ডিটেক্টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/লেখকের বক্তব্য/প্রথম পরিচ্ছেদ
লেখকের বক্তব্য।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
অবতরণিকায় বিবৃত বেনামী পত্র সম্বন্ধীয় বিষয়ের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমিই যে পরিশেষে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, তাহা পাঠকগণ পূর্ব্বেই অবগত হইয়াছেন।
আমি প্রথমে গিয়া কাশীমিত্রের ঘাটের সেই প্রবীণ কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহার নিকট পূর্ব্ববর্ণিত সমস্ত বিষয় শ্রবণ করিয়া আমার বিলক্ষণ বিশ্বাস হইল যে, ডাক্তার বাবুরই দ্বারা তাঁহার ভ্রাতার জীবন শেষ হইয়াছে। কিন্তু কেবল বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া, আমি কি করিতে পারি? ডাক্তারের পরীক্ষার পূর্ব্বেই যখন শব জ্বালান হইয়াছে, তখন প্রকৃত হত্যা হইলেই বা তাহাকে কি প্রকারে রাজদ্বারে আনিতে সমর্থ হই? এরূপ অবস্থায় ভ্রাতাকে হত্যা করা অপরাধে ডাক্তারের কোনরূপ দণ্ড হইতে পারে না, জানিয়াও কিন্তু কোনরূপে নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলাম না। বীমা আফিসের অনুরোধ অনুসারেই আমাকে অনুসন্ধানে নিযুক্ত থাকিতে হইল।
ইহার পূর্ব্বে আমি ডাক্তার বাবুকে চিনিতাম না, কার্য্যের অনুরোধে কোনরূপে উহাকে চিনিয়া লইতে হইল। একদিবস সন্ধ্যার পর ডাক্তার বাবুর বাড়ীতে গমন করিলাম, বাড়ীর সম্মুখেই সেই বাড়ীর একজন পরিচালকের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহাকে ডাক্তার বাবুর কথা জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “ডাক্তার বাবু এখন বাড়ীতেই আছেন, কিন্তু এইক্ষণেই বাহিরে গমন করিবেন।”
পরিচারকের কথা শ্রবণমাত্র আমি দ্রুতগতি সেই কাশীমিত্রের ঘাটে গমন করিলাম। ডাক্তার বাবুর বাড়ী হইতে ঐ স্থান অতি নিকট; বোধ হয়, দুই তিন শত হস্তের অধিক হইবে কি না সন্দেহ। ঘাটের কর্ম্মচারী ঘাটেই উপস্থিত ছিলেন, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, কহিলাম, “ডাক্তার বাবু এখন বাড়ীতেই আছেন, কিন্তু এখনই বাহিরে গমন করিবেন। সেই সময়ে যদি আপনি দূর হইতে তাঁহাকে দেখাইয়া দেন, তাহা হইলে আমি বিশেষ বাধিত হইব। কারণ উহাকে চিনিয়া লইতে না পারিলে অনুসন্ধানের সুবিধা হইতেছে না।”
কর্ম্মচারী আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, ও তৎক্ষণাৎ আমার সহিত গমন করিলেন। আমরা উভয়েই ডাক্তার বাবুর, বাটীর নিকটবর্ত্তী একস্থানে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলাম। প্রায় অর্দ্ধঘণ্টা পরে ডাক্তার বাবু বাড়ীর বাহিরে আসিলেন ও ধীরে ধীরে পদব্রজে ক্রমে চিৎপুররোডে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কর্ম্মচারী দূর হইতে ডাক্তার বাবুকে দেখাইয়া দিয়া আপন কার্য্যে প্রস্থান করিলেন, আমি অলক্ষিত ভাবে ভাক্তার বাবুর অনুগমন করিলাম।
ডাক্তার বাবু এখন প্রকৃতই “বাবুর বেশ” ধারণ করিয়াছেন। তাঁহার পরিধানে একখানি কালাপেড়ে ফুর্ফুরে শান্তিপুরে ধুতি। অঙ্গে পঞ্জাবী আস্তেনের একটী ঢিলে পিরাণ, সেই আস্তেনের সর্ব্বস্থানই “গিলে করা” কোঁচান। গলায় একখানি পাকদেওয়া কোঁচান চাদর। মস্তকের চুলগুলি বাবু ফ্যাশনে কাটা এবং দুইভাগে বিভক্ত। পায়ে একজোড়া বার্ণিস করা চকচকে জুতা এবং হাতে একগাছি সাদা-হাতের হ্যাণ্ডেলযুক্ত বেতের ছড়ি। বাবু তাঁহার পরিধেয় বস্ত্রের কোঁচান কোঁচা বামহস্তে ধরিয়া, দক্ষিণ হস্তের ছড়িগাছটী অল্প অল্প ঘুরাইতে ঘুরাইতে চিৎপুর রাস্তা ধরিয়া দক্ষিণমুখে চলিলেন। বাবু রাস্তা বাহিয়া চলিলেন সত্য, কিন্তু তাঁহার দৃষ্টি সম্মুখের রাস্তার উপর না পড়িয়া রাস্তার উভয় পার্শ্বের বারান্দার উপর দৌড়াদৌড়ি করিতে লাগিল। চিৎপুর রাস্তা ছাড়িয়া ক্রমে ডাক্তার সোণাগাছির ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ, পশ্চাদ্বর্ত্তী ছায়ার ন্যায় গমন করিতে লাগিলাম। দেখিলাম, সেইস্থানের একটা বাড়ীর ভিতর ডাক্তার প্রবেশ করিলেন। আমি বাহিরেই রহিলাম। সেই বাড়ীর সম্মুখে একটী পানের দোকান ছিল। আমি সেই দোকানে গিয়া উপবেশন করিলাম, এক এক পয়সা করিয়া ক্রমে দুই আনার পান ক্রয় করিলাম, এবং সেই স্থানে বসিয়া বসিয়াই ঐ পান খাইতে লাগিলাম। খিলিওয়ালার সহিত এ কথা ও কথা নানাকথা পাড়িয়া ক্রমে অবগত হইতে পারিলাম যে, ডাক্তার বাবু ঐ বাড়ীতে হরিনাম্নী একটী বেশ্যার ঘরে প্রত্যহই সন্ধ্যার পরে আগমন করেন এবং সমস্ত রাত্রি সেইস্থানে অতিবাহিত করিয়া, পরদিবস বেলা নয়টা-দশটার সময় সেই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যান।
পানওয়ালার নিকট হইতে এই বিষয় অবগত হইয়া, সেইদিবস আমি সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। পরদিবস দিবাভাগে আমি সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, হরিনাম্নী একটী স্ত্রীলােক বাস্তবিকই সেই বাড়ীর ভিতর একখানি ঘরে বাস করে। হরির ঘরের পার্শ্ববর্ত্তী ঘরে সাগরনাম্নী অপর আর একটী স্ত্রীলােকের ঘর।
অনুসন্ধানােপলক্ষে অনেক সময় আমি দেখিতেছি, যে কার্য্যে সফলতা-লাভের উপক্রম হয়, তাহার অনুকূল উপায় দেখিতে দেখিতে আপনি জুটিয়া যায়। সাগরের ঘরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিবামাত্র দেখিতে পাইলাম, সেই ঘরে আমার বিশেষ পরিচিত বিনােদ নামধেয় একটী যুবক বসিয়া আছে। আমাকে দেখিবামাত্র বিনােদ যেন একটু লজ্জিত হইয়া, ঘাড় হেঁট করিয়া সরিয়া বসিল। বিনােদের ভাবগতি দেখিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, সাগরের ঘরে বিনােদের যাওয়া আসা আছে। আমি কিন্তু বিনােদের অবস্থা দেখিয়াও দেখিলাম না। একেবারে সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া, বিনােদের নিকট উপবেশন করিলাম ও কহিলাম, “বিনােদ বাবু! তােমার অনুসন্ধানের নিমিত্তই আমি এইস্থানে আসিয়াছি।”
“কেন মহাশয় আমার অনুসন্ধান করিতেছেন?”
“বিশেষ প্রয়ােজন আছে বলিয়াই তোমাকে খুঁজিতেছি।” এই বলিয়া সেইস্থান হইতে উঠিলাম, এবং বিনােদকে সঙ্গে করিয়া সম্মুখস্থ বারান্দায় গমন করিলাম। সেইস্থানে বিনােদকে কহিলাম, “বিনােদ বাবু! আমি যে কার্য্যের নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছি, তাহা সমস্ত তােমাকে বলিব, এবং তােমার সাহায্য লইয়াই আমি আমার কার্য্য উদ্ধারের চেষ্টা করিব; কিন্তু আমার বিশেষ অনুরােধ—আমার প্রকৃত পরিচয় এইস্থানে তুমি কাহারও নিকট প্রকাশ করিও না।”
বিনােদ আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল। আমিও তাহাকে আমার অভিসন্ধির সমস্ত কথা বললাম। আমার কথা শুনিয়া বিনােদ যদিও বিস্মিত হইল সত্য, কিন্তু সাধ্যানুসারে আমার সাহায্য করিতে সে অঙ্গীকার করিল।