চোখের বালি/১৭

উইকিসংকলন থেকে
১৭

মাঝখানের এই গোলমালটা একেবারে মুছিয়া ফেলিবার জন্য মহেন্দ্র প্রস্তাব করিল, “আসছে রবিবারে দমদমের বাগানে চড়িভাতি করিয়া আসা যাক্।”

 আশা অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া উঠিল। বিনোদিনী কিছুতেই রাজি হইল না। মহেন্দ্র ও আশা বিনোদিনীর আপত্তিতে ভারি মুষড়িয়া গেল। তাহারা মনে করিল, আজকাল বিনোদিনী কেমন যেন দূরে সরিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে।

 বিকালবেলায় বিহারী আসিবামাত্র বিনোদিনী কহিল, “দেখুন তো বিহারীবাবু, মহিনবাবু দমদমের বাগানে চড়িভাতি করিতে যাইবেন, আমি সঙ্গে যাইতে চাহি নাই বলিয়া আজ সকাল হইতেই দুইজনে মিলিয়া রাগ করিয়া বসিয়াছেন।”

 বিহারী কহিল, “অন্যায় রাগ করেন নাই। আপনি না গেলে ইহাদের চড়িভাতিতে যে কাণ্ডটা হইবে, অতিবড়ো শক্ররও যেন তেমন না হয়।”

 বিনোদিনী। চলুন-না বিহারীবাবু। আপনি যদি যান তবে আমি যাইতে রাজি আছি।

 বিহারী। উত্তম কথা! কিন্তু কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, কর্তা কী বলেন।

 বিহারীর প্রতি বিনোদিনীর এই বিশেষ পক্ষপাতে কর্তা গৃহিণী উভয়েই মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইল। বিহারীকে সঙ্গে লইবার প্রস্তাবে মহেন্দ্রের অর্ধেক উৎসাহ উড়িয়া গেল। বিহারীর উপস্থিতি বিনোদিনীর পক্ষে সকল সময়েই অপ্রিয়, এই কথাটাই বন্ধুর মনে মুদ্রিত করিয়া দিবার জন্য মহেন্দ্র ব্যস্ত— কিন্তু অতঃপর বিহারীকে আটক করিয়া রাখা অসাধ্য হইবে।

 মহেন্দ্র কহিল, “তা বেশ তো, ভালোই তো। কিন্তু বিহারী, তুমি যেখানে যাও একটা হাঙ্গাম না করিয়া ছাড় না। হয়তো সেখানে পাড়া হইতে রাজ্যের ছেলে জোটাইয়া বসিবে, নয়তো কোন্ গোরার সঙ্গে মারামারিই বাধাইয়া দিবে— কিছু বলা যায় না।”

 বিহারী মহেন্দ্রের আন্তরিক অনিচ্ছা বুঝিয়া মনে মনে হাসিল; কহিল, “সেই তো সংসারের মজা, কিসে কী হয়, কোথায় কী ফেসাদ ঘটে, আগে হইতে কিছুই বলিবার জো নাই। বিনোদ-বোঠান, ভোরের বেলায় ছাড়িতে হইবে, আমি ঠিক সময়ে আসিয়া হাজির হইব।”

 রবিবার ভোরে জিনিসপত্র ও চাকরদের জন্য একখানি থার্ড্ক্লাস ও মনিবদের জন্য একখানি সেকেণ্ডক্লাস গাড়ি ভাড়া করিয়া আনা হইয়াছে। বিহারী মস্ত একটা প্যাক্বাক্স সঙ্গে করিয়া যথাসময়ে আসিয়া উপস্থিত। মহেন্দ্র কহিল, “ওটা আবার কী আনিলে। চাকরদের গাড়িতে তো আর ধরিবে না।”

 বিহারী কহিল, “ব্যস্ত হইয়ো না দাদা, সমস্ত ঠিক করিয়া দিতেছি।”

 বিনোদিনী ও আশা গাড়িতে প্রবেশ করিল। বিহারীকে লইয়া কী করিবে, মহেন্দ্র তাই ভাবিয়া একটু ইতস্তত করিতে লাগিল। বিহারী বোঝাটা গাড়ির মাথায় তুলিয়া দিয়া চট্‌ করিয়া কোচবাক্সে চড়িয়া বসিল।

 মহেন্দ্র হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। সে ভাবিতেছিল, ‘বিহারী ভিতরেই বসে কি কী করে তাহার ঠিক নাই।’

 বিনোদিনী ব্যস্ত হইয়া বলিতে লাগিল, “বিহারীবাবু, পড়িয়া যাবেন না তো?”

 বিহারী শুনিতে পাইয়া কহিল, “ভয় করিবেন না, পতন ও মুর্ছা— ওটা আমার পার্টের মধ্যে নাই।”

 গাড়ি চলিতেই মহেন্দ্র কহিল, “আমিই না-হয় উপরে গিয়া বসি, বিহারীকে ভিতরে পাঠাইয়া দিই।”

 আশা ব্যস্ত হইয়া তাহার চাদর চাপিয়া কহিল, “না, তুমি যাইতে পারিবে না।”

 বিনোদিনী কহিল, “আপনার অভ্যাস নাই, কাজ কী, যদি পড়িয়া যান!”

 মহেন্দ্র উত্তেজিত হইয়া কহিল, “পড়িয়া যাব? কখনো না।”

 বলিয়া তখনই বাহির হইতে উদ্যত হইল।

 বিনোদিনী কহিল, “আপনি বিহারীবাবুকে দোষ দেন, কিন্তু আপনিই তো হাঙ্গাম বাধাইতে অদ্বিতীয়।”

 মহেন্দ্র মুখ ভার করিয়া কহিল, “আচ্ছা, এক কাজ করা যাক। আমি একটা আলাদা গাড়ি ভাড়া করিয়া যাই, বিহার ভিতরে আসিয়া বসুক।”

 আশা কহিল,”তা যদি হয়, তবে আমিও তোমার সঙ্গে যাইব।”

 বিনোদিনী কহিল, “আর আমি বুঝি গাড়ি হইতে লাফাইয়া পড়িব?”

 এমনি গোলমাল করিয়া কথাটা থামিয়া গেল।

 মহেন্দ্র সমস্ত পথ মুখ অত্যন্ত গভীর করিয়া রহিল।

 দমদমের বাগানে গাড়ি পৌঁছিল। চাকরদের গাড়ি অনেক আগে ছাড়িয়াছিল, কিন্তু এখনো তাহার খোঁজ নাই।

 শরৎকালের প্রাতঃকাল অতি মধুর। রৌদ্র উঠিয়া শিশির মরিয়া গেছে, কিন্তু গাছপালা নির্মল আলোকে ঝল্মল্ করিতেছে। প্রাচীরের গায়ে শেফালি গাছের সারি রহিয়াছে, তলদেশ ফুলে আচ্ছন্ন এবং গন্ধে আমোদিত।

 আশা কলিকাতার ইষ্টকবন্ধন হইতে বাগানের মধ্যে ছাড়া পাইয়া বন্য মৃগীর মতো উল্লসিত হইয়া উঠিল। সে বিনোদিনীকে লইয়া রাশীকৃত ফুল কুড়াইল, গাছ হইতে পাকা আতা পাড়িয়া আতা গাছের তলায় বসিয়া খাইল, দুই সখীতে দিঘির জলে পড়িয়া দীর্ঘকাল ধরিয়া স্নান করিল। এই দুই নারীতে মিলিয়া একটি নিরর্থক আনন্দে গাছের ছায়া এবং শাখাচ্যুত আলোক, দিঘির জল এবং নিকুঞ্জের পুষ্পপল্লবকে পুলকিত সচেতন করিয়া তুলিল।

 স্নানের পর দুই সখী আসিয়া দেখিল, চাকরদের গাড়ি তখনো আসিয়া পৌঁছে নাই। মহেন্দ্র বাড়ির বারান্দায় চৌকি লইয়া অত্যন্ত শুষ্কমুখে একটা বিলাতি দোকানের বিজ্ঞাপন পড়িতেছে।

 বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারীবাবু কোথায়।”

 মহেন্দ্র সংক্ষেপে উত্তর করিল, “জানি না।”

 বিনোদিনী। চলুন, তাঁহাকে খুঁজিয়া বাহির করি গে।

 মহেন্দ্র। তাহাকে কেহ চুরি করিয়া লইবে, এমন আশঙ্কা নাই। না খুঁজিলেও পাওয়া যাইবে।

 বিনোদিনী। কিন্তু, তিনি হয়তো আপনার জন্য ভাবিয়া মরিতেছেন, পাছে দুর্লভ রত্ন খোওয়া যায়; তাঁহাকে সাত্বনা দিয়া আসা যাক।

 জলাশয়ের ধারে প্রকাণ্ড একটা বাঁধানো বটগাছ আছে, সেইখানে বিহারী তাহার প্যাক্বাক্স খুলিয়া একটি কেরোসিন-চুলা বাহির করিয়া জল গরম করিতেছে। সকলে আসিবা মাত্র আতিথ্য করিয়া বাঁধা বেদির উপর বসাইয়া এক-এক পেয়ালা গরম চা এবং ছোটো রেকাবতে দুই-একটি মিষ্টান্ন ধরিয়া দিল। বিনোদিনী বারবার বলিতে লাগিল, “ভাগ্যে বিহারীবাবু সমস্ত উদ্যোগ করিয়া আনিয়াছিলেন, তাই তো রক্ষা! নহিলে চা না পাইলে মহেন্দ্রবাবুব কী দশা হইত।”

 চা পাইয়া মহেন্দ্র বাচিয়া গেল, তবু বলিল, “বিহারীর সমস্ত বাড়াবাড়ি। চড়িভাতি করিতে আসিয়াছি, এখানেও সমস্ত দস্তুরমত আয়োজন করিয়া আসিয়াছে! ইহাতে মজা থাকে না।”

 বিহারী কহিল, “তবে দাও ভাই, তোমার চায়ের পেয়ালা; তুমি না খাইয়া মজা করো গে— বাধা দিব না।”

 বেলা হয়, চাকররা আসিল না। বিহারীর বাক্স হইতে আহারাদির সর্বপ্রকার সরঞ্জাম বাহির হইতে লাগিল। চাল-ডাল-তরি-তরকারি এবং ছোটো ছোটো বোতলে বিচিত্র পেষা মসলা আবিষ্কৃত হইল। বিনোদিনী আশ্চর্য হইয়া বলিতে লাগিল, “বিহারীবাবু, আপনি যে আমাদেরও ছাড়াইয়াছেন! ঘরে তো গৃহিণী নাই, তবে শিখিলেন কোথা হইতে।”

 বিহারী কহিল, “প্রাণের দায়ে শিখিয়াছি, নিজের যত্ন নিজেকেই করিতে হয়।”

 বিহারী নিতান্ত পরিহাস করিয়া কহিল, কিন্তু বিনোদিনী গম্ভীর হইয়া বিহারীর মুখে করুণ চক্ষের কৃপা বর্ষণ করিল।

 বিহারী ও বিনোদিনীতে মিলিয়া রাঁধাবাড়ায় প্রবৃত্ত হইল। আশা ক্ষীণ সংকুচিত ভাবে হস্তক্ষেপ করিতে আসিলে বিহারী তাহাতে বাধা দিল। অপটু মহেন্দ্র সাহায্য করিবার কোনো চেষ্টাও করিল না। সে গুঁড়ির উপরে হেলান দিয়া একটা পায়ের উপরে আর-একটা পা তুলিয়া কম্পিত বটপত্রের উপরে রৌদ্রকিরণের নৃত্য দেখিতে লাগিল।

 রন্ধন প্রায় শেষ হইলে পর বিনোদিনী কহিল, “মহিনবাবু, আপনি ঐ বটের পাতা গণিয়া শেষ করিতে পারিবেন না, এবারে স্নান করিতে যান।”

 ভূত্যের দল এতক্ষণে জিনিসপত্র লইয়া উপস্থিত হইল। তাহাদের গাড়ি পথের মধ্যে ভাঙিয়া গিয়াছিল। তখন বেলা দুপুর হইয়া গেছে।

 আহারান্তে সেই বটগাছের তলায় তাস খেলিবার প্রস্তাব হইল; মহেন্দ্র কোনোমতেই গা দিল না, এবং দেখিতে দেখিতে ছায়াতলে ঘুমাইয়া পড়িল। আশা বাড়ির মধ্যে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া বিশ্রামের উদ্যোগ করিল।

 বিনোদিনী মাথার উপর একটুখানি কাপড় তুলিয়া দিয়া কহিল, “আমি তবে ঘরে যাই।”

 বিহারী কহিল, “কোথায় যাইবেন, একটু গল্প করুন। আপনাদের দেশের কথা বলুন।”

 ক্ষণে ক্ষণে উঞ্চ মধ্যাহ্নের বাতাস তরুপল্লব মর্মরিত করিয়া চলিয়া গেল, ক্ষণে ক্ষণে দিঘির পাড়ে জাম গাছে ঘনপত্রের মধ্য হইতে কোকিল ডাকিয়া উঠিল। বিনোদিনী তাহার ছেলেবেলাকার কথা বলিতে লাগিল, তাহার বাপ-মায়ের কথা, তাহার বাল্যসাথির কথা। বলিতে বলিতে তাহার মাথা হইতে কাপড়টুকু খসিয়া পড়িল; বিনোদিনীর মুখে খরযৌবনের যে একটি দীপ্তি সর্বদাই বিরাজ করিত, বাল্যস্মৃতির ছায়া আসিয়া তাহাকে স্নিগ্ধ করিয়া দিল। বিনোদিনীর চক্ষে যে কৌতুকতীব্র কটাক্ষ দেখিয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টি বিহারীর মনে এ পর্যন্ত নানাপ্রকার সংশয় উপস্থিত হইয়াছিল, সেই উজ্জ্বলকৃষ্ণ জ্যোতি যখন একটি শান্তসজল রেখায় ম্লান হইয়া আসিল তখন বিহারী যেন আর-একটি মানুষ দেখিতে পাইল। এই দীপ্তিমণ্ডলের কেন্দ্রস্থলে কোমল হৃদয়টুকু এখনো সুধাধারায় সরস হইয়া আছে, অপরিতৃপ্ত রঙ্গরস-কৌতুকবিলাসের দহনজ্বালায় এখনো নারীপ্রকৃতি শুষ্ক হইয়া যায় নাই। বিনোদিনী সলজ্জ সতীস্ত্রীভাবে একান্ত-ভক্তিভরে পতিসেবা করিতেছে, কল্যাণপরিপূর্ণা জননীর মতো সন্তানকে কোলে ধরিয়া আছে, এ ছবি ইতিপূর্বে মুহূর্তের জন্যও বিহারীর মনে উদিত হয় নাই— আজ যেন রঙ্গমঞ্চের পটখানা ক্ষণকালের জন্য উড়িয়া গিয়া ঘরের ভিতরকার একটি মঙ্গলদৃশ্য তাহার চোখে পড়িল। বিহারী ভাবিল, “বিনোদিনী বাহিরে বিলাসিনী যুবতী বটে, কিন্তু তাহার অন্তরে একটি পূজারতা নারী নিরশনে তপস্যা করিতেছে।” বিহারী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে কহিল, ‘প্রকৃত আপনাকে মানুষ আপনিও জানিতে পারে না, অন্তর্যামাই জানেন; অবস্থাবিপাকে যেটা বাহিরে গড়িয়া উঠে সংসারের কাছে সেইটেই সত্য।’ বিহারী কথাটাকে থামিতে দিল না, প্রশ্ন করিয়া করিয়া জাগাইয়া রাখিতে লাগিল; বিনোদিনী এ-সকল কথা এ পর্যন্ত এমন করিয়া শোনাইবার লোক পায় নাই— বিশেষত, কোনো পুরুষের কাছে সে এমন আত্মবিস্মৃত স্বাভাবিক ভাবে কথা কহে নাই— আজ অজস্র কলকণ্ঠে নিতান্ত সহজ হৃদয়ের কথা বলিয়া তাহার সমস্ত প্রকৃতি যেন নববারিধারার স্নাত স্নিগ্ধ এবং পরিতৃপ্ত হইয়া গেল।

 ভোরে উঠিবার উপদ্রবে ক্লান্ত মহেন্দ্রের পাঁচটার সময় ঘুম ভাঙিল। বিরক্ত হইয়া কহিল, “এবার ফিরিবার উদ্যোগ করা যাক।”

 বিনোদিনী কহিল, “আর-একটু সন্ধ্যা করিয়া গেলে কি ক্ষতি আছে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “না, শেষকালে মাতাল গোরার হাতে পড়িতে হইবে?”

 জিনিসপত্র গুছাইয়া তুলিতে অন্ধকার হইয়া আসিল। এমন সময় চাকর আসিয়া খবর দিল, “ঠিকা গাড়ি কোথায় গেছে, খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। গাড়ি বাগানের বাহিরে অপেক্ষা করিতেছিল, দুইজন গোরা গাড়োয়ানের প্রতি বলপ্রকাশ করিয়া স্টেশনে লইয়া গেছে।”

 আর-একটা গাড়ি ভাড়া করিতে চাকরকে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। বিরক্ত মহেন্দ্র কেবলই মনে মনে কহিতে লাগিল, ‘আজ দিনটা মিথ্যা মাটি হইয়াছে।’ অধৈর্য সে আর কিছুতেই গোপন করিতে পারে না, এমনি হইল।

 শুক্লপক্ষের চাঁদ ক্রমে শাখাজালজড়িত দিক্প্রান্ত হইতে মুক্ত আকাশে আরোহণ করিল। নিস্তব্ধ নিষ্কম্প বাগান ছায়ালোকে খচিত হইয়া উঠিল। আজ এই মায়ামণ্ডিত পৃথিবীর মধ্যে বিনোদিনী আপনাকে কী-একটা অপূর্ব ভাবে অনুভব করিল। আজ সে যখন তরুবীথিকার মধ্যে আশাকে জড়াইয়া ধরিল, তাহার মধ্যে প্রণয়ের কৃত্রিমতা কিছুই ছিল না। আশা দেখিল, বিনোদিনীর দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছে। আশা ব্যথিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কী ভাই চোখের বালি, তুমি কাঁদিতেছ কেন।”

 বিনোদিনী কহিল, “কিছু নয় ভাই, আমি বেশ আছি। আজ দিনটা আমার বড়ো ভালো লাগিল।”

 আশা জিজ্ঞাসা করিল, “কিসে তোমার এত ভালো লাগিল, ভাই।”

 বিনোদিনী কহিল, “আমার মনে হইতেছে, আমি যেন মরিয়া গেছি, যেন পরলোকে আসিয়াছি, এখানে যেন আমার সমস্তই মিলিতে পারে।”

 বিস্মিত আশা এ-সব কিছুই বুঝিতে পারিল না। সে মৃত্যুর কথা শুনিয়া দুঃখিত হইয়া কহিল, “ছি ভাই চোখের বালি, অমন কথা বলিতে নাই।”

 গাড়ি পাওয়া গেল। বিহারী পুনরায় কোচবাক্সে চড়িয়া বসিল। বিনোদিনী কোনো কথা না বলিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল, জ্যোৎস্নায় স্তম্ভিত তরুশ্রেণী ধাবমান নিবিড় ছায়াস্রোতের মতো তাহার চোখের উপর দিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল। আশা গাড়ির কোণে ঘুমাইয়া পড়িল। মহেন্দ্র সুদীর্ঘ পথ নিতান্ত বিমর্ষ হইয়া বসিয়া থাকিল।