বিষয়বস্তুতে চলুন

চমৎকুমারী ইত্যাদি গল্প/মাৎস্য ন্যায়

উইকিসংকলন থেকে

মাৎস্য ন্যায়

বাজারের সামনে দিবাকরের সঙ্গে তার এককালের সহপাঠী গণপতির দেখা হল। গণপতি বলল, কি খবর দিবু, আজকাল কি করছ? চেহারাটা খারাপ দেখছি কেন, কোনও অসুখ করেছে নাকি?

 দিবাকর বলল, সিকি-পেটা খেলে চেহারা ভাল হতে পারে না। তিনটে ছেলেকে পড়িয়ে পঞ্চান্ন টাকা পাচ্ছি আর চাকরির খোঁজে ফ্যা ফ্যা করে বেড়াচ্ছি। নেহাত একটা বউ আছে, তিন বছরের একটা মেয়েও আছে, নয়তো সোজা পরলোকে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতুম।

 দিবাকরের বুকে একটা আঙুল ঠেকিয়ে গণপতি বলল, ভাল রোজগার চাও? ভাল ভাল জিনিস খেতে চাও? শৌখিন জামা কাপড় চাও?

 —কে না চায়।

 —দেদার ফুর্তি চাও? নারীমাংস চাও?

 —নারী একটা আছে, কিন্তু মাংস নেই, শুধুই হাড়।

 —কোনও চিন্তা নেই, সব ব্যবস্থা হবে। সাহস আছে? বীরভোগ্যা বসুন্ধরা জান তো? রিস্ক নিতে পারবে?

 —টাকার যদি আশা থাকে তবে সাহসের অভাব হবে না, রিস্কও নিতে পারব। হেঁয়ালি ছেড়ে খোলসা করেই বল না। আমাকে করতে হবে কি? জুয়ো খেলতে বল নাকি?

 —না। জুয়ো হল অকর্মণ্য বড়লোকের খেলা, তোমার মতন নিঃস্বের কর্ম নয়। বেশ ভেবে চিন্তে বল— বিবেকের উপদ্রব আছে? নরকের ভয়? মিছে কথা বলতে বাধে? এসব থাকলে কিছুই হবে না বাপু!

 একটু ভেবে দিবাকর বলল, স্বর্গ নরক মানি না, তবে ধর্মভয় একটু আছে, চিরকালের সংস্কার কিনা। দরকার হলে অল্প স্বল্প মিছে কথাও বলি, প্র্যাকটিস করলে হয়তো অনর্গল বলতে পারব। দারিদ্র্য আর সইতে পারি না, এখন মরিয়া হয়ে উঠেছি। বাঁচতে চাই, তার জন্যে শয়তানের গোলাম হতেও রাজী আছি।

 দিবাকরের হাত ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গণপতি বলল, ঠিক আছে। শুধু বাঁচলে চলবে না, জীবনটা পুরোপুরি ভোগ করতে হবে। আর একবার বল— বুকের পাটা আছে? বিপদকে অগ্রাহ্য করতে পারবে? ধর্মরূপী জুজুর ভয় ছাড়তে পারবে?

 —সব পারব। কিন্তু তুমি তো শাস্ত্রচর্চা করে থাক, গীতাও আওড়াও, তোমার মুখে এসব কথা কেন?

 —কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, সর্ব ধর্ম ত্যাগ করে আমার শরণ নাও, যুদ্ধে লেগে যাও। যদি জয়ী হও তো পৃথিবী ভোগ করবে, যদি মর তো স্বর্গলাভ করবে। আমিও তোমাকে সেই রকম উপদেশ দিচ্ছি— সব ছেড়ে দিয়ে আমার বশে চল। যদি জীবনযুদ্ধে জয়ী হও তবে সর্ব সুখ ভোগ করবে। আর যদি দৈবদুর্বিপাকে নিতান্তই হেরে গিয়ে জেলে যাও তবে বীরোচিত গতি লাভ করবে, তোমার দলের সবাই বাহবা দেবে। জেল থেকে ফিরে এসে পুনর্জন্ম পাবে, আবার উঠে পড়ে লাগবে। আজ সন্ধ্যার সময় আমার বাসায় এসো, পাঁচ নম্বর শেওড়াতলা লেন। আমি তোমাকে দীক্ষা দেব, সকল অভাব দূর করব, সর্বপাপেভ্যো রক্ষা করব।

 দিবাকর বলল, বেশ, আজ সন্ধ্যায় দেখা করব।

ন্ধ্যাবেলা দিবাকর পাঁচ নম্বর শেওড়াতলা লেনে উপস্থিত হল। গণপতি অবিবাহিত, একটা চাকর নিয়ে একাই আছে। কি একটা খবরের কাগজে কাজ করে, জমি বাড়ি আর পুরনো মোটরের দালালিও করে। তার বসবার ঘরে একটা তক্তপোশের উপর শতরঞ্জি পাতা, দুটো তাকিয়া আর কতকগুলো পত্রপত্রিকা ছড়ানো। দেওয়ালে একটা র‍্যাকে কিছু বই আছে।

 চাকরকে দু পেয়লা চায়ের ফরমাশ দিয়ে গণপতি বলল, মাৎস্য সমাজের নাম শুনেছ? তোমাকে তার মেম্বার হতে হবে। ভয় নেই, প্রথম এক বৎসর চাঁদা দিতে হবে না।

 দিবাকর বলল, মাৎস্য সমাজের কাজটা কি? ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে হয় নাকি? মৎস্য ধরিবে খাইবে সুখে— এই কি তোমার উপদেশ?

 —সত্যিকারের মৎস্য নয়, মনুষ্যরূপী মৎস্যকে খাবলে খেতে হবে। মাৎস্য ন্যায় শুনেছ? মহাভারতে আছে—

নারাজকে জনপদে স্বকং ভবতি কস্যচিৎ।
মৎস্যা ইব জনা নিতাং ভক্ষয়ন্তি পরস্পরম্॥

 অর্থাৎ অরাজক জনপদে কারও নিজস্ব কিছু নেই, লোকে মৎস্যের ন্যায় সর্বদা পরস্পরকে ভক্ষণ করে। এদেশে অবশ্য ঠিক অরাজক অবস্থা এখনও হয় নি, তবে মাৎস্য ন্যায়ের সূত্রপাত হয়েছে, পরস্পর ভক্ষণের সুযোগ দিন দিন বাড়ছে। এখানে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা হারুন অল রসিদের নির্মম দণ্ডবিধি নেই, কমিউনিস্ট বা ফাসিস্টদের দুর্দান্ত শাসনও নেই, পাঁচ ভুতের লীলাখেলা চলছে। এরই সুযোগ আমরা মাৎস্য সমাজীরা নিয়ে থাকি।

 —মাৎস্য সমাজের তুমি একজন কর্তা ব্যক্তি নাকি?

 — আমি একজন কর্মী, হাঁপানির বেয়ারাম আছে তাই হাতে কলমে কাজ করতে পারি না, মুখের কথায় যতটুকু সম্ভব করি। বড় বড় মাতব্বর লোক হচ্ছেন এর নির্বাহসমিতির সভ্য, সভাপতি, সচিব আর উপসচিব। তাঁরা আত্মপ্রকাশ করেন না, আড়ালে থাকেন। আমি হচ্ছি মাৎস্য সংস্কৃতির একজন ব্যাখ্যাতা আর প্রচারক। যারা আমাদের সমাজে ঢুকতে চায় তাদের আমি যাচাই করি, বাজিয়ে দেখি। যদি দীক্ষার উপযুক্ত মনে হয় তবে মাৎস্য সমাজের ফিলসফিও তাদের বুঝিয়ে দিই।

 —ফিলসফিটা কি রকম?

 —গোটা কতক মূল সূত্র বলছি শোন। জোর যার মুলুক তার। উদ্যোগী পুরুষসিংহ অর্থাৎ যোগাড়ে গুণ্ডাকে লক্ষ্মী বরণ করেন। দু-চার জন রোগা-পটকা গুণ্ডা হাজার জন বলবান সজ্জনকে কাবু করতে পারে। দুর্জনরা একজোট হতে পারে কিন্তু সজ্জনরা পারে না, তারা কাপুরুষ, তাদের নীতি হচ্ছে, চাচা আপনা বাঁচা। মাৎস্য সমাজী জনসাধারণের উদ্দেশে বলে— মানতে হবে, মানতে হবে, কিন্তু নিজের বেলায় বলে— মানব না, মানব না। পাপ পুণ্য সব মিথ্যে, শুধু দেখতে হবে পুলিসে না ধরে, আর আত্মীয় বন্ধুরা বেশী না চটে।

 —আমাকে নাস্তিক হতে হবে নাকি?

 —তার দরকার নেই। ভক্তিতে গদগদ হয়ে যত খুশি গুরুভজন করতে পার। ভক্তিচর্চার সঙ্গে মাৎস্য ন্যায়ের বা চুরি ডাকাতি মাতলামি ব্যভিচার ইত্যাদির কোনও বিরোধ নেই।

 —তোমার মাৎস্য ফিলসফিতে নতুন কিছু তো দেখছি না।

 —আরও বলছি শোন। কলেজে তোমার তো অঙ্কে বেশ মাথা ছিল। সম্ভাবনা-গণিত অর্থাৎ প্রবাবিলিটি মনে আছে?

 —কিছু কিছু আছে।

 —কলকাতার রাস্তায় যত লোক চলে তাদের মধ্যে জন কতক প্রতি বৎসরে অপঘাতে মারা যায়। সেজন্যে পথে হাঁটা ছেড়ে দিয়েছ কি?

 —তা কেন ছাড়ব। বেশীর ভাগ লোকেই তো নিরাপদে যাতায়াত করে, অতি অল্প লোকেই মরে। আমার মরবার সম্ভাবনা খুবই কম।

 —ঠিক কথা। যারা হাঁটে তাদের তুলনায় যারা মোটর রেলগাড়ি বা এয়ারোপ্লেনে চড়ে তাদের অপঘাতের হার ঢের বেশী। প্রাণের ভয়ে এই সব বর্জন করতে বল কি?

 —কেন বলব। লক্ষ লক্ষ লোকের মধ্যে হয়তো দু-চার জন মারা যায়, কিন্তু তাতে ভয় পেলে চলে না।

 —উত্তম কথা। বিনা টিকিটে যারা রেলে যাতায়াত করে তাদের কত জনের সাজা হয় জান?

 —হয়তো লাখে এক জন ধরা পড়ে, দণ্ড যা দিতে হয় তাও খুব বেশী নয়। কাগজে পড়েছি, গত বৎসরে সাড়ে চার হাজার বার অকারণে শিকল টেনে ট্রেন থামানো হয়েছিল, কিন্তু খুব অল্প লোকেরই বোধ হয় সাজা হয়েছে।

 —অতি সত্য কথা। বিনা টিকিটে রেলে চড়া, শিকল টেনে গাড়ি থামানো, গার্ড আর স্টেশন মাস্টারকে ঠেঙানো খুব নিরাপদ কাজ, রিস্ক নগণ্য। পরীক্ষার প্রশ্ন পছন্দ না হলে ছাত্ররা দাঙ্গা করে, চেয়ার টেবিল ভাঙে। ফেল হলে মাস্টারকে ঠেঙায়। কত জনের সাজা হয়?

 —বোধ হয় কারও হয় না।

 —অর্থাৎ দাঙ্গা করা অতি নিরাপদ। ছেলেরা জানে তাদের পিছনে মা বাবা আছেন, ঠাকুমা আছেন, হরেক রকম দেশনেতাও আছেন। মন্ত্রীরাও কিছু করতে ভয় পান। ছেলেরা হচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণকথিত বটুক ভৈরব, কার সাধ্য তাদের শাসন করে।

 —কিন্তু এসব কাজে লাভ কতটুকু হয়?

 —বিনা টিকিটে রেলে চড়লে কিছু পয়সা বাঁচে। চেন টানলে, গার্ড’কে মারলে বা স্কুল কলেজে দাঙ্গা করলে আর্থিক লাভ হয় না, কিন্তু বাহাদুরি দেখানো হয়, সেটাই মস্ত লাভ। আইন লঙ্ঘনে একটা অনির্বচনীয় আত্মতৃপ্তি আছে। আর্থিক লাভের হিসেব যদি চাও তবে পকেটমারদের খতিয়ান দেখ। হাজার বার পকেট মারলে হয়তো এক বার ধরা পড়ে। এক জনের না হয় সাজা হল, কিন্তু বাকী ন শ নিরেনব্বুই জন তো বেঁচে গেল, তারা ভয় পেয়ে তাদের পেশা ছাড়ে না।

 —আমাকে পকেটমার হতে বলছ নাকি?

 —না। এ কাজে রোজগার অবশ্য ভালই, কিন্তু ঝাঁকা মুটে রিকশওয়ালা কিংবা পকেটমারের কাজ তোমার মতন ভদ্রলোকের উপযুক্ত নয়। দৈবাৎ যদি ধরা পড় তবে আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না, তোমার পক্ষে তা মৃত্যুর বেশী। যারা খাবার জিনিসে বা ওযুধে ভেজাল দেয়, কালোবাজার চালায়, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, ঘুষ নেয়, মদ চোলাই করে, নোট বা পাসপোর্ট জাল করে, তবিল তসরুপ করে, তাদের অপরাধ গুরুতর, কিন্তু পকেটমারের চাইতে তারা ঢের বেশী রেস্পেক্‌টেব্‌ল গণ্য হয়।

 —আমাকে কি করতে হবে তাই স্পষ্ট করে বল।

 —মাৎস্য ফিলসফিটা আর একটু বুঝে নাও। নিরাপত্তার বিপরীত অনুপাতে লাভের সম্ভাবনা। ধরা পড়া আর শাস্তির সম্ভাবন। যত কম, লাভও তত কম। রিস্ক যত বেশী, লাভও তত বেশী। যে কাজে লাখে এক জন ধরা পড়ে তা প্রায় নিরাপদ, যেমন বিনা টিকিটে রেলে চড়া। সরকারী বিজ্ঞাপনে আছে, দক্ষিণপূর্ব রেলওয়ের প্রতি বৎসরে ষাট লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়। তার মানে এই টাকাটা যাত্রীদের পকেটে যায়। তবে মাথা পিছু লাভ অতি অল্প। যাতে দশ হাজারে এক জন ধরা পড়ে তাতেও রিস্ক বেশী নয়, লাভও মন্দ নয়, যেমন ঘুষ, ভেজাল, ট্যাক্স ফাঁকি। যাতে হাজারে এক জন ধরা পড়ে তাতে লাভ বেশ মোটা, যেমন মদ চোলাই, নোট জাল, ডাকাতি। আর যাতে শতকরা এক জন ধরা পড়ে তাতে প্রচুর লাভ, রিস্কও খুব, যেমন দলিল জাল, তবিল তসরুপ। অনেক ধুরন্ধর ব্যবসাদার এই কাজ করে ফেঁপে উঠেছেন, আবার কেউ কেউ ফাঁদেও পড়েছেন।

 —সব তো বুঝলুম। এখন আমাকে করতে বল কি?

 —একটু একটু করে ধাপে ধাপে সাধনা করতে হবে, ভয় ভাঙতে হবে। মুরুব্বী অর্থাৎ পৃষ্ঠপোষকও সংগ্রহ করা দরকার, যাঁরা বিপদে রক্ষা করবেন। তুমি দিন কতক বিনা টিকিটে রেলে যাতায়াত কর, মনে সাহস আসবে। সবিধে পেলেই গার্ড আর স্টেশন মাস্টারকে ঠেঙাবে, অতি নিরাপর কাজ। দরকার করুণ ভাষার বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন — ভাই সব, ভাড়া না দিলে রেলগাড়ি চলবে কি করে? ও তো তোমাদেরই জিনিস। রেল-কর্মচারীরা নির্দোষ, তাদের মেরো না। এই মিনতিতে কেউ কর্ণপাত করে না। আরও শোন — বিক্ষোভ দেখাবার জন্যে যত সব প্রসেশন বেরয় তাতে যোগ দিয়ে স্লোগান আওড়াবে, সুবিধা হলে দাঙ্গা বাধাবে, ইট ছুঁড়বে। এর ফলে তুমি এক জন লোকসেবক কেষ্টবিষ্টু হয়ে উঠবে, গুণ্ডোচিত আত্মপ্রত্যয় লাভ করবে, প্রভাবশালী মুরুব্বীদের সুনজরে পড়বে।

 —তাঁরা আমার কোন্ উপকারটা করবেন?

 —কি না করবেন? যদি ইলেকশনে সাহায্য কর, তোমার চেষ্টার ফলে যদি তাঁরা কৃতকার্য হন তবে কেনা গোলাম হয়ে থাকবেন, পুলিসও তোমাকে খাতির করবে।

 —সংসার চলবে কি করে?

 —আপাতত তেমাকে একটা খয়রাতী কাজ জুটিয়ে দেব, দুঃস্থ লোকদের সাহায্য করতে হবে। বরাদ্দ টাকার সিকি ভাগ দান করবে, সিকি ভাগ আত্মসাৎ করবে আর বাকী টাকা মাৎস্য সমাজের ফণ্ডে জমা দেবে। এ কাজে রিস্ক কিছুই নেই। কালোবাজার আর ঘুষের দালালিও উত্তম কাজ, তোমাকে তাও জুটিয়ে দেব। তার পর ভেজালওয়ালা আর চোলাইওয়ালাদের সঙ্গেও ভিড়িয়ে দেব। মনে বেশ সাহস এলে একটু আধটু দোকান লুট আর রাহাজানিও অভ্যাস করবে। তার পর তোমাকে আর শেখাবার দরকার হবে না, মাথা খুলে যাবে, বড় বড় অ্যাডভেঞ্চারে নামতে পারবে।

 দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দিবাকর বলল, রাজী আছি, আমাকে মাৎস্য সমাজের মেম্বার করে নাও।

 গণপতি বলল, তোমার সুমতি হয়েছে জেনে সুখী হলাম। খয়রাতী কাজটা দিন তিনেকের মধ্যে পেয়ে যাবে। আপাতত এই এক শ টাকা হাওলাত নাও, মাস দুই পরে শোধ দিলেই চলবে। কালীধন মণ্ডলের সঙ্গে তোমার আলাপ হওয়া দরকার, চৌকশ লোক, অনেক রকম মতলব আর সাহায্য তার কাছে পাবে। কাল সন্ধ্যাবেলা আবার এখানে এসো, কালীধনও আসবে।


দিবাকরের নূতন জীবন আরম্ভ হল, বিচিত্র অভিজ্ঞতাও হতে লাগল। প্রথম প্রথম একটু বক ধড়ফড় করত, কিন্তু তার পর সয়ে গেল। বছর দুই ভালই চলল, তার পর কালীধন এক দিন তাকে বলল, এ কিছুই হচ্ছে না দিবুদা, যা বলি শোন। সমাজের সব চাইতে বড় শত্রু হল ধনীদের মেয়েরা, তাদের গহনা যোগাবার জনোই বড়লোকরা গরিবদের শোষণ করে। সেকরার দোকান হচ্ছে প্রলোভনের আড়ত, মেয়েদের মাথা খাবার আস্তানা। তাই আমাদের ধ্বংস করতে হবে।

 দু দিন পরে সন্ধ্যার সময় খিদিরপুরে একটা গহনার দোকান লুট হল। লুটের মাল নিয়ে কালীধন পালাল, কিন্তু দিবাকর ধরা পড়ল। সাজা হল দু বছর জেল। তার মুরুব্বী বললেন, এহেহে বড়ই কাঁচ। কাজ করে ফেলেছ হে দিবাকর, এ বুদ্ধি তোমার কেন হল! ভেবো না, দু বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে, তার পর বেরিয়ে এসে নামটা বদলে ফেলবে আর খুব হঁশিয়ার হয়ে চলবে।

 দু বছর পরে দিবাকর যখন খালাস হয়ে ফিরে এল তখন তার বউ আর মেয়ে বেঁচে নেই, সে বন্ধনহীন দায়িত্বহীন মুক্তপুরুষ। নিজের নামটা বদলে সে রজনীকান্ত হল এবং অতি সতর্ক কঠোর সাধনার ফলে অল্প কালের মধ্যে মাৎস্য সমাজের শীর্ষে উঠল। এখন সে একজন রাঘব বোয়াল, সামান্য লোকের মত তাকে ‘সে’ বলা চলবে না, ‘তিনি’ বলতে হবে।

 শ্রীরজনীকান্ত চৌধুরী এখন স্বহস্তে কোনও তুচ্ছ কর্ম করেন না, চুরি ডাকাতি তবিল ভাঙা ইত্যদির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগ নেই। গুণ্ডা বললে তাঁকে ছোট করা হয়। রাজার উপরে যেমন অধিরাজ, কর্তার উপরে যেমন অধিকর্তা, রজনীকান্ত তেমনি অধিগুণ্ডা, অর্থাৎ গুণ্ডাদের উপদেষ্টা নিয়ন্তা প্রতিপালক ও রক্ষক। ভূতপূর্ব গুরু গণপতি এখন তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারী। এক কালে যাঁরা মরুব্বী ছিলেন তাঁরাই এখন রজনীকান্তের সাহায্যের ভিখারী। তাঁর কৃপা না হলে ইলেকশনে জয়লাভ হয় না, উচুদরের দুষ্কর্ম নির্বিঘ্নে করা যায় না, আইনের জাল কেটে বেরিয়ে আসা যায় না। মিথ্যা প্রচারে কোনও জননেতাই তাঁর কাছে দাঁড়াতে পারেন না। রাম যদি শ্যামকে খুন করে তবে শ্রীরজনীকান্ত অম্লান বদনে ঘোষণা করেন যে শ্যামই রামকে খুন করেছে। তিনি একটু অন্তরালে থাকলেও তাঁর মতন ক্ষমতাশালী লোক আর কেউ নেই। দেশনেতারা সকলেই নিজের নিজের দলে টানবার জন্যে তাঁকে সাধাসাধি করছেন।

১৮৮০