জোড়া পাপী/প্রথম পরিচ্ছেদ
জোড়া পাপী।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
একদিন বৈশাখের রৌদ্রসিক্ত মধুময় প্রভাতে জনমানব-সমাকীর্ণ ধূলিপূর্ণ মহানগরীর একটা থানার কোন নিভৃত প্রকোষ্ঠে বসিয়া আমার এক বন্ধুর সহিত একটা রহস্যপূর্ণ হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে কথা কহিতেছিলাম, এমন সময়ে সহসা টেলিফোনের ঘণ্টা টুং টুং করিয়া অকুল-আহ্বান করিল। তাড়াতাড়ি চেয়ার হইতে উঠিয়া আমি সেই যন্ত্রের নিকট গমন করিলাম এবং অনুচ্চস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কে?”
উত্তর হইল, “আপনি কে আগে বলুন?”
আমি নিজের নাম বলিলাম।
উত্তর হইল, “আমি পুলিশ সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট। চিৎপুররোডের উপর একটা ভয়ানক হত্যাকাণ্ড হইয়াছে। এখনই একজন সুদক্ষ গোয়েন্দার প্রয়োজন। অপর কোন বিচক্ষণ ডিটেকটভি উপস্থিত না থাকায় আপনাকেই উহার তদন্ত করিতে যাইতে হইবে। জন কনষ্টেবলের নিকট অন্যান্য সংবাদ শিখিয়া আপনার থানায় পাঠাইলাম। সে পৌছিবা মাত্র আপনি গমন করিবেন। প্রথম হইতে তদন্ত না হইলে খুনিকে ধরা যাইবে না। আপনি প্রস্তুত হউন, অধিক বিলম্ব করিবেন না।”
বন্ধু সহিত যে বিষয়ের কথোপকথন হইতেছিল, তাহা স্থগিত রাথিয়া দুঃখিতান্তঃকরণে বন্ধুরকে বিদায় দিলাম। তিনিও খানা হইতে বাহির না হইতে হেড অপিস হইতে সেই কনষ্টেবল আলিয়া উপস্থিত হইল। তাহার নিকট যে পত্র ছিল, তাহা গ্রহণ করিয়া একবার পাঠ করিলাম। বুঝিলাম, অতি প্রত্যুষে ট্রাম লাইনের ঠিক মধ্যে একটা সুন্দরী যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। রমণীকে দেখিয়া ভদ্রয়ের মেয়ে বলিয়াই বোধ হয়। আপনি সেই স্থানে এখনই গমন করিয়া ঐ অনুসন্ধানে লিপ্ত হউন।
মুহুর্ত্ত মাত্র বিলম্ব না করিয়া তখনই থানা হইতে বহির্গত হইলাম; এবং একখানি সেকেণ্ডক্লাস, ভাড়াটায়া গাড়ীতে গারোহণ করিয়া অবিলম্বে কার্য্যস্থানে গমন করিলাম।
গাড়ীখানি যখন ঘটনার স্থলে আসিল, তখন বেলা প্রায় আটটা, সেই স্থানে গিয়া দেখিলাম, লোকের ভয়ানক ভিড় হইয়াছে। তাহার মধ্যে স্থানীয় থানার ইন্সপেক্টার বাবুও আছেন।
থানার ইন্সপেক্টারবাবু আমার পরিচিত। আমার সহিত তাঁহার বেশ সম্ভাবও ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য আমাকে নিযুক্ত দেখিয়া তিনিও আন্তরিক অনিন্দিত হইলেন; এবং আমাকে সেই শবদেহ দেখাইলেন।
শবদেহ পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, উহা তখনও বিকৃত হয় নাই; গুরুতর আঘাতে উহার নাক, মুখ ও চোক যেন হেঁচিয়া গিয়াছে, বক্ষঃস্থল যেন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। পীনোন্নত পয়োধরু যুগলের মধ্যস্থ স্থান যেন একেবারে দমিয়া গিয়াছে। মুখ ও নাসিকা দিয়া অনেক রক্ত বাহির হইয়াছে।
রমণীকে দেখিয়াই সত্য সত্যই ভদ্রঘরের মেয়ে বলিয়া বোধ হইল। রমণী যুবতী এবং সত্যই অনিন্দ্যসুন্দরী। কিরূপে কোন্ সময়ে এই কাণ্ড ঘটিল জিজ্ঞাসা করায়, ইন্সপেক্টরবাবু উত্তর করিলেন, “বেগ ছয়টার সময় একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ী চিৎপুর রোড দিয়া উত্তর মুখে যাইতেছিল। গাড়ীখানি কিছু আস্তে আস্তেই যাইতেছিল। ঠিক সেই সময়ে একখানি টামগাড়ী অতি দ্রুতবেগে দক্ষিণ দিক হইতে উত্তর দিকে যাইতেছিল। টমখানি যখন কিছুদূর দক্ষিণে ছিল, সেই সময়ে সহসা সেই ভাড়াটীয়া গাড়ীর দরজা খুলিয়া গেল এবং নিমেষ মধ্যে ঐ সুন্দরী রমণী যেন গতিশীল উমের সম্মুখে নিক্ষিপ্ত হইল। ট্রামখানি সাত আটহাত দূরে ছিল, কিন্তু চালক অত্যন্ত বিচক্ষণ থাকায় সে একেবারে গাড়ীর গতিরোধ করিল। সকলেই ভাবিয়াছিল, রমণী বাঁচিয়া গেল। কিন্তু যেরূপ বলে সে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, তাহাতে তাহাকে আর কেহ জীবিত অবস্থায় দেখিতে পায় নাই। পতন গাত্রেই তাহার মৃত্যু হইয়াছিল। ইত্যবসরে পথে লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল; এবং সেই ভাড়াটীয়া গাড়ীর ভিতর হইতে এক যুবক সহসা সকলের অগোচরে কোথায় যে পলায়ন করিল, তাহা কেহই বলিতে পারিল না। ভাড়াটায়া গাড়িখানি অগত্যা ধৃত হইয়া থানায় আনীত হইয়াছে। টামগাড়ীর নম্বর এবং কণ্ডাক্টর ও চালকের নাম ও নম্বর সমস্তই লিখিত আছে। প্রয়োজন হইলেই তাহারা আসিয়া হাজির হইবে।”
ইন্সপেক্টারবাবুর কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,“কে সেই ভাড়াটা গাড়ীর ভিতর ছিল, তাহা কি জানিতে পারিয়াছেন? এত লোকের চক্ষে ধূলি দিয়া সে কেমন করিয়া পলায়ন করি বলিতে পারেন?”
ইন্সপেক্টারবাবু বলিলেন, “আমি কোচমানকে ডাকিতে পাঠাই তেছি। তাহার মুখে সকল কথা শুনিলে এ রহস্য অনেকটা বুঝিতে পারিবেন। সেই স্থানে উপস্থিত লোকদিগের মধ্যে কেহই গাড়ীর ভিতরে কোন লোককে দেখে নাই। কিন্তু কোচমান বলিতেছে, একজন পুরুষ ও একজন, মণী তাহার গাড়ীতে ছিল। সেই জই অনুমান হইতেছে, লোকটা সকলের অগোচরে পলায়ন করিয়াছে।”
কিছুক্ষণ পরে কোচমন আসিয়া উপস্থিত হইল। আমাকে দেখিয়াই সে ভয়ে কাপিতে লাগিল। একে বৃদ্ধ, তাহাতে জীর্ণ শীর্ণ, আমি তাহাকে অভয় দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোথা হইতে সওয়ারি লইয়াছিলে?”
সভয়ে হাত জোড় করিয়া কোচমান বলিল, “আজ্ঞে হাওড়া ষ্টেশন হইতে।”
আ। কোথায় যাইতেছিলে?
কো। বাগবাজারে।
আ। কয়জন সওয়ারি ছিল?
কো। আজ্ঞে দুই জন, একজন পুরুষ আর একজন স্ত্রী লোক।
আ। যিনি মারা পড়িয়াছেন, সেই স্ত্রীলোক কি তোমার গাড়ীতে ছিল?
কো। আজ্ঞে হ্যাঁ।
আ। পুরুষটি কোথায়?
কো। আজ্ঞে সে কথা বলিতে পারিলাম না। যখন আমার গাড়ী হইতে স্ত্রীলোকটা পড়িয়া যায়, তখন আমার এত ভাবনা হইয়াছিল যে, অপর কোন কথা আমার মনোমধ্যে স্থান পায় নাই। বলিতে পারি না, কোন সময়ে বাবু আমাদের চকে ধুর দিয়া পলায়ন করিয়াছেন।
আ। পথে আর কোথাও তোমার গাড়ী থামাইয়াছিলে?
কো। অজ্ঞে না। বাবু আমাকে সেরূপ করিতে বলেন ফো। নাই।
কিছুক্ষণ চিন্তার পর আমি পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলাম, “বাবুর নাম ধাম তোমার জানা আছে?
কোচমান ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “না হুজুর! আর কখনও তাহাকে দেখিয়াছি বলিয়া বোধ হয় না। বাবু বোধ হয় কোন দুর দেশ হইতে আসিয়াছেন।”
আ। বাবুর সঙ্গে কোন জিনিষ পত্র ছিল না?
কো। ছিল বই কি! সমস্তই ত থানায় জমা আছে।
ইন্সপেক্টারবাবু কিছুদূর বসিয়াছিলেন। কোচমানের কথায় সায় দিয়া বলিলেন, “হাঁ, একটা ট্রাঙ্ক ও একখানা কম্বলমোড়া একটা বালিস। সম্ভবতঃ বিছানা গাড়ীর চালে ছিল, সেগুলি আমারই নিকট আছে। বলেন ত এখানে আনিতে আদেশ করি।