ছিন্নমুকুল/ষোড়শ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

হাসিমুখে বিষাদ

 সেই অপরাহ্নে যামিনীনাথের বাটীর অন্তঃপুরস্থ উদ্যানের বৃক্ষলতাসমাকুল একটি নিভৃত প্রান্ত হইতে নীরজা বাহির হইল। নীরজার বাম হস্তে একটি কাকাতুয়া, তাহার সহিত কথা কহিতে কহিতে সে উদ্যানস্থিত সরােবরতীরে আসিয়া দাঁড়াইল। তখন স্বচ্ছসলিলা সরসী মৃদু সমীরস্পর্শে তলতল ঢলঢল করিয়া কাঁপিতেছিল; কাঁপিয়া কুমুদদল কাঁপাইয়া মৃদু মৃদু কল্লোলে তট চুম্বন করিতেছিল। তীরস্থিত একটি কামিনী বৃক্ষের অসংখ্য ফুলরাশি হইতে মধে, মধ্যে দুই একটি বায়ুস্খলিত কুসুম চৌদিকে বাস বিকীর্ণ করিতে করিতে সরােবরে আত্ম সমর্পণ করিতেছিল; নীরজা গান গাহিতে গাহিতে এক একবার সেই স্রোতসঞ্চালিত সুখ-ক্রীড়মান কুসুম রাশির প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেছিল, এক একবার গান বন্ধ করিয়া কাকাতুয়ার মুখ চুম্বন করিতেছিল। গাহিতেছিল,—

চললো, কাননে যাইব দুজনে
জুড়াতে জীবন জ্বালা;
সজনিলো, আজি ফুলে ফুলে সাজি
কাটাব সরাটা বেলা;
তরু মূলে মূলে, ফুল তুলে তুলে,
কহিব মরম কথা;
গাহিব, লো, গান খুলিয়ে পরাণ,
ভুলিব সকল ব্যথা;
তুলিয়ে বকুলে পরাইব চূলে,
বেলায় করিব দুল,
উড়ায়ে ভ্রমরে, বোঁটা ধরে ধরে
তুলিব গোলাপ ফুল;
কিসের বেদনা, কিসের যাতনা,
কিসের হৃদয় জ্বালা?
দেখিব আজিকে হৃদয় আঁধার
ঘোচাতে পারি কি বালা।

 নীরজা অধিকক্ষণ তীরদেশে দাঁড়াইয়া রহিল না, গানটী গাহিতে গাহিতে সে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কামিনী ফুলে অঞ্চল পূর্ণ করিল; চাঁপাবৃক্ষের নিকট গিয়া নিম্নমুখী শাখা হইতে কতকগুলি সপত্র চাঁপা পাড়িল, বকুলতলা হইতে কতকগুলি বকুল কুড়াইল, লতাবৃক্ষের নিকট আসিয়া কতকগুলি লতা ছিঁড়িল, শেষে কতকগুলি বেল, মল্লিকা, গোলাপ তুলিয়া গোলাপের কাঁটা ছিঁড়িতে ছিঁড়িতে, গানে কাকাতুয়ার সহিত কথা কহিতে কহিতে, আবার সেই বৃক্ষসমাকুল নিভৃত প্রান্তে গমন করিল।

 সেখানে আসিয়া কাকাতুয়াকে বলিল “তুই দুঃখ বুঝিস্? তোকে নিয়ে আজ আমার মনের জ্বালা জুড়াব।” বলিয়া আবার গাহিতে গাহিতে সেই নিভৃত কুঞ্জমধ্যে ফুলপত্রে একটি শয্যা রচনা করিয়া সেই শয্যার চতুষ্পার্শে ফুল সাজাইয়া কাকাতুয়াটিকে তথায় শোয়াইতে গেল। নীরজার হস্ত ছাড়িয়া কাকাতুয়া তখন কুসুম শয্যায় যাইতে চাহিবে কেন? সে অনিচ্ছার স্বরে চীৎকার করিয়া পুনরায় তাহার হস্তে উঠিয়া বসিল। নীরজা আর একবার তাহাকে ফুলশয্যায় শোয়াইতে চেষ্টা করিয়া বলিল—

 “বেশ বিছানা হয়েছে তুই শুয়ে থাক, আমি ততক্ষণ আমার নুরীটিকে এইখানে নিয়ে আসি।” কাকাতুয়া তাহার কথা বুঝিল না, অবাধ্য সন্তানের মত রাগিয়া নীরজার হস্তে চঞ্চুর আঘাত করিল। নীরজাও তাহাতে ঈষৎ ক্রোধ দেখাইয়া কুসুম অঙ্গুলিতে ধীরে ধীরে তাহাকে মারিয়া বলিল—

 “তুই বড় বোকা এইখানে শুয়ে থাক্।” বলিয়া ছেলে ঘুম পাড়াইবার মত দু একটি চাঁপা পত্র দ্বারা বিছানার উপর তাহাকে চাপিয়া ধরিল। কাকাতুয়া বিষম চীৎকার করিতে করিতে আবার তাহার হস্তে উঠিয়া আসিল। তখন নীরজা আর তাহাকে শোয়াইতে চেষ্টা না করিয়া বলিল—

 আহা এ বিছানা বুঝি তোর ভাল লাগলো না? কবে কাকাতুয়া আমি সেই বনে যাব বল দেখি? তাহলে তোকে কত ভাল ভাল পাতার বিছানা ক’রে দেব, সে সব তো এখানে নেই।” কাকাতুয়া তাহার আদর বুঝিয়া তাহার দিকে চাহিয়া ‘কাকাতুয়া’ ‘কাকাতুয়া’ করিল, নীরজা বুঝিল কাকাতুয়া তাহার ব্যথার ব্যথী। এই সময় যামিনীনাথ সমস্ত উদ্যানটি খুঁজিতে খুঁজিতে এই খানে আসিয়া দাঁড়ালেন। দাঁড়াইয়া কাকাতুয়ার সহিত নীরজার গল্প শুনিতে লাগিলেন। নীরজা মুখ তুলিয়া একবার যামিনীনাথকে দেখিল, একটু ছেলেমানুষের মত হাসিল; কিন্তু তাঁহার সহিত কথা না কহিয়া আবার মুখ নত করিয়া কাকাতুয়ার সহিত কথা কহিতে লাগিল। অনেক ক্ষণ যামিনী মৌনভাবে থাকিয়া থাকিয়া অবশেষে বলিলেন “নীরজা এত গল্প কার সঙ্গে?”

 নীরজা মুখ নত করিয়াই বলিল “কেন?” আমার সখীর সঙ্গে?”

 “কাকাতুয়া নুরী এরাই কি নীরজা চিরকাল তোমার সখী থাকবে? আমাকে কি মনের কথা বল্‌বে না?” বলিয়া যামিনীনাথ একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়িয়া মৌন হইয়া পড়িলেন। কিন্তু যখন দেখিলেন নীরজা তাঁহার নীরবতা বা দীর্ঘনিশ্বাস কিছুই লক্ষ্য করিল না—তখন আবার মৌন ভঙ্গ করিয়া বলিলেন “নীরজা আমাকে আর কতদিন এরূপ যাতনা সইতে হবে?”

 নী। “কাকাতুয়াটা বুঝি ঘুমোলো?—আপনার যন্ত্রণা? কেন? কি যন্ত্রণা?”

 যা। “কতকাল আমার মনোরথ আর অপূর্ণ থাকবে?”

 নী। “এই যন্ত্রণা? দেখুন্ আমাদের বনে তো এমন বড় মল্লিকা ছিল না, কিন্তু আমার বোধ হয় এর চেয়ে সেগুলি তবু ভাল।”

 যা। “নীরজা আমার কষ্টে তোমার কি কিছুমাত্র কষ্ট হয় না?” আমার এমন জিজ্ঞাসার উত্তর পর্য্যন্ত নেই।”

 নী। “অ্যাঁ অ্যাঁ? আমি এই মল্লিকাটি দেখতে বড় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেম। আমাদের কুটীরের চার ধারে এত মল্লিকা ফুট্‌তো কি আর বলব? বাবা কি আমাদের শেষ চিঠিখানি পেয়েছেন? সে চিঠি পেয়ে উত্তর দিলে কিম্বা তিনি এলে কতদিনে এখানে পৌঁছবেন বলুন দেখি? আহা, কতদিনে সেই কুটীরে গিয়ে বেড়াব!

 যা। তোমার ইচ্ছার মত কাজ করতে আমার তো বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই। সন্ন্যাসী মহাশয়কে যে কত চিঠি লিখেছি তাতো জান?”

 নী। “আমার কি সব কথাই আপনি রেখেছেন? তা’হ’লে এতদিন কেন সেখানে আমাকে রেখে এলেন না? কাকাতুয়া, আমার সঙ্গে তুই যাবি? বল্‌না? যাবিতো?”

 কাকাতুয়া আবার তাহার দিকে চাহিয়া ‘কাকাতুয়া’ ‘কাকাতুয়া’ করিল। নীরজা বুঝিল কাকাতুয়া যাইবে। যামিনী বলিলেন “ছি! তুমি ঐ কথা নিয়ে আমার মনে মিছামিছি কষ্ট দিচ্ছ? তুমি কি জাননা তােমার কথাটি রাখতে পারলেম না বলে কত কষ্ট হয়েছে? কিন্তু কি করবো এখানে কাজে এমনি ব্যস্ত আছি যে কল্‌কাতা ছেড়ে আমার একদিনের জন্যও কোথাও যাবার যাে নেই। কিন্তু আমি তােমাকে দস্যুদের হাত হতে রক্ষা করলেম, শুধু তা নয়, তােমার জন্য কত কষ্ট স্বীকার করেছি, তুমি তার পরিবর্ত্তে আমার কথার উত্তর পর্য্যন্ত আজকাল দাও না?”

 নী। “কথার উত্তর আবার কখন দিইনে? আহা, আমার সেই হরিণটা যে কেমন ছিল, বাবা নৈমিষারণ্য হতে এনে দিয়েছিলেন। সেটি থাকলে কেমন কাকাতুয়াব সঙ্গে খেলা করত। কিন্তু না, না, ভুলে গেছি, কি বলছিলেন?”

 যা। “আমার এমনি অদৃষ্ট, তােমার মনের কথা এখনো বুঝতে পারলেম না, আমি হতভাগা, আমি দুর্ভাগা, আমার মরণই ভাল।”

 নী। “ও কি! ও কথা কেন? কি বলছিলেন?

 যা। “কতদিন আর বিবাহ করতে দেরি করবে?”

 নী। আচ্ছা আপনি এ কাকাতুয়াটি কোথায় পেলেন?” যামিনী বিষাদার্দ্র স্বরে বলিলেন,—

 “নীরজা এই কি আমার কথার উত্তর?”

 নীরজা কিছু অপ্রতিভ ভাবে বলিল “না, না, আর আমি কাকাতুয়ার পানে চাইব না, তা হলে কেমন অন্যমনা হয়ে পড়ি।”

 যামিনী আবার বলিলেন “বিবাহে আর কত দেরি?”

 নী। “কেন এক বৎসর?”

 যা। “এক বৎসরই যে এক যুগ”।

 নীরজা হাসিয়া বলিল “তা কি করে হবে? আমি শাস্ত্রে পড়েছি ১২ বৎসরে এক যুগ।”

 যা। “নীরজা তুমি বড় নিষ্ঠুব, যদি বিবাহই করবে তো এক বৎসর আবার বিলম্ব কেন।”

 নী। “এক বৎসরের মধ্যে নিশ্চয়ই বাবা আসবেন তখন আমাকে নিয়ে তাঁর যা ইচ্ছা কর্‌বেন, তা না আসেন তখন”—

 যা। “আমি তোমাকে দস্যুহস্ত হ’তে মুক্ত করলেম প্রত্যুপকারে তুমি আমার এই কথাটি রাখবে না? সুন্দরি তুমি বড় কৃতঘ্ন।” নীরজার ভ্রূধনু ঈষৎ কুঞ্চিত হইল, মুক্তাদন্তে অধর ঈষৎ চাপিয়া গম্ভীর ভাবে বলিল “আমি কৃতঘ্ন! অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিবাহে সম্মত; আমি কৃতঘ্ন!”

 যা। “তোমার বিবাহে ইচ্ছা নেই, এই ত কৃতঘ্নতা, এত ভালবাসার প্রতিদান নেই এই ত কৃতঘ্নতা।”

 নী। “আমি যে ভালবাসিনা তাও ত নয়। কিন্তু ভালবাসলেই কি বিয়ে করতে হয় নাকি?”

 যা। তুমি যদি সত্য সত্যই আমাকে ভালবাসতে তা হলে আর ও রকম কথা বলতে না। আমি তোমার ঐ বিশাল চক্ষুর মোহন দৃষ্টি যতই দেখি ততই মনে হয় এক বৎসর আমার পক্ষে এক যুগ।”

 নী। “কই আমার তো তা মনে হয় না।”

 যা। “আমার বেলা হয় না, কিন্তু প্রমোদ হোলে হ’ত।”

 নীরজা যদিও প্রমোদের কথা যামিনীকে কিছুই বলে নাই, তথাপি যামিনী মনে সন্দেহ করিতেন নীরজা প্রমোদকে ভালবাসে। কিন্তু সে কথা কখনও তাহাকে ফুটিয়া বলেন নাই। আজ মনের আবেগে এই কথাটি আপনা হইতে বাহির হইয়া পড়িল। নীরজা একটু অপ্রকৃতিস্থ ভাবে বলিল—

 “প্রমোদ—প্রমোদ আবার কবে এখানে আসবেন?”

 যা। “প্রমোদ এখানে আসুন না আসুন তোমার তাতে কি?

 নী। “কেন? তাঁকে এক-একবার দেখতে ইচ্ছা—”

 যা। “আমার সম্মুখে ও কথা বলতে তোমার লজ্জা বোধ হ’ল না?”

 নী। লজ্জা! এতে লজ্জা! কেন, একি কোন দোষের কথা?”

 যা। “লজ্জাহীনা! কৃতঘ্ন। আমি বুঝতে পেরেছি—”

 নী। “আবার বলবেন আমি কৃতঘ্ন! কেবলমাত্র কৃতজ্ঞতার উপরোধেই আমি আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছি—আমি কৃতঘ্ন?” বলিতে বলিতে নীরজার চক্ষুদ্বয় স্থির বিদ্যুতের ন্যায় জ্বলিতে লাগিল। যামিনী ঈষৎহাস্য করিয়া বলিলেন “আমি দেখছিলেম তোমার অঙ্গীকার হৃদয়ের না অধরের—”

 যামিনীর কথা শেষ না হইতে হইতে একজন ভৃত্য আসিয়া বলিল, “একজন সন্ন্যাসী আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।” সন্ন্যাসীর নাম শুনিয়া যামিনী চমকিয়া উঠিলেন। বুঝিলেন—এ সন্ন্যাসী কে। তিনি আর নীরজাকে কিছু না বলিয়াই সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন।