ছবি/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 কিছুকাল এইরূপ আমোদে অতিবাহিত হইলে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার খবর কি? এর মধ্যে কতগুলো চোর ধরিলে বল?”

 আমি হাসিয়া বলিলাম, “সে কথা এখন নয়। আপাতঃ আজ আমি একটা গোলযোগে পড়িয়াছি। একখানা উড়ো চিঠি আসিয়াছে।”

 ডা। চিঠিখানা কোথায়?

 আ। এই নাও। পড়ে দেখ দেখি, তুমি কিছু করিতে পারি কি না?

 ডা। যখন তুমি কিছু পার নাই, তখন আমি কোন্ ছার।

 আ। সে কথা বলা যায় না।

 ডাক্তার চিঠিখানি অনেকবার পড়িলেন। কিন্তু কোন কথা বলিতে পারিলেন না। তখন আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “ডাক্তার, তোমার বিশেষ কিছু কাজ আছে?”

 ডা। কই না।

 আ। খানিকক্ষণ এখানে থাকিতে পারিবে?

 ডা। নিশ্চয়ই পারিব।

 আ। স্ত্রীর কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হইবে না ত?

 ডা। বোধ হয় না।

 আ। কেন?

 ডা। তুমি যখন মাঝে আছ, তখন আমি সে ভয় করি না। তোমার উপর আমার স্ত্রীর যথেষ্ট বিশ্বাস আছে।

 আ। তবে ভালই হইয়াছে, রাত্রি সাড়ে সাতটা বাজিয়া গিয়াছে। ঠিক আট্‌টার সময় তিনি আসিবেন লিখিয়াছেন।

 ডা। বেশ কথা। আমি অনেক দিন তোমার কাজ দেখি নাই। বড় সৌভাগ্যবশতই আজ এখানে আসিয়াছি।

 আ। তবে এই আধ ঘণ্টা কোন সংবাদপত্র পাঠ কর। তিনি এখনই আসিবেন।

 আট্‌টা বাজিবার অব্যবহিত পরেই আমার ভৃত্য গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, “একটী বাবু আপনার সহিত নির্জ্জনে দেখা করিতে চান।”

 ভৃত্যের কথা শুনিয়া আমি বলিলাম, “বাবুকে এখানে আন।”

 ভৃ। তিনি এখানে আসিতে চান না।

 আ। কেন?

 ভৃ। আমি ডাক্তার বাবুর কথা তাঁহাকে বলিয়াছি।

 আ। কেন বলিলে?

 ভৃ। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার নিকট কেহ আছে কি না? আমি তাঁহাকে সত্য কথাই বলিয়াছি।

 আ। বেশ করিয়াছ। এখন আমার নাম করিয়া তাঁহাকে এখানে লইয়া আইস।

 ভৃত্য প্রস্থান করিল এবং অবিলম্বে একজন সুপরিচ্ছদধারী সম্ভ্রান্ত যুবককে সঙ্গে করিয়া আনিল।

 যুবককে দেখিতে অতি সুপুরুষ। বয়স পঁচিশের অধিক নহে। তিনি নাতিশীর্ণ, নাতিস্থূল; তাঁহার চক্ষুদ্বয় আয়ত, বর্ণ গৌর; তাঁহার পরিধানে একখানি সুন্দর ঢাকাই কাপড়, গায়ে ভাল বনাতের কোট, তাহার উপর একখানি বহুমূল্য শাল। পায়ে পম্-সু। হাতে স্বর্ণমণ্ডিত একগাছি ফ্যান্সি লাঠী। চক্ষে স্বর্ণের চশমা।

 গৃহে প্রবেশ করিয়া যুবক আমার বন্ধু ডাক্তারের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন এবং পরক্ষণেই মুখ বিকৃত করিয়া আমার দিকে চাহিলেন। আমি তাঁহার মনোভাব বুঝিতে পারিলাম এবং নিকটস্থ একখানি আরাম-চৌকিতে বসিতে বলিলাম। যুবক আমার কথামত চেয়ারে উপবেশন করিলেন।

 আমি তখন যুবককে ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম, কিন্তু তাঁহাকে আর কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া বোধ হইল না। যুবক কিন্তু গৃহে প্রবেশ করিয়াই আমাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন। নতুবা তিনি ডাক্তারের দিকে ওরূপ ভাবে চাহিবেন কেন?

 ক্ষণকাল পরে যুবক জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি আমার পত্র পাইয়াছেন?”

 আমি সহাস্যমুখে উত্তর করিলাম, “আপনার পত্র না পাইলে এতক্ষণ বাসায় ফিরিয়া যাইতাম। এই দারুণ শীতে আজ আমার কোন কাজ করিবার ইচ্ছা ছিল না।

 যুবক। তবে ত আমি বড় অন্যায় করিয়াছি।

 আ। কিছু না। কাজ ছিল না বলিয়াই বাড়ী যাইতাম। আমি কাজ ফেলিয়া আমোদ করিতে ইচ্ছা করি না। আর এক কথা, ইনি আমার প্রিয় বন্ধু বলাই বাবু, একজন বিখ্যাত ডাক্তার। সময়ে সময়ে আমি ইঁহার নিকট পরামর্শ গ্রহণ করিয়া থাকি। আমায় যে কথা বলিবেন, ইনিও সেই কথা জানিতে পারিবেন। সুতরাং ইঁহার সমক্ষে আপনি সকল কথাই বলিতে পারেন; তাহাতে আপনার কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হইবে না।

 যু। যে বিষয় বলিবার জন্য এখানে আসিয়াছি, তাহা বড়ই ভয়ানক। লোকে ঘুণাক্ষরে সে কথা জানিতে পারিলে আমার সর্ব্বনাশ হইবে।

 আ। আপনার কোন চিন্তা নাই। আমাদের নিকট যাহা বলিবেন, তাহা তৃতীয় ব্যক্তি জানিতে পারিবে না। কিন্তু আপনাকে কি বলিয়া সম্বোধন করিব?

 যু। আপনার নিকট মিথ্যা বলিতে পারিব না। আপনি পত্রের কথামত এখন আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিবেন না।

 এই বলিয়া যুবক ক্ষণকাল কি চিন্তা করিলেন। পরে যেন হতাশ হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “না মহাশয়! আমি ভুল বুঝিয়াছিলাম। আপনাকে বিশ্বাস না করিলে আমি কোনরূপে কৃতকার্য্য হইতে পারিব না। আমি—রাজবাটীর একমাত্র বংশধর, নাম বিদ্যুৎপ্রকাশ।

 আমিও সেইরূপ অনুমান করিয়াছিলাম, সম্প্রতি এক সংবাদপত্রে তাঁহার বিবাহের বিজ্ঞাপন বাহির হইয়াছিল, তাহাও জানিতাম, সেই জন্য বলিলাম, “তবে আপনারই বিবাহের কথা সেদিন সংবাদ-পত্রে পাঠ করিয়াছি?”

 যুবক বিবাহের নাম শুনিয়া যেন বিমর্ষ হইলেন? বলিলেন, “এখন আর সে কথায় কাজ নাই। আপনি আমার বক্তব্য শুনুন। তাহার পর যেমন বুঝিবেন, সেইরূপ কার্য্য করিবেন।”

 আমি আগ্রহসহকারে বলিলাম, “ভাল, তাহাই হউক।”

 যু। প্রায় তিন বৎসর অতীত হইল, আমি কিছুদিন কলিকাতায় বাসা ভাড়া লইয়া বাস করিতাম। সেই সময়ে এক প্রসিদ্ধ অভিনেত্রীর সহিত আমার ঘনিষ্ঠতা হয়।

 আমি সমস্ত কথা না শুনিয়াই ব্যাপার বুঝিতে পারিলাম। পরে বলিলাম, “সেই অভিনেত্রী এখন আপনাকে কোন ফাঁদে ফেলিবার পরামর্শ করিতেছে, কেমন?”

 যু। আজ্ঞা হাঁ।

 আ। সে বলে কি?

 যু। আমার বিবাহের সংবাদ পাইয়া সে আমার ভাবী শ্বশুরকে আমাদের সকল কথা বলিবার চেষ্টা করিতেছে। যদি আমার শ্বশুর মহাশয় আমার পূর্ব্ব চরিত্রের কথা জানিতে পারেন, তাহা হইলে তিনি কখনও আমাকে তাঁহার কন্যা সমর্পণ করিবেন না। ক্রমে আমার পিতাও আমার গুণ জানিতে পারিবেন, তাহা হইলে আমার আর মুখ দেখাইবার উপায় থাকিবে না।

 আমি তাঁহার কথায় আশ্চর্য্যান্বিত হইলাম। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম,“আপনি বড় মানুষের ছেলে হইয়া এমন কি পাপ করিয়াছেন, যাহার জন্য এত ভাবিত হইতেছেন? সেই অভিনেত্রীকে কি আপনি বিবাহ করিয়াছিলেন?”

 বিদ্যুৎপ্রকাশ হাসিয়া উত্তর করিলেন, “না, বিবাহ করি নাই।”

 আ। রেজেষ্ট্রী করা কোন দলিল আছে?

 বি। কি সম্বন্ধে?

 আ। আপনাদিগের উভয় নামে কোন দলিলাদি রেজেষ্ট্রির জন্য পাঠান হইয়াছিল কি?

 বি। না, সে ভয়ও নাই।

 সা। তবে কেবল ফাঁকা চিঠিতে সে আপনার কি করিবে? যদি কখনও সেরূপ চিঠি আপনার ভাবি শ্বশুর কিম্বা পিতার নিকট আনীত হয়, আপনি অনায়াসে উহা জাল বলিয়া প্রমাণ করিতে পারিবেন।

 বি। চিঠিতে আমার মোহর আছে।

 আ। মোহর চুরি যাইতে পারে, জাল হইতে পারে।

 বি। আমার মোহরাঙ্কিত চিঠির কাগজ আর কাহারও নাই।

 আ। আপনার বাক্স হইতে কাগজখানি চুরি গিয়াছিল, এ কথা অক্লেশে বলিতে পারিবেন।

 বি। কেবল চিঠি নহে, আমার ফটো তাহার কাছে আছে।

 আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “আপনি যেখানে ফটোগ্রাফ উঠাইয়া ছিলেন, সেইখানে উহার “নেগেটিভ” আছে, কেহ ইচ্ছা করিলে তথা হইতে যত ইচ্ছা আপনার ফটোগ্রাফ পাইতে পারে।

 বি। আজ্ঞা না, তদপেক্ষাও গুরুতর। সে ফটোতে আমাদের দুজনের আকৃতি আছে।

 আমি হতাশ হইয়া বলিয়া উঠিলাম, “কি ভয়ানক! এ যে সর্ব্বনাশ করিয়াছেন?”

 বিদ্যুৎপ্রকাশ লজ্জিত হইয়া বলিলেন, “তখন আমার হিতাহিতজ্ঞান লোপ পাইয়াছিল। অভিনেত্রী আমায় যাদু করিয়াছিল জানি না, কোন্ গুণে আমি তাহার এত বশীভূত। কিন্তু এখন উপায় কি? ছবিখানি আদায় করিতে হইবে।”

 আ। আপনি মিষ্ট কথায় আদায় করিতে পারিবেন না?

 বি। না, আমি অনেক চেষ্টা করিয়াছি।

 আ। অর্থলোভে সে উহা বিক্রয় করতে পারে।

 বি। অনেক টাকা দিতে চাহিয়াছিলাম, সে কিছুতেই ছবি দিতে চায় না।

 আ। তবে চুরি করিবার চেষ্টা করুন।

 বি। সে চেষ্টাও করিয়াছি, কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই। সর্ব্বশুদ্ধ পাঁচবার সেই অভিনেত্রী চোরের হস্তে পতিত হয়। দুইবার তাহার বাড়ীতে, একবার রেলে, আর দুইবার পথে। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, কেহই সেই ছবিখানি বাহির করিতে পারে নাই।

 আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “এ বড় বিষম সমস্যা! এতবার চুরি হইয়া গেল, কিন্তু ছবি বাহির হইল না! সে অভিনেত্রী যে সে রমণী নহে,—একজন পাকা চোর।

 বি। এখন উপায়?

আ। সে অভিনেত্রী ছবিখানি রাখিয়া কি করিতে চায়? আপনি তাহার কোন পত্র পাইয়াছেন? কিম্বা তাহার মুখে কোন কথা শুনিয়াছেন?

 বি। আজ্ঞা হাঁ! সেই ছবি আমার গুরুজনের নিকট পাঠাইয়া দিবে। যদি আমার ভাবী-পত্নী এ বিষয় জানিতে পারে, তাহা হইলে সে আমায় কি মনে করিবে, একবার ভাবিয়া দেখুন। তাহা অপেক্ষা আমার মৃত্যু শ্রেয়। সে অভিনেত্রীকে আমার বেশ জানা আছে। সে কথায় যাহা বলে, কাজেও ঠিক সেইরূপ করিয়া থাকে। সে যখন বলিয়াছে, তখন সে নিশ্চয়ই ঐ ছবিখানি আমার গুরুজনের নিকট পাঠাইয়া আমার সর্ব্বনাশ করিবে।

 আ। আপনি নিশ্চয় জানেন যে, সে এখনও উহা পাঠায় নাই?

 বি। আজ্ঞা হাঁ, ছবিখানি এখনও পাঠান হয় নাই।

 আ। কেমন করিয়া জানিলেন?

 বি। বিবাহের দিন স্থির হইলেই সে ছবিখানি পাঠাইবে, এরূপ বলিয়াছে।

 আ। কবে দিন স্থির হইবে?

 বি। এই সোমবারে।

 আ। আজ বৃহস্পতিবার। এখন তবে তিন দিন সময় আছে?

 বি। আজ্ঞা হাঁ, সময় আছে বটে, কিন্তু আমার মন অত্যন্ত অস্থির হইয়াছে। যদি এই সময়ের মধ্যে কিছু না করা যায়, তাহা হইলে আমার সর্ব্বনাশ হইবে।

 আ। আপনি কি এখন কলিকাতায় বাস করিতেছেন?

 বি। আজ্ঞে হাঁ। বৌ-বাজার স্ট্রীটে, নগেন্দ্রনাথ নাম ধারণ করিয়া, আপাততঃ বাস করিতেছি।

 আ। তবে ভালই হইয়াছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার কোন চিন্তা নাই। কাল আমার হাতে এক গুরুতর কাজ আছে। সুতরাং কাল আপনার কিছু করিতে পারিব না। পরশ্ব আপনি আমার পত্র পাইবেন।

 বি। যত শীঘ্র পারেন, আমায় সকল ব্যাপার জানাইবেন। আমি যে কিরূপ উদ্বিগ্ন অবস্থায় কাল কাটাইব, তাহা-আপনি বেশ বুঝিতে পারিয়াছেন।

 আ। আপনার কোন চিন্তা নাই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

 আমার কথায় অশ্বাসিত হইয়া তিনি বিদায় গ্রহণ করিলেন।