গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/চাঁদ
চাঁদ
এখন চাঁদের কথা বলা যাউক। তোমাদিগকে আগেই বলিয়াছি, পৃথিবী যেমন সূর্য্যের চারিদিকে ঘোরে, চাঁদ সেই-রকম পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়। এজন্য পৃথিবী গ্রহ, এবং চাঁদ তাহার উপগ্রহ। সে যেন পৃথিবীরই অধীনে আছে, পৃথিবী তাহাকে টানিয়া নিজের চারিদিকে ঘুরাইয়া লইয়া বেড়াইতেছে। কিন্তু তাই বলিয়া চাঁদের সঙ্গে সূর্য্যের যে কোনো সম্বন্ধ নাই, এ কথা বলা যায় না। কারণ পৃথিবীর চারিদিকে যখন চাঁদ ঘুরে, তখন পৃথিবী তাহাকে সঙ্গে লইয়া সূর্য্যকে ঘুরিতে থাকে। এজন্য চাঁদের গতিটা বড়ই গোলমেলে রকমের।
একটা উদাহরণ দিয়া চাঁদের গতিটা বুঝানো যাক্। মনে কর, তুমি যেন সূর্য্য হইয়া মাঝে দাঁড়াইয়া আছ, আর তোমার সেই বন্ধু ধরণী তোমার চারিদিকে পৃথিবী সাজিয়া ঘুরিতেছে। (পর পৃষ্ঠার ছবি দেখ)। এখন চাঁদ হইবে কে? যে চাঁদ হইবে, তাহাকে কিন্তু ধরণীর চারিদিকে ঘুরিতে হইবে। আচ্ছা, একটা কাজ করা যাক্, ধরণীকে বলা যাউক, সে যেন একটা ঢিলে দড়ি বাঁধিয়া ঘুরাইতে থাকে। ধরণ ঢিলে দড়ি বাঁধিল এবং তাহার মাথার চারিদিকে সেই ঢিলটাকে ঘুরাইতে লাগিল, আবার সঙ্গে সঙ্গে সে তোমারও চারিদিকে ঘুরিতে লাগিল। কাজেই চাঁদ যেমন পৃথিবীকে ঘুরিতে ঘুরিতে সূর্য্যের চারিদিকে ঘুরিয়া আসে, এখানে দড়িতে-বাঁধা ঢিলটাও সেই রকম ধরণীর চারিদিকে ঘুরিতে ঘুরিতে তোমাকেও ঘুরিয়া আসিল। তাহা হইলে এই ঢিলের গতি ঠিক্ চাঁদের মতই হইল না কি?
পূর্ব্বে তোমাদিগকে বলিয়াছি, চাঁদকে আমরা পৃথিবী হইতে প্রায় সূর্য্যের মত বড় দেখি বলিয়াই চাঁদ কখনো সূর্য্যের মত বড় জিনিস
ধরণী ঢিলে দড়ি বাঁধিয়া তাহা মাথার চারিদিকে ঘুরাইতে ঘুরাইতে অন্য বালকটির চারিদিকে ঘুরিতেছে
নয়। নক্ষত্রদের চেয়ে চাঁদ অনেক ছোট, তা’ছাড়া আর যাহা কিছু আকাশে খালি চোখে দেখা যায়, তাহাদেরও চেয়ে ছোট, অর্থাৎ আকাশে যত ছোট বড় জ্যোতিষ্ক আছে, তাহাদের সব চেয়ে চাঁদই ছোট। কিন্তু মায়ের ছোট ছেলেটির মত সে পৃথিবীর কাছে থাকিয়া ঘুরিয়া বেড়ায় বলিয়া তাহাকে আমরা এত বড় দেখি।
চাঁদকে ছোট বলিলাম তাই বলিয়া মনে করিও না, যেন তাহা আমাদের খেলার ফুট্বলের মত ছোট বা ধান রাখিবার মরাইয়ের মত ছোট, বা পাহাড়ের মত ছোট বা হিমালয় পর্ব্বতের মত ছোট। পৃথিবীর উপর যত জিনিস আছে, তাদের সব চেয়ে চাঁদ বড়। কিন্তু আকাশে থাকিয়া যত গ্রহ-নক্ষত্র রাত্রিতে আলো দেয়, তাহাদের সব চেয়ে চাঁদ ছোট। সূর্য্যের তুলনায় চাঁদ কত ছোট তোমাদিগকে আগে বলিয়াছি। কিন্তু চাঁদ আবার পৃথিবীর চেয়ে এত ছোট যে, বিধাতা পুরুষ যদি চাঁদ দিয়া এই পৃথিবীর মত আর একটা পৃথিবী গড়িতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে পঞ্চাশটা চাঁদকে ভাঙিয়া কাদা না করিলে পৃথিবী গড়িতে পারিবেন না। তাহা হইলে ভাবিয়া দেখ, আমাদের পৃথিবীটাকে যদি ধরা যায় একটা বড় মার্ব্বেল কিম্বা একটা মাঝারি গোছের মাটির ভাঁটা, তাহা হইলে চাঁদ হইয়া দাঁড়ায় একটা ছোট মটরের মত।
আর একটা হিসাবের কথা বলি। তোমরা ছোট বেলায় ছেলে-ভুলোনো গল্পে শুনিয়াছ, মাটির তলায় পাতালে, এক রাজার বাড়ী আছে; সেখানে এক রাজ-কন্যা আছেন, দৈত্য-দানব কত কি আছে। এ গল্পটা যদি তোমাদের মনে না থাকে, তোমাদের ঠাকুরমার কাছে জিজ্ঞাসা করিও। গল্পটা আমার একটুও মনে নাই, তা’ না হইলে এখনি তাহা তোমাদিগকে বলিতে আরম্ভ করিতাম। যাহা হউক মনে কর, তোমরা যেখানে বসিয়া বই পড়িতেছ, সেখানে একটা প্রকাণ্ড কূয়ো খুঁড়িয়া পৃথিবীর মাঝামাঝি জায়গায় যাইবার চেষ্টা করিতেছ। কত খুঁড়িলে গল্পের সেই পাতালপুরীতে পৌঁছানো যাইবে, আন্দাজ করিতে পার কি? পণ্ডিতেরা হিসাব করিয়া দেখিয়াছেন, তাহা হইলে কূয়োটাকে প্রায় চারি হাজার মাইল খুঁড়িতে হইবে। কলিকাতা হইতে পঞ্জাব প্রায় হাজার মাইল। কাজেই দেখ, কলিকাতা হইতে পঞ্জাব যত দূরে কূয়োটাকে তাহারি চারিগুণ গভীর করিতে হইবে।
কিন্তু কেউ যদি চাঁদে গিয়া কূয়ো খুঁড়িতে আরম্ভ করে, তাহা হইলে এক হাজার মাইল খুঁড়িলেই চাঁদের ঠিক মাঝখানে গিয়া পৌঁছিবে। ইহাও বড় কম দূর নয়। কিন্তু তাহা হইলেও পৃথিবীর মাঝে পৌঁছিতে যত খুঁড়িতে হয়, চাঁদের মাঝে যাইতে তাহার সিকি খুঁড়িলেই চলে। দেখ চাঁদ পৃথিবীর চেয়ে কত ছোট!
কত দূরে থাকিয়া চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরিতেছে এখন দেখা যাউক। চাঁদ পৃথিবীর প্রায় কোলের কাছে আছে, এজন্য জ্যোতিষীরা ইহার দূরত্বের খুব সূক্ষ্ম হিসাব করিতে পারিয়াছেন। তোমাদের চেয়ে যাঁহারা বয়সে বড়, তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিবে যে, চাঁদ পৃথিবী হইতে প্রায় দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার মাইল দূরে আছে। কিন্তু এই দূরত্বটা কত, মনে মনে আন্দাজ করিতে পার কি? আচ্ছা, সূর্য্যের দূরত্ব ঠিক করিবার সময়ে আমরা যে রেলের গাড়ীর উদাহরণ লইয়াছিলাম, এখানে সেই-রকম একটা কিছু লওয়া যাক্।
মনে কর, আজকালকার নূতন ব্যোমযান অর্থাৎ এরোপ্লেনে চড়িয়া আমরা যেন চাঁদের রাজ্য দেখিবার জন্য বাহির হইয়াছি। এরোপ্লেন ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে চাঁদের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে। দিবারাত্রি তাহার বিরাম নাই। তাহার কলটা যেন কেবলি বন্ বন্ করিয়া ঘুরিতেছে। কতদিনে তাহা চাঁদে পৌঁছিবে আন্দাজ করিতে পার কি?—প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস লাগিবে। সূর্য্যের দূরত্ব হিসাব করিবার সময়ে আমরা দেখিয়াছিলাম, পৃথিবীর ডাক-গাড়ী যদি শূন্য দিয়া সূর্য্যে পৌঁছিতে যায়, তবে তাহাকে তিনশত পঞ্চাশ বৎসর দিবারাত্রি হুস্ হুস্ করিয়া চলিতে হয়। কোথায় সাড়ে পাঁচ মাস, আর কোথায় সাড়ে তিনশত বৎসর। ভাবিয়া দেখ, চাঁদ সূর্য্যের তুলনায়, পৃথিবীর কত কাছে! আর এত কাছে আছে বলিয়াই, আমরা ছোট চাঁদটিকে এত বড় দেখি!
তোমরা দূরবীণ দেথিয়াছ কি? যদি না দেখিয়া থাক তবে, আতসী কাঁচ দিয়া বই পড়িতে গেলে বইয়ের অক্ষরগুলি কি-রকম বড় দেখায়, তোমাদের মধ্যে কেহ কেহ তাহা নিশ্চয়ই দেখিয়া থাকিবে। দূরবীণে চোখ লাগাইয়া চাঁদ বা অপর গ্রহদিগকে দেখিলে, সেগুলিও ঐ রকমেই বড় দেখায়। এজন্য খালি চোখে আকাশের যে-সব জিনিসকে দেখা যায় না, দূরবীণ দিয়া দেখিলে তাহাদিগকে দেখা যায়। যদি তোমরা একটা ছোট দূরবীণ হাতের গোড়ায় পাও, সকলের আগে একবার চাঁদকে দেখিয়া লইও। এমন আশ্চর্য্য দৃশ্য আর কখনো দেখিবে না!
আজকালকার দিনে সকলের চেয়ে যে বড় দূরবীণ আছে, তাহা দিয়া দেখিলে দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার মাইল দূরে না থাকিয়া কেবল চল্লিশ মাইল দূরে থাকিলে চাঁদ যেমনটি দেখাইত, ঠিক সেই-রকমই বড় দেখায়। চল্লিশ মাইল দূরের জিনিস কত কাছে থাকে মনে করিয়া দেখ। দূরবীণ দিয়া দেখিয়া চাঁদকে আমরা ঠিক সেই-রকম কাছে পাইয়াছি। ইহাতে চাঁদের উপরকার সব খবর জানিবার শুনিবার খুব সুবিধা হইয়াছে। পৃথিবীর উপরে এখনো অনেক জায়গা আছে, যেখানে মানুষ যাইতে পারে নাই, কাজেই সেখানে কোথায় সমুদ্র আছে, কোথায় পাহাড় আছে এবং সেখানকার জীবজন্তু গাছ-পালা কি-রকম, এ সব আমরা জানিতে পারি নাই। পৃথিবীর উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু এই রকমের অজানা দেশ। সেখানকার ভয়ানক শীতে ও বরফ ঢাকা সমুদ্রে মানুষ যাইতে পারে নাই; কাজেই সেখানকার সকল অবস্থাও জানা যায় নাই। কিন্তু চাঁদের যতটা পৃথিবী হইতে দেখা যায়, তাহার সকল অবস্থাই জ্যোতিষীদের জানা আছে। পৃথিবীর কোথায় কোন্ সমুদ্র, কোথায় কোন্ পর্ব্বত আছে, আমরা ম্যাপে তাহা আঁকিয়া রাখি। জ্যোতিষীরা চাঁদেরও সেই রকম ম্যাপ্ আঁকিয়াছেন, এবং সেখানকার পাহাড় পর্ব্বত সমুদ্রের এক-একটা নামও দিয়াছেন।
তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, দেখিবার শুনিবার জিনিস চাঁদে অনেক আছে। বড় দূরবীণ দিয়া দেখিলে চাঁদকে যে-রকম দেখায়,এখানে তাহার একটা ছবি দিলাম। দেখিলেই বুঝিবে, এটা পূর্ণিমার চাঁদের ছবি নয়। পূর্ণিমার পরে কি-রকম এক-একটু করিয়া চাঁদের ক্ষয় হয়, তাহা তোমরা হয় ত দেখিয়াছ। ছবিখানি পূর্ণিমার ছয় সাত দিন পরে উঠানো হইয়াছিল, এজন্য ইহা সম্পূর্ণ গোলাকার নয়। কিন্তু দেখ ছবি দেখিতে কেমন!