জীবনচরিত/সর উইলিয়ম জোন্স

উইকিসংকলন থেকে

সর উইলিয়ম জোন্স।




 উইলিয়ম জোন্স, ১৭৪৬ খৃঃ অব্দে ২০এ সেপ্টম্বর, লণ্ডন নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার তৃতীয় বৎসর বয়ঃক্রম কালে পিতৃবিয়োগ হয়; সুতরাং তাঁহার শিক্ষার ভার তাঁহার জননীর উপর বর্ত্তে। এই নারী অসামান্যগুণসম্পন্না ছিলেন। জোন্স অতি শৈশব কালেই অদ্ভুত পরিশ্রম ও গাঢ়তর বিদ্যানুরাগে দৃঢ়তর প্রমাণ দর্শাইয়াছিলেন। ইহা বিদিত আছে, তিন চারি বৎসর বয়ঃক্রম কালে যদি কোন বিষয় জানিবার অভিলাষে আপন জননীকে কিছু জিজ্ঞাসা করিতেন, ঐ বুদ্ধিমতী নারী সর্ব্বদাই এই উত্তর দিতেন পড়িলেই জানিতে পরিবে। এইরূপে পুস্তক পাঠ বিষয়ে তাহার গাঢ় অনুরাগ জন্মে; এবং তাহা বয়োবৃদ্ধি সহকারে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।

 সপ্তম বৎসরের শেষে তিনি হারো নগরের পাঠশালায় প্রেরিত হয়েন; এবং ১৭৬৪ খৃঃ অব্দে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়স্থিত অন্যান্য ছাত্রবর্গের ন্যায় বৃথা সময় নষ্ট না করিয়া, অধ্যয়ন বিষয়েই অনুক্ষণ নিমগ্নচিত্ত থাকিতেন, এবং যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত পরিশ্রম দ্বারা বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট পাঠ অপেক্ষা অনেক অধিক শিক্ষা করিতেন। বাস্তবিক তিনি পাঠশালায় এরূপ পরিশ্রমী ও বিদ্যানুরাগী ছিলেন যে তদ্দষ্টে তাঁহার এক অধ্যাপক কহিয়া ছিলেন এই বালক সালিসবরি প্রান্তরে নগ্ন ও নিঃসহায় পরিত্যক্ত হইলেও খ্যাতি ও সম্পত্তির পথ প্রাপ্ত হইবেক, সন্দেহ নাই।

 এই সময়ে তিনি প্রায় সর্ব্বদাই নিদ্রা প্রতিরোধের নিমিত্ত কফি কিংবা চা খাইয়া সমস্ত রাত্রি অধ্যয়ন করিতেন। কিন্তু এই প্রকার অনুষ্ঠান প্রশংসনীয় নহে; ইহাতে অনায়াসেই রোগ জন্মিতে পারে। জোন্স অবকাশ কালে ব্যবহারশাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেন। ইহা নির্দিষ্ট আছে যে তিনি কোকলিখিত ব্যবহার শাস্ত্রের সারসংগ্রহ অধ্যয়ন করিয়া তাহাতে এমন ব্যুৎপন্ন হইয়াছিলেন যে স্বীয় জননীর পরিচিত গৃহাগত ব্যবহারদর্শীদিগকে উক্ত গ্রন্থ হইতে সমুদ্ধৃত ব্যবহার বিষয়ক প্রশ্ন দ্বারা সর্ব্বদাই প্রীত ও চমৎকৃত করিতেন।

 দৃষ্ট হইতেছে, জোন্স ভাষা শিক্ষা বিষয়ে স্বভাবতঃ অত্যন্ত নিপুণ ও অনুরাগী ছিলেন। সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায়,যে সকল ব্যক্তির ভাষা শিক্ষায় বিশেষ অনুরাগ ও নৈপুণ্য থাকে,তাহাদের প্রায় অন্য কোন বিষয়ে বুদ্ধি প্রবেশ হয় না। কিন্তু জোন্সের বিষয়ে সেরূপ লক্ষ্য হইতেছে না। তিনি অত্যন্ত প্রয়োজনোপযোগী বহুতর জ্ঞানশাস্ত্রে ও সুকুমার বিদ্যাতেও বিশিষ্ট রূপ পারদর্শী ছিলেন। অক্সফোর্ডে অধ্যয়ন কালে তিনি এসিয়া খণ্ডের ভাষা সমূহ শিক্ষা বিষয়ে অত্যন্ত অভিলাষী হইয়াছিলেন এবং আরবির উচ্চারণ শিখাইবার নিমিত্ত স্বয়ং বেতন দিয়া এলিপোদেশীয় এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন। গ্রীক ও লাটিন ভাষাতে তৎপুর্ব্বেই বিলক্ষণ ব্যুৎপন্ন হইয়াছিলেন। বিদ্যালয়ের অনধ্যায় কাল উপস্থিত হইলে,তিনি অশ্বারোহণ ও স্বাত্মরক্ষা শিক্ষা করিতেন; এবং ইটালীয়, স্পানিশ, পোতুগীজ ও ফ্রেঞ্চ ভাষার অত্যুত্তম গ্রন্থ সকল পাঠ করিতেন; এবং ইহার মধ্যেই অবকাশক্রমে নৃত্য, বাদ্য খড়্গপ্রয়োগ এবং বীণাবাদন শিখিতেম।

 ছাত্রবৃত্তি প্রাপ্ত হইলে জননীকে বিদ্যালয়ের বেতন দান রূপ ভার হইতে মুক্ত করিতে পারিবেন,এই আশয়ে তিনি পুর্ব্ব নির্দিষ্ট বহুবিধ অধ্যয়নে ব্যাপৃত থাকিয়াও, উক্ত অভিলষিত বৃত্তি প্রাপ্তি বিষয়ে কোন রূপে অমনোযোগী ছিলেন না। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষিত বিষয় সাধনে কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া, ১৭৬৫ খৃঃ অব্দে, লার্ড আলথর্পের শিক্ষকতা কার্য্য স্বীকার করিলেন এবং কিয়দিবস পরে অভিপ্রেত ছাত্রবৃত্তিও প্রাপ্ত হইলেন। ১৭৬৭ খৃঃ অব্দে,তাঁহাকে আপন ছাত্রের সহিত জর্ম্মনির অন্তর্ব্বত্তী স্পা নামক নগরে অবস্থিতি করিতে হইয়াছিল; এই সুযোগে তিনি জর্ম্মন ভাষা শিক্ষা করেন। তথা হইতে প্রত্যাগমন করিয়া নাদিরশাহের জীবনবৃত্ত ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনুবাদিত করেন। এই জীবনবৃত্ত পারসী ভাষায় লিখিত ছিল।  কিয়দ্দিনানন্তর তাঁহাকে আপন ছাত্র ও তদীয় পরিবারের সহিত মহাদ্বীপে গমন করিয়া ১৭৭০ খৃঃ অব্দ পর্য্যন্ত অবস্থিতি করিতে হয়। উক্ত অব্দে তাঁহার শিক্ষকতা কর্ম্ম রহিত হওয়াতে, ব্যবহারশাস্ত্র অধ্যয়নার্থে টেম্পল নামক বিদ্যালয়ে নিযুক্ত হইলেন। কিন্তু এই রূপে বিষয়কর্ম্মের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়াও,তিনি বিদ্যানুশীলন একবারেই পরিত্যাগ করেন নাই। মধ্যে মধ্যে নানা বিষয়ে নানা গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন; সে সমুদায় অদ্যাপি বিদ্যমান আছে। তাহাতে তাঁহার বিদ্যা,বুদ্ধি, মনের উৎকর্ষ প্রদর্শিত হইয়াছে।

 ১৭৭৪ খৃঃ অব্দে,জোন্স বিচারালয়ে ব্যবহারাজীবের কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন, এবং অবলম্বিত ব্যবসায় বিষয়ে ত্বরায় বিলক্ষণ খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করিতে লাগিলেন।

 কলিকাতার মুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ বহুকালাবধি তাঁহার প্রার্থনীয় ছিল। পরে ১৭৮৩ খৃঃ অব্দের মার্চ মাসে উক্ত চিরপ্রার্থিত পদে নিযুক্ত হইলেন। ঐ সময়ে নাইট উপাধি প্রাপ্ত হইলেন। সুপ্রিম কোর্টের বহু পরিশ্রমসাধ্য কর্ম্মে অত্যন্ত ব্যাপৃত থাকিয়াও, তিনি পুর্ব্বাপেক্ষায় অধিকতর প্রযত্ন ও পরিশ্রম সহকারে সাহিত্য বিদ্যা ও দর্শন শাস্ত্রের অনুশীলন করিতে লাগিলেন। কলিকাতায় উপস্থিত হইয়াই,লগুন নগরের রয়েল সোসাইটী নামক সভাকে আদর্শ করিয়া স্বীয় অসাধারণ উৎসাহ ও উদ্যোগ দ্বারা এসিয়াটিক সোসাইট নামক সভা স্থাপন করিলেন। যত দিন জীবিত ছিলেন তাবৎ কাল পর্যন্ত তিনি তাহার সভাপতির কার্য্য নির্ব্বাহ করেন। এবং প্রতিবৎসর বহুতর পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক এতদ্দেশীয় শব্দ বিদ্যা ও পূর্ব্বকালীন বিষয় সকলের তত্ত্বানুসন্ধান দ্বারা উক্ত সভার কার্য্য উজ্জ্বল ও বিভূষিত করিয়াছিলেন।

 অতঃপর বিচারালয় বন্ধ ব্যতিরেকে আর তাঁহার অধ্যয়নের অবকাশ ছিল না। ১৭৮৫ খৃঃ অব্দের দীর্ঘ বন্ধের সময় যেরূপে দিবস যাপন করিতেন, তাঁহার কাগজপত্রের মধ্যে তাহার এই বিবরণ দৃষ্ট হইয়াছে। প্রাতঃকালে প্রথমতঃ এক খানি পত্র লিখিয়া, কয়েক অধ্যায় বাইবল অধ্যয়ন করিতেন; তৎপরে সংস্কৃত ব্যাকরণ ও ধর্ম্মশাস্ত্র; মধ্যাহ্ণকালে ভারতবর্ষের ভূগোল বিবরণ; অপরাহ্ণে রোমরাজ্যের পুরাবৃত্ত; পরিশেষে দুই চারি বাজী শতরঞ্জ খেলিয়া ও আরিয়ষ্টোর কিয়দংশ পাঠ করিয়া দিবাবসান করিতেন।

 তিনি এতদ্দেশীয় জল ও বায়ুর দোষে শারীরিক অসুস্থ হইতে লাগিলেন। বিশেষতঃ তাঁহার চক্ষু এমন নিস্তেজঃ হইয়া যায় যে মধূত্থ বর্ত্তিকার আলোকে লেখা রহিত করিতে হইয়াছিল। কিন্তু যাবৎ তাঁহার কিঞ্চিস্মাত্র সামর্থ্য থাকিত কিছুতেই তাঁহার অভিলষিত অধ্যয়নের ব্যাঘাত ঘটাইতে পারিত না। পীড়াভিভূত হইয়া শয্যাগত থাকিয়াও বিনা সাহায্যে উদ্ভিদ বিদ্যা অধ্যয়ন করেন। এবং চিকিৎসকের উপদেশানুসারে স্বাস্থ্যপ্রতিলাভার্থে যে কিয়ৎকাল পর্য্যটন করেন তাহাতে গ্রীশ, ইটালি ও ভারতবর্ষীয় দেবতাগণের বিষয়ে এক প্রশস্ত গ্রন্থ রচনা করেন। ইহাতে বোধ হইতেছে যে তিনি আপন মনকে এমন দৃঢ়ীভূত করিয়াছিলেন যে এইরূপ পরিশ্রম বিশ্রামভূমিতে গণনীয় হইত।

 কিয়দ্দিবস পরে তিনি কিঞ্চিৎ মুস্থ হইয়া উঠিলেন এবং পুনর্ব্বার পুর্ব্বাপেক্ষায় সমধিক প্রযত্ন ও উৎসাহ সহকারে বিচারালয়ের কার্য্যে ও অধ্যয়নে মনোনিবেশ করিলেন। কিছুকাল তিনি কলিকাতার আড়াই ক্রোশ দূরে ভাগীরথীতীর সন্নিহিত এক ভবনে অবস্থিতি করেন। ঐ সময়ে তাঁহাকে কার্য্য বশতঃ প্রতিদিন বিচারালয়ে আসিতে হইত। তাঁহার জীবনবৃত্তলেখক সুশীল প্রজ্ঞাবান্ লার্ড টিনমৌথ কহেন যে তিনি প্রতিদিন সুর্য্যাস্তের পর এই স্থানে প্রত্যাগমন করিতেন; এবং এমন প্রত্যুষে গাত্রোত্থান করিতেন যে পদব্রজে আসিয়া অরুণোদয় কালে কলিকাতার আবাসে উপস্থিত হইতেন। তথায় উপস্থিতির পর ও বিচারালয়ের কার্য্যারম্ভ হইবার পূর্ব্ব যে সময় থাকিত তাহা রীতিমত পৃথক পৃথক্ অধ্যয়ন বিষয়ে নিয়োজিত ছিল। এই সময়ে তিনি, রাত্রি তিন চারিটার সময় শয্যা পরিত্যাগ করিতেন।  বিচারালয়ের কর্ম্ম বন্ধ হইলেও তিনি কর্ম্মেই ব্যাসক্ত থাকিতেন। ১৭৮৭ খৃঃ অব্দের কর্ম্মবন্ধ সময়ে কৃষ্ণনগরে অবস্থিতি করেন। তথা হইতে লিখিয়াছিলেন “আমি এই গ্রাম্য কুটীরে বাস করিয়া অত্যন্ত প্রীতি প্রাপ্ত হইতেছি; এই তিন মাস কর্ম্মবন্ধ উপলক্ষে অবকাশ পাইয়াছি বটে, কিন্তু আমি এক দণ্ডের নিমিত্তেও কর্ম্মশূন্য নহি। ইচ্ছানুরূপ বিদ্যানুশীলনের সহিত স্বকীয় বিষয় কার্য্যের ভূয়িষ্ঠ সম্বন্ধ প্রায় ঘটিয়া উঠে না। কিন্তু সৌভাগ্য ক্রমে আমার পক্ষে তাহা ঘটিয়াছে। এই কুটীরে থাকিয়াও আমি আরবি ও সংস্কৃত অধ্যয়ন দ্বারা বিচারালয়েরই কার্য্য করিতেছি। এক্ষণে সাহস পূর্ব্বক বলিতে পারি মুসলমান ও হিন্দু ধর্ম্মশাস্ত্রজ্ঞেরা মিথ্যা ব্যবস্থা দিয়া আর আমাদিগকে ঠকাইতে পরিবেক না”। বাস্তবিক এইরূপ সার্ব্বক্ষণিক পরিশ্রমে ব্যাসক্ত থাকাতেই তাঁহার আনন্দে কালষাপন হইয়াছিল।

 যে সকল মোকদ্দমা শাস্ত্রের ব্যবস্থা অনুসারে নিম্পত্তি করা আবশ্যক; সে সমুদায়, পণ্ডিত ও মৌলবীদিগের অপেক্ষা না রাখিয়াই, অনায়াসে নিষ্পত্তি করিতে পারা যাইবেক এই অভিপ্রায়ে তিনি হিন্দু ও মুসলমানদিগের ধর্ম্মশাস্ত্রের সারসংগ্রহ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। এই গ্রন্থ তিনি সমাপন করিয়া যাইতে পারেন নাই। কিন্তু পরিশেষে অন্যান্য ব্যক্তি দ্বারা তাহার ষে সমাধান হইয়াছে তাহা এই মহানুভাবের পরামর্শ ও প্রাথমিক উদ্যোগ দ্বারাই হইয়াছে, সন্দেহ নাই।

 ১৭৮৯ খৃঃ অব্দে, তিনি শকুন্তলানামক সংস্কৃত নাটকের ইঙ্গরেজী ভাষাতে অনুবাদ প্রকাশ করেন। অনন্তর ১৭৯৪ খৃঃ অব্দের আরম্ভেই মনুপ্রণীত ধর্ম্মশাস্ত্রের অনুবাদ প্রকাশ হয়। যে সকল ব্যক্তি ভারতবর্ষের পুর্ব্বকালীন আচার ব্যবহার জানিবার বাসনা রাখেন এই গ্রন্থ তাঁহাদের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী। পরিশেষে এই সুবিখ্যাত প্রশংসিত ব্যক্তি, বিচারালয়ের কার্য্য নিম্পাদন ও বিদ্যানুশীলন বিষয়ে অবিশ্রান্ত এইরূপ অসঙ্গত পরিশ্রম করাতে, অকালে কালগ্রাসে পতিত হইলেন। ১৭৯৪ খৃঃ অব্দের এপ্রিল মাসে, কলিকাতাতে তাঁহার যকৃৎ স্ফীত হয়, এবং ঐ রোগেই উক্ত মাসের সপ্তবিংশ দিবসে অষ্টচত্বারিংশত্তম বর্ষ বয়ঃক্রম সময়ে কলেবর পরিত্যাগ করেন।

 সর উইলিয়ম জোন্সের কতিপয় অতি সামান্য নিয়ম নিৰ্দ্ধারিত ছিল; তদ্বিষয়ে দৃঢ়তর মনোযোগ থাকাতেই তিনি এই সমস্ত গুরুতর কার্য্য নির্ব্বাহে সমর্থ হইয়া ছিলেন। তন্মধ্যে একটী এই যে, বিদ্যানুশীলনের সুযোগ পাইলে কখন উপেক্ষা করিবেক না। অন্য এক এই যে, অন্যেরা যে বিষয়ে কৃতকার্য্য হইয়াছে, আমিও অবশ্য তাহাতে কৃতকার্য্য হইতে পারিব; এবং সেই নিমিত্তে বাস্তবিক প্রতিবন্ধক দেখিয়া, অথবা প্রতিবন্ধকের সম্ভাবনা করিয়া, অভিপ্রেত বিষয় হইতে নিবৃত্ত হওয়া যুক্তিসিদ্ধ নহে, বরং তাহার সিদ্ধি বিষয়ে স্থিরনিশ্চয় হইতে হইবেক।

 তাঁহার জীবনচরিতলেখক লার্ড টিনমৌথ কহেন যে ইহাও তাঁহার এক নিৰ্দ্ধারিত নিয়ম ছিল, যে সকল ব্যাঘাত অতিক্রম করতে পারা যায় তদ্দৃ‌ষ্টেবিবেচনাপূর্ব্বক হস্তার্পিত ব্যাপারের সমাধানবিষয়ে কোন ক্রমেই ভগ্নোৎসাহ হওয়া উচিত নহে। এই নিয়ম তিনি কখন স্বেচ্ছা পূর্ব্বক লঙ্ঘন করেন নাই। কিন্তু তিনি যে পৃথক্ পৃথক্ এক এক কর্ম্মের নিমিত্ত সময় নিরূপণ করিতেন এবং অতি সাবধান হইয়া সেই সেই নিৰ্দ্ধারিত সময়ে তত্তৎ কর্ম্মের সমাধান করিতেন, আমার বোধে এই মহাফলদায়ক নিয়ম দ্বারাই অব্যাঘাতে ও অনাকুলিতচিত্তে এই সমস্ত বিদ্যায় কৃতকার্য্য হইয়াছিলেন।

 সর উইলিয়ম জোন্সের মৃত্যুতে সর্ব্বসাধারণের যেরূপ অসাধারণ মনস্তাপ ও ক্ষতিবোধ হইয়াছে অতি অল্প লোকের বিষয়ে সেরূপ দেখিতে পাওয়া যায়। ভাষাজ্ঞান বিষয়ে, বোধ হয়, প্রায় কোন ব্যক্তিই তাঁহা অপেক্ষা অধিক নিপুণ ছিলেন না। পুরাবৃত্ত, দর্শনশাস্ত্র, স্মৃতি, ধর্ম্মসংক্রান্ত গ্রন্থ, পদার্থবিদ্যা ও সর্ব্বজাতীয় আচার ব্যবহার বিষয়ে তাঁহার অসাধারণ জ্ঞান ছিল। আর যদি তিনি ভিন্নদেশীয় কাব্যের ভাব লইয়া স্বভাষায় সঙ্কলন করিবার নিমিত্ত এত অধিক অনুরক্ত না হইতেন এবং বহুবিস্তৃত বিষয়কর্ম্ম নিৰ্বাহ করিয়া আপন শক্ত্যনুযায়িনী রচনা বিষয়ে প্রযত্নবান্ হইবার নিমিত্ত উপযুক্তরূপ অবকাশ পাইতেন তাহা হইলে তাঁহার কবিত্ব বিষয়েও অসাধারণ খ্যাতিলাভের ভূয়সী সম্ভাবনা ছিল। তিনি পরিবার ও পোষ্যবর্গের প্রতি যেরূপ ব্যবহার করিতেন তাহা অতি প্রশংসনীয়। তিনি স্বভাবতঃ বদান্য ও তেজস্বী ছিলেন।

 সর উইলিয়ম জোন্সের নাম চিরস্মরণীয় করিবার নিমিত্ত ভারতবর্ষে ও ইংলণ্ডে নানা উপায় নিৰ্দ্ধারিত হইয়াছে। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির অধ্যক্ষেরা সেণ্টপালের কাথিড্রলে তাঁহার এক কীর্ত্তিস্তম্ভ নির্মাণ করিয়া দিয়াছেন; এবং বাঙ্গালাতে এক প্রস্তরময়ী প্রতিমূর্ত্তি প্রেরণ করিয়াছেন। কিন্তু তাহার সহধর্ম্মিণী ১৭৯৯ খৃঃ অব্দে তদীয় সমুদায় গ্রন্থ সংগ্রহ করিয়া ছয় খণ্ড পুস্তকে যে মুদ্রিত ও প্রচারিত করিয়াছিলেন তাহাই তাঁহার পক্ষে সর্ব্বাপেক্ষা সমধিক প্রশংসনীয় ও অবিনশ্বর কীর্তি স্তম্ভ। তদ্ব্যতিরিক্ত ঐ বিধবা নারী আপন ব্যয়ে তাহার এক প্রস্তরময় প্রতিমূর্ত্তি নির্ম্মাণ করাইয়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে স্থাপিত করিয়াছেন।


সম্পূর্ণ।

.