকার দ্বারা সন্তানের কর্ণ চিরিয়া দেওয়া অবশ্য কর্ত্তব্য। তিন বৎসর বয়সে গুরুর মন্ত্র গ্রহণ করিতে হয়, নতুবা শিশুর পংক্তি-ভোজনে অধিকার জন্মে না। মৃতদেহ ষোড়াসন বা যোগাসনে সমাধিস্থ করা হয়। ধর্ম্মঠাকুরকে কোন কোন স্থানে চূণ উপহার দেওয়া হয় বলিয়া শুনা যায়। চূণবিক্রয় ও ভিক্ষা রংপুরের যোগ বা যুগীদিগের প্রধান উপজীবিকা। ঢাকা ও ত্রিপুরা জেলায় বস্ত্রবয়ন প্রধান কার্য্য। উচ্চশ্রেণীর হিন্দুর অনুকরণে স্থানে স্থানে ক্রমশঃ সামাজিক প্রথা পরিবর্ত্তিত হইতেছে। সমাধির পরিবর্ত্তে মৃতদেহের অগ্নিসংস্কারও কোন কোন স্থানে দেখা দিয়াছে। শৈব ও বৈষ্ণব মত ক্রমশঃ বিলক্ষণ আধিপত্য বিস্তার করিতেছে। এই গ্রন্থে অনেক স্থলেই বৌদ্ধদিগের উপাস্য ধর্ম্মদেবের প্রাধান্য বর্ণিত হইয়াছে; সুকুর মামুদের গ্রন্থে শূন্যরাজকে ডাকার কথা আছে। রংপুরের যোগীরা আপনাদিগকে অনাদিগোত্র, শিব বংশ বলিয়া পরিচয় প্রদান করে। এক শ্রেণীর যুগী শূকর ও কুক্কুট মাংস ভোজন, মদিরা সেবন ও বাদ্যকারের কার্য্য করে।[৫২]

 রংপুরের যোগীদিগের মধ্যে হরপার্ব্বতী লইয়া অনেক গান প্রচলিত দেখিতে পাওয়া যায়। ধর্ম্ম পূজার ২টী গান নিম্নে উদ্ধৃত হইল।

ধর্ম্ম পূজার গান 

(১) উঠ উঠ ধর্ম্ম মাতা ধর্ম্ম কর সার।
শিব শঙ্খ দুইটা পুজা ধরম দুআর॥
চণ্ডি বলে শুন গোসাই জটিয়া ভাঙ্গেড়া।
তোমার সঙ্গে আও করিলে নাগিবে ঝগড়া॥

চা’র ছেইলার মাও হৈলাম তোর দ্যাবের ঘরে।
দয়া করি চার খান শাখা নাই পিন্ধাইস মোরে॥
ভাসুর আইসে শশুর আইসে অন্ন আন্ধি দ্যাওঁ তারে।
আমার হাত মুড়া গোসাই তা নজ্জা নাগে তোকে॥
শিব বলে শুন চণ্ডি দক্‌খ রাজার বেটি।
শাঁখা দিবার না পাইম আমি জাক বাপের বাড়ি॥
একথা শুনিয়া চণ্ডি আনন্দিত মন।
নাইওর নাগিয়া চণ্ডি করিল গমন॥
কাত্তিক গনেশ নিল ডাইনে বায়ে সাজাইয়া।
অগ্নিপাটা সারি নিল পরিধান করিয়া॥
নাইওরক নাগিয়া চণ্ডি জায়তো চলিয়া।
পালঙ্গেতে বুড়া শিব আছে শুতিয়া॥
নারদ মুনি ডাকে তাকে মামা মামা বলিয়া।
ওহে মামা ওহে মামা তুমি বড় অসিয়া॥
পাকা দ্যাড় পহর ব্যালা আছ পালঙ্গে শুতিয়া॥
ঝগড়া নাগাইয়া চণ্ডি জায় গোসা হইয়া।
নারদ ভাইগ্না তাকে ডাকায় কান্দিয়া কাটিয়া॥
ওহে মামি ওহে মামি কাত্তিক গনেশের মাও।
এক পাও আগাইবা জদি মামি কাত্তিকের মুণ্ডু খাও॥
ফিরা পা আগাইও জদি গনেশের মুণ্ডু খাও।
ফিরা পা আগাইও মামি আমার মাথা খাও॥
বাড়ির কাম কাজ ন্যাখা দিয়া কাল নাইওরেতে জাও।
নারদ ভাইগ্নার বাক্যেতে মহল ফিরিয়া গ্যাল।
মহল জাইয়া চণ্ডি মাতা কামের ন্যাখা দিল॥
প্রথমে দিলে ন্যাখা ভাত রান্ধা হাড়ি।
তার পরে ন্যাখা দিলে গাজা খোআ খুড়ি॥
চণ্ডি বলে ওরে নারদ বচন মোর হিয়া।
নিচ্চয় জাইব কা’ল নারদ নাইওর নাগিয়া॥
বাপের বাড়ি জাইয়া আমি কাটব মানার পাত।
মানার পাতে এক কোমর ভাত নিবোতো বাড়িয়া।
একতোলা সন্দক নবন পাতের আগালে থুইয়া।
গোটা চা’রেক মইসের মুড়ি দিব ভত্তা সাজাইয়া॥

বড় গ্রাসে খাব অন্ন বাপের বাড়ি জাইয়া॥
উঠ উঠ ধর্ম্ম মাতা ধর্ম্ম কর সার।
শিব শঙ্খ দুইটা পুজা ধরম দুআর॥


(২) শিব শিব বন্দে গাওঁ মুঞি ঐনা শিবের বানি।
হরগৌরি বলে শিব জগৎ নারায়নি॥
তোর ঘরে পড়িয়া রইলাম রন্নেরে ভিখারি।
রন্ন বিনে শুকালাম শুকালাম নব নারি॥
বস্তু আবানে চণ্ডি হ’ল দিগম্বরি।
একানা বস্ত্রের তথে চণ্ডি জায় নাইয়রি॥
নাইয়র যাবার আশে দুর্গার নাইয়র আছে মন।
দোআদশের বাড়ি নি জাই ভাঙ্গিব কমর॥
তুই বড় মারিবার গোসাই আমি তোকে জানি।
উনচল কপালি দুর্গা আর মটুকচুলি॥
আমাক বল্ল কাঙ্গালিনি তোর বাপ কত গিরি।
বিভার রাত্রে দেখিয়াছি সোলার মাচাখানি।
ইন্দুর চড়িলে নাচা হড়মড় করে।
ওন্দা বিলাই মাচা চ’ড়লে রুবুদ হ’য়ে পড়ে॥
তোরে বাপের বাড়ি গ্যাছলাম নাশের বাশি নৈয়া।
এক দুইফোর গাওনা কচ্চি গোলানে বসিয়া॥
ভিক্খা দিবার না পারি শশুর তোক দিছে আনিয়া
তোরে বাপের বাড়ি গ্যালাম দান পাবার আশে।
কিসের শশুর দিবে দান মইলাম প্যাটের ভোকে।
তোরে বাপের বাড়ি গ্যালাম বসতে দিছে গুন।
এণ্ডা বাড়ির খুড়িয়া শাক করজ করা নুন॥
তোরে বাপের রন্ন খায় ব্যঞ্জনে না খায় নুন।
নারদ ভা’গ্‌না বাটে গুআ গুআত না দ্যায় চুন॥
তোরে বাপের বাটি গ্যালাম বসতে দিছে পাটি।
ভাত জদি খান জামাই বসিয়া কাট বাটি॥
জ্যাও চাইট্টা পন্তা ছিল শালার মাইয়ার খাইলে।
আমার বাদে শাশুরি জে ধান শুকিবার দিলে।

তিন ন্যাগারে তিন ঠ্যাগারে জুড়লে ধানের বাড়া।
বাড়া জে বানিতে জামাইর বেলি হ’ল শ্যাস।
এলকায় মনে থাকেন জামাইয়া একেনে খাইবেন ভাত॥
কে তোমাক জুড়িছে দুর্গা কে তোমাক বরিছে।
জাচি ক্যানে তোমার বাপ কাঙ্গালর ঘরো দিছে॥
ব্রহ্মা বিষ্টু মহেশ্বর আমরা তিনো ভাই।
গুআ পান ধরিয়া দুর্গা জুড়বার নাইও জাই॥
দুর্গা বলে ওগো শিব জটিয়া ভাঙ্গেড়া।
আমার জাড়ের কথা শিব তুই কলু ভাঙ্গিয়া।
তোমার জাড়ের কথা কইলে নাগিবে ঝগড়া।
ভাশুর আইসে শশুর আইসে রন পরশুম তাকে।
হাতে শাঙ্কা নাহি দ্যান গোসাঁই নজ্জা পাছুঁ তাতে॥
শাঙ্কা কিনিয়া দ্যাওহে মদন মুরলি।
দশ হাতে দশ মুট শাঙ্কা কানে মদনকড়ি।
শাঙ্খা না পাইলে তবে জাব বাপের বাড়ি॥
বাপের বাড়ি জাব দুর্গা ভাইএর বাড়ি জাব।
কাটনি কাটিয়া তবে দুই ছেইলাক পালিব॥
বাপের বাড়ি জাব রে কাটিব মানার পাত।
চাপিয়া চুপিয়া বাড়ব কমর খানেক ভাত॥
চাইট্টা মইসের মুড়ি ভরতা সাজাইয়া।
বড় গাসের রন্ন খাব বাপের বাড়ি জাইয়া॥
শিব বলে ওগো দুর্গা হেমরিশের বেটি।
দুপোর পোয়াতি রাইতে ছাইলাক কান্দাও।
জদি ছাইলা না কান্দে তাক চিমটাইয়া কান্দাও।
ছাইলার আলে দুধ পন্তা থালি ভ'রে ন্যাও।
জদি ছাইলা না খাবে আপনি বইসা খাও॥
দিনটা রুমানে দুর্গা সাতসন্ধ্যা খাও।
একসন্ধ্যা কমি হৈলে সদাই নাইওর জাও॥
ধার উধার কইরা চণ্ডি চড়াইয়া দি নে চাউল।
কাল মুঞি মাগিয়া সুজুম জগৎ বুড়ার রাউল॥

ধারের কথা কইলেন গোঁসাই জাইম কবিরের বাড়ি।
কাউ কিছু খোটা দিলে উপড়াইম পাকা দাড়ি॥
পাকা গোছ ছাড়িয়া গোঁসাই কাছা গোছ টানিব।
কোড়া চা’রকের দুস্ক পাইলে তবে ছাইড়া দিব॥
কাছত নাই মোর বাপের বাড়ি ধার করিবার জাব।
হাতত শাঙ্কা নাই দ্যান গোসাই বান্ধা থুইয়া খাব॥
দুই চোখ খাইছে বাপ মাও দোনো পাড়ার নোক।
জনম ঠেঙ্গুআর ঘরো ব্যাচাইয়া খাইছে মোক॥
দুই চোখ কাইছে বাপ মাও, দুই চোখ খাইছে রাই।
কোন্‌ঠে পিন্ধিম শাঙ্ক। খাড়ু প্যাটে রন্ন নাই॥
মাথায় হস্ত দিয়া কান্দে কাত্তিক আর গনাই॥
দুই চোখ খাইছে বাপ মাও মোর দুই চোখ খাইছে খুড়া।
আন্ধার রাইতো দিছে বিভা কমর ভাঙ্গা বুড়া॥
দাঁত নড়চড় করে শিবের চক্‌খে পেচুব গলে।
হাটেবার না পারে শিব ঝুলি প্যাটের ভরে॥
এতেরে বেতেরে ডালি কাখতে করিয়া।
দশ হাতে দশখান খাড়া নইলে ঘেচিয়া॥
মার মার করিয়া জাইছে কবির ক নাগিয়া।
কতেক দুর জায় দুর্গা কতেক পন্থ পায়।
কতেক দুর জাইতে কবিরের মহল পায়॥
কবির কবির বলিয়া তুলিয়া কারে রাও।
ঘরে ছিল কবির বেটা চমকিত গাও॥
হস্তে নৈল সিংহাসন ভৃঙ্গারতে জল।
কোরফুর তাম্বুল লইয়া জিগ্‌গাসে বচন।
কি কারনে আইছন মাগো সমাচার কর।
দুর্গা বলে ওগো কবির শোন সমাচার।
কা’ল হাতে কাত্তিক গনাই আছে উপবাস।
আড়াই পুটি চাউল দিয়া রুপাস রক্‌খা কর॥
জ্যান নাখান কবির তবে এই কথা শুনিল।
ধারের কথা কৈলা মাগো ধারের কথা শোন॥

একবার ধার দিয়াছিলাম বুড়া শিবের ঘরে।
ধার সাধিবার গেছিলাম মা বুড়া শিবের ঘরে।
ভাঙ্গা ঘরের রুয়া ধরি হুড়াহুড়ি করে॥
জে গুনে কবিরের আমার গায়ে ছিল বল।
দৌড়িয়া এসে সোন্ধাইলাম ভাঙ্গা মাচার তল॥
ধারের কথা কইলেন মাগো ধারের কথা শোন।
ব্রহ্মা ভাসুরক আনেক জামিনদার করিয়া।
বিষ্টু ভাসুরক আনেক সরকার করিয়া।
কাত্তিক গনাইরে নাঞে দ্যাও খত নেখিয়া।
আড়াই পুটি চাউল দেউঁছ তারাজুত তৌলিয়া॥
জ্যান নাকান জুআন ডেবি এ কথা শুনিল।
এতেরে বেতেরে ডালি পাকিয়া মারিল॥
দশ হাতে দশ ধান খাড়া নইলে টানিয়া।
মার মার করিয়া জাইছে শিবক নাগিয়া॥
কত কত মুণ্ড নইলে গলাতে গাথিয়া।
আর কত মুণ্ড নইলে কমরে গাথিয়া॥
কতেক দূর জায় দুর্গা কতেক পন্থ পায়।
কতেক দুর জাইতে নারদ দেখতে পায়॥
নারণ বলে ওগো মামা ভোলা মহেশ্বর।
কিবা কর ওগো মামা নিচন্তে বসিয়া।
মামি আমার আইস্‌ছে জে একরাত করিয়া॥
কতক কতক মুণ্ড নইছে গলাতে গাথিয়া।
আর কতেক মুণ্ড নইছে কমরে গাথিয়া॥
জ্যান নাকান বুড়াশিব এ কথা শুনিল।
মন চৈদ্দ ভাঙ্গের গুড়ি মুখ্‌খে তুলি দিল॥
কলসি দশেক জল দিয়া গিলিয়া ফ্যালাইল॥
কত কত সপ্প নইলে জটাত বান্ধিয়া।
আর কত সপ্প নইলে ডোর কৌপিন মারিয়া॥
তিপখা ঘাটাতে শিব থাকিল পড়িয়া।
ঐ দিয়া জুআন ডেবি জায় চলিয়া॥

কতেক দুর জায় দুর্গা কতেক পন্থ পায়।
কতেক দুর জাইতে দুর্গা শিবের লাগ্য পায়॥
এক পাঁও চড়িয়া দিলে বুক্‌খক নাগিয়া।
আর এক পাঁও চড়িয়া দিলে চরুকে নাগিয়া॥
হ্যাট মুণ্ড হইয়া তবে শিবক দেখিল।
শিবক দেখিয়া দুর্গা জিবাত কামড় দিল॥
আউর জুগে জুআন ডেবি কমর ব্যাকাঁ হ’ল।
পুবে উঠে ধর্ম্মি ব্যালা হইয়া ডণ্ডিপুর।
শাল মান্দার ভাঙ্গিয়া পবনে কৈলে চুর॥
শাল মান্দার ভাঙ্গিয়া বিরনে দিলে থানা।
পশ্চিম পাকে নাম পাড়া’লে হাজিপুর পটনা॥
ধল ঘাট ধল পাট ধল সিংহাসন।
ধল রথে চড়ি আইল আনন্দ ধরম॥
আনন্দ ধরমের পায় পড়িল ভজিয়া।
এক রাত মাথার ক্যাশ দুই রাত করিয়া।
আনন্দ ধরনের পায় পড়িল ভজিয়া॥
জা জা গঙ্গা বেটি তোমাক দিলাম বর।
ধামানি খ্যালাইতে দিলাম খিল নদি সাগর॥
হাট করিতে দিলাম চৌখুটা লগব।
পুজা খাইতে দিলাম ধবলা ছাগল॥
মহাদেবের বরে থাল ফিরে ঘরে ঘর।
চাউল কড়ি লইয়া থালক বিদায় কর॥[৫৩]

গান গুলির রচনা কাল  এক্ষণে গ্রন্থের রচনাকাল সম্বন্ধে কয়েকটী কথা বলা আবশ্যক মনে করি। পূর্ব্বেই কথিত হইয়াছে রংপুরের সংগৃহীত গাথার কোন হস্তলিখিত পুঁথি পাওয়া যায় নাই; উহা নিরক্ষর লোকদিগের নিকট হইতে সংগৃহাত। ডাঃ গ্রীয়ার্সনও কোন হস্তলিখিত পুঁথি পান নাই; তবে গাথাটী স্মরণাতীত কাল হইতে প্রচলিত—শাখাপল্লর নিশ্চয়ই ক্রমশঃ যোজিত হইয়াছে। গোপীচাদের আবির্ভাবের অল্প কাল পরেই মূল গাথা রচিত হওয়ার সম্ভাবনা। মুখে মুখে প্রচলিত গাথার ভাষা অবশ্যই ক্রমশঃ পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। তাহা হইলেও ইহা স্থানে স্থানে যে খুব প্রাচীন তাহা গাথা পাঠ করিলেই বুঝিতে পারা যায়। ভবানীদাসের ও সুকুর মামুদের গাথা হস্ত-লিখিত পুঁথি হইতে সংগৃহীত। ইঁহাদের ভাষা পরিবর্ত্তনের কোন কারণ উপস্থিত হয় নাই। ভবানীদাস খুব সম্ভবতঃ প্রায় ৩০০ বৎসর পূর্ব্বের লোক। রামাভিষেক বা দিগ্বিজয় ও রাম স্বর্গারোহণ নামক কাব্য ইঁহারই রচিত বলিয়া কথিত হইয়াছে। তন্মধ্যে রামাভিষেক কাব্যের রচয়িতা আমাদের আলোচ্য ভবানীদাস বলিয়া মনে হয় না। দুই গ্রন্থে ভাষাগত পার্থক্য বেশ পরিস্ফুট। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ্ হইতে প্রকাশিত প্রাচীন পুঁথির বিববণে ৪৩৪ ও ৫৯৯ সংখ্যক পুঁথির পরিচয়ে দেখিতে পাওয়া যায় এই কাব্যের রচয়িতার প্রকৃত নাম ভবানীনাথ; আমাদের কবির নাম ভবানীদাস। স্বর্গারোহণ কাব্যের রচয়িতা ভবানীদাস আপনাকে কমলজ দেব বা বামন দেবের ও যশোদা দেবীর পুত্র বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। তাঁহার পাটিকারায় বসতি ছিল এবং তিনি কিছুদিন নবদ্বীপের নিকট বদরিকাশ্রমে বাস করিয়াছিলেন জানিতে পারা যায়।

“নবদ্বীপ বন্দম অতি বড় ধন্য।
যাহাতে উৎপত্তি হল ঠাকুর চৈতন্য।
গঙ্গার সমীপে আছে বদরিকাশ্রম।
তাহাতে বসতি করে ভবানীদাস নাম”।[৫৪]

 ইহা হইতে বুঝিতে পারা যায় যখন চৈতন্থদেব-প্রবর্ত্তিত বৈষ্ণব ধর্ম্ম বেশ প্রভাবযুক্ত সেই সময়েই এই কবির আবির্ভাব। তিনি খৃঃ ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব্ববর্ত্তী মনে করিবার কোন কারণ নাই। তিনি পাটিকাবার লোক এবং ষোড়শ শতাব্দী বা তৎপরবর্ত্তী সময়ের কবি স্মরণ রাখিলেই আমাদের আলোচ্য গ্রন্থের কবি বলিয়া স্বভাবতঃই মনে হইবে। ত্রিপুরা জেলায় যে জয়চন্দ্রের নামাঙ্কিত বুদ্ধমূর্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তিনি গোপীচন্দ্রের বংশীয় রাজা হইতেও পারেন, কিন্তু আমাদের ভবানীদাস কখনও অত প্রাচীন কালের লোক হইতে পারেন না। রামাভিষেক কাব্যের রচয়িতা হয়ত অন্য কোন জয়চন্দ্রের আশ্রয় লাভ করিয়াছিলেন। তিনি জয়চন্দ্রের পরিচয় দিতে গিয়া লিখিয়াছেন—“জয়চন্দ্র নরপতি স্বদেশী ব্রাহ্মণ”।[৫৫] গোপীচন্দ্রের বংশীয় জয়চন্দ্র কখনও “স্বদেশী ব্রাহ্মণ” হইতে পারেন না। সুকুর মামুদ কোন্ সময়ের লোক তাহাও জানিতে পারা যায় নাই। খালি এই গ্রন্থ হইতে বিচার করিলে দুই এক শত বৎসরের অধিক প্রাচীন নহেন এরূপ অনুমান উপেক্ষনীয় নহে।

গাথাগুলির ভাষায় ও ভাবে সাদৃশ্য  ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম অঞ্চল ও রংপুরের ভাষা এক রকম না হইলেও, আলোচ্য গাথাগুলির ভাষায় ও ভাবে স্থানে স্থানে যে ঐক্য দেখিতে পাওয়া যায় তাহা বিশেষ প্রণিধান যোগ্য। কয়েকটী স্থান এখানে উদ্ধৃত হইতেছে।

রংপুরের গাথা—

হাল খানাএ খাজনা ছিল দ্যাড় বুড়ি কড়ি।

(পৃঃ ১)

কারও পুস্কনির জল কেহ না খায়।
আথাইলের ধন কড়ি পাথাইলে শুকায়॥
সোনার ভ্যাটা দিয়া রাইয়তের ছাওয়ালে খ্যালায়
হ্যান দুক্‌খি কাঙ্গাল নাই যে ধরিয়া পালায়।

* * *

সেল্কা রাইয়তের ছিল সরঙ্গা নলের ব্যাড়া।
ব্রেতন করি জে ভাত খায় তার দুআরত ঘোড়া॥
ঘিনে বান্দি নাহি পিন্দে পাটের পাছড়া॥

(পৃঃ ২)

ভবানীদাসের পুঁথি—

সোন। রূপাএ গড়াগড়ি না ছিল কাঙ্গাল॥
হীরা মন মাণিক্য লোক তলিতে সুখাইত।
কাহার পুষ্কর্ণীর জল কেহ না খাইত॥
কাহার বাটীতে কেহ উদারে না জাইত।
সোনার ঢেপুয়া লৈয়া বালকে খেলাইত॥

* * *

মেহারকুল বেড়ি ছিল মুলি বাসের বেড়া।
গৃহস্থের পরিধান সোনার পাছড়া॥

* * *

দেড়বুড়ি কৌড়ি ছিল কানি খেতের কর।
চৌদ্দ বুড়ি কৌড়ি ছিল টাকার মোহর॥

পৃঃ ৩২১-৩২২

রংপুরের গাথা—

কলিকাল মন্দ কাল কলির সাত ভাও
জুআন বেটায় না পোসে বৃদ্ধ বাপমাও॥ (পৃঃ ৬৯)
রাজ্য হৈয়া না করে রাজ্যের বিচার।
পুত্র হৈয়া না করে জাঁয় পিতার উদ্ধার॥
নারি হৈয়া না করিবে জাঁয় সামির ভকতি।
শিস্‌স হৈয়া না ধরে গুরুর আরতি॥
এই কয় ঝন মইলে রানি জাবে রধোগতি॥ (পৃঃ ১৭৬)
অকুণ্ডল নারি হএয়া পুরুস বাছিবে। (পৃঃ ৬৯)

ভবানীদাসের পুঁথি—

কলির প্রবেশ হৈলে ধর্ম্ম হৈব নাশ।
বিধর্ম্ম করিয়া সবে করিব বিনাশ॥
রাজা হৈয়া না করিব রাজ্যের বিচার।
শাস্ত্রনীতি না মানিব করিব অনাচার॥

* * *

পুত্র সবে না করিব পিতার পালন।
স্বামীভক্ত না হৈব নারী সবের মন॥ (পৃঃ ৩২২-২৩।

* * *

অকুমারী নারী সবে মাগিব শৃঙ্গার। (পৃঃ ৩২৩)

রংপুরের গাথা—

দিনে আসে সাতবার জম আইতে নওবার।
চিলার নাকান ভৌরি ছান্দে তোমাক ধরিবার॥ (পৃঃ ৬৮)

ভবানীদাসের পুঁথি—

রাত্রিকালে আইসে জম দিনে চারিবারে।
নাজানি পাপিষ্ঠ জমে কারে আসি ধরে॥ (পৃঃ ৩২৮)
চিলরূপে আইসে জম সাচনরূপে জাএ।
মাছিরূপ ধরি জম ঘরেতে সামাএ॥ (পৃঃ ৩২৯)

রংপুরের গাথা—

আশপশি কান্দে তোর জদি গুন থাকে।
কুকিধন্নি মাও কান্দে জাবত প্রান বাচে॥

মাএর কান্দন ওলা ঝোলা বোনের কান্দন সার।
কোলার ত্রি তোর মিছায় কান্দে দেশের ব্যাবহার। (পৃঃ ৭২)

ভবানীদাসের পুঁথি—

ভ্রাতি ভৈনে কান্দিব বেইলের অড়াই পহর।
পশ্চাতে চিন্তিব সে আপনা বাড়ি ঘর॥
জননী কান্দিব জান পুরা ছয় মাস।
নাবীএ কান্দিব জান লোকের আসপাস। (পৃঃ ৩৩০)

সুকুর মামুদের গ্রন্থে—

স্ত্রীপুত্র কান্দে বাছা ঠাণ্ডা পানি পিয়ে।
কুক ধরণী মায়ে কান্দে যাবৎ প্রাণে জিয়ে॥ (পৃঃ ৪৩৯)

রংপুরের গাথা—

ভাল মানুসের ছাইলা হৈলে রবে দিনাচারি।

* * *

এছিলা গাবুরাক দেখি খসম পাকড়িবে॥ (পৃঃ ৭২)

ভবানীদাসের পুঁথি—

ভাল মানুষের বেটী হৈলে কুল দেখি রহে।
অধার্ম্মিক নারী হৈলে ফিরি বর লএ॥ (পৃঃ ৩৩০)

রংপুরের গাথা—

সেই পথে কত আছে দুর্জ্জন বাঘের ভয়।
স্ত্রী আর পুরুসে কখন পন্থ নাহি বয়॥ (পৃঃ ১৭৮))
থাক না ক্যানে বনের বাঘ তাক না করি ডর।
নিস্কলঙ্কে মরন হউক সোমামির পদের হল।
সোআমির পদে মরন হইলে মরবার সফল॥ (পৃঃ ১৭৯)
জখন ছিলাম আমরা আচলে শিশুমতি।
তখন ক্যানে ধম্মি রাজা না হইলেন সন্ন্যাসি॥
এখন হইলাম আসিয়া আমি তোমার যোগ্যমান।
মোক ছাড়িয়া হবু বৈরাগ মুঞি তেজিম পরান॥ (পৃঃ ১৮২)

ভবানীদাসের পুঁথি—

রাজা বোলে কি প্রকারে হাটিয়া জাইবা।
সে পন্থে বাঘের ভয় দেখি ডরাইবা॥

থাউক বনের বাঘে তারে নাহি ডর।
তোমা আগে মৈলে হইব সাফল্য মোহর॥
জে দিনে আছিলু শিশু বাপমাএর ঘরে।
সেদিন না গেলা প্রিয়া দূর দেশান্তরে॥
[অখন] যৌবন হৈল তোমা বিদ্যমান।
তুমি যোগী হইলে প্রভু তেজিব জীবন॥ (পৃঃ ৩৩৩)

রংপুরের গাথা—

হাড়ির খাইছ গুআ মা হাড়ির খাইছ পান।
ভাব করি শিখিয়া নিছ ঐ হাড়িব গেয়ান॥ (পূঃ ৬৩)

ভবানীদাসের পুঁথি—

হাড়িয়ার লগে যুক্তি হাড়িনীর লগে কথা।
হাড়ি লগে বসি খাএ পান এক বাটা॥ (পৃঃ ৩৩৮)

রংপুরের গাথা—

ছাড়িয়া না জাইও রাজা দুর দেশান্তর॥ (পৃঃ ১৭৪)

ভবানীদাসের পুঁথি—

না জাইব না জাইব প্রিয়া দেশদেশান্তর (পৃঃ ৩৩৯)

রংপুরের গাথা—

হাকিম নয় আপনার কোটোআল নয় রিশ।
ঘরে স্ত্রী তোর আপনার নয় জার চঞ্চল চিত॥ ((পৃঃ ৭৯))

ভবানীদাসের পুঁথি—

রাজা নহে আপনা কোতওাল নহে মিত।
ঘরে স্তিহৃ আপন নহে চঞ্চল পিরিত॥ (পৃঃ ৩১৭)

রংপুরের গাথা—

বগ্‌দুলে চুসিলে কলা ডাঙ্গর নয়। (পৃঃ ৭৩)

ভবানীদাসের পুঁথি—

থোড় কলা বাদুড়ে খাইলে কলা ডাঙ্গর নএ। (পৃঃ ৩৪১)

সুকুর মামুদের গ্রন্থে—

থোর কলা বাদুলে খাইলে কলা ডাঙ্গর লয়। (পৃঃ ৪৩৮)

রংপুরের গাথা—

ও মএনা পাইছে গোরকনাথের বর।
আগুনেতে পোড়া না জায় জলত না হয় তল॥ (পৃঃ ৯৬)

ভবানীদাসের পুঁথি—

অগ্নিএ না জাবে পোড়া পানিতে না হএ তল। (পৃঃ ৩৪৫)

রংপুরের গাথা—

এমনি জদি আমার জাহান জায় যোগ ছাড়িয়া।
তবু মাইয়ার গিয়ান না নিমু শিখিয়া॥
আজি জদি তোমার গিয়ান নেই শিখিয়া।
কাইলকে ডাকাবেন হামাক শিস্য বেটা বলিয়া॥ (পৃঃ ১৪-১৫)

ভবানীদাসের পুঁথি—

ঘরের রমণী স্থানে জ্ঞান জে সাধিমু।
গুরু বুলি কোনমতে পদধূলি লৈমু॥ (পৃঃ ৩৪৭)

সুকুর মামুদের গ্রন্থে—

তোমার পিতা বলে আমি যদি প্রাণে মরি।
তবেত স্ত্রীর সেবক হইতে নাহি পারি॥ (পৃঃ ৪৫০)

রংপুরের গাথা—

ব্রহ্মার ভেতর বসি থাকিল যেমন কাঞ্চা সোনা। (পৃঃ ৪৮)

ভবানীদাসের পুঁথি—

সেই অগ্নিতে রহিল মুহি জেন কাঞ্চা সোন)। (পৃঃ ৩৪৯)

রংপুরের গাথা—

খেতুক দিম রাজ্যভার খ্যাতুক দিম বাড়ি।
ভাই খেতুক সপিয়া জাইম তোমা হ্যান সুন্দরি॥ (পৃঃ ১৮৪)

ভবানীদাসের পুঁথি—

থের্ত্তা স্থানে সমর্পিবে ঘড় আর বাড়ি।
কার স্থানে সমর্পিরে এচারি সুন্দরী॥ (পৃঃ ৩৫৩)

রংপুরের গাথা—

তিন কোন পৃথিবির গনোন ঠাঞতে গনি বইসে॥ (পৃঃ ১৩৯)

ভবানীদাসের পুঁথি—

তিন কোণ পৃথিবী আমি ঠাঞি বসি গণি॥ (পৃঃ ৩৫৭)

রংপুরের গাথা—

এতই জদি হাড়ি আছে গিয়ানে ডাঙ্গর।
তবে ক্যান খাটি খায় আমার খাটের তল॥ (পৃঃ ৬০)

ভবানীদাসের পুঁথি—

জদি জ্ঞান থাকিত হাড়িফার ধড়ে।
এক পেটের লাগি কেনে হাড়ি কর্ম্ম করে॥ (পৃঃ ৩৬৯)

রংপুরের গাথা—

জমের বেটা মেঘনাল কুমর পাঙ্খা ঢুলায়। (পৃঃ ৬১)

ভবানীদাসের পুঁথি—

জমের পুত্র মেঘনালে ছত্র ধরিয়াছে। (পৃঃ ৩৭০)

রংপুরের গাথা—

প্রথমে হুঙ্কার ছাড়ে ঝাড়ু বলিয়া।
আপনে ঝাড়ু ব্যাড়ায় হাটখোলা সাম্‌টিয়া॥

* * * *

তারপরে মারিলে হুঙ্কার কোদালক বলিয়া।
আপনে কোদাল ব্যাড়ায় হাটখোলা চেচিয়া॥ (পৃঃ৮১)

ভবানীদাসের পুঁথি—

এক হুঙ্কার সিদ্ধা-এ দিলেন ছাড়িয়া।
উনশত কোদাল জাএ দর্খল চাছিয়া॥
সোনার ঝাড়ুএ জাএ খলা ঝাড়ু দিয়া॥ (পৃঃ ৩৭০)

রংপুরের গাথা—

সোম বারক দিনে তোমার মুড়িয়া জাবে মাথা।
মঙ্গলবার দিনে তোমার সিলাবে ঝুলি ক্যাঁথা॥ (পৃঃ ১৪৭)

ভবানীদাসের পুঁথি—

শনিবারে রাজা তুমি মুড়াইবে মাথা।
রবিবারে নৃপ তুমি গলে দিবা কাঁথা॥ (পৃঃ ৩৭৭)

রংপুরের গাথা—

ঝুলিত হস্ত দিয়া রাজা পড়িয়া গ্যাল ধান্দা।
ঝুলির কড়ি ঝুলিত নাই গুরু বাপ এ ক্যামন কথা॥
উপরে আছে গিরো গাইট তলত নাই জে ভাঙ্গা।
ঝুলির কড়ি ঝুলিত নাই গুরু বাপ মোগ থুইয়া খা বান্দা॥ (পৃঃ ২২৮)
হাতে পদ্দ পাএ পদ্দ কপালে রতন জলে।

* * * *

এই কি খাটিবার পারে আমার চাসা নোকের ঘর॥ (পৃঃ ২৩৯)

ভবানীদাসের পুঁথি—

ঝুলিতে ঢালিয়া হস্ত হৈয়া গেল ধান্দা।
ঝুলি-এ খাইল কৌড়ি মোরে দেও বান্ধা॥

* * * *
হাতে রত্ন পাএ রত্ন কপালে ভাগ্য তার।

হেন বন্ধক না লইব সুরিপু নগর॥ (পৃঃ ৩৮৬)

বর্ণনীয় বিষয়ে অনেক স্থলে অনৈক্য থাকিলেও সুকুর মামুদের পুঁথির সহিত রংপুরের গাথার ভাষা ও ভাবগত সাদৃশ্য আরও স্থানে স্থানে লক্ষিত হয়।

রংপুরের গাথার ভাষা ও বর্ণবিন্যাস  কোন হস্ত লিখিত পুঁথি না পাওয়ায় রংপুরে সংগৃহীত গাথায় বর্ণবিন্যাস যথাসম্ভব উচ্চারণানুযায়ী করার চেষ্টা করা হইয়াছে; কিন্তু সর্ব্বত্রই যে কৃতকার্য্য হইয়াছি একথা বলা যায় না। রংপুরের প্রাচীন ভাষা ক্রমশঃ পরিবর্ত্তিত হইয়া সাধারণ বাঙ্গালা ভাষার সহিত একীভূত হইয়া যাইতেছে। ক্রিয়ার রূপও ক্রমশঃ বদলাইয়া যাইতেছে। এই গাথাতেই স্থানে স্থানে প্রাচীন রূপ, স্থানে স্থানে নতুন রূপ লক্ষিত হইবে। পূর্ব্বে রংপুরে যেরূপ ক্রিয়ার রূপ প্রচলিত দেখা যাইত তাহা নিম্নে প্রদর্শিত হইল:

ধর (ধ) ধাতু

প্রথম পুরুষ

(সংস্কৃত উত্তম পুরুষ)

(আমি ধরি =) মুঞি ধরোঁ

(আমরা ধরি =) আমরা বা হামরা ধরি

(আমি ধরিতেছি =) মুঞি ধরচঁ বা ধরচোঁ

(আমরা ধরিতেছি =) হামরা ধর্‌চি বা ধর্‌ছি

(আমি ধরিলাম =) মুঞি ধরনু

দ্বিতীয় পুরুষ

(সং মধ্যম পুরুষ)

(তুমি ধর =) তুই ধর বা তোমরা ধর

তোমরা ধর

তুই ধৈরচ বা ধৈরছ

তোমরা ধৈর্‌ছেন


তুই ধরলু (=তুমি ধরিলে)

তৃতীয় পুরুষ

(সং প্রথম পুরুষ)

(সে ধরে =) তাঁয় ধরে, উঁয়ায় ধরে

তারা ধরে

তাঁয় ধৈরচে

তারা ধৈর্‌চে বা ধৈর্‌ছে


তাঁয় ধৈল্লে

প্রথম পুরুষ

(সংস্কৃত উত্তম পুরুষ)

(আমি ধরিলাম =) হামরা ধর্‌চি

(আমরা ধরিয়াছি =) মুঞি ধর্‌চুঁ

(আমি ধরিয়াছিলাম =) মুঞি ধরচুনু

(আমরা ধরিয়াছিলাম =) হামরা ধর্‌চুনু

(আমি ধরিব =) মুঞি ধরিম
(আমরা ধরিব=) হামরা ধইরম

দ্বিতীয় পুরুষ

(সং মধ্যম পুরুষ)

তোমরা ধৈর্‌ছেন বা ধৈল্লেন


তোমরা ধৈর্‌ছেন

তুই ধর চুলু

তোমরা ধর্‌ছিলেন


তুই ধরবু

তৃতীয় পুরুষ

(সং প্রথম পুরুষ)

তারা ধৈর ছে ছে বা ধৈল্লে

তাঁয় ধৈরে

তাঁয় ধৈর ছে

তাঁয় ধৈর্‌ছে বা ধর্‌ছিল


তাঁয় ধৈর্‌বে
তারা ধৈরবে

পাঠক এই গ্রন্থে প্রকাশিত গাথায় অনেক স্থলেই এইরূপ ক্রিয়াপদের ব্যবহার দেখিতে পাইবেন। অন্যত্র সংগৃহীত গানেও ভাষার বিশেষত্ব লক্ষিত হইবে। কারণ—কতকটা প্রাদেশিকতা, কতকটা গানের প্রাচীনতা।

 গ্রন্থে আধুনিক সমাজ হইতে বিভিন্নতাসূচক যে সকল সামাজিক প্রথার উল্লেখ দেখা যায় তাহার কতকটা সঙ্গীত-রচয়িতার সমসাময়িক অবস্থা, কিন্তু যে প্রাচীন গীতি সকলের মূল তাহা হইতেও প্রকৃত তথ্য গৃহীত হয় নাই একথা বলা যাইতে পারে না। অদুনার বিবাহে পদুনাকে যৌতুক স্বরূপ দানের উল্লেখ সকল গানেই আছে, বিবরণটা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ও প্রাচীন গাথার অন্তর্ভুক্ত মনে করিলে কিছুমাত্র অন্যায় হইবে না। অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়েও বৈষ্ণব-প্রবর নিত্যানন্দ কত্তৃক জাহ্নবী দেবীকে যৌতুকে গ্রহণ দেখিতে পাওয়া যায়। যে সময়ের ঘটনা লইয়া এই গাথা বা গানগুলি লিখিত তখন বঙ্গদেশে বৌদ্ধ মতের প্রভাব। সামাজিক ব্যবস্থা ঠিক হিন্দুধর্ম্মের অনুযায়ী না হইলেও বিস্ময়ের কারণ নাই। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও সতীদাহ বহুকাল হইতেই এ দেশে প্রচলিত। রংপুরের গাথায় ও ভবানীদাসের গ্রন্থে বিধবাবিবাহ প্রথারও উল্লেখ দেখা যায়। একদিকে যেমন আমরা অদুনা ও পদুনার পাতিব্রত্য-ধর্ম্মের উজ্জ্বল আলেখ্য দেখিতে পাই, অপর দিকে তারা আবার গোপীচাঁদের অন্তঃপুরের বাজে রাণীগুলির অবস্থা বিবেচনা করিলে মনে হয়, জনসাধারণের মধ্যে সতীত্বধর্ম্ম এই সময়ে খুব প্রবল ছিল কিনা সন্দেহ। স্বাধীনতা যে যথেষ্ট ছিল, পদে পদে তাহার পরিচয় প্রাওয়া যায়।

 ভূমিকা দীর্ঘ হইয়া পড়িল, কিন্তু অনেক কথারই সন্তোষজনক সিদ্ধান্ত করা গেল না। আশা করা যায় কোন দিন কোন নবাবিষ্কৃত তাম্রফলক হইতে এই ভারত-বিখ্যাত বঙ্গ-নৃপতির বিবরণ আরও পরিস্ফুটরূপে প্রকাশিত হইয়া আমাদিগের কৌতুহলনিবৃত্তির সাহায্য করিবে।

 রংপুরের সাহিত্য-পরিষদের সম্পাদক শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রচন্দ্র রায় চৌধুরী, স্বনামখ্যাত রায় সাহেব পঞ্চানন বস্মন্ এম্ এ, বি এল্, শ্রীমান্ মহেন্দ্রনাথ দাস প্রভৃতি যাহারা এই গ্রন্থের শব্দার্থ নিরূপণে সহায়তা করিয়াছেন তাহারা সকলেই সম্পাদকগণের অশেষ কৃতজ্ঞতা ভাজন। শব্দার্থ নিরূপণে ও ভাষাতত্ত্ববিষয়ক আলোচনায় অন্যতম সম্পাদক শ্রীযুক্ত বসন্তরঞ্জন রায় মহাশয় যথেষ্ট শ্রম স্বীকার করিয়াছেন। শ্রীযুক্ত অমূল্য চরণ বিদ্যাভূষণ, নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রভৃতি যাহাদিগের নিকট ঐতিহাসিক তথ্যের আলোচনায় সহায়তা পাইয়াছি তাঁহারাও ধন্যবাদার্হ। পরিশেষে, যাঁহার দেশভাষার প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগান্তর আনয়ন করিয়াছে, যাঁহার উৎসাহ ও যত্ন এই গ্রন্থ বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক প্রকাশিত হইবার মূল কারণ, সেই দেশবরেণ্য স্যার্ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রতি সম্পাদকগণ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইতেছেন। গোপীচন্দ্রের গানের পাণ্ডুলিপি দেখিয়াই তিনি ইহার মুদ্রণের ব্যবস্থা করিয়া দেন, নতুবা গাথাটী কতদিনে লোকলোচনের বিষয়ীভূত হইত তাহা কে জানে?

শ্রীবিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য্য

  1. গোপীচন্দ্রের গান, বুঝান থণ্ড ৬১পৃঃ।
  2. বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, চতুর্থ সংস্করণ, ৬৩ পৃঃ।
  3. “এক হুঙ্কার হাড়ি দিলেন ছাড়িয়া।/স্কন্ধপরে মুণ্ডগোটা পড়ে লম্ফ দিয়া।”
  4. “বান্দি বান্দি বলি তখন ডাকে বন বন
    কি করি বান্দিব বিটি কার পানে চাও
    বাপ কালিয়া কাপড়ের ঝাপী আনিয়া ফেলাও।
    আনিল প্যাটারা বান্দি ঘুচালে ঢাকনি!
    দুই নগুলে বাহির কেল্ল বাঙ্গাল গাইয়া ভনি।
    ঐ সাড়ি পরি নটী উপ নেহালায়।
    মনত না খাইল সাড়ি বান্দিকে বিলায়।
    আর এক না সাড়ি পরে নির্যর মেলানি।"
     গোপীচন্দ্র, সন্ন্যাস, খণ্ড, ২.. পৃঃ
    “কাপড়ের পেটারি বালি আনে টান দিয়া।
    খান কত বঙ্গ তোলে নিচিয়া বাচিয়া।
    প্রথমে পরেন সাড়ি ‘নাম যাত্রা সিদ’।
    নাটুয়ায় নাট করে গায়েন গায় গীত।
    সে কাপড় পরিয়া বালি আগে পাছে চায়।
    মনোরমা নহে কাপড় পেটরায় পরায়।”
     বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়, ২৮৮ পৃঃ।

  5. সাহিত্য পরিষৎ-পত্রিকা, পঞ্চদশ ভাগ, দ্বিতীয় সংখ্যা।
  6. J A. S. B., Vol. LXVII, Part I, No. 1, pp. 21.24.
  7. ডাঃ দীনেশচন্দ্র সেনের বঙ্গ-সাহিত্য-পরিচয়, ১ম খণ্ড।
  8. সুখের বিষয় উভয়েই এক পতির সম্পত্তি, সুতরাং বেতালের প্রশ্ন করিবার অবসর ঘটিল না।
  9. প্রবাসী, ১৩২৮।
  10. Indian Antiqnary, Vol. VII, p. 40.
  11. Baealer - Archive (1916).
  12. Study of the Medical Science in Anciont India by Gananath Sen Vidyanidhi, BA., J. M.S.
  13. History of Hindu Chemistry, Vol. 1, 2nd Edition, p. LXXXIX.
  14. উড়িষ্যা হইতে সংগৃহীত গানেও এই দর্পণে মুখ দেখার উল্লেখ আছে, যথা—

    এতে বোলি মেঘা দর্পণকু ঘেণিকর।
    আপন দেখই বাজা মুখ যে কমল॥ ইত্যাদি

    —বঙ্গ-সাহিত্য পরিচর, ১ম খণ্ড। 
  15. Dr. Hultzsch's S. I. Inscriptions.
  16. বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎ পত্রিকা, পঞ্চদশ ভাগ, দ্বিতীর সংখ্যা।
  17. Epigr. Indica vol XII P. 136 Dacca Review 1912, 1919 etc.
  18. Dacca Review. Sep. and October 1920. মহেন্দ্রের লিপির সময় মীনাঙ্কাদ্রি লিখিত হইয়াছে।
  19. Grierson.
  20. ইতিহাস ও আলোচনা—চৈত্র, বৈশাখ ১৩২৮।২৯।
  21. ১৩১৯ সনের ফাল্‌গুন মাসের প্রতিভায় প্রকাশিত শ্রীযুক্ত বৈকুণ্ঠনাথ দত্ত মহাশয়ের প্রবন্ধে ময়নামতী পাহাড়ের সংলগ্ন ঘোষনগর গ্রামে ৩০০ঘর যুগীর বাস লিখিত হইয়াছে। মদীয় বন্ধু ত্রিপুরা জেলায় ভূতপূর্ব্ব এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট্ যুক্ত ব্রজদুর্ল্লভ হাজরা আমাকে জানাইয়াছেন যে, ঐ গ্রামে ৯ ঘর যুগীর বাস। দত্ত মহাশয হয়ত নিকটবর্ত্তী গ্রামের যুগীগণকেও ঘোষনগরের অন্তর্গত ধরিয়া লইয়াছেন। শ্রীযুক্ত হাজরা মহাশয় আরও বলেন, ভগ্ন প্রাসাদ গোপীচন্দ্রের নামেই পরিচিত, মাণিকচন্দ্রের নামের কোন প্রবাদ লক্ষিত হয় না। অদুনামুড়া ও পদুনামুড়া উভয়ই বর্ত্তমান।
  22. পাঠান্তর—
    মেহার কুলেতে আছে ডাকিনী যোগিনী।

    এবং


    মেহার কুলেতে আছে জ্ঞানী যে ডাকিনী॥

  23. রাজমালা
  24. Colebrooke's Essays.
  25. N. K. Bhattasali’s Iconography of Buddhist & Brahmanical sculpturea in the Dacca museum.
  26. সাহিত্য পরিষৎ হইতে প্রকাশিত বাঙ্গালা প্রাচীন পুঁখির বিবরণে ৫১৬ সংখ্যক পুঁথির পরিচয় দ্রষ্টব্য।
  27. ইতিহাস ও আলোচনা, পৌষ ১৩২৮
  28. মন্ত্রটী পূর্ব্বে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত করা হইয়াছে।
  29. চিয়াও—উপস্থিত হও।
  30. কুস্পে—পুষ্পে।
  31. ভালুং ভাসা—এলোমেলো।
  32. থানসিরি বা থানচিড়ি—গৃহ স্থাপনের সময় প্রোথিত বাঁশের উপরিস্থ ঢিপি যাহার পূজা করা যায়।
  33. গিরি—গৃহস্থ।
  34. তেসালি—সকল।
  35. বর্থ—ব্রত।
  36. মগ্রবানে—মকর বাহনে।
  37. প্যাচাবানে—পেঁচা বাহনে।
  38. টান টোকারি—কোশা, কুশি, শঙ্খ ইত্যাদি।
  39. নিলক্‌খ—আকাশ।
  40. পির—কান্দি।
  41. ঝোকে—চড়ায়।
  42. রংপুর অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমানে কালুয়া পূজা করে।
  43. আমিই মালিয়া অর্থাৎ মালাকার।
  44. বাবরি এক রকম ফুল, তার পূজা হত।
  45. নিধার—সর্ব্বদা।
  46. গোমা—একরকম সাপ।
  47. ভৈরব তাতিয়া—ভৈরব তাঁতি।
  48. মোরলী—মুরলী
  49. ঢেকুর—পূজার স্থান।
  50. বাগতে—ঘেরাতে।
  51. কুছাই—কুশাসন।
  52. নাথপন্থ ও যোগি-জাতি স্বম্বন্ধে অনেক জ্ঞাতব্য কথা ১৩২৮ ও ১৩২৯ সনের প্রবাসীতে শ্রীযুক্ত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ মহাশয় লিখিত প্রবন্ধগুলিতে আছে। ইহা ব্যতীত ডাঃ ওয়াইজএর লিখিত বিবরণ, রিজলি সাহেবের Castes ard Tribes of Bengal, বাঙ্গালা দেশের অদমশুমারি রিপোর্ট ইত্যাদি দ্রষ্টব্য।
  53. আমাদের ভাণ্ডারে আর একটী গান আছে। তাহা অনেকটা দ্বিতীয়টীর অনুরূপ। পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতির ভয়ে তাহা আর উদ্ধৃত হইল না। গ্রাম্য ভাষায় হর-পার্ব্বতীর কোন্দলই এই সকল গানের জীবন।
  54. বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, তৃতীয় সংস্করণ ৫১৫ পৃঃ।
  55. সাহিতা পরিষৎ কর্ত্তৃক প্রকাশিত বাঙ্গালা প্রাচীন পুঁথির বিবরণে ৪৩৪ সংখ্যক গ্রন্থের পরিচয়। ৫৯৯ সংখ্যক গ্রন্থের পরিচয়ে “সাদাস ব্রাহ্মণ” পাঠ উদ্ধৃত হইয়াছে। “সাদাস্” সম্ভবতঃ লিপিকর প্রমাদ!

এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।