বিষয়বস্তুতে চলুন

চিত্রা/বিজয়িনী

উইকিসংকলন থেকে

বিজয়িনী।

অচ্ছোদ সরসীনীরে রমণী যেদিন
নামিলা স্নানের তরে, বসন্ত নবীন
সেদিন ফিরিতেছিল ভুবন ব্যাপিয়া
প্রথম প্রেমের মত কাঁপিয়া কাঁপিয়া
ক্ষণে ক্ষণে শিহরি শিহরি! সমীরণ
প্রলাপ বকিতেছিল প্রচ্ছায় সঘন
পল্লবশয়ন তলে, মধ্যাহের জ্যোতি
মুর্চ্ছিত বনের কোলে; কপোত দম্পতি

বসি শান্ত অকম্পিত চম্পকের ডালে
ঘন চঞ্চ-চুম্বনের অবসর কালে
নিভৃতে করিতেছিল বিহ্বল কূজন।


তীরে শ্বেত শিলাতলে সুনীল বসন
লুঠাইছে একপ্রান্তে স্খলিত-গৌরব
অনাদৃত,—শ্রীঅঙ্গের উত্তপ্ত সৌরভ
এখনো জড়িত তাহে,— আয়ু-পরিশেষ
মুর্চ্ছান্বিত দেহে যেন জীবনের লেশ,—
লুটায় মেখলাখানি ত্যজি কটিদেশ
মৌন অপমানে;—নুপুর রয়েছে পড়ি;
বক্ষের নিচোল বাস যায় গড়াগড়ি
ত্যজিয়া যুগল স্বর্গ কঠিন পাষাণে।
কনক দর্পণ খানি চাহে শূন্যপানে
কার মুখ স্মরি! স্বর্ণপাত্রে সুসজ্জিত
চন্দন কুঙ্কুমপঙ্ক, লুণ্ঠিত লজ্জিত
দুটি রক্ত শতদল, অম্লান সুন্দর
শ্বেত করবীর মাল,—ধৌত শুক্লাম্বর
লঘু স্বচ্ছ, পূর্ণিমার আকাশের মত।


পরিপূর্ণ নীল নীর স্থির অনাহত-
কুলে কুলে প্রসারিত বিহ্বল গভীর
বুকভরা আলিঙ্গন রাশি! সারসীর
প্রান্তদেশে, বকুলের ঘনচ্ছায়া তলে
শ্বেত শিলাপটে, আবক্ষ ডুবায়ে জলে
বসিয়া সুন্দরী,—সকম্পিত ছায়াখানি
প্রসারিয়া স্বচ্ছনীরে-বক্ষে লয়ে টানি
সযত্নপালিত শুভ্র রাজহংসীটিরে
করিছে সোহাগ,—নগ্ন বাহুপাশে ঘিরে
সুকোমল ডানা দুটি, লম্ব গ্রীবা তার
রাখি স্কন্ধ পরে, কহিতেছে বারম্বার
স্নেহের প্রলাপ বাণী—কোমল কপোল
বুলাইছে হংসপৃষ্ঠে পরশ-বিভোল।


চৌদিকে উঠিতেছিল মধুর রাগিণী
জলে স্থলে নভস্তলে; সুন্দর কাহিনী
কে যেন রচিতেছিল ছায়া রৌদ্রকরে
অরণ্যের সুপ্তি আর পাতার মর্ম্মরে
বসন্ত দিনের কত স্পন্দনে কম্পনে
নিঃশ্বাসে উচ্ছ্বাসে ভাষে আভাসে গুঞ্জনে

চমকে ঝলকে। যেন আকাশ-বীণার
রবি-রশ্মী-তন্ত্রীগুলি সুরবালিকার
চম্পক অঙ্গলিঘাতে সঙ্গীত ঝঙ্কারে
কাঁদিয়া উঠিতেছিল—মৌন স্তব্ধতারে
বেদনায় পীড়িয়া মুর্চ্ছিয়া। তরুতলে
স্খলিয়া পড়িতেছিল নিঃশব্দে বিরলে
বিবশ বকুলগুলি; কোকিল কেবলি
অশ্রান্ত গাহিতেছিল,—বিফল কাকলী
কাঁদিয়া ফিরিতেছিল বনান্তর ঘুরে
উদাসিনী প্রতিধ্বনি; ছায়ায় অদূরে
সরোবর প্রান্তদেশে ক্ষুদ্র নির্ঝরিণী
কলনৃত্যে বাজাইয়া মাণিক্য কিঙ্কিণী
কল্লোলে মিশিতেছিল;—তৃণাঞ্চিত তীরে
জল কলকল স্বরে মধ্যাহ্ণ সমীরে
সারস ঘুমায়েছিল দীর্ঘ গ্রীবাখানি
ভঙ্গীভরে বাঁকাইয়া পৃষ্ঠে লয়ে টানি’
ধূসর ডানার মাঝে; রাজহংসদল
আকাশে বলাকা বাঁধি সত্বর-চঞ্চল
ত্যজি কোন্ দূর নদী-সৈকত-বিহার
উড়িয়া চলিতেছিল গলিত-নীহার

কৈলাসের পানে। বহু বনগন্ধ বহে’
অকস্মাৎ শ্রান্ত বায়ু উত্তপ্ত আগ্রহে
লুটায়ে পড়িতেছিল সুদীর্ঘ নিঃশ্বাসে
মুগ্ধ সরসীর বক্ষে স্নিগ্ধ বাহুপাশে।


মদন, বসন্তসখা, ব্যগ্র কৌতুহলে
লুকায়ে বসিয়াছিল বকুলের তলে
পুষ্পাসনে, হেলায় হেলিয়া তরুপরে
প্রসারিয়া পদযুগ নব তৃণস্তরে,
পীত উত্তরীয় প্রান্ত লুষ্ঠিত ভূতলে,
গ্রস্থিত মালতী মালা কুঞ্চিত কুন্তলে,
গৌর কণ্ঠতটে,—সহাস্য কটাক্ষ করি
কৌতুকে হেরিতেছিল মোহিনী সুন্দরী
তরুণীর স্নানলীলা-অধীর চঞ্চল
উৎসুক অঙ্গুলি তার, নির্ম্মল কোমল
বক্ষস্থল লক্ষ্য করি লয়ে পুষ্পশর
প্রতীক্ষা করিতেছিল নিজ অবসর।
গুঞ্জরি ফিরিতেছিল লক্ষ মধুকর
ফুলে ফুলে; ছায়াতলে সুপ্ত হরিণীরে
ক্ষণে ক্ষণে লেহন করিতেছিল ধীরে

বিমুগ্ধ-নয়ন মৃগ; বসন্ত পরশে
পূর্ণ ছিল বনচ্ছায়া আলসে লালসে।

জলপ্রান্তে ক্ষুব্ধ ক্ষুন্ন কম্পন রাখিয়া,
সজল চরণচিহ্ণ আঁকিয়া আঁকিয়া
সোপানে সোপানে, তীরে উঠিলা রূপসী;
মুক্ত কেশভার পৃষ্ঠে পড়ি গেল খসি’।
অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উচ্ছ্বল
লাবণ্যের মায়ামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল
বন্দী হয়ে আছে-তারি শিখরে শিখরে
পড়িল মধ্যাহ্ণ রৌদ্র-ললাটে অধরে
উপরে কটিতটে স্তনাগ্র চূড়ায়
বাহুযুগে,—সিক্ত দেহে রেখায় রেখায়
ঝলকে ঝলকে। ঘিরি তার চারিপাশ
নিখিল বাতাস আর অনন্ত আকাশ
যেন এক ঠাঁই এসে আগ্রহে সন্নত
সর্ব্বাঙ্গ চুম্বিল তার,—সেবকের মত
সিক্ত তনু মুছি নিল আতপ্ত অঞ্চলে
সযতনে,—ছায়াখানি রক্ত পদতলে


চ্যুত বসনের মত রহিল পড়িয়া;—
অরণ্য রহিল স্তব্ধ, বিস্ময়ে মরিয়া!


ত্যজিয়া বকুলমূল মৃদুমন্দ হাসি’
উঠিল অনঙ্গদেব।
সম্মুখেতে আসি
থমকিয়া দাঁড়াল সহসা। মুখপানে
চাহিল নিমেষহীন নিশ্চল নয়ানে
ক্ষণকাল তরে। পরক্ষণে ভূমিপরে
জানু পাতি’ বসি, নির্ব্বাক্‌ বিস্ময়ভরে
নতশিরে, পুষ্পধনু পুষ্পশর ভার
সমর্পিল পদ প্রান্তে পূজা-উপচার
তৃণ শূন্য করি। নিরস্ত্র মদনপানে
চাহিলা সুন্দরী শান্ত প্রসন্ন বয়ানে।

১ মাঘ,
১৩০২।