জীবনের ঝরাপাতা/গ্রন্থোক্ত ব্যক্তি ও বিষয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

উইকিসংকলন থেকে

গ্রন্থোক্ত ব্যক্তি ও বিষয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

[সরলা দেবীর ‘জীবনের ঝরাপাতা’ প্রায় চল্লিশ বৎসরব্যাপী ভারতের জাতীয় ইতিহাসের আকর-গ্রন্থ হিসাবে গণ্য হইবার যোগ্য। ইহাতে বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ রহিয়াছে। প্রসিদ্ধ ও বহুজনবিদিত বিষয়গুলি সম্বন্ধে এখানে বিবৃত করিতে বিরত রহিলাম। আবার অনাবশ্যক-বোধেও কোন কোন বিষয় বলা হইল না। সকল বিষয়ে বলিতে গেলে পরিশিষ্ট অংশই একখানি বিরাট গ্রন্থ হইয়া দাঁড়ায়। সরলা দেবীর জন্ম: ৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৭২।]

॥ এক ॥

 সৌদামিনী দেবী (১৮৪৭—১৯২০): মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে স্ত্রীশিক্ষার রেওয়াজ ছিল। গোঁসাই মেয়েরা পরিবারের স্ত্রীকন্যাদের প্রাথমিক লেখাপড়া শিখাইতেন। ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ১৮৪৯, ৭ই মে, কলিকাতা বালিকা বিদ্যালয় (পরে ‘বেথুন স্কুল’) স্থাপন করেন। তখন প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে বালিকাদের প্রেরণের রীতি উচ্চ ও মধ্য-স্তরের হিন্দু পরিবারে প্রচলিত ছিল না। বেথুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর হইতে প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে মেয়েদের পড়াইবার রীতি সমাজে চালু হয়। ১৮৫১ সনের মাঝামাঝি দেবেন্দ্রনাথ জ্যেষ্ঠা কন্যা পঞ্চম বর্ষীয়া সৌদামিনীকে এই স্কুলে ভর্তি করিয়া দেন। এই ঘটনাটির কথা তখন সাময়িক পত্রের সংবাদ-স্তম্ভেও প্রকাশিত হইয়াছিল। জুলাই ১৮৫১ সংখ্যা ‘দি ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান অব্‌জার্ভার’ লেখেন:

 ‘‘One of the most influential natives in Calcutta, Debendernauth Tagore, has added his own daughter to the long list of eighty female children already receiving instruction in the Institution, and the Raja Kri Krishna Bahadur, who occupies the prominent position in Hindu Society in the metropolis has accepted the office of its president.’’

 দেবেন্দ্রনাথ ৮ই জুলাই ১৮৫৯ তারিখে রাজনারায়ণ বসুকেও এই বিষয়টির কথা এক পত্রে এইরূপ লিখিলেন, “আমি বেথুন সাহেবের বালিকা বিদ্যালয়ে সৌদামিনীকে প্রেরণ করিয়াছি, দেখি ও দৃষ্টান্তে ফল কি হয়।” (পত্রাবলী, প. ৪১)। সৌদামিনী দেবী ‘পিতৃস্মৃতি’তেও (প্রবাসী—ফাল্গুন ১৩১৮) বলিয়াছেন যে, তাঁহার পিতৃদেব তাঁহাকে এবং তাঁহার খুড়তুতো বোনকে বেথুন স্কুলে ভর্তি করিয়া দেন।

 সৌদামিনী দেবীর বিবাহ হয় বড়বাজারস্থ বিখ্যাত গঙ্গোপাধ্যায় বংশের অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র সারদাপ্রসাদের সঙ্গে (১৮৫৫?)। ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুযায়ী সারদাপ্রসাদ ঘরজামাই ছিলেন। তিনি দেবেন্দ্রনাথের জমিদারী পরিচালনায় নিযুক্ত হন। দেবেন্দ্রনাথ-পরিচালিত বিভিন্ন সমাজ-কর্মের সঙ্গে তাঁহার যোগ ছিল। ব্রাহ্মবিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হইবার প্রাক্কালে আদি-ব্রাহ্মসমাজের পক্ষে, ভারত সরকারের নিকট লিখিত প্রতিবাদ জ্ঞাপনের জন্য নবগোপল মিত্রের সঙ্গে সারদাপ্রসাদ সিমলায় যান। সৌদামিনী স্নেহবৎসল ও সেবাপরায়ণ ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের পত্নী-বিয়োগের (১৮৭৫) পর তিনিই গৃহকর্ত্রীরূপে বিরাট পরিবারের সবকিছু আগলাইয়া রাখিতেন। তাঁহার উপর দেবেন্দ্রনাথের আস্থা ও নির্ভর ছিল যথেষ্ট।

 সুকুমারী দেবী (১৮৫০-৬৪): মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয়া কন্যা। ব্রাহ্মসমাজের ‘অনুষ্ঠান-পদ্ধতি’ রচিত হইলে, সর্বপ্রথম ব্রাহ্মমতে সকুমারীর বিবাহ হইল (১৮৬১)। ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসে এই বিবাহটি একারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দেবেন্দ্রনাথ স্বয়ং এই পদ্ধতি অনুসারে একটি বিবাহপ্রণালী রচনা করেন। এই প্রণালীটি সকুমারী দেবীর বিবাহে পূর্ণরূপে অনুসৃত হয়। এই প্রণালীটি সমুদয়ই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় (ভাদ্র ১৭৮৩ শকে) প্রকাশিত হয়। ইহা হইতে সংবাদ-অংশ এখানে প্রদত্ত হইল:

 “ব্রাহ্মবিবাহ। গত ১২ই শ্রাবণ শুক্রবার ব্রাহ্মধর্মের ব্যবস্থানুসারে শ্রীযুক্ত রাজারাম মুখোপাধ্যায়ের পুত্র শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায়ের সহিত শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের কন্যার শুভ বিবাহ অতি সমারোহ পূর্বক সম্পন্ন হইয়া গিয়াচে। বাঙ্গালাদেশে ব্রাহ্মধর্মানুযায়ী বিবাহের এই প্রথম সূত্রপাত হইল। বিবাহসভায় লোকের বিস্তর সমাগম হইয়াছিল। আহ্লাদের বিষয় এই যে, প্রায় দুই শত ব্রাহ্ম সভাস্থ হইয়া যথাবিধানে কার্য সম্পাদন করিয়াছিলেন। তাহা যেরূপ পদ্ধতিক্রমে নির্বাহ হইয়াছে, অবিকল তাহা নিম্নে প্রকাশিত করা গেল...।”

 জানকীনাথ ঘোষাল (১৮৪০-১৯১৩): জানকীনাথ ঘোষালের জ্যেষ্ঠা কন্যা হিরন্ময়ী দেবী শ্রাদ্ধবাসরে তাঁহার একটি সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্ত পাঠ করেন। ইহার মূল অংশ এখানে উদ্ধত হইল:

 “নদীয়ার জয়রামপুরের ঘোষালবংশে প্রায় ৭৩ বৎসর পূর্বে পিতৃদেবের জন্ম হয়। আমাদের পিতামহ ৺জয়চন্দ্র ঘোষালের দুই পুত্র ছিলেন: তন্মধ্যে পিতামহাশয় কনিষ্ঠ। এই ঘোষালবংশ অসাধারণ বলবীর্যের জন্য প্রসিদ্ধ। তাঁহাদের জয়রামপুরের পৈতৃক জমিদারী সম্বন্ধে এই প্রসিদ্ধি আছে যে, ঘোষালদিগের কোন পূর্বপুরূষ উহা বীর্যবত্তার পুরস্কার স্বরপ কৃষ্ণনগরের রাজার নিকট হইতে প্রাপ্ত হন।...

 “জানকীনাথের নিজ ইচ্ছামতই পিতামহ মহাশয় তাঁহাকে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে বিদ্যাশিক্ষার্থ পাঠান। তদানীন্তন প্রিন্সিপ্যাল প্রসিদ্ধ শ্রীযুক্ত উমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয়ের তিনি প্রিয় শিষ্য ছিলেন। এইখানেই তিনি ৺রামতনু লাহিড়ী, ৺রাধিকা প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, ‘কালীচরণ ঘোষ, ৺রায় যদুনাথ রায় বাহাদুর (কৃষ্ণনগর রাজার দ্রৌহিত্র) প্রভৃতি বন্ধুগণের সংস্পর্শে আসেন। রামতনু লাহিড়ী প্রমুখ মনীষিগণের উপদেশ ও উত্তেজনায় পিতামহাশয় ও আরও কতিপয় ছাত্র জাতিভেদে বিশ্বাসশূন্য হন, এবং যজ্ঞোপবীত ত্যাগ করেন। আমাদের পিসেমহাশয় ৺পরেশনাথ মুখোপাধ্যায়ও ইহাদের মধ্যে একজন। উপবীতত্যাগবার্তা শুনিয়া পিতামহ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে ত্যাজ্যপুত্র করেন, কিন্তু শুনিতে পাই পিতামহী ইহাতে মোটেই রাগ করেন নাই, বলিয়াছিলেন ছেলের যাহা সত্য মনে হয় তাহাই করিয়াছে, তাহা করুক। কিন্তু ঠাকুরদাদা অনেকদিন পর্যন্ত তাঁহাকে ক্ষমা করিতে পারেন নাই। এমন কি জ্যেঠামহাশয়ের মৃত্যু হইলে পিতাকে বঞ্চিত করিবার জন্য অনেক বিষয়-সম্পত্তি তিনি বিক্রয় করিয়া ফেলেন; তথাপি পিতৃদেব স্বার্থের জন্য নিজের মত ও বিশ্বাস ত্যাগ করেন নাই, পিতার ক্রোধবজ্র মাথায় লইয়া এই সময় তিনি নানা সমাজসংস্কার কার্যে ব্রতী ছিলেন, এবং নিজ ব্যয়নির্বাহার্থে পুলিশে কর্ম গ্রহণ করেন, কিন্তু তাঁহার ন্যায় লোকের পুলিশের সব কার্য অনুমোদন করিয়া সদ্ভাবে চলা অধিকদিন সম্ভব নহে তাহা বলা বাহুল্য।

 “এই সময় মাতামহ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কৃষ্ণনগরে যান ও এই সুদর্শন উৎসাহী সমাজ-সংস্কারক যুবককে দেখিয়া প্রীত ও আকৃষ্ট হয়েন এবং কয়েক বৎসর পরে মাতৃদেবীর সহিত তাঁহার বিবাহ স্থির হয়। আশ্চর্যের বিষয় এই, পিতা বিবাহ করিতেছেন শুনিয়া ঠাকুরদাদা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েন এবং এই সময় হইতে আবার তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হইয়া অন্তরের সহিত তাঁহাকে পুনর্গ্রহণ করেন। তিনি কলিকাতায় আসিয়া মূল্যবান অলঙ্কার দ্বারা বধূর মুখদর্শন করেন এবং তখন হইতে মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় আমাদের বাটীতে আসিয়া বাস করিতেন ও আমাদের লইয়া আহারাদি করিতেন। সেকালের হিসাবে তাঁহারও প্রকৃতি উদার ছিল। ব্রাহ্মণত্বের চিহ্ন পর্যন্ত পরিত্যাগ করায় তাঁহার মনে আঘাত লাগিয়াছিল কিন্তু অনেকগুলি ছোট ছোট কুসংস্কার তিনি নিজেই মানিতেন না।

 “বিবাহকালে পিতৃদেব মাতামহ পরিবারের ২টী রীতি গ্রহণ করেন নাইঃ— ১। ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ, ২। ঘরজামাই থাকা। এই সময় তিনি ডেপুটী কলেক্টর ছিলেন। মাতৃদেবীর যখন বিবাহ হয়, তখন তাঁহার বয়স ১২ বৎসর মাত্র। মাতামহ কন্যার যে শিক্ষা পত্তন করেন স্বামীর যত্নে তাহা পরিস্ফুট হইয়া উঠে। পিতা তাঁহার কন্যাদ্বয়কে পুত্রনির্বিশেষে শিক্ষা দিয়া আসিয়াছেন, ইহা সকলেই জানেন। মাতৃদেবী ও আমরা যে কোন সৎকার্যের বা দেশহিতকর কার্যের প্রয়াস পাইয়াছি তাহার তিনি প্রধান সহায় ও উদ্যোগী ছিলেন। পূজনীয় মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজসংস্কার-প্রযত্নে তিনিই সর্বপ্রধান সহায় ছিলেন। তাঁহার বন্ধু-বাৎসল্য যে কি গভীর ছিল, তাহা প্রত্যক্ষ ফললাভ দ্বারা তাঁহার অনেক বন্ধুই বিশেষ ভাবে অবগত আছেন।...

 “বিবাহের পরেই পিতার বিলাত যাইবার প্রস্তাব হওয়ায় তিনি ডেপউটী কলেক্টরের পদ ত্যাগ করেন। কিন্তু নানা অভাবিত কারণে সেই সময় বিলাত যাওয়ার বাধা পড়ায় তিনি স্বাধীন জীবিকার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য আরম্ভ করেন। সেই সূত্রে বেরিণী কোম্পানীর হোমিওপ্যাথিক দোকান তিনি ক্রয় করেন। তাহা খুব লাভজনক ছিল। বিক্রয় করিবার অল্পদিন পরে—তাহার পূর্ব মালিক তাহা পুনর্লাভে ইচ্ছুক হইয়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শরণাপন্ন হন। বিদ্যাসাগর মহাশয় পিতৃদেবের একজন বিশেষ বন্ধু ছিলেন। বিদ্যাসাগরের অনুরোধে পিতা গভীর স্বার্থত্যাগ করিয়া দোকান ফিরাইয়া দিলেন।...

 “রোগীর সেবা তাঁহার একটি প্রধান ব্রত ছিল। পরিবারের সকলেই এবিষয়ে সাক্ষ্য দিতে পারিবেন।...গরীব দুঃখীর সেবার জন্য তিনি ঘরে বসিয়া হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা করিয়া বিনা পয়সায় ডাক্তারী করিতেন। কাশিয়াবাগান বাগানবাড়িতে আমরা যখন ছিলাম—তখন দেখিয়াছি, রোজ সকালে পাড়ার আর্তলোকে বাড়ি ভরিয়া যাইত। ভোর হইতে রোগী দেখিয়া ঔষধ বিতরণ করিতে করিতে বেলা দশটা এগারটা বাজিয়া যাইত। তাহার পর তিনি স্নান আহার করিতেন।

 “আইনে তাঁহার বিশেষরূপ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখিয়া তাঁহার বন্ধুগণ তাঁহাকে বিলাত যাইয়া ব্যারিষ্টার হইবার পরামর্শ দেন এবং তিনি আমাদের মাতুলালয়ে রাখিয়া বিলাত যাত্রা করেন। সেখানে অধিকাংশ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েন কিন্তু শেষ পরীক্ষার পূর্বেই ছয় বৎসর বয়স্কা কনিষ্ঠা কন্যার মত্যু-সংবাদে তাঁহাকে দেশে ফিরতে হয়। ইচ্ছা ছিল আবার যাইয়া পরীক্ষা দিবেন এবং তজ্জন্য বরাবর ফি দিয়া নাম বজায় রাখিয়াছিলেন, কিন্তু ঘটনাচক্রে আর যাওয়া হয় নাই!...

 “কলিকাতায় প্রায় সব সাধারণ হিতকর কার্যেই তাঁহার যোগ ছিল। অনেক বৎসর তিনি মিউনিসিপ্যাল কমিশনার ছিলেন। মেকেঞ্জি বিলের প্রতিবাদে যে ২৪ জন কমিশনার পদত্যাগ করেন, তন্মধ্যে তিনি একজন। শিয়ালদহ ও লালবাজার দুই কোর্টেই তিনি অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। বৎসরাবধি তাঁহার শরীর অসুস্থ ছিল, মধ্যে মধ্যে এক একবার শয্যাগত থাকিতেন, কিন্তু একটু সুস্থবোধ করিলেই কোর্টে ও অন্যান্য কার্যে যাইতেন, আমাদের নিষেধ মানিতেন না। এরূপ কর্তব্যনিষ্ঠা বিরল।

 “ইঁহার সঙ্কলিত ‘Celebrated Trials in India’ নামক পুস্তক সাধারণের একটি বিশেষ অভাব দূর করিয়াছে।

 “পাবলিক কার্যের মধ্যে তাঁহার সবচেয়ে প্রিয় কার্য ছিল—ইণ্ডিয়ান ন্যাসনাল কংগ্রেস। হিউমের উদ্বোধনে এটি জানকীনাথের স্বহস্তে রোপা, স্বহস্তে জল সেচন করা ও সহস্তে বাড়ান জাতীয়-মহীরুহ। কংগ্রেসের জীবন আজ ২৮ বৎসর, আজ অনেকেই ইহার বন্ধু, সহায় ও মুরুব্বী, কিন্তু যতদিন এ নাবালক ছিল, ততদিন জানকীনাথই ইহার প্রধান অভিভাবক ছিলেন।

 “যে সময়ে অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন মাদাম ব্লাভাট্‌স্কি ভারতবর্ষে আসিয়া থিয়সফি প্রচার করেন সে সময় জানকীনাথ থিয়সফিস্ট সম্প্রদায়ভুক্ত হন। মিঃ হিউমও থিয়সফিষ্ট ছিলেন। সেকালে বৎসরান্তে মাদ্রাজে একটি থিয়সফিক্যাল কনফারেন্স হইত, ভারতবর্ষের সকল অংশ হইতে থিয়সফিস্টগণ সেখানে আসিয়া সম্মিলিত হইতেন। এইরূপ সম্মিলনী হইতেই হিউম সাহেবের একটি ভাবের স্ফুরণ হইল যে, সমগ্র ভারতবাসীর এরূপ একটি পলিটিক্যাল সম্মিলনী গড়িয়া তুলিতে পারিলে ভারতবাসীর অশেষ মঙ্গল হইবে। এই ভাব হইতেই কংগ্রেসের উৎপত্তি এবং সেই ভাবটিকে কাজে পরিণত করার মূলে ছিলেন জানকীনাথ ঘোষাল। তিনি তখন কিছুকালের জন্য এলাহাবাদে থাকিয়া ‘Indian Union’ নামক একখানি সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদন ভার গ্রহণ করেন। কংগ্রেসের আরম্ভ হইতে তিনি যে কিরূপ ভাবে ইহার জন্য কাজ করিয়াছেন, ধন প্রাণ মন দিয়া সকলের তিরস্কার নিগ্রহ সহ্য করিয়া অম্লানচিত্তে কার্য করিয়া গিয়াছেন তাহা সর্বজনবিদিত।...”


 উমেশচন্দ্র গুপ্ত: পুরা নাম উমেশচন্দ্র দত্তগুপ্ত, সাধারণতঃ উমেশচন্দ্র দত্ত নামেই পরিচিত। উমেশচন্দ্র কৃষ্ণনগর কলেজের খ্যাতিমান ছাত্র ছিলেন। তিনি প্রথমে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরে কৃষ্ণনগর কলেজে ইতিহাস ও সাহিত্যের অধ্যাপক হন। তিনি ১৮৭৫ সনে কলেজের অস্থায়ী অধ্যক্ষ হইয়াছিলেন। স্কুল-বিভাগে শিক্ষকতাকালে উমেশচন্দ্র কর্তৃক জানকীনাথ বিশেষ প্রভাবিত হইয়াছিলেন।


 মা: স্বর্ণকুমারী দেবী (? ১৮৫৫-১৯৩২) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থা কন্যা। স্বর্ণকুমারী গৃহে বসিয়া শিক্ষালাভ করেন। জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে তাঁহার বিবাহ হয় ১৭ নবেম্বর ১৮৬৭ তারিখে। এই বিবাহের সংবাদ ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় (পৈৗষ ১৭৮৯ শক) এইরূপ বাহির হয়:

 “ব্রাহ্ম-বিবাহ। গত ২ অগ্রহায়ণ রবিবার ব্রাহ্মসমাজের প্রধান আচার্য শ্রদ্ধাস্পদ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যার সহিত কৃষ্ণনগরের অন্তঃপাতী জয়রামপুর নিবাসী শ্রীযুক্ত বাবু জানকীনাথ ঘোষালের ব্রাহ্মবিধানানুসারে বিবাহ হইয়া গিয়াছে। বরের বয়ঃক্রম ২৭ বৎসর কন্যার বয়ঃক্রম ১৩ বৎসর। এই বিবাহ উপলক্ষে দেশ-বিদেশ হইতে বহুসংখ্যক ভদ্রলোক ও ব্রাহ্মণপণ্ডিত উপস্থিত হইয়াছিলেন।”

 স্বর্ণকুমারী দেবী বাংলা, সংস্কৃত এবং ইংরেজী ভাষায় বুৎপন্ন হন। অল্প বয়সেই তিনি সাহিত্যচর্চা আরম্ভ করেন। তিনি ‘ভারতী’ সম্পাদনা করেন ১২৯১ হইতে ১৩০১ সাল এবং ১৩১৫ হইতে ১৩২১ সাল পর্যন্ত। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রবন্ধ প্রভৃতি রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। স্বর্ণকুমারীর সাহিত্য-সাধনার বিষয়ে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘স্বর্ণকুমারী দেবী, মীর মশারফ হোসেন’ পুস্তকখানি পঠিতব্য।

 স্বামী জানকীনাথের সঙ্গে স্বর্ণকুমারীও থিয়সফিতে বিশ্বাসী হন। বঙ্গদেশীয় থিয়সফিক্যাল সোসাইটির মহিলা শাখার সভাপতি ছিলেন স্বর্ণকুমারী। এই সূত্রে তিনি বহু সম্ভ্রান্ত মহিলার সংস্পর্শে আসেন। সোসাইটির মহিলা শাখা উঠিয়া গেলে এই সকল নারী সভ্যদের লইয়া তিনি ‘সখি-সমিতি’ গঠন করেন। এবিষয়ে যথাস্থানে বলা হইবে। তিনি আমৃত্যু কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর ‘বিধবা শিল্পাশ্রমে’র সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে এই শিল্পাশ্রমকে তাঁহার রচিত যাবতীয় পুস্তকের স্বত্ব দান করেন।

 কংগ্রেসের সহিত জানকীনাথের ঘনিষ্ঠ যোগের কথা বলা হইয়াছে। স্বর্ণকুমারী কংগ্রেসী রাজনীতির চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৯০ সনে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের কলিকাতা অধিবেশনে তিনি প্রতিনিধিরূপে যোগ দিয়াছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় স্বর্ণকুমারী জাতীয় সঙ্গীত রচনা দ্বারা দেশবাসীকে স্বদেশীমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন।

 স্বর্ণকুমারী বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনীর কলিকাতা অধিবেশনে (১৯২৮) সভাপতিত্ব করেন। তিনি শ্রেষ্ঠ লেখিকারূপে ১৯২৭ সনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। ১৯৩২, ৩ জুলাই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।


 ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায় (১৮৬০-১৯২৭): হিরন্ময়ী দেবীর স্বামী। ফণিভূষণের পিতার নাম অঘোরনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৮৬০, নবেম্বর মাসে যশোহরের জয়দিয়া গ্রামে তাঁহার জন্ম হয়। ফণিভূষণ পিতৃব্য পরেশনাথ মুখোপাধ্যায়ের ঢাকা বাসাবাটীতে থাকিয়া পড়াশুনা করেন। পরেশনাথ ছিলেন জানকীনাথ ঘোষালের ভগিনীপতি। পাঠ্যাবস্থাতেই ফণিভূষণ পিতৃব্যের সহিত কলিকাতাস্থ ঘোষাল-ভবনে যাইতেন। ক্রমে এই পরিবারের সঙ্গে ফণিভূষণের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। ফণিভূষণ গিলক্রাইস্ট বৃত্তি লইয়া ১৮৭৮ সনে বিলাত গমন করেন। তিনি ১৮৮১ সনে লণ্ডন ইউনিভার্সিটি হইতে বি-এস্‌সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উদ্ভিদবিদ্যা ও দর্শনে তিনি অনার্স পান, এবং রসায়নে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ফণিভূষণ ১৮৮৩, জুলাই মাসে সরকারী শিক্ষা বিভাগে কার্যে নিযুক্ত হন এবং রাজশাহী কলেজে অধ্যাপক হইয়া যান। হিরন্ময়ী দেবীর সঙ্গে ফণিভূষণের এই সময় বিবাহ হয়। রাজসাহী কলেজ, হুগলী কলেজ এবং প্রেসিডেন্সী কলেজে পর পর অধ্যাপনা করিয়া পরে তিনি প্রেসিডেন্সী বিভাগে ইন্‌স্‌পেক্টর পদে বৃত হন। তিনি এই পদে কার্য করিতে করিতে সরকারী কর্ম হইতে ১৯১৫ সনে অবসর গ্রহণ করেন। ইহার পর ফণিভূষণ ১৯১৭ সন হইতে তিন বৎসর যাবৎ ইন্দোর স্টেটে ডি-পি-আই বা ‘শিক্ষা-অধিকর্তা’র কার্য করেন। ১৯২৭ ১৪ই ডিসেম্বর তিনি মারা যান। ফণিভূষণ বিজ্ঞানে অধ্যাপনা কালে সাহিত্য-সাধনাও করিয়া গিয়াছেন। ‘ভারতী’ মাসিকে বিজ্ঞানবিষয়ক তাঁহার বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে। ‘উচ্চশিক্ষা সুহৃদ’ ও ‘নিশ্চশিক্ষা সুহৃদ’ নামে দুইখানি শিক্ষাবিজ্ঞান সংক্রান্ত পুস্তকও তিনি লিখিয়াছেন। পত্নী হিরন্ময়ী দেবীর সর্ববিধ জনহিতকর কার্যে তিনি সহায় ছিলেন।


 দিদি: হিরন্ময়ী দেবী (১৮৬৮-১৯২৫)। হিরন্ময়ী দেবী সম্বন্ধে পুস্তকে নানা স্থানে উল্লেখ আছে। ‘হিরন্ময়ী’ শিরোনামার একটি অধ্যায়ও ইহাতে সংযোজিত হইয়াছে। হিরন্ময়ীর মৃত্যুর পর সরলা দেবী তাঁহার সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এখানে তাঁহার জীবন-সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয়ের মাত্র উল্লেখ করিব। হিরন্ময়ী দেবী বেথুন কলেজের ছাত্রী ছিলেন এবং এখান হইতে ১৮৮২ সনে তিনি মাইনর পরীক্ষা পাস করেন। ‘বামাবোধিনী পএিকা’র (পৌষ ১২৮৮) সংবাদ-স্তম্ভে সংবাদটি এইরূপ বাহির হয়:

 “এবার মাইনর পরীক্ষায় বেথুন স্কুলের ছাত্রী কুমারী শৈলবালা দাস এবং হিরন্ময়ী দেবী ২য় বিভাগে এবং কুমারী গিরিবালা মজুমদার ৩য় বিভাগে উত্তীর্ণ হইয়াছেন।”

 হিরন্ময়ীর স্কুলের শিক্ষা হয়ত আর অধিক দূর অগ্রসর হয় নাই, তবে তিনি যে প্রায় এই সময় হইতেই বাংলা গদ্যপদ্য রচনায় হস্তক্ষেপ করেন, ‘সখা’ পাঠে তাহা জানা যাইতেছে। ‘সখা’, ‘বালক’, ‘ভারতী ও বালক’ এবং ‘ভারতী’তে ক্রমশঃ তাঁহার গদ্যপদ্য রচনা প্রকাশিত হইতে থাকে। তিনি সরলা দেবীর সঙ্গে একযোগে ১৩০২ হইতে ১৩০৪ সাল পর্যন্ত ‘ভারতী’ সম্পাদনা করেন। স্বদেশী আন্দোলন কালে নারীজাতিকে দেশসেবায় অনুপ্রাণিত করিবার উদ্দেশ্যে হিরন্ময়ী লেখনী পরিচালনা করেন। এই সময় তাঁহার কতকগুলি দেশপ্রেমোদ্দীপক রচনা ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হয়।

 হিরন্ময়ী দেবী ১৯০৬ সনে ‘বিধবা শিল্পাশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই শিল্পাশ্রমের কার্যে তিনি নিজেকে সঁপিয়া দিয়াছিলেন। যথাস্থানে এ বিষয়টি সম্বন্ধে উল্লিখিত হইবে।

 ১৯২৫, ১৩ই জলাই হিরন্ময়ী দেবীর দেহান্ত ঘটে। তাঁহার মাতাপিতার প্রতি ভক্তি ছিল অসামান্য।


 দাদা: জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল। জন্ম ১৮৭১ সন। তিনি আই-সি-এস হইয়া বোম্বাইয়ে স্থিত হন। ১৯৩০ সনে অবসর গ্রহণ করেন।

॥ দুই ॥

 বিষ্ণু: বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী (১৮০৪-১৯০০)। রাজা রামমোহন রায়ের সময় হইতে বিষ্ণুচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজের গায়ক ছিলেন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসর একক্রমে গায়কের কার্য করিয়া ১৮৮৩ সনে বিষ্ণু অবসর গ্রহণ করেন। অবসর-গ্রহণ কালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ (ফাল্গুন ১৮০৪ শক) লেখেন:

 “পঞ্চাশ বৎসর অতীত হইল মহাত্মা রামমোহন রায়ের সময় হইতে শ্রীযুক্ত বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী আদি ব্রাহ্মসমাজে অতি নিপুণতার সহিত সঙ্গীত করিয়া আসিয়াছেন। তিনি এক্ষণে বার্ধক্য নিবন্ধন অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। অতঃপর এইরূপ মধুর কণ্ঠে ব্রহ্মসঙ্গীত আর শুনিতে পাইবেন কিনা সন্দেহ। যাঁহারা শ্রদ্ধান্বিত হইয়া উপাসনায় যোগ দিয়া আসিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে প্রায় এমন কেহই নাই বিষ্ণুর মধুর সঙ্গীতে যাঁহার অশ্রুপাত না হইয়াছে। বহু দিনের পর ব্রাহ্মসমাজে আমাদের একটি অভাব উপস্থিত হইল। পুরণ হইবে কিনা ঈশ্বর জানেন।...”

 বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী ১৯০০ সনের ৫ই মে দেহত্যাগ করেন। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় (জ্যৈষ্ঠ ১৮২২ শক) তাঁহার মৃত্যু-সংবাদ এইরূপ প্রকাশিত হয়:

 “সংবাদ। আমরা শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে প্রকাশ করিতেছি আদি-ব্রাহ্মসমাজের সুপ্রসিদ্ধ গায়ক বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী ২২ বৈশাখ ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছেন। ইঁহার বয়ঃক্রম ৯৬ বৎসর হইয়াছিল। মহাত্মা রামমোহন রায়ের সময় হইতে ইনি ব্রাহ্মসমাজে সঙ্গীত করিতেন। ইঁহার সুকণ্ঠ তান মান রাগ রাগিণী রক্ষা করিয়া ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতে আর কেহই রহিলেন না। ঈশ্বর ইঁহার অমর আত্মার কল্যাণ সাধন করুন।”

॥ তিন ॥

 সেজ মামা: হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৫-১৮৮৪)। হেমেন্দ্রনাথ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র। ঠাকুর-পরিবারে অন্তঃপুরে স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ উদ্যোগী। হেমেন্দ্রনাথ স্বয়ং পরিবারস্থ মহিলাদিগকে সাহিত্যাদি বিষয় সাগ্রহে পড়াইতেন। ঠাকুরবাড়ির বধূ ও কন্যাদের স্মৃতিকথা হইতে এ বিষয় কিছু কিছু জানা যায়। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বলেন:

 বিয়ের পর মেজ দেয়র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইচ্ছে করে আমাদের পড়াতেন। আমরা মাথায় কাপড় দিয়ে তাঁর কাছে বসতুম আর এক এক বার ধমকে দিলে চমকে উঠতুম। আমার যা কিছু বাংলা শিক্ষা সেজঠাকুরপোর কাছে পড়ে। মাইকেল প্রভৃতি শক্ত বাংলা পড়াতেন, আমার খুব ভাল লাগত।”

 স্বর্ণকুমারী দেবী লিখিয়াছেন:

 “এক্ষণে সেজদাদা মহাশয় তাঁহার পত্নীকে ওস্তাদের নিকট গান শিক্ষা দিতে লাগিলেন। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গানবাজনা লেখাপড়া সবরকমে বেশ ভাল করিয়া শিক্ষা পাইতে লাগিল। দিদিরা পর্যন্ত ঘরে থাকিয়া ইংরেজী শিখতে আরম্ভ করিলেন।”

 হেমেন্দ্রনাথের পুত্রকন্যাদের মধ্যে প্রতিভা দেবীর কথা পুস্তকে একাধিকবার উল্লিখিত হইয়াছে। তাঁহার সম্বন্ধে নিদিষ্ট স্থলে বলা যাইবে।


॥ চার ॥

 বেথুন স্কুল: জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ১৮৪৯, ৭ই মে এদেশীয়দের সহায়তায় কলিকাতায় এই বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয়টির সঙ্গে বালীগঞ্জের ‘বঙ্গমহিলা বিদ্যালয়’ ১৮৭৮ সনের আগষ্ট মাসে সম্মিলিত হয়। এ বৎসরে এই কুল হইতে কাদম্বিনী বসু (পরে, গাঙ্গুলী) সর্বপ্রথম কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। ইহার পর এখানে কলেজ বিভাগ খোলা হয়। ১৮৮৮ সনে ইহা একটি পুরাপুরি প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত হইল। নূতন নিয়ম প্রবর্তনের পূর্বাবধি এখান হইতে মহিলারা এম-এ পরীক্ষাও দিতেন। প্রথম এম-এ উত্তীর্ণা মহিলা—চন্দ্রমুখী বসু। এই স্কুল ও কলেজের আনুপূর্বিক ইতিহস ‘Bethune College School and College Centenary Volume’ পুস্তকে শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র বাগল লিখিত ইতিহাস অধ্যায়ে পাওয়া যাইবে।

 সরলা দেবীকে বেথুন স্কুলে ১৮৮০ সনে নিম্ন শ্রেণীতে ভর্তি করিয়া দেওয়া হয়। এখান হইতে ১৮৮৬ সনে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি বিএ পাস করেন ১৮৯০ সনে। বি-এ পরীক্ষোত্তীর্ণ মহিলাদের মধ্যে সর্বাধিক নম্বর পাইয়া তিনি এই সনে সর্বপ্রথম ‘পদ্মাবতী মেডাল’ প্রাপ্ত হন। এই মেডাল বা পদকটি মাত্র পদ্মাবতীর নামে দিবার জন্য ডক্টর রাসবিহারী ঘোষ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে থোক টাকা দান করিয়াছিলেন। বেথুন কলেজের সঙ্গে সরলা দেবীর সামাজিক মেলামেশার কথা পুস্তকে বর্ণিত হইয়াছে।


 লজ্জাবতী বসু (? ১৮৭০-১৯৪২) ও রাজনারায়ণ বসুর কনিষ্ঠা কন্যা। আজীবন কুমারী ছিলেন। সাহিত্য-সেবা করিয়া তিনি সুনাম অর্জন করেন। তাঁহার কবিতা বিভিন্ন মাসিক পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল। তিনি ১৯৪২, ২৯শে আগস্ট বাহাত্তর বৎসর বয়সে যোগ করেন।


 দুর্গামোহন দাস: কনিষ্ঠা কন্যা শৈল বা খুসী। দুর্গামোহন দাস (? ১৮৪০—১৮৯৭) সেযুগের অন্যতম প্রসিদ্ধ ব্রহ্মনেতা। তিনি প্রথমে বরিশালে এবং পরে হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় করিয়া প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। উপার্জিত অর্থের একটি প্রধান অংশ তিনি জনহিতে ব্যয় করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে তিনি ছিলেন বিশেষ উৎসাহী। ব্রাহ্মবিবাহ আইন বিধিবদ্ধ করার প্রয়াসে তিনি কেশবচন্দ্র সেনের প্রধান সহযোগী ছিলেন। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠায় যাঁহারা অগ্রণী ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে দুর্গামোহন অন্যতম। স্ত্রীজাতির উন্নতি ও শিক্ষা বিষয়ে তাঁহার সহায়তা ও কৃতিত্ব ভুলিবার নয়। কলিকাতার হিন্দু-মহিলা বিদ্যালয় এবং পরে বঙ্গ-মহিলা বিদ্যালয় স্থাপনে তিনি সবিশেষ উদ্যোগী হন। প্রধানতঃ তাঁহারই অর্থ সাহায্যে পর পর প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয় দুইটি পরিচালিত হইত। পরে বেথুন স্কুল ও কলেজ পরিচালনায়ও তিনি সহযোগিতা করেন।

 দুর্গামোহনের তিন কন্যা—সরলা, অবলা এবং শৈলবালা। শৈলবালা হিরন্ময়ী দেবীর সঙ্গে একই বৎসরে—১৮৮২ সনে বেথুন স্কুল হইতে মাইনর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলিকাতার বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাঃ ডি. এন. রায়ের সঙ্গে শৈলবালার বিবাহ হয়।


 শিবনাথ শাস্ত্রী: কন্যা হেমলতা। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীও (১৮৪৭-১৯১৮) অন্যতম ব্রাহ্ম নেতা। তিনি কবি, সাহিত্যিক, সংবাদপত্রসেবী এবং বিবিধ জনহিতমূলক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগী সদস্য।

 তাঁহার জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতা দেবী (১৮৬৮-১৯৪৩)। হেমলতা বঙ্গমহিলা বিদ্যালয়ে এবং বেথুন স্কুলে শিক্ষালাভ করেন। বেথুন কলেজ হইতে বি-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ডাঃ বিপিনবিহারী সরকারের সঙ্গে তাঁহার বিবাহ হয় (১৮৯৩) হেমলতা আজীবন শিক্ষাব্রতী ছিলেন। প্রধানতঃ তাঁহারই উদ্যোগে স্থাপিত দার্জিলিং মহারাণী বালিকা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষা ছিলেন ত্রিশ বৎসর যাবৎ। তিনি কয়েকখানি স্কুলপাঠ্য ও শিশুপাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন করেন। তাঁহার ‘মিবার গৌরব কথা’, ‘নেপালে বঙ্গনারী’, ‘পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর জীবনচরিত’ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁহার ‘তিব্বতে তিন বৎসর’ ধারাবাহিকভাবে ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত হয়।


॥ পাঁচ ॥

 কাশিয়াবাগান: সরলা দেবী এই পুস্তকে ‘কাশিয়াবাগানে’র কথা উল্লেখ করিয়াছেন। পিতামাতার সঙ্গে তিনি বাল্যকালে এখানকার বাগানবাড়িতে কয়েক বৎসর বাস করেন। ‘কাশিয়াাগানে’র কথা তাঁহার জীবনে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করিয়া আছে। ‘কাশিয়াবাগান’ অঞ্চল কলকাতাস্থ বর্তমান রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট এবং উল্টাডিঙ্গি মেন রোডের মোড় বরাবর অনেকটা জায়গা জুড়িয়া ছিল। এই নামটির উৎপওি সম্বন্ধে এ অঞ্চলের প্রাচীন ব্যক্তিদের নিকট হইতে এইরূপ শুনিয়াছি:

 ‘কাশিয়াবাগান’ উল্টাডিঙ্গি খালের সন্নিকট। এই স্থানটি পূর্বে একটি ব্যবসায়কেন্দ্র ছিল। পূর্ববঙ্গ হইতে বড় বড় নৌকাবোঝাই হইয়া ‘বালাম’ চাউল ও অনান্য কাঁচা মাল এখানে আমদানী হইত। আবার এখান হইতে ঐসব নৌকায় মালপত্র পূর্ববঙ্গে চালান যাইত। এসকল নৌকা নঙ্গর করবার জন্য লম্বা মোটা দড়ি দরকার হইত। ইহাকে ‘কাছি’ বলে। উল্টাডিঙ্গির এই অঞ্চলে ‘কাছি’ তৈরী হইত প্রচুর। আর এ সমুদয় নানা দিকে চালান করা হইত। বিস্তর কাছি তৈরী হইত বলিয়া কাছির বাগান বলা হইত। এই কাছির বাগান হইতেই ‘কাশিয়াবাগান’ নামটির উৎপত্তি।


 মেজমামা: সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যম পুত্র। ভারতবর্ষের প্রথম আই-সি-এস বলিয়া তিনি পরবর্তী কালে প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। কিন্তু অন্য নানা গুণেও তিনি ভূষিত ছিলেন। মহর্ষির শিক্ষায় ও তত্ত্বাবধানে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের ধর্মপ্রবণতা এবং সাজাত্যবোধ তাঁহার মধ্যেও বিশেষভাবে অনুপ্রবিষ্ট হয়। হিন্দু মেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে (১৮৬৮) গীত—“মিলে সবে ভারত সন্তান, এক মন এক প্রাণ, গাও ভারতের যশোগান” —তাঁহারই রচনা। অন্যতম জাতীয় সঙ্গীত-রূপে ইহার খুবই প্রসিদ্ধি। সত্যেন্দ্রনাথ বোম্বাই প্রদেশে সিবিলিয়ানী কর্মে নিযুক্ত ছিলেন। একারণ বোম্বাই ও গুজরাট অঞ্চলে ঠাকুর পরিবার এবং ঠাকুর পরিবারের নিকট-আত্মীয়দের বারবার যাতায়াত ও ঐ অঞ্চলবাসীদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোেগ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী—ইঁহারাও বহু বার ঐ প্রদেশে গিয়া সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে বসবাস করেন। সরলা দেবীর আত্মকথা এবং অন্যান্য রচনা হইতে ঐ অঞ্চল ও অঞ্চলবাসীদের সম্বন্ধে অনেক কথা জানা যায়।

 সত্যেন্দ্রনাথ স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রীস্বাধীনতা এবং স্ত্রীজাতির সর্বপ্রকার উন্নতির পক্ষপাতী ছিলেন। পত্নী জ্ঞানদানন্দিনীকে যুগোপযোগী পূর্ব-সংস্কার বর্জিত উন্নতিমূলক কার্য সম্পাদনে এবং নূতন আচার-অনুষ্ঠান প্রবর্তনে বিশেষ উৎসাহ দান করিতেন। তিনি পুত্র ও কন্যাকে প্রচলিত রীতি না মানিয়া মেম ও পাদ্রীদের স্কুলে পড়িতে দেন। সত্যেন্দ্রনাথ ১৮৯৬ সনে সরকারী কর্ম হইতে অবসর গ্রহণ করেন। ১৮৯৭ সনে রাজশাহীর নাটোরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি সভাপতি হন। সত্যেন্দ্রনাথ সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যেরও সেবা করিয়া গিয়াছেন। সাময়িক পত্রাদিতেও তাঁহার বহু রচনা প্রকাশিত হয়। সতেন্দ্রনাথ লিখিত ‘আমার বাল্যকথা ও আমার বোম্বাই প্রবাস’ পুস্তকখানি বাংলা সাহিত্যের একটি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ।


 সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭২-১৯৪০): সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র পুত্র। প্রথম দিক্‌কার বিপ্লব আন্দোলনের সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথের নানাভাবে যোগসাধন হয়। তিনি কলিকাতার সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজ হইতে ১৮৯৩ সনে বি-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বঙ্গদেশে সমবায় জীবনবীমা ও ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠরূপে যুক্ত ছিলেন। হিন্দুস্থান লাইফ এস্যুরেন্স কোম্পানীর তিনি ছিলেন অন্যতম কর্ণধার। রবীন্দ্র-সাহিত্যের সহিত তাঁহার পরিচয় অত্যন্ত নিবিড়।


 বিবি: ইন্দিরা দেবী (১৮৭৩) সত্যেন্দ্রনাথের একমাত্র কন্যা। তিনিও উচ্চ শিক্ষিতা। ‘লরেটো হাউস’ হইতে তিনি এণ্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। পরে, গৃহে বসিয়া শিক্ষালাভ করেন এবং বি-এ পরীক্ষায় উওীর্ণ হন। প্রমথ চৌধুরীর (‘বীরবল’) সঙ্গে তাঁহার বিবাহ হয়। ইন্দিরা দেবী রবীন্দ্রসঙ্গীতে পারদর্শিনী। বাংলা সাহিত্যের সেবায়ও তিনি তৎপর। ‘ভারতী’ ও অন্যান্য পত্রপত্রিকায় তাঁহার বহু রচনা প্রকাশিত হইয়াছে। তিনি সাময়িকভাবে বিশ্বভারতী ইউনির্ভাসিটির ‘উপাচার্য’ পদে বৃত হইয়াছিলেন।


 ইলবার্ট বিল: বড়লাট লর্ড রিপনের সময়ে তাঁহার পরিষদ আইন-সদস্য সার্ কোর্টনে ইলবার্ট এই বিলটি ১৮৮৩ সনে ব্যবস্থা পরিষদের বিবেচনার জন্য উপস্থাপিত করেন বলিয়া ‘ইলবার্ট বিল’ নামকরণ হইয়াছে। এই বিলটির মর্ম ছিল এই যে, ইউরোপীয় ও দেশীয় সিবিলিয়ন কর্মচারী ইউরোগীয় অপরাধীদের বিচারে সম-অধিকারসম্পন্ন হইবেন। বড়লাট লর্ড রিপন বিলটির সপক্ষে ছিলেন। এই বিলের ঘোর বিরোধিতা করেন ভারতবর্ষস্থিত ইউরোপীয় সম্প্রদায়। বলা বাহল্য, ভারতবাসীরা সর্বান্তঃকরণে বিলটি সমর্থন করেন। এই সময় হইতে ভারতবাসীদের মধ্যে যে আন্দোলন উপস্থিত হয় তা নাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মূলে কম রসদ জোগায় নাই।


 কামিনী দিদি: কবি কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩) সে যুগের বিখ্যাত সাহিত্যিক চণ্ডীচরণ সেনের কন্যা এবং স্ট্যাটুটারি সিবিলিয়ান কেদারনাথ রায়ের পত্নী। সরলা দেবী ১৮৮০, জানুয়ারী মাসে বেথুন কলেজে ভর্তি হন। এই সনে কামিনী সেন এণ্ট্রান্স পরীক্ষা প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সংস্কৃতে দ্বিতীয় শ্রেণীর অনার্স সহ এই স্কুলের কলেজ-বিভাগ হইতে বি-এ ডিগ্রী লাভ করেন। ইলবার্ট বিল আন্দোলন ও সুরেন্দ্রনাথের কারাবরণের সময় কামিনী সেন স্বতঃই বেথুন বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নেতৃস্থানীয় হইয়াছিলেন। কলেজ শিক্ষা সমাপন করিয়া তিনি প্রথমে বেথুন স্কুল এবং পরে কলেজ-বিভাগে শিক্ষয়িত্রীর কর্মে বিবাহের (১৮৯৪) পূর্ব পর্যন্ত লিপ্ত ছিলেন। তিনি বহু কবিতা-পুস্তক রচনা করিয়াছেন। তাঁহার ‘আলো ও ছায়া’ একখানি প্রথম শ্রেণীর কাব্যগ্রন্থ।

 অবলা দিদি: লেডী অবলা বসু (১৮৬৫-১৯৫১) প্রথিতযশ্য আইন-ব্যবসায়ী ও ব্রাহ্মসমাজকর্মী দুর্গামোহন দাসের মধ্যমা কন্যা এবং আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সহধর্মিণী। তিনি পূর্বে বঙ্গমহিলা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। বেথুন স্কুল হইতে ১৮৮২ সনে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তখন কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রী গ্রহণের রেওয়াজ না থাকায় তিনি মাদ্রাজে গিয়া তথাকার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। বাংলা সরকার মাসিক কুড়ি টাকার একটি বিশেষ বৃত্তি তাহাকে দিয়াছিলেন। ১৮৮৫ সনে তিনি প্রথম এল-এম-এফ পরীক্ষা পাস করেন। কিন্তু অসুস্থ হইয়া পড়ায় তাঁহাকে মাদ্রাজ ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আসিতে হয়। ইহার পর আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁহার বিবাহ হয়।

 জগদীশচন্দ্রের জীবনসঙ্গিনীরপে তাঁহার বিজ্ঞান-সাধনায় তিনি সর্বপ্রকারে সহায় হইয়াছিলেন। তিনি ভগিনী নিবেদিতার ঘনিষ্ঠ সংস্রবে আসেন। শ্রীরামকৃষ্ণ-সহধর্মিণী সারদামণি দেবীর নিকট হইতেও তিনি বিশেষ অনুপ্রেরণা লাভ করেন। লেডী বসু নারীজাতির উন্নতিমূলক কর্মে উদ্বুদ্ধ হইয়া ১৯১৯ সনে নারীশিক্ষা সমিতি স্থাপন করেন। শিল্পভবন ও বাণীভবন দুইটি বিভাগের মাধ্যমে তিনি বালবিধবা ও দুর্গতা নারীদের সাধারণ বিদ্যা ও শিল্পবিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। আমত্যু তিনি ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের সম্পাদিকার পদে অধিষ্ঠিত থাকিয়া ইহাকে ক্রমোন্নতির পথে লইয়া যান। তিনি স্বামীর সঙ্গে বহুবার পাশ্চাত্ত্য দেশসমূহ পরিভ্রমণ করেন। বেথুন স্কুলে ছাত্রী থাকাকালীন অবলা নিম্নশ্রেণীর ছাত্রীদের অন্যতম নেতারূপে গণ‍্য হন। তখনই জাতীয়তামূলক কার্যে তৎপর হইয়া অল্পবয়স্কাদের আদর্শস্থল হইয়াছিলেন। লেডী বসু সুলেখিকা। তাঁহার কয়েকটি রচনা ‘প্রবাসী’ ও ‘মুকুলে’ বাহির হইয়াছে।

 মোহিনী দেবী (?—১৯৫৫) গত শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রামশংকর সেনের কন্যা। রামশংকর স্বদেশের বিবিধ জনহিতকর কার্যে, বিশেষতঃ স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে, অতিশয় তৎপর ছিলেন। মোহিনী দেবী স্বদেশসেবার প্রেরণা বাল্যে পিতার নিকট হইতেই প্রাপ্ত হন। তাঁহার স্বামী ছিলেন রায় বাহাদুর তারকচন্দ্র দাস। বৈধব্য-দশায়, প্রায় ষাট বৎসর বয়সে, মোহিনী দেবী অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৩০ সনে সত্যাগ্রহ আন্দোলনেও তিনি যোগ দিয়াছিলেন। এই সময় তিনি নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সহকারী সভাপতি হন এবং আইন অমান্য করিয়া কারাবরণ করেন। স্বাধীনতা লাভের পরেও তিনি স্বদেশের সর্ববিধ কল্যাণকর্মে উৎসাহ দান করিতেন।

 ভারতী: শ্রাবণ ১২৮৪ (ইং ১৪৭৭) হইতে ‘ভারতী’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংকল্প অনুযায়ী প্রকাশিত হয়। ইহার উদ্দেশ্য প্রথম সংখ্যায়ই এইরপ বর্ণিত হইয়াছেঃ

 ‘‘ভারতীর উদ্দেশ্য যে কি তাহা তাঁহার নামেই সপ্রকাশ। ভারতীর এক অর্থ বাণী, আর এক অর্থ বিদ্যা, আর এক অর্থ ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। বাণীস্থলে স্বদেশীয় ভাষার আলোচনাই আমাদের উদ্দেশ্য। বিদ্যাস্থলে বক্তব্য এই যে, বিদ্যার দুই অঙ্গ, জ্ঞানোপার্জন এবং ভাবস্ফূর্তি। উভয়েরই সাধ্যানুসারে সহায়তা করা আমাদের উদ্দেশ্য। স্বদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাস্থলে বক্তব্য এই যে, জ্ঞানালোচনার সময় আমরা স্বদেশ-বিদেশ নিরপেক্ষ হইয়া যেখান হইতে যে জ্ঞান পাওয়া যায়, তাহাই নত মস্তকে গ্রহণ করিব। কিন্তু ভালোচনার সময় আমরা স্বদেশীয় ভাবকেই বিশেষ স্নেহ দৃষ্টিতে দেখিব।”

 ‘ভারতী’ দীর্ঘকাল স্থায়ী হইয়াছিল। শ্রেষ্ঠ লেখকগণের রচনা দ্বারা ইহা সমৃদ্ধ হয়। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইহার প্রথম সম্পাদক। কার্যকালসহ বিভিন্ন সম্পাদকের নাম এখানে দেওয়া হইল:

সম্পাদক
কার্যকাল
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রাবণ ১২৪৪-১২৯০
স্বর্ণকুমারী দেবী
১২৯১-১৩০১
হিরন্ময়ী দেবী, সরলা দেবী
১৩০২-১৩০৪
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৩০৫
সরলা দেবী
১৩০৬-১৩১৪
স্বর্ণকুমারী দেবী
১৩১৫-১৩২১
মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়
১৩২২-১৩৩০
সরলা দেবী
১৩৩১-আশ্বিন ১৩৩৩


॥ ছয়॥

 সুধীদাদা: সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৯-১৯২৯) দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র। তিনি সুশিক্ষিত ও সুসাহিত্যিক। অগ্রহায়ণ ১২৯৮ হইতে ‘সাধনা' পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সুধীন্দ্রনাথ প্রথম তিন বৎসর ইহা সম্পাদনা করেন। চতুর্থ বৎসরে রবীন্দ্রনাথ ইহার সম্পূর্ণ ভার লন। রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন:

 “সাধনা পত্রিকার অধিকাংশ লেখা আমাকে লিখিতে হইত এবং অন্য লেখকগণের রচনাতেও আমার হাত ভূরি পমািণ ছিল।”

 সুধীন্দ্রনাথ আজীবন সাহিত্য-সাধনা করিয়া গিয়াছেন। অমায়িক ব্যবহারের জনা তিনি সকলের প্রিয় হইয়াছিলেন।


 বলু: বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭৫-১৮৯৯) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৪৫-১৯}} একমাত্র সন্তান। তিনি বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত। রবীন্দ্রনাথ বলেন্দ্রনাথকে লইয়া ১৮৯৯ সানে একটি স্বদেশী ভাণ্ডার খুলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ্, সম্প্রতি বলেন্দ্র-বচনাবলী প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার রচনার সাহিত্যিক মূল্য সর্বজনস্বীকৃত।


॥ আট॥

 মেজ মামী: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী (১৮৫২-১৯৭১)। মহর্ষির মধ্যম পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিণী। যশোহর জেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামে জ্ঞানদানন্দিনীর জন্ম হয়। তাঁহার পিতার নাম অভয়াচরণ মুখোপাধ্যায়। ১৮৫৯ সনে স্যন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁহার বিবাহ হয়। সত্যেন্দ্রনাথের শিক্ষা ও সহযোগিতায় জ্ঞানদানন্দিনী ক্রমে সু-শিক্ষা ও স্বাধীনতার পক্ষপাতী হইয়া উঠেন। ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরে বসিয়া তিনি বাংলা ও ইংরেজী ভাষা আয়ত্ত করেন। তিনি বাংলাদেশে কতকগুলি নতুন প্রথার সূচনা করেন, তন্মধ্যে দুইটি প্রধান: ১। জন্মদিন পালন এবং ২। নতন ধরনে শাড়ি পরা। শাড়ি পরার নতুন রীতি প্রবর্তন সম্পর্কে তিনি স্বামীর কর্মস্থল আমেদাবাদ হইতে একখানি পত্রে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা'য় আলোচনা করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের সেবায়ও তৎপর ছিলেন। 'ভারতী'তে বিভিন্ন সময়ে তাঁহার কয়েকটি রচনা প্রকাশিত হয়। বৈশাখ ১২৯২ হইতে এক বৎসর কাল তিনি 'বালক’ সম্পাদনা করেন। এখানি কিশোরপাঠ্য সচিত্র মাসিক পত্রিকা। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ছেলে-মেয়েদের বাংলা রচনায় উৎসাহ দানের নিমিত্তই ইহা মুখ্যতঃ প্রকাশিত হয়। সুরেন্দ্র-নাথ, শলেন্দ্রনাথ, হিরন্ময়ী দেবী, সরলা দেবী প্রমুখ বাড়ির বালক-বালিকাদের রচনা ইহাতে বিশেষভাবে স্থান পাইত। এক বৎসর চলিবার পর ‘বালক’ ‘ভারতীর' সঙ্গে মিলিত হয়। জ্ঞানদানন্দিনীর শিশুপাঠ্য দুইখানি পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছিল- ১। টাক ডুম্ ডুম্ ডুম্ (নাটিকা)—১৯১০ এবং ২। সাত-ভাই চম্পা (নাটিকা। ১৯১১।

 হেমপ্রভা বসু: ভগবানচন্দ্র বসুর কনিষ্ঠা কন্যা এবং আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর কনিষ্ঠা ভগিনী। তিনি বেথুন হোস্টেলে থাকিতেন, এবং সরলা দেবীর বন্ধুরূপে ছুটির দিনে তাহাদের বাড়িতে আসিতেন। হেমপ্রভা সরলা দেবীর দুই শ্রেণী নিম্নে পড়িতেন। তিনি ১৮৮৮ সনে এণ্ট্রান্স, ১৮৯০ সনে এফ-এ, ১৮৯৪ সনে বি-এ এবং ১৮৯৮ সনে এম-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি প্রথমে বেথুন স্কুলের শিক্ষয়িত্রী এবং পরে বেথুন কলেজের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। তিনি আজীবন কৌমার্যব্রত অবলম্বন করেন।

 ভগবানচন্দ্র বসু (? ১৮২৯-৯২): ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে রাড়িখাল গ্রামে ভগবানচন্দ্রের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন রামশংকর সেনের সতীর্থ এবং ঢাকা কলেজের উত্তীর্ণ ছাত্র। তিনি বেথুন সাহেবের দ্বারা স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ে বিশেষরূপে অনুপ্রাণিত হন। প্রথমে জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রপে তিনি সরকারী কার্যে লিপ্ত ছিলেন। তিনি মানব-দরদী ছিলেন, এবং এক প্রসিদ্ধ ডাকাতকে কারাবাস অন্তে নিজ গৃহে স্থান দিয়া এই মানবিকতার চরম দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেন। ইহার মুখে অসম-সাহসিকতার নানা গল্প শুনিয়া জগদীশচন্দ্র শৈশবে মুগ্ধ হইয়া যাইতেন। পরবর্তী কালের তাঁহার বেপরোয়া নির্ভীক মনোবৃত্তি কতটা এই ডাকাত-ভৃত্যের সঙ্গলাভের ফল, একথা তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন। ভগবানচন্দ্র সরকারী কর্ম ব্যতিরেকে স্বদেশের শিল্পোনতিকল্পে প্রচুর অর্থ ঢলিয়াছিলেন, কিন্তু ইহা লাভজনক না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাঁহাকে প্রায় সর্বস্বান্ত হইতে হয়।

 ভগবানচন্দ্রের পাঁচ কন্যা। জ্যেষ্ঠা কন্যা স্বর্ণপ্রভা বসু। তিনি গৃহে প্রথমে বাংলা ও পরে ইংরেজী ভাষা শিখিয়া উভয় সাহিত্যেই বুৎপন্ন হন। ১৮৬৮ সনে আনন্দমোহন বসুর সঙ্গে তাঁহার বিবাহ হয়। ১৮৬৯ সনে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিঠা-দিবসে যে দুইজন নারী কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হইয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে স্বর্ণপ্রভা একজন। তিনি স্ত্রী বিদ্যালয় পরিচালনা এবং অন্যান্য জনহিতকর কার্যে স্বামীর একান্ত সহায় ছিলেন। বর্ণপ্রভা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্গত বঙ্গ-মহিলাসমাজেরও প্রতিষ্ঠাতা।

 ভগবানচন্দ্রের অপর চারি কন্যা-স্বর্ণপ্রভা বসু, লাবণ্যপ্রভা বসু, হেমপ্রভা বসু, চারুপ্রভা বসু। স্বর্ণপ্রভা ১৮৮০ সনে বেথুন স্কুল হইতে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। তাঁহার বিবাহ হয় আনন্দমোহন বসুর অনুজ বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি মোহিনী মোহন বসুর সহিত। লাবণ্যপ্রভা দীর্ঘকাল সাহিত্যসেবা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার পুস্তকগুলি পাঠ্য এবং সাহিত্যপদবাচ্য। ১৯০৭ সনে ডাক্তার হেমচন্দ্র সরকারের সঙ্গে তিনি পরিণীতা হন। হেমপ্রভা চতুর্থ এবং চারুপ্রভা পঞ্চম কন্যা। উভয়েই উচ্চশিক্ষিতা, সেবাপরায়ণা এবং বিভিন্ন কর্মে রত ছিলেন।

 কুমুদিনী খাস্তগিরি (১৮৬৫-?): ডাঃ অন্নদাচরণ খাস্তগীরির কন্যা। বেথুন কলেজের কৃতী ছাত্রী, বি-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। ১৮৯১-৯৩ সনে বেথুন স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষয়িত্রী, ১৮৯৪ সনে প্রথম শিক্ষয়িত্রী এবং ১৮৯৫-৯৭ সনে বেথুন কলেজের তৃতীয় অধ্যাপকের কার্য করেন। ১৮৯৪ সনে কিছুকাল মহিশূরে মহারাণী গার্লস স্কুলে কর্মে লিপ্ত ছিলেন বলিয়া সরলা দেবী উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহার স্থলে তিনি সেখানে নিযুক্ত হইয়া যান। ১৮৯৭ সনে বিবাহের পর তিনি কুমদিনী দাস নামে পরিচিত হন। ক্রমে পদোন্নতি হইয়া ১৯০২ সনে তিনি বেথুন কলেজের অধ্যক্ষ হন। এই পদে তিনি ১৯১২ সনের মার্চ পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইহার পর তিনি ঢাকা বিভাগের সহকারী ইন্সপেক্‌ট্রেস্ অব স্কুল্‌স্ হইয়া যান। এখান হইতে ১৯১৮ সনের এপ্রিল মাসে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।


 নতুন মামা: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম পুত্র। দেবেন্দ্রনাথ-কেশবচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা কলেজ হইতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ১৮৬৪ সনে এণ্ট্রান্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন। বিখ্যাত রমেশচন্দ্র দত্ত এই বৎসর প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ খুল্লতাত পত্র গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কিছুকাল কলিকাতা গবনমেণ্ট আর্ট স্কুলে শিল্পবিদ্যা শিক্ষা করেন। ১৮৬৮ সনে কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে তিনি পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন। কাদম্বরী দেবী এই পুস্তকে ‘নূতন মামী' বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন।

 জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভা বিভিন্ন কর্মপ্রচেষ্টার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে। আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক রূপে (১৮৬৯-১৮৮৪} তিনি ইহার পরিচালন ও প্রচারে মন দেন। তিনি সঙ্গীতবিদ্যা-চর্চার বিশেষ আয়োজন করেন। প্রথমে কেশবচন্দ্রের স্ত্রী-স্বাধীনতার বিপক্ষ হইলেও তিনি পরে ইহার একান্ত সমর্থক হইয়া উঠেন, এবং নিজের পত্নীকে লইয়া প্রকাশ্য রাজবর্ত্মে স্বামি-স্ত্রী পাশাপাশি দুইটি ঘোড়ায় বসিয়া ছুটাইয়া চলিতেও দ্বিধা বোধ করেন নাই। এই স্বাধীনার মনোবৃত্তি তিনি রাজনীতি ও শিল্পোন্নতির মধ্যেও অনুপ্রবিষ্ট করান। তৎপ্রতিঠিত সঞ্জীবনী-সভা বাঙ্গালী যুবকদের মধ্যে বৈপ্লবিক মনোভাবের একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন। শিল্পোন্নয়ন প্রয়াসে তিনি নিজের বিস্তর ক্ষতি স্বীকার করিয়াও শিল্প-বাণিজ্য পরিচালনে অগ্রসর হইয়াছিলেন। 'বরিশাল স্টীমার কোম্পানী' জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এক অপূর্ব কীর্তি।

 বাংলা সাহিত্যের অনলস সাধনা, নাটক-অভিনয়ে উদ্যোগ আয়োজন, 'ভারতী' পরিচালনে ঐকান্তিকতা, মরাঠী ও ফরাসী গ্রন্থসহমূহ অনুবাদ দ্বারা বাংলা সাহিত্যের পুষ্টিসাধন, ভারত-সঙ্গীত-সমাজ প্রতিষ্ঠা (১৮৯৭) এবং সঙ্গীত-বিষয়ক 'বীণাবাদিনী’ ও 'সঙ্গীত-প্রকাশিকা' সম্পাদন প্রভৃতি তাঁহাকে অমর করিয়া রাখিয়াছে।

॥ নয়॥

 মাদাম ব্লাভাট্‌স্কি (১৮৩১-৯১)। বিখ্যাত থিয়সফিস্ট্ এবং থিরসফিক্যাল সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ব্লাভাট্‌স্কির পুরা নাম-হেলেনা পেট্রোভ্‌না ব্লাভাট্‌স্কি। ব্লাভাট্‌স্কি জাতিতে জার্মান; কিন্তু তাঁহার পূর্বপুরুষেরা রাশিয়ায় বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন। ষাট বৎসরের এক বৃদ্ধের সঙ্গে সত্তর বৎসর বয়সে তাঁহার বিবাহ হয়। অল্পদিন পরে উভয়ের মধ্যে বিবাহবিচেছদ ঘটে। ব্লাভাট্‌স্কি সাহসী ও তেজস্বিনী মহিলা। ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বহু বৎসর পরিভ্রমণ করেন এবং নানা বিপদ-আপদের সম্মুখীন হন। তিনি বহু কষ্টে কাশ্মীরের পথে তিব্বত যান। কথিত আছে, তিনি এক তিব্বতী সাধুর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। সমগ্র ভারতবর্ষ পরিক্রমার পর ব্লভাট্‌স্কি ১৮৭৩ সনে আমেরিকা গমন করেন। সেখানে অধ্যাত্মতত্ত্ববিদ্ কর্ণেল অলকটের সঙ্গে তাঁহার পরিচয় হয়। মার্কিন জাতিভুক্ত হইয়া ব্লভাট্‌স্কি একক্রমে ছয় বৎসর নিউ ইয়র্কে অবস্থান করেন। ব্লভাট্‌স্কি ও অলকট উভয়ে মিলিয়া ১৮৭৫ সনে থিয়সফিক্যাল সোসাইটি স্থাপন করেন। এই সোসাইটি কোন বিশেষ ধর্ম প্রচার না করিয়া সদস্যগণকে নিজ নিজ ধর্মে আস্থাবান হইবার জনা উপদেশ দিতেন। সোসাইটি বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভ্রাতৃভাবের উদ্রেকের নিমিত্ত যত্নপর হইলেন। এতদৃশ আদর্শের প্রতি বিভিন্ন দেশের সুধীগণ স্বতঃই আকৃষ্ট হন। মাদাম ব্লভাট্‌স্কি অলৌকিক শক্তি ও অবিশ্বাস্য কার্যকলাপের প্রচারে এদেশবাসীরাও তাহার প্রতি সবিশেষ আকৃষ্ট হন। তিনি কর্নেল অলকট-সহ ভারতবর্ষে আসিবার পর শিক্ষিত সাধারণ কর্তৃক সম্বর্ধিত হইলেন। শুনা যায়, তিব্বতী গুরু সূক্ষদেহে আসিয়া ব্লভাট্‌স্কির সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করিতেন। ভারতবর্ষে সোসাইটির কেন্দ্রস্থল প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি গুরু-কর্তৃক আদিষ্ট হইয়াছিলেন। মাদ্রাজের আডিয়ারে তখন থিয়সফিক্যাল সোসাইটির কেন্দ্র স্থাপিত হয়। সমগ্র জগতে সোসাইটির কেন্দ্রস্থল এই আডিয়ার। ব্লভাট্‌স্কির অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে অনেকেই ক্রমে সন্দিহান হইয়া উঠেন। সংবাদপত্রেও তখন ইহার সমালোচনা হয়। এই পুস্তকে থিয়সফিক্যাল সোসাইটি ভাঙনের কথা যে বলা হইয়াছে তাহা এ সময়কার ঘটনা। স্বর্ণকুমারী দেবী প্রমুখ সভ্রান্ত মহিলারা থিয়সফিক্যাল সোসাইটির সংস্রব ত্যাগ করেন। তিনি সোসাইটির সদস্য মহিলাদের লইয়া সখি-সমিতি স্থাপন করেন (১৮৮৬)। মাদাম ব্লভাট্‌স্কি ১৮৮৭ সনে ইংলণ্ডে চলিয়া যান। সেখান হইতে তিনি অধ্যাত্মবিদ্যা সম্পর্কীয় একখানি পত্রিকা সম্পাদনা করিতে থাকেন। অধ্যাত্মবিদা সন্ধে তাঁহার কয়েকখানি পুস্তকও রহিয়াছে। বিলাতে অবস্থানকালে তাঁহার নিকট এনি বেসাণ্ট থিয়সফি-মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ভারতবর্ষের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহোর প্রতি বিশ্ববাসীর আগ্রহের মূলে থিয়সফিক্যাল সোসাইটির কৃতিত্ব অসামান্য।


 কর্নেল অলকট: পুরো নাম কর্নেল এইচ. এস, অলকট। অলকট ছিলেন আমেরিকার অধিবাসী। তিনি মাদাম ব্লাভাট্‌স্কির সঙ্গে ভারতবর্ষে আগমনান্তর বরাবর এদেশেই বাস করেন। তিনি থিয়সফিস্ট সোসাইটিকে দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপনমানসে সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়াছিলেন। অলকট সোসাইটি-কর্তৃক প্রকাশিত 'থিয়সফিস্ট' পত্রিকা যোগ্যতার সহিত সম্পাদনা করিয়া গিয়াছেন। তিনি নিজে ছিলেন বৌদ্ধ- ধর্মাবলম্বী, তথাপি হিন্দুধর্মের মূল তত্ত্ব যাহাতে সর্বসাধারণের হৃদয়ঙ্গম হয় সেজন্য নানাভাবে যত্ন লইয়াছিলেন। থিয়সফিক্যাল সোসাইটির গ্রন্থন-বিভাগ ভারতীয় ধর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রচারে সবিশেষ তৎপর হয়। কর্নেল অলকটও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দেখাইতে পারিতেন। অলকট কিছুকাল পর্যন্ত থিয়সফিক্যাল সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। ১৯০৭ সনে তাঁহার মত্যু হয়।

 সখিসমিতি: মহিলা থিয়সফিস্ট সভা ভাঙিয়া গেলে সভানেত্রী স্বর্ণকুমারী দেবী ইহার সভ্রান্ত মহিলা সদসাদের লইয়া ১৮৮৬ সনে ‘সখিসমিতি' স্থাপন করেন। এই নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। প্রতিষ্ঠার দুই বৎসর পরে প্রকাশিত সখিসমিতির একটি বিবরণীতে ইহার উদ্দেশ্য এইরুপ বিবৃত হইয়াছে:

 “অসহায় বঙ্গবিধবা ও অনাথা বঙ্গকন্যাগণকে সাহায্য করা এই সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য।

 “আবশ্যক অনুসারে দুই উপায়ে এই সাহায্য দান হইবে। বিধবাই হউন আর কুমারীই হউন, যিনি নিরাশ্রিত, যাঁহার কেহ নাই, বা যাঁহার অভিভাবকেরা নিতান্ত সঙ্গতিহীন তাঁহাদের অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে সখিসমিতি কোন কোন স্থলে তাহাদের ভার লইতে প্রস্তুত, কোন কোন স্থলে সাধ্যানুসারে অর্থ সাহায্য করিতে প্রস্তুত।

 “ষে সকল অল্পবয়স্ক অনাথা বিধবা বা কুমারীগণের ভার সখিমমিতি গ্রহণ করিবে, তাহাদিগকে সুশিক্ষিত করিয়া তাঁহাদের দ্বারা স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার করা সখি-সমিতির দ্বিতীয় উদ্দেশ্য। শিক্ষিত হইয়া যখন এই বালিকাগণ অন্তঃপুরের শিক্ষা-দান কার্যে নিযুক্ত হইবেন, তখন সমিতি ইহাদিগকে বেতন দান করিবে। ইহা দ্বারা দুইটি কাজ একসঙ্গে সাধিত হইবে। অনাথা ও বিধবা বঙ্গকন্যাগণ হিন্দু, ধর্মানুমোদিত পরোপকার কার্যে জীবন দিয়া সুখে স্বচ্ছন্দে জীবিকা নির্বাহ করতে পারিবেন, আর দেশে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের একটি প্রকৃত পথ মুক্ত হইবে।”

('ভারতী ও বালক',পৌষ, ১২৯৫)।

সখিসমিতির উদ্যোগে একাধিকবার মহিলা শিল্পমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সখি-সমিতি বহু বৎসর জীবিত থাকিয়া সমাজসেবায়, বিশেষতঃ নারীজাতির হিতকর্মে রত থাকে।


 মহিলা শিল্পমেলা: সরলা দেবী যে শিপ সংগ্রহপূর্বক মেলানুষ্ঠানের কথা বলিয়াছেন তাহাই এই 'মহিলা শিল্পমেলা'। এই ধরনের মেলার একটির কথা উক্ত বিবরণীতে আছে। ইহার কিয়দংশ এই:

 “গত ১৫ই পৌয়, কলিকাতার বেথুন স্কুল বাটীতে লেডী বেলী কর্তৃক বেলা দ্বিপ্রহরের সময় হইতে এই মেলা খোলা হয়, মেলা খুলিবার পরেই লেডী ল্যান্সডাউন আগমন করেন।...কলিকাতার অধিকাংশ সম্প্রাস্তু বংশীয় মহিলাগণ এই মেলায় আগমন করিয়াছিলেন। মেলা তিন দিন খোলা ছিল এবং ১২টা হইতে ৩টা অবধি মেলার দোকান খোলা থাকিত। বিক্রেতা, ক্রেতা ও দর্শক সকলেই এই মেলায় মহিলা। মেলা উপলক্ষে বেথুন স্কুলের বাড়িটি লতাপাতাফুল প্রভৃতি দ্বারা সুন্দর করিয়া সাজান হইয়াছিল। বাটীর মধ্যস্থলের খোলা উঠান চাঁদোয়ার দ্বারা ঢাকিয়া উঠানের মধ্যভাগে লতাপাতা রচিত কুটীর নির্মিত হইয়াছিল। কুটীরের মধ্যে ফুলের দোকান। উঠানের চারিপার্শ্বে বারান্দায় ঘরে মহিলাদের ক্রয়োপযোগী নানারূপ দ্রব্যাদ সজ্জিত হইয়াছিল এবং এক এক জন মহিলার উপর বা দুই তিন জনের উপর দ্রব্যবিশেষ বিক্রয়ের ভার ছিল।...এখানে অনেক প্রকার মহিলাশিল্প সংগ্রহ করা হইয়াছিল।.."

 সরলা দেবী 'মায়ার খেলা'র অভিনয়ের কথা বলিয়াছেন। উক্ত বিবরণীতে আছে:

 “মেলার পর বাবু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত 'মায়ার খেলা' নামে একখানি গীতি-নাটক বালিকাগণকর্তৃক অভিনীত হইয়াছিল, দর্শক মহিলাগণ অনেকেই অভিনয় দর্শনে বিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করিয়াছিলেন।” ('ভারতী ও বালক’, পৌষ ১২৯৫)।


 শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪০-১৯২৫): অপূর্ব ও অনন্যতুল্য সেবা-পরায়ণতার নিমিত্ত তিনি 'সেবাব্রত' শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে অভিহিত হন। শশিপদ ব্রাহ্মধর্মে একান্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন। সর্বজনীন ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক রামমোহন রায়ের আদর্শে তিনি সাধারণ সভা স্থাপন করেন। ইহারই পরিণতি হয় ‘দেবালয়ে'। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন, হিন্দু বালবিধবার শিক্ষা ও বিবাহ প্রভৃতি কার্যে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। শ্রমজীবীদের নিমিত্ত শ্রমজীবী ক্লাস স্থাপন এবং 'ভারত শ্রমজীবী' শীর্ষক মাসিকপত্র (১৮৭৪, বৈশাখ) প্রকাশ দ্বারা তিনি শ্রমজীবীদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক উন্নতিসাধনে তৎপর হন। স্ত্রীশিক্ষার প্রসার ও উন্নতিকল্পে তাঁহার জীবনব্যাপী প্রযত্ন সর্বজনবিদিত। তাঁহার স্থাপিত বরাহনগর হিন্দু বিধবা আশ্রমে বহুসংখ্যক বিধবা শিক্ষা পাইয়া স্বাধীনভাবে সদুপায়ে উপার্জনক্ষম হন। সেবাব্রতের এই আশ্রমটি চল্লিশ বৎসর জীবিত ছিল। এই সময়ের মধ্যে তিনি চল্লিশটি বিধবা বিবাহ দিতে সক্ষম হন। তাঁহার যাবতীয় সম্পত্তি তিনি দান করিয়া যান।

 বিধবা-শিল্পাশ্রম: সরলা দেবী এই আশ্রমের উদ্ভব সম্বন্ধে গ্রন্থে বলিয়াছেন। আশ্রমটি সখিসমিতির অনুক্রম। সখিসমিতির উদ্দেশ্য সঞ্জীবিত রাখিবার জন্য স্বর্ণকুমারী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা হিরন্ময়ী দেবী ১৯০৬ সনে রুপান্তরিত আকারে বিধবা-শিল্পাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুকাল (১৯২৫) পর্যন্ত তিনি ইহা পরিচালনা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার মত্যুর পর ইহা 'হিরন্ময়ী বিধবা-শিম্পাশ্রম' নাম পরিগ্রহ করে। অতঃপর স্বর্ণকুমারী দেবীর অধ্যক্ষতায় ইহা পরিচালিত হয়। আশ্রমের অধ্যক্ষ সভার নাম ‘সখি-শিল্পসমিতি'।

॥ দশ॥

 বড়মামা: দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬)। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। শৈশবে কিছুকাল হিন্দু কলেজে ও প্রেসিডেন্সী কলেজে শিক্ষালাভ করেন। কাব্য, দর্শন, গণিত ও সঙ্গীতে তাঁহার অসামান্য প্রতিভা ছিল। দেবেন্দ্রনাথের ধর্মনিষ্ঠতা ও স্বাদেশিকতা তাঁহার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিরাজিত ছিল। তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। বহু স্বাদেশিক প্রতিষ্ঠানেরও তিনি মূলে ছিলেন। নবগোপাল মিত্রের হিন্দু মেলা (১৮৬৭), বেঙ্গল থিয়সফিক্যাল সোসাইটি (১৮৮২), বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদ্ (১৮৯৪) প্রভৃতির সঙ্গে প্রতিষ্ঠাবধি যুক্ত হন। তিনি বেঙ্গল থিয়সফিক্যাল সোসাইটির সহকারী সভাপতি হইয়া-ছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন তিন বৎসর যাবৎ (১৮৯৭-১৯০৫)। ১৩২০ সনে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের কলিকাতা অধিবেশনে সভাপতি পদে বৃত হন। তিনি বাংলা শর্টহ্যাণ্ডেরও উদ্ভাবক। দ্বিজেন্দ্রনাথ 'ভারতী'র প্রথম সম্পাদক (শ্রাবণ ১২৮৪-১২৯০)। ইহার পর দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর যাবৎ (তিনি 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' সম্পাদনায় ব্যাপক ছিলেন। 'হিতবাদী' প্রতিষ্ঠায় দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রযত্ন উল্লেখযোগ্য) তিনিই উহার এই নামকরণ করেন। “হিতং মনোহারি চ দুর্লভং বচঃ”-হিতবাদীর মটোটি তাঁহারই প্রদত্ত। বাংলা সাহিত্য সাধনায় দ্বিজেনাথ আজীবন রত ছিলেন।

 দ্বিজেন্দ্রনাথের আট পুত্র এবং দুই কন্যা। চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথ এবং দুই কন্যা সরোজা দেবী ও ঊষা দেবীর কথা পুস্তকে উল্লিখিত হইয়াছে। সরোজা দেবীর ও ঊষা দেবীর বিবাহ হয় যথাক্রমে মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় ও রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।

 সেজ মাসীমা: শরৎকুমারী (১৮৫৫-১৯২০)

 ছোট মাসীমা: বর্ণকুমারী (১৮৫৮–;}

॥ এগার॥

 আশু, চৌধুরী: সার্, আশুতোষ চৌধুরী (১৮৫৯-১৯২৪)। পাবনা জেলার হরিপুরে বিখ্যাত জমিদার বংশে তাঁহার জন্ম। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ইংলণ্ডে গমন করেন। তিনি ব্যারিস্টার হইয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসেন এবং হাইকোর্টে আইন-ব্যবসায় শুরু করিয়া দেন। এই ব্যবসায়ে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। তিনি ইংরেজী সাহিত্যে পণ্ডিত ছিলেন। ইংরেজ কবিদের জীবন ও কাব্য সম্বন্ধে তাঁহার কয়েকটি প্রবন্ধ 'ভারতী' মাসিকে প্রকাশিত হয়। আশুতোষ স্বদেশের হিতের জন্য বিবিধ আন্দোলনে যোগদান করিয়া ছিলেন। ১৯০৪ সনে বর্ধমানে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতি হইয়াছিলেন। অভিভাষণে তিনি বলেন যে, “পরাধীন জাতির রাজনীতি নাই” {“A subject nation has no politics")। এই উক্তিটি লইয়া রাজনীতিক মহলে বিশেষ আলোচনার সৃষ্টি হয়। তিনি সমকালীন রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় জাতীয় শিক্ষা প্রবর্তনে অগ্রণীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রুপেও তাঁহার নাম স্মরণীয়। তিনি বহু বৎসর ইহার অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সভাপতি ছিলেন তিন বৎসর (১৯২০-১৯২৩)। বেঙ্গল ল্যাণ্ডহোল্ডার্স এসোসিয়েসন প্রতিষ্ঠার মূলেও ছিলেন আশুতোষ। এই প্রতিষ্ঠানটি স্বদেশী আন্দোলনের কালে গঠনমূলক কার্যে বিশেষ সহায়তা করে। আশুতোষ ১৯১২ সনে উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে (দিনাজপুর) সভাপতি হন। হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা প্রতিভা দেবীর সঙ্গে তাঁহার বিবাহ হয়। পত্নীর সঙ্গীতানুশীলন এবং সঙ্গীত শিক্ষাদানে তিনি বিশেষ উৎসাহ দান করিতেন।

 “চৌধরী মহাশয় সদালাপী, মিষ্টভাষী, বিনয়নম্র ও অমায়িক লোক ছিলেন। যেমন কাজের লোক ছাড়া সংসার চলে না, তেমনি কেবল কাজের লোকই পৃথিবীতে থাকিলে লোকালয়ের আনন্দ ও শ্রীসৌন্দর্য্য থাকে না, তজ্জন্য সামাজিকতার প্রয়োজন আছে। চৌধুরী মহাশয় যে কাজের লোক ছিলেন না, তাহা নহে; কিন্তু তিনি সামাজিকতার জন্য লোকপ্রিয় ছিলেন। এইজন্য তাহার অভাবে কলিকাতার বাঙ্গালী সমাজের এই অংশ অন্যতম ভূষণ হারাইল!”-'প্রবাসী', আষাঢ় ১৩৩১, পঃ ৪৭৫।


 সার্, রাজেন ও লেডী মুখার্জী: সার্ রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং পত্নী লেডী যাদুমণি মুখোপাধ্যায়। ১৮৫৪, জুন মাসে রাজেন্দ্রনাথ চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত বসিরহাট মহকুমার ভাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছয় বংসর বয়সে তাঁহার পিতৃবিয়োগ হয়। শৈশব ও কৈশোরে তিনি অতি কষ্টে বিদ্যাভ্যাস করেন। বিপদে-আপদে মা ছিলেন একমাত্র সহায়। কোনরুপে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া রাজেন্দ্রনাথ কলিকাতায় ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে প্রবেশ করেন। তখন এই কলেঞ্জ প্রেসিডেন্সী কলেজের অঙ্গরপে উহারই হাতার মধ্যে অবস্থিত ছিল। কলেজের ত্রৈবার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া তিনি অপরের সঙ্গে অংশীদাররুপে ঠিকাদারী কার্য আরম্ভ করেন। কঠোর পরিশ্রম, অপূর্ব অধ্যাবসায়, আশ্চর্য সততা এবং নিয়মানুবর্তিতার গুণে রাজেন্দ্রনাথ ক্রমে বাবসায়ে উন্নতি করিতে থাকেন। তিনি কলিকাতা, এলাহাবাদ, লক্ষৌ, বারাণসী, পাটনা প্রভৃতি অঞ্চলে জলের কলের ঠিকাদারী করিয়া প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। মার্টিন কোম্পানীর সমান অংশী রপে তিনি ইহাতে যোগ দেন। পরে তিনিই ইহার সম্পূর্ণ মালিক হন। রাজেন্দ্রনাথ বার্ন কোম্পানীর লৌহ-কারখানা ক্রয় করিয়া যান। ইহা এখন একটি বিরাট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইয়াছে। বাবসাক্ষেত্রে রাজেন্দ্রনাথ দেশে ও বিদেশে বিশেষ মর্যাদা লাভ করিয়াছিলেন। ১৯১১ সনের দিল্লী দরবারে তিনি 'নাইট' উপাধি প্রাপ্ত হন। রাজেন্দ্রনাথের দেশহিতৈষণার বিষয় উল্লেখযোগা। তিনি নিজ গ্রামে স্কুল ও হাসপাতাল স্থাপন করেন, কলিকাতা শ্যামবাজারস্থ অনাথ আশ্রম তাঁহারই অর্থ-সাহায্যে এবং প্রত্যক্ষ পরিচালনায় একটি বিশিষ্ট সমাজহিতকর প্রতিষ্ঠানে দাঁড়াইয়াছিল। ‘সোসাইটি ফর ইমপ্রুভমেণ্ট অব ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস্'-এর সঙ্গে তাঁহার যোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। শেষ দিকে কয়েক বৎসর তিনি ইহার সভাপতিত্ব করেন। বঙ্গের অনুন্নত সমাজের সর্বপ্রকার শিক্ষার ব্যবস্থা করিতেন এই সোসাইটি।


॥ বার॥

 মিসেস পি. কে. রায়: সরলা রায় (১৮৬১–১৯৪৬)। দুর্গামোহন দাসের জ্যেষ্ঠা কন্যা। হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় এবং বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে সরলা অধ্যয়ন করেন। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে ১৮৭৬ সনে সরলা চতুর্থ শ্রেণীর পরীক্ষা দিয়া কৃতিত্বের সহিত উত্তীর্ণ হন। কাদম্বিনী বসু, (গাঙ্গুলী) ছিলেন তাঁহার সহপাঠিনী। ১৮৭৮ সনে বঙ্গ মহিলা বিদালয় বেথুন স্কুলের সহিত মিলিত হইলে, প্রবেশিকার টেস্ট পরীক্ষায় সরলা ও কাদম্বিনী উভয়েই উত্তীর্ণ হন। এই সময় ডক্টর প্রসন্নকুমার রায়ের সঙ্গে সরলার বিবাহ হওয়ায় তিনি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের এণ্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে সক্ষম হন নাই। উপযুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষয়িত্রীর তত্ত্বাবধানে সরলা ইংরেজী, বাংলা ও অন্যান্য বিষয় ভাল করিয়া অধিগত করেন। শিক্ষার প্রতি তাঁহার অনুরাগ আজীবন প্রবল ছিল। স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় গমনান্তর তিনি নারী-শিক্ষা-মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতায় ফিরিয়া সরলা ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। এই শিক্ষালয়ের প্রথম মহিলা সম্পাদক তিনি। কিন্তু তাঁহার প্রধান কীর্তি গোখলে মেমোরিয়াল স্কুল ও কলেজ। এই বিদ্যালয়টি উন্নত ধরনের নারী-শিক্ষা-কেন্দ্র। ঐকান্তিক শিক্ষানুরাগ এবং শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নৈপুণ্য প্রদর্শনের পুরস্কারস্বরুপ তাঁহাকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের সদস্য পদে বৃত করা হইয়াছিল। তিনিই সেনেটের প্রথম মহিলা সদস্য। সরলা রায় ১৯৪৬, ২১শে জুন পঁচাশী বৎসর বয়সে পরলোকগমন করেন।


 প্রতিভা দিদি: প্রতিভা দেবী (১৮৬৫-১৯২২)। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোষ্ঠা কন্যা। হেমেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে গৃহে বসিয়াই তিনি শিক্ষালাভ করেন। সঙ্গীত-বিদ্যায়ও কৈশোর হইতে তিনি পারদর্শিনী হন। 'ভারতী ও বালক' এবং 'ভারতী'তে সে যুগে তাঁহার বিস্তর ‘স্বরলিপি' প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের তিনি অন্যতম ধারক ছিলেন। বিখ্যাত ব্যারিস্টার দেশকর্মী ও সমাজহিতৈষী আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে তিনি পরিণীতা হন। তিনি কয়েকটি ভাষা জানিতেন, এছাড়া সাধারণ শিক্ষায়ও তিনি সুশিক্ষিতা ছিলেন। তিনি স্বামীর সকল কাজের উৎসাহী সঙ্গিনী ছিলেন। আবার তাঁহার বিবিধ প্রয়াসেও স্বামী যথাসাধ্য সাহায্য করিতেন। প্রতিভা দেবী সঙ্গীত শিক্ষা দিবার জন্য 'সঙ্গীত সংঘ’ স্থাপন করেন। ঐ বিষয়ে ছাত্রছাত্রীর হাতে সুশিক্ষা লাভ করে তজ্জন্য বিশেষ যত্ন লইতেন। তিনি ‘আনন্দ-সঙ্গীত পত্রিকা' নামক সঙ্গীত-বিষয়ক একখানি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ইন্দিরা দেবীর সহযোগে তিনি ইহা সম্পাদনা করতেন।


 চন্দ্রমাধৰ ঘোষ: (১৮৩৮-১৯২৮)। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এণ্ট্রান্স পরীক্ষায় (১৮৫৭) চন্দ্রমাধব প্রেসিডেন্সী কলেজের ল বিভাগ হইতে উত্তীর্ণ হন। ১৮৫৯ সনে আইন পরীক্ষা পাস করেন। কলিকাতা হাইকোর্টে তিনি আইন ব্যবসা আরম্ভ করিয়া খ্যাতিলাভ করেন। ১৮৮৫ সনে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে তিনি অধিষ্ঠিত হন। এই পদ হইতে অবসর গ্রহণ করেন ১৯০৭ সনের জানুয়ারী মাসে। মধ্যে তিনি অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির অসনও গ্রহণ করেন। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো এবং ফ্যাকালটি অব ল-এর ডীন বা অধ্যক্ষ হন। ১৯২৮ সনের জানুয়ারী মাসে তিনি দেহত্যাগ করেন। চন্দ্রমাধৰ ঘোষের পরিবারের সঙ্গে সরলা দেবীর ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের কথা পুস্তকে বিবৃত হইয়াছে।
॥ তের॥

 সখা: এই নামে বালক-বালিকাদের পাঠোপযোগী একখানি সচিত্র মাসিক পত্রিকা জানুয়ারী ১৮৮৩ হইতে প্রমদাচরণ সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ১৮৮৫ সনের ২১শে জুন প্রমদাচরণের মৃত্যু হইলে, পরবর্তী জুলাই মাস হইতে ১৮৮৬ সন পর্যন্তু 'সখা' সম্পাদনা করেন পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী। 'সখা'র আনুকূল্যে বালক-বালিকাদের মধ্যে রচনা-প্রতিযোগিতা হইত, এবং যাহার রচনা উৎকৃষ্টতম বিবেচিত হইত তিনি পুরস্কৃত হইতেন। সরলা দেবী লিখিয়াছেন যে, তিনি বার বৎসর বয়সে এইরুপ একটি প্রতিযোগিতায় কবিতা লিখিয়া প্রথম পুরুস্কার পাইয়াছিলেন। ‘সখা’য় দেখিতেছি, তাঁহার একটি পুরস্কৃত রচনা প্রকাশিত হয়, তবে এটি কিন্তু গদ্য রচনা; ইহা ১৮৮৫ সনের নবেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। রচনটির নাম পিতামাতার প্রতি কর্তব্য। প্রবন্ধশেষে সরলা দেবীর বয়স লিখিত হইয়াছে “১২ বৎসর ১১ মাস"।


 দ্বিজু রায়: দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩)। কৃষ্ণনগরের মহারাজার দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্রের পুত্র। তিনি কৃষ্ণনগর স্কুল ও কলেজ এবং প্রেসিডেন্সী কলেজে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। শেষোক্ত কলেজ হইতে এম-এ পাস করিয়া স্টেট স্কলারশিপ পান এবং কৃষিবিদ্যা অধ্যয়নের নিমিত্ত বিলাত গমন করেন। স্বদেশে ফিরিয়া তিনি ডেপুটি মাজিস্ট্রেটের পদ লাভ করেন (১৮৮৬)। ১৯০৯ সনে এই পদ হইতে অবসর লন। বিলাতে অবস্থান কালেই তিনি সাহিত্যচর্চায় মন দেন। তাঁহার প্রথম পুস্তক ইংরেজীতে 'Lyrics of Ind' (১৮৮৭)। দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা সাহিত্যে কবিতা ও নাটক লিখিয়া যশস্বী হইয়াছেন। তাহার হাসির গান বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সরলা দেবী ‘বাঙ্গালার হাসির গান ও তার কবি' প্রবন্ধে ইহার বিশেষ প্রশংসা করিয়াছেন।


 গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী: (১৮৫৮-১৯২৪। 'অশ্রুকণা’র কবি গিরীন্দ্রমোহিনী নামে তিনি খ্যাত হইয়াছিলেন। চব্বিশ পরগনার অন্তর্গ৩ মজিলপুর গ্রামে মাতুলালয়ে ভাঁহার জন্ম হয়। পিতা হারানচন্দ্র মিত্রের আদি নিবাস পানিহাটিতে। কলিকাতা বৌবাজারে দুর্গাচরণ দত্তের কনিষ্ঠ পুত্র নরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে দশ বৎসর বয়সে গিরীন্দ্রমোহিনীর বিবাহ হয়। বিয়ের পরে প্রথম প্রথম অসুবিধা হইলেও তিনি বিদ্যাচর্চা বরাবর অক্ষুন্ন রাখিয়াছিলেন। গিরীন্দ্রমোহিনীর কাব্যগ্রন্থসমূহ সাহিতরসিক সমাজে বিশেষ সমাদর লাভ করিয়াছি। 'জাহ্নব' (১৩১১, আষাঢ়) সম্পাদনেও তিনি বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় গিরীন্দ্রমোহিনী দেশসেবায় রত হন। মজিলপুরে এই সময় যে স্বদেশী প্রদর্শনী হয় তাহার অন্যতর সহকারী সম্পাদিকা ছিলেন গিরীন্দ্রমোহিনী। তাঁহার 'রাখীবন্ধন' কবিতাটি স্বদেশবাসীদের মনে বিশেষ প্রেরণা জোগায়।


 এন্. ঘোষ, ব্যারিস্টার: নগেন্দ্রনাথ ঘোষ {১৮৫৪-১৯০৮)। ব্যারিস্টার ও শিক্ষাব্রতী। প্রথমে কলিকাতায় এবং পরে বিলাতে অধ্যয়ন করেন। ১৮৭৬ সনে ব্যারিস্টার হইয়া এদেশে আসেন। আইন-ব্যবসার বদলে অধ্যাপনা এবং সংবাদপত্র-সেবাকে জীবিকার অবলম্বন করিয়া লন। তিনি মেট্রোপলিটন কলেজের প্রথমে অধ্যাপক এবং পরে অধ্যক্ষ হন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাহার বিশেষ যোগস্থাপন হয়। England's Work in India -কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রচারিত তাঁহার বিখ্যাত পাঠ্যপুস্তক। নগেন্দ্রনাথ Indian Nation নামক সাপ্তাহিকের সম্পাদক এবং পরিচালক ছিলেন। 'কৃষ্ণদাস পালের জীবনী' এবং 'মহারাজা নবকৃষ্ণ' তাঁহার দুইখানি প্রসিদ্ধ ইংরেজী গ্রন্থ।  লোকেন পালিত: (? ১৮৬৫-?)। সার্, তারকনাথ পালিতের পুত্র। সাহিত্য-রসিক, রবীন্দ্রনাথের বিশেষ বন্ধু। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ১৮৮৬ সনে কর্মে লিপ্ত হন। ১৯১২ সনে পদত্যাগ করেন, মনে হইতেছে। ইহার পর তিনি কিছুকাল ব্যারিস্টারি করিয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথ 'জীবন-স্মৃতি'তে (বিশ্বভারতী সং. ৯৩৬৩, প. ৯৮) অন্যান্য কথার মধ্যে লিখিয়াছেন: “সাহিত্যে লোকেনের প্রবল আনন্দ আমার রচনার বেগকে পালের হাওয়ার মতো অগ্রসর করিয়াছে। আমার পূর্ণ যৌবনের দিনে ‘সাধনা'র সম্পাদক হইয়া অবিশ্রামগতিতে যখন গদ্যপদ্যর জুড়ি হাঁকাইয়া চলিয়াছি তখন লোকেনের অজস্র উৎসাহ আমার উদ্যমকে একটুও ক্লান্ত হইতে দেয় নাই। তখনকার কত পঞ্চভূতের ডায়রি এবং কত কবিতা মফঃস্বলে তাঁহারই বাংলাঘরে বসিয়া লেখা। আমাদের কাব্যালোচনা সঙ্গীতের সভা কতদিন সন্ধ্যাতারার আমলে সুরু হইয়া শুকতারার আমলে ভোরের হাওয়ার মধ্যে রাত্রের দীপশিখার সঙ্গে সঙ্গেই অবসান হইয়াছে।” লোকেন পালিতের বহু প্রবন্ধ ‘ভারতী'র পৃষ্ঠায় স্থান পাইয়াছে।


॥ চৌদ্দ॥

 মোহিনীবাবু: মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় (১৮৫৮-১৯৩৬)। মোহিনীমোহন ১৮৭৯ সনে এম-এ, ১৮৮০ সনে বি-এল, এবং ১৮৮৩ সনে এটর্নীশিপ পরীক্ষা পাস করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা সরোজা দেবীর সঙ্গে ১৮৭৬ সনে মোহিনীমোহনের বিবাহ হয়। ১৮৮৩ সনের মাঝামাঝি মোহিনীমোহন বিখ্যাত থিয়সফিস্ট মাদাম ব্লাভাট্স্কির সেক্রেটারী হইয়া ইউরোপ যাত্রা করেন। ইংলণ্ডে অবস্থান-কালে বহু ইংরেজ মনীষীর সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। থিয়সফির সঙ্গে ক্রমে তাঁহার বিচ্ছেদ ঘটে। মোহিনীমোহন আমেরিকায় গমন করেন। ১৮৮৯ সনে দেশে ফিরিয়া তিনি এটর্নীর ব্যবসায়ে মন দেন। বহু সামাজিক এবং জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাহার যোগ ছিল। তিনি পরমহংস শিবনারায়ণ স্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ইংরেজী-বাংলা বহু পুস্তক ও প্রবন্ধ রচনা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার রচিত কয়েকখানি পুস্তক: ব্যাখ্যাসহ শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা, ইংরেজী অনুবাদ, Indian Spirituality, History as a Science, ভিক্ষার ঝুলি, জীবন-প্রবাহ (কবিতা), অবলা জীবনের আঁধার কোণ এবং প্রণবাদির ব্যাখ্য। ইহা ছাড়া পরমহংস শিবনারায়ণ স্বামীর ভ্রমণ-বৃত্তান্ত, উপদেশাবলীর সংগ্রহ, পরমকল্যাণ গীতা প্রভৃতি পুস্তকও উল্লেখযোগ্য।


 রমণীবাবু: রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায় (১৮৬৫-১৯১৯)। মোহিনীমোহনের মধ্যম ভ্রাতা। তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজ হইতে এম-এ পাস করিয়া পুরাতন মেট্রো-পলিটন (বিদ্যাসাগর) কলেজে অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। পরে জানকীনাথ ঘোষালের সহায়তায় কলিকাতা কর্পোরেশনের লাইসেন্স অফিসারের পদ লইয়াছিলেন। তিনি পরে ইহার ভাইস-চেয়ারম্যান হন। মধ্যে দুবৎসর তিনি ত্রিপুরারাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কার্য করেন। রমণীমোহন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যা উষা দেবীর পাণিগ্রহণ করেন।


 যোগিনী ও রজনী: যথাক্রমে যোগিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় (১৮৬৩-১৯৩২) এবং রজনীমোহন চট্টোপাধ্যায় (১৮৬৫-১৯৩৪)। রজনীমোহন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠা ভগিনী সুনয়নী দেবীকে বিবাহ করেন।
॥ পনর॥

 গগনদাদা: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯৩৮)। শিল্পগুরু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। গগনেন্দ্রনাথ খ্যাতনামা বাঙ্গচিত্র-শিল্পী। তাঁহার বিখ্যাত বাঙ্গচিত্র-গ্রন্থ Reform Screams (নব হুল্লোড়') ১৯২২ সনে প্রকাশিত হয়। নিজে বিদ্যোৎসাহী এবং সাহিত্যসেবীদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।


॥ ষোল॥

 মহারাণী গার্লস্ স্কুল, মহীশূর: সরলা দেবী এই বিদ্যালয়ে এক বৎসর কাল কর্মে লিপ্ত ছিলেন। সমসাময়িক পত্রিকাদিতে এই সময়কার কিছু কিছু সংবাদ বাহির হয়। ইহাতে সরলা দেবীর কার্যকলাপের উপর আলোকপাত হইতেছে:

 (১) “ভারতীর ভূতপূর্ব সম্পাদিকা শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা শ্রীমতী সরলা দেবী মহীশূর মহারাণীর কলেজে অধ্যাপিকা ছিলেন। তিনি সম্প্রতি ৪৫০ টাকা বেতনে বরদার মহারাণীর প্রাইভেট সেক্রেটারী হইয়াছেন।”—'বামাবোধিনী পত্রিকা', অগ্রহায়ণ ১৩০২।

 (২) “কুমারী সরলাদেবী-ইনি বরদার মহারাণীর প্রাইভেট সেক্রেটারীর পদ ত্যাগ করিয়া পুনরায় মহীশূরের কর্মে ফিরিয়া গিয়াছেন।”—ঐ, ফাগুন ১৩০২।


॥ সতর॥

 ডন সোসাইটির সতীশ মুখুয্যে: সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, এম-এ, বি-এল (১৮৬৫-১৯৪৮)। সতীশচন্দ্র হিন্দুশাস্ত্র চর্চা ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন-কল্পে ভবানীপুরে একটি সংস্কৃত চতুম্পাঠী স্থাপন করেন। ইহার মুখপত্র-স্বরূপ ১৮৯৭ সনে ‘ডন পত্রিকা' প্রকাশিত করিলেন। এই পত্রিকার নাম হইতে ১৯০২ সনে 'ডন সোসাইটি' প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গের বহু শ্রেষ্ঠ মনীষীর প্রবন্ধাবলী এই পত্রিকায় স্থান পাইতে থাকে। ডন সোলাইটিতে সে যুগের উৎকৃষ্ট যুবক ছাত্রগণ যোগ দিয়াছিলেন। সোসাইটির যুবক সদস্যদের মধ্যে অনেকে পরবর্তী কালে বিভিন্ন বিভাগে খ্যাতিলাভ করেন। সতীশচন্দ্রের যুবক শিষ্য এবং ডন সোসাইটির যুবক সদস্যদের মধ্যে বিনয়কুমার সরকার, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, হারানচন্দ্র চাকলাদার, রবীন্দ্রনারায়ণ ঘোষ, প্রফুল্লকুমার সরকার প্রভৃতি প্রধান ছিলেন। সতীশচন্দ্র স্বদেশী আন্দোলনের সময় বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ ও স্কুলের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট হন। অরবিন্দ ঘোষ (শ্রীঅরবিন্দ) পদত্যাগ করিলে সতীশচন্দ্র ইহার অধ্যক্ষ হন।


 বঙ্গের বীর সিরিজের দুখানি বই: এই সিরিজের একখানি বই দেখিয়াছি, নাম—'পিতৃধন', 'ভারতী'তে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংশোধিত ও পরিবর্ধিত আকারে মুদ্রিত হয়।


 নরেন্দ্রনাথ সেন: (১৮৪৩-১৯১১)। রামকমল সেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র হরিমোহন সেন, তদীয় চতুর্থ পুত্র নরেন্দ্রনাথ। প্রথমে হিন্দু কলেজ ও পরে নিজ গৃহে বিদ্যাভাস করেন। তিনি অল্পবয়স হইতেই সংবাদপত্র সেবায় মনঃসংযোগ করেন। কিশোরীচাঁদ মিত্রের 'ইণ্ডিয়ান ফিল্ডে' প্রথম প্রথম তাঁহার রচনা প্রকাশিত হইত। ১৮৬১ সনে 'ইণ্ডিয়ান মিরর' প্রকাশিত হইলে তিনি ইহার নিয়মিত লেখক হইলেন। সম্পাদক মনোমোহন ঘোষ ১৮৬৩ সনে বিলাত যান। তদবধি ১৮৬৬ সন পর্যন্ত নরেন্দ্রনাথ এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কেশবচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে ১৮৭১ সন হইতে এখনি দৈনিকে পরিণত হয়; এই সময় নরেন্দ্রনাথ পুনরায় ইহার সঙ্গে যোগ দেন। কিছুকাল পরে তিনি ক্রমে ইহার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী হইলেন এবং মত্যুকাল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি রাজনীতি, সমাজসেবী এবং থিয়সফিস্ট মতাবলম্বী ছিলেন। কংগ্রেসের পরিকল্পনা ও প্রতিষ্ঠা অবধি দীর্ঘক্যল তিনি ইহার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। প্রথম কংগ্রেসের (বোম্বাই) অধিবেশনে বঙ্গের তিনজন প্রতিনিধির মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। স্বদেশী আন্দোলনেও তাঁহার সক্রিয় সহযোগিতা লক্ষণীয়। তবে তিনি ছিলেন ধীরপন্থী, অগ্রগামী রাজনীতিক দল বা মতবাদের তিনি সমর্থক ছিলেন না। ১৯১১ সনে সরকারী আনকূল্যে তাঁহারই সম্পাদনায় ‘সুলভ-সমাচার' পুনঃপ্রকাশিত হয়। বিভিন্ন সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক প্রতিষ্ঠানের সভাপতিপদে তিনি বৃত ছিলেন।

॥ আঠার॥

 বীরাষ্টমী ব্রত সম্বন্ধে পুস্তকে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। এ বিষয়ক সঙ্গীত 'বীরাষ্টমীর গান' নিম্নে দিলাম:

জান কী মানব কোথাকার তুমি সোনা হতে মূল্যবান,
কোথা বহে বায়, সদা সুশীতল জড়াইতে মন প্রাণ।
কোথা ফুটে ফল সুবাসে অতুল পারিজাত যার নহে সমতুল,
কোথাকার নীর সদা সুধা ঝরে, কারে হেরে হয় পুলকিত মন।
পিতামাতা দারাসুত পরিজন, সবা হতে বল কেবা প্রিয়তম,
সাধিবারে কাষ লভিলে মরণ, মানব হইবে দেবতা সমান।
স্বর্গ হ'তে শ্রেষ্ঠ বল কে বৈভবে, সুধা হ'তে স্বাদু কার নাম ভবে,
শোন রে মানব শোন মন দিয়ে,
সে যে জন্মভূমি মহা মহীয়ান্।
স্বদেশানুরাগে যে জন জাগে, অতি মহাপাপী হোক না কেন
তবুও সে জন অতি মহাজন সার্থক জনম তাহার জেনো।
দেশহিতব্রত এ পরশমণি, পরশিবে যারে বারেক যখনি,
রাজভয় আর কারাভয় তার ঘুচিবে তাহার তখনি জেনো।
মাতৃভূমি তরে যেই অকাতরে নিজ প্রাণ দিতে কভু নাহি ডরে
অপঘাত ভয় আশু তার যাস মরণে গোলোক যায় সেই জন।

॥ উনিশ॥

 জাপানী চিত্রকর: ইয়োকোয়ামা: ইহার কৃত 'কালী' চিত্রের ফোটো ‘প্রবাসী', আশ্বিন ১৩১০-এ প্রকাশিত হয়। “By the courtesy of Miss Ghosal”- চিত্রের নিম্নে চিত্র ও চিত্রকরের নামের সঙ্গে এইরপ লিপিবদ্ধ আছে।

 —যুন্সো হিষিডা, টোকিও কৃত 'সরস্বতী'-'প্রবাসী', কার্তিক ১৩১০। উক্ত প্রকার ইহার নিম্নেও মিস ঘোষালের সৌজন্যে লিখিত হইয়াছিল।

 ওকাকুরা: ওকাকুরা, ইহার বিখ্যাত পুস্তক 'The Ideal of the East, with special reference to the art of Japan'-১৯০৩ সনে লণ্ডন হইতে প্রকাশিত হয়।

 সত্যসুন্দর দেব: জন্ম ২৯শে ডিসেম্বর ১৮৮১। পিতা—ত্রৈলোক্যনাথ দেব। সত্যসুন্দর ১৯০৩ সনের মে মাসে 'Society of Theists' নামক এক সমিতির বৃত্তিলাভ করিয়া শিল্প ও কারিগরি বিদ্যা শিক্ষার জন্য জাপানে গমন করেন। জাপান হইতে ফিরিয়া তিনি 'Calcutta Pottery Works' স্থাপন করেন। সত্যসুন্দর দেবের পুত্র সরল দেবের কথাও পুস্তকে উল্লিখিত হইয়াছে।


॥ কুড়ি॥

 ‘ভারতী' পত্রিকার গৌরব বৃদ্ধির জন্য সয়লা দেবী বাঙ্গালী ছাড়াও অবাঙ্গালী কয়েকজন বিখ্যাত মনীষীর ইংরেজী রচন্য বাংলায় অনুবাদ করিয়া প্রকাশিত করেন। লেখকদের নাম সহ এইরপ কয়েকটি রচনা:

 আর্য্যা নিবেদিতা: 'প্রত্যেক মা ছেলের জন্য কি করিতে পারে'—'ভারতী', জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬, 'বঙ্গমাতার কর্তব্য'—'ভারতী', শ্রাবণ ১৩০৬

 মহাদেব গোবিন্দ রানাড়ে: ‘পূর্ব্বকালের সমাজশাসন'—'ভারতী', শ্রাবণ ১৩০৭

 মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী: 'দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতোপনিবেশ'-‘ভারতী', বৈশাখ ১৩০৯

 শিতোবু হোরী: 'জাপানের সনাতন আদর্শ'-'ভারতী', বৈশাখ ১৩১০

॥ একুশ॥

 স্বামী স্বরূপানন্দ: (? ১৮৭২-১৯০৬): পূর্বাশ্রমে স্বামিজীর নাম ছিল অজয়হরি বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ভবানীপুরে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সহযোগে হিন্দুশাস্ত্র চর্চা এবং হিন্দু-সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে একটি চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা করেন। 'ডন' পত্রিকা সম্পাদনা এবং প্রকাশেও তিনি সতীশচন্দ্রের সহযোগী হন। স্বামী বিবেকানন্দের সংস্রবে আসিয়া তিনি ১৮৯৮ সনে তিনি সন্ন্যসব্রত গ্রহণ করেন। তিনি মায়াবতী অদ্বৈতাশ্রমের প্রথম অধ্যক্ষ। 'প্রবুদ্ধ ভারত' মাদ্রাজ হইতে মায়াবতীতে নীত হইলে তিনি ইহার সম্পাদনায় ব্রতী হন। আট বৎসর কাল তিনি যোগ্যতার সহিত 'প্রবুদ্ধ ভারত' সম্পাদনা করেন। তিনি সেবাপরায়ণ ছিলেন এবং যুবকগণকে সেবাধর্মে উদ্বুদ্ধ করেন। স্বরূপানন্দ হিন্দুশাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। তাঁহার বেদান্তব্যাখ্যা শ্রবণে শ্রোতৃগণ মুগ্ধ হইতেন। শ্রীমদ্‌ভাগবদ্‌গীতার তৎকৃত শঙ্করভাষ্য-ভিত্তিক ইংরেজী অনুবাদ শিক্ষিত-সমাজে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছি। সরলা দেবী হিমালয়ে অবস্থানকালে স্বামী স্বরূপানন্দদের নিকট শাস্ত্র- ব্যাখ্যা শুনিয়া সবিশেষ মুগ্ধ হন


॥ বাইশ॥
 আনন্দ রায়:আনন্দচন্দ্র রায়: (? ১৮৪৪-১৯৩৫)। কবি গোবিন্দচন্দ্র রায়ের মধ্যম ভ্রাতা, স্বদেশী আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতা। আনন্দচন্দ্রের কর্মক্ষেত্র ছিল ঢাকায়। এখানে তিনি ওকালতি ব্যবসা করিয়া প্রচুর অর্থ উপাভ করেন। আলিপুর বোমার মামলা, কুমিল্লা শুটিং কেস্ প্রভৃতি রাজনৈতিক মোকদ্দমায় তিনি অন্যতম কৌঁসুলী ছিলেন। রাজনীতি এবং সমাজকর্মী হিসাবে তাঁহার প্রসিদ্ধি। শিক্ষা, শিল্প-প্রতিষ্ঠানাদির সঙ্গে তাহার ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির প্রথম বেসরকারী চেয়ারম্যান, বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের সভাপতি, ঢাকেশ্বরী কটন মিলস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে অন্যতম উদ্যোক্তা। ৯১ বৎসর বয়সে তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন।
॥ তেইশ॥

 যতীন বাঁড়ুয্যে: যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (? ১৮৭৭-১৯৩০)। যতীন্দ্রনাথ আদি যুগের বিখাত বিপ্লবী। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া তিনি এলাহাবাদের কায়স্থ পাঠশালায় (কলেজ) ভর্তি হন। তখন 'প্রবাসী' ও 'মডার্ন-রিভিয়ু'র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কায়স্থ পাঠশালার প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। যতীন্দ্রনাথের এলাহাবাদ গমনের আসল উদ্দেশ্য ছিল ‘দেহাতী হিন্দী' শেখা, যাহাতে সৈন্যদলে সহজে ভর্তি হইতে পারেন। তখনকার দিনে বাঙ্গালীর পক্ষে মৈনাবিভাগে ভর্তি হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। তিনি বরদার সৈন্যদলে ছদ্মনামে প্রবেশ করেন। এখানে অরবিন্দ ঘোষের (শ্রীঅরবিন্দ) সঙ্গে তাঁহার পরিচয় হয়। যতীন্দ্রনাথ ও অরবিন্দের ভিতরে বৈপ্লবিক উপায়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ-বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলিয়াছিল। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কথিত আছে, শ্রীযুক্ত অরবিন্দ ঘোষ যতীন্দ্রনাথের নিকট হইতে স্বাধীনতার মন্ত্র লাভ করেন।” প্রসিদ্ধ বিপ্লবী ডাঃ যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় ও ডাঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত যতীন্দ্রনাথ প্রমখাৎ শ্রবণান্তর অনুরুপ উক্তিই করিয়াছেন। বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইবার উপক্রম হইলে যতীন্দ্রনাথ সৈনাবিভাগ ত্যাগ করেন এবং অরবিন্দের পত্র লইয়া ১৯০২ সনে কলিকাতায় আসিয়া সরলা দেবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর কলিকাতাস্থ ১০৮নং আপার সারকুলার রোড়ে যতীন্দ্রনাথ একটি ক্লাব স্থাপন করেন। শ্রীবারন্দ্রকুমার ঘোষ ১৯০৩ সনের প্রারম্ভে যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগদান করিলেন। কিন্তু ১৯০৪ সন নাগাদ এই বিপ্লবী সঙ্ঘটি নানা কারণে ভাঙ্গিয়া যায়। যতীন্দ্রনাথ দক্ষ ঘোড়সওয়ার ছিলেন। তিনি সঙ্ঘের সভ্যদের ডনকুস্তি, অশ্বারোহণ, অসিচালনা প্রভৃতি শিক্ষা দিতেন, আবার তাহাদের বৈপ্লবিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির নিমিত্ত যোগ্য ব্যক্তিদের দ্বারা বিভিন্ন দেশের বৈপ্লবিক ইতিহাস শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। যতীন্দ্রনাথ অশ্বারোহণ বালীগঞ্জ সারকুলার রোড় অঞ্চলে গিয়া বিলাতফেরত ব্যারিস্টার এবং বিত্তশালী ব্যক্তিদের নিকট হইতে অর্থ সংগ্রহ করিতেন। ব্যারিস্টার পি. মিত্র ছিলেন এই বিপ্লবী সঙ্ঘের সভাপতি। যতীন্দ্রনাথ সরলা দেবী সম্পাদিত 'ভারতী’তে ইটালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক ম্যাটসিনি ও গ্যারিবল্ডীর জীবনবৃত্ত লিখিয়াছিলেন। বিপ্লবী সঙ্ঘ ভাঙ্গিয়া যাইবার কিছুকাল পরে যতীন্দ্রনাথ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তাঁহার সন্ন্যাসাশ্রমের নাম-স্বামী নিরলম্ব। আলিপুর বোমার মামলায় তিনি ধত হন, কিন্তু প্রাথমিক প্রমাণাভাবে চারিয়াস হাজতবাসের পরই তিনি মুক্তিলাভ করেন।


____________