জীবনের ঝরাপাতা/ছাব্বিশ

উইকিসংকলন থেকে

ছাব্বিশ

শ্বশুরকূল

লাহোরের বাড়িতে পৌঁছে কদিন ধরে পাঁচটি বা দশটি করে মিছরির কুঁদো ও তদনুপাতে ছোয়ারা বাদাম ও মঙ্গলসূত্রসহ টাকা হাতে নিয়ে যাঁরা নূতন বধূকে দেখতে এলেন, তাঁদের কেহই প্রায় শ্বশুরকুলের সম্পর্কীয় নয়, সকলেই আর্যসমাজী ভ্রাতাদের স্ত্রী, মাতা ও বোন বা ব্যারিস্টার উকীলদের আত্মীয়া। এঁরা বাদে সর্বপ্রথম এলেন সপত্নীক লালা লালচাঁদ, লাহোরের তখনকার পিতৃনামের গোলাব সিং প্রেসের অন্যতম অংশীদার। তাঁরা দুই ভাই, মোহনলাল ও লালচাঁদ। দুজনেরই দুটি দুটি স্ত্রী, তথাপি দুজনেই অপুত্রক। এই তাঁদের মায়ের দুঃখ। লালচাঁদের প্রথমা স্ত্রী সেকেলে, পূজা-আর্চা নিয়ে থাকেন। তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী বিলাত-ফেরৎ স্বামীর অভিরুচি অনুযায়ী চলেন, ইংরেজী বলেন, স্বামীর সঙ্গে বল-ড্যান্সেও যান। সেকালের পক্ষে অত্যন্ত প্রগতিশালিত্ব। আমাকে তাঁরা দুই বাহু বাড়িয়ে অভ্যর্থনা করলেন। লালচাঁদ অতি মিশুক লোক। যখন কলিকাতায় গোলাবসিং প্রেসের শাখা খুলে অবস্থানের সঙ্কল্প করলেন, আমার পিতার কাছে পরিচয়পত্র নিলেন আমার বিশেষ বন্ধু বলে কলিকাতায় নতুন আগন্তুক হিসেবে সাহায্য পাবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কলিকাতায় তাঁর সঙ্গিনী হলেন যে স্ত্রী—যাঁর সঙ্গে আমার লাহোরে ভাব হয়েছিল তিনি নয়—ইতিমধ্যে রাতারাতি সকলের অগোচরে বিবাহিতা তৃতীয়া পত্নী। লাল লালচাঁদের সকল পুত্রকন্যারা এই স্ত্রীর গর্ভজাত। কিন্তু তাঁর ব্যবহার পূর্ব পত্নীদের প্রতিও অনবদ্য রইল, তাঁরা নিজের নিজের মহলে সমান সমাদরে স্বামি-বিচ্ছিন্ন জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে লাগলেন। তাঁর বড় ভাই মোহনলালেরও কিছুদিন পরে এক ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যার সঙ্গে তৃতীয়বার বিবাহ হলে তিনিও পুত্রলাভ করলেন। জীবনে এই প্রথম হিন্দুর বহুপত্নীকতার সঙ্গে সাক্ষাৎ সংস্পর্শ হল। একজন মাত্র দ্বিপত্নীক হিন্দুকে দেখেছিলুম ইতিপূর্বে সাতারায়, তিনি সাব-জজ সুগায়ক সোহনি সাহেব। তাঁর স্ত্রীদ্বয়ের দর্শনলাভ করিনি কিন্তু, তাঁরা আড়ালেই থাকতেন। শুনেছিলুম দুজনের বনে না। সোহনি সাহেব পুত্রার্থে দ্বিতীয় দারগ্রহণ করলেও পুত্রমুখ-দর্শনে বঞ্চিত রইলেন। হিন্দুসমাজে বহু-বিবাহ আইনসঙ্গত হলেও কার্যতঃ শিক্ষিত লোকদের একপত্নীক হওয়াই নিয়ম, একাধিক পত্নী গ্রহণ সেই নিয়মের ব্যতিক্রম, বিশিষ্ট কতকগুলি কারণে ছাড়া তা হয় না। কারণগুলির মধ্যে প্রধান কারণ অপুত্রকতা। আর এক পরিবারের মা-বাপের কাছ থেকে শিশু ছিনিয়ে এনে দত্তক করার চেয়ে অনেকে পছন্দ করেন শিশুর মা নিজেরই পত্নীপদবাচ্যা হোক—যখন আইনে তার পথ খোলা আছে। হিন্দু-গৃহে সন্তানহীনা প্রথমা পত্নী অনেক সময় নিজেই স্বামীর ভবিষ্যৎ সন্তানের মাতাকে নিজে পছন্দ করে ঘরে তোলেন, স্বামি-প্রেমের ভাগীদার করেন। এই হল রক্ত-পরাম্পরাগত হিন্দু-সভ্যতা, হিন্দু নারীর কৃষ্টি, স্ত্রীর নিজের ব্যক্তিত্বকে স্বামীর বংশরক্ষা প্রয়োজনের সঙ্গে একীভূত করা। এই সহজ আত্মবিলীনতার ভিতর কত আত্মসম্মান আছে—এ হল স্বামীর অপর স্ত্রী আসক্তির ফণিনী দংশন থেকে আত্মবিলোপ মন্ত্রবলে আত্মরক্ষা। সকলে পারে না, কিন্তু যদি কেউ পারে, তবে কি সেটা দোষের? একটা সমগ্র জাতি যদি পারে তবে সে জাতি কি নিন্দনীয়? হিন্দুর সামাজিক নতুন আইন যে বিধিবদ্ধ হতে চলেছে, তাতে অনেকগুলি আবশ্যকীয় কু-রীতির সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলি সু-রীতিরও অনাবশ্যকীয় কর্তন হতে চলেছে—একটা সাজান ফলফুলের বাগান যখন অযত্নে আগাছায় ভরে যায়, সেগুলো উপড়োতে গিয়ে যেমন ভাল ভাল দামী গাছও জড়সুদ্ধ ছাঁটা হয়ে যায়। বিবাহিত জীবনে বৈধ একপত্নীকতার নিয়মটি দেখতে অতি ভদ্রলোকের মত, কিন্তু তার আড়ালে অবৈধ বহুপত্নীকতা পাশ্চাত্য সমাজে কুৎসিতরূপে বিরাজমান। প্রাচ্যে বৈধ ভাবে পরিণীতা একাধিক স্ত্রী গৃহে সম্মাননীয়া—এমন কি রাজওয়াড়ার সপ্তপদের স্থলে ত্রিপদের ফেরে পরিণীতা সখীরাও স্বামিগৃহে ভরণপোষণের অধিকারী। পাশ্চাত্যের অবৈধভাবে উপভোগ্যা স্ত্রী সম্মানহীনা এবং তার নিজের ও সন্তানদের ভরণপোষণ নির্ভর করে পুরুষের ক্ষণিক মোহ ও মর্জির উপর। আমরা দেখতে পাই বিশেষ কারণ উপস্থিত না হলে, এককালে একাধিক বিবাহ আইন-সঙ্গত হলেও ভদ্রসমাজে তা অপ্রচলিত, তার দৃষ্টান্ত অতি বিরল। রাজা-রাজড়ার গৃহে এটা এখনও প্রচলিত থাকার একটা কারণ কন্যাবহুল রাজ-পিতামাতারা এ বিধি আইন-বিরুদ্ধ হলে বিপন্ন হবেন—তাঁরা বলেন, তাহলে ‘‘আমাদের কন্যারা যাবে কোন্‌ ঘরে?”

 প্রথম প্রথম ‘সমাজী’ অর্থাৎ আর্যসমাজী যেসব মেয়েরা আমাকে দেখতে আসতেন তাঁদের পরিচয় পেতুম কেউবা ‘চাচী’ (কাকিমা), কেউবা ‘তায়ী’ (জ্যেঠাইমা), কেউবা ‘ভাবি’ (বৌদিদি), সুতরাং ধরতে পারতুম না সত্যিকারই সম্বন্ধ—না পাতান। ক্রমে ক্রমে শ্বশুরকুলের আত্মীয়দের ও ‘সমাজী’ আত্মীয়াদের পার্থক্য পরিষ্কার হতে থাকল। শ্বশুরকুলেও আর এক নতুন জিনিস পঞ্জাবের—স্কটল্যাণ্ডের ‘clan’-এর মত, বাঙলায় তা নেই। আমার স্বামী যে শ্রেণীর ব্রাহ্মণ, জানলুম সেই শ্রেণীকে বলে মহিয়াল ব্রাহ্মণ, তাঁরা ৬টি অন্তঃশ্রেণীতে বিভক্ত—দত্ত, বালি, ছিব্বর, মোহল, লৌ ও ভীমবল। এঁদের পরস্পরের বৈবাহিক আদান-প্রদান হয়, অন্য শ্রেণীর ব্রাহ্মণকে এঁরা কন্যাদান করেন না, তাঁদের ঘর থেকে কন্যা আনতে পারেন। এঁরা সবাই শস্ত্রধারী ব্রাহ্মণ, যখন শত্রু আসে দ্বারে তখন অস্ত্র দিয়ে তার প্রতিরোধ করেন, অন্যথা জমির চাষবাস নিয়ে থাকেন—agriculturist পর্যায়ভুক্ত, land alienation act-এর দ্বারা প্রশাসিত। ইংরেজ শাসনে ভারতের দ্বার-রক্ষক এরা, ভারত সীমান্তে “Kings own guides” নামে পল্টন শুধু, এঁদেরই জাতভাইয়ের দ্বারা বিরচিত। আলেকজাণ্ডার যখন পঞ্জাবের দ্বারে সমুপস্থিত হন, এঁদেরই পূর্বপুরুষ রাজা জয়পাল ও অনঙ্গপাল তাঁকে যুদ্ধদান করেন।

 লাহোরে আমার স্বামীর বাসাবাড়ি মাত্র, তাঁর পিতৃপিতামহাগত গৃহ ও জন্মভূমি ‘কঞ্জরূর’এ। সে গ্রামখানি হিমালয়ের পাদতলে গুরুদাসপুর জেলায় অবস্থিত। তার পুরো নাম—‘কঞ্জরূরএ দত্তা’ অর্থাৎ দত্তদের কঞ্জরূর। কিম্বদন্তী এই, একবার লাহোরের এক নবাবের জন্য একটি সুন্দরী রাজপুত-কন্যা হরণের প্রচেষ্টায় এঁদের কোন পূর্বপুরুষ বাধা দিতে গিয়ে সবংশে নিহত হন। কিছুকাল পরে সেই নবাব কি এক প্রকার কর্ণপীড়াগ্রস্ত হন। অনেক হাকিম-বৈদ্য দেখান হল—কিন্তু কেউ কিছু করতে পারলে না। শেষে একজন জ্যোতিষী বললেন,—“অমুক যুদ্ধে আপনার দ্বারা অসংখ্য ব্রাহ্মণ-হত্যা হয়েছে—তার ফলে এই শাস্তি। প্রায়শ্চিত্ত না করলে এ শাস্তির অপনোদন হবে না—আপনার কর্ণপীড়া সারবে না।”

 “কি প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে?‘‘

 “সেই দত্ত-বংশের কোন সন্তান যদি আজও জীবিত থাকে খুঁজে বের করুন। তারই থুঁতুতে আপনার কানের ঘা সারবে, আর ওষুধ নেই।”

 চারিদিকে খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল। নবাবের চরেরা সন্ধান পেলে যুদ্ধকালে একটি গর্ভিণী দত্তকুলবধূ, তাঁর পিত্রালয় শেয়ালকোটে ছিল। দত্তকুল নির্মূল হলে সেখানে তার দুটি যমজ পুত্র ভূমিষ্ঠ হয়। মাতুল ভাগিনেয় দুটিকে অতি সঙ্গোপনে রক্ষা করছিলেন। নবাবের গুপ্তচর এসে তাদের লাহোরে ধরে নিয়ে গেল। সেখানে নবাবের শয়নকক্ষে নবাবের কাছে সমুপস্থিত করে হাকিম আদেশ দিলেন—“নবাব বাহাদুরের কানে থুঁতু ফেল।” শিশু, দুইটি ভয়ে আড়ষ্ট। অনেক পীড়াপীড়ি, অনুনয়বিনয়, ভয় দেখানর পর তারা অগত্যা তাই করলে। কিছুদিন পরে নবাব নীরোগ হয়ে উঠলেন। তখন দুই ছেলেকে দুই ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে নবাব স্বয়ং আদেশ দিলেন—“ঘোড়া ছুটিয়ে দুজনে দুদিকে বেরও। চব্বিশ ঘণ্টা ধরে ঘুরে প্রতি ঘোড়া যতটা ভূখণ্ড পরিভ্রমণ করবে ততটার নিষ্কর মালিক হবে তার আরোহী।”

 এক ঘোড়া শিয়ালকোট জিলার ডাফরওয়ালের দিকে গেল, আর এক ঘোড়া গুরুদাসপুর জিলার কঞ্জরূরের দিকে। এই দুই ভূখণ্ডে দুই দত্তবংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল।

 কঞ্জরূরে অবস্থিতির পরও অনেকানেক যুদ্ধে দত্তরা নিযুক্ত হয়েছেন, শান্তিময় জীবন অতিবাহিত করেননি। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত হওয়াটা তাঁদের পক্ষে সাধারণ কথা—যেমন সচরাচর লোকের পক্ষে রোগাক্রান্ত হয়ে বিছানায় মৃত হওয়া। কিন্তু ‘শহীদ’—martyr—উপাধি সেই পায় যে অসাধারণ বীরত্ব দেখাতে দেখাতে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণদান করে। এ কালের Victoria Cross-এর বীরত্ব তার সঙ্গে কতকটা তুলনীয়। কঞ্জরূরী দত্তদের এক পূর্বপুরুষ আততায়ীদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে ‘শহীদ’ বা martyr হয়েছিলেন। তাঁর নাম বাবা অটল খাঁ। কঞ্জরূরে তাঁর সমাধি অবস্থিত, একটা মাটির ঢিবি, অনতিউচ্চ মাটির দেওয়ালে ঘেরা। সন্ধ্যা হলে আশপাশের গ্রাম থেকে হিন্দু-মুসলমান উভয় শ্রেণীর স্ত্রী-পুরুষেরা আসে সমাধির উপরে। নিজের নিজের দীপ জ্বালায়। দত্তদের সামাজিক প্রথা এই যে, মুণ্ডন, উপনয়ন, বিবাহাদি ক্রিয়াকর্মে কর্মকর্তা ও কর্মকর্ত্রীরা এই সমাধিতে এসে শহীদের স্মরণে প্রণিপাত করে পুষ্পাঞ্জলি ও কড়াপ্রসাদ (মোহন ভোগ) নিবেদন করেন। এটি একটি অবশ্যকর্তব্য কর্ম, সব শেষে এইটি না হলে কোন সামাজিক কাজ সম্পূর্ণ হয় না। আমার স্বামী সসঙ্কোচে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,—‘‘আমাদের কুলের এই রীতি তুমি অনুসরণ করবে কি? নববিবাহিত বধূর সেখানে গিয়ে প্রণিপাত করার নিয়ম মানবে কি? এটা কুসংস্কার ভেবে যদি বর্জন করতে চাও আমি আপত্তি করব না।” আমি বললুম—“নিশ্চয়ই মানব। কুসংস্কার কিসের? এ ত গৌরবের কথা যে এমন ঘরে পড়েছি যাঁদের বংশে এতবড় বীরপুরুষ জন্মেছিলেন যিনি ‘শহীদ’ বলে আজও গণ্য ও পূজ্য, যাঁর স্মৃতি আজও উত্তরপুরুষদের গর্ব ও উৎসাহের কারণ।” আমার কঞ্জরূরে আদি শ্বশুরালয়ে যাওয়ার দিন ধার্য হল। লাহোর থেকে অমৃতসহরে গিয়ে সেখানে গুরুদাসপুরের ট্রেন ধরতে হয়। মধ্যপথে বাটালা শহর আসে। সেই পর্যন্ত রেলে যাত্রা। সেখানে নেমে টঙ্গা বা এক্কাযোগে ডেরা বাবানথনকে পৌঁছে রাবী নদী পার হতে হবে। নদীর উপর খুব চওড়া নৌকায় মানুষ, গরু, ঘোড়া সব পার হচ্ছে। অল্পক্ষণেই ওপারে পৌঁছন গেল। এখানে আর সকলের জন্যে ঘোড়া অপেক্ষা করছে, আমার জন্যে ডুলি—এদেশে পাল্কী পাওয়া যায় না। ডুলি চড়ে রীতিমত কনে বউয়ের মত আট-দশ মাইল গিয়ে আবার একটি ছোট্ট স্বল্পতোয়া নদীর ধারে পৌঁছলুম, নদীর নাম বসন্তর—তার ওপারেই কঞ্জরূর। বেহারারা ডুলিসমেত হেঁটে নদী পার হল, অশ্বারোহীরাও নদীর উপর দিয়ে ঘোড়া হাঁটিয়ে নিয়ে গেলেন। ওপারে গ্রাম্য লোকেরা ও অনেক আত্মীয়-আত্মীয়ারা সমবেত হয়েছেন। বেহারাদের কাঁধ থেকে ডুলি নামিয়ে তাঁদের যা যা মঙ্গলাচার করবার, তা করলেন। এদেশে শাঁখ বাজান বা উলু দেওয়া নেই; কিন্তু দীপ হাতে নিয়ে বরণ করা আছে। বাড়ি পৌঁছে আহারান্তে বিশ্রাম করলুম। বিশ্রামস্থল নিভৃত নয়, আত্মীয়স্বজন পূর্ণ। বিকেল হতে না হতে উঠে বসতে হল। আশপাশের পাঁচটি গ্রাম থেকে লোকস্রোত বয়ে আসছে—কলকাতা হতে আসা বি-এ পাশ-করা চৌধুরী সাহেবের নতুন বউকে দেখতে। সবাই আশ্চর্য যে এতটা লেখাপড়া জানা মেয়ে শ্বশুরদের ক্ষুদ্র গ্রামে আসতে রাজী হল—আর সে নাকি ‘বাবা ঠক্করের মহলে’ গিয়ে মাথা টেকবে—অর্থাৎ প্রণত হবে।

 এ বিষয়টা নিয়ে লাহোরেও পরে খুব চর্চা হয়েছিল। পঞ্জাব ব্রাহ্মসমাজের মেয়েদেরও তাদের সনাতনী আত্মীয়স্বজনেরা আমার দৃষ্টান্তের

অনুসরণ করে চলতে অনুনয় করেছিলেন, ব্রাহ্মসমাজী হলেই সব স্বদেশী আচার ও কুলাচার বর্জন যে অত্যাবশ্যক নয় তা আমার ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বোঝান হয়েছিল। প্রায় মণখানেক মোহনভোগ সঙ্গে নিয়ে পরের দিন 'বাবা ঠক্কর মহলে' অর্থাৎ বাবাঠাকুরের —বাবা অটল খাঁর—সমাধি অভিমুখে সকলে মিলে যাত্রা করলেন। সেখানে কয়েকবার সমাধি প্রদক্ষিণ করে, প্রণাম করে, দীপদান করে প্রসাদ নিবেদন করা হল। সেই প্রসাদ গ্রামসুদ্ধ সকলের ঘরে ঘরে একটু করে বিতরণ করা হবে।

 মাটির প্রাচীরটি প্রতি বছর বর্ষাকালে ধুয়ে ভেঙ্গে যায়। সেটি ইটের পাকা গাঁথুনি করে দেবার জন্যে সমাধিরক্ষক আমায় অনুরোধ জানালেন। আমি তাতে স্বীকৃত হয়ে যত খরচ হবে তার একটা এস্টিমেট আমায় পাঠাতে বললুম এবং কার্যারম্ভের জন্যে অগ্রিম দুই শত টাকা তার হাতে দিয়ে এলাম। চার-পাঁচদিন কঞ্জরূপে থেকে, শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কিত নিকট ও দূরের প্রত্যেক আত্মীয় ও আত্মীয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁদের আশীর্বাদ নিয়ে লাহোর ফিরলুম।

 বলেছি পঞ্জাবের এক এক জাতি এক একটি 'clan' এর মত। তাঁদের পিতৃ-পিতামহাগত কুলপ্রথা, আচ্যর ও সামাজিক বন্ধনে এক একটি বিশেষত্ব আছে। সে বিশেষত্ব আজ পর্যন্ত রক্ষিত হয়ে চলেছে। তাঁদের সামাজিক মিলনে ধনিদরিদ্রের ভেদ নেই। একজন হাইকোর্টের জজ ও ডাকপিয়নও সমান আসন লাভ করে সামাজিক মেলামেশায়। ছেলেমেয়ের বিবাহ উপলক্ষে খরচের নিয়ম বাঁধা আছে—বড়মানুষ বলে মেয়ের বিবাহে এতটা কিছু যৌতুক দিতে পারবে না বা ধূমধাম করতে পারবে না, যা একজন গরীবও নিজের মেয়ের বেলায় না পারবে। সব বাঁধাদস্তুর আছে—এতগুলো রেশমী জোড়, এতগুলো সূতির, বরযাত্রীদের এই এই খাওয়ান ইত্যাদি। বরেদের তরফ থেকে মেয়ের বাপের কাছে বরপণ চাওয়ার নিয়ম নেই, তাতে যেন মেয়েকে বিক্রয় করা হয় —অতি ঘৃণ্য কাজ।

 বংশের কীর্তিগায়ক একটি জাতি আছে—তাদের বলে 'মিরাসি'— স্কচ 'Pipers'দের মতো। ভাট নয় তারা, ভাটও আছে, কিন্তু তারা ব্রাহ্মণ আর মিরাসিরা এককালে হিন্দ, হলেও মুসলমান প্রভাবে মুসলমান-ধমী হয়ে গেছে। বিবাহাদি সংস্কারে মিরাসিদের পাওনা একটা বড় পাওনা—সেইটে প্রত্যেক ক্রিয়াকর্মের অঙ্গীভূত প্রধান খরচ। প্রত্যেক পরিবারের সঙ্গে এক এক ঘর মিরাসিরা সংযুক্ত। সমাগত অতিথিরা যখন খেতে বসেন তখন মিরাসিরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের কীর্তিকলাপ গাইতে থাকে। শুনতে শুনতে গর্বে শ্রোতাদের বুক ফুলে ওঠে। যজমানদের সেই ‘অতীত গৌরব বাহিনী বাণী’ মিরাসিদের বংশপরম্পরাগত খাতায় ভরা আছে, অপলাপ হবার যো নেই, ভোলবার যো নেই। এখন তাদের সন্তানসন্ততি এত বেড়ে গেছে যে তাদের প্রত্যেকের প্রতিপালন যজমানদের দানে সঙ্কুলান হওয়া সম্ভব নয়, তাই এখন তারা পঞ্জাবের সর্বত্র চাকরি খুঁজে ছড়িয়ে পড়ছে। এখনও অনেক ঘর কিন্তু কঞ্জরূরে বসবাস করে। আমি সেখানে পৌঁছলে—‘গউহর’ বলে শ্বশুরকুলের মিরাসি আমার অভ্যর্থনার জন্যে এসে সম্মুখে দাঁড়িয়ে দত্তবংশের কীর্তিগাথা গাইতে লাগল। কোন স্ত্রীলোকের জন্যে এটা করা দস্তুর নয়—আমার বেলা সে নিয়মের ব্যতিক্রম হল। এই প্রথম কঞ্জরূরের চৌধুরাণী সেখানকার চৌধুরীদের সমতুল্য গণনীয় হল।