জ্ঞাতি-শত্রু/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
বেলা একটার পর ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া পদব্রজেই শক্তিসাধনের বাড়ীর দিকে গমন করিলাম। ভাবিলাম, যখন শক্তিসাধনের সহিত ডাক্তার বাবুর এত আলাপ, তখন উহাঁর সাহায্যে হয় ত তাঁহাকে শীঘ্র পাওয়া যাইবে। এই চিন্তা করিয়া অগ্রে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে মনস্থ করিলাম এবং তখনই তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম।
শক্তিসাধন নীচেকার একটী ক্ষুদ্র গৃহেই বসিয়াছিলেন, আমাকে দেখিয়াই রাগিয়া উঠিলেন এবং অতি কর্কশ স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি? এমন সময়ে এ বাড়ীতে কেন? সমস্ত দিনই কি ভিক্ষা দেওয়া যায়? তিন করিবার কি সময় অসময় নাই?”
শক্তিসাধনের কথায় আমি আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলাম। ভাবিলাম, তিনি আমায় চিনিতে পারেন নাই বলিয়াই বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিতেছেন। আমি কিন্তু তাঁহার কথায় রাগ করিলাম না। অতি বিনীতভাবে বলিলাম, “না মহাশয়, আমি ভিক্ষা করিতে এখানে আসি নাই। আপনার নিকটে কোন বিষয়ে সাহায্য প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি।”
শক্তিসাধন আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার নিকটে? কিসের সাহায্য? আমায় এখন সাহায্য করিবার সময় নাই। কাল আমার ভ্রাতৃ বিয়োগ হইয়াছে, এখন আমার মন স্থির নহে।”
আমি আরও বিনীতভাবে বলিলাম, “সামান্য দয়া করিলেই আমি উপকৃত হই। আমি বড় গরীব।”
শ। কি করিতে হইবে বল?
আ। আপনার সহিত ডাক্তার বাবুর বেশ আলাপ আছে জানি। আপনি যদি তাঁহাকে একবার আমাদের বাড়ীতে বিনা ভিজেটে যাইতে বলেন, তাহা হইলে একটী রমণী রক্ষা পায়।
শক্তিসাধন আত্ম প্রশংসায় আন্তরিক আনন্দিত হইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডাক্তার বাবু কে? কেদার বাবু?”
আ। আজ্ঞে হাঁ।
শ। তোমার বাড়ী কোথায়?
আ। আমাদের বাড়ী বর্দ্ধমান জেলায়। এখানে জোড়াবাগানে বাসা।
শ। ডাক্তার বাবু ত অনেক স্থানেই কিনা ভিজিটে গিয়া থাকেন। অক্ষম দেখিলেই তিনি ভিজিট ছাড়িয়া দেন।
আ। আমি ত তাহা জানিতাম না। আর তাহা হইলেও আমি যখন তাঁহার পরিচিত নহি, তখন কেমন করিয়া তাঁহাকে এ প্রকার অনুরোধ করিব।
শক্তিসাধন তখনই গাত্রোখান করিলেন এবং আমাকে সঙ্গে লইয়া একখানি দ্বিতল অট্টালিকার দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন। দেখিলাম, সেই-ই ডাক্তারখানা।
শক্তিসাধন আমাকে লইয়া বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিতে না করিতে একজন যুবক বলিয়া উঠিলেন, “কেও, শক্তি বাবু! এমন অসময়ে কেন?”
শক্তিসাধন হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলেন, “আর ভাই! তোমার কাছে আসিব, তাহার আর সময় অসময় কি? এখন এই লোকটীর সঙ্গে একবার জোড়াবাগানে যাইতে হইবে।”
এই বলিয়া শক্তিসাধন তাঁহার নিকটস্থ একখানি চেয়ারে উপবেশন করিলেন। আমি তাঁহাদের নিকট দাঁড়াইয়া রহিলাম। যে বেশে সেখানে গিয়াছিলাম, তাহাতে তাঁহাদের নিকটে বসিতে সাহস করিলাম না।”
দুই একটা অন্য কথা কহিয়া ডাক্তার বাবু আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাহার কি হইয়াছে বাপু?”
আমি অতি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, “আমাদের বাসার একটী স্ত্রীলোকের গাত্রে কি সব দাগ হইয়াছে। লোকে বলিতেছে, পারা ফুটিয়াছে। জোড়াবাগানের অনেকেই আপনাকে বিশেষ চেনে, তাঁহারাই আমাকে আপনার নিকটে আসিতে বলিয়াছিলেন। যদি দয়া করিয়া একটীবার দেখিয়া আসেন, তাহা হইলে সে রমণী এ যাত্রা রক্ষা পায়।”
ডাহার বাবু তখন উপস্থিত দুই চারিটা রোগী দেখিয়া গাত্রোত্থান করিলেন, সদরদ্বারেই তাঁহার গাড়ী অপেক্ষা করিতে ছিল। তিনিই অগ্রে তাহাতে আরোহণ করিলেন। পরে, আমাকেও উঠিতে আদেশ করিয়া কোচমানকে শকট চালনা করিতে বলিলেন।
কিছুদূর যাইলে পর ডাক্তার বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “যে স্ত্রীলোকটীর পীড়া হইয়াছে, তিনি আপনার কে?”
আমি কেবল হাসিলাম, কোন উত্তর করিলাম না, তিনিও আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। বোধ হয় আমাকে হাস্য করিতে দেখিয়া রমণীকে আমারই আশ্রিতা বলিয়া মনে করিয়াছিলেন।
আরও কিছুক্ষণ পরে তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “পূর্ব্বে কোন প্রকার চিকিৎসা হইয়াছিল কি?”
আ। আজ্ঞে হাঁ, তবে কোন ডাক্তার দেখেন নাই। জোড়াবাগানেই একজন বৃদ্ধ আছেন, তিনি ঐ প্রকার দুই একটা রোগের চিকিৎসা করেন। আমি তাঁহাকেই একবার দেখাইয়া ছিলাম।
ডা। তিনি কি ঔষধ দিয়াছিলেন?
আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, “কি ঔষধ জানি না। কাগজে কি লিখিয়া দিয়াছিলেন, তাহাও জানি না। কিন্তু যখন ঔষধটী কিনিতে যাই, তখন একজন সেই কাগজখানি পড়িয়া বলিয়াছিল, তাহাতে “আসে নি” নামে কি বিষ আছে। বিষের নাম শুনিয়া আমি আর সে ঔষধ ক্রয় করি নাই।
আমার কথা শুনিয়া ডাক্তার বাবু হাসিয়া উঠিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বিষ? আসে নি? না যায় নি?”
আমি যেন অত্যন্ত অপ্রতিভ হইলাম। লজ্জার হাসি হাসিয়া বলিলাম, “আমরা সামান্য লোক, লেখাপড়া শিক্ষা করি নাই। আমাদের মুখ দিয়া কি সকল কথা ঠিক বাহির হয়। আমরা কি সকল কথা উচ্চারণ করিতে পারি? আপনি একজন বিখ্যাত ডাক্তার, নিশ্চয়ই আমার কথা বুঝিতে পারিয়াছেন। ঐ নামে সত্যই কি কোন বিষ আছে?”
“আছে বই কি! কিন্তু তাহার নাম আর্সেনিক, আসেনি নয়, বাঙ্গালায় উহাকে সেঁকো বিষ বলে।”
“বাজারে পাওয়া যায়?”
“যায় বই কি? কিন্তু সকলকে দেয় না।”
“কেন? সেটা যখন ঔষধে ব্যবহার হয়, তখন দেয় না কেন?”
ডা। অনেকে ঐ বলিয়া ক্রয় করিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে। এই জন্যই এখন আর ঐ দ্রব্য সকলকে বিক্রয় করে না। সে দিন শক্তিসাধনের স্ত্রী দন্তের যন্ত্রণায় ভয়ানক কষ্ট পাইতেছিলেন। পূর্ব্বে আমি তাঁহাকে একবার ঐ ঔষধের সাহায্যে যন্ত্রণা হইতে মুক্ত করিয়াছিলাম। শক্তিসাধন তাহা বেশ জানিতেন, সে দিন আমি কলিকাতায় ছিলাম না। সুতরাং সেই ঔষধের জন্য শক্তি বাবুকে অন্যান্য ঔষধালয়ে যাইতে হইয়াছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, সমস্ত দিন চেষ্টা করিয়াও, কলিকাতায় প্রায় সকল দোকানে ঘুরিয়াও, তিনি উহা ক্রয় করিতে পারেন নাই। অবশেষে রাত্রি দশটার সময় আমি বাড়ীতে আসিলে আমার নিকট হইতে লইয়া যান।”
আমার কৌতুহল বর্দ্ধিত হইল। জিজ্ঞাসা করিলাম, “তাঁহার স্ত্রীর যন্ত্রণার লাঘব হইয়াছিল?”
ডা। নিশ্চয়ই তিনি সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হইয়াছিলেন।
আ। এ কাণ্ড কবে হইয়াছিল?
ডা। বেশী দিন নয়, তিন চারি দিনের অধিক হইবে না।
অ। আপনি তাঁহাকে প্রয়োজন মতই দিয়াছিলেন?
ডা। না, তাহার অপেক্ষা কিছু বেশী দিয়াছিলাম।
আ। কেন?
ডা। যদি আবার প্রয়োজন হয়।
আ। তবে বুঝি ঐ ঔষধে দন্তরোগ একেবারে আরোগ্য হয় না?
ডা। দন্তরোগ প্রায়ই একবারে যায় না। কেবল কিছু দিনের মত ভাল হয়, আর তদ্ভিন্ন ঐ ঔষধ ব্যবহার করিলে তৎক্ষণাৎ যাতনার লাঘব হয়।
আমি তখন ঐ বিষয়ে আর কোন কথা না বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “শক্তিবাবুর সহিত আপনার বড় সদ্ভাব বলিয়া আমি আগে তাঁহারই নিকট গিয়াছিলাম। তিনি যদি আপনাকে অনুরোধ না করিতেন, তাহা হইলে আমি যে কোথা হইতে ভিজিট সংগ্রহ করিতাম বলিতে পারি না। শক্তি বাবু বড় দয়ালু।”
ডাক্তার বাবু আমার কথায় সায় দিয়া বলিলেন, “হাঁ, তিনি বাস্তবিক বড় দয়াবান। আর সেই জন্যই তাঁহার সহিত আমার এত আলাপ।”
আ। শক্তি বাবুর দাদার স্বর্গলাভ হইয়াছে শুনিয়াছেন কি?
ডা। হাঁ—শুনিয়াছি।
আ। শুনিয়াছি, তাঁহার মৃতদেহের সৎকারের সময় না কি গোলযোগ হইয়াছিল?
ডা। হাঁ—তাহাও শুনিয়াছি।
আ। তবে কি সত্য সত্যই তিনি বিষ খাইয়া মারা পড়িয়াছেন?
ডা। কেমন করিয়া জানিব! সরকারি ডাক্তার না কি তাঁহার পেটের ভিতর হইতে বিষ বাহির করিয়াছে?
কিছুক্ষণ কোন কথা না কহিয়া পরে আমি অতি গোপনে বলিলাম, “কতলোকে যে কত কথা বলিতেছে, তাহার স্থিরতা নাই। কেহ বলিতেছে, কোন জ্ঞাতিই তাঁহাকে হত্যা করিয়াছেন, কেহ বা বলিতেছে, শক্তিবাবুই তাঁহার দাদার কোন খাদ্য দ্রব্যের সহিত বিষ মিশাইয়া তাঁহাকে হত্যা করিয়াছেন। কাহার কথাই বা বিশ্বাস করি?”
আমার শেষোক্ত কথাগুলি শুনিয়া ডাক্তার বাবু স্তম্ভিত হইলেন। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সত্য না কি? শক্তির উপরে সন্দেহ করিতেছে?”
আ। আজ্ঞে হাঁ, তাঁহারা বলেন, তিনি কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন যে, তাঁহার দাদার কোন খাদ্যদ্রব্যের সহিত বিষ মিশ্রিত ছিল?
ডাক্তার বাবু ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলেন, “এই কারণ? হরিসাধনের সহসা মৃত্যু হওয়ায় তাঁহার ভ্রাতা, স্ত্রী বা অন্য কোন আত্মীয়ের সন্দেহ না হইবে কেন? বিশেষতঃ আহারের পূর্ব্বে তিনি বেশ সুস্থ ছিলেন। আহার করিবার পরই রোগের সূত্রপাত হয়।”
আমি অতি বিনীত ভাবে বলিলাম, “সন্দেহ হইতে পারে কিন্তু সন্দেহ করিয়া থানায় সংবাদ দিতে সাহস হয় কি? পুলিসের গোচর করা নিতান্ত সহজ কথা নহে। যদি প্রমাণিত না হইত, তাহা হইলে শক্তিবাবু সহজে নিষ্কৃতি পাইতেন না। সকলেই বলিতেছে, তিনি ঐ বিষয় নিশ্চয়ই জানিতেন। না জানিলে, কেবল সন্দেহ মাত্র করিয়া তিনি থানায় সংবাদ দিতে সাহস করিতেন না।”
আমার শেষোক্ত কথাগুলি বলা ভাল হয় নাই। কেন না, ঐ কথা শুনিয়া ডাক্তার বাবু আমাকে একবার ভাল করিয়া দেখিলেন। পরে কি ভাবিয়া বলিলেন, “তোমাকে যেন আর কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া বোধ হইতেছে। তোমার নাম কি বল দেখি? আর এই জোড়াবাগানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তোমার বাসা কোথায় কোচমানকে বলিয়া দাও?”
আমি দেখিলাম, সত্যই আমরা জোড়াবাগানে আসিয়া পঁহুছিয়াছি। বাস্তবিক সেখানে আমার কোন বাসা বাড়ী নাই। আমি ডাক্তার বাবুর মুখের কথা শুনিবার জন্যই এই উপায় অবলম্বন করিয়াছিলাম। এখন ডাক্তার বাবুর কথা শুনিয়া আত্মগোপন করিবার আবশ্যকতা বুঝিলাম না। ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, “আপনাকে বৃথা কষ্ট দিলাম বলিয়া ক্ষমা করিবেন। কোন রোগী দেখাইবার জন্য আমি আপনাকে এখানে আনি নাই। যে কারণে এই কষ্ট স্বীকার করিলাম, তাহাতে সফল হইয়াছি।”
আমার কথায় ডাক্তার বাবু আর একবার আমার আপাদ মস্তক নিরীক্ষণ করিলেন। পরে হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আপনাদের বাহাদুরী আছে। যেরূপ ছদ্মবেশ করিয়াছেন, তাহাতে কেহ যে আপনাকে চিনিতে পারিবে এমন বোধ হয় না। যাহা হউক, আপনাদের অসাধ্য কার্য্য নাই। আমাকে কি করিতে বলেন?”
আ। আপনাকে প্রধান সাক্ষী হইতে হইবে।
ডা। কেন?
আ। আপনিই শক্তিবাবুকে আর্শেনিক দিয়াছিলেন।
ডা। তাহাতে কি? বিশেষতঃ ঐ বিষ আমি তাঁহার স্ত্রীর রোগের জন্য ব্যবহার করিতে দিয়াছিলাম।
আ। সত্য কিন্তু শক্তি বাবু সে বিষ কৌশলে জ্যেষ্ঠের খাদ্য দ্রব্যের সহিত মিশাইয়া দেন, তাহাতেই তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। এখন আপনাকে কিছুক্ষণ ঘরে ফিরিতে দিব না, আপনাকে সাক্ষ্য দিতে হইবে।
অনন্তর আমরা একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ী করিয়া থানায় ফিরিয়া গেলাম এবং সেখানে ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া পুনরায় শক্তিবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম।