জীবনের ঝরাপাতা/উনিশ

উইকিসংকলন থেকে

॥ উনিশ॥

জাতীয় দৈন্যের নানা দিক

নতুন মামার স্থাপিত সঙ্গীতসমাজে বরোদার রাজা নিমন্ত্রিত হয়ে গেলেন। সেটি সেকালের বনেদী ঘরের ধনী সৌখীন পুরুষদের গান-বাজনা ও থিয়েটারের আড্ডা। একবার “বাল্মীকি প্রতিভা’’ অভিনয় হচ্ছিল সেখানে। তাতে বৌবাজারের যোগেন মল্লিক মহাশয় বাল্মীকি সেজেছিলেন। তাঁর পার্টে যখন গান এল—

‘‘যাও লক্ষী অলকায়!
যাও লক্ষী অমরায়!
এ বনে এসোনা, এসোনা,
এসোনা এ ‘দীনজন’ কুটীরে—’’

তিনি গাইতে গাইতে স্টেজের মধ্যিখানে বলে উঠলেন—“আমার দ্বারা এ হবে না। আমি মা লক্ষ্মীকে এ কথা বলতে পারব না, তাঁকে তাড়াতে পারব না। জন্ম জন্ম এসো মা, থেকো মা এই দীন অভাগ্যজনের কুটীরে।”—বলে স্টেজ ছেড়ে পালালেন।

 সেই ধনী ও বিলাসীদের প্রমোদগহে বরোদার রাজা গেলেন যখন গান-বাজনার টুঁ শব্দটি শোনা গেল না। সেদিন গোবরডাঙ্গার জমিদারপ্রমুখ বলশালী পুরুষগণের বলবীর্যের নানাপ্রকার নিদর্শন দেখান হল শুধু। বরোদাকে আর কিছু দেখান শুনান যেন বাঙালীর পক্ষে লজ্জাকর হবে, তাঁদেরও মনে তাই ঠেকল। সেদিন প্রমাণ হল দেশের ধাত বদলেছে।

 আর এক ব্যাপার হতে থাকল। নানা স্থান থেকে আমার কাছে দরখাস্ত আসতে লাগল তাদের দেশে আমার ক্লাবের কতিপয় ছেলেকে পাঠাতে—তাদের ওখানে খেলাধূলা দেখান ও শেখানরও জন্যে। পূজার সময় বাঙলা দেশে বড়লোকদের ঘরে বাইনাচ আনা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। বাঙালীর জাতীয় চরিত্রের প্যাটার্ন বদলাতে থাকল।

 এই সময় আমার নিজের সম্বন্ধে নানা গুজব আমার কানে ওঠাতে থাকলেন দুই-একটি গুজবী ব্যক্তি। সবই যে প্রীতিকর হত তা নয়। আমি চুপ করে সব শুনে যেতুম, কোন মন্তব্য করতুম না। শুনতে পেলুম আমার একটা নামকরণ হয়েছে বাঙলার ‘Joan of Arc’—‘দেবী চৌধুরাণী’ নামেও আখ্যাত হতে লাগলুম। একবার শুনলুম—রেলেতে একটা পার্সেল ধরা পড়েছে, ভিতরে বন্দুকে ভরা, উপরে কারো নাম নেই। পুলিসের বিশ্বাস আমি নাকি সেগুলির আমদানী করিয়েছি—পুলিস কিন্তু তদন্ত করতে আসেনি আমাদের বাড়িতে। আর একবার সি আর দাস আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে বলে গেলেন—“আপনি সাবধানে থাকবেন। সন্ধ্যেবেলা বালিগঞ্জে এ বাড়ি ও বাড়ি হেঁটে বেড়াতে বেরোবেন না। পুলিশ বলছে, আপনি বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন, অথচ আপনাকে ধরবার, ছোঁবার কোন উপায় পাচ্ছে না। তাই তারা এবার পরামর্শ এঁটেছে কোনদিন সন্ধ্যেবেলায় আপনি বাড়ির বাইরে বেরোলে তাদের গুণ্ডা দিয়ে আপনাকে আক্রমণ করিয়ে জাহির করে দেবে গুণ্ডারা আপনার ক্লাবেরই ছেলে—আপনিই এই সব গুণ্ডা তৈরী করেছেন।”

এইবার ভারতীতে আমার “আহিতাগ্নিকা” কবিতা বেরল। সেটি এইঃ—

আহিতাগ্নিকা

সর্ব্বদেব সাক্ষী করি একি ব্রত করিলে গ্রহণ!
পথ যে দুর্গম একায়ন!
সুতীব্র দিবস আর সুদীর্ঘ শর্বরী,
অপ্রকম্প্যচিতে
সর্ব্ব ভয় পরিহরি
পারিবে কি যেতে?
হে সুখলালিতা!
দুরাশা-চালিতা!


দৃষ্টিবিষ সর্প সেথা জাগে অতি ভীষণ-আকার!
করে নিতা গরল উদ্গার।
ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, ক্রূর, হিংস্র পরানী যতেক
ফিরিছে গোপনে,
আছে কণ্টক শতেক!
পারিবে সহিতে সব?
তুমি বিক্লববচনা
অশ্রু-আবিল-লোচনা!


উজ্জ্বর্স্বল দ্বিজসম হইবে কি
সত্য-সঙ্গরা!
অতন্দ্রিতা, চিরলক্ষ্য-পরা!
পারিবে সাধিতে শক্তি
রিপুনিবর্হণা!
লোকহাস, ভয়, লজ্জা, মিথ্যা বিগহর্ণা
সহিবে প্রশান্ত চিতে?
অয়ি আহিতাগ্নিকা!
অতি সাহসিকা!


যে অগ্নি জ্বালিলে আজি, চিরদীপ্ত
রহিবে কি তাহা?
উচ্চারিবে নিত্য স্তস্তি স্বাহা!
প্রাণাহুতি দিবে তায়! আত্মবিসর্জন
নিয়ত হইবে তার সমিধ ইন্ধন!
সঙ্কল্প অটল রবে!
হবে চিরধন্যা!
অয়ি বীরম্মন্যা!


পুষ্পমাসে গন্ধ-বহ যদি আনে
 মোহ অভিনব,
নিদাঘ সন্ধ্যায় উঠে বেণুবীণা রব,
ময়ূরবিরুতমধু, বনভূবচ্ছায়,
পুলকসমুত্থ কল্প যদি শিহরায়,
 রবে অকম্পিতা তুমি!
 হে আত্ম-ঈশানা
 চির-অতৃষাণা!


যদি ঝড়ঝঞ্জা উঠে, বক্ষ-মাঝে
 অঞ্চল আবরি,
অগ্নি রাখি দিও, জাগি সারা বিভাবরী!
আর সব নারী ভবে প্রিয়-পরিজনা,
তুমি রহ শ্রেয়োনিষ্ঠ ব্রত-পরায়ণা!
অনাকুলা, অনলসা, সুকঠোরজপা!
 দৃঢ়পরন্তপা!

 এই সময় রুশের সঙ্গে জাপানের যুদ্ধ বাধল। বাঙালীদের মনুষ্যত্বের পথে আর এক ডিগ্রি উঠানর জন্যে এই সুযোগটা গ্রহণপরায়ণ হলুম। খবরের কাগজে একটি বিজ্ঞপ্তি দিলুম, ইংরেজদের রেডক্রসের মত বাঙালীদেরও একটি রেডক্রস দল গঠনের জন্যে আমি সচেষ্ট—জাপানের যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে আহতদের সেবার জন্যে। যাঁরা যোগ দিতে চান নিজেদের নাম ধাম আমার কাছে পাঠাবেন; এবং এর ব্যয় নির্বাহার্থে দশ হাজার টাকার প্রয়োজন হবে, যাঁরা অর্থ সাহায্য করতে চান তাঁদের সাহায্য সাদরে গৃহীত হবে। এর উত্তরে তিন শ-র অধিক লোকের আবেদন এল ‘বেঙ্গলী রেডক্রস’ দলভুক্ত হবার জন্যে; এবং অর্থের দিক থেকে সর্ব প্রথমে মৌরভঞ্জের মহারাজা শ্রীরামচন্দ্র ভঞ্জ অযাচিতভাবে একখানি এক হাজার টাকার চেক পাঠালেন। ময়মনসিংহের মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য এবং অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবেরা জানালেন তাঁরা প্রস্তুত আছেন, যখনি যত টাকার প্রয়োজন জানালে পাঠিয়ে দেবেন। দেখলুম, দেশে প্রাণের অভাব নেই, খালি জ্বালিয়ে দেবার দেশলাই কাঠি একটি চাই। এই সময় বেলুচিস্থান থেকে Colonel Yates নামে একজন ইংরেজ মিলিটারী অফিসারের একখানি চিঠি পেলুম। তিনি অনুযোগ করলেন, আমি বাঙালীদের একটা স্বতন্ত্র Ambulance Corps ম্যাঞ্চুরিয়ায় পাঠাবার জন্যে কেন প্রয়াসী হয়েছি? লর্ড কার্জনের প্রচেষ্টায় ইণ্ডিয়া গবর্নমেণ্ট থেকে যে Corps পাঠান হবে তার সঙ্গে এইটে মিলিত কেন না করি? তাছাড়া আমার Corps কি St. John Ambulance Association-এর ট্রেনিং প্রাপ্ত? তা না হলে যাওয়া নিষ্ফল—তিনি আমায় সতর্ক করে দিলেন। হয়ত এ বিষয়ে বাঙালীদের কোন স্বাধীন প্রচেষ্টা ইংরেজদের মনঃপুত ছিল না, হয়ত ইণ্ডিয়া গবর্নমেণ্ট থেকেই এ চিঠির ইঙ্গিত গিয়েছিল,—যাই হোক এর থেকে আমি একটা মস্ত শিক্ষা পেলুম। ব্যাপারটার গুরুত্ব সম্বন্ধে একটা ধারণা এল। আমার ‘বেঙ্গলী রেডক্রস’ সংগঠন ও যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণের পরিকল্পনাটি শুধু ভাবের তোড়ে নির্গত একটি বস্তু। এর জন্যে নিজেদের তৈরি হওয়ার প্রধান উপকরণ কি কি তা ভাবিনি। দেশের লোকেরাও কেউ এদিকে মাথা ঘামাননি, আমায় সে সম্বন্ধে কেউ সচেতনও করেননি—একের উৎসাহেই খালি সকলের উৎসাহ প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে। শুধু শতাব্দীগত ভীরুতার শিক্ষাকে দলিত করে—‘শতহস্তেন বাজিনঃ’ প্রভৃতি বুলি প্রত্যাখ্যান করে ভয়াবহ যুদ্ধস্থলে গোলাবন্দুকের সন্নিকটে উপস্থিত হওয়ার সাহস অবলম্বনই যে যথেষ্ট নয়, যে উদ্দেশ্যে যাওয়া সে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে—আহত মুমূর্ষুদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও সেবার জনো যারা ডাক্তার নয় তাদের সে বিষয়ে অধীতবিদ্য হয়ে যাওয়া যে কতদূর প্রয়োজন তা ভাবিনি। কর্নেল ইয়েট্‌সের চিঠি পেয়ে এ সম্বন্ধে জাগরণ এল। কিন্তু St. John Ambulance Association কি বাঙালীদের শেখাবে? সেটা British Red Cross-এর অঙ্গীভূত—তাতে ইংরেজ ও ফিরিঙ্গি ছাড়া আর কেউ শিক্ষা পায় বলে ত জানিনে। আমি তার বড়কর্তাকে একখানি চিঠি লিখে অনুরোধ করলুম আমার সঙ্গে এসে দেখা করতে, তিনি সৌজন্য করে এলেন। আমি তাঁকে সব অবস্থাটা খুলে বললুম। তিনি শুনে বললেন—“এ পর্যন্ত একটি বাঙালীও তাঁদের কাছে ট্রেনিংপ্রার্থী হয়ে কখন আসেনি। তাঁদের ক্লাস শুধু ইংরেজ ও ফিরিঙ্গিতেই ভরা। বাঙালীদের শেখান হবে কিনা এ বিষয়ে কোন দিন কোন প্রশ্ন উঠবার অবসরই হয়নি। আমার অনুরোধ তিনি নিশ্চয়ই রক্ষা করবেন—বেঙ্গলী Ambulance Corpsকে উপযুক্তভাবে শিক্ষিত করে দেবেন। সেজন্যে তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার পূর্বে অন্তত তিন মাস কলকাতায় অবস্থান করে শিক্ষা নেওয়ার দরকার।”

 এই সকল পর্যালোচনা চলছে—ইতিমধ্যেই খবরের কাগজে হঠাৎ একদিন একটি খবর বেরল—জাপানী গবর্নমেণ্ট ইস্তেহার দিয়েছেন—“বহু জাতি তাঁদের প্রতি সহৃদয়তা প্রকাশ করে তাঁদের আহতদের সেবার জন্যে স্ব স্ব রেডক্রস-সেবকদের পাঠাবার অভিপ্রায় জানিয়েছেন। তাঁদের সকলকে জানান হচ্ছে তাঁদের সাহায্য প্রস্তাবের জন্য জাপান কৃতজ্ঞ, কিন্তু এস্থলে কোন বিদেশীয় সাহায্য গ্রহণে তাঁরা পরাঙ্মুখ।” জাপানের তীক্ষ্ণ রাজনীতি-বিচক্ষণতার ফলেই এইরূপ বিধান তাঁরা সাব্যস্ত করেছিলেন সন্দেহ নেই।

 দেখা যায় সেদিনকার জাপান ও আজকেকার জাপানের প্রতি ভারতবর্ষে আমাদের দৃষ্টিকোণের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেদিন তারা সবেমাত্র এক প্রচণ্ড বলশালী য়ুরোপীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করেছে…একমাত্র এসিয়াটিক জাতি তারা সমস্ত এসিয়ার মুখোজ্জ্বল করেছে এবং ‘Asia is one’ এই বাণীর দ্বারা সমগ্র এসিয়াকে জাগ্রত করেছে। আজ দেখি “এসিয়া এক” এই অভিনব বুলিটির ভিতর এক দারুন গুলী লুকিয়ে রেখেছিল যেটা সুযোগ মত বেরিয়ে পড়ে তামাম এসিয়াকে বিব্রত করে তুলবে, সেটি হচ্ছে ‘জাপানের অধীনতায়’। আজ কয়েক বৎসর ধরে চীন মহাদেশকে জাপানের ছত্রছায়ে আনবার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় সেটা পদে পদে প্রমাণিত হচ্ছে। শ্যাম, বর্মা, মলয়দ্বীপ, কোরিয়া, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ—কোথাও তাদের এ অভিসন্ধি আর লুকান নেই। পথিবীর পশ্চিম প্রান্তের ক্ষুদ্র দ্বীপ জাপানও যে সাম্রাজ্য বিস্তারের সমান অধিকারী এ বিষয়ে আর তাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ইংলণ্ড যেমন ‘white man's burden’ বহন করার মহদুদ্দেশ্যে, কেবলমাত্র পরোপকারার্থ, দেশবিদেশে নিজেদের ‘ঝাণ্ডা উচা’ করছেন, জাপানও—ইংলণ্ডের দক্ষতম শিষ্যটিও—তদ্রুপ ‘yellow man's burden’ কাঁধে ওঠানর জন্যে, প্রতিবেশীদের অতিভার লাঘবের জন্যে, কেবলমাত্র তাদেরই কল্যাণের প্রতি দৃষ্টিবান হয়ে তাদের দিকে হস্তবিস্তার করছে। ইংলণ্ডের লৌহপাশ থেকে মুক্ত হয়ে জাপানের বজ্রকুসুমের বলয় পরতে কিসের আপত্তি? এ যে এসিয়াটিক স্যাকরার হাতে গড়া স্বদেশী জিনিস! কিন্তু ভবী ভোলবার নয়! নাড়া বেলতলায় দুবার যেতে নারাজ!

 যুদ্ধের পর অনেক জাপানীর সমাগম হতে থাকল ভারতবর্ষে ও আমাদের পরিবারমণ্ডলে। তার মধ্যে তিন-চারটির সঙ্গে আমাদের বিশেষ পরিচয় হল। তাদের মধ্যে দুটি ইয়োকোআনা ও হিষিদ্য চিত্রকর, তখনি নিজেদের দেশে কিছু কিছু নামকরা, পরে ভারতবর্ষ থেকে ফিরে গিয়ে বিশেষরূপে প্রথিতনামা হন। তাঁরা আমাদের পরিবারস্থ কারো কারো ফরমাসে ভারতীয় বিষয়ের অনেকগুলি চিত্র আঁকলেন। য়ুরোপীয়দের মত ক্যানভাসের উপরে নয়, রেশমের উপর আঁকেন জাপানীরা। তাতে ভারি একটি মোলায়েম ভাব হয়। আর তাঁদের তুলির স্পর্শ যে কি সুকোমল, রঙগুলি যে কি সুমোহন হয়ে ফোটে, তা চিত্রশিল্পী মাত্রে জানেন। আমার ফরমাসে একজন ইয়োকোআনা কালী ও একজন হিষিদা সরস্বতীর ছবি আঁকলেন। সে দুখানিই আমার ঘরে আজও বিরাজিত এবং দর্শকমাত্রের দৃষ্টি ও চিত্ত-আকর্ষক। যদি বোমা পড়ে, তবে রামের বোমাতেও যাবে, রাবণের বোমাতেও যাবে—এই ভয় মনে পোষণ করেও ছবি দুখানি রেখেছি সযত্নে যুদ্ধের আজ তিন-চার বছর ধরে নিজের বসবার ঘরেই। এ দুখানির ফটো সে সময়কার প্রবাসীতে বেরিয়েছিল—তখন ভারতী সচিত্র ছিল না। ‘কালী’র ছবিটি ঠিক সচরাচর দৃষ্ট কালীর ছবি নয়। তার কল্পনায় যে নূতনত্ব ছিল তার ব্যাখ্যান দিয়েছিলুম প্রবাসীতে।

 সুরেন মহাভারতের ‘গীতা’ কথনের সময়কার ছবি আঁকিয়েছিলেন, তাঁর প্রণীত ‘সংক্ষিপ্ত মহাভারত’ পুস্তকের অন্তঃপৃষ্ঠায় তার ফটো সন্নিবিষ্ট আছে। শ্বেত অশ্বযুগলের রথে অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণ দুজনে সমাসীন। সে ছবি শ্রীকৃষ্ণের তেজোময়তার একটি আদর্শ ছবি। গগনদাদা ও অবনদাদা রাসলীলা ও অন্যান্য হাল্কা রসাত্মক বিষয়ের ছবি আঁকিয়েছিলেন। সে রাসলীলার ছবিখানি একটু একটু মনে পড়ে—কি অপার্থিব চন্দ্রালোক, কি আকাশবৎ সূক্ষ্ম বায়বীয় উত্তরীয় গোপীদের, কি নৃত্যভঙ্গি! এগুলি প্রকাণ্ড বড় বড় ছবি। আমার পঞ্জাব অবস্থানকালে জাপান গবর্নমেণ্টের দূত এসে তাদের আর্টিস্টের অঙ্কিত অমূল্য ছবিগুলি তাদেরই দেশে থাকা উচিত বলে সুরেনের ও গগনদাদাদের ছবিগুলি বহুমূল্যে ক্রয় করে নিয়ে গেল। আমার দুখানি আমার সঙ্গে পঞ্জাবেই ছিল—তাই বেঁচে গেছে, এখনও ভারতবর্ষেই রয়ে গেছে।

 এই আর্টিস্টদের সমসাময়িককালে ‘প্রিন্স হিতো’ বলে জাপানী রাজবংশের একটি ছেলে আসেন। তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন এবং ভারতবর্ষের তীর্থস্থান দেখে বেড়াচ্ছিলেন। এ‘কে দেখতে অনেকটা ত্রিপুরার রাজবংশের একটি সুন্দর ছেলের মত—একটি ভারি সৌকুমার্য আছে শরীরে, মুখে ও মনে। তাঁর সরল, সাদাসিদে অথচ সবিনয় ভদ্রব্যবহারে সকলে মুগ্ধ হয়েছিলেন। যেন পথহারা পথিকের মত পৃথিবীতে

ফিরতেন তিনি। তাঁকে দু-একটি তথাকথিত রসিক পুরুষ তাঁদের দেশের নর্তকীদের সম্বন্ধে নানা রকম প্রশ্ন করতেন, তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন। এরা ছাড়া স্বামী বিবেকানন্দের আমেরিকান শিষ্যা মিসেস ওলেবুলের—যাঁর টাকাতেই বেলুড় মঠের ভিত্তি স্থাপিত হয়—বন্ধু, আমেরিকায় কিছুকাল অবস্থিত ও ইংরেজী শিক্ষিত একজন বিশিষ্ট লেখক, আর্ট সমালোচক ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ওকাকুরা এসেছিলেন। তিনি একজন আদর্শ সামুরাই জাপানী—চেহারায়, ধরন-ধারনে, পোশাক-পরিচ্ছদে, সর্বদিকে চৌকস, জাতীয়তায় ভরা, এসিয়ার ঐক্যবাদে অনুপ্রাণিত, এসিয়ার প্রতি অংশকে—শ্যাম, জাভাদি এবং ভারতবর্ষ থেকে আরম্ভ করে পারস্য পর্যন্ত প্রতি খণ্ডটিকে দেশাত্মবোধে কানায় কানায় ভরে দেওয়ার আগ্রহবান। তাঁর একখানি প্রসিদ্ধ বই কলিকাতায় বসেই লেখা, মিসেস ওলেবুল, মিস ম্যাকলয়েড প্রভৃতির তত্ত্বাবধানে এবং নিবেদিতার টাইপিংয়ে। তাঁর বইয়ের আরম্ভের সেণ্টেন্স—‘Asia is one’, তার শেষ সেণ্টেন্স—Victory from within or Death from withou’'। তাঁর বইয়ের অন্তর্গত ভাব ও বাণী বাঙলা থেকে পঞ্জাব পর্যন্ত মুখে মুখে প্রচার হতে থাকল, লাজপৎ রায় প্রমুখ প্রত্যেক দেশভক্তের লেখনীতে লেখনীতে প্রতিফলিত হতে লাগল।

 এই সব জাপানীরাই সুরেনদার বাড়িতে অতিথি হয়ে বাস করতেন। আমাদের পরিবার ছাড়া আর এক বাঙালী পরিবারের কর্তার সঙ্গেও ওকাকুরার ভাব হল—তিনি ক্রীক রো-র সুবোধ মল্লিকের পিতৃব্য হেম মল্লিক। ওকাকুরা যখন জাপানে ফিরে যান, হেম মল্লিক মহাশয়ের পুত্র তাঁর সঙ্গে গেলেন।

 রুশ-জাপানী যুদ্ধের পর থেকে জাপানের সঙ্গে ভারতবর্ষীয়দের বাণিজ্যের সংযোগ বেড়ে গেল এবং বাঙলাদেশ থেকে অনেক ছাত্ররা গিয়ে নানাবিধ শিল্প শিক্ষা করতে লাগল। সিলেটের রমানাথ রায় সে সময়ে একজন প্রসিদ্ধ জাপান প্রত্যাগত সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ফিরে এসেই আমার সঙ্গে দেখা করেন—জাপানের অনেকানেক অদ্ভুত অদ্ভুত ছোট ছোট শিল্পজাত উপহার নিয়ে এসেছিলেন মনে পড়ে, যা তৈরি করতে জাপানীদের বেশি খরচ হয় না, অথচ যার ভিতর শিল্পনৈপুণ্যের পরাকাষ্ঠা পাওয়া যায়। জাপানের আদর্শে নানা রকম ছোট ছোট কলকারখানা ব্যবসা-বাণিজ্য চালান তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। অল্পদিনেই সকলকে মর্মাহত করে তাঁর অকাল-মৃত্যু হয়, দেশ একটি সুকর্মীকে হারায়। ছাত্রদের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের উমেশ দত্ত মহাশয়ের দৌহিত্র সত্যসুন্দর দেব আমার কতকটা সাহায্যে একটি স্কলারশিপ পেয়ে জাপানে ‘পটারি ওয়ার্কস’ শিখতে যান এবং দেশে ফিরে ‘বেঙ্গল পটারি’ খোলেন। খুব ভাল চলছিল। নিজের দেশের পেয়ালা পিরিচে চা খেতে পেয়ে বাঙালী ধন্য বোধ করছিল। কিন্তু যতদূর জানি, ভিন্ন ভিন্ন স্বত্বাধিকারীর হাতে পড়ে পড়ে শেষে কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্র নন্দীর সময় বোধহয় এটা ফেল করে। এখন একটি লিমিটেড কোম্পানী হয়ে পঞ্জাবী ও দিল্লীওয়ালাদের শেয়ার আধিক্যে তাঁদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সত্যসুন্দর দেব এখন রূপনারায়ণপুরে ‘Behar Pottery’ নাম দিয়ে ও বেলিয়াঘাটায় তাঁর পুত্র সরল দেবের Bengal Porcelain Co. নামে স্বতন্ত্র পটারি ওয়ার্কস খুলেছেন। শুনতে পাই, এগুলির অবস্থাও খুব ভাল।