ছিন্নপত্র (১৯১২)/৬৬
নাটোর,
২রা ডিসেম্বর।
কাল ম—র ওখানে গিয়েছিলুম। বিকেলে সকলে মিলে বেড়াতে গেলুম। দুইধারে মাঠের মাঝখান দিয়ে রাস্তাটা আমার বেশ লেগেছিল। বাংলাদেশের ধূ ধূ জনহীন মাঠ এবং তার প্রান্তবর্ত্তী গাছপালার মধ্যে সূর্য্যাস্ত—কি একটি বিশাল শান্তি এবং কোমল করুণা! আমাদের এই আপনাদের পৃথিবীর সঙ্গে আর ঐ বহুদূরবর্ত্তী আকাশের সঙ্গে কি একটি স্নেহভারবিনত মৌন ম্লান মিলন! অনন্তের মধ্যে যে একটি প্রকাণ্ড চিরবিরহবিষাদ আছে সে এই সন্ধ্যেবেলাকার পরিত্যক্তা পৃথিবীর উপরে কি একটি উদাস আলোকে আপনাকে ঈষৎ প্রকাশ করে দেয়,– সমস্ত জলে স্থলে আকাশে কি একটি ভাষাপরিপূর্ণ নীরবতা! অনেকক্ষণ চুপ করে অনিমেষ নেত্রে চেয়ে দেখ্তে দেখ্তে মনে হয়, যদি এই চরাচর ব্যাপ্ত নীরবতা আপনাকে আর ধারণ করতে না পারে, সহসা তার অনাদি ভাষা যদি বিদীর্ণ হয়ে প্রকাশ পায় তাহলে কি একটা গভীর গম্ভীর শান্তসুন্দর সকরুণ সঙ্গীত পৃথিবী থেকে নক্ষত্রলোক পর্যন্ত বেজে ওঠে! আসলে তাই হচ্চে। আমরা একটু নিবিষ্টচিত্তে স্থির হয়ে চেষ্টা করলে জগতের সমস্ত সম্মিলিত আলোক এবং বর্ণের বৃহৎ হার্ম্মনিকে মনে মনে একটি বিপুল সঙ্গীতে তর্জ্জমা করে নিতে পারি। এই জগৎব্যাপী দৃশ্যপ্রবাহের অবিশ্রাম কম্পনধ্বনিকে কেবল একবার চোখবুজে মনের কান দিয়ে শুন্তে হয়। কিন্তু আমি এই সূর্য্যোদয় এবং সূর্যাস্তের কথা কতবার লিখ্ব! নিত্য নূতন করে অনুভব করা যায় কিন্তু নিত্য নূতন করে প্রকাশ করি কি করে!