চমৎকুমারী ইত্যাদি গল্প/গুলবুলিস্তান

উইকিসংকলন থেকে

গুলবুলিস্তান

(আরব্য উপন্যাসের উপসংহার)

ম্প্রতি আরব্য উপন্যাসের একটি প্রাচীন পুঁথি উজবেকীস্তানে পাওয়া গেছে। তাতে যে আখ্যান আছে তা প্রচলিত গ্রন্থেরই অনুরূপ, কেবল শেষ অংশ একবারে অন্যরকম। বিচক্ষণ পণ্ডিতরা বলেন, এই নবাবিষ্কৃত পুঁথির কাহিনীই অধিকতর প্রামাণিক ও বিশ্বাসযোগ্য, নীতিসংগতও বটে। আপনাদের কৌতূহলনিবৃত্তির জন্যে সেই উজবেকী উপসংহার বিবৃত করছি। কিন্তু তা পড়বার আগে প্রচলিত আখ্যানের আরম্ভ আর শেষ অংশ জানা দরকার। যদি ভুলে গিয়ে থাকেন তাই সংক্ষেপে মনে করিয়ে দিচ্ছি।

 শাহরিয়ার ছিলেন পারস্য দেশের বাদশাহ, আর তাঁর ছোট ভাই শাহজমান তাতার দেশের শাহ। দৈবযোগে তাঁরা প্রায় একই সময়ে আবিষ্কার করলেন, তাঁদের বেগমরা মায় সখী আর বাঁদীর দল সকলেই ভ্রষ্টা। তখন দুই ভাই নিজ নিজ অন্তঃপুরের সমস্ত রমণীর মুণ্ডচ্ছেদ করলেন এবং সংসারে বীতরাগ হয়ে একসঙ্গে পর্যটনে নির্গত হলেন।

 স্ত্রীচরিত্রের আর একটি নিদর্শন তাঁরা পথে যেতে যেতেই পেলেন। এক ভীষণ দৈত্য তার সুন্দরী প্রণয়িনীকে সিন্দুকে পুরে সাতটা তালা লাগিয়ে মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াত। মাঝে মাঝে সে সুন্দরীকে হাওয়া খাওয়াবার জন্যে সিন্দুক থেকে বার করত এবং তার কোলে মাথা রেখে ঘুমুত। সেই অবসরে সুন্দরী নব নব প্রেমিক সংগ্রহ করত। দুই দ্রাতাও তার প্রেম থেকে নিষ্কৃতি পান নি।

 শাহরিয়ার তাঁর কনিষ্ঠকে বললেন, ভাই, এই ভীষণ দৈত্য তার প্রণয়িনীকে সিন্দুকে বন্ধ করে সাতটা তালা লাগিয়েও তাকে আটকাতে পারে নি, আমরা তো কোন ছার। বিবাগী দরবেশ হয়ে লাভ নেই, আমরা আবার বিবাহ করব। কিন্তু স্ত্রীজাতিকে আর বিশ্বাস নেই, এক রাত্রি যাপনের পরেই পত্নীর মুণ্ডচ্ছেদ করে পরদিন আবার একটা বিবাহ করব, তা হলে অসতী-সংসর্গের ভয় থাকবে না। দুই ভ্রাতা একমত হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন এবং প্রাত্যহিক বিবাহ আর নিশান্তে মুণ্ডচ্ছেদের ব্যবস্থা করে অনাবিল দাম্পত্য সুখ উপভোগ করতে লাগলেন।

 শাহরিয়ারের উজিরের দুই কন্যা, শহরজাদী ও দিনারজাদী। শহরজাদীর সনির্বন্ধ অনুরোধে উজির তাঁকে বাদশাহের হস্তে সমর্পণ করলেন। রাত্রিকালে শহরজদী স্বামীকে জানালেন, ভগিনীর জন্যে তাঁর মন কেমন করছে। দিনারজাদীকে তখনই রাজপ্রাসাদে আনা হল। শাহরিয়ার আর শহরজাদীর শয়নগৃহেই দিনারজাদী রাত্রিযাপন করলেন। শেষ রাত্রে তিনি বললেন দিদি, আর তো দেখা হবে না, বাদশাহ যদি অনুমতি দেন তো একটা গল্প বল। শাহরিয়ার বললেন, বেশ তো, সকাল না হওয়া পর্যন্ত গল্প বলতে পার।

 শহরজাদীর গল্প শুনে বাদশাহ মুগ্ধ হলেন, কিন্তু গল্প শেষ হল না। বাদশাহ বললেন, আচ্ছা, কাল রাত্রিতে বাকীটা শুনব, একদিনের জন্যে তোমার মুণ্ডচ্ছেদ মুলতবী থাকুক। পরের রাত্রিতে শহরজাদী গল্প শেষ করলেন এবং আর একটি আরম্ভ করলেন। তারও শেষ অংশ শোনবার জন্যে বাদশাহের কৌতূহল হল, সুতরাং শহরজাদীর জীবনের মেয়াদ আর একদিন বেড়ে গেল। এইভাবে শহরজাদী এক হাজার একরাতি যাবৎ গল্প চালালেন এবং বেঁচেও রইলেন। পরিশেষে শাহরিয়ার খুশী হয়ে বললেন, শহরজাদী, তোমাকে কতল করব না, তুমি আমার মহিষী হয়েই বেঁচে থাক। তোমার ভগিনী দিনারজাদীর সঙ্গে আমার ভাই শাহজমানের বিবাহ দেব। অতঃপর শহরজাদীর সঙ্গে শাহরিয়ার এবং দিনারজাদীর সঙ্গে শাহজমান পরম সুখে নিজ নিজ রাজ্যে কালযাপন করতে লাগলেন।

 এখন আরব্যরজনীর উজবেকী উপসংহার শুনুন।


হাজার-এক রাত্রি শেষ হলে শাহরিয়ার প্রসন্নমনে বললেন, শহরজাদী, তুমি যেসব অত্যাশ্চর্য গল্প বলেছ তা শুনে আমি অতিশয় তুষ্ট হয়েছি। তোমাকে মরতে হবে না।

 শহরজাদী যথোচিত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন।

 দিনারজাদী বললেন, জাহাঁপনা, এতদিন আপনি শুধু দিদির গল্পই শুনলেন, পুরস্কার স্বরূপ জীবনদানও করলেন। কিন্তু আমার কথা তো কিছুই শুনলেন না।

 শাহরিয়ার বললেন, তুমিও গল্প জান নাকি? বেশ, শোনাও তোমার গল্প।

 দিনারজাদী বললেন, আমি যা বলছি তা গল্প নয়, একবারে খাঁটি সত্য। জাহাঁপনা, আপনি তো বিস্তর স্ত্রীর সংসর্গে এসেছেন, এমন কাকেও জানেন কি যার তুলনা জগতে নেই?

 —কেন, তোমার এই দিদি আর তুমি।

 —আমাদের চাইতে শতগুণ শ্রেষ্ঠ নারী আছে, তার বৃত্তান্ত আমার প্রিয়সখী গুলবদনের কাছে শুনেছি। তার দেশ বহু দূরে। ছ মাস আগে একদল হুন দস্যু তাকে হরণ করে ইস্পাহানের হাটে নিয়ে এসেছিল, তখন আমার বাবা এক শ দিনার দাম দিয়ে তাকে কেনেন। গুলবদনের সঙ্গে একটু আলাপ করেই আমি বুঝলাম, সে সামান্য ক্রীতদাসী নয়, উচ্চ বংশের মেয়ে, গুলবুলিস্তানের শাহজাদীদের আত্মীয়া।

 —গুলবুলিস্তান কোন্‌ মুলুক? তার নাম তো শুনি নি।

 —যে দেশে প্রচুর গোলাপ তার নাম গুলিস্তান। আর যে দেশে যত গোলাপ তত বুলবুল, তার নাম গুলবুলিস্তান। এই দেশ হচ্ছে হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণে বল্‌খ উপত্যকায়। জানেন বোধ হয়, অনেক কাল আগে মহাবীর সেকেন্দর শাহ এই পারস্য সাম্রাজ্য আর পূর্বদিকের অনেক দেশ জয় করেছিলেন। দিনকতক তিনি সসৈন্যে গুলবুলিস্তানে বিশ্রাম করেছিলেন, সেই সময়ে তিনি নিজে আর তাঁর দু শ সেনাপতি ওখানকার অনেক মেয়েকে বিবাহ করেন। বর্তমান গুলবুলিস্তানীরা তাঁদেরই বংশধর। ওদেশের পুরুষেরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, আর মেয়েরা অত্যন্ত রূপবতী। তাদের গায়ের রঙ গোলাপী, গাল যেন পাকা আপেল, চোখের তারা নীল, চিবুকের গড়ন গ্রীক দেবীমূর্তির মতন সুগোল। স্বয়ং সেকেন্দর শাহ ওদেশের রাজার পর্বপুরুষ। এখন রাজা জীবিত নেই, দুই শাহজাদী রাজ্য চালাচ্ছেন, উৎফুলুন্নেসা আর লুৎফুলুন্নেসা।

 —ও আবার কিরকম নাম!

 —আজ্ঞে, গ্রীক ভাষার প্রভাবে অমন হয়েছে। নিকটেই হিন্দ্ মুলুক, তার জন্যেও কিছু বিগড়েছে। গুলবুলিস্তান অতি দুর্গম স্থান, অনেক পর্বত নদী মরুভূমি পার হয়ে যেতে হয়। পথে একটি গিরিসংকট আছে, বাব-এল-মৈমুন, অর্থাৎ বানর-তোরণ। দুই খাড়া পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে অতি সরু পথ, একলক্ষ সশিক্ষিত বানর সেখানে পাহারা দেয়, কেউ এলে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলে। শোনা যায় বহুকাল আগে ওদেশের এক রাজা বংগাল মূলকে থেকে এই সব বানর আমদানি করেছিলেন। জাহাঁপনা, আমি বলি কি, আপনি আর আপনার ভাই শাহজমান সেই গুলবুলিস্তান রাজ্যে অভিযান করুন, শাহজাদী উৎফুল আর লুৎফুলকে বিবাহ করুন। আমার সখী গুলবদন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, আপনাদের সঙ্গে গেলে সেও নিরাপদে নিজের দেশে ফিরতে পারবে।

 শাহরিয়ার বললেন, আমরা যাকে-তাকে বিবাহ করতে পারি না। সেই দুই শাহজাদী দেখতে কেমন? তাদের চরিত্র কেমন?

 —জাহাপনা, তাঁদের মতন রূপবতী দুনিয়ায় নেই, তেমন ভীষণ সতীও পাবেন না। তাঁদের যেমন রূপ তেমনি ঐশ্বর্য। আপনারা দুই ভাই যদি সেই দুই শাহজাদীকে বিবাহ করেন তবে স্বর্গের হুরীর মতন স্ত্রীর সঙ্গে প্রচুর ধনরত্নও পাবেন।

 —তোমার দিদি কি বলেন?

 শহরজাদী বললেন, জাহাঁপনা, আমার জন্যে ভাববেন না, আপনাকে সুখী করবার জন্যে আমি জীবন দিতে পারি।

 একটু চিন্তা করে শাহরিয়ার বললেন, বেশ, আমি আর শাহজমান শীঘ্রই গুলবুলিস্তান যাত্রা করব। সঙ্গে দশ হাজার তীরন্দাজ, দশ হাজার বর্শাধারী ঘোড়সওয়ার আর ত্রিশ হাজার টাঙ্গিধারী পাইক সৈন্য নেব।

 দিনারজাদী বললেন, অমন কাজ করবেন না জাহাঁপনা, তা হলে গুলবুলিস্তানে পৌঁছুবার আগেই সসৈনো মারা যাবেন। বাব-এল-মৈমন গিরিসংকটে যে এক লক্ষ বানর আছে তারা পাথর ছুঁড়ে সবাইকে সাবাড় করবে। তা ছাড়া শাহজাদীদের পাঁচ হাজার হাতি আছে, আপনার সৈন্যদের তারা ছত্রভঙ্গ করে দেবে। আমি যা বলি শুনুন। সঙ্গে শুধু পঞ্চাশজন দেহরক্ষী নেবেন, আপনার পঁচিশ আর ছোট জাহাঁপনার পঁচিশ। আপনার যে দুজন জোয়ান সেনাপতি আছেন, শমশের জঙ্গ্ আর নওশের জঙ্গ্ তাদেরও নেবেন।

 —কিন্তু সেই বাঁদরদের ঠেকাবে কি করে?

 — শুনুন। এখন রমজান চলছে, কিছুদিন পরেই ঈদ-অল-ফিত্‌র। এই সময় দেশের আমির ফকির সকলেই জালা জালা শরবত খায়, তার জন্যে হিন্দুস্তান থেকে রাশি রাশি তখ্‌ত-ই-খণ্ডেসরি অর্থাৎ খাঁড় গুড়ের পাটালি বসরা বন্দরে আমদানি হয়। আপনি সেই পাটালি হাজার বস্তা বাজেয়াপ্ত করুন, সঙ্গে নিয়ে যাবেন। বাব-এল-মৈমনের কাছে এসে পথের দুই ধারে সেই পাটালি ছড়িয়ে দেবেন। বাঁদরের দল হুমড়ি খেয়ে পড়বে আর কাড়াকড়ি করবে, তখন আপনারা অনায়াসে পার হয়ে যাবেন।

 শাহরিয়ার বললেন, বাঃ তোমার খুব বদ্ধি, যদি পুরুষ হতে তো উজির করে দিতাম। যেমন বললে সেই রকমই ব্যবস্থা করব। শাহজমানের কাছে আজই দূত পাঠাচ্ছি। তোমরা দুই বোন আর তোমাদের সখী গুলবদন যাবার জন্য তৈরী হও।


দিনারজাদীর পরামর্শ অনুসারে যাত্রার আয়োজন করা হল। কিছুদিন পরে শাহরিয়ার শাহজমান শহরজাদী দিনারজাদী, দুই সেনাপতি আর পঞ্চাশ জন অনুচের গুলবদনের প্রদর্শিত পথে নিরাপদে গুলবুলিস্তানে পৌঁছুলেন।

 চার জন রক্ষীর সঙ্গে গুলবদন এগিয়ে গিয়ে শাহরিয়ার ইত্যাদির আগমন-সংবাদ দুই শাহজাদীকে জানালেন। তাঁরা মহা সমাদরে অতিথিদের সংবর্ধনা করলেন। বিশ্রাম ও আহারাদির পর বড় শাহজাদী উৎফুলুন্নেসা বললেন, মহামহিম পারস্যরাজ ও তাতাররাজ কি উদ্দেশ্যে আপনারা এখানে এসেছেন তা প্রকাশ করে আমাদের কৃতার্থ করুন।

 শাহরিয়ার উত্তর দিলেন, হে গুলবুলিস্তানের শ্রেষ্ঠ গোলাপী বুলবুল দই শাহজাদী, যা শুনেছিলাম তার চাইতে তোমরা ঢের বেশী সুন্দরী। আমরা একবারে বিমোহিত হয়ে গেছি, তোমরা দুই ভগিনী আমাদের দুজনের বেগম হও।

 শাহজাদী উৎফুল বললেন, তা বেশ তো, আমাদের আপত্তি নেই, বিবাহে আমরা সর্বদা প্রস্তুত। আপনাদের দলে এই যে দুজন সুন্দরী দেখছি এঁরা কে?

 শাহরিয়ার বললেন, ইনি হচ্ছেন আমার এখনকার বেগম শহরজাদী, আর উনি আমার শালী দিনারজাদী, আমার ভাইএর বাগ্‌দত্তা। সপত্নীর সঙ্গে থাকতে এঁদের কোনও আপত্তি নেই।

 মাথা নেড়ে উৎফুল বললেন, তবে তো আমাদের সঙ্গে বিবাহ হতে পারে না। আমাদের নীতিশাস্ত্র কলীলা-ওঅ-দিম্‌না অনুসারে পুরুষের এককালে একাধিক ত্রী আর স্ত্রীর একাধিক স্বামী নিষিদ্ধ।

 —তুমি যে ধর্ম বিরুদ্ধ খীষ্টানী কথা বলছ শাহজাদী। স্ত্রীর পক্ষেই একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ, পুরুষের পক্ষে নয়।

 —আপনাদের রীতি এখানে চলবে না। আমাদের শরিয়ত অন্য রকম, তা যদি না মানেন তবে আপনাদের সঙ্গে আমাদের বিবাহ হবে না।

 শাহরিয়ার তাঁর ভাই শাহজামানের সঙ্গে কিছুক্ষণ চুপি চুপি পরামর্শ করলেন। তার পর বললেন, বেশ, তোমাদের রীতিই মেনে নিচ্ছি। শহরজাদী, তোমাকে তালাক দিলাম, তুমি আর আমার বেগম নও। তোমার জন্যে সত্যই আমি দুঃখিত। কি করা যায় বল, সবই আল্লার মর্জি। তোমার জন্যে আমি অন্য একটি ভাল স্বামী যোগাড় করে দেব।

 শাহজমান বললেন, দুনিয়াজাদী, আমিও তোমাকে চাই না। তুমি অন্য কাকেও বিবাহ করো।

 অনন্তর সানাই ভেঁপু কাড়া-নাকাড়া আর দামামা বেজে উঠল, সখীর দল নাচতে লাগল, গুলবুলিস্তানের মোল্লারা শাহরিয়ারের সঙ্গে উৎফুলের আর শাহজমানের সঙ্গে লুৎফুলের বিবাহ যথারীতি সম্পাদন করলেন।

 বিকাল বেলা প্রাসাদ-সংলগ্ন মনোরম উদ্যানে ফোয়ারার কাছে বসে শাহরিয়ার বললেন, প্রেয়সী উৎফুল, তোমাদের সখীরা অতি খাসা, অনেকে তোমাদের দুই বোনের চাইতেও খুবসুরত। আমরা দুই ভাই ওদের ভাগাভাগি করে আমাদের হারেমে রাখব।

 উৎফুল বললেন, খবরদার প্রাণনাথ, আমাদের সখী বাঁদী ঝাড়ুদারনী বা অন্য কোনও স্ত্রীলোকের দিকে যদি কুদৃষ্টি দাও তো তোমার গরদান যাবে।

 অত্যন্ত রেগে গিয়ে শাহরিয়ার বললেন, ইন্‌শাল্লাহ্! মুখ সামলে কথা বল প্রিয়ে, গরদান নেওয়া আমারও ভাল রকম অভ্যাস আছে।

 উৎফুল বললেন, এস আমার সঙ্গে, বুঝিয়ে দিচ্ছি। এই বাঁদী, এখনই চারজন মশালচী আর দশজন রক্ষীকে গরদানি মহলে যেতে বল।

 দই শাহজাদী স্বামীদের নিয়ে সুবিশাল গরদানি মহলে প্রবেশ করলেন। মশালের আলোকে দুই ভ্রাতা সন্ত্রস্ত হয়ে দেখলেন, দেওয়ালের গায়ে বিস্তর গোঁজ পোঁতা আছে, তা থেকে সারি সারি নরমুণ্ড ঝুলছে। তাদের দাড়ি হরেক রকম, কাঁচা, কাঁচা-পাকা, গালপাট্টা, ছাগল দাড়ি, লম্বা দাড়ি, গোঁফহীন দাড়ি ইত্যাদি।

 উৎফুলুন্নেসা বললেন, শোন বড় জাহাঁপনা আর ছোট জাহাঁপনা, এই সব মুণ্ড হচ্ছে আমাদের ভূতপূর্বে স্বামীদের। উত্তরদিকের দেওয়ালে আমার স্বামীদের, আর দক্ষিণের দেওয়ালে লুৎফুলের। বিবাহের পর এরা প্রত্যেকেই আমাদের সখীদের প্রতি লোলুপ নয়নে চেয়েছিল, সেজন্যে আমাদের নিয়ম অনুসারে এদের কতল করা হয়েছে। তোমরা যেমন কুলটা স্ত্রীকে দণ্ড দাও, আমরা তেমনি লম্পট স্বামীকে দিই। ওহে শাহরিয়ার আর শাহজমান, যদি হুঁশিয়ার না হও তবে তোমাদেরও এই দশা হবে। খবরদার, তলোয়ারে হাত দিও না, তা হলে আমাদের এই রক্ষীরা এখনই তোমার গরদান নেবে।

 শাহরিয়ার বললেন, পিশাচী রাক্ষসী ঘূলী ইবলিস-নন্দিনী, তোমাদের মনে কি দয়া মায়া নেই?

 —তোমাদের চাইতে ঢের বেশী আছে। তোমরা প্রতিদিন নব নব বধূ ঘরে এনেছ, এক রাত্রির পরেই প্রত্যেককে হত্যা করেছ। তাদের চরিত্র ভাল কি মন্দ তা না জেনেই মেরে ফেলেছ। আমরা অত নির্দয় নই, বিনা দোষে পতিহত্যা করি না। যদি দেখি লোকটা অন্য নারীর উপর নজর দিচ্ছে তবেই তার গরদান নিই।

 শাহজমান চুপি চুপি বললেন, দাদা, মুণ্ডুগুলো মাটির কি প্লাস্টিকের তৈরী নয় তো?

 শাহরিয়ার বললেন, না, তা হলে মাছি বসত না। অবশ্য একটু গুড় লাগালেও মাছি বসে। যাই হক, এই শয়তানীদের কবল থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আমাদের সঙ্গে যদি প্রচুর সৈন্য থাকত তবে সখীর দল সমেত এদের গ্রেপতার করে নিয়ে যেতাম।

 তার পর শাহরিয়ার গুরুম্ভীর স্বরে বললেন, শাহজাদী, তোমাদের আমরা তালাক দিলাম, এখনই দেশে ফিরে যাব।

 উৎফুল বললেন, তোমাদের তালাক-বাক্য গ্রাহ্য নয়, এখানকার আইন আলাদা। আমরা ছেড়ে না দিলে তোমাদের এখান থেকে মুক্তি নেই।

 —তবে এই সখীদের সরিয়ে দাও, ওরা চোখের সামনে থাকলে আমাদের লোভ হবে।

 —ওরা এখানেই থাকবে, নইলে তোমাদের চরিত্রের পরীক্ষা হবে কি করে।

 মাথা চাপড়ে শাহরিয়ার বললেন, হা, আমাদের পারস্য আর তাতার রাজ্যের কি হবে?

 উৎফুল বললেন, তার জন্যে ভেবো না। তোমার সেনাপতি শমশের জঙ্গ্ শহরজাদীকে বেগম করে পারস্যের সিংহাসনে বসবে আর নওশের জঙ্গ দিনারজাদীকে বেগম করে তাতার রাজ্যের মালিক হবে। তুমি আর শাহজমান এখনই ফরমান আর রাজীনামায় পাঞ্জা ছাপ লাগাও। দেরি ক’রো না, তা হলে বিপদে পড়বে।

 নিরুপায় হয়ে শাহরিয়ার আর শাহজমান দলিলে পাঞ্জার ছাপ দিলেন। তার পর শাহরিয়ার করজোড়ে বললেন, শাহজাদী, দয়া কর এখানে তোমাদের সখীদের দেখলে আমরা প্রলোভনে পড়ব, প্রাণ হারাব। আমাদের অন্য কোথাও থাকতে দাও।

 —তা থাকতে পার। এই গুলবুলিস্তানের উত্তরে পাহাড়ের গায়ে অনেক গুহা আছে, সেখানে তোমরা সুখে থাকতে পারবে। সাত দিন অন্তর এখান থেকে রসদ পাবে। দুজন মোল্লাও মাঝে মাঝে গিয়ে ধর্মোপদেশ দেবেন। ওখানে তোমরা পাপমোচনের জন্যে নিরন্তর তসবি জপ করবে এবং হরদম আল্লার নাম নেবে।

 পাঁচ বৎসর পরে মেল্লারা জানালেন যে আল্লার কৃপায় দুই ভ্রাতার চরিত্র কিঞ্চিৎ দুরস্ত হয়েছে। তখন দুই শাহজাদী নিজ নিজ স্বামীকে মুক্তি দিলেন, তালাকও দিলেন।

 শাহরিয়ার ও শাহজমান দেশে ফিরে গিয়ে দেখলেন, প্রজা সৈন্য আর রাজকোষ সব বেহাত হয়ে গেছে, শমসের আর নওশের সিংহাসনে জেঁকে বসেছেন, রাজ্য ফিরে পাবার কোনও আশা নেই। অগত্যা তাঁরা বাগদাদে গেলেন এবং কাফিখানার জনতাকে আরব্য রজনীর বিচিত্র কাহিনী শুনিয়ে কোনও রকমে জীবিকনির্বাহ করতে লাগলেন।

১৮৮৯