চিঠিপত্র (দশম খণ্ড, ১৯৬৭)/দীনেশচন্দ্র-প্রসঙ্গ
দী নে শ চ ন্দ্র - প্র স ঙ্গ
দীনেশচন্দ্র সেন
৩ নভেম্বর ১৮৬৬ - ২০ নভেম্বর ১৯৩৯
আমি আমার যমজ ভগিনী মগ্নময়ী দেবীকে সঙ্গে লইয়া মাতুলালয় [ঢাকা জেলার] বগজুড়ী গ্রামে এক আম্রবৃক্ষতলে আতুড় ঘরে অবতীর্ণ হইয়াছিলাম। কার্তিক মাসের ১৭ই, শক ১৭৮৮ শুক্রবার রাত্রি তখন ৪ দণ্ড বাকি আছে।
আমার পিতৃদেব ঈশ্বরচন্দ্র সেন ১৮২৫ খৃষ্টাব্দে সুয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
...ইংরেজি শিক্ষার ফলে যাহা হইত তাঁহার তাহাই হইল, তিনি নব ব্রাহ্মমতের পক্ষপাতী হইয়া পড়িলেন।
...ঢাকা জেলা কোর্টের সরকারী উকিল গোকুলকৃষ্ণ মুন্সী মহাশয় তাঁহার কন্যা রূপলতা দেবীকে ইহার সঙ্গে বিবাহ দেন; তখন আমার পিতার বয়স ১৫/১৬।
...পাঁচ বছর বয়সে যথারীতি হাতে খড়ি হওয়ার পর আমি সুয়াপুর গ্রামে বিশ্বম্ভর সাহার পাঠশালায় লেখাপড়া করিতে সুরু করিয়া দেই।...
বিশ্বম্ভরের পাঠশালায় চারুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত পড়া শেষ করিয়া আমি মাণিকগঞ্জ মাইনর স্কুলে ভর্তি হইলাম। ...[হেডমাষ্টার পূর্ণচন্দ্র সেনের] কাছে ইংরেজি প্রথম শিখিয়াছিলাম। ...আমি তাঁহার কাছে বিছাপতি চণ্ডীদাসের পদের ব্যাখ্যা প্রথম শুনিয়াছিলাম।
...আমার সাহিত্য-জীবন অতি শৈশবেই আরদ্ধ হইয়াছিল। যখন আমার সাত বৎসর বয়স, তখন আমি পয়ার ছন্দে সরস্বতীর এক স্তব লিখিয়াছিলাম। তৎপর কত যে কবিতা লিখিয়াছি, তাহার ইয়ত্তা ছিল না।
...দিদি মুক্তালতাবলী পড়িয়া শুনাইতেন। মুক্তা না দেওয়াতে ক্রুদ্ধ কৃষ্ণ মায়াপুরী নির্মাণ করিয়া বিরহী রাধার স্পর্ধা ভাঙিয়া দিয়াছিলেন। স্বর্ণবেত্র হস্তে রাধার অপেক্ষা রূপলাবণ্যশীলা রাজকুমারীরা নিথর রাত্রিতে তাঁহাকে গঞ্জনা ও ঠাট্টা করিয়া অনুতাপ বাড়াইয়া দিয়াছিলেন। সেগুলি দিদি এমনই করুণ কণ্ঠে সুর করিয়া পড়িতেন যেন আমার চক্ষে ছবির পর ছবি ফুটিয়া উঠিত। রাধার দুঃখে শিশুহৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইত। সেই স্মৃতি হইতে ৪২ বৎসর পরে আমি গত বৎসর ‘মুক্তাচুরি’ [প্রথম প্রকাশ ১৪ এপ্রিল ১৯২০] বহি লিখিয়াছিলাম।
তার পর মাইনর ক্লাসে উঠিয়া আমি বাইরণের ‘চাইল্ড হেরল্ড’ ও ‘ডন জুয়ান’ প্রভৃতি পাঠ করি। সকলাংশ না বুঝিলেও যেটুকু বুঝিতাম তাহাতে আমার কল্পনা আমাকে অনেক দূর লইয়া যাইত। আমি খাতার পর খাতা পূর্ণ করিয়া কবিতা লিখিয়া তৃপ্তি বোধ করিতাম।
...যখন সেকেণ্ড ইয়ার ক্লাসে পড়ি তখন একটা নোটবুকে এই মর্মে লিখিয়াছিলাম “বাঙ্গালার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হইব— যদি না পারি তবে ঐতিহাসিক হইব। যদি কবি হওয়া প্রতিভায় না কুলোয়, তবে ঐতিহাসিকের পরিশ্রমলব্ধ প্রতিষ্ঠা হইতে আমায় বঞ্চিত করে, কার সাধ্য?”
...কাব্যানুরাগ দিদি দিগ্বসনী দেবী আমায় দান করিয়াছিলেন। তিনি যখন বৈষ্ণবপদ মৃদু স্বরে গাহিতে থাকিতেন, তখন আমার মনে যে আনন্দ হইত তাহা শুধু অশ্রুজলপ্লাবিত হইয়া ভাসিয়া যাইত না, তাহা আমার কল্পনার ঘরে আরতির ঘিয়ের বাতি জ্বালাইয়া দিত।
...ক্লাসে এবং পরীক্ষার ফল সম্পর্কে আমার খ্যাতি যে রূপই থাকুক, ঢাকা ছাত্রসমাজে শীঘ্রই সকলে জানিতে পারিল— আমি ইংরেজি কবিতা ও বৈষ্ণব-পদ ইত্যাদি এত পড়িয়া ফেলিয়াছি যে কেহই আমার সঙ্গে এই সকল বিষয়ে আঁটিয়া উঠিতে পারিত না।
...ঢাকার বাসায় আমাদের পড়িবার আড্ডাটা কম জমকালো ছিল না। বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের আমরা যেরূপ চর্চা করিয়াছি সেকালের ছাত্রদের মধ্যে কেউ সেরূপ করে নাই।
...আমি যখন প্রথম বার্ষিক শ্রেণীতে পড়ি তখন অক্ষয় সরকারের 'নবজীবন' প্রথম প্রকাশিত হয়। সে বোধ হয় ১৮৮৩ [১৮৮৪] সন হইবে। সেই বৎসরই আমার একটা কবিতা ‘পূজার কুসুম’ নবজীবনে প্রকাশিত হয়।
...ইংরেজি সাহিত্যের একখানি ইতিহাস ভারতীয় আদর্শের মাপ-কাঠিতে বিচার করিয়া বাঙ্গালা ভাষার লিখিতে শুরু করিব, এই সংকল্প করিতেছিলাম, এমন সময় কলিকাতায় পিস্ এসোসিয়েশনের নোটিশ পড়িলাম, ‘বঙ্গভাষা ও ও সাহিত্য’ সম্বন্ধে গবেষণামূলক সর্বোত্তম প্রবন্ধের পুরস্কার একটি রৌপ্য পদক দেওয়া হইবে। প্রবন্ধের বিচারক হইবেন চন্দ্রনাথ বসু ও রজনীকান্ত গুপ্ত।
আমি বঙ্গের প্রাচীন সাহিত্য লইয়া একদিন ঘাঁটাঘাটি করিয়াছিলাম, সুতরাং এ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখিতে সহজেই প্রবৃত্ত হইলাম।...পিস্ এসোসিয়েশন ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ সম্বন্ধে আমার প্রবন্ধই পুরস্কারযোগ্য মনে করিয়াছিলেন। এই প্রবন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই আমি ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস লিখিতে শুরু করিয়াছিলাম।
...কুমিল্লায় ১৮৯৬ সনে যখন আমি উৎকট রোগশয্যায় [মস্তিষ্ক পীড়ায়] পড়িয়াছিলাম, এবং যখন বঙ্গভাষা ও সাহিত্য প্রথম প্রকাশিত হয় [১ম ভাগ ২ ডিসেম্বর, ১৮৯৬] সেই সময় ... আমি রবীন্দ্রবাবুর একখানি চিঠি পাইয়াছিলাম। তাহা একটা গৌরবের জিনিস বলিয়া আমি অনেকদিন রাখিয়া দিয়াছিলাম। ছোট একখানি কাগজ দো-ভাঁজ করিয়া মুক্তার মতো হরফে কবিবর লিখিয়াছিলেন, সেই প্রত্যেকটি হরফ আমার নিকট মুক্তার মতো মূল্যবান বলিয়া মনে হইয়াছিল। বঙ্গ-সাহিত্যের রাজার অভিনন্দন সেই রাজ্যে নূতন প্রবেশার্থীর পক্ষে কত আদর-সম্মানের, তাহা সহজেই অনুমেয়। প্রথমবার কলিকাতায় আসিয়া একটি বছর ছিলাম, তখন আমি শয্যাগত— রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয় নাই। ফরিদপুরে থাকা কালে তিনি তাঁহার ‘ক্ষণিকা’ (প্রথম প্রকাশ ১৯০০) আমাকে উপহার পাঠাইয়াছিলেন আমার মন্তব্যসম্বলিত চিঠির উত্তরে বাং ১৩০৭ সনের ৩০শে ভাদ্র তারিখে তিনি লিখিয়াছিলেন— “আপনার সমালোচনাটি কবির পক্ষে যে কত উপাদেয় হইয়াছে, তাহা ব্যক্ত করিতে পারি না। অসুস্থ শরীরে [ও] যে এই পত্রখানি[১] লিখিয়া পাঠাইয়াছেন, সেজন্য আমার অন্তরের ধন্যবাদ জানিবেন।”[২]...
এই সময় হইতে আমাদের পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে পত্র-ব্যবহার চলিয়াছিল। ১৯০১ সনে কলিকাতায় ফিরিয়া যাইয়া আমি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তাঁহার সঙ্গে দেখা করি।
...তাঁহার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিবার পর অন্য সমস্ত প্রসঙ্গ ছায়ার ন্যায় মন হইতে চলিয়া যায়, এবং ছবির মতো তিনি সমগ্র মনটি দখল করিয়া বসেন। কতদিন আমার ন্যায় শ্রোতার সম্মুখে সারাটিদিন বীণা-নিন্দিত সুরে তিনি গান গাহিয়া কাটাইয়াছেন— কতদিন সাহিত্যধর্মসমাজ —নীতি সম্বন্ধে আলোচনা চলিয়াছে— তিনি নিত্যই নূতন হইয়া দেখা দিয়াছেন।
...আমার সঙ্গে পরিচয়ের পর তিনি ‘চোখের বালি’ লিখিতে শুরু করেন।[৩]
একবার তিনি আমাকে বোলপুরে যাইতে সাদর আহ্বান পাঠাইয়া লিখিয়াছিলেন “আপনি একবার আমার এলাকার মধ্যে আসিয়া পড়িলে তাহার পরে যে কাণ্ডটা করা যাইবে সে আমার মনেই আছে। তাই বলিয়া বিনোদিনীর রহস্য-নিকেতনে আপনাকে অকালে প্রবেশ করিতে দেওয়া আমার সম্পাদকধর্ম্মসঙ্গত হইবে কি না তাহা এখনো স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।”[৪]
কিন্তু চোখের বালি তিনি কিস্তিতে কিস্তিতে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হইবার পূর্বে আমাকে পড়িয়া শুনাইয়াছিলেন, বিনোদিনীর রহস্য-নিকেতনে আমাকে প্রবেশাধিকার দিয়াছিলেন। ‘গোরা’রও অনেকটা ছাপা হইবার পূর্বে আমি তাঁহার মুখে শুনিয়াছিলাম।
...আমি নৌকাডুবি, চোখের বালি, গোরা পড়ি নাই, রবিবাবুর মুখে শুনিয়াছিলাম, তেমন আগ্রহে ইহার পূর্বে কোনো বই শুনি নাই।
...রবীন্দ্রবাবুর সর্বাপেক্ষা চিত্তাকর্ষক গুণ তাঁহার ভগবৎপ্রীতি। ইহাই তাঁহার নৈবেদ্য, গীতাঞ্জলি, খেয়া প্রভৃতি কাব্যের ছত্রগুলিকে এত উজ্জ্বল করিয়াছে। এই ভগবৎ-প্রীতি তাঁহাকে মনুষ্যসমাজ হইতে স্বতন্ত্র করিয়া দেয় নাই, বরং সমস্ত মনুষ্যসমাজ, এমনকি প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর সঙ্গে তাঁহার নৈকট্য ঘনীভূত করিয়া আনন্দরসসিক্ত করিয়া দিয়াছে— ইহা শুধু তাঁহার কবিতার কথা নহে, ইহা শুধু প্রতিভার স্ফূরিত আকস্মিক আলো নহে— ইহা তাঁহার জীবনের কথা, তাঁহার সাধনা। তাঁহার বহু চিঠিপত্র আমার নিকট আছে; এই পত্রগুলিতে অনেকের মধ্যেই সেই সাধকের তপস্যা ব্যক্ত হইয়াছে। তাঁহার বিরুদ্ধে একবার কোনো লোক বদ্ধপরিকর হইয়া দাড়াইয়াছিলেন এবং ক্রমাগত বিদ্বেষের বিষ পত্রিকায় বর্ষণ করিতেছিলেন। আমি অন্য প্রসঙ্গে তাঁহাকে লিখিয়াছিলাম, উত্তরে তিনি লিখিয়াছিলেন “পত্রে আপনি যে কথার আভাসমাত্র দিয়া চুপ করিয়াছেন, সে কথাটা আমার গোচর হইয়াছে।...বিদ্বেষে কোনো সুখ নাই কোনো শ্লাঘা নাই, এইজন্য বিদ্বেষটার [বিদ্বেষ্টার] প্রতিও যাহাতে বিদ্বেষ না আসে, আমি তাহার জন্য বিশেষ চেষ্টা [যত্ন] করিয়া থাকি।”[৫]
...আমি প্রাচীন বঙ্গীয় কাব্য সমূহ হইতে একটা বড় সংগ্রহ-গ্রন্থ সংকলন করিব এই জন্য তিনি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে অনুরোধ করিয়াছিলেন এবং আমাকে লিখিয়াছিলেন “প্রাচীন কবিতা যে প্রস্তাব আপনার নিকট করিয়াছি, তাহা একান্তই [নিতান্তই] প্রয়োজনীয় এবং আপনি ছাড়া আর কাহারো দ্বারা সাধ্য নহে।”[৬]
...যখন আমি বঙ্গভাষার ইতিহাস ইংরেজিতে লিখিতে আরম্ভ করি তখন কি ভাবে লিখিতে হইবে তৎসম্বন্ধে অনেক উপদেশ রবীন্দ্রবাবু দিয়াছিলেন।
...প্রদীপে কবি হেমচন্দ্র সম্বন্ধে আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল, সে প্রবন্ধটি রবীন্দ্রবাবুর বড়ই ভাল লাগিয়াছিল। তিনি বঙ্গদর্শনের সঙ্গে আমার একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া দিয়াছিলেন। বঙ্গদর্শন পরিচালনার গুরুভার আমার উপর ছিল— অনেক পত্রে তাহার উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বিলাতী ও দেশীয় অনেক কাগজ হইতে সন্দর্ভ সঙ্কলন করিবার জন্য সেগুলি আমার নিকট পাঠাইয়া দিতেন।
তাঁহার পত্রগুলির পাতা উল্টাইয়া সেই প্রীতি-সম্বন্ধের পূর্বস্মৃতি মনে জাগিয়া উঠে।