বিষয়বস্তুতে চলুন

জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ/স্বদেশী আন্দোলন (শেষার্ধ)

উইকিসংকলন থেকে

স্বদেশী আন্দোলন (শেষার্ধ)

 ১৬ অক্টোবর (১৯০৫) রাখীবন্ধন উৎসবের[১] পর ‘ফেডারেশনের হল-গ্রাউণ্ডে’ (বর্তমানে আপার সার্কুলার রোডস্থিত ব্রাহ্ম বালিকাশিক্ষালয়ের উত্তরে অবস্থিত) বিরাট জনসভা আহূত হইল। প্রবীণ কংগ্রেসনেতা সর্বজনশ্রদ্ধেয় আনন্দমোহন বসু ঐ সভার সভাপতিপদে বৃত হইয়াছিলেন। আনন্দমোহনবাবু তখন বৃদ্ধ—রোগে শয্যাশায়ী। তৎসত্ত্বেও সেই জাতীয় সঙ্কটের দিনে তিনি দেশমাতৃকার আহ্বানে রোগশয্যা হইতেই উঠিয়া আসিলেন। আমার বেশ মনে পড়িতেছে, তাঁহাকে ‘ইনভ্যালিড চেয়ারে’ করিয়া সভাস্থলে আনা হইল। আনন্দমোহন বাঙালী জাতির পক্ষ হইতে ঘোষণা করিলেন যে, তাঁহারা বঙ্গ-বিভাগ কখনই মানিয়া লইবেন না এবং যতদিন ব্রিটিশ গভর্মেণ্টের ঐ আদেশ বাতিল না হয়, ততদিন জাতির সমস্ত শক্তি দিয়া আন্দোলন চালাইবেন। ঐক্যবদ্ধ অখণ্ড বাঙলার প্রতীকস্বরূপ ফেডারেশন হল বা “মিলন মন্দির”-এর ভিত্তিও ঐ দিন আনন্দমোহন স্থাপন করিলেন। আনন্দমোহন নিজে তাঁহার লিখিত বক্তৃতা পাঠ করিতে পারিলেন না, দেশপূজ্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার পক্ষ হইতে ঐ বক্তৃতা জলদগম্ভীর স্বরে পাঠ করিলেন।

 রবীন্দ্রনাথ সেই বিরাট সভায় যোগ দিয়াছিলেন এবং তিনিই আনন্দমোহনের বক্তৃতা বাঙলায় অনুবাদ করিয়া পাঠ করেন। তারপর বাঙলা ও ইংরেজীতে জাতীয় সঙ্কল্পবাক্য বা প্রতিজ্ঞাপত্র পাঠ করা হইল। বঙ্গভঙ্গ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত বাঙালী নিরস্ত হইবে না এবং তাহারা কেবল স্বদেশী দ্রব্যই ব্যবহার করিবে, কোন বিদেশী পণ্য ক্রয় করিবে না, ইহাই ছিল সঙ্কল্পের সার মর্ম। বাঙলার সর্বত্র হাজার হাজার সভায় দিনের পর দিন সেই জাতীয় সঙ্কল্পবাক্য পঠিত হইয়াছিল । সাধারণত ঐসব সভায় সভাপতি সঙ্কল্পবাক্য বা প্রতিজ্ঞাপত্র পাঠ করিতেন, সঙ্গে সঙ্গে সভাস্থ সকলে সমস্বরে উহা আবৃত্তি করিতেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে বহু সভায় জনসাধারণকে জাতীয় সঙ্কল্পবাক্য আবৃত্তি করাইয়াছিলেন। ১৬ই অক্টোবর অপরাহ্ণেই বাগবাজারে পশুপতি বসুর বহির্বাটীর বৃহৎ প্রাঙ্গণে আর একটি বিরাট জনসভা হয় এবং রবীন্দ্রনাথ তাহাতে বক্তৃতা করেন। এই সভায় প্রধানত রবীন্দ্রনাথের আবেগময় আহ্বানে ‘জাতীয় ভাণ্ডার’-এর জন্য ৫০ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণপুর (হাওড়া) প্রভৃতি আরও কয়েকটি স্থানে সভা করিয়া জাতীয় ভাণ্ডারের জন্য অর্থ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। ইহার কিছুদিন পরে পশুপতি বসুর বাড়ীর সেই প্রাঙ্গণেই যে ‘বিজয়া সম্মেলন হয়’, তাহাতেও রবীন্দ্রনাথ মর্মস্পর্শী বক্তৃতা করেন।

 পূর্বেই বলিয়াছি, শ্রীঅরবিন্দ প্রমুখ নবীন জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বে “বন্দে মাতরম্” শব্দটি ‘জাতীয় মন্ত্র’ হইয়া উঠে।[২] ঠিক এই কারণেই পুলিস ও সিভিলিয়ান—সংক্ষেপে আমলাতন্ত্রের পক্ষে “বন্দে মাতরম্” শব্দটি বিষবৎ মনে হইতে লাগিল, তাঁহারা উহাকে “বিদ্রোহ-ধ্বনি” বলিয়াই গণ্য করিতে লাগিলেন। বাঙলা সরকারের শিক্ষাবিভাগ এক সার্কুলার জারি করিয়া বসিলেন যে, কোন ছাত্র স্বদেশী সভায় যোগদান করিলে অথবা “বন্দে মাতরম্” ধ্বনি উচ্চারণ করিলে তাহাকে বিদ্যালয় হইতে বিতাড়িত করা হইবে। ইহাই কুখ্যাত “কার্লাইল সার্কুলার”। এই সার্কুলারের ফলে বাঙলার ছাত্র ও যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল উত্তেজনার সঞ্চার হইল। উহার প্রতিবাদ করিয়া বাঙলার সর্বত্র জনসভা হইতে লাগিল। রবীন্দ্রনাথ কলিকাতা অঞ্চলে এইরূপ কয়েকটি সভায় সরকারী স্বেচ্ছাচারের প্রতিবাদ করিয়া জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা করেন। “কার্লাইল সার্কুলার”-এর ভয়ে যুবক ও ছাত্রেরা ভীত হওয়া দূরে থাকুক, বরং তাহারা আরও দ্বিগুণ উৎসাহে স্বদেশী সভায় যোগ দিতে লাগিল এবং “বন্দে মাতরম” ধ্বনি করিতে লাগিল। ফলে পুলিসের লাঠি তাহাদের মাথায় পড়িল, বহু ছাত্র বিদ্যালয় হইতেও বিতাড়িত হইল। শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থা দাঁড়াইল যে, “বন্দে মাতরম্” ধ্বনি উচ্চারণ করাই রাজদ্রোহের তুল্য একটা অপরাধ বলিয়া গণ্য হইয়া উঠিল। বাঙলার নানাস্থানে, বিশেষত পূর্ববঙ্গ ও আসামে “বন্দে মাতরম্” ধ্বনি করিয়া বহু লোক পুলিসের লাঠি খাইল, অনেকে জেলেও গেল । এই সময়েই বরিশালে ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্স’ কি ভাবে ম্যাজিস্ট্রেট ভাঙিয়া দেন এবং নেতারা কেহ কেহ গ্রেপ্তার হন, দেশবাসী নিশ্চয়ই তাহা বিস্মৃত হন নাই। এই কনফারেন্সেই মনোরঞ্জন গুহ ঠাকুরতার পুত্র চিত্তরঞ্জন পুলিসের পুনঃপুনঃ লাঠির আঘাত খাইয়াও অজ্ঞান হইয়া না পড়া পর্যন্ত কিছুতেই “বন্দে মাতরম্” ধ্বনি ত্যাগ করেন নাই। “বন্দে মাতরম্” সেই দিন হইতে সত্যই “জাতীয় মন্ত্রে” পরিণত হইল। ইহার জন্য কতজন যে দুঃখবরণ করিয়াছে, নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই।

 স্বদেশী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের দান নানাদিক দিয়া অসামান্য। সভাসমিতিতে বক্তৃতা, সাময়িক পত্রিকায় প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প প্রভৃতির দ্বারা দেশবাসীর চিত্তে যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা তিনি সঞ্চার করিয়াছিলেন, তাহা আমাদের জাতীয় জীবনে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। তাহা ছাড়া আরও দুই দিক দিয়া স্বদেশী আন্দোলনে তাঁহার দানের প্রাচুর্য বিশেষভাবে স্মরণ করিতে হইবে। প্রথমত, জাতীয় সংগীত রচনা, দ্বিতীয়ত, জাতীয় শিক্ষা প্রচার। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্রনাথকে ‘গানের রাজা’ আখ্যা দিয়াছেন। বাস্তবিক সংগীত রচনায় রবীন্দ্রনাথ কেবল বাঙলা দেশে কেন, সমগ্র পৃথিবীতে অদ্বিতীয় বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। এত অধিকসংখ্যক এবং এত বিচিত্র ভাবপূর্ণ গান পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কোন কবি রচনা করেন নাই। রবীন্দ্রনাথের এই সংগীতাবলীর মধ্যে আবার জাতীয় সংগীত বা স্বদেশপ্রেমের সংগীতের সংখ্যা প্রচুর। স্বদেশী যুগে কয়েক সহস্র জাতীয় ভাবপূর্ণ সংগীত বাঙলা দেশের কবিগণ রচনা করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে একা রবীন্দ্রনাথের দানই সর্বাধিক। দেশমাতৃকাকে তিনি যে গভীরভাবে ভালবাসিয়াছিলেন, জাতীয় আন্দোলনে যেভাবে নিজের মনপ্রাণকে উৎসর্গ করিয়া দিয়াছিলেন—সেই প্রেম, সেই আত্মোৎসর্গ ই সহস্র ধারায় তাঁহার গানের মুখে উৎসারিত হইয়াছিল। এই সমস্ত গান একদিকে যেমন গভীর দেশপ্রেম, অন্যদিকে তেমনি অপূর্ব উদ্দীপনায় পূর্ণ। স্বদেশী আন্দোলনে বাঙলার সর্বত্র সহস্র সহস্র জনসভায়, হাটে, মাঠে, ঘাটে রবীন্দ্রনাথের এই সমস্ত গান গীত হইত। দেশবাসীর চিত্তে স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশী ভাবের সঞ্চারে উহা যে কতদূর সহায়তা করিয়াছে, তাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তাঁহার সমগ্র স্বদেশী সংগীতের পরিচয় দেওয়া অসম্ভব, সামান্য কিছু পরিচয় দিতে চেষ্টা করিব।

 দেশমাতৃকা যে গাছপালা, মাটি, জল, আকাশ, গ্রাম-নগর লোকসংখ্যার সমষ্টিমাত্র নহেন, ইহার অন্তরালে তাঁহার যে চিন্ময়ী রূপ আছে, আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতি, হাজার হাজার বৎসরের সুখদুঃখ বেদনা, ইতিহাসের ভাঙাগড়া উত্থানপতন—সমস্ত মিলিয়া সহস্রদল পদ্মে সেই চিন্ময়ী জননীর পাদপীঠ রচনা করিয়াছে, এই সত্য বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথমে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। “বন্দে মাতরম্” সংগীত সেই চিন্ময়ী দেশ-জননীর ধ্যান। বঙ্কিম-শিষ্য রবীন্দ্রনাথও মাতৃভূমির এই চিন্ময়ী রূপকেই অন্তরে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন।—

অয়ি ভুবন-মনোমোহিনী,
অয়ি নির্মল-সূর্যকরোজ্জ্বল ধরণী,
জনক-জননী-জননী ॥
নীল-সিন্ধু-জল- ধৌত-চরণতল,
অনিল-বিকম্পিত-শ্যামল-অঞ্চল,
অম্বর-চুম্বিত-ভাল-হিমাচল,
শুভ্র-ভূষার-কিরীটিনী॥

* * * *

চিরকল্যাণময়ী তুমি ধন্য,
দেশবিদেশে বিতরিছ অন্ন,
জাহ্নবী-যমুনা-বিগলিত-করুণা,
পুণ্যপীযূষ-স্তন্যবাহিনী॥

 বঙ্গজননীর এই ভুবনমোহিনী রূপ কবি যেন আমাদের চোখের সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়াছেন, তিনি যেন ধ্যাননেত্রে এই অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। অথবা—

ও আমার দেশের মাটি
তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর,
(তোমাতে বিশ্বমায়ের)
আঁচল পাতা।
তুমি মিশেছো মোর দেহের সনে,
তুমি মিলেছো মোর প্রাণে মনে,
তোমার ঐ  শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি
মর্মে গাঁথা॥ ইত্যাদি।

এখানে দেশজননীর মূর্তিকে কবি বিশ্বজননীর মূর্তির মধ্যে বিলীন করিয়া দিয়াছেন। আবার—

আজি  বাঙলা দেশের হৃদয় হতে
কখন আপনি
তুমি  এই অপরূপ রূপে বাহির
হলে জননী?
ওগো মা—
তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে।
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে
সোনার মন্দিরে॥

ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে,
বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি,
ললাটে-নেত্র আগুন-বরণ।
ওগো মা—
তোমার কী মূরতি আজি দেখি রে।
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে
সোনার মন্দিরে॥
তোমার মুক্ত-কেশের পুঞ্জ মেঘে
লুকায় অশনি,
তোমার আঁচল ঝলে আকাশতলে,
রৌদ্র-বসনী!·····

 স্বদেশী আন্দোলনে জাতির চিত্তে যে প্রলয়ের ঝটিকা উত্থিত হইয়াছিল, তাহার মধ্য হইতে এই ভীষণ-মধুর-রূপে বঙ্গমাতার আবির্ভাব। কবি সেই জ্যোতির্ময়ী কল্যাণময়ী মাকেই এই গানে ধ্যান করিয়াছেন।

 দেশের প্রতি অণু-পরমাণু, তাহার আকাশ জল বাতাস, শ্যামল বনানী, আম্রবনঘেরা নদীকূল, নিভৃত পল্লী—সকলের সঙ্গে বাঙালীর অন্তরের যে নিগূঢ় যোগ, যে সমতার বন্ধন— কবি তাঁহার অমর সংগীত ‘সোনার বাংলা’য় সেই ভাব অপূর্ব ভাষায় ব্যক্ত করিয়াছেন—

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥

* * * *

ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রাণে পাগল করে, (মরি হায়, হায় রে)—
ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে,
কী দেখেছি মধুর হাসি॥
কী শোভা কী ছায়া গো,
কী স্নেহ কী মায়া গো,
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে,
নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী, আমার কানে
লাগে সুধার মতো (মরি হায়, হায় রে)—
মা, তোর বদনখানি মলিন হ’লে,
আমি নয়নজলে ভাসি॥

* * * *

ধেনু-চরা তোমার মাঠে
পারে যাবার খেয়াঘাটে,
সারাদিন পাখী-ডাকা ছায়ায় ঢাকা
তোমার পল্লীবাটে,—
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে
জীবনের দিন কাটে, (মরি হায়, হায় রে)—

ও মা, আমার যে ভাই, তা’রা সবাই,
তোমার রাখাল তোমার চাষী।

* * * *

 অথবা—

সার্থক জনম আমার
জন্মেছি এ দেশে।
সার্থক জনম মা গো,
তোমায় ভালোবেসে। ইত্যাদি

ইহাতেও কবির সেই স্বদেশপ্রেম ফুটিয়া উঠিয়াছে।

 অন্য এক শ্রেণীর গানে কবি জাতিকে স্বাধীনতার তপস্যায় সর্বস্ব ত্যাগ করিতে আহ্বান করিয়াছেন, অত্যাচারীর রক্তনেত্র, নির্যাতন, নিপীড়ন উপেক্ষা করিয়া নির্ভীক উন্নত শিরে লক্ষ্যপথে অগ্রসর হইবার জন্য প্রেরণা দিয়াছেন:—

(১) যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,
তবে এক্‌লা চলো রে। ইত্যাদি
(২) তোর আপন জনে ছাড়্‌বে তোরে,
তা ব’লে ভাবনা করা চ’ল্‌বে না।
তোর  আশা লতা প’ড়্‌বে ছিঁড়ে,
হয়তো রে ফল ফ’ল্‌বে না—
তা  ব’লে ভাবনা করা চ’ল্‌বে না।
আসবে পথে আঁধার নেমে,
তাই ব’লেই কি রইবি থেমে,

ও তুই বারে বারে জ্বালবি বাতি,
হয়তো বাতি জ্ব’লবে না—
তা ব’লে ভাবনা করা চ’ল্‌বে না॥ ইত্যাদি
(৩) এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে,
জয় মা ব’লে ভাসা তরী।
ওরে রে ওরে মাঝি, কোথায় মাঝি,
প্রাণপণে ভাই, ডাক্ দে আজি;
তোরা সবাই মিলে’ বৈঠা নে রে,
খুলে ফেল্‌ সব দড়াদড়ি।
(৪) আপনি অবশ হ’লি, তবে
বল দিবি তুই কারে।
উঠে দাঁড়া উঠে দাঁড়া,
ভেঙে পড়িস্ না রে॥

* * * *

বাহির যদি হ'লি পথে
ফিরিস্‌নে তুই কোনো-মতে,
থেকে থেকে পিছনপানে
চাস্‌নে বারে বারে।
নেই-যে রে ভয় ত্রিভুবনে,
ভয় শুধু তোর নিজের মনে,
অভয়-চরণ শরণ ক’রে
বাহির হ’য়ে যা রে॥

(৫)  আমি ভয় ক’র্‌বো না, ভয় ক’র্‌বো না।
দু-বেলা মরার আগে
ম’র্‌বো না, ভাই, ম’র্‌বো না।
তরীখানা বাইতে গেলে
মাঝে মাঝে তুফান মেলে;
তাই বলে হাল ছেড়ে দিয়ে
কান্নাকাটি ধ’র্‌বো না। ইত্যাদি
(৬) যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক,
আমি তোমায় ছাড়্‌বো না, মা।
আমি  তোমার চরণ ক’র্‌বো শরণ,
আর কারো ধার ধার্‌বো না, মা॥ ইত্যাদি

 রবীন্দ্রনাথের যে দুইটি বিখ্যাত জাতীয় সংগীত আজ সর্বত্র গীত হয়—

(১) দেশ দেশ নন্দিত করি’ মন্দ্রিত তব ভেরী,
আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরি’।
দিন আগত ঐ,
ভারত তবু কই? ইত্যাদি
(২) জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারত-ভাগ্যবিধাতা!

 এগুলি তাঁহার পরিণত বয়সের অপূর্ব সৃষ্টি। এই সব সংগীতে ভারতের স্বাধীনতার সাধনাকে বিশ্বমানবের মুক্তিসাধনার মধ্যে তিনি উপলব্ধি করিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দে মাতরম্” ব্যতীত আর কোন জাতীয় সংগীত এই সব সংগীতের মতো জাতির চিত্তের উপর এত বেশী প্রভাব বিস্তার করে নাই।

 স্বদেশী আন্দোলনের সময় উহারই সঙ্গে সঙ্গে যে ‘জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন’ হইয়াছিল, রবীন্দ্রনাথ তাহাতেও প্রধান অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন।

 সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবর্তিত বিজাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহরূপেই এই ‘জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন’ দেখা দিয়াছিল। যে শিক্ষাপ্রণালীর সঙ্গে আমাদের মাতৃভূমির যোগ নাই, আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি হইতে যাহা বিচ্ছিন্ন, সর্বোপরি যাহা সম্পুর্ণরূপে সরকারী নীতির করায়ত্ত, সে শিক্ষা কখনই জাতির মনুষ্যত্বকে উদ্বোধন করিতে পারে না। অতএব সম্পূর্ণরূপে আমাদের নিজেদের আয়ত্তাধীনে, আমাদের জাতীয় আদর্শ ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করিয়া শিক্ষানীতি প্রবর্তিত করিতে হইবে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে। ইহাই ছিল সংক্ষেপে ‘জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন’-এর মূল কথা। আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, মনস্বী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, আশুতোষ চৌধুরী, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ এই আন্দোলনের মূলে ছিলেন। রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক এবং মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, ব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী এবং তারকনাথ পালিত এই আন্দোলনের জন্য প্রভূত অর্থ দান করেন এবং তাঁহাদেরই অর্থসাহায্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রথমে যখন অপেক্ষাকৃত সামান্য সম্বল লইয়া জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ গঠিত এবং জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, তখন কয়েকজন ত্যাগী, নিঃস্বার্থব্রতী কর্মীই উহাকে ধাত্রীর ন্যায় পালন করিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে আচার্য সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার, অরবিন্দ প্রকাশ ঘোষ, শ্রীযুত প্রমথনাথ মুখোপাধ্যায় (বর্তমানে সন্ন্যাসী), ডাঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, ৺কুমুদনাথ লাহিড়ী প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শ্রীঅরবিন্দও কিছুকাল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষতা করিয়াছিলেন। সেই সময় কলিকাতার জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে বাঙলার নানাস্থানেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। উত্তরকালে যখন এই আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাস হয় এবং পূর্বেকার হিতৈষীদের অনেকেই জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সহিত সংস্রব ত্যাগ করেন, তখনও যাহারা আহিতাগ্নিকের মত জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে হীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম সর্বাগ্রগণ্য। প্রধানত তাঁহারই নীরব সাধনা ও অক্লান্ত কর্মপ্রচেষ্টার ফলে এবং ডাঃ রাসবিহারী ঘোষের বদান্যতায় যাদবপুরের বিরাট জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া উঠিয়াছে এবং বাঙলার, শুধু বাঙলার কেন, ভারতের অন্যতম গৌরবের বস্তু বলিয়া গণ্য হইয়াছে।

 রবীন্দ্রনাথ প্রথমাবধিই এই জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথম যখন জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ গঠিত হয়, তখন তিনি বিশেষ উৎসাহসহকারে ইহাতে যোগ দিতেন । এমন কি জাতীয় বিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকা নির্বাচন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রচনা প্রভৃতি কার্যেও তিনি অংশগ্রহণ করিতেন। কিন্তু যে-কোন কারণেই হউক, কিছুদিন পরে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁহার ঘনিষ্ঠতা হ্রাস হয়। সম্ভবত জাতীয় শিক্ষার সম্বন্ধে তাঁহার নিজের আদর্শ ও পরিকল্পনা উহাতে সম্পূর্ণ সার্থক হইয়া উঠে নাই। তিনি ইতিপূর্বেই ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সহযোগিতায় বোলপুর শান্তিনিকেতনে যে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন তাহাকেই নিজের আদর্শ অনুসারে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানরূপে গড়িয়া তুলিবার কার্যে আত্মনিয়োগ করেন। কিছুদিন পরে অধ্যাপক মোহিতচন্দ্র সেন আসিয়া তাঁহার কার্যে যোগদান করেন ।

 স্বদেশী যুগে যে নূতন জাতীয়তাবাদী দলের উদ্ভব হয়, তাহার কথা পূর্বেই বলিয়াছি। বাঙলার কবি ও মনীষীদের প্রবর্তিত জাতীয় আন্দোলনের ইহারাই ছিলেন উত্তরসাধক। রবীন্দ্রনাথের সহানুভূতি স্বভাবতই এই নূতন দলের প্রতি ছিল এবং তিনি নিজেও এই দলের অন্যতম নেতা বলিয়া গণ্য হইতেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তিনি সম্পুর্ণরূপে এই দলের সঙ্গে যুক্ত হন নাই, দলগত রাজনীতির বাহিরে কতকটা নিরপেক্ষভাবেই থাকিতেন। প্রয়োজন হইলে প্রাচীন নিয়মতান্ত্রিক দলের সঙ্গেও তিনি যোগ দিয়া কাজ করিতেন। অনেক বিষয়ে তিনি উভয় দলের মধ্যবর্তী সেতুস্বরূপ ছিলেন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। যাঁহাদের চেষ্টায় স্বদেশী আন্দোলনের সময় প্রাচীন ও নবীন দল একযোগে কাজ করিয়াছেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে প্রধান। তাঁহার “দেশনায়ক” প্রবন্ধে এইভাবে অনুপ্রাণিত হইয়াই তিনি সুরেন্দ্রনাথকে বাঙলার একমাত্র নেতা বলিয়া বরণ করিয়া লইবার জন্য দেশবাসীকে অনুরোধ করিয়াছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও তাঁহার সমমতাবলম্বীদের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও প্রাচীন ও নবীন দলের মধ্যে ভেদ ক্রমেই বাড়িতে লাগিল এবং শেষ পর্যন্ত কোন কোন দিক দিয়া উহা মর্মান্তিক হইয়া উঠিল। “ নরমপন্থী” (মডারেট) ও “চরমপন্থী” (একস্ট্রিমিস্ট) বলিয়া দুই দলের নামকরণও হইয়া গেল। কংগ্রেস কমিটির সভায়, নানাস্থানে জনসভায়, নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের কলহ ও বাগবিতন্ডা চলিল। চরমপন্থীরা দলে ভারী, দেশের যুবক সম্প্রদায় তাঁহাদের সমর্থক, সুতরাং নরমপন্থীরা তাঁহাদের সঙ্গে আঁটিয়া উঠিতে পারিলেন না। কেবল বাঙলায় নয়, ভারতের সমস্ত প্রদেশেই—বিশেষত মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব ও মধ্য প্রদেশে নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের দ্বন্দ্ব প্রবল হইয়া উঠিল। অবশেষে ১৯০৭ সালে সুরাট কংগ্রেসে এই দ্বন্দ্ব আত্যন্তিকরূপে দেখা দিল। প্রবীণ নরমপন্থীরা ডাঃ রাসবিহারী ঘোষকে সভাপতি মনোনীত করিয়াছিলেন, কিন্তু নবীন চরমপন্থী দল তাহা মানিয়া লইলেন না, তাঁহারা তৎস্থলে লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলকের নাম প্রস্তাব করিলেন। ফলে সুরাট কংগ্রেসে “দক্ষযজ্ঞ” হইল, কংগ্রেসের অধিবেশন পণ্ড হইয়া গেল। প্রবীণ নরমপন্থীরা এলাহাবাদে ফিরিয়া গিয়া বৈঠক করিলেন এবং নবীন দলকে কংগ্রেস হইতে বিতাড়িত করিবার ব্যবস্থা করিলেন। কিন্তু তাহার ফল ভাল হইল না, কয়েক বৎসরের মধ্যে নবীন দলই বালগঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে কংগ্রেসে প্রাধান্য স্থাপন করিলেন এবং প্রবীণ দলই কংগ্রেস হইতে সরিয়া গিয়া “লিবারেল ফেডারেশন” গঠন করিতে বাধ্য হইলেন। রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই এইসব দ্বন্দ্ব-কোলাহল হইতে দূরে থাকিতেন। সুরাট কংগ্রেসের পর তিনি ক্রমে ক্রমে প্রকাশ্য রাজনীতিক্ষেত্র হইতে আরও দূরে সরিয়া গেলেন। কিন্তু নবীন দলের প্রতি তাঁহার আন্তরিক প্রীতি হ্রাস হয় নাই। নবীন দলের নেতা শ্রীঅরবিন্দ একাধারে তাঁহার বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন। শ্রীঅরবিন্দকে তিনি কিরূপ শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিতেন, “অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার” কবিতায় তাহার অক্ষয় নিদর্শন তিনি রাখিয়া গিয়াছেন। ১৯০৭ সালে রাজদ্রোহের অভিযোগে শ্রীঅরবিন্দ গ্রেপ্তার হইলে রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটি লেখেন। রবীন্দ্রনাথের অন্তরের গভীর স্বদেশপ্রেমের পরিচয়স্বরূপ এই কবিতার কিয়দংশ উদ্ধৃত না করিয়া পারিতেছি না,—

অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার।
হে বন্ধু, হে দেশ-বন্ধু, স্বদেশ আত্মার
বাণী-মূর্তি তুমি। তোমা লাগি’ নহে মান,

নহে ধন, নহে সুখ;
কোনো ক্ষুদ্র দান
চাহ নাই কোন ক্ষুদ্র কৃপা; ভিক্ষা লাগি’
বাড়াওনি আতুর অঞ্জলি। আছ জাগি’
পরিপূর্ণতার তরে সর্ববাধাহীন,—
যার লাগি’ নর-দেব চির রাত্রি দিন
তপোমগ্ন; যার লাগি’ কবি বজ্ররবে
গেয়েছেন মহাগীত, মহাবীর সবে
গিয়াছেন সঙ্কট-যাত্রায়; যার কাছে
আরাম লজ্জিত শির নত করিয়াছে;
মৃত্যু ভুলিয়াছে ভয়;— সেই বিধাতার
শ্রেষ্ঠ দান আপনার পূর্ণ অধিকার—
চেয়েছ দেশের হয়ে অকুণ্ঠ আশায়,
সত্যের গৌরব-দৃপ্ত প্রদীপ্ত ভাষায়
অখণ্ড বিশ্বাসে।······

* * * *

জয়, তব জয়।
কে আজি ফেলিবে অশ্রু, কে করিবে ভয়,
সত্যেরে করিবে খর্ব কোন্ কাপুরুষ
নিজেরে করিতে রক্ষা? কোন্ অমানুষ
তোমার বেদনা হতে না পাইবে বল?
মোছরে, দুর্বল চক্ষু, মোছ্ অশ্রুজল।

দেবতার দীপ হস্তে যে আসিল ভবে
সেই রুদ্র দূতে, বলো, কোন্ রাজা কবে
পারে শাস্তি দিতে? বন্ধন শৃঙ্খল তার
চরণ বন্দনা করি’ করে নমস্কার—
কারাগার করে অভ্যর্থনা। রুষ্ট রাহু
বিধাতার সূর্যপানে বাড়াইয়া বাহু
আপনি বিলুপ্ত হয় মুহূর্তেক পরে
ছায়ার মতন।......

* * * *

যিনি নানা কণ্ঠে কন্ নানা ইতিহাসে,
সকল মহৎ কর্মে পরম প্রয়াসে,
সকল চরম লাভে, “দুঃখ কিছু নয়,
ক্ষত মিথ্যা, ক্ষতি মিথ্যা, মিথ্যা সর্ব ভয়;
কোথা মিথ্যা রাজা, কোথা রাজদণ্ড তার,
কোথা মৃত্যু, অন্যায়ের কোথা অত্যাচার।
ওরে ভীরু, ওরে মূঢ়, তোলো তোলো শির,
আমি আছি, তুমি আছ, সত্য আছে স্থির।”

 ১৯০৮ সালে পাবনায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সের যে অধিবেশন হয়, রবীন্দ্রনাথ তাহাতে সভাপতি নির্বাচিত হন। নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের মধ্যে একটা মিলন প্রয়াসের নিদর্শনস্বরূপই রবীন্দ্রনাথকে এই অধিবেশনের সভাপতি করা হইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথও ঐভাবে অনুপ্রাণিত হইয়াই সভাপতিত্ব করিতে স্বীকৃত হইয়াছিলেন। কিন্তু ইহাই, বলিতে গেলে, তাঁহার প্রকাশ্য রাজনীতিতে যোগদানের শেষ দৃষ্টান্ত। ইহার পর তিনি প্রকাশ্য রাজনীতি হইতে সরিয়া দাঁড়াইলেন ।

 পাবনায় প্রাদেশিক সম্মেলনের অধিবেশনে সভাপতিরূপে রবীন্দ্রনাথ যে অভিভাষণ দিয়াছিলেন, নানা কারণেই তাহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইহা রবীন্দ্রনাথের জীবনে “যুগ পরিবর্তনের” সূচনা করে। প্রকাশ্য রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়িয়া গঠনমূলক স্বদেশসেবাতেই যে তিনি আত্মনিয়োগ করিবেন, তাহা এই অভিভাষণে সুস্পষ্টরূপেই তিনি ব্যক্ত করিয়াছিলেন। সেকথা বারান্তরে আলোচনা করিব।


  1. রাখীবন্ধন উৎসবের প্রসঙ্গে মৌলবী লিয়াকত হোসেনের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। এই আত্মত্যাগী দারিদ্র্যব্রতী স্বদেশসেবক প্রতি বৎসর ৩০ শে আশ্বিন ছাত্র ও যুবকদের লইয়া মহাসমারোহে রাখীবন্ধন উৎসব করিতেন ও “বন্দে মাতরম্” গান গাহিতেন। বঙ্গভঙ্গ বাতিল হইবার পরও বহু বৎসর তিনি এই জাতীয় উৎসব রক্ষা করিয়াছিলেন।
  2. স্বদেশী আন্দোলনে “বন্দে মাতরম্”ধ্বনি কবে প্রথম উচ্চারিত হইয়াছিল তাহা এখন নির্ণয় করা কঠিন। তবে আমাদের যতদূর স্মরণ হয়, ১৯০৫ সনের এই আগস্ট তারিখে টাউন হলে যে বিরাট ‘বয়কট’ সভা হইয়াছিল, তাহাতেই “বন্দে মাতরম্” ধ্বনি প্রথম উচ্চারিত হয়।