ছিন্নমুকুল/একাদশ পরিচ্ছেদ
একাদশ পরিচ্ছেদ
বিস্ময়
যামিনীনাথ ভবানীপুরে এক জন ধনশালী যুবা। তিনি চতুর্ব্বিংশ বর্ষীয়। শরীর কিছু কৃশ, মুখাবয়বও সর্ব্বাঙ্গসুন্দর নহে, কিন্তু বর্ণ গৌর এবং দেখিতে কুরূপ নহেন। ললাট প্রশস্ত না হউক, নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে, চক্ষু আয়ত, কিন্তু দৃষ্টি তত সরল নহে বলিয়া চক্ষুর তেমন সৌন্দর্য্য নাই; নাসিকা সুবঙ্কিম, তাহা কার্য্যতৎপরতার চিহ্ন।
মাতা ও এক বৃদ্ধা জ্যেষ্ঠতাতপত্নী এবং একমাত্র ভগিনী ছাড়া যামিনীনাথের আর কেহ নাই। যামিনীর অষ্টাদশ বর্ষ বয়ঃক্রমের সময় তাঁহার পিতার মৃত্যু হয়। এই অল্প বয়সে সমস্ত বিভবের অধিপতি হইয়া তাঁহার মস্তক কিছু ঘুরিয়া গিয়াছিল; পিতার মৃত্যুর পরেই তিনি স্কুল ছাড়িয়া দেন। সেই অবধি পুস্তকের সহিত তাঁহার সম্পর্ক রহিত। যেমন হইয়া থাকে, কতকগুলি চাটুকার লইয়া, কতকগুলি সঙ্গী বন্ধুবান্ধব লইয়া তিনি সময় কাটাইতে লাগিলেন। তিনি ন্যায়ান্যায় যে কাজই করুন, চাটুকারগণ তাহাতেই তাঁহার গুণ কীর্ত্তন করিতে থাকে। যামিনীনাথ যে তাহাদের অন্যায় প্রশংসা বোঝেন না তাহা নহে, তিনি বিলক্ষণ বুদ্ধিমান, কিন্তু বুঝিয়াও তিনি তাহাতে সন্তুষ্ট বই অসন্তুষ্ট হন না। যামিনীর হাত বিলক্ষণ দরাজ। প্রশংসা পাইবার নিমিত্ত চাটুকারদিগকে তুষ্ট করিতে, মানের জন্য বন্ধুদের কথা রাখিতে, নাম কিনিবার জন্য গবর্ণমেণ্টকে দান করিতে, তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন না। একে পিতার অনেক ধন, তাহাতে যামিনীর জ্যেষ্ঠতাতপত্নী আপন পিতার যে পাঁচলক্ষ টাকা পাইয়াছিলেন, যামিনীনাথ সে টাকারও ভাবী অধিপতি হইবেন আশা ছিল, কেন না জ্যেষ্ঠতাতপত্নীর আর কেহই ছিল না। সুতরাং ব্যয় করিতে প্রথম প্রথম তিনি কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইতেন না। কিন্তু এই রূপে দুই চারি বৎসরেই তিনি যখন পিতৃসঞ্চিত ধনের অর্দ্ধেক খােয়াইয়া ফেলিলেন তখন তাঁহার চেতনা হইল। তিনি দরাজ হাত ক্রমে গুটাইয়া আনিলেন, দানের মাত্রা সকলই প্রায় কমাইয়া ফেলিলেন। এখন তিনি সুবিধা পাইলে নিজেই কোন বন্ধুর ঘাড় ভাঙ্গিতে পারিলে ছাড়িতেন না।
তিন চার বৎসর পূর্ব্বে, পিতার মৃত্যুর আগে যখন যামিনীনাথ কলেজে পড়িতেন তখন প্রমােদের সহিত তাঁহার আলাপ হয়। তাহার পর কলেজ ছাড়িয়াও যামিনী প্রমােদকে সর্ব্বদা নিমন্ত্রণ আমন্ত্রণ করিতেন, সর্ব্বদাই প্রমােদের সঙ্গে দেখা করিতে যাইতেন। আসল কথা প্রমােদ, ধনবান তারাকান্তের বিষয়ের ভবিষ্য-মালিক, সুতরাং এখন হইতেই যামিনীনাথ তাঁহাকে আপন দলে টানিবার অভিপ্রায়ে ছিলেন। পরস্পর নানা মতের বিভিন্নতা সত্ত্বেও ক্রমে এইরূপে যামিনীর সহিত প্রমােদের বিশেষ বন্ধুতা জন্মিল; কিন্তু নীরজা যামিনীনাথের সহিত তাঁহার বাড়ী আসা অবধি আর প্রমােদের সহিত যামিনীর দেখা শুনা হয় নাই। সেই অবধি আর প্রমােদকে নিমন্ত্রণ করা বা প্রমোদের বাড়ী যাওয়া যামিনীর ঘটিয়া উঠে নাই। প্রমােদও অবকাশ অভাবে এখানে আসিতে পারেন নাই। আজ প্রমােদ এখানে আসিয়া শুনিলেন—যামিনীনাথ বাড়ী নাই, কিন্তু শীঘ্রই ফিরিবেন শুনিয়া তাহার বৈঠকখানা গৃহে আসিয়া বসিলেন।
যামিনীনাথের একটু বিশেষরূপে পরিচয় দিবার নিমিত্ত এই স্থলে আর একটি কথা বলা আবশ্যক। যামিনীনাথ বিদেশীয় রীতিনীতি ও আচারব্যবহারের বড় বিদ্বেষী; ভালই হৌক্ আর মন্দই হৌক্ এ সকলের প্রতি তাঁহার দারুণ ঘৃণা। এমন কি বিদেশীয় ভাষা আর শিখিবেন না বলিয়াই তিনি স্কুল ত্যাগ করেন। কিন্তু যে ঘরটিতে প্রমোদ আসিয়া বলিলেন সেটি সম্পূর্ণ ইংরাজি প্রথায় সজ্জিত। মধ্যে টেবিল, চতুঃপার্শ্বে কৌচ চৌকি, তাহাতেই সর্ব্বদা যামিনী বন্ধুবান্ধব লইয়া বসিতেন। বোধ করি নীচের বিছানায় বসিতে পৃষ্ঠ-বেদনা করিত সেই হেতু সুবিধার অনুরোধে স্বদেশানুরাগী যামিনীনাথের অগত্যা বিদেশীয় অনুকরণ করিতে হইয়াছিল।
গৃহের একটি প্রান্তে একটি লম্বা শ্বেত প্রস্তরের টেবিল, তাহার মধ্যস্থলে একটি ফুলদানি, ফুলদানির দুই পার্শ্বে দুই খানি অ্যালবম্। সময় কাটাইবার অভিপ্রায়ে প্রমোদ সেই টেবিলের নিকট একখানি চৌকিতে বসিয়া অ্যালবম্ খুলিয়া ছবি দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন তাহাতে য়ুরোপের সমস্ত রাজা রাণীর এবং সে দেশীয় প্রসিদ্ধা সুন্দরীগণের ছবি রহিয়াছে। ফ্রান্সের রাজ্ঞী ইয়ুজিনী ইংলণ্ডের যুবরাজ পত্নী এবং মিশেশ ল্যাংট্রি প্রভৃতি যাঁহারা সুন্দরী বলিয়া প্রসিদ্ধ, প্রমোদ চিত্র দেখিয়া মনে মনে তাঁহাদের সৌন্দয্য অনুভব করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। মুখের প্রত্যেক অবয়বগুলি বিশেষ মনোযোগ দিয়া দেখিলেন তাহাতে কিছুই নিন্দনীয় নাই, দেখিলেন নাসিকা চক্ষু সকলি বাস্তবিক সুগঠন। কিন্তু তবে? তবে একটির মাত্র অভাব। যে একটি সুন্দর ভাব থাকিলে সমস্ত মুখটিতে সৌন্দর্য্য আপ্লুত করে, সেই ভাবটির তবুও যেন অভাব। যে ভাবটি দেখিবামাত্র শরীর রোমাঞ্চিত হয়, হৃদয়ে সহসা একটি স্বপ্নময় আনন্দ জন্মে, কই সে ভাবটি এ সকল চিত্রে কই? একটি মাত্র জীবন্ত প্রতিমাতে তিনি যে সৌন্দর্য্য দেখিয়াছেন সে সৌন্দর্য্য তিনি য়ুরোপের প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ সুন্দরীতেও দেখিতে পাইলেন না। কিন্তু প্রমোদের মনের কথা প্রমোদ মনে মনেই চাপিয়া লইলেন। সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে সভ্যতম দেশের প্রসিদ্ধ সুন্দরী বলিয়া যাঁহারা বিখ্যাত, প্রমোদ কেমন করিয়া আজ স্পষ্ট করিয়া বলেন, তিনি তাঁহাদের সৌন্দর্য্য অনুভব করিতে অক্ষম; কথা শুনিলে কে না হাসিবে, তাঁহাকে রুচি-হীন বলিয়া কে না তাঁহাকে রুচির উৎকর্ষ সাধনে পরামর্শ দিবে? অন্যের কথা দুরে থাকুক, সেই সকল চিত্রের সৌন্দর্য্য হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারায় নিজেই লজ্জিত হইয়া সে অ্যালবমখানি বন্ধ করিয়া অন্যখানি খুলিলেন। খুলিয়া প্রথমেই সুপ্রসিদ্ধ সুন্দরী স্কটল্যাণ্ডের রাণী মেরীর ছবি পাইলেন। যে রূপে কত রাজ্যবিপ্লব ঘটিয়াছিল, যে রূপের প্রশংসায় আজও পর্য্যন্ত দিক আমোদিত, সেই রূপের মোহিনী শক্তি তাঁহার মুখের কোন স্থলে বিদ্যমান তাহা প্রমোদ মনোযোগপূর্ব্বক দেখিতে লাগিলেন। সহসা আর দেখা হইল না, বীণাধ্বনিবৎ সহসা তাঁহার কর্ণে এই কথাটি বাজিয়া উঠিল “যামিনী বাবু!” সে স্বর প্রমোদ চিনিতে পারিলেন, সে স্বরে প্রমোদ রোমাঞ্চিত কায়ে মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন তাঁহার পশ্চাতে নীরজা। সাধকের আকাঙ্ক্ষিত বর পাইলেও যত আনন্দ না হয়, নীরজাকে দেখিয়া প্রমোদের তাহা হইল। প্রমোদের মুখ দেখিতে না পাইয়া যামিনী বোধে নীরজা ডাকিয়াছিল। সহসা প্রমোদকে দেখিয়া তাহার মুখেও আনন্দ বিভাসিত হইল। সেই বৃহৎ কক্ষে, দুই প্রান্তে দুইজনে নিস্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন, উভয়ের নয়নে নয়নে স্থির দৃষ্টি সংলগ্ন হইল, উভয়ে মনেমনে মন হারাইয়া চাহিয়া রহিলেন। কিছু পরে নীরজা বলিয়া উঠিল “একি, আপনি এখানে?” প্রমোদ এক সময়েই প্রায় বলিয়া উঠিলেন “আপনি এখানে?” হঠাৎ বিস্ময় ও আনন্দজনিত মনের বিশৃঙ্খল ভাব শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া লইয়া কিছু পরে নীরা তাহার দুঃখের কাহিনী আনুপূর্ব্বক বলিল; শুনিয়া প্রমোদ সন্ন্যাসীর কথা বুঝিতে পারিলেন। প্রমোদ মনে মনে বলিলেন “আমি কেন যামিনীর মত সৌভাগ্যবান হলেম না, আমি কেন ইহাকে উদ্ধার করতে পাল্লেম না,” এই ভাবের আধিক্য বশতঃ প্রমোদের কথা বন্ধ হইয়া গেল, ধীরে ধীরে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস পড়িল, নিজের নিশ্বাস শব্দে নিজেই চমকিয়া উঠিয়া প্রমোদ বলিলেন “কিছু আগে যদি এসব জানতেম! কিছু আগে যদি যামিনীর সঙ্গে দেখা হত, তা হলেই আজ—”
এই সময় যামিনীনাথ তাঁহাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন, প্রমোদের আর কিছু বলা হইল না। প্রমোদ ও নীরজাকে একত্রে দেখিয়া যামিনীনাথ বিস্মিত হইয়া ঈষৎ ক্রুদ্ধভাবে তাহাকে বলিলেন “একি, তুমি এখানে?” নীরজা বলিল “বাবার শেষ চিঠির উত্তর এল কি না জানার জন্য বড়ই উৎসুক হয়েছি।” সমস্ত দিন আপনার জন্যে অপেক্ষা ক’রে ক’রে শেষে আপনাকে এইখানে খুঁজতে এলুম।” যামিনী একটু বিরক্তব্যঞ্জক স্বরে বলিলেন “বাইরে কখন কে আসে, এখানে আসবার কি আবশ্যক? আমি চিঠি পেলেই তো তোমাকে বলতে যেতুম।”
এই কথায় নীরজাও একটু বিরক্ত হইয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিল।