চিত্রা/জ্যোৎস্না রাত্রে
শান্ত কর শান্ত কর এ ক্ষুব্ধ হৃদয়
হে নিস্তব্ধ পূর্ণিমা যামিনী! অতিশয়
উদ্ভ্রান্ত বাসনা বক্ষে করিছে আঘাত
বারম্বার, তুমি এস স্নিগ্ধ অশ্রুপাত
দগ্ধ বেদনার পরে। শুভ্র সুকোমল
মোহভরা নিদ্রাতরা কর-পদ্মদল,
আমার সর্বাঙ্গে মনে দাও বুলাইয়া
বিভাবরী, সর্ব্ব ব্যথা দাও ভুলাইয়া।
বহু দিন পরে আজি দক্ষিণ বাতাস
প্রথম বহিছে। মুগ্ধ হৃদয় দুরাশ
তমার চরণপ্রান্তে রাখি তপ্ত শির
নিঃশব্দে ফেলিতে চাহে রুদ্ধ অশ্রনীর
হে মৌন রজনী! পাণ্ডুর অম্বর হতে
ধীরে ধীরে এস নামি’ লঘু জ্যোৎস্নাস্রোতে
মৃদু হাস্যে নতনেত্রে দাঁড়াও আসিয়া
নির্জন শিয়রতলে। বেড়াক্ ভাসিয়া
রজনীগন্ধার গন্ধ মদির লহরী
সমীর-হিল্লোলে; স্বপ্নে বাজুক্ বাঁশরী
চন্দ্রলোক প্রান্ত হতে; তোমার অঞ্চল
বায়ুভরে উড়ে এসে পুলকচঞ্চল
করুক আমার তনু; অধীর মর্ম্মরে
শিহরি উঠুক্ বন; মাথার উপরে
চকোর ডাকিয়া যাক্ দূরশ্রুত তান;
সম্মুখে পড়িয়া থাক তটান্ত-শয়ান
-সুপ্ত নটিনীর মত-নিস্তব্ধ তটিনী
স্বপ্নালসা!
হের আজি নিদ্রিতা মেদিনী,
ঘরে ঘরে রুদ্ধ বাতায়ন। আমি একা
আছি জেগে, তুমি একাকিনী দেহ দেখা
এই বিশ্বসুপ্তি মাঝে!অসীম সুন্দর
ত্রিলোকনন্দনমূর্ত্তি! আমি যে কাতর
অনন্ত তৃষায়, আমি নিত্য নিদ্রাহীন,
সদা উৎকণ্ঠিত, আমি চিররাত্রিদিন
আনিতেছি অর্ঘ্যভার অন্তর-মন্দিরে
অজ্ঞাত দেবতা লাগি,—বাসনার তীরে
একা বসে গড়িতেছি কত যে প্রতিমা
আপন হৃদয় ভেঙ্গে, নাহি তার সীমা!
আজি মোরে কর দয়া, এস তুমি, অয়ি,
অপার রহস্য তব হে রহস্যময়ী,
খুলে ফেল,—আজি ছিন্ন করে ফেল ওই
চিরস্থির আচ্ছাদন অনন্ত অম্বর!
মহামৌন অসীমতা নিশ্চল সাগর,
তারি মাঝখান হতে উঠে এস ধীরে
তরুণী লক্ষ্মীর মত হৃদয়ের তীরে
আঁখির সম্মুখে! সমস্ত প্রহরগুলি
ছিন্নপুষ্পদল সম পড়ে যা খুলি
তব চারিদিকে,—বিদীর্ণ নিশীথখানি
খসে যাক্ নীচে! বক্ষ হতে লহ টানি’
অঞ্চল তোমার, দাও অবারিত করি’
শুভ্র ভাল, আঁখি হতে লহ অপসরি’
উন্মুক্ত অলক! কোন মর্ত্ত্য দেখে নাই
যে দিব্য মূরতি, আমারে দেখাও তাই
এ বিশ্রব্ধ রজনীতে নিস্তব্ধ বিরলে।
উৎসুক উন্মুখ চিত্ত চরণের তলে
চকিতে পরশ কর;—একটি চুম্বন
ললাটে রাখিয়া যাও-একান্ত নির্জ্জন
সন্ধ্যার তারার মত; আলিঙ্গন-স্মৃতি
অঙ্গে তরঙ্গিয়া দাও, অনন্তের গীতি
বাজায়ে শিরার তন্ত্রে! ফাটুক হৃদয়
ভূমানন্দে-ব্যাপ্ত হয়ে যাক্ শূন্যময়
গানের তানের মত! একরাত্রি তরে
হে অমরী, অমর করিয়া দাও মোরে।
তোমাদের বাসরকুঞ্জের বহির্দ্বারে
বসে আছি,—কানে আসিতেছে বারে বারে
মৃদুমন্দ কথা, বাজিতেছে সুমধুর
রিনিঝিনি রুনুঝুনু সোনার নুপুর,—
কার কেশপাশ হতে খসি’ পুষ্পদল
পড়িছে আমার বক্ষে, করিছে চঞ্চল
চেতনা প্রবাহ! কোথায় গাহিছ গান।
তোমরা কাহারা মিলি করিতেছ পান
কিরণ কনকপাত্রে সুগন্ধি অমৃত-
মাথায় জড়ায়ে মালা পূর্ণ-বিকশিত
পারিজাত;—গন্ধ তারি আসিছে ভাসিয়া
মন্দ সমীরণে,—উন্মাদ করিছে হিয়া
অপূর্ব্ব বিরহে! খোল দ্বার, খোল দ্বার!
তোমাদের মাঝে মোরে লহ একবার
সৌন্দর্য্য সভায়! নন্দনবনের মাঝে
নির্জন মন্দিরখানি,—সেথায় বিরাজে
একটি কুসুমশয্যা, রত্ন দীপালোকে
একাকিনী বসি আছে নিদ্রাহীন চোখে
বিশ্বসোহাগিনী লক্ষ্মী, জ্যোতির্ম্ময়ী বালা;
আমি কবি তারি তরে আনিয়াছি মালা!
৬ মাঘ,
১৩০০ সাল।