তিতাস একটি নদীর নাম/তিন/রামধনু

উইকিসংকলন থেকে

 তিন 

রামধনু

 তিতাস নদী এখানে ধনুর মত বাঁকিয়াছে।

 তার নানা ঋতুতে নানা রঙ, নানা রূপ। এখন বর্ষাকাল। এখন রামধনুর রূপ। দুই তীরে সবুজ পল্লী। মাঝখানে শাদা জল। উপরের ঘোলাটে আকাশ হইতে ধারাসারে বর্ষণ হইতে থাকে। ক্ষেতের গৈরিক মাটিমাখা জল শতধারে সহস্রধারে বহিয়া আসে। তিতাসের জলে মিশে। সব কিছু মিলিয়া সৃষ্টি করে একটা মায়ালোকের। একটা আবেশমধুর মরমী রামধনুলোকের।

 বর্ষাকাল আগাইয়া চলে।

 আকাশ ভাঙ্গিয়া বর্ষণ সুরু হয়। সে বর্ষণ আর থামে না। তিতাসের জল বাড়িতে শুরু করে। নিরবধি কেবল বাড়িয়া চলে।

 হু হু করিয়া ঠাণ্ডা বাতাস বহে। নদীর ঘোলা জলে ঢেউ তোলে। সে-ঢেউ জেলেদের নৌকাগুলিকে বড় দোলায়। তার চাইতে বেশি দোলায় আলুর নৌকাগুলিকে।

 সকরকন্দ আলু বেচিতে রওয়ানা হইয়াছিল একটি নৌকা। পথে নামিয়াছে ঢল। ছোট নৌকা। তাতে কানায় কানায় বোঝাই। বড় বড় আলু। আধসের থেকে একসের এক একটার ওজন। নৌকার বাতা ডুবে-ডুবে। তার উপর বৃষ্টির জল। এখনি না সেচিতে পারিলে হয়ত কোনো এক সময় টুপ্ করিয়া ডুবিয়া যাইবে। বোঝাই নাও, সেউতি ঢুকে না। কাদির মিয়া হতবুদ্ধি হইয়া যায়। শুক্‌নো বাঁশপাতার মাথালটা চিবুক বেড়াইয়া মাথায় আঁটা। তাতে কেবল মাথাটাই বাঁচে। সমস্ত শরীরে লাগে বৃষ্টির অবারণ ছাঁট। মাথালশুদ্ধ মাথা বাঁকাইয়া কাদির তাকায় আকাশের দিকে আর কাদিরের ছেলে চায় বাপের মুখের দিকে। চার দিক একেবারে শূন্য দেখা যায়, মাথায় কোন বুদ্ধি জোগায় না। বাপ বলিতে থাকে, ‘অত মে’ন্নতের সাগরগঞ্জ আলু, বেবাক বুঝি যায় রসাতলে।’ ছেলে বলে, ‘বা-জান তুমি সাঁতার দিয়া পারে যাও। গরীবুল্লার গাছের তলায় গিয়া জান বাঁচাও, আমার যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। যখন দেখুম নাও ডুবতাছে, দিমু সব আলু ঢাইল্যা তিতাসের পানিত। তারপর ডুবা নাও পারে লাগাইয়া তোমারে ডাক দিমু।’

 এমন সময় দেখা গেল পরিচিত জেলেনৌকা, সন্ধ্যায় ঘরে-ফেরা সাপের মত তিতাসের দীঘল বুকে সাঁতার দিয়াছে। দুই দাঁড় এক কোরা মচ্‌মচ্ ঝুপ্‌ঝাপ্ করিয়া চলিয়াছে, জল কাটিয়া, ঢেউ তুলিয়া। তার ঢেউ লাগিয়াই বুঝিবা ছোট আলুর নৌকা ডুবিয়া যায়। কাদির ডাকিয়া বলে, ‘কার নাও!’

 পাছার কোরা হইতে ধনঞ্জয় ডাকিয়া বলে, ‘অ বনমালী, সেওতখান তাড়াতাড়ি বাইর কর। একটা অলুর নাও ডুব্‌তাছে।’

 চট্‌পট্ দু’খানা দাঁড় উঠিয়া গেলে ধনঞ্জয় হাতের কোরা চিত করিয়া চাপিয়া ধরিল। সাপের ফণার মত নৌকাখানা বাঁ দিকে চির খাইয়া কাদিরের নৌকা বরাবর রুদ্ধগতি হইয়া গেল।

 ধনঞ্জয়ের বুদ্ধি অপরূপ। তার বুদ্ধি খেলিয়া গেল একান্তই ঠিক সময়ে। একটু দেরি হইলে সর্বনাশ হইয়া যাইত।

 তারপর জেলে নৌকার তিনজন, আলুর নৌকার দুইজন, পাঁচ জনের হাত চলিল সেলাইকলের সূঁচের মত ফর্‌ফর্ করিয়া। দেখিতে দেখিতে জেলে নৌকার প্রশস্ত ডরা এক বোঝাই আলুতে ভরিয়া গেল। আর আলুর নৌকা খালি হইয়া ভাসিয়া উঠিল।

 কাদিরের মাথার টোকা তখনও অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হইতে তার মাথা বাঁচাইয়া চলিয়াছে। বিপদমুক্তির পরের অবসন্নতা তাকে কাবু করিল। মাচানের উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল, ‘মালোর পুত, বড় বাঁচানটাই আজ বাঁচাইলা।’


 এতক্ষণ বৃষ্টি ছিল রিমঝিমে, ছন্দমধুর। সহসা সে-বৃষ্টি ক্ষেপিয়া গেল। মার্ মার্ কাট্‌ কাট্ শব্দে বৃষ্টি আকাশ ফাঁড়িয়া পড়িতে লাগিল। সাঁ সাঁ ঝম্ ঝম্ সাঁ সাঁ ঝম্ ঝম্‌ শব্দে কানে বুঝি তালা লাগিয়া যায়। তীর-ভূমি, তীরের মাঠ-ময়দান, ‘গাঁ-গেরাম’ আর চোখে দেখা যায় না। ধোঁয়াটে শাদা আবছায়ায় চারিদিক ঝাপসা হইয়া গিয়াছে।

 বনমালী মনে করিয়াছিল তারা তীরে নাও ঠেকাইয়া বসিয়া থাকিবে। কিন্তু তীর কোথায়। কাছেই তীর; তবু চোখে দেখা যায় না। ধনঞ্জয় ছইয়ের পেছনের মুখ ধাপর দিয়া ঢাকিতে ঢাকিতে বলিল, ‘বনমালী ভাই, গাঙ দীঘালে নাও চালাইয়া কোনো লাভ নাই। ইখানেই পাড়া দে।’

 ভারী মোটা একটা বাঁশ জলে নামাইয়া নদীর মাঝখানেই দুই জনে পাড় দিতে দিতে পুঁতিয়া ফেলিল। তার সঙ্গে শক্ত দড়ি দিয়া নৌকাখানা বাঁধিয়া ধনঞ্জয় বলিল, ‘থাউক, নাও অখন বাতাসের সাথে সাথে ঘুরুক। কই অ মিয়ার পুত, ছইয়ের তলে গিয়া বও।’

 কাদির মাথা ঢুকাইতে ঢুকাইতে থামিয়া গেল দেখিয়া বনমালী বলিল, ‘ছইয়ের তলে কিছু নাই, ভাত ব্যানুন সব খাওয়া হইয়া গেছে।’

 পাঁচজনেরই ভিজা গা। সঙ্গে একাধিক কাপড় নাই যে বদলায়। ছোট ছইখানার ভিতরে তারা গা-ঠেকাঠেকি করিয়া বসিয়া রহিল। কাদিরের ভিজা চুল এলোমেলো হইয়া গিয়াছে। তার শাদা দাড়ি হইতে বিন্দু বিন্দু জল ঝরিয়া পড়িতেছে বনমালীর কাঁধের উপর। কাদির এক সময় টের পাইয়া হাতের তালুতে বনমালীর কাঁধের জলবিন্দুগুলি মুছিয়া দিল। বনমালী ফিরিয়া চাহিল কাদিরের মুখের দিকে। বড় ভাল লাগিল তাকে দেখিতে। লোকটার চেহারায় যেন একটা সাদৃশ্য আছে যাত্রাবাড়ির রামপ্রসাদের সঙ্গে। তারও মুখময় এমনি শাদ সোণালি দাড়ি। এমনি শান্ত অথচ কর্মময় মুখভাব। রামায়ণ মহাভারতে পড়া বাল্মীকি ও অন্যান্য মুনিঋষিদের যেন রামপ্রসাদ একজন উত্তরাধিকারী। আর এই কাদির মিয়া? হাঁ, তার মনে পড়িতেছে। সেবার গোকনঘাটের বাজারে মহরমের লাঠিখেলা হয়। বনমালী দেখিতে গিয়াছিল। ফিরিবার সময় তাদেরই গায়ের একজন মুসলমানের সঙ্গে পথে তার দেখা হয়। তারই মুখে কারবালার মর্মবিদারক কাহিনী শুনিতে শুনিতে বনমালী প্রায় কাঁদিয়াই ফেলিয়ছিল। এর সঙ্গে আরও শুনিল তাদের প্রিয় পয়গম্বরের কাহিনী। সেজন বীরত্বে ছিল বিশাল, কিন্তু তবু তার আপন জনকে বড় ভালবাসিত। কাদির যেন সেই বিরাটেরই একটুখানি আলোর রেখা লইয়া বনমালীর কাঁধে দাড়ি ঠেকাইয়া চুপচাপ বসিয়া আছে। বনমালীর বড় ভাল লাগিতেছে। বাস্তবিক, যাত্রাবাড়ির রামপ্রসাদ, বিরামপুর গাঁয়ের এই কাদির মিয়া—এরা এমনি মানুষ, যার সামনে হোঁচট খাইলে হাত ধরিয়া তুলিয়া অনেক কাঁটাঘেরা পথ পার করাইয়া দিবে; আবার দাড়ির নিচে প্রশান্ত বুকটায় মুখ গুঁজিয়া, দুই হাতে কোমর জড়াইয়া ধরিয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিলেও ধমক দিবে না, কেবল অসহায়ের মত পিঠে হাত বুলাইবে। বনমালীর চোখ সজল হইয়া উঠে। তার বাপও ছিল এমনি একজন। কিন্তু সে আজ নাই। একদিন রাতের মাছধরা শেষে ভিজা জাল কাঁধে করিয়া বাড়ী ফিরিতেছিল। পথের মাঝে তুফানে গাছ-চাপা পড়িয়া মারা গিয়াছে।

 ছইয়ের বাহিরে বাঁশের মাচানগুলিতে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়িয়া ভাঙ্গিয়া চৌচির—শতচির হইয়া পড়িতেছে। নৌকার বাহিরে যতদূর চোখ যায় সবটাই তিতাস নদী। তার জলের উপর বৃষ্টির লেখা-জোখাহীন ফোঁটাগুলি পাথরের কুচির মত, তার বুকে গিয়া বিঁধিতেছে আর তারই আঘাত খাইয়া ফোঁটার চারিপাশটুকুর জল লাফাইয়া উঠিতেছে। হাওয়া নাই, জলে ঢেউ নাই। তবু নদীর বুকময় আলোড়ন। আর, একটানা ঝা ঝা ঝিম্ ঝিম্ শব্দ। ছইয়ের সামনের দিক খোলা। এদিক দিয়া বাতাস ঢোকে না। বলিয়া জলের ছাঁটও ঢোকে না। যে দিক দিয়া ঢুকিবার, সে পিছনের দিক। সেদিক বন্ধ আছে। কাদিরের চক্ষু ছিল নৌকার বাতার বাহিরে, যেখানে কোন সুদূর হইতে তীরের বেগে ছুটিয়া আসা ফোঁটাগুলি তীরের মতই তিতাসের বুকে বিঁধিয়া আলোড়ন জাগাইতেছে। বনমালী তার গামছাখানা খানিক বৃষ্টির জলে ধরিয়া রাখিয়া, চিপিয়া জল নিংড়াইয়া কাদিরের হাতে দিয়া বলিল, ‘নেও বেপারী, গতর মোছ।’ কাদির সস্নেহে তার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল, বনমালীকে নিতান্ত ছেলেমানুষটির মত দেখাইতেছে, অথচ মালোর বেটার দেহের পেশীগুলি কেমন মজবুত।

 ‘বেপার আমার বংশের কেউ করে নাই বাবা। চরের জমিতে আলু করছি। শনিবারে শনিবারে হাটে গিয়া বেচি। বেপারীর কাছে বেচি না। বড় দরাদরি করে আর বাকি নিলে পয়সা দেয় না।’

 ‘মাছ-বেপারীরাও এই রকম। জাল্লার সাথে মুলামুলি কইরা দর দেয় টেকার জাগায় সিকা। শহরে নিয়া বেচে সিকার মাল টেকায়।’

 কাদিরের দৃষ্টি সামনের দিকে, যেখানে বৃষ্টির বেড়াজালে সব কিছু ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে। খানিক চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘কি ঢল্ নাম্‌ছে রে বাবা, গাঁও-গেরাম মালুম হয় না।’ তাহার তামাক খাইতে ইচ্ছা করিতে লাগিল। এই সময়েই অন্তর্যামী বনমালী নামক ছেলেটা তামাকের ব্যবস্থায় হাত দিল। বাঁশের চোঙ্গার এক দিকে টিকা, আর এক দিকে তামাক রাখার ব্যবস্থা। কাদিরের ছেলে এইবার ভাবনায় পড়িল। সে যখন আরও ছোট ছিল, তখন বাপের সঙ্গে গ্রাম গ্রামান্তরের কত বামুন কায়েতের বাড়িতে দুধ বেচিতে গিয়াছে।

 তারা তার বাপকে আদর করিয়া ডাকিয়া বসায়। নিজেরা চেয়ারে বসিয়া ছেলেপুলের হাতে একখানা ধূলিধূসর তক্তা আনাইয়া মুখে মিষ্টি ঢালিয়া দিয়া বলে, ‘বও বও, কাদির বও। তামুক খাও।’ তাদের নিজেদের হাতে তেলকুচ্‌কুচে মসৃণ হুকা। কাদিরের জন্য বাহির করিয়া দেয় মাচার তলায় হেলান-দিয়া-রাখা সরু খামচাখানেক আকারের থেলো। কাদির আলাপী মানুষ। বলিতে যেমন ভালবাসে শুনিতেও তেমনি ভালবাসে। আলাপে মজিয়া গিয়া লক্ষ্যই করে না কোথায় বসিল আর কি হাতে লইল। ফুঁ দিয়া ধূলা উড়াইয়া হুকার মুখে মুখ লাগায়। তার বাপ মাটির মানুষ, তাই অমন পারে। ওরা বড় লোক। তেলে জলে যেমন মিশে না, তাদের সঙ্গেও তেমনি কোনোদিন মেশার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু এরা জেলে। চাষার জীবনের মতই এদের জীবন। উঁচু বলিয়া মানের ধূলি নিক্ষেপ করা যায় না এদের উপর; বরং সমান বলিয়া গলা জড়াইয়া ধরিতেই ভাল লাগে। কাটিলে কাটা যাইবে না, মুছিলে মুছা যাইবে না, এমনি যেন একটা সম্পর্ক আছে জেলেদের সঙ্গে চাষীদের। বনমালী তামাক সাজার আয়োজন করিতেছে। নিজের হুকায় সুখের টান দিয়া, সে যদি কল্‌কেখানা খুলিয়া তার বাপের দিকে হাত বাড়ায়, সে তখন কি করিবে; বড়লোকের হাতের অপমানে চটা যায়, কিন্তু সমান লোকের হাতের অপমানে চটা যায় না, খালি ব্যথার ছুরিতে কলিজা কাটে।

 এই ঘনঘোর বাদলের মাঝখানে বসিয়া মাথা বাঁচাইতে বাঁচাইতে কাদির হয়ত বনমালীর হুকা-বিচ্যুত কলিকাখানা খুশি মনে হাতে লইত। কিন্তু বনমালী মালসায় হাত দিয়া দেখে জলের ছাঁট লাগিয়া আগুনটুকু নিবিয়া গিয়াছে।


 নদীর মোড় ঘুরিতে বাজার দেখা গেল। একটু আগে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। এখন চারিদিক ফর্সা। কিন্তু রোদ উঠে নাই। আকাশের কোন কোন দিক গুমোটে আচ্ছন্ন। মনে হয় কোথায় কোথায় যেন এখনও বৃষ্টি হইতেছে। এক একবার দমকা হাওয়া আসে। ঠাণ্ডা লাগে শরীরে। মেহনতের সময় এই বাতাস গায়ে বড় মিঠা লাগে। নৌকা একেবারে তীর ঘেঁষিয়া না চলিলেও, তীরের গাছ-গাছড়ার সবুজ ছায়া কাদিরের নৌকার ধমকে জলের ভিতর কাঁপিয়া মরিতেছে। ছায়াগুলি এত কাছে থাকিয়া কাঁপিতেছে, আর কাদিরের ছেলের বৈঠার আঘাত খাইয়া ভাঙ্গিয়া শতটুকরা হইয়া যাইতেছে।

 নদীর এ বাম তীর। দক্ষিণ তীর ফাঁকা। গ্রাম নাই, ঘর বাড়ি নাই, গাছ-গাছড়া নাই। খালি একটা তীর। তীর ছাড়াইয়া কেবল জমি আর জমি। অনেক দূর গিয়া ঠেকিয়াছে ধোঁয়াটে কতকগুলি পল্লীর আবছায়ায়। যে সব খোলা মাঠ বাহিয়া বাতাস আসে, নদী পার হইয়া লাগে আসিয়া এ পারের গাছগুলির মাথায়।

 ছোটবড় দুইটি নৌকাই একসঙ্গে গিয়া হাটের মাটিতে ধাক্কা খাইল।

 পশ্চিম হইতে সোজা পূবদিকে আসিয়া এইখানটায় নদী একটা কোণ তুলিয়া দক্ষিণ দিকে বাঁকিয়া গিয়াছে। সেই কোণের মাটিই বাজারের ‘টেক’। তারই পূবদিক দিয়া একটা খাল গিয়াছে সোজা উত্তর দিকে সরল রেখার মত। নদীর বাঁক থেকে খালটা গিয়াছে, দেখিয়া মনে হয় নদী চলিতে চলিতে এখানে দক্ষিণদিকে মুখ ঘুরাইয়াছে আর উত্তরদিকে কোথায় অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে তার মাথার লম্বা বেণীটা।

 সেই খালের পূব পারে একটা পল্লী। নাম আমিনপুর। একদিকে কয়েকটা পাটের অফিস, আরেক দিকে কতকগুলি ঘরবাড়ি গাছ-গাছালি। খালের এপারে হাট বসিতেছে, আর ওপারে গাছ-গাছালির মাথার উপর দিয়া আকাশে উঠিয়াছে একটা রামধনু। সূর্য পশ্চিমদিকে ঢলিয়া পড়িয়াছে। পূবের আকাশে কণাকণা বৃষ্টির আভাসে ঝাপসা একটা ঠাণ্ডা ছায়া লাগানো। পশ্চিমের সূর্যের সাত রঙ পূবের আকাশের মেঘলার ফাঁদে ধরা পড়িয়া গিয়া উঠাইয়াছে এই রামধনু।

 মাত্র ঘণ্টা দুই আগে যে বৃষ্টি হইয়াছে তেমন প্রচণ্ড বৃষ্টি খুব কমই দেখা যায়। নৌকাতে থাকিয়া ততটা বোঝা যায় না। বাড়িতে থাকিলে দেখা যাইত ঘরের চালের ঝম্‌ঝম্ শব্দে কান ফাটিয়া যাইতেছে; চাল-বাহিয়া-পড়া একটানা বৃষ্টির জলে ছাঁচে লম্বা এক সারি গর্ত হইয়া গিয়াছে। কোথায় কোন নালা আটকাইয়া গিয়া উঠান জলে ভরিয়া গিয়াছে, তুলসীতলার উঁচু মাটিটুকু বাদে ভিটার নিচের সবটুকু জায়গা ডুবিয়া গিয়াছে; উঠানের কোণে অযত্নে যে-সব দূর্বাঘাস গজাইয়াছিল, সেগুলি জলে সাঁতার কাটিতেছে।

 খালটা শুকনা ছিল। আজিকার ঢলে মাঠময়দান ভাসিয়াছে, হালদেওয়া ক্ষেতগুলির ভাঙ্গা ভাঙ্গা মাটি ঢলে গুলিয়া গিয়া কাদা হইয়াছে। সেই কাদাগোলা জল আল উপছাইয়া পড়িয়াছে আসিয়া খালে। শতদিক হইতে শত বাহু বাড়াইয়া দিয়া ক্ষেতের খালের দৈন্যদশা প্রাচুর্যে পূর্ণ করিয়া দিয়াছে। খালে তখন উজানের ঠেলা। যে-খাল আগে নদীর জল টানিয়া নিয়া কোনোরকমে শুকনা গলা ভিজাইয়া রাখিত, আজ সে খাল উল্লোলিত, কল্লোলিত, উথলিত হইয়া স্রোত বাঁকাইয়া ঢেউ খেলাইয়া বুক ফুলাইয়া তার ভরা বুকের উপচানো জল তিতাসের বুকে ঢালিয়া দিয়াছে। বৃষ্টি থামিয়া গিয়াছে অনেকক্ষণ, কিন্তু সে দেওয়া এখনও থামে নাই। এখনও ধারায় ছুটিয়া আসিতেছে সেই কাদাগোলা জল।

 কাদিরের পিপাসা হইয়াছিল। আঁজলা ভরিয়া তুলিয়া মুখে দিতে গিয়া দেখে অর্ধেক তার মাটি। বনমালী দেখিতে পাইয়া দয়ার্দ্র হইয়া উঠিল; ‘থইয়া দেও, খাইতে পারবা না। খালের জলে গাঙের জলেরে খাইছে। মালো-পাড়ায় আমার কুটুম আছে। আলু তোলার পর নিয়া যামু তোমারে।’

 ‘কি কুটুম? সাদি সম্বন্ধ করচ্ না কি।’

 ‘না। ভইন বিয়া দিছি।’


 বনমালীর সাহায্য পাইয়া কাদিরের সব আলু একদণ্ডের মধ্য হাটে গিয়া উঠিল। চারিদিকে ছড়াইয়া না পড়ে এইজন্য কাদিরের ছেলে জলো-ঘাসের ন্যাড়া বানাইয়া আলুর গাদার চারিপাশে গোল করিয়া বাঁধ দিল। সেই বাঁধ ডিঙ্গাইয়া দুই চারিটা ছোট ছোট আলু এ-পাশে ও-পাশে ছিটকাইয়া পড়িতে লাগিল। আর সেগুলি মালিকের অধিকারের বাইরে মনে করিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িয়া ধরিতেছিল কতকগুলি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। ভিখারীর ছেলে নয়, কিন্তু দেহের আকারে, বসনের অপরিচ্ছন্নতায় ও অপ্রাচুর্যে এবং অস্বাভাবিক কাঙ্গলপনায় সেগুলিকে মনে হইল যেন ভিখারীর বাড়া। ইহারা সবখানেই আছে, সব দেশে সব গাঁয়ে আর সব গাঁয়ের বাজারে। কাদিরেরা যারা আলু বেচিতে আসে তারা অমন দুই চারিটা আলুর জন্য ইহাদিগকে ধমক দেয় না, কিছু বলেও না। তাদের কত আলু, নিক না দুইচারিটা এই সব দুঃখীর ছেলেপিলে। পয়সা দিয়া ত কিনিতে পারে না। কিন্তু ধমক দেয় বেপারীরা। আলুতে হাত দিলে চড়-চাপড় মারে, আলু কাড়িয়া নেয়; শুধু তাদের থেকে নেওয়া আলু নয়, অপর জায়গা থেকে সংগ্রহ করা আলুও কাড়িয়া নেয় বেপারীরা। আর ছোট ছোট কচি গালগুলিতে মারে ঠাস করিয়া চড়। চড় খাইয়া উহারা চীৎকার করিয়া কাঁদে না, গাল-মুখ চাপিয়া ধরিয়া এখান হইতে সরিয়া পড়ে আরও মার খাওয়ার ভয়ে। কেবল যখন তাদের নিজের সঞ্চয় সুদ্ধ কাড়িয়া নেয়, কাকুতি করিয়া ফল হয় না, অনুরোধ করিলে উল্টা গাল খায় মা-বাপ সম্পর্কিত অশ্রাব্য ভাষায়, তখন কেবল অনুচ্চকণ্ঠে ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদে। কাদির এ হাটে অনেক আলু বেচিয়াছে আর অনেক দিন হইতে ইহাদিগকে দেখিয়া আসিতেছে। বছরের পর বছর ইহারা আলু কুড়াইয়া চলিয়াছে, কতক মরিয়াছে, কতক বড় হইয়া সংসারে ঢুকিয়াছে, না হয়ত পুঁজিদার কারবারী নয়তো জমি-মালিক মজুর-খাটানেওয়ালা বড়-চাষীর গোলামি করিয়া জানপ্রাণ খুয়াইতেছে। কাদিরকে ইহারা আর চিনিতে পরিবে না, কাদিরও ইহাদের কাউকে সামনে দেখিলে ঠাহর করিতে পারিবে না। কিন্তু তার বেশ মনে পড়ে, হাটের মাটিতে আলু ঢালিতে গিয়া ইচ্ছা করিয়া দশটা-বিশটা আলু এইসব কৃপা-প্রার্থীর দিকে ঠেলিয়া দিয়াছে। এখনও দিতে কৃপণতা করে না। হাটে এই প্রথম আলু উঠিয়াছে দেখিয়া এই খুদে ডাকাতের দল সবগুলি জোট পাকাইয়া আসিয়া এইখানে মিলিয়াছে। কারো হাতে ন্যাক্‌ড়ার একখানা ছোট থলে; পুরানো কাপড়ের লাল নীল পাড়ের সূতা দিয়া অপটু হাতের সূঁচের ফোঁড়ে তৈয়ারী। কারো হাতে মালসা কারো বা কোঁচড়মাত্র সম্বল।

 কি ভাবিয়া সহসা কাদির কল্পতরু হইয়া উঠিল। তাহার হয়ত ইচ্ছা হইয়াছিল ওদের হাতে হাতে অনেকগুলি আলু সে বিলাইয়া দেয়। কিন্তু সাবালক বড় ছেলে সামনে। কি মনে করিবে। বিক্রী করিতে হাটে আসিয়াছে, খয়রাত করিবার কোন অর্থ হয় না। ইচ্ছা করিয়া খুশি মনে নড়াচাড়া করিতে করিতে ঘাসের বাঁধ উপচাইয়া কতকগুলি আলু চারিপাশে ছড়াইয়া দিল ওদের জন্য। ছেলের দৃষ্টি এড়াইলনা, ‘না করলাম বোয়ানি, না করলাম সাইত; তুমি বাপ অখনই এইভাবে দিতে লাগ্‌ছ!’

 কাদির অজুহাত পাইল সঙ্গে সঙ্গেই, ‘কাটা-আলু খরিদ্দারে নেয় না, বাছাবাছি কইরা থুইয়া রাখে। দিয়া দিলাম।’

 ছেলে খুঁতখুঁত করিতে লাগিল, ‘কিন্তু সাইত করলাম না।’

 কাদির দিল-খোলা ভাবে হাসিয়া বলিল; করলাম এই এতিম ছাইলা-মাইয়ার হাতেই পরথম সাইত। খাইয়া দোয়া করব। আল্লা বড় বাঁচান বাঁচাইছে আইজ।’

 কাদিরের এই কাজকর্ম বনমালীর খুব ভাল লাগিতেছিল। বিস্ময়ের সহিত সে কাদিরের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কাদির বনমালীর দিকে চাহিয়া তার ছেলেকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, ‘বড় আভাগ্যা এরা। কেউর মা নাই, বাপ নাই, লাথি ঝাঁটা খায়; কেউর মা আছে, কিন্তু দানা দিতে পারে না। কেউর বাপ আছে মা নাই। লোকে কয়, মা মরলে বাপ তালই, ভাই বনের পশু।’

 তামাক জ্বালাইয়া আনিয়াছিল। টিকায় ফু দিতে দিতে বনমালী বলিল, ‘একজনের যে মা মরছে, চোখের সাম্‌নেই দেখ্‌তাছি।’

 কাদিরের দৃষ্টি পড়িল ছেলেটার দিকে। লম্বা, কৃশ, হাড় জিরজির করিতেছে। শিশুমুখেও মলিনতার ছাপ বেয়াড়া রকমের স্পষ্ট। দলের বাহিরে দাঁড়াইয়া বড় বড় চোখ দুইটি মেলিয়া রাখিয়াছে কাদিরের মুখের উপর। ছেলেরা কাড়াকাড়ি করিয়া হরির লুটের বাতাসার মত আলু ধরিতেছিল, আর সে নীরবে দাঁড়াইয়া আশাপূর্ণ মনে কামনা করিতেছিল কাদির বুড়ার মনের একটুখানি ছোঁয়া। যেন তাকে দেখিতে পাইলে অন্যান্য ছেলেদের থেকে আলাদা করিয়া শুধু তার একার জন্য বুড়া করুণার ধারা বহাইয়া দিবে। এ যেন তার দাবি। চিরদিনের নির্ভরতা মাখানো এই দাবি দুনিয়া যদি পূর্ণ করে তবে ভালো কাজ করা হইবে, যদি না করে তো না করিবে, সে শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া এখান থেকে চলিয়া যাইবে।


 কাদির দুই মুঠা আলু তুলিয়া তার চোখের দিকে চাহিয়া একদিকে সরিয়া আসার ইঙ্গিত করিল। তার মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল। স্বচ্ছ আবদেরে হাসি; কিন্তু বড় ম্লান। সর্বাঙ্গে মাতৃরিষ্টির ধ্বজা ধারণ করিয়া সে ছিল নীরবে দণ্ডায়মান। কাদিরের ডাকে সহসা সে আগাইয়া আসিল না। দান প্রত্যাখ্যানের ভব্যতা। ‘আরে নে, আগাইয়া ধর; না অইলে তারা নিয়া যাইব।’

 ছেলেটা আদরে গলিয়া গিয়া ঘাড় নিচু করিল, তারপর ঘাড় ঘুরাইয়া অর্থহীন ভাবে এদিক ওদিক চাহিল, আর চাহিল মাথা তুলিয়া একবার সামনের, খাল পারের, আমিনপুর গ্রামের উপরের পূব আকাশের দিকে। কাদিরের অযাচিত দানের ধনগুলি তখন তার পায়ের কাছে মাটিতে লুটাইতেছে। আর সেই যে সে আকাশের দিকে চাহিল, একভাবে চাহিয়াই রহিল, মাথা আর নামাইতে পারিল না। কাদির তার চাওয়ার বস্তুর খোঁজে তাকাইল, কিছু বুঝিতে পারিল না। বনমালী তার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিল, আমিনপুরের গাছগাছালির মাথার উপর দিয়া আকাশে রামধনু উঠিয়াছে। ছেলেটা তারই দিকে চাহিয়া আছে।

 ‘অ, ধেনু উঠ্‌ছে। তাই দেখ্‌তাছে।’ বলিল বনমালী। জেলে সে। জেলেরা আর চাষীরা জল আর মাটি চষিয়া বেড়ায় মুক্ত আকাশের নিচে। উদয়ের মাধুরী আর অস্তের বিধুরতা কোনোদিন গোপন থাকে না তাদের কাছে। কিন্তু তারা কি সে সব কখনো চাহিয়া দেখিয়াছে? দেখিয়াছে কেবল দুপুরের খরাটাকে, যখন মাথার উপর আগুনের মত আসিয়া পড়িয়াছে তখন। শীতে শরতে সকালে বিকালে আকাশের গায়ে খামচা খামচা কত রঙীন মেঘ ভাসিয়া বেড়াইয়াছে। বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে সূর্য চোখ মেলিলে তার বিপরীত দিকের আকাশে জাগিয়াছে কতদিন কত রামধনু। তারা কি কোনোদিন তাহা চাহিয়া দেখিয়াছে? হয়ত দেখিয়াছে। কিন্তু নূতন কিছু লাগে নাই চোখে। উঠে, মিলাইয়া যায়। চাহিয়া থাকিয়া দেখিবার কিছু নাই রামধনুতে। শিশুরা মায়ের কোলে থাকিয়া আকাশে চাঁদ দেখিয়া হাসে, হাততালি দেয়। কই বনমালীরা তো কোনোদিন চাঁদের দিকে চাহিয়া হাসেও নাই হাততালিও দেয় নাই। কাদির মিয়াদের ঈদের চাঁদ দেখিবার কত আগ্রহ। কত আনন্দ আর পুণ্যের বাণী লইয়া আকাশের এক কোণে উঁকি দেয় রমজানের চাঁদ। একফালি দুর্বল, প্রভাহীন চাঁদ—চাঁদের কণা বলিলেই চলে। কিন্তু সে চাঁদ যখন বড় হইয়া আকাশে সাঁতার কাটে তখন তো কই তারা চাহিয়াও দেখে না। তেমনি রামধনু দেখিবে বালকে, দেখিবে এই বোকা অর্বাচীন ভিখারী ছেলেটা। দেখুক সে রামধনু; আর এদিকে তার পায়ের কাছে থেকে ছড়ানো আলুগুলি আর আর ছেলেরা কুড়াইয়া নিয়া যাক। বনমালীর ইচ্ছা হইল আলুগুলি কুড়াইয়া দেয়। কিন্তু নাবালকের দেখাদেখি রামধনুর দিকে চাহিয়া সেও নাবালক হইয়া গেল। সত্যই ত, রামধনু দেখিতে অত সুন্দর। তার বোনটি যখন ছোট ছিল, সেও একদিন তেমনি করিয়া রামধনুর দিকে চাহিয়াছিল। কিন্তু সে অমন বোকার মত সব ভুলিয়া চাহিয়া থাকে নাই। হাতে নূতন গাছা কাঁচের চুড়ি কিনিয়া দেওয়া হইয়াছিল। তাহাই বাজাইয়া হাততালি দিতেছিল আর একটা ছড়া কাটিতেছিল, ‘রামের হাতের ধেনু, লক্ষ্মণের হাতের ছিলা, যেইখানের ধেনু সেইখানে গিয়া মিলা।’ মেয়েদের ধারণা, এই মন্ত্র পড়িলে রামধনু মিলাইয়া যাইবে। বোনটিকে কতদিন ধরিয়া দেখিতে যাওয়া হয় নাই। এই গাঁয়েই তার বিবাহ হইয়াছে। এই হাটের অল্প দূরেই তার স্বামীর বাড়ি।


 বিরাট আকাশের ধনু। আকাশের দুই কোণ ছুঁইয়া বাঁকিয়া উঠিয়াছে। মোটা তুলির যেন সাত রঙের সাতটি পোঁচ। রঙগুলি সব আলাদা আলাদা, আর কি স্পষ্ট! পিছনের আকাশ হইতে খসিয়া যেন আগাইয়া আসিয়াছে। যত অস্পষ্টতা যত আবছায়া অনেক পিছনে পড়িয়া রহিয়াছে, দিক উজ্জ্বল করিয়া বাঁকা হইয়া উঠিয়াছে এই রামধনুটা। কি উজ্জ্বল বর্ণ। কি স্নিগ্ধ আর সামঞ্জস্যপূর্ণ তার রঙের ভাঁজ। কোন্ কারিগর না জানি এই রঙের ভাঁজ করিয়াছে! চোখে কি ভালো লাগে; কি ঠাণ্ডা লাগে। কোথায় ছিল এতক্ষণ লুকাইয়া! কোথাও তো ছিল না। এখন কোথা হইতে কেমন করিয়া আসিল! চাঁদসুরুজের দেশ এটা। তারা নিত্য উঠে, নিত্য অস্ত যায়। পশ্চিমে ডুবিয়া ঘুমাইয়া থাকে, আবার সকালে পূবে উদয় হয়। কিন্তু রামধনু থাকে কোথায়। বড় একটা ত দেখা যায় না। অনেকদিন পর দেখা যায় একদিন উঠিয়াছে। কতদিন ঘুমায় এ! কুম্ভকর্ণের মত! উঠিবারও তাল-বেতাল নাই। ইচ্ছা হইলে একদিন উঠিলেই হইল। কিন্তু, কি বড়! বোন ঠিকই বলিয়াছিল তার ছড়াতে—রামের হাতেরই ধনু এটা। যে-ধনু অমন যে রাক্ষস, দশমাথা কুড়ি হাতের রাক্ষস,—জোর করিয়া সে ধনু তুলিতে গিয়া তারও মুখে রক্ত উঠিয়াছিল। রামায়ণের বইয়ের সে কথা বনমালী শুনিয়াছে সীতার বিবাহের পালা গানে ছুটা-কীর্তনিয়ার মুখে। শেষে রাম তাকে হাতে তুলিয়া নেয়। হরধনু না কি বলিয়াছিল—তাই রামের হাতের ধনু। কিন্তু সীতা সে ধনু রোজই বাঁ হাতে তুলিয়া লইয়া ডানহাতে তলাকার জায়গাটুকু লেপিয়া পুঁছিয়া শুদ্ধ করিয়া দিত। তারপর সীতার বিবাহ হইয়া গেল। রাম তাকে নিয়া অযোধ্যাতে আসিল। তারপর সীতা আর বাপের বাড়ি ফিরিয়া আসে নাই। নাঃ, বোনটাকে দেখিতে যাইতেই হইবে। কতদিন তাকে নেওয়া হয় নাই।


 কতক্ষণ পরে রামধনু মিলাইয়া গেল আকাশে। কিন্তু রাখিয়া গেল অনন্তর মনে একটা স্থায়ী ছাপ। কোনোদিন দেখে নাই। মায়ের কাছে গল্প শুনিয়াছিল: মানুষের অগম্য এক দ্বীপ-চরে এক জাহাজ নোঙর করিয়াছিল। খাইয়া দাইয়া লোকগুলি ঘুমাইয়াছে, অমনি চারিদিক কাঁপাইয়া ধপাস ধপাস শব্দ হইতে লাগিল। আকাশ হইতে পড়িল কয়েকটা দেও-দৈত্য। এরা ছাড়াও আরও কত কিছু আছে, যারা মানুষ নয়; মানুষের মধ্যে, মানুষের বাসের এই দুনিয়ার মধ্যে যাদের দেখিতে পাওয়া যায় না। দেও-দৈত্য তো ভয়ের জিনিস। কত ভালো জিনিসও আছে তাদের মধ্যে। সকলেই তারা এই আকাশেই থাকে। এই যেমন চন্দ্র, সূর্য, তারা। তাহারাও আকাশেই থাকে; নিত্য উঠে নিত্য নামে, দেখিতে দেখিতে চোখে প্রায় পুরানো হইয়া গিয়াছে। কিন্তু এদেরই রহস্য ভেদ এখনও করা হয় নাই। অলৌকিক রহস্যভরা অনন্তর আকাশ-ভুবন। আজও তাদেরই একটা অদেখা রহস্যজনক বস্তু তার চোখের সামনে নামিয়া আসিয়াছিল পিছনের অনেক দূরের আকাশ হইতে, অদেখার কোল হইতে একেবারে নিকটে, আমিনপুরের জামগাছটার প্রায় মাথার কাছাকাছি।

 বনমালীর মন হইতেও কল্পনার রামধনু মুছিয়া গেল; কেউ বুঝি নামাইয়া দিল তাকে বাস্তবের মুখে। ছেলেটার গায়ের রঙ ফর্সা। কিন্তু খড়ি জমিয়া বর্ণললিত্য নষ্ট করিয়া দিয়াছে। এক চিলতা সাদা মাঠা-কাপড় কটিতে জড়ানো। আর এক চিলতা কাঁধে। বিঘৎ পরিমাণ একখানা কুশাসন ডানহাতের মুঠায় ধরা। নৌকা গড়িবার সময় তক্তায়-তক্তায় জোড়া দেয় যে দুইমুখ সরু চ্যাপ্টা লোহা দিয়া, তারই একটা দুইমুখ এক করিয়া কাপাস সূতায় গলায় ঝুলানো। পিতামাতা মারা যাওয়ার পর মাসাবধি হবিষ্য করার সন্তানের এই সমস্ত প্রতীক।

 বনমালী দরদী হইয়া বলে, ‘তোর নাম কি রে।’

 ‘অনন্ত।’

 ‘অনন্ত কি? যুগী, না পাটনী, না সাউ, না পোদ্দার?’

 অনন্ত এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিল না।

 ‘তোর মা মরছে না বাপ মরছে?’

 ‘মা।’

 ‘কোন্ হাটি বাড়ি তোর্?’

 আঙ্গুল দিয়া মালোপাড়া দেখাইয়া দিল।

 ‘জাতে তুই মালো? আম্‌রার স্বজাতি?’

 অনন্ত ভালে করিয়া কথাটা বুঝিল না। আব্‌ছাভাবে বুঝিল, তার মাসীর মত, এও তারই একটা কেউ হইবে! তা না হইলে অত কথা জিজ্ঞাসা করিতেছে কেন?

 ‘তোর বাড়িত্ লইয়া যাইবি আমারে?’

 গলার ধড়ার সূতাটা দাঁতে কামড়াইতে কামড়াইতে ঘাড় কাৎ করিয়া অনন্ত জানাইল, হাঁ, নিয়া যাইবে।

 ‘বাজার জম্‌ছে। চল্ তোরে লইয়া বাজারটা একবার ঘুইরা দেখি।’

 বাজারের তখন পরিপূর্ণ অবস্থা। কাদিরের দোকানের চারিপাশে অনেক আলুর দোকান বসিয়াছে। গণিয়া শেষ করা যায় না। ক্রেতাও ঘুরিতেছে অগণন। হাতে খালি বস্তা লইয়া তাহারা দরদস্তুর করিতেছে আর কিনিয়া বস্তাবন্দী আলু মাথায় তুলিয়া ভিড় ঠেলিয়া বাজারের বাহির হইতেছে। একটানা একটা কলরব শুরু হইয়া গিয়াছে। কাছের মানুষকে কথা বলিতে হইলেও জোরগলায় বলিতে হয়, কানের কাছে মুখ নিয়া।

 কাদির বড় এক পাইকার পাইয়াছে। খুচরা বিক্রিতে ঝামেলা। অবশ্য দর দুই চারি পয়সা করিয়া মণেতে বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু মণামণি হিসাবের বিক্রি তার চাইতে অনেক ভাল। আগেভাগে শেষ করিয়া উঠিয়া পড়া যায়। বয়স্কদের ভিড়ে আর ঠেলাঠেলিতে তিষ্ঠিতে না পারিয়া অনন্তর সঙ্গীরা হাট ঘন হইয়া জমার মুখেই সরিয়া পড়িয়াছে। অনন্ত চাহিয়া দেখে সচল চঞ্চল এক জনসমুদ্রের মধ্যে সে একা। বালক অনন্তর ইচ্ছা করে বনমালীর একখানা হাত ধরিতে।

 কাদির শক্তহাতে দাঁড়িপাল্লা তুলিয়া ধরিল, একদিকে চাপাইল দশসেরী বাটখারা, আর একদিকে ডুবাইয়া তুলিল আলু। আর মুখে তুলিল কারবারীদের একটা হিসাবের গৎঃ আয়, লাভে রে লাভে রে লাভে রে লাভে, আরে লাভে! আয়, দুয়ে রে দুয়ে রে দুয়ে রে দুয়ে, আরে দুয়ে! আয়, তিনে রে তিনে রে তিনে রে তিনে, আরে তিনে—

 বেচাবিক্রি চুকাইয়া কাদির বলিল, ‘বাবা বনমালী, যাইও একবার বিরামপুরে, কাদির মিয়ার নাম জিগাইলে হালের গরুতে অবধি বাড়ি চিনাইয়া দিব। যাইও।’


 গুণ-টানা নৌকার মতন বনমালী অনন্তর হাত ধরিয়া টানিয়া চলিয়াছে। এই বাজারের ভিতর দিয়া অনন্ত রোজ দুই চারিবার করিয়া হাঁটে। কিন্তু ভরা হাটের বেলা সে কোনদিন এখানে ঢোকে নাই। আজ দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া গেল। একজায়গায় বসিয়াছে পানের দোকান। দোকানের পর দোকান। বড় বড় পান গোছায় গোছায় ডালার উপর সাজানো। কাছে একটা হাঁড়িতে জল; দোকানীরা বার বার হাত ডুবাইয়া জল পানের উপর ছিটাইয়া দিতেছে, আর যত বেচিতেছে পয়সা সেই হাঁড়িটার ভিতর ডুবাইয়া রাখিতেছে। বনমালী খুব বড় দেখিয়া এক বিড়া পান কিনিয়া অনন্তর হাতে দিল। হাতে লইয়া অনন্তর চোখ জলে ভরিয়া আসিতে থাকে। বনমালীকে বুক খুলিয়া শুনাইতে চায়ঃ হাটের দিন দুপুরের আগে এই দোকানীটা নৌকা হইতে পান তুলিয়া ভাঁজ করিতে বসে। একখানা চৌকির উপর বসিয়া পানের গোছা হাতে করিয়া তার মধ্য হইতে পচা আধ-পচা পানগুলি ফেলিয়া দেয়। সঙ্গীদের লইয়া সে কতদিন এই ছেঁড়াকোড়া পচা পানগুলি কুড়াইয়া নিয়াছে। মা কোনদিন পয়সা দিয়া পান কিনিয়া খাইতে পারে নাই। তার হাতের কুড়ানো পচা-পান পাইয়া মা কত খুশি হইয়াছে। একদিন অনন্ত তিতাস হইতে সেই লোকটাকে এক হাঁড়ি জল তুলিয়া দিয়াছিল। দোকানী সেদিন পচা-পান তো দিলই, সামান্য একটু দাগী হইয়াছে, একটু ছিঁড়িয়া ভাল পানের সঙ্গে মিশাইয়া দিলে কেহ ধরিতে পারিবে না, এমন পানও তার দিকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়াছে। সেও অভ্যাসবশে ধরিয়াছে, কিন্তু তখন আর তাহার মা নাই। এই রকম ভাল ভাল পান ফেলিয়া দিবার কিছুদিন আগেই একদিন মা মরিয়া গেল। মাসী পান বড় একটা খায় না। দিলেও খুশি হয় না, না দিলেও রাগ করে না। মাসীর মা খায়—দিলে খুশি হয় না, না দিলে মারে।

 কিন্তু এ সকল কথা এ লোকটাকে কি বলা যায়! মোটে একদিনের দেখা। আর দোকানীটা নিশ্চয়ই আমাকে মনে রাখিয়াছে। তারপাশে কত ঘুরিয়াছি আধ-পচা পানের জন্য। মনে কি আর রাখে নাই? সব সময়ই তো মনে ভাবিয়াছে এ ছেলেটা খালি আধ-পচা পানই নিবে। ফেলিয়া দেওয়া পান। কোনদিন পয়সা দিয়া কিনিতে পারিবে না। আজ সে দেখুক তার ডালার সব চাইতে দামী পানের বড় একটা গোছা তার হাতে। পয়সা দিয়া কেনা।

 সুপারির গলি হইতে বনমালী কিছু কাটা-সুপারিও কিনিল।

 আরেক জায়গাতে কতকগুলি গেঞ্জির দোকান। মলাটের বাক্স খুলিয়া মাটির উপর বিছানো চটে সাজাইয়া রাখিয়াছে। বুকে ফুলকাটা একটা গেঞ্জি কিনিল বনমালী। গলা হইতে বুক পর্যন্ত বোতামের এলাকায় লম্বা একটা সবুজ লতা, তাতে লালফুল ধরিয়াছে। এতক্ষণ খালি গা ছিল। এবার নূতন গেঞ্জিতে বনমালীকে রাজপুত্রের মত মানাইয়াছে বলিয়া অনন্ত মনে মনে আন্দাজ করিল। লতাটাও কত সুন্দর।


 আরও সুন্দর বাজারের এদিকটা। মাঝখানে পায়ে চলার জায়গা খালি রাখিয়া দুইপাশে তারা পসরা সাজাইয়াছে। চলতি কথায় ইহাদিগকে বেদে বলে, কিন্তু সাপুড়ে নয়। অত্যন্ত লোভনীয় তাদের দোকানগুলি। একধারে অনেকগুলি কোমরের তাগা। পোষমানা সাপের মত শোয়াইয়া রাখিয়াছে। কতক কালো, আর কতক হল্‌দে লালে মিশানো। মাথায় এক একটা জগজগার টোপর। একদিকে এলাইয়া রাখিয়াছে কতকগুলি আরসি। একদিকে নানা রঙের ও নানা আকারের সাবান। আর একখানে পুঁতির মালা, রেশমী ও কাঁচের চুড়ি। আরও অনেক কিছু। এক একটা দোকানে এত সামগ্রী। বনমালী পাশে বসিয়া দুই তিনটা সাবানের গন্ধ শুঁকিয়া বলিল, জলে-ভাসা সাবান আছে? আছে শুনিয়া গন্ধ শুঁকিয়া দর করিয়া রাখিয়া দিল। কাঁচের চুড়ির মধ্যে তিন আঙ্গুল ঢুকাইয়া মাপ আন্দাজ করিল, তারপর রাখিয়া দিল। কিনিল না। কিনিল খালি কয়েকটা বঁড়শি। এক কোণে কতকগুলি বাল্যশিক্ষা, নব-ধারাপাত বই। অনন্ত ইত্যবসরে বসিয়া পাতা উল্টাইতে শুরু করিয়া দিল। দুইটা গরু নিয়া এক কৃষক চাষ করিতেছে ছবিটাতে চোখ পড়িতে না পড়িতে দোকানী ঝঙ্কার দিয়া উঠিল। অনন্তর আর দেখা হইল না।


 বনমালী অনন্তর হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে ধনঞ্জয়কে বলিল, ‘গাঁওয়ের নাপিতে চুল ছাঁটেনা, যেমুন কচু কাটে। আর হাটের নাপিতে চুল কাটেনা, যেমুন রান্দা দিয়া পালিশ করে। নাওয়ে গিয়া থাইক্য, চুল কাটাইতে গেলাম।’

 নাপিতের উঁচু ভিটিখানাতে গিয়া দেখা গেল কতক নাপিতের হাতের কাঁচি, চিরুণির উপর দিয়া কাচুম কাচুম করিয়া বেদম চলিয়াছে, আর কতক নাপিত ক্ষুর কাঁচি চিরুণি এবং নরুণ লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। মাথায় অগোছাল লম্বা চুল দেখিয়া বনমালীর উদ্দেশ্য তারা বুঝিল। বুঝিয়া নানা জনে নানা দিক হইতে তাহাকে ডাকিতে লাগিল। অনন্তর মাথার চুলও বেশ লম্বা হইয়াছে, কিন্তু তাহার গলায় ধড়া দেখিয়া কেহ তাহাকে ডাকিল না।

 চুলকাটা শেষ করিয়া দেখে বেলা ডুবিয়া গিয়াছে। নাপিত একখানা ছোট আয়না বনমালীর হাতে তুলিয়া দিল, কিন্তু তার ভিতর দিয়া তখন কিছুই দেখা যায় না। অপ্রসন্ন মনে উঠিয়া পড়িল বনমালী। আবার অনন্তকে হাতে ধরিয়া বাজার-সমুদ্র পার করিয়া ঘাটের কিনারায় আনিল। হাট তখন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। ধনঞ্জয় একছালা গাব, দুইটা বাঁশ, সপ্তাহের মত হলুদ লঙ্কা লবণ জিরা মরিচ কিনিয়া তৈরী হইয়া আছে।

 বনমালী মনে মনে বলিল, আজ আর ও-পাড়ায় যাইব না। রাত হইয়া গিয়াছে, আর একদিন আসিলে যাইব। প্রকাশ্যে বলিল, ‘হেই পুলা, তুই আমার নাওয়ে যাইবি? আমি খালে-বিলে জাল লইয়া ঘুরি, মাছ ধরি মাছ বেচি, নাওয়ে রাঁন্ধি নাওয়ে খাই। সাত দিনে একদিন বাড়িত্ যাই। যাইবি তুই আমার নাওয়ে?’

 অনন্ত ঘাড় কাত করিয়া জানাইল, হাঁ যাইবে।

 ‘চল্ তা হইলে।’

 অনন্ত নৌকায় উঠিবার জন্য জলে নামিল।

 ‘আরে না না, অখনই তোরে নেমু না। তোর বাড়ির মানুষেরে না জিগাইয়া নিলে, তারা মারামারি করতে পারে।’

 অনন্ত ঘাড় দুলাইয়া বলিতে চাহিল, না কেহ মারামারি করিবে না।

 ‘না না, তুই বাড়ি যা।’

 অনন্ত জোর করিয়া নৌকার গলুই আঁকড়াইয়া ধরিল।

 ধনঞ্জয়ের ধমক খাইয়া বনমালী নৌকায় গিয়া উঠিল, কিন্তু ছেলেটার জন্য তার বড় মায়া লাগিল। তাকে বাড়িতে আগাষ্টয়া দিয়া আসা উচিত। এতক্ষণ সঙ্গে করিয়া ঘুরাইয়াছে।

 ধনঞ্জয় লগি ফেলিয়া ঠেলা মারিলে, অনন্তর ছোট দুইখানা হাতের বাঁধন ছিন্ন করিয়া গলুই ডানদিকে ঘুরপাক খাইল এবং দেখিতে দেখিতে নৌকা অন্ধকারের মাঝে কোথায় চলিয়া গেল, আর দেখা গেল না। বুকভরা একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া অনন্ত ডাঙ্গায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

 চারিদিক অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু বাড়ির পথ তার চেনা। ভয়-ডরেরও কিছু নাই। তবু সে যেন দেহে মনে নিরুৎসাহ হইয়া গিয়াছে। পা যেন তার বাড়ির দিকে চলিতে চায় না। বনমালীর শেষ কথা কয়টি রহিয়া রহিয়া তার কানে বার বার বাজিয়া উঠিতে লাগিল। তুই এখন বাড়ি যা। তোদের পাড়া আমি চিনি। আমার বোন বিয়া দিয়াছি তোদের পাড়াতে। আবার আমি আসিব। কোন ভাবনা করিস না তুই। আবার আমি আসিব।

 তুমি বলিয়াছিলে আবার আসিবে, কিন্তু কখন আসিবে! আমার যে আর বাড়িতে যাইতে পা চলিতেছে না! কখন তুমি আসিবে—ভাবিতে ভাবিতে অনন্ত বাড়ির উঠানে পা দিল।

 একটা পরিচিত গলার আওয়াজের আশঙ্কা সে করিতেছিল। শীঘ্রই সেটি শোনা গেল, ‘তেলে-মরা বাতির মত নিম-ঝিম করে,—মরেও না। আইজ ত নিখোঁজ দেইখ্যা মনে করছিলাম, বুঝি পেরেতে ধরছে, অখন দেখি চান্দের ছটার মত হাজির! মনে লয় পোড়া কাঠ মাথায় মাইরা খেদাইয়া দেই, পোড়ামুখি মাইয়া আমার কাল করছে।’

 সুবলার বৌ বাসন্তী একটু আগে নদীর পাড় হইতে খুঁজিয়া আসিয়া কাজে হাত দিয়াছিল। কিন্তু হাতে কাজ উঠিতেছিল না। দৌড়াইয়া আসিয়া বলিল, ‘কি কও গো মা তুমি। মা-মরা, হাতে আগুন, মুখে হবিষ। তুমি কি সগল কথা কও। শত্তুরেও তো এমুন কথা কয় না!’

 ‘শত্তুর শত্তুর। ইটা আমার শত্তুর। অখনই মরুক। সুবচনীর পূজা করুম।’

 সুবলার বউ এবার রণচণ্ডী হইয়া উঠিল, ‘ইটা মরব কোন্ দুঃখে? তার আগে আমি মরি,—আমি ঘরের বাইর হই!’

 মা হঠাৎ নরম হইয়া বলিল, ‘অখন আর কিছু করলাম না। দিমু খেদাইয়া একদিন চেলাকাঠ পিঠে মাইরা।’

 মাসী শুইয়া শুইয়া অনন্তকে আজ কতকগুলি নূতন কথা শুনাইলঃ মা যদি মরিয়া যায়, তবে সে মা আর মা থাকে না, শত্তুর হইয়া যায়। মরিয়া যেখানে চলিয়া গিয়াছে, ছেলেকে সেখানে লইয়া যাইবার জন্য সব সময়েই তার লক্ষ্য থাকে। অন্তত শ্রাদ্ধশান্তি না হওয়া পর্যন্ত একমাস তো খুব ভয়ে ভয়ে কাটাইতে হয়। তার আত্মা তখন ছেলের চারিপাশে ঘুরিয়া বেড়ায় কি না। এক পাইলে, কিংবা আঁধারে, কি বট বা হিজল গাছের তলায় পাইলে, কিংবা নদীর পারে পাইলে, কাছে কেউ না থাকিলে লইয়া যায়। নিয়া মারিয়া ফেলে!

 সেই রাত্রিতে অনন্ত মাকে স্বপ্ন দেখিল। মা কতকগুলি ছেঁড়া কাঁথায় জড়াইয়া কোথা হইতে আসিয়া খালের পাড়ে হুমড়ি খাইয়া পড়িয়াছে। অনন্তকে যে লইয়া যাইবার জন্য আসিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু কই, মারিয়া ফেলিবার মত জিঘাংসা, ক্রোধ কিছুইত তাঁর মধ্যে নাই, মা চাহিয়া আছে তার মুখের পানে বড় করুণ চোখে, বেদনায় কি মলিন মার মুখখানা! হাঁ, মা নিয়া যাইতে চায়; কিন্তু মারিয়া ফেলিবার জন্য নহে, কাছে কাছে রাখিবার জন্য। মার জন্য বড় করুণা জাগিল অনন্তর মনে।


 হবিষ্য সাজাইতে সাজাইতে অনেক বেলা হইয়া যায়। কচি ছেলে। ক্ষুধায় আরও নেতাইয়া পড়ে। সুবলার বউ সবই বুঝে। কিন্তু কিছু করিবার নাই তার! বিধবা সে। বাপের সংসারে গলগ্রহ হইয়া আছে। তার উপর রক্তমাংসের সম্পর্কের লেশ নাই এমন একটা মা-মরা হবিষ্যের ছেলেকে আনিয়া ঝঞ্ঝাট পোহাইতেছে। শুধু কি নিজে ভুগিতেছে। বাপমাকেও ভোগাইতেছে। তার বাপ রাতে জাল বাইস করিয়া সকালে বাড়ি আসে। একঝাঁকা মাছ আনে। কাটিয়া কুটিয়া কতক জালের তলায় রোদে দিতে হয়, কতক ধুইয়া হাঁড়িতে চাপাইতে হয়। মা কেবল হুকুম চালাইয়া খালাস। এত সব করিয়া বাপকে খাওয়াইলে, তবে বাপ ঠাণ্ডা হয়; তারপর তার পয়সায় তারই হাতে বাজার হইতে কিছু আলো চাল আর দুই একটা কলা আনাইতে পারা যায়। সে চাল দিয়া সুবলার বউ মালসায় জাউ রাঁধিয়া দেয়। কলার খোল কাটিয়া সাতখানা ডোঙ্গা বানায়। তাতে জাউ আর কলা দিয়া তুলসীতলায় সারি সারি সাজায়। অনন্ত স্নান করিয়া আসিয়া তাতে জল দেয়। সরিয়া পড়িলে কাকেরা আসিয়া উহা ভক্ষণ করে। যেদিন কাক আসে না, সেদিন অনন্ত ডোঙ্গা হাতে করিয়া আ আ করিয়া ডাকিয়া বেড়ায়—তারা বলিয়াছে, মা নাকি কাকের রূপ ধরিয়া আসিয়া অনন্তর দেওয়া জাউ-কলা খাইয়া যায়। অনন্ত যাহা কিছু শোনে, কিছুই অবিশ্বাস করে না। যে কাকগুলি খাইতে আসে, একদৃষ্টে তাদের দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখে—এর মধ্যে কোন্‌টা তার মা হইতে পারে। এখন আর মানুষ নয় বলিয়া কথা বলিতে পারে না, কিন্তু খাইতে খাইতে ঘাড় তুলিয়া চাহিয়া থাকে—বোধ হয় ঐটাই তাহার মা! কিন্তু বেশিক্ষণ থাকিতে চায় না, খাওয়া শেষ না করিয়াই এক ফাঁকে উড়িয়া যায়!

 অনন্তর কথা শুনিয়া ঘাটের নারীদের কেউ হাসিল, কেউ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। খোলের ডোঙ্গাগুলি পরিষ্কার করিয়া ধুইয়া সেগুলি হাতে লইয়াই সে ডুব দিয়া স্নান করিল। তারপর মাটির ছোট একটি ঘড়াতে জল ভরিয়া যাইতে উদ্যত হইল। একজন স্ত্রীলোক তাহাকে ডাকিয়া ফিরাইল, বলিল, ‘তা হইলে, তোর মা কাউয়া হইয়া আইয়ে?’

 ‘হ’।

 ‘খাওয়া শেষ না কইরা উইড়া যায়!’

 ‘হ।’

 ‘খাইয়া যায় না কেনে?’

 ‘পাছে আমি তার লগে কথা কইতে চাই, এই ডরে বেশিক্ষণ থাকে না। যারা মইরা যায়, তারা ত জীয়ন্ত মানুষের সাথে কথা কইতে পারে না। তার লাগি মানুষের কথা শুনতেও চায় না, মনে মনে বুইঝ্যা চইল্যা যায়।’—অনন্ত মমতায় বিগলিত হইয়া পড়ে।

 মা যখন বাঁচিয়া ছিল, অনন্ত সব সময়ে মার জন্য গর্ব অনুভব করিয়াছে। মার তুলনায় নিজেকে ভাবিয়াছে অকিঞ্চিৎকর! মা মরিয়া গিয়া লোকের কাছে যেন অনন্তর মাথা হেঁট করিয়া দিয়া গিয়াছে। এমন মার ছায়ায় ছায়ায় থাকিতে পারিলে অনন্ত যেন অনেক কিছু অসাধ্য সাধন করিতে পারিত। এখন, মা নাই, তার যে আর কিছুই নাই; লোকের কাছে এখন তার দাম কানাকড়িও না। সে এখন মরিয়া গেলে কারো কিছু হইবে না। কেউ তার কথা মুখেও আনিবে না। কিন্তু মা? একমাস হইতে চলিল মরিয়াছে, এখনও তার কথা কি কেউ ভুলিতে পারিয়াছে? ঘাটে জমিলে মেয়েরা তার মার কথা আলোচনা করে; দুঃখ করে, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। বিশেষ করিয়া অনন্তকে দেখিলে তারা তখন তখনই তার মার কথা শুরু করিয়া দেয়। মার প্রতি কৃতজ্ঞতায় অনন্তর বুক ভরিয়া উঠে।


 ঘাটে আসিয়া যে-বধূটি সকলের চেয়ে বেশি দেরি করে, বেশি কথা বলে, আর কথায় কথায় ছড়া কাটে, দুনিয়ায় তার পরিচয় দিবার উপলক্ষ্য মাত্র দুইটি—এক, সাদকপুরের বনমালীর বোন বলিয়া, আর দুই, লবচন্দ্রের বউ বলিয়া। তবে এখানে প্রথমোক্ত নামে তার পরিচয় বেশি নাই, শেষোক্ত নামেই সে মালোপাড়ায় অভিহিত। কথার মাঝে মাঝে সুন্দর ছড়া কাটিতে পারে বলিয়া সকল নারীরা তাকে একটু সমীহ করে; সে যেন দশজনের মাঝে একজন। শ্রাদ্ধের দিন অনেক নারী দেখিতে আসিল। সেও আসিল। নাপিত আসিয়া অনন্তর মস্তক মুণ্ডন করিয়া গেল। অনন্ত কতকগুলি খড়ের উপর শুইত, সেই খড়গুলি, হাতের আধছেঁড়া নিত্যসঙ্গী কুশাসনখানা, কাঁধের ও কটিদেশের মাঠা-কাপড়ের চিলতা দুইখানা সেই নারীর কথামত নদীতীরে ঘাটের একটু দূরে কাদায় পুঁতিয়া স্নান করিয়া আসিল। পুরোহিত চাউলভরা পাঁচটি মালসাতে মন্ত্র পড়িয়া অনন্তর মাতৃশ্রাদ্ধ সমাধা করতঃ একটা সিকি ট্যাঁকে গুজিয়া চলিয়া গেলে, সেই স্ত্রীলোকটি তাড়া দিল, ভাত বাড়নের কত দেরি! কড়া ডিগা মানুষ। ভুখে মরতাছে!’

 সুবলার বউর এক হাতে সব কাজ করিয়া উঠিতে দেরি হইল। তবু সে পরিপাটি করিয়া পাঁচটি ব্যঞ্জন রাঁধিল। অনন্ত এক স্থানে বসিয়া পড়িয়াছিল। মাসীর মা খেঁকাইয়া উঠিল, ‘নিষ্কর্মা গোঁসাই, আরে আমার নিষ্কর্মা গোঁসাই, একটা কলার খোল কাইট্যা আন্‌তে পারলে না!’

 সেই নারী প্রতিবাদ করিল, ‘চিরদিন গালি দিও মা, আইজের দিনখান সইয়া থাক। দাও দেও, আমি খোল কাইট্যা আনি।’

 লম্বা একটা খোলে ভাতব্যঞ্জন সাজাইয়া সুবলার বউ বলিল, ‘রাঁড়িরে শেষ খাওন খাওয়াইয়া দেই, আর ত কোনদিন খাইতে আইব না।’

 খোলের এককোণে একটু পান সুপারি, একটু তামাক টিকাও দেওয়া হইল।

 সেই নারী সুবলার বৌকে বলিল, ‘তোমার সাথে ত কত ভাব আছিল দিদি! তুমি যাইও না। আমি যাই তারে লইয়া।’

 অনন্ত ভাত ব্যঞ্জন ভরতি খোলটা হাতে করিয়া নদীর পারের দিকে চলিল, সঙ্গে চলিল সেই স্ত্রীলোকটি। সে নির্দেশ দিল, ‘না-জল না-শুক্‌না, এমুন জায়গাত্ রাইখ্যা পাছ ফিরা আইয়া পড়, আর পিছের দিকে চাইস্ না।’

 অনন্ত জন্মের মত মাকে শেষ খাবার দিয়া স্ত্রীলোকটির পিছু পিছু বাড়ি চলিয়া আসিল।


 লোকে তেপথা পথে রোগীকে স্নান করায়, ফুল দিয়া রাখে। যে পা দিবে সেই মরিবে। এ আপদ একদিন কেন সেই পথ দিয়া আসে না!—হবিষ্যের সময় একবার করিয়া খাইত, এখন খায় তিনবার করিয়া। কোথা হইতে আসে এত খাওয়া?

 —বুড়ির এই কথাটা ভাবিবার মত। বুড়া চিন্তা করে, একা মানুষ সে। তিন পেট চালায় তার উপর এই অবাঞ্ছিত পোষ্য। কিন্তু কি করা যায়!

 একদিন বুড়ি প্রস্তাব করিল, ‘ছরাদ্দ শান্তি হইয়া গেছে। অখন কানে ধইরা নিয়া জাল্লার নাওয়ে তুল।’

 বুড়া ইন্ধন জোগাইল, ‘হ। জগতারের ডহরের গহীন পানিত্ একদিন কানে ধইরা তুইল্যা দিমু ছাইড়া। আপদ যাইব।’

 নদীর উপর নৌকাতে ভাসিয়া মাছ ধরার আনন্দ অনন্তর মনে দম্‌কা হাওয়ার মত একটা দোলা জাগাইয়া দিল, কিন্তু বুড়া-বুড়ির কথার ধরণ দেখিয়া উহা উবিয়া গেল।

 তাহা সত্ত্বেও একদিন সন্ধ্যাবেলা জাল কাঁধে লইয়া বুড়া যখন হুকুম করিল, ‘এই অনন্ত, হুক্কা-চোঙ্গা হাতে নে, আজ তোরে লইয়া জালে যামু।’ অনন্ত তখন বিদ্যুতের বেগে আদিষ্ট দ্রব্যগুলি হাতে লইয়া পরম বাধিতের মত আদেশকারীর পাছে পাছে চলিল।

 মাসী দৌড়াইয়া আসিয়া বাধা দিল। বাপ তার অত্যন্ত রাগী মানুষ। রাগ হইয়া যখন মারিতে আরম্ভ করিবে, এক নৌকায় অনন্তকে তখন বাঁচাইবে কে?

 ‘হাতের আগুন নিব্‌তে না নিব্‌তে তুমি তারে জালে নিওনা বাবা। ছোট মানুষ। জলে পইড়া মরে, না সাপে খাইয়া মারে, কে কইব। অখন তারে নিওনা, আরেকটু বড় হইলে নিও।’

 মাসীর কথায় অনন্ত অপ্রসন্ন মুখে নিরস্ত হইল। এবং বুড়াবুড়ি নিরস্ত হইল আরো অপ্রসন্ন মুখে, ভবিষ্যতের এক প্রবল ঝড়ের আভাষ দিয়া।


 মাঝে মাঝে ঝড় হয়। কোনোদিন দিনের বেলা, কখনো রাত্রিতে। দিনের ঝড়ে বেশি ভাবনা নাই; রাতের ঝড়ে বেশি ভাবনা। বাঁশের খুঁটির মাথায় দাঁড়ানো ঘরখানি কাঁপিয়া উঠে। মুচড়াইয়া বুঝিবা ফেলিয়া দেয়। কিন্তু তাতেও অত ভয় করে না। কোনো রাতে ঝড় আরম্ভ হইলে সহজে কমিতে চায় না। সারারাত্রি চলে তার দাপট। কোনো কোনো সময়ে প্রতি রাতে ঝড় আসে। সারাদিন খায় দায়, সন্ধ্যার দিকে আসন্ন ঝড়ের জন্য প্রস্তুত হয়। ঈশান কোণের কালো মেঘ সারা আকাশে ধোঁয়ার মত ছড়াইয়া গিয়া হু হু করিয়া বাতাস আসে। তারপর আসে ঝড়। ভয় হয় ঘরটা বুঝিবা এ রাতেই পড়িয়া যাইবে। পড়ে না। কিন্তু আজই ত শেষ নয়। কালকের ঝড়ে যদি পড়িয়া যায়! পরশুর ঝড়ে! কিন্তু তাতেও অত ভয় করে না —যত ভয় করে বুড়াকে। কোন্ ঝড়ের রাতে অনন্তকে টানিয়া লইয়া নৌকায় তুলিবে, মেয়ে মানুষ সে, বুড়া বাপ তার বাধা মানিবে না। কি সে করিবে। একটা নিঃসহায় নারীর শেষ গচ্ছিত ধন নষ্ট হইয়া যাইবে। ঝড়ে কোন গাঙের বাঁকে বুড়ার নাও উল্টাইয়া যাইবে। বুড় ত মরিবেই, এটাকেও সঙ্গে নিয়া মারিবে।

 দিনের ঝড় অনন্তর খুব ভাল লাগে। একদিন অকারণে পাড়ায় ঘুরিতে ঘুরিতে ঝড় আসিয়া পড়িল। যার যার উঠানে ছেলেরা খেলা করিতেছিল বড়রা ডাকিয়া ঘরে নিয়া ঢুকিল। অনন্তকে কেউ ডাকিল না। কার ঘরে গিয়া উঠিবে ভাবিতেছিল, এমন সময় দেখা গেল যে স্ত্রীলোকটি তার মার শ্রাদ্ধের দিনে তার সঙ্গে নদীর পারে গিয়াছিল সে তার হাত ধরিয়া টানিতেছে। এক সঙ্গে ঝড় ও বৃষ্টি দুই আসিল। সঙ্গে সঙ্গে শিল পড়িল। অনন্তর ন্যাড়া মাথায় কয়েকটা শিল প্রচণ্ড আঘাত করিল, আর ঝড়ো হাওয়ার তোড়ে কয়েকটি বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা তার খড়িউঠা চামড়ায় তীরের মত গিয়া বিঁধিল। কিন্তু পরক্ষণেই সেই নারীর মাথার ঘোমটা খুলিয়া গেল, বাহির হইয়া পড়িল খোঁপাটা আর সিঁথির উপর সযত্নে আঁকা দগদগে লাল সিন্দূরের চিহ্নটা। বড় বড় কয়েকটা শিল সযত্নশোভিত খোঁপাটিকে থেতলাইয়া দিল, বড় বড় কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটা তার সিন্দূরের দাগ গলাইয়া ফ্যাকাসে করিয়া দিল; তার ঘোমটার কাপড় দিয়া ইতিপূর্বেই সে অনন্তর থেলো মাথাটিকে ঢাকিয়া দিয়াছিল।

 কারো ঘরে না গিয়া সে অনন্তকে নিয়া তার নিজের ঘরের বারান্দায় গিয়া থামিল। ততক্ষণে ঝড়ের প্রচণ্ড মাতামাতি সুরু হইয়া গিয়াছে। ঝড়ের এতবড় আলামত অনন্ত জীবনে কোনোদিন দেখে নাই। চারিদিকে ঘরের চালগুলি কাঁপিতেছে, গাছগুলি মুচড়াইয়া এক একবার মাটিতে ঠেকিতেছে আবার উপরে উঠিতেছে, লতাপাতা ছিঁড়িয়া মাটিতে গড়াইতেছে, আবার কোথায় কোন দিকে বাতাস তাহাদিগকে ঝাঁটাইয়া লইয়া যাইতেছে। ঝড় খুব শক্তিশালী সন্দেহ নাই। কিন্তু এ নারীও কম শক্তিশালী নহে। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়া সমানে সে চেঁচাইয়া চলিয়াছে, ‘দোহাই রামের দোহাই লক্ষ্মণের, দোহাই বাণ রাজার; দোহাই ত্রিশ কোটি দেব্‌তার।’ কিন্তু ঝড় নির্বিকার। দাম্ভিক অঙ্গুলি হেলনে ত্রিশ কোটি দেবতাকে কাত করিয়া বহিয়াই চলিল। এবার তার গলার আওয়াজ কাঁপাইয়া অন্য অস্ত্র বাহির করিয়া দিল, ‘এইঘরে তোর ভাইগ্না বউ ছুঁইসনা ছুঁইসনা— এইঘরে তোর ভাইগ্না বউ, ছুঁইসনা ছুঁইসনা।’ কিন্তু ঝড় এ বাধাও মানিল না। পাশব শক্তিতে বিক্রম দেখাইয়া প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরটা কাঁপাইয়া দিয়া গেল। সে নারীও দমিবার নয়। এবার সুর সপ্তমে চড়াইয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘যা বেটা যা, পাহাড়ে যা, পর্বতে যা, বড় বড় বিরিক্ষের সনে যুদ্ধ কইরা যা!’ এ-আদেশ অগ্রাহ্য করিতে না পারিয়াই বুঝিবা ঝড়টা একটু মন্দা হইয়া আসিল এবং ঝিমাইয়া ঝিমাইয়া এক সময় তারও দম বন্ধ হইয়া গেল। অনন্ত বিস্ময়ভরা চোখে তাকাইয়া রহিল তার মুখের দিকে। কি কড়া আদেশ। এমন যে ঝড়, সেও এই নারীর কথায় মাথা নত করিল!


 ঝড়ে মালোপাড়ার প্রায়ই সাংঘাতিক রকমের ক্ষতি করিয়া থাকে। তাদের অর্ধেক সম্পত্তি থাকে বাড়িতে, আর অর্ধেক থাকে নদীতে। যাদের ঘর বাড়ি ঠিক থাকে, তারা হয়ত তিতাসে গিয়া দেখে নাওখানা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। আর যারা নাওয়ে থাকিয়া সারারাত তুফানের সাথে যুঝিয়া আত্মরক্ষা করিয়াছে, তারা হয়ত বাড়িতে আসিয়া দেখে ঘর পড়িয়া গিয়াছে।

 আজিকার এত বড় ঝড়ে কিন্তু মালোপাড়ার অধিক লোকের ক্ষতি করিতে পারে নাই। ক্ষতি করিয়াছে মাত্র দুইটি পরিবারের। কালোবরণের বড় নাওখানা লইয়া মাছ কিনিবার জন্য বড় গাঙে গিয়াছিল। সে নাওখানা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। লোকজন পায়ে হাঁটিয়া পরদিন বাড়ি আসিয়া জানাইয়াছে, একখানা তক্তাও পাওয়া গেল না। একেবারে চুরমার করিয়া ফেলিয়াছে।

 ঘর ভাঙ্গিয়াছে অনন্তর মাসীর বাবার। যে ঘরে অনন্তকে লইয়া মাসী শুইত সেই ঘরখানা।

 ঘরখানা আবার তুলিয়া লইয়া, হিসাব করিয়া দেখা গেল, বুড়ার গাঁটের সব টাকাকড়ি খরচ হইয়া গিয়াছে। এখন দিন-আনা দিন-খাওয়ার অবস্থা। যেদিন মাছ না পাইবে সেদিন উপবাস করিতে হইবে। ঘোর দুর্দিনে এমন অবস্থায় একটা উপরি পোষ্যকে কিছুতেই রাখা চলে না। একথা বুড়ার জপমালা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আর না বলিলেও মাসীর বুঝিতে কষ্ট হয় না। তার মার রকমসকম দেখিয়া মনে হয়, একদিন হয়ত সত্যই ছেলেটার পিঠে সে পোড়া কাঠ চাপিয়া ধরিবে।

 অনেক দিন ধরিয়া সে কালোর মার কথা ভাবিতেছিল। একদিন তার কাছে গিয়া বলিল, ‘আপনে ত তার মারে কত ভালবাসতেন। আমার কাছে তার কষ্টের পারাপার নাই। আপনে তারে লইয়া যান, দুই মুঠা খাইয়া বাঁচব।’

 কিন্তু কালোর মার মন খারাপ। অতবড় নৌকা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। এমন বিপদে কার না মন খারাপ হয়। এই সময়ে এসব ভাবনার কথা এড়াইয়া চলিতেই ভাল লাগে। তবে কালোর মা একেবারে নিরাশ করিল না; বর্ষার পর সুদিন আসিলে কালোবরণ উত্তর হইতে কাঠ আনিবে, নূতন নাও গড়িবে। সে নাওয়ে যখন জিয়লের ক্ষেপ দিতে যাইবে, কালো তখন অনন্তকে সঙ্গে নিতে ভুলিবে না। এই কথা শুনিয়া সুবলার বৌর ভিতরটা মোচড় দিয়া উঠিল।

 কিন্তু সে অনেক দিনের কথা।


 আর একদিন খুব বৃষ্টি হইয়া গেল। বাদলায় পান খুব পচে। তখন পচা-ভালো-মেশানো বিড়ায় বিড়ায় পান ফেলিয়া দেয় দোকানীরা। অনন্তর বয়সী ছেলেমেয়েরা এমন পান হাতভরতি করিয়া কুড়াইয়া আনিতেছে। মাসীর মা নিজের চোখে দেখিয়াছে। তারা অনেক পান আনিয়াছে। আর তাদের মা’রা ডালায় করিয়া লইয়া ধুইয়া খাইয়া মুখ লাল করিয়াছে। অনন্ত কেন গেল না, গেলে ত আনিতে পারিত। অনন্তর খুব ভাল লাগে, হাটে-বাজারে ঘুরিতে। বুড়ির ইঙ্গিত পাইয়া সে খুশিমনে ছুটিল বাজারের দিকে।

 বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে একটু আগে। বাজারের রাস্তা দিয়া তখনও জলের স্রোত চলিতেছে। কোথায় কোন ডোবা উপচাইয়াছে, তারই জল। দুএকটি পানাও আসে সেই জলের সঙ্গে। অনন্তর বয়সী কয়েকটি ছেলে, তাদের বাপদাদারা যেমন লম্বা বাঁশের আগায় জাল বাঁধিয়া খালের দুই পাড় আগ্‌লাইয়া জাল পাতে, তারই অনুকরণে রাস্তার দুইধার বন্ধ করিয়া দুইটি কঞ্চিতে দড়ি আর সূতা বাঁধিয়া জাল পাতিয়া বসিয়াছে। পায়ের গোড়ালির চাপে কঞ্চির আগা উঁচাইয়া, দড়ি টানিয়া, বুক চিতাইয়া, যেন কত মাছই জালে উঠিয়াছে এমন একটি ভাব-ভঙ্গিতে না-দেখা মাছ সব ঝাড়িয়া ফেলিতেছে। অনন্তকে তারা একসাথে ডাক দিয়া তার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। দৌড়িয়া আসিয়া অনন্ত সকৌতূহলে বলিল, ‘কি মাছ উঠেরে?’

 ‘এই তর চান্দা বৈচা, তিত্-পুঁটি। জব্বর মাছ উজাইছে, আইজকার ঢলে।’

 অনন্ত ও তাদের সঙ্গে মাছ-ধরার খেলায় মাতিয়া গেল।

 কতক্ষণ এই খেলা চলিল। শুধুই খেলা। মেয়েরা যেমন মাটির ভাত রাঁধিয়া রাঁধা-রাঁধা খেলা করে, তেমনি এ মাছ-ধরা-ধরা খেলা।

 সহসা তাদেরই একজন আবিষ্কার করিল একটা সত্যিকারের কৈ মাছের বাচ্চা কান্‌কো আছড়াইয়া উজাইবার চেষ্টা করিতেছে। সব কয়টি দস্যিছেলে একসঙ্গে হৈ হৈ করিয়া ছুটিয়া গিয়া মাছটিকে লুঠ করিয়া আনিল। তারপর দেখা গেল—একের পর এক ছোট বড় কৈ মাছ স্রোত ঠেলিয়া উজাইতেছে। অনন্তর দলের তখন মহা স্ফূর্তি। যার পরণে যা ছিল, তারই কোঁচড় করিয়া তারা ইচ্ছামত কৈ মাছ ধরিল। ধরিতে ধরিতে বেলা ফুরাইয়া গেল। রাস্তার জলের স্রোতটুকু একসময় বন্ধ হইয়া গেল। কৈ মাছও আজিকার মত উজাইবার পালা সাঙ্গ করিল।

 পানের কথা অনন্তর একবারও মনে পড়িল না। এক কোঁচড় জ্যান্ত কৈ মাছ লইয়া খুশি মনে সে ঘরে গিয়া ঢুকিল।

 বাড়ির কর্তার মন ভাল না। খালে জাল পাতিয়া পুঁটি মাছে নাও বোঝাই করিয়া ফেলিয়াছে, কিন্তু এক পয়সাও বেচিতে পারিল না। বাদলার দিন বলিয়া ব্যাপারী আসিল না, হাটও বসিল না। বাদলার দিন বলিয়া শুকাইতেও দেওয়া চলিবে না। এত মাছ সে করিবে কি?

 ‘আমি চাইলাম পান, লইয়া আইছে মাছ। মাছ দিয়া আমি কি করুম। আমার কি মাছের অভাব?’ বুড়ি গজ গজ করিতে লাগিল।

 পরের দিন দুপুরে বুড়ির মনে পড়িয়া গেল, অনন্তকে তো পোড়াকাঠ মারা হয় নাই। উনানের ধারে গিয়া দেখে সেখানে পোড়া কাঠ নাই। তার উনুনমুখী মেয়ে খড়দিয়া রান্না করিতেছে। অনন্ত কাছে বসিয়া কি যেন গিলিতেছে। বুড়ি খপ্ করিয়া একমুঠা পোড়া খড় উনান হইতে তুলিয়া লইল। একদিক তখনো জ্বলিতেছে। কিন্তু এ দিয়া তো পিঠে মারা যায় না। মুখে গুঁজিয়া দেওয়া যায়। বুড়ি এক হাতে অনন্তর হাত ধরিয়া আরেক হাতে জ্বলন্ত খড় তার মুখে গুঁজিতে গেল। তার মেয়ে বাধা দিতে আসিলে তারও মুখে গুঁজিতে গেল। মেয়ে হেঁচ্‌কা টানে খড়গুলি বুড়ির হাত হইতে কাড়িয়া লইয়া মাটিতে ফেলিয়া দিল। আচমকা খড়ের আগুন হাতে লাগিয়া বুড়ির হাতের খানিকটা পুড়িয়া গেল। রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে সে মেয়ের গলা চাপিয়া ধরিল। তারপর মায়েতে মেয়েতে শুরু হইল তুমুল ধ্বস্তাধ্বস্তি। মেয়ে শেষে কায়দা করিয়া মাকে মাটিতে ফেলিয়া বুকের উপর বসিল। তারপর চুলের মুঠি ধরিয়া তার মাথাটা ঘন ঘন মাটিতে ঠুকিয়া শেষে ছাড়িয়া দিল। বুড়ি ছাড়া পাইয়া কোন রকমে উঠিয়া গিয়া ভাতের হাঁড়িটা বড় ঘরে টানিয়া তুলিয়া খিল আঁটিয়া দিল।

 মারামারির মাঝখানে অনন্ত বাহির হইয়া গিয়াছিল। যার আদেশে ঝড় থামিয়া গিয়াছিল, সেই নারীকে ডাকিয়া আনিবার জন্য। সে না হইলে, এই যুদ্ধ থামাইবে কে? কিন্তু তাকে ঘরে পায় নাই। ফিরিয়া আসিয়া দেখে মাসী ম্লানমুখে বসিয়া আছে। চুলগুলি আলুথালু। পিঠের কাপড় খুলিয়া গিয়াছে। রণজয়ের ক্লান্তিতে যেন ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে মাসী। ভয়ে ভয়ে কাছে আসিয়া দাঁড়াইতেই সহসা তার দিকে চাহিয়া মাসীর চোখ দুইটি জ্বলিয়া উঠিল। বজ্রের মত গর্জন করিয়া উঠিয়া সে বলিল, ‘শত্তুর, তুই বাইর হ। এই ঘরে তুই ভাত খাস ত তোর সাতগুষ্ঠির মাথা খাস। তোর লাগি আমার মায়েরে মারলাম। তুই আমার কি, ঠ্যাঙ্গের তলা, পায়ের ধূলা। যা যা, অখনই যা, যমের মুখে যা। ডাকিনী যোগিনীর মুখে যা, কালীর মুখে যা। ধর্মে যেন আর তোরে ফিরাইয়া না আনে। চোখের মাথা নাকের মাথা খাইয়া যেখানে যমে টানে, সেইখানে যা। আমার সামনে আর মুখ দেখাইস না। তোর মা গেছে যে-পথে, তুইও সেই পথে যা।’

 কিন্তু ওকি, অনন্তর অমন আদর-কুড়ানো ম্লান মুখখানা যে দৃঢ়তায় কঠোর হইয়া উঠিল! অমন ঢল ঢল আয়ত চোখ দুইটা যে শৈশব-সূর্যের মত লাল তেজালো হইয়া উঠিল! ওকি! সুবলার বউ কি স্বপ্ন দেখিতেছে!

 কোন্ যুদ্ধজয়ী বীর যেন পলকে সব কিছু ফেলিয়া ছড়াইয়া চলিয়া যাইতেছে। ছোট ছোট পা দুইখানাতে এত জোর। মাটি কাঁপাইয়া যেন চলিয়াছে অনন্ত। ছুটিতেছে না, ধীরে ধীরে পা ফেলিতেছে। কিন্তু কি শব্দ! এক একটা পদক্ষেপ যেন তার বুকে আসিয়া আঘাত করিতেছে। বারান্দা হইতে উঠানে নামিয়াছে। তার বুকের সীমানাটুকু ছাড়াইয়া অনন্ত যেন এখনি কোন্ এক আজানা জগতে লাফ দিবে। সুবলার বউ আর স্থির থাকিতে পারিল না। উঠিয়া হাত বাড়াইয়া স্খলিত কণ্ঠে ডাকিল, অনন্ত! অনন্ত ফিরিল না। সুবলার বউ পড়িয়া যাইতেছিল। তার মা কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া ধরিল। মার বৃদ্ধ বুকে মাথা রাখিয়া সুবলার বউ এলাইয়া পড়িল, সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ দুইটিও বুজিয়া আসিল।


 অন্তহীন আকাশের তলায় অনন্তর আজ পরম মুক্তি। কারো পিছুর ডাকে সে আর সাড়া দিবে না। প্রথমেই তিতাসের পারে গিয়া দাঁড়াইল। প্রাণ ভরিয়া একবার দেখিয়া লইল নদীটাকে। ঢেউয়ের পর ঢেউ চলিয়াছে, দুরন্ত স্বপ্নের মত, উদাত্ত সঙ্গীতের মত। জল বাড়িতেছে। নৌকাগুলি চলিয়াছে। কোথাও বাধা বন্ধ নাই। সব কিছুতেই যেন একটা সচল ব্যস্ততা! আজিকার এই সময়ে সে যদি আসিত! আসিবে বলিয়া গিয়াছে। কতদিন ত হইয়া গেল। সেত আসিল না! বাজারের ঘাটে যেখানে সে নৌকা ভিড়াইয়াছিল সেখানে গিয়া দাঁড়াইল। এখানে দিনের পর দিন বসিয়া থাকিবে। তার জন্য প্রতীক্ষা করিবে। একদিন হাটবারে সে আসিবেই।

 খালের মুখে মস্তবড় একটা ভাঙ্গা নৌকা ‘গেরাপী’ দিয়া রাখিয়াছে। অনন্ত তার উপর গিয়া উঠিল। ভয়ানক পিছল। বাতায় ধরিয়া ছইয়ের ভিতর ঢুকিল। নৌকায় আধ বোঝাই জল। চাহিলে ভয় করে। একবার পা ফস্কাইয়া তলায় পড়িয়া গেলে অনন্ত সে-জলে ডুবিয়া মারা যাইবে। পাছার দিকে কয়েকখানা পালিস পাটাতন। রোদ বৃষ্টি কিছুই ঢুকিবে না। কেউ দেখিতে পাইবে না। ভারী সুন্দর। এখানে অনন্ত চিরদিন কাটাইয়া দিতে পারিবে। যতদিন সে না আসিবে, এখানেই কাটাইয়া দিবে।

 এখান হইতে সোজা দক্ষিণ দিকে নদীর গতি। চাহিলে শেষ অবধি দেখা যায়। বহু দূরদূরান্তর হইতে, দক্ষিণের রাজ্য হইতে কেউ বুঝি ঢেউ চালাইয়া দেয়, সেই ঢেউ আসিয়া লাগে অনন্তর এই নৌকাখানাতে। সেদিকে চোখ মেলিয়া চাহিয়া থাকে। কিন্তু সে ত ওদিক হইতে আসিবে না, সে আসিবে পশ্চিম দিক হইতে।

 অনন্ত একএকবার পশ্চিম দিকে যতদূর চোখ যায়, চাহিয়া দেখে—সে আসে না। ব্যর্থতায় তার মন ভরিয়া যায়। আবার দক্ষিণ দিকে চায়, দেখে নদী কত দীর্ঘ। এই দীর্ঘতা তার মন আশায় ভরাইয়া দেয়।

 বিকালে ক্ষুধা পাইলে চুপি চুপি নামিয়া আসিয়া সেই পানওয়ালাটার সামনে দাঁড়াইল। আজ হাটবার নয়। পানওয়ালা তেমনিভাবে পান ভাঁজাইয়া চলিয়াছে। তার ইঙ্গিত পাইয়া এক হাঁড়ি জল তুলিয়া দিল। সেও প্রতিদানে এক গোছা পান তার দিকে ফেলিয়া দিল। অনন্ত পান লইল না। কি ভাবিয়া লোকটা একটি পয়সা দিল। অনন্ত এক পয়সার ছোলাভাজা খাইয়া দেখিল পেট ভরিয়া গিয়াছে।

 কালো আঁধার। পাটাতনে শুইয়া খুব ভয় করিতেছিল। কিন্তু কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সকালে জাগিয়া দেখে সারারাত তার মা ঠিক তার কাছটিতে শুইয়া গিয়াছে, তার দেহের উষ্ণতা এখনও পাটাতনে লাগিয়া রহিয়াছে। ওরা মিথ্যাকথা বলিয়াছে। মা কি কখনও তার অনিষ্ট করিতে পারে? মা দিনের বেলা দেখা দিতে পারে না মরিয়া গিয়াছে বলিয়া, কিন্তু রাতে ঠিক আসিবে। আর সে কিছুরই ভয় করিবে না।


 বড় ঘটা করিয়া, বড় তেজ দেখাইয়া চলিয়া গিয়াছে ছেলেটা। যে-খানেই থাক, মরিবেনা ঠিক। একটা গোটা মানুষের মরিয়া যাওয়া কি এতই সহজ? সে যদি আর কখনো ফিরিয়া এঘরে না আসিত, কেউ যদি তাকে দেখিতে পাইয়া সঙ্গে করিয়া নিয়া মানুষ করিত! কোন্ মুখে আর সে এঘরে আসিবে! ঈশ্বর করুন আর যেন সে ফিরিয়া না আসে! যার মা নাই, দুনিয়ার সব মানুষই তার কাছে সমান। আর কোনো মানুষের বাড়িতে সে চলিয়া যাক।

 চারদিন পরের এক দুপুরে নারীদের মজলিসে বসিয়া সুব্‌লার বউ এই কথাগুলিই ভাবিতেছিল। অনন্তর প্রসঙ্গ উঠিতেই বলিল, ‘আপদ গেছে ভাল হইছে। কার দায় কে সামলাইবে গো দিদি? আমার পেটের না পিঠের না, আমার কেনে অত ঝকমারি। মা খালি ঘরে পইড়া মরছে। কেউ নেয় না দেইখ্যা আমি গিয়া আন্‌ছিলাম। অখন শ্রাদ্ধশান্তি চুইক্যা গেছে, অখন যেখানে খুশি গিয়া মরুক। আমার দায় ফইরাদ নাই।’

 নিজে এতগুলি কথা বলিল সকলের অনন্ত সম্বন্ধে বলিবার সকল কথা চাপা দিবার জন্য। তবু একজন বলিয়া বসিল, আমার বিন্দাবন দেখিয়াছে, গামছায় করিয়া হাটে খলসে মাছ বেচিতেছে।

 আর একজন পান চিবাইতে চিবাইতে বলিল, আমার নন্দলাল দেখিয়াছে, পচাপানের দোকানের সামনে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দোকানী কত পচা পান তার দিকে ছুঁড়িয়া ফেলিতেছিল, সে একটিও না ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

 সুবলার বউ আর শুনিতে চায় না। কিন্তু তৃতীয় একজন না শুনাইয়া ছাড়িল না। কাল রাতের আঁধারে লবচন্দ্রের বউয়ের ঘরে গিয়া ঢুকিল কতকগুলি পানসুপারী নিয়া। লবচন্দ্রের বউ তাকে ভাত খাওয়াইয়া বিছানা করিয়া বলিল, শুইয়া থাক; কিন্তু শুইল না, বাহির হইয়া ভূতের মতন আঁধারে মিলাইয়া গেল। দিনের বেলা লবচন্দ্রের বউ তার স্বামীকে দিয়া কি খোঁজাটাই না খোঁজাইয়াছে, কিন্তু কোথায় থাকে কেউ বলিতে পারে না! কেউ নাকি বলে জঙ্গলের মধ্যে থাকে, কেউ বলে শিয়ালের গর্তে থাকে— কেউ বলে, যাত্রাবাড়ির শ্মশানে যে মঠ আছে, তার ভিতর থাকে! ছেলেটা দেওয়ানা হইয়া না গেলেই হয় দিদি।

 খুব যে দরদ লবচন্দ্রের বউ-এর। স্বামীকে দিয়া খোঁজাইয়াছে। বলি কয়দিনের কুটুম? এতদিন দেখাশুনা করিয়াছে কে? মা যখন মরিল, লবচন্দ্রর বউ তখন কোথায় ছিল? আর মরিতে আসিলেই যদি, এদিকের পথে ত কাঁটা দিয়া রাখে নাই কেউ। ভাত ভিক্ষা করিয়া খাইতে আসিয়া লবচন্দ্রর ঘরে কেন—এমন ভিক্ষা ত আমিও দিতে পারিতাম। কথাগুলি সুবলার বউ মনে মনে ভাবিল, কিন্তু প্রকাশ করিয়া বলিল না।

 রাত্রিতে পেট পুরিয়া খাইয়া শুইতে গিয়াছে, এমন সময় বিন্দার মা আসিয়া বলিল, ‘অ সুবলার বউ, দেইখ্যা যা রঙ্গ।’

 ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া গিয়া দেখে অনন্ত আঁস্তাকুড়ের পাশে বসিয়া বসিয়া আঁচাইতেছে, আর লবচন্দ্রর বউ হাতে একটা কেরাসিনের কুপি লইয়া দাঁড়াইয়া আছে! এতখানি সামনে গিয়া পড়া সুবলার বৌয়ের অভিপ্রেত ছিল না। সে হকচকাইয়া গেল। ছেলেটা একটুও না চমকাইয়া হাতের ঘটি মাটিতে রাখিয়া গটগট করিয়া চলিয়া গেল; কেহ কিছু বলিতে পারিল না।

 ফেরার পথে সুবলার বউ বলিল, ‘বিন্দার মা, একদিন ধইরা জন্মের শোধ মাইর দিয়া দেই, কি কও।’

 বিন্দার মা কিছু বলিল না।


 ভিতরে ভিতরে কি ষড়যন্ত্র হইতেছিল, সুবলার বউকে কেউ কিছু জানিতে দিল না। একদিন দেখা গেল, লবচন্দ্রর বৌর ভাই আসিয়াছে, নাম নাকি তার বনমালী। যে-রহস্য কেউ ভেদ করিতে পারে নাই, সে-রহস্য ভেদ করিয়া ফেলিয়াছে; খালের মুখের এক গেরাপী-দেওয়া ভাঙ্গা নৌকার খোপ হইতে টানিয়া বাহির করিয়া আনিয়াছে অনন্তকে। তারপরের দিন দেখা গেল তারা তিনজনে মিলিয়া নৌকায় গিয়া উঠিয়াছে।

 সব কথা শুনিয়া সুবলার বৌর যাইতে প্রবৃত্তি হইতেছিল না। বিন্দার মা জানে তার ব্যথাটা কোথায়; বলিল, ‘এদ্দিন পাল্‌লি-লাল্‌লি, খাওয়াইলি ধোয়াইলি, আইজ পরে লইয়া যায়, কোনদিন দেখ্‌বি কি দেখ্‌বি না, শেষ দেখা একবার দেইখ্যা দে।’

 হাঁ, শেষ দেখা একবার দেখিতে হইবে! সুবলার বউ উঠিয়া পড়িল।

 ঘাটের কাছে অনেক নারী গিয়া জমিয়াছে। সাহা পাড়ার এক নারি ঝাকুনি মারিয়া কলসী কাঁকালের উপরে তুলিতে তুলিতে মালো পাড়ার এক নারীকে বলিল, ‘কারে কে লইয়া যাইতাছে গো দিদি!’

 —লবচন্দ্রর বউ উদয়তারাকে তার দাদা বনমালী নিতে আসিয়াছিল, নিতেছে। আমার বাপের বাড়ি আর তার বাপের বাড়ি এক গাঁয়ে, পাশাপাশি ঘর।

 ‘বুঝলাম।’

 নারীদের দলে গিয়া সুবলার বউও দাঁড়াইল। দেখিল, দুই জনেই মহা খুশি। উদয়তারা মাঝে মাঝে ছড়া কাটিয়া রঙ্গ করিতেছে আর অকৃতজ্ঞ কুকুরটা খুশি মনে এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিতেছে।

 উদয়তারা এখন আর লবচন্দ্রের বউ নহে; এখন সে বনমালীর বোন। গর্বিত দৃষ্টিতে ঘাটের নারীদের দিকে চাহিল সে। একটি বৌ ম্লান মুখে তাকাইয়াছিল উদয়তারার দিকে, তারও বাপের বাড়ি নবীনগর গ্রামে। তাকে খুশি করিবার জন্য উদয়তারা ডাকিয়া বলিল, ‘কিগো নবীনগরের ছবি না, বহু দিন ধইরা যে দেখি না?’

 উদয়তারাকে যারা জানে তারা সকলেই হাসিয়া উঠিল।

 সে বৌও অমনি ফিক করিয়া হাসিয়া বলিল, ‘জামাই-ঠকানী, কি কয় লা?’

 এই কয়জনার হাসি-তামাসার মধ্যে বনমালীর নৌকা তিতাসের জলে ভাসিয়া পড়িল।

 আকাশটা বেজায় ভারী। মেঘে মেঘে ছাইয়া গিয়াছে। সারাদিন সূর্যের দেখা নাই। মাথার উপর যেন চাপিয়া ধরিয়াছে বাদলার এই নুইয়া-পড়া আকাশটা। মানুষের অবাধে নিশ্বাস ফেলার অনেকখানি অধিকার আত্মসাৎ করিয়া ময়লা একখানা কাঁথা দিয়া বুঝি কেউ ঢাকিয়া ফেলিয়াছে মালোপাড়াটাকে।

 হু হু করিয়া বাতাস বহিতেছে। মাথার কাপড়টুকু বুকে পিঠে দুই তিন পরতা জড়াইয়া সুবলার বউ একটা মেটে কলসী লইয়া নদীতে গেল।

 পারের উঠানের মত ঢালা জায়গা এতদিন অবারিত ভাবে পড়িয়া থাকিত। জেলেরা জাল ছড়াইত, জেলের ছেলেরা লম্বা করিয়া মেলিয়া সূতা পাকাইত। ছেলেরা শিশুরা বয়স্কা বিধবারা রোদের জন্য সকালে গিয়া বসিত; বিকালে ছেলেরা খেলা করিত। ছুটিয়া-আশা দুটি একটি গরু ছাগল ঘাস খাইত। রাক্ষুসী তিতাস ধাপে ধাপে বাড়িয়া আসিতে আসিতে তার অনেকখানি জায়গা গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছে। অবাধে কেউ এখানে নড়াচড়া করিবে সে উপায় নাই। সুদিনে কোথায় কোন্ সুদূরে ছিল জল, ভরা কলসী লইয়া আসিতে পথ ফুরাইতে চাহিত না। এখন এত কাছে আসিয়াছে; বাড়ি হইতে নামিয়া পাড়ার বাহিরে পা দিলেই জল। তবু যা একটু জায়গা খালি আছে, আর দুইদিন পরে তাও জলে ভরিয়া যাইবে।—আগে যেখানে নামিয়া স্নান করিতাম, সেখানে আজ গাঙের তলা। বড়জালের বড় বাঁশ ডুবাইয়াও সেখানকার মাটি ছোঁয়া যাইবে না। মাথার উপর কালো আকাশ ঝুলিয়া পড়িয়াছে। পাড়ার বাহিরে তিতাসের কালাপানি সাঁ সাঁ করিয়া আগাইয়া আসিতেছে। দুইদিক হইতেই চাপিয়া ধরার মতলব।

 দক্ষিণ দিকে চাহিলে নির্ভরসায় বুক কাঁপিয়া উঠে! আষাঢ় শেষ হইয়া গিয়াছে। মাঠ ঘাট যতদিন ডাঙ্গা ছিল, বৃষ্টির জল তাহাদের ধুইয়া মুছিয়া সাদা গেরুয়া অনেক মাটি লইয়া গিয়া নদীতে পড়িত। এখন সেসব মাঠ ময়দান জলের তলায় চাপা পড়িয়াছে। তাহাদের উপর এখন বুক জল সাঁতার জল। সব পলিমাটি জলের তলে থিতাইয়া রহিয়াছে, উপরে ভাসিয়া রহিয়াছে নির্মল জল। তিতাসের জল তাই সাদাও নয়, গৈরিকও নয়, একেবারে নির্মল; আর নির্মল বলিয়াই কালো। সেই কালো জলের উপর দিয়া ঢেউয়ের পর ঢেউ আসিয়া এখানে আছাড় খাইতেছে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে জল কেবল আগাইয়া আসিতেছে।

 জেলেদের হইয়াছে ঝকমারি। ঘন ঘন নাও-বাঁধা খুঁটি বদলাইতে হয়। একদিন হাঁটুজলে গলুই রাখিয়া খোঁটা ছিল, পাছার খোঁটা ছিল বুক জলে। তিনদিনের দিন গলুইর খোঁটায় হইয়াছে কোমর জল আর পাছার খোঁটায় সাঁতার পানি। নৌকায় উঠিতে কাপড় ভিজাইতে হইতেছে। তোল আবার খুঁটি, আগাইয়া আনো নাও আরও মাটির কাছে, এইভাবে খুঁটি তোলাতুলি করিতে করিতে শেষে নাওয়ের গলুই পল্লীর গায়ে আসিয়া ঠেকিল।

 নতুন জল মালোপাড়ার গায়ে ধাক্কা দিয়া তার পূর্ণতা ঘোষণা করিয়াছে। ঘরবাড়ির কিনারায় বেতঝোপ, বনজমানী, ছিট্‌কির গাছগাছালি ছিল—নূতন জলের তলায় এখন সেগুলির কোমর অবধি ডুবিয়া গিয়াছে। তার আশেপাশে ঢেউ ঢোকে না, স্রোত চলে, সেই স্রোতে নিরিবিলিতে উজাইয়। চলে ছোট ছোট মাছ। পুঁটি চাঁদা খলসে ডিম ছাড়িয়াছে, বাচ্চা হইয়াছে, সাঁতার কাটিতে আর দল বাঁধিয়া স্রোত ঠেলিয়া উজাইতে শিখিয়াছে সে-সব মাছেরা। থালা ধুইতে গেলে এত কাছ দিয়া চলে, যেন আঁচল পাতিয়াই ধরা যাইবে। অনন্ত এখানে একটা ছোট জাল পাতিলে বেশ ধরিতে পারিত! হাটে নিয়া বেচিতেও পারিত। এই সময় মাছের দর বাড়ে। উজানিয়া-জলে অঢেল মাছ ধরা দেয় না; কমিবার মুখে মরা জলে যত মাছ মারা পড়ে, তখন মাছের দর থাকে কম। এখন দর খুব বেশি।

 ঘাটে লোক নাই। নিরালা ঘাট পাইয়া ঝাঁকে ঝাঁকে তারা ঘাট অতিক্রম করিতেছে। এই রকম কত ঘাট ডিঙ্গাইয়া আসিয়াছে, আরও কতঘাট ডিঙ্গাইতে হইবে, তারপর এত বাধা-বিঘ্নের পাহাড় ঠেলিয়া কোথায় গিয়া তাহাদের যাত্রা শেষ হইবে, কোথায় তাহাদের পথের শেষ, কে জানে! কে তার খোঁজ রাখে? কিন্তু তারা উজাইবে। থালা দিয়া ঢেউ খেলাইয়া বাধা দাও, তারা আলোড়নে কাঁপিয়া কাঁপিয়া একটু পিছু হটিয়া যাইবে। কিন্তু জল স্থির হইলে আবার তারা চলিতে থাকিবে। হাত বাড়াইয়া ধরিতে যাও, নিকট দিয়া যাইতেছিল, দুই হাত বার-পানি দিয়া আবার পাল্লা ধরিবে, তবু তারা যাইবেই। ঘাটে অত্যধিক মানুষের আলোড়ন থাকে যখন, তারা গাছগাছড়ার খোপেখাপে দলে দলে তিষ্ঠাইতে থাকিবে। বেশী বার-পানি দিয়া যাইতে পারে না; ছোট মাছের অগাধ জলে বিষম ভয়, ঘাটের এধারে তারা দলে ভারী হইতে থাকিবে। ঘাট ঠিক চুপ হইলেই আবার যাত্রা শুরু করিবে। কেউ আটকাইয়া রাখিতে পারিবে না।

 ঘাটে কেহ নাই। সুবলার বউ আঁচল পাতিয়া কয়েকটি মাছ তুলিয়া ফেলিল। তারা পুঁটিমাছের শিশুপাল। কাপড়ের বাঁধনে পড়িয়া ফরফরাইয়া উঠিল। জলছাড়া করিবার প্রবৃত্তি হইল না। আঁচল আলগা দিয়া ছাড়িয়া দিল। খলসে বালিকারা কেমন শাড়ি পরিয়া চলিয়াছে। চাঁদার ছেলেরা কেমন স্বচ্ছ—এপিঠ ওপিঠ দেখা যায়। সারা গায়ে বিজল। ধরিলে হাতে আঠা লাগে। একটা ঘন ছোট জাল পাতিয়া অনন্ত ইহাদের সবগুলিকেই ধরিতে পারিত!

 আরও কিছুদিন পরে গলা-জলে জল-বন গজাইয়াছে, আঁকিয়া বাঁকিয়া ঘন হইতে ঘনতর হইয়া সেগুলি মাছেদের এক একটা দুর্গে পরিণত হইয়াছে। মালোর ছেলেরা তখন বসিয়া নাই। বড়রা নৌকা লইয়া মাঝ নদীতে নানা রকমের জাল ফেলিতেছে তুলিতেছে, ছোটরা ছোট ছোট তিনকোণা ঠেলা জাল লইয়া সেই জলদুর্গে অবিরত খোঁচাইয়া চলিয়াছে। কয়েকবারের খোঁচার পর জালখানা টানিয়া মাটির উপর তুলিলে দেখা যায় অসংখ্য চিংড়ি-সন্ততি শুঁয়া উঁচাইয়া লাফাইয়া লাফাইয়া নাচিতে থাকে। দশ বারো খেউ দিলেই মাছে ডোলা ভরিয়া যায়। অনন্তকে একখানা জাল বুনিয়া তিনখানা মোটা কঞ্চিতে বাঁধিয়া দিলে অনেক চিংড়ির ছা’ মারিয়া হাটে গিয়া বেচিতে পারিত! সুবলার বউ যদি নিজে সূতা কাটিত জাল বুনিত, আর অনন্ত চিংড়ি বাচ্চা ধরিয়া হাটে বাজারে বেচিত, তাতে দুই জনের একটা সংসার চলিতে পারিত! মা-বাপের গঞ্জনা হইতে সুবলার বউ বাঁচিয়া যাইত।


 থমথমে আকাশ এক এক সময় পরিষ্কার হয়। সূর্য হাসিয়া উঠে, কালো কেশরের গহনারণ্য ফাঁক করিয়া। বিকালের পড়ন্ত রোদ গাছগাছালির মাথায় হলুদ রঙ বুলাইয়া দেয়। পুরুষ মানুষেরা এই সময় অনেকেই নদীতে। যারা বাড়িতে থাকে, তারা ঘুমায়। নারীরা সূতা পাকাইবার জন্য উঠানে বাহির হয়। চোঙ্গার মত মুখ একটা খুঁটি স্থায়ীভাবে মাটিতে পোঁতা থাকে। তার উপর সূতা-ভরা চরকি বসাইয়া দেয়। টেকোয় সূতা বাঁধিয়া উঠানের এ-কিনারা থেকে ও-কিনারায় পোঁতা একটা বড় খুঁটি বেড়িয়া আনে। তার পর ডান হাঁটুর কাপড় একটু গুটাইয়া লইয়া, নগ্ন ঊরু তুলিয়া তুলিয়া হাতের তেলোয় ঘষা মারিয়া ঊরুতে টেকো ঘুরায়। একবারের ঘুরানিতে টেকে হাজার বার ঘুরে। দশবারের ঘুরানিতে একবেড়ের সূতা পাকানো হইয়া যায়। তখন বুকের খানিকটা কাপড় তুলিয়া ডান হাতের তেলোয় টেকোর ডাঁট ঘুরাইতে থাকে। বাঁ হাত থাকে টেকোর ঘাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটিয়া চলে সে নারী। এই ভাবে পাকানো সূতা টেকোতে গুটানো হইয়া যায়। নিতান্তই পুরুষের কাজ। কিন্তু মালোর মেয়েরা কোন কাজ নিতান্তই পুরুষের জন্য ফেলিয়া রাখিতে পারে না। রাখিলে চলেও না। নদীতে খাটিয়া আসে। সূতা পাকাইবে কখন? তাই, পুরুষের আনাগোনা না থাকিলে এ-বাড়ি ও-বাড়ি সব বাড়ির মেয়েরাই এইরূপ চরকি-টেকো লইয়া উঠানে নামিয়া পড়ে।

 তেলিপাড়ার একটা লোক একদিন এমনই সময়ে মালোপাড়ার ভিতর দিয়া কোথায় যাইতেছিল, যুবতী মালো-বৌদের এমন বে-আবরু ব্যবহার দেখিয়া প্রলুব্ধ হইয়া উঠিল সে। তারপর থেকে রোজ এমনি সময়ে একবার করিয়া সে পাড়াটা ঘুরিয়া যাইত কেউ জিজ্ঞাসা করিলে বলিত, অমুকের বাড়ি যাইবে; অমুকের বাড়ির কেউ জিজ্ঞাসা করিলে বলিত, অমুকের বাড়ি গিয়াছিলাম। প্রথম প্রথম মেয়েরা তাকে গ্রাহ্য করে নাই। পরে যখন লোকটা অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত করিতে শুরু করিল, তখন মেয়েদের কান খাড়া হইল। সুবলার বউ দলের পাণ্ডা হইয়া একদিন রাত্রে তাকে ডাকিয়া ঘরে নিল, আর বাছা বাছা জোয়ান মালোর ছেলেরা তাকে গলা টিপিয়া মারিয়া, নৌকায় তুলিয়া বার-গাঙ্গে নিয়া ছাড়িয়া দিল। স্রোতের টানে সে কোথায় চলিয়া গেল, কেউ জানিল না।

 সারা মালো পাড়ার মধ্যে এক মাত্র তামসীর বাপই বামুন কায়েত পাড়ার লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিত। তার বাড়ি বাজারের কাছে। বামুন কায়েতের ছেলেরা তার বাড়িতে আসিয়া তবলা বাজাইত। তামসীর বাপকে তারা যাত্রার দলের রাজার পাঠ দিত বলিয়া সে এসব বিষয় দেখিয়াও দেখিত না। এইজন্য তার উপর সব মালোদের রাগ ছিল। আর সেও মালোদিগকে বড় একটা দেখিতে পারিত না, বামুন কায়েতদিগকে দেখিতে দেখিতে তার নজর উঁচু হইয়া গিয়াছিল।

 এতবড় টাকাওয়ালা একটা মানুষ তেলিপাড়া হইতে গুম হইয়া গেল, কিন্তু সাক্ষী প্রমাণের অভাবে তার কোন হদিস পাওয়া গেল না। না হইল মামলা-মোকদ্দমা, না হইল আচার-বিচার। কিন্তু তামসীর বাপের মারফতে তেলিরা জানিতে পারিল, এ কাজ মালোদেরই। কিন্তু এমন সূত্রহীন জানার দ্বারা মামলা করা যায় না। কাজেই তেলিরা কি করিবে ভাবিয়া স্থির করিতে পারিল না। শেষে বামুন সাহা, তেলি, নাপিত, সব জাত মিলিয়া গোপনীয় এক বৈঠক করিল। কেউ প্রস্তাব করিল: মালোদের নৌকাগুলি একরাতে দড়ি কাটিয়া ভাসাইয়া নিয়া তলা ফাঁড়িয়া ডুবাইয়। দেওয়া যাক; আর টাকা দিয়া লোক লাগাও, জালগুলি সব চুরি করিয়া আনিয়া আগুনে পোড়াইয়া ফেলুক।

 কিন্তু এ প্রস্তাব সকলের মনঃপূত হইল না; গুরুপাপে লঘুদণ্ড হইবে। কাজেই দ্বিতীয় প্রস্তাব উঠিল: সারা তেলিপাড়াতে রজনী পালের মাথা খুব সাফ! কূটনীতি তার বেশ খুলে। এসব ভোঁতা প্রস্তাবের অসারতা বুঝিতে তার বিলম্ব হইল না। সে প্রস্তাব করিল: বিষ্ণুপুরের বিধুভূষণ পাল আমার মামা। সমবায় ঋণদান সমিতির ফিসারী শাখার ম্যানেজার। ফিসারীর টাকা নিয়া সব মালোরা গিলিয়াছে। মাছে যেমন টোপ গিলে তেমনিভাবে গিলিয়াছে, আর উগ্‌লাইয়া দিতে পারিতেছে না। সুদ কম বলিয়া, লোভে লোভে ধার করিয়াছিল। এখন চক্রবৃদ্ধি হারে সুদে আসলে বাড়িতেছে। জানইত সমবায় সমিতির টাকা কত অত্যাচার করিয়া আদায় করা হয়। মামাকে গিয়া জানাইয়া দেই, প্রত্যেক মালোকে যেন ব্যাঙ্‌নাচানী নাচাইয়া ছাড়ে।

 কিন্তু এ প্রস্তাবও কারো মনঃপূত হইল না। মামা কখন আসিবে কে জানে! বড় সুদূর-প্রসারী প্রস্তাব। গরম গরম কিছুই করা হইল না। শেষে একটা প্রস্তাব তুলিল রজনী পালের ভাই: যে-মাগী তাকে ডাকিয়া ঘরে নিয়াছিল, তাকে ধরিয়া নিয়া আস, কয়েক পাইট মদ কিন, তারপর নিয়া চল ভাঙ্গা কালীবাড়ীর নাটমন্দিরে। কিন্তু ব্যাপার আপাততঃ এর বেশি আর গড়াইল না। তেলিপাড়া ও মালোপাড়া উভয় পাড়ার প্রস্তাবই প্রস্তাবে পর্যবসিত হইল। তবে মালোপাড়ার সঙ্গে আর সব পাড়ার একটা মিলিত বিরোধের যে-গোড়াপত্তন সেইদিন হইয়া থাকিল, তাহা আর উৎপাটিত হইল না।


 পথে রাত হইয়া গেল। বর্ষার প্রশস্ত নদীর উপর মেঘভরা আকাশের ছায়া দৈত্যের মত নামিয়া পড়িয়াছে। অনন্ত বসিয়া বসিয়া তাহাই দেখিতেছিল। পরে এক সময় চারিদিক গাঢ় আঁধারে ঢাকিয়া গেলে, আর কিছু দেখা গেল না।

 উদয়তারা দুইদিক খোলা ছইয়ের ভিতর হইতে ডাকিয়। বলিল, ‘আয় রে অনন্ত, ভিতরে আয়।’

 বনমালী পাছায় থাকিয়া প্রচণ্ড শক্তিতে হাল চালাইতেছে। তার দাপটে হালের বাঁধন-দড়ি ক্যাঁচ্ কোঁচ করিয়া কাঁদিয়া উঠিতেছে, আর সারা না’খানা একটানা হেলিয়া দুলিয়া কাঁপিয়া চলিয়াছে। সেই দোলায়মান নৌকার বাঁশের পাতনির উপর দিয়া পা টিপিয়া টিপিয়া অনন্ত ছইয়ের ভিতরে আসিল। উদয়তারাকে দেখা যাইতেছে না। আন্দাজ করিয়া তার কাছে গিয়া বসিল। কিছু বলিল না। ঘুম পাইতেছিল। পাটাতনের উপর ছোট শরীরখানা এলাইয়া দিয়া শুইয়া পড়িল। মশার কামড়ে আর নৌকার দোলানিতে একবার তার ঘুম খুব পাতলা হইয়া আসিল। মাথাটা যেন নরম কি একটা জিনিসের উপর পড়িয়া আছে। তুলার মত নরম আর চাঁদের মত শীতল। আর রাশি রাশি ফুলঝুরি নামাইয়া-রাখা একপাট আকাশ কে বুঝি অনন্তর গায়ের উপর চাপাইয়া ধরিয়া রাখিয়াছে। ঐ যে আকাশের উপর দিয়া এদিক হইতে ওদিকে চলিয়া গিয়াছে কি-একটা যেন উজ্জ্বল সাঁকো—কিছুদিন আগের দেখা সেই রামধনুটারই যেন ছিল এটা। সাতরঙা ধনুটি গা-ঢাকা দিয়া আছে আর তার ছিলাটি অনন্তর জন্য বাড়াইয়া দিয়াছে। উজ্জ্বল কাঁচা সোনার রঙ তার থেকে ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। আর তার চারিপাশে ভিড় করিয়া আছে লাখ লাখ তারা। হাত বাড়াইলেই ধরা যাইবে। আর তারই উপর ঝুলিয়া অনন্ত আকাশের এমন এক রহস্যলোকে যাত্রা করিবে যেখানে থাকিয়া সে কেবল অজানা জিনিস দেখিবে। তাহার দেখা আর কোনকালে ফুরাইবে না।

 উদয়তারা মশার কামড় হইতে বাঁচাইবার জন্য অনন্তর গাটুকু শাড়ির আঁচলে ঢাকিয়া দিয়াছিল আর শক্ত পাটাতনে কষ্ট পাইবে বুঝিয়া মাথাটা কোলের উপর তুলিয়া নিয়াছিল। আর বুকের উপর দিয়া বাঁ হাতখানা বাড়াইয়া শাড়ির কিনারাটা পাটাতনের সঙ্গে চাপিয়া রাখিয়াছিল, যেন অনন্তর গা থেকে শাড়িটুকু সরিয়া না যায়। সেই হাতখানা ছেলেটা খাপছাড়া ভাবে হাতড়াইতেছে মনে করিয়া সে শাড়িটুকু গুটাইয়া কোল হইতে অনন্তর মাথাটা নামাইয়া দিল। ডাকিয়া বলিল, ‘অনন্ত উঠ্।’

 অনন্ত জাগিয়া উঠিয়া দেখে দুনিয়ায় আর এক রূপ। তারায় ভরা আকাশের তলায় অদূরে নদী অসাড় হইয়া পড়িয়া আছে। অনেক দূরের আকাশের তারায় তারায় যেন সড়ক বাঁধিয়াছে। না জানি কত সুন্দর সে পথ, আর সে পথে চলিতে না জানি কত আনন্দ! পায়ের নিচে কত তারার ফুল মাড়াইয়া চলিতে হয়, আশেপাশে, মাথার উপরে, খালি তারার ফুল আর তারার ফুল। সে-পথ কত উপরে। অনন্ত কোনদিন তার নাগাল পাইবে না। কিন্তু দেবতারা প্রসন্ন। তিতাসের স্থির জলে তা’রা তারই একটা প্রতিরূপ ফেলিয়া রাখিয়াছে। সেটা খুব কাছে। বনমালী একটু বার-গাঙ দিয়া নৌকা বাহিলেই সে পথে অনন্ত নৌকা হইতেই পা বাড়াইয়া দিতে পারিবে। কিন্তু জলের ভিতরে সে পথ। কেবল মাছেরাই সে-পথে চলাফেরা করিতে পারে। অনন্ত তো মাছ নয়। তারার স্বল্প আলোয় নদীর বুক ঝাপসা, সাদা। তারই উপর দুই একটি মাছ ফুট দিতেছে আর তারাগুলি কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে। অনন্তর বিস্ময় জাগে। উপরে তো ওরা এক এক জায়গায় আঁটিয়া লাগিয়া আছে; জলে কি তবে তারা আল্‌গা? মাছের কেমন তাদের কাঁপাইতেছে, নাচাইতেছে; তাদের লইয়া ভাইবোনের মত খেলা করিতেছে। কি মজা! অনন্তর মন মাছ হইয়া জলের ভিতরে ডুব দেয়।


 বনমালীর নৌকা তখন পল্লীর কোল ঘেঁষিয়া চলিয়াছে। বর্ষাকালের বাড়তি জল কেবল পল্লীকে ছোঁয় নাই, চুপে চুপে ভরাইয়া দিয়াছে। পল্লীর কিনারায় প্রহরীর মত দাঁড়ানো কত বড় বড় গাছের গোড়ায় জল শুধু পৌঁছায় নাই, গাছের কোমর অবধি ডুবাইয়া দিয়াছে। সে গাছে ডালপালারা লতায় পাতায় ভরভরন্ত হইয়া জলের উপর কাত হইয়া মেলিয়া রহিয়াছে। বনমালীর নৌকা এখন চলিয়াছে তাদের তলা দিয়া, তাদেরই ছায়া মাথায় করিয়া। এখন তারায়ভরা আকাশটাও দূরে, আকাশের আর্শির মত নদীর বুকখানাও তেমনি দূরে।

 অনন্ত অত মনোযোগ দিয়া কি দেখিতেছে? না, আকাশের তারা দেখিতেছে। উদয়তারার একটা ছড়া মনে পড়িয়া গেল। এতক্ষণ বিশ্রী নীরবতার মধ্যে তার ভাল লাগিতেছিল না। আর এক ফোঁটা একটা ছেলের সঙ্গে কিই বা কথা বলিবে! আলাপ জমিবে কেন? পাড়া গুলজার করাই যার কাজ, নির্জন নদীর বুক গুলজার করিবে সে কাকে লইয়া? শ্রোতা কই, সমজদার কই? কিন্তু অনন্ত আর সব ছেলেদের মত অত বোকা নিরেট নয়। আর সব ছেলেরা যখন চোখ বুজিয়া ঘুমায় অনন্ত তখন অজানাকে জানিবার জন্য আকাশের তারার মতই চোখ দুটি জাগাইয়া রাখিয়াছে। আর উদয়তারার ছড়াটিও তারারই সম্বন্ধে, ‘সু-ফুল ছিট্যা রইছে, তুলবার লোক নাই; সু-শয্যা পইড়া রইছে, শুইবার লোক নাই,—ক দেখি অনন্ত এ-কথার মান্‌তি কি?

 এ-কথার মানে অনন্ত জানে না; কিন্তু জানিবার জন্য তার চোখ দুইটি চক্চক্ করিয়া উঠিল।

 ‘সুফুল ছিট্যা রইছে—এই কথার মান্‌তি আসমানের তারা। আসমানে ছিট্যা রইছে, তুলবার লোক নাই।’

 অনন্ত ভাবে ছিটিয়া থাকে বটে! মানুষের হাত অত দূরে নাগাল পাইবে না। কিন্তু স্বর্গে যে দেবতারা থাকে। রাম, লক্ষ্মণ, কৃষ্ণ, দুর্গা, কালী, শিবঠাকুর, তারাও কি তুলিতে পারে না?

 তারা ইচ্ছা করিলে তুলিতে পারে, কিন্তু তোলে না। তারাই ছিটাইয়া দিয়াছে, তারাই তুলিবে? রোজ রাতে ছিটাইয়া দিয়া তারা মানুষেরে ডাকিয়া বলিয়া দেয়, দিলাম ছিটাইয়া কেউ যদি পার তুলিয়া নাও। কিন্তু তুলিবার লোক নাই। এখন দেবতার পূজা হইবে কি দিয়া! শেষে তারা মাটিতে নকল ফুল ফুটাইয়া দিল। সে-ফুল রোজ ফুটে, লোকে রোজ তুলিয়া নিয়া পূজা করে। যে-সব ফুল তোলা হয় না, তারা ঝরিয়া পড়িয়া যায়। বাসি হইয়া থাকে না। বাসি ফুলে ত পূজা হইতে পারে না।

 দেবতারা ডাকিয়া বলে, কিন্তু শুনিতে পাই না ত?

 দেবতাদের ডাক সকলে বোঝে না। সাধুমহাজনেরা বোঝে। তারা তপ করে, ধেয়ান করে, পূজা করে। তারা দেবতার কথা বোঝে, দেবতারে খাওয়াইতে ধোয়াইতে পারে। তারা দেবতার কথা শুনে, দেবতা তাদের কথা শুনে।

 আমার মার কথাও দেবতা শুনিত। একদিন — কালীপূজার দিন দেবতার একেবারে কাছে গিয়া মা কি যেন বলিয়াছিল। আমাকে কাছে যাইতে দেয় নাই লোকে। দূরে দাঁড়াইয়া দেখিয়াছি, কিছু শুনিতে পাই নাই।

 আরে, এমন পূজাত আমরাও করি। আমি এই কথা বলি না! আমি বলি সাধুমহাজনদের কথা, তারা কিভাবে দেবতার কথা বুঝে। দেবতার মূর্তি যখন চোখের সামনে থাকে, দেবতা তখন চুপ করিয়া থাকে। দেবতা যখন চোখের সামনে থাকে না, তখন দেবতার মনে আর সাধুমহাজনদের মনে কথাবার্তা চলে। আমি বলি সেই কথা। চোখে দেখিয়া কথা শুনি, সে ত মানুষের কথা; চোখে না দেখিয়া কথা শুনি, সেই হইল দেবতার কথা।

 সে কথা যারা, যে-সব সাধুমহাজনেরা শুনিতে পায় তারা সেই সু-ফুল তোলে বুঝি।

তোলে। তবে এই জনমে তোলে না। মাটির দেহ মাটিতে রাখিয়া তারা যখন দেবতাদের রাজ্যে চলিয়া যায়, তখন তোলে। স্বর্গে রোজ কাঁসিঘণ্টা বাজে, আর একটিমাত্র ফুল তুলিয়া তারা পূজা করে। সে-ফুলটি আবার আসিয়া ছিটিয়া থাকে!

 অনন্তর মনে শেষ প্রশ্ন এই জাগে: গাছ দেখি না পাতা দেখি না, খালি ফুল ধরিতে দেখি। সে-সব ফুল কি তবে বিনা গাছের ফুল!

 শীতলপাটীর মত স্থির, নিশ্চল তিতাসের বুকের উপর একবার চোখ বুলাইয়া উদয়তারা বলিল, ‘আর সুশয্যা পইড়া আছে, শুইবার লোক নাই—এর মান্‌তি কই শুন্। সুশয্যা এই গাঙ্। কেমন সু-বিছ্‌না। ধূলা নাই, ময়লা নাই, উচা নাই নিচা নাই—পাটীর মত শীতল। শুইলে শরীর জুড়ায়, কিন্তু শুইবার মানুষ নাই।’

 আছে, আছে, একজন আছে। সে অনন্ত। জলের উপর কঠিন একটুখানি আবরণ পাইলে সে হাত পা ছড়াইয়া চিৎ হইয়া কাত হইয়া উপুড় হইয়া শুইয়া থাকিতে পারে। নদীর স্রোত তাহাকে দেশদেশান্তরে ভাসাইয়া নিবে, ঢেউ তাহাকে দোলা দিবে। চারিদিকের আঁধারে কেউ জাগা থাকিবে না। জাগিয়া থাকিবে সে আর তার চারিদিকের আঁধার আর উপর আকাশের তারাগুলি। আর জাগিয়া থাকিবে জলের মাছগুলি। সে ঘুমাইয়াছে মনে করিয়া তারাও তার চারিধারে দল বাঁধিয়া ভাসিয়া চলিবে। জাগিতে জাগিতে ক্লান্ত হইয়া এক সময় তার ঘুম আসিবে; রাত ফুরাইবে, কিন্তু ঘুম ভাঙ্গিবে না, সকাল হইবে, সূর্য উঠিবে, এ-পার ও-পার দুই পারের ছেলেমেয়ে নারী-পুরুষ কাতারে কাতারে দাঁড়াইয়া দেখিবে আর ভাবিবে অনন্ত বুঝি জলে পড়িয়া গিয়াছে। হায় হায় কি হইবে, অনন্ত জলে পড়িয়া গিয়াছে। আমার তখন ঘুম ভাঙ্গিবে, তাহদের দিকে চাহিয়া চোখ কচলাইয়া মৃদু হাসিয়া আমি তখন জলের উপর উঠিয়া বসিব, তারপর আস্তে আস্তে হাঁটিয়া তাহাদের পাশ কাটাইয়া দিনের কাজে চলিয়া যাইব।

 অনন্তর কল্পনার দৌড় দেখিয়া উদয়তারা হাসিয়া উঠিল, দেহে প্রাণ থাকিতে কেউ নদীর উপর শোয় না রে; প্রাণপাখী যখন উড়িয়া যায়, দেহখাঁচা তখন শূন্য, যারা পোড়াইতে পারে না, জলসই করিয়া ভাসাইয়া দেয়। এই জল-বিছানায় শুইবার মানুষ শুধু ত সে, তুই শুইতে যাবি কোন্ দুঃখে! তুই কি লখাই পণ্ডিত?

 ‘হ, আমি লখাই পণ্ডিত। মোটে একটা আখর শিখলাম না, আমি হইলাম পণ্ডিত।’

 আরে পড়া-লেখার পণ্ডিতের কথা কই না, কই সদাগরের ছেলের কথা। লখাই ছিল চান্দসদাগরের ছেলে। কালনাগের দংশনে মারা গিয়াছিল। তখন একটা কলাগাছের ভেলায় করিয়া তারে জলে ভাসাইয়া দিল, আর উজান ঠেলিয়া সেই ভেলা ভাসিয়া চলিল। তার বৌ ভেলইয়া সুন্দরী ধনুক হাতে লইয়া নদীর তীরে থাকিয়া ভেলার সঙ্গে সঙ্গে চলিল।

 ‘লখাই পণ্ডিত ত মরা। এক্‌লা ভেলইয়া সুন্দরী চলল — সদাগরের নাও তারে তুইল্যা লইয়া গেল না?’

 ধনাগোদার ভাই মনাগোদা নিতে চাহিয়াছিল; ভেলইয়া তাকে মামাশ্বশুর ডাকাতে ছাড়িয়া দিল। মামাশ্বশুর ডাকিলে সকলেই ছাড়িয়া দেয়।

 ‘অ, বুঝলাম। ভাসতে ভাসতে তারা গেল কই?’

 গেল স্বর্গে। সেখানে দেবগণের সভাতে ভেলইয়া সুন্দরী নৃত্য করিল, করিয়া মহাদেব আর চণ্ডীকে খুশি করিল। তাদের আদেশে মনসা তখন লখাই পণ্ডিতেরে জিয়াইয়া দিল।

 ‘মরা মানুষেরে জিয়াইয়া দিল ত!’

 হাঁ, জিয়াইতে গিয়া দেখে পায়ের গোড়ালি নাই। মাছে খাইয়া ফেলিয়াছে।

 মরা ছিল বলিয়াই খাইয়াছে। জ্যান্ত থাকিলে লখাই পণ্ডিত মাছদের ধরিয়া ধরিয়া বাজারে নিয়া বেচিত! কিন্তু নদীর উজান ঠেলিতে ঠেলিতে একদম স্বর্গে যাওয়া যায়? যেখানে দেবতারা থাকে?

 হাঁ। নদীর ‘সির্জন’ হইয়াছে হিমাইল রাজার দেশে। সেই দেশে স্বর্গে-সংসারে মিলন হইয়াছে। ‘দুধিষ্ঠির’ মহারাজা সেই দেশে গিয়া, তারপর হাঁটিয়া স্বর্গে গেল।

 চাঁদের দেশে তারার দেশে রামধনুকের দেশে তাহা হইলে হাঁটিয়াও যাওয়া যায়। আর একটু বড় হইলে যখন রোজগার করিতে পারিবে তখন হাতে কিছু পয়সা হইবে। সেই সময় অনন্ত একবার নদীর তীর ধরিয়া হিমাইল রাজার দেশে যাইবে, আর সে-দেশ হইতে পায়ে হাঁটিয়া স্বর্গে যাইবে।

 অনন্তর সব শ্রদ্ধা প্রণতি হইয়া লুটাইয়া পড়ে, তুমি অত জান! তোমারে নমস্কার।


 নৌকাটা হঠাৎ কিসে ধাক্কা খাইয়া থামিয়া গেল। কোমরজলে দাঁড়ানো মোটা মোটা গাছেরা জলের উপর দিয়া অনেক ডাল মেলিয়াছে, অজস্র পাতা মেলিয়াছে। সেই ডালপাতার গহনারণ্য মাথায় করিয়া নৌকা ঘাটের মাটিতে ঠেকিয়াছে। উদয়তারার তন্দ্রা অসিয়াছিল। সচকিত হইল। বনমালী পাছার খুঁটি পুঁতিতেছে, নৌকার একটানা ঝাঁকুনিতে টের পাইল উদয়তারা। সুদিনে তার বিবাহ হইয়াছিল, সুদিনে সে এখান হইতে বিদায় হইয়াছে। তখন এসব জায়গা ছিল ডাঙ্গা। জল ছিল অনেক দূরে, গাঙের তলায়। তারপর উদায়তারার কত বর্ষা কাটিয়াছে জামাইবাড়িতে। এখানে কোন বর্ষার মুখ বিবাহের পর থেকে দেখে নাই। তবু পরিচিত গাছগুলি আঁধারেও তার মনে জ্বলজ্বল করিয়া উঠিল। তার তলার মাটি তখন শুক্‌না ঠন্‌ঠনে, সে মাটিতে বসিত চাঁদের হাট। ছেলেরা খেলিত গোল্লাছুট খেলা, আর মেয়েরা খেলিত পুতুলের ঘরকন্নার খেলা। কত ঠাণ্ডা ছিল এর তলার বাতাস। আর এখন এর তলায় ঠাণ্ডা জল থই থই করে। উদয়তারার বয়সী মেয়েরা চলিয়া গিয়াছে পরের দেশে পরের বাড়িতে, আর ছেলেরা এখন বড় হইয়া এ জলে স্নান করে।

 পান সুপারির তিনকোণা থলে, একখানা কাপড় আর টুকিটাকি জিনিসের একটা ছোট পুঁটলি গুছাইয়া উদয়তারা অনন্তর হাত ধরিয়া মাটিতে পা দিল।

 দিশ কইরা পা বাড়াইবি অনন্ত, না হইলে পইড়া যাইবি! যে পিছলা।’

 পদে পদে পতনোন্মুখ অনন্ত শক্ত করিয়া উদয়তারার হাতখানা ধরিয়া বলিল, ‘আমি পইড়া যাই। তুমি ত পড় না?’

 ‘আমার বাপ-ভাইয়ের দেশ। চিনা-পরিচিত সব। বর্ষায় কত লাই-খেলা খেলাইছি, সুদিনে কত পুতুলখেল খেলাইছি।’

 খেলায় বুঝি খুব নিশা আছিল তোমার!’

 ‘আমার আর কি আছিল। নিশা আছিল আমার বড় ভইন নয়নতারার। ছোট ভইন আসমানতারারও কম আছিল না। এই খেলার লাগি মায়ে বাবায় কত গালি দিছে। পাড়ার লোকে কত সাত কথা পাঁচ কথা শুনাইছে। তিন ভইন একসাথে খেলাইছি বেড়াইছি, কেউরে গেরাহ্য কর্‌ছি না। তারপর তিন দেশে তিন ভইনের বিয়া হইয়া গেল।’

 ‘সেই অবধি দেখা নাই বুঝি?’

 ‘না। গাঙে গাঙে দেখা হয়, তবু ভইনে ভইনে দেখা হয় না। বড় ভালমানুষ আমার বড় ভইন নয়নতারা আর ছোট ভইন আসমানতারা।’

 তারার মেলা। অনন্ত নামগুলি একবার মনে মনে আওড়াইয়া লইল।

 বনমালীর একার সংসার। বাহির হইতে দরজা বন্ধ করিয়া গিয়াছিল। ফিরিয়া আসিয়া দেখে অত রাতে ঘরের ভিতর আলো জ্বলিতেছে। আশ্চর্য হইবার কথা। সাড়াশব্দ না করিয়া উদয়তারা হাঁটুর সাহায্যে দরজায় ধাক্কা দিলে দরজা মেলিয়া গেল এবং আশ্চর্যের সহিত দেখা গেল নয়নতারা আসমানতারা দুইজনে ঘরে বসিয়া গল্প করিতেছে—মেঝে। বোন উদয়তারারই গল্প। অতদিন পরে দুই বোনেরে একসঙ্গে পাইয়া উদয়তারা কি বলিবে ভাবিয়া পাইল না। কিন্তু আনন্দে চোখ দিয়া জল আসিয়া পড়িল। কি করিয়া আসিল তারা এ দারুণ বর্ষাকালে?

 আসার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: বিদেশে মাছ ধরিতে গিয়। দুইজনের বরের দেখা হয়। তারা ঠিক করিয়া ফেলে, অমুক মাসের অমুক তারিখে পরিবার নিয়া এখানে মিলিত হইবে। সেকথার কেহই খেলাপ করে নাই।

 ‘তারা দুইজনা কই?’

 ‘পাড়া বেড়াইতে গেছে।’

 ‘তোরা পাড়া বেড়াইতে গেলি না?’

 ‘আমরা রাইতে পাড়া বেড়াই না, বেলাবেলি পাড়া বেড়ান শেষ কইরা ঘরে দুয়ারে খিলি দিয়া রাখি। তোরা গোকনগাঁয়ের মানুষেরা বুঝি রাইতে পাড়া বেড়াস্?’

 বড় বোনের দিকে চোখ নাচাইয়া উদয়তারা গুনগুন করিয়া উঠিল, ‘জানি গো জানি নয়ানপুরের মানুষ; সবই জানি; অত ঠিসারা কইর না।’

 এমন সময় তারা দুইজন আসিল। ছোট বোনের জামাই সঙ্গে, কাজেই নয়নতারা ও উদয়তারা মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিল। কেবল আসমানতারার ঘোমটা কপালের নিচে নামিল। বড় বোনদের দুর্দশা দেখিয়া সে মৃদুমৃদু হাস্য করিতে লাগিল।

 মালোদের দূরের মানুষের সঙ্গে দেখা হইলে আগেই উঠে মাছের কথা। কুশল মঙ্গলের কথা উঠে তার অনেক পরে। নয়নতারার বরের সামনের দিকের কয়েকটা দাঁত পড়িয়া গিয়াছে। গোছায় গোছায় চুল পাকিয়া উঠিয়াছে, খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফেও শাদা-কালোর মেশাল। যৌবন তাহাকে ছাড়িয়া যাইতেছে—তবু গায়ের সামর্থ্যে ভাঁটা পড়ে নাই। মেজ শালীর হাত হইতে হুকাটা হাতে করিয়া, মুখে লাগাইবার আগে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তিতাসে আজকাইল মাছ কেমুন পাওয়া যায়?’

 ‘ঘরের বৌয়ানি ঘরে থাকি, আমি কি জানি মাছের খবর! আমারে কেনে, পুরুষেরে যদি পাও জিগাইও।’

 ‘জীবনে দেখ্‌লাম না তোমার পুরুষ কেমুন জন। সাথে আন না কেনে?’

 ‘পুরুষ কি আমার মাথার বোঝা যে, তারে ফালাইয়া আই ইচ্ছা কইরা!’

 ‘মাথার বোঝা হইবে কেনে। হাতের কঙ্কণ, গলার পাঁচ নরী। সাথে আন ত শরীরের শোভা। না আন ত খালি শরীর।’

 ‘শীতলীয়া কথা কইও ন। সাধু; হাতের কঙ্কণ হাতে থাকে, গলার হার গলায় থাকে। আর সেই মানুষ তিতাসে মাছ ধরতে চইল্যা যায়। বাড়ি আইলে যদি কই অনেক দিন দাদারে দেখি না, চলনা গো, একদিন গিয়া দেইখ্যা আই, কয়, দাদারে নিয়াই সংসার কর গিয়া। তোমারে আমি চাই না। শুনছ কথা!’

 ‘ভুল কর্‌লা দিদি। পরাণ দিয়া চায় বইল্যাই চাই না কইতে পার্‌ছে।’

 তার গলার মোটা তুলসীমালার দিকে চাহিয়। উদয়তারার খুব শ্রদ্ধা হইল। আরও শ্রদ্ধা হইল যখন দেখিল, তার চোখ দুইটি আবেশমাখা—মুখ ভাবময় হইয়া উঠিতেছে—সে গান ধরিয়াছে—‘ও চাঁদ গৌর আমার শঙ্খ-শাড়ি, ও চাঁদ গৌর আমার সিঁথির সিন্দূর চুল-বান্ধা দড়ি, আমি গৌর-প্রেমের ভাও জানি না ধীরে ধীরে পাও ফেলি!’ — গানের তালে তালে তার মাথাটাও দুলিতে লাগিল।

 পরিবেশে আধ্যাত্মিক ভাবটা একটু ফিকা হইয়া আসিলে উদয়তারা বলিল, ‘দেখ মানুষ, আমার একখান কথা। দাদার লাগি কিছু একটা করলা না। এমন কার্তিক হইয়াই দাদা দিন কাটাইব? দাদার মাথায় কি শোলার মটুক কোন কালেই উঠ্‌ব না?’

 ‘বনমালীর কথা কও? তুমি ত জান দিদি, মা বাপ ভাই বেরাদর যার নাই, ক্ষেত পাথর জাগা জমি যার নাই, টাকা কড়ি গয়নাগাটি যার নাই, তারে লোকে মাইয়া দেয়? অন্ততঃ তিনশ’ টাকা হাতে থাক্‌ত ত দেখ্‌তাম—মাইয়ার আবার অভাব।’

 তিনশ’ টাকা! পর পর তিনটা বোনের বিবাহ হইয়াছে বাবা বাঁচিয়া থাকিতে। পণ লইয়াছে তিনশ’ টাকা করিয়া। আর এই টাকা দিয়া সমাজের লোক খাওয়াইছে। এখন বনমালীর নিকট হইতেও তিনশ’ টাকা পণ লইয়া মেয়ের বাপ তার সমাজকে খাওয়াইবে। কি ভীষণ সমস্যা! উদয়তারা চুপ করিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে বলিল, ‘তোমার একটা ভইনটইন থাক্‌লে দিয়া দেও।’

 ‘আপন ভইন নাই, আছে মামাত ভইন। কিন্তু আমার কোন হাত নাই!’

 এমন সময় বনমালী ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকিল। তার হাতে কাঁধে কোমরে অনেক কিছু মালপত্র। আতপ চাউল, গুড়, তেল—এসব পিঠা করার সরঞ্জাম আনিয়াছে।


 অনন্ত বিছানার একপাশে বসিয়া এতক্ষণ নীরবে তাহাদের কথাবার্তা শুনিতেছিল। এইবার বড় বোন নয়নতারার দৃষ্টি তাহার দিকে পড়িল। প্রত্যেকটি কথা যেন ছেলেটা গিলিয়া খাইতেছে, প্রত্যেকটা লোককে যেন নাড়ীর ভিতর পর্যন্ত দেখিয়া লইতেছে, এমনি কৌতূহল।

 ‘এরে তুই কই পাইলি?’

 ‘এ আমার পথের পাওয়া! মা বাপ নাই। সুবলার বউ রাঁড়ি মানুষ করত। পরে নি গো বুঝে পরের মর্ম, একদিন খেদাইয়া দিল। বড় মায়া লাগল আমার। লইয়া আইলাম, যদি কোনদিন কামে লাগে।’

 বলে কি, পরের একটা ছেলে—মাটির পুতুল নয়, কাঠের পুতুল নয়, একটা ছেলে এমনি করিয়া পাইয়া গেল? একি দেশে মানে, না দুনিয়া মানে। পেটে ধরিল না, মানুষ করিল না, পথের পাওয়া—তাই কি তার আপন হইয়া গেল? এমন করিয়া পরের ছেলে যদি আপন হইয়া যাইত তবে আর ভাবনা ছিল কি? কিন্তু হয় না। পরের ছেলে বড় বেইমান।

 বনমালী ও পুরুষ দুইজন একটু আগেই অন্য ঘরে চলিয়। গিয়াছিল — কোন্ খালে কোন্ বিলে কোন্ সালে কত মাছ পড়িয়াছিল, তার সম্পর্কে তর্কাতর্কি তখন উচ্চগ্রামে উঠিয়াছে আর এঘর হইতে শোনা যাইতেছে। আসমানতারার বরের গল। সকলের উপরে। সরেস জেলে বলিয়া প্রতিবেশী দশ বারো গাঁয়ের মালোদের মধ্যে তার নামডাক আছে। সেই গর্বে আসমানতারা বলিল, ‘আমারে দিয়া দে দিদি, আমি খাওয়াইয়া ধোয়াইয়া মানুষ করি; পরে একদিন বেইমান পক্ষীর মত উইড়া যাউক, আমার কোন দুঃখ নাই।’

 ‘তোর ত দিন আছে ভইন। ঈশ্বর তোরে দিব—কিন্তু আমারে কোনকালে দিব না—এরে দিলে আমি নাচতে নাচতে লইয়া যাই!’ নিঃসন্তান বুকের বেদনা নয়নতার হাসিয়া হাল্কা করিল।

 কেন আমি কি দোকানের গামছা না সাবান! কোন্ সাহসে আমাকে কিনিয়া নিতে চায়।—অনন্ত এই কথা কয়টি মনে মনেই ভাবিল। প্রকাশ করিয়া বলিল না।

 অনন্ত ও অন্যান্য পুরুষ মানুষদের খাওয়া হইয়া গেলে তিন বোনে এক পাতে বসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া খাইল। তারপর পাশের ঘরে তিন পুরুষের বিছানা করিয়া দিয়া, অনন্তকে এ ঘরে শোয়াইয়া, তিন বোনে পিঠা বানাইতে বসিল।

 রাত অনেক হইয়াছে। প্রদীপের শিখা তিন বোনের মুখে হাতে কাপড়ে আলো দিয়াছে। পিছনের বড় বড় ছায়া দেওয়ালে গিয়া পড়িয়াছে। ভাবে বোঝা গেল, তারা আজ সারারাত না ঘুমাইয়। কাটাইবে।

 ‘ঘুম আইলে কি করুম?’ ছোট বোন জিজ্ঞাসা করিল।

 ‘উদয়তারা শিলোকের রাজা। শিলোক দেউক, আর আমরা মান্‌তি করি—ঘুম তা হইলে পলাইব।’ বলিল বড় বোন।

 উদয়তারা একদলা কাই হাতের তালুতে দলিতে দলিতে বলিল, ‘হিজল গাছে বিজল ধরে, সন্ধ্যা হইলে ভাইঙ্গা পড়ে—কও, এই কথার মান্তি কি?’

 ‘এই কথার মান্তি হাট।’ বলিল আসমানতারা।

 ‘আচ্ছা,—পানির তলে বিন্দাজী গাছ ঝিকিমিকি করে, ইলসা মাছে ঠোকর দিলে ঝরঝরাইয়া পড়ে?’

 বড় বোন মানে বলিয়া দিল—‘কুয়াসা।’

 এইভাবে অনেকক্ষণ চলিল। অনন্তর খুব আমোদ লাগিতেছিল, কিন্তু ঘুমের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়া পারিল না। শুনিতে শুনিতে সে এক সময় ঘুমাইয়া পড়িল।

 নিশুতি রাতে আপনা-থেকে ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। তিন বোন তখনও অক্লান্ত ভাবে হেঁয়ালী বলিতেছে আর হাত চালাইতেছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ মুদিয়া অনন্ত তখনও কানে শুনিতেছে—‘আদা চাক্‌চাক্ দুধের বর্ণ, এ শিলোক না ভাঙ্গাইলে বৃথা জন্ম।’

 এর মান্তি—টাকা, বলিয়া এক বোন পাল্টা তীর ছাড়ে—


 ভোরের আঁধার ফিকা হইবার সঙ্গে সঙ্গে অনন্তর ঘুম পাতলা হইয়া আসিল। উঠান দিয়া কে মন্দিরা বাজাইয়া গাহিয়া চলিয়াছে,—

রাই জাগো গো, আমার ধনী জাগো গো,

বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই জাগো গো।

 অনন্ত উঠিয়া পড়িল। পিঠা বানাইতে বানাইতে তিন বোন কখন এক সময় শুইয়া পড়িয়াছিল। অর্ধসমাপ্ত পিঠাগুলি অগোছালো পড়িয়া আছে, আর তিন বোনে জড়াজড়ি করিয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে। প্রদীপটা এখনও জ্বলিতেছে, তবে উস্কাইয়া দেওয়ার লোকের অভাবে আর জ্বলিতে পারিবে না, এ স্বাক্ষর তার শিখায় স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে।

 অনন্ত বাহিরে আসিল। ও-ঘরে তিনজন ঘুমাইয়াছিল, তারা নাই। শেষরাতে বনমালী জালে গিয়াছে, অতিথি দুজনও সঙ্গে গিয়াছে, এখানকার মাছধরা সম্বন্ধে জানিবার বুঝিবার  পূবের আকাশ ধীরে ধীরে খুলিতেছে। স্নিগ্ধ নীলাভ মৃদু আলো ফুটিতেছে। চারিদিকে একটানা ঝিঁঝির ডাক। গাছে গাছে পাখির কলরব। মন্দিরা বাজাইয়া লোকটা এ-পাড়া হইতে ও-পাড়ায় চলিয়া গিয়াছে! তার গানের শেষ কলি মন্দিরার টুনটুনাটুন্ আওয়াজের সঙ্গে অনন্তর কানে আসিয়া বাজে,—

শুক বলে ওগো সারী কত নিদ্রা যাও,
আপনে জাগিয়া আগে বন্ধুরে জাগাও;
আমার রাই জাগো গো, আমার ধনী জাগো গো,
বৃন্দাবন বিলাসিনী, রাই জাগো গো।

 অনন্ত উঠানের পর উঠান পার হইয়া চলিল। যুবকরা সব নদীতে গিয়াছে। বাড়িতে আছে বুড়ারা আর বৌ ঝি মায়েরা। বুড়ারা সকালে উঠিয়া তুলসীতলায় প্রণাম করিতেছে। প্রত্যেক বাড়িতে তুলসী গাছ, উঁচু একটা ছোট বেদীর উপর। দুই পাশে দুই চারিটা ফুলের গাছ। মিষ্টি গন্ধ। বৌরা উঠানগুলি ঝাড় দিয়াছে, এখন গোবরছড়া দিতেছে। হাঁটিতে হাঁটিতে এক উঠানে গিয়া দেখে, আর পথ নাই, মালোপাড়া এখানে শেষ হইয়া গিয়াছে। এরপর গভীর খাদ, তারপর থেকে কেবল পাটের জমি। পুরুষপ্রমাণ পাটগাছ কোমরজলে দাঁড়াইয়া বাতাসে মাথা দুলাইতেছে। ক্ষেতের পর ক্ষেত, তারপর ক্ষেত, শেষে আকাশের নীলিমার সঙ্গে মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে। সীমার মাঝে অসীমের এই ভোরের আলোতে ধরা দেওয়ার দৃশ্য দেখিতে দেখিতে বিস্ময়ে তাহার চক্ষু দুইটি আপনি আনত হইয়া আসিল। প্রকৃতির সঙ্গে তাহার এত নিবিড় অন্তরঙ্গতার মাধুর্য কিন্তু একজনের দৃষ্টি এড়াইল না। তুলসীতলায় প্রণাম সারিয়া সে গুন্‌গুন্ করিয়া নরোত্তম দাসের প্রার্থনা গাহিতেছিল, কাছে আসিয়া তাহার মনে হইল, অসীম অনন্ত সংসার পারাবারের ও-পারে আপনা থেকে জন্মিয়াছে যে বৃন্দাজী গাছ, প্রকৃতির একটি ছোট্ট সন্তান তাহার দিকে চোখ মেলিয়া নিজের প্রণতি পাঠাইয়া দিতেছে। কাঁধে হাত দিয়া আবেগের সহিত বলিল, ‘নিতাই, ওরে আমার নিতাই, কঙালেরে ফাঁকি দিয়া এতদিন লুকাইয়া কোথায় ছিলি বাপ। আয় আমার কোলে আয়।’

 তার বাহুর বাঁধন দুই হাতে ঠেলিতে ঠেলিতে অনন্ত বলিল, ‘আমি অনন্ত!’

 ‘জানি বাবা জানি, তুই আমার অনন্ত! অনন্ত রাখিল নাম অন্ত না পাইয়া; আমি দান জানি না, ধ্যান জানি না, সাধন জানি না, ভজন জানি না;—কেবল তোমারেই জানি। ধরা যখন দিছ, আর ছাড়মু না তোমায়।’

 অনন্ত বিস্ময়ে অবাক!

 লোকটা সহসা সম্বিৎ পাইয়া বলিল, ‘হরি হে, একি তোমার খেলা। বারবার মায়াজাল ছিঁড়িতে চাই, তুমি কেন ছিঁড়তে দাও না? যশোদা তোমারে পুত্ররূপে পাইয়া কাঁদছিল, শচীরাণী তোমারে পুত্ররূপে পাইয়া কাঁদছিল, রাজা দশরথ তোমারে পুত্ররূপে পাইয়া কাঁদতে কাঁদতে প্রাণ দিল। তবু তোমারে পুত্ররূপে পাওয়ার মধ্যে কত তৃপ্তি, কত আনন্দ! পুত্ররূপে একবার আইছিলা, চইলা গেলা। ধইরা রাখতে ত পারলাম না। আইজ আবার কেনে সেই স্মৃতি মনে জাগাইয়া তুল্‌লা। ভুলতে দাও হরি, ভুলতে দাও! যা বাবা, কার ছেলে তুই জানি না, মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরা যা। আমার অখন অনেক কাজ। গোষ্ঠের সময় হইয়া আইল; যাই বাছারে আমার গোষ্ঠে পাঠাই গিয়া।’

 খেলাঘরের মত ছোট একটা মন্দির। সে ঘরে একখানা রাধাকৃষ্ণ ঠাকুর, আর সালুকাপড়ে মোড়া খানদুই পুঁথি। সেখানে গিয়া সে গান ধরিল, ‘মরি হায়রে কিবা শোভা! রাখালগণ ডাকতে আছে ঘনঘন বৃন্দাবনে।’

 একটু পরে প্রশস্ত সূর্যালোকে পাড়াটা ঝলকিত হইয়া উঠিল। ঘরে ঘরে জাগিয়া উঠিল কর্মচাঞ্চল্য। এখানে হাটবাজার নাই। এ গাঁয়ের মালোরা দূরের হাটবাজারে মাছ বেচিয়া আসে। সূতাকাটা, বাঁশের জাল বোনা, ছেঁড়া জাল গড়া, জালে গাব দেওয়া,—কারো বাড়িতে অবসর নাই। অন্তঃপুরের মেয়েদেরও অবসর নাই। নানারকম মাছের নানারকম ভাজাভুজি ঝোলঝাল রাঁধিতে রাঁধিতে তারা গলদঘর্ম হয়। দুপুর গড়াইয়া যায়। পুরুষেরা সকালে পান্তা খাইয়া কাজে মাতিয়াছিল, মায়েদের আদেশে ছেলেরা গিয়া জানায়, ভাত হইয়াছে, স্নান কর গিয়া। জলে ডুব দিয়া আসিয়া তারা খাইতে বসে। তারপর শুইয়া কতক্ষণ ঘুমায়, সন্ধ্যায় আবার জাল দড়ি কাঁধে করিয়া নৌকায় গিয়া ওঠে। বিরাম নাই।

 অতিথিবৃন্দ যেমন একদিন আসিয়াছিল, তেমনি একদিন বিদায় হইয়া গেল। বনমালীর ঘর হাসি গান আমোদ আহ্লাদে থই থই করিতেছিল, নীরব হইয়া গেল।

 শ্রাবণ মাস, রোজই রাতে পদ্মাপুরাণ গান হয়। বনমালী রাতের জালে আর যায় না। দিনের জালে যায়। আর রাত হইলে বাড়ি বাড়ি পদ্মাপুরাণ গান গায়। এক এক রাতে এক এক বাড়িতে আসর হয়। সুর করিয়া পড়ে সেই সাধুবাবাজী—যে-জন রোজ ভোরে মন্দিরা বাজাইয়া পাড়ায় নাম বিতরণ করে, যে জন অনস্তকে সেদিন ভোরে নিতাইর অবতার বলিয়া ভুল করিয়াছিল। প্রধান গায়ক বনমালী। তার গলা খুব দরাজ। হাতে থাকে করতাল। আর দুইটা লোক বাজায় খোল। গায়ক আছে অনেকে। কিন্তু বনমালীর গলা সকলের উপরে। সেজন্য সাধু সকলের আগে তাকেই বলে ‘তোল’।

 ‘কি? লাচারী না দিশা?’

 একখানা ছোট চৌকিতে সালু কাপড়ে বাঁধা পদ্মাপুরাণ পুঁথি। কলমী। সাধু ছাড়া এযুগের কোনো মানুষের পড়ার সাধ্য নাই। সামনে সরিষা-তেলের বাতি। সল্‌তে উস্কাইয়া চাহিয়া দেখেন যেখান থেকে শুরু করিতে হইবে তাহা ত্রিপদী। বলিলেন, ‘লাচারী তোল।’

 বনমালী ডানহাতে ডানগাল চাপিয়া, বাঁহাত সামনে উঁচু করিয়া মেলিয়া কাক-স্বরে ‘চিতান’ ধরিল,—

‘মা যে-মতি চায় সে-মতি কর, কে তোমায় দোষে,
বল মা কোথায় যাই দাঁড়াইবার স্থান নাই,

আমারে দেখিয়া সাগর শোষে
মা, আমারে দেখিয়া সাগর শোষে!’

 দুই একজনে দোহার ধরিয়াছিল, যুৎসই করিতে না পারিয়া ছাড়িয়া দিল। ছাড়িল না শুধু অনন্ত। সুরটা অনুকরণ করিয়া বেশ কায়দা করিয়াই তান ধরিয়াছিল সে। মোটা মোটা সব গলা মাঝপথে অবশ হইয়া যাওয়াতে তার সরু শিশুগলা পায়ের তলায় মাটি-ছাড়া হইয়া বায়ুর সমুদ্রে কাঁপিতে কাঁপিতে ডুবিয়া গেল। তার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে চাহিয়া বাবাজী বনমালীকে বলিলেন, ‘পুরান সুর। কিন্তু বড় জমাটি। আইজকালের মানুষ শ্বাসই রাখতে পারে না, এসব সুর তারা গাইব কি। যারা গাইত তারা দরাজ গলায় টান দিলে তিতাসের ঐ-পারের লোকের ঘুম ভাঙ্গত। কর্ণে করত মধু বরিষণ। অখন সব হালকা সুর। হরিবংশ গান, ভাইটাল্ সুরের গান অখন নয়া বংশের লোকে গাইতে পারে না, গাঁওয়ে গাঁওয়ে যে দুইচার জন পুরান গাতক অখনো আছে, তারা গায়, আর গলার জোর দেইখ্যা জোয়ান মানুষ চমকায়! সোজা একটা লাচারী তোল বনমালী।’

 বনমালী সহজভাবেই তুলিল—

‘সোণার বরণ দুইটি শিশু ঝল্‌মল্ ঝল্‌মল্ করে গো,
আমি দেইখে এলাম ভরতের বাজারে।’

 বাবাজী বলিলেন, ‘না এইখানে এই লাচারী খাটে না। কাইল প্রহ্লাদের বাড়িতে লখিন্দররে সৰ্পে দংশন করছিল; অখন তারে কলার ভেলাতে তোলা হইছে, ভেলা ভাসব, যাত্রা করব উজানীনগর, আর গাঙ্গের পারে পারে ধেনুক হাতে যাত্রা করব বেহুলা। দিশা কইরা তোল!’

 ‘অ, ঠিক, সুমন্ত্র চইলে যায়রে, যাত্রা কালে রাম নাম।’

 ‘রামায়ণের ঘুষা। তরণীসেন যুদ্ধে যাইতাছে। আচ্ছা, চলতে পারে।’

 ভেলা চলিয়াছে নদীর স্রোত ঠেলিয়া উজানের দিকে; তীরে বেহুলা, হাতে তীর ধনুক। কাক শুকুন বসিতে যায় ভেলাতে, পার হইতে বেহুলা তীর নিক্ষেপের ভঙ্গি করিলে উড়িয়া যায়। কত গ্রাম, কত নগর, কত হাওর, কত প্রান্তর, কত বন, কত জঙ্গল পার হইয়া চলিয়াছে বেহুলা, আর নদীতে চলিয়াছে লখিন্দরের ভেলা। এইখানে ত্রিপদী শেষ হইয়। দিশা শুরু।

 ‘এইবার চান্দসদাগরের বাড়িতে কান্নাকাটি। খেদের দিশা তোল।’

 বনমালী একটু ভাবিয়া তুলিল—

‘সাত পাঁচ পুত্র যার ভাগ্যবতী মা;
আমি অতি অভাগিনী একা মাত্র নীলমণি,
মথুরার মোকামে গেলা, আর ত আইলা না।’

 এই গানে অনন্তর বুক বেদনায় টন্ টন্ করিয়া উঠিল।

 গানের শেষে পুঁথি বাঁধিতে বাঁধিতে বাবাজী বলিলেন: অমূল্য রতনের মত ছেলে এই অনন্ত। কৃষ্ণ তাকে বিবেক দিয়াছে, বুদ্ধি দিয়াছে, তবে ভবার্ণবে পাঠাইয়াছে। ইস্কুলে দিলে ভাল বিদ্যা পাইত। তোমরা যদি বাধা না দাও, চারদিকে এখন বর্ষা, জল শুখাইয়া মাঠে পথ পড়িলে তাকে আমি গোপালখালি মাইনর ইস্কুলে ভরতি করিয়া দেই। বেতন মাপ, আর আমি যখন দশদুয়ারে ভিক্ষা করি—কৃষ্ণের জীব, তাকেও কৃষ্ণে উপবাসী রাখিবে না।

 কথাটি উপস্থিত মালোদের সকলেরই মনঃপুত হইল: মালোগুষ্টির মধ্যে বিদ্যামান লোক নাই, চিঠি লেখাইতে, তমসুকের খত লেখাইতে, মাছ বেপারের হিসাব লেখাইতে গোপালনগরের হরিদাস সা’র পাও ধরাধরি করি, ভাল ভাল মাছ খাওয়াই। এ যদি বিদ্যামান হইতে পারে মালোগুষ্টির গৈরব।

 তবে আর তাকে উদয়তারার সাথে গোকনগাঁওয়ে দিয়া কাজ নাই, এখানেই রাখ। সামনে তিন মাস পরেই সুদিন।

 বনমালী স্বীকৃত হইয়া বাড়ি আসিল। কিন্তু ব্যবস্থাটা উদয়তারার মনঃপূত হইল না।

 কয়েক দিন আগে পাড়াতে একটা বিবাহ গিয়াছে। এখন জামাই আসিয়াছে দ্বিরাগমনে। যুবতীরা এবং অনুকূল সম্পর্কযুক্তা বর্ষীয়সীরা মিলিয়া ঠিক করিল জামাইকে আচ্ছা ঠকান ঠকাইতে হইবে। জামাই অনেকগুলি খারাপ কাজ করিয়াছে। প্রথমতঃ সে তাদের জন্য পান-বাতাসা, পানের মসলা এ-সব আনে নাই; দুপুরে তার স্নানের আগে মেয়েরা গাহিতে লাগিল: জামাই খাইতে জানে, নিতে জানে, দিতে জানে না, তারে তোমরা ভদ্র বইলো না। জামাই যদি ভদ্র হইত, বাতাসার হাঁড়ি আগে দিত, জামাই খাইতে জানে, নিতে জানে ইত্যাদি। কিন্তু, উঁহু, তাতেও কুলাইবে না। খুব করিয়া ঠকাইতে হইবে। কিন্তু কি ভাবে জব্দ করা যায় তাকে। একজন সমাধান করিল, ভয় কি জামাই-ঠকানী আছে, বনমালীর বোন জামাই-ঠকানী। সকলেই যেন সাঁতারে অবলম্বন পাইল, বলিল, ‘লইয়া আয় জামাইঠকানীরে।’ সমাগত নারীদের অবাক করিয়া দিয়া উদয়তারা জানাইল যাইতে পারিবে না।


 শ্রাবণ মাস শেষ হইয়াছে, পদ্মাপুরাণও পড়া শেষ হইল। ঘরে ঘরে মনসা পূজার আয়োজন করিয়াছে। আর করিয়াছে জালা বিয়া’র আয়োজন। বেহুলাসতী মরা লখিন্দরকে লইয়া পুরীর বাহির হইবার সময় শাশুড়ী ও জা’দিগকে কতকগুলি সিদ্ধ ধান দিয়া বলিয়াছিল, আমার স্বামী যেদিন বাঁচিয়া উঠিবে, এই ধানগুলিতে সেদিন চারা বাহির হইবে। চারা তাতে যথাকালেই বাহির হইয়াছিল। এই ইতিহাস পুরাণরচয়িতার অজানা হইলেও মালোপাড়ার মেয়েদের অজানা নাই। তারা বেহুলার এয়োস্তালির স্মারকচিহ্নরূপে মনসা পূজার দিন এক অভিনব বিবাহের আয়োজন করে। ধানের চারা বা জালা এর প্রধান উপকরণ। তাই এর নাম জালা-বিয়া। এক মেয়ে বরের মত সোজা হইয়া চৌকিতে দাঁড়ায়, আরেক মেয়ে কনের মত সাতবার তাকে প্রদক্ষিণ করে, দীপদানির মত একখানি পাত্রে ধানের চারাগুলি রাখিয়া বরের মুখের কাছে নিয়া প্রতিবার নিছিয়া-পুছিয়া লয়। এইভাবে জোড়ায় জোড়ায় নারীদের মধ্যে বিবাহ হইতে থাকে আর একদল নারী গীত গাহিয়া চলে।

 পূজার দিন এক সমবয়সিনী ধরিল, ‘দুই বছর আগে তুই আমারে বিয়া কইরা রাখ্‌ছিলি, মনে আছে? এইবছর তোরে আমি বিয়া করি কেমুন লা উদি।’

 ‘না ভইন্।’

 ‘তবে তুই কর আমারে।’

 ‘না ভইন। আমার ভাল লাগে না।’

 বিয়ের কথায় অনন্তর আমোদ জাগিল, ‘কর না বিয়া, অত যখন কয়।’

 ‘তুই কস্? আচ্ছা তা হইলে করতে পারি।’

 কি মজা। উদয়তারা নিজে মেয়ে হইয়া আরেকজন মেয়েকে বিবাহ করিতেছে! দুইজনেরই মাথায় ঘোমটা, কি মজা! কিন্তু অনন্তর কাছে তার চাইতেও মজার জিনিস মেয়েদের গান গাওয়াটা। তারা গাহিতেছে এই মর্মের এক গান: অবিবাহিতা বালিকার মাথায় লখাই ছাতা ধরিয়াছে; কিন্তু বালিকা লখাইকে একটাও পয়সা কড়ি দিতেছে না; ওরে লখাই, তুই বালিকার মাথায় ছাত ধরা ছাড়িয়া দে, কড়ি আমি দিব। তারপরের গান: ‘সেই দোকানে যায় গো বালা ঘট কিনিবারে!’ সেই ঘটে মনসা পূজা হইল, কিন্তু মনসা নদী পার হইবে কেমন করিয়া। এক জেলে, নৌকা নিয়া জাল পাতিয়াছিল। মনসা তাকে ডাকিয়া বলিল, তোর না খানা দে আমি পার হই, তোকে ধনে পুত্রে বড় করিয়া দিব।

 উদয়তারার এক ননাসের নাম ছিল মনসা। তাই মনসাপূজা বলিতে পারে না। স্বামী যেমন মান্য, স্বামীর বড় বোনও তেমনি মান্য। সে কনে-বৌটিকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, ‘শাওনাই পূজা ত হইয়া গেল ভইন, সাম্‌নে আছে আর নাও-দৌড়ানি। বড় ভাল লাগে এইসব পূজা-পালি হুড়ুম-দুড়ুম নিয়া থাকতে।’

 কনে-বৌ মাথার ঘোমটা ফেলিয়া দিয়া কাঁসের থালায় ধানদূর্বা পঞ্চপ্রদীপ ইত্যাদি তুলিতে তুলিতে বলিল, ‘তারপর কত পূজাই ত আছে—দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, কার্তিকপূজা, ভাইফোঁটা’—

 ‘কিন্তু তা ত কত পরের কথা। শাওন মাস, ভাদর মাস, তারপরে ত আইব বড় ঠাকরাইন পূজা।’

 কিন্তু দুই মাস ত মোটে—তেমন কি বেশি। ক্ষেতপাথারের জল কমিতে লাগিবে পনর দিন। তিতাসের জল কমিয়া তার পাড়ে পাড়ে পথ পড়িতে লাগিবে আরও পনর দিন। তখন বর্ষা শেষ হইয়া যাইবে। গাঙ-বিলের দিকে চাও, দেখিবে পরিষ্কার—দিনের দিকে চাও, পরিষ্কার। কিন্তু ঘর বাড়ির দিকে চাও—পরিষ্কার দেখ কি! দেখ না। পরিষ্কার না করিলে পরিষ্কার দেখিবে কি করিয়া! চারিদিকে পূজা-পূজা ভাব। লাগিয়া যাও ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার কাজে! কিন্তু কি ঘরবাড়ি পরিষ্কার করিবে তুমি? ভাঙ্গা ঘরবাড়ি? না, পুরুষ আছে কোন্ দিনের তরে? বর্ষাকালে একটানা বৃষ্টির জলে ধা’র ভাঙ্গিয়াছে, পিঁড়া ভাঙ্গিয়াছে, ঘনঘন তুফানের ঠেলায় বেড়াগুলি মুচড়াইয়া গিয়াছে। পুরুষেরা ছন আনিবে মূলি আনিবে, বাঁশ আনিবে বেত আনিবে—আনিয়া ঘরদুয়ার ঠিক করিয়া দিবে, তারপর মেয়ে-বৌরা তিতাসের পারের নরম সোঁদাল মাটি আনিয়া ধা’র-পিঁড়া ঠিক করিবে, লেপিবে পুঁছিবে, আরসির মত ঝক্‌ঝকে তক্‌তকে করিবে—তাতেও কোন্-না পনর দিন লাগিবে? বাকি পনর দিনের মধ্যে সাত দিনে কাঁথা কাপড় কাঁচিবে, চাটাই মাদুর ধুইবে, তারপর সাতদিন বাকি থাকিতে তেল-সাবান মাখিয়া দেবী হইয়া বসিয়া থাকিবে—দিন আবার ফুরায় না!

 ‘কি লা উদি, কথা কস্ না যে? দিন ফুরায় না!’

 একটু আগে এই মেয়েটি তাকে সাত পাক ঘুরিয়াছে; পঞ্চপ্রদীপ তার কপালের কাছখানে ঠেকাইয়া লইয়া তাহা আবার নিজের কপালে ঠেকাইয়াছে, কতকগুলি খই আর অতসী ফুল তার মাথার উপর ছিটাইয়া দিয়াছে—সত্যিকারের বিবাহের মতই ভাবভঙ্গি দেখাইয়াছে—অথচ অনেক অর্থহীন অনুষ্ঠানের মত ইহা একটি পূজাবিশেষের অনুষ্ঠান মাত্র। কিন্তু কি মজার অনুষ্ঠান! সাত বছর আগের কথা মনে করাইয়া দেয়। সেদিন উদয়তারার সামনে বসিয়া ছিল, অজানা একটা নূতন পুরুষ মানুষ—চুলদাড়ি সুন্দর করিয়া ছাঁটা, মাথায় জবজবে তেল দিয়া বাঁকা টেরি কাটা—নূতন কাপড়ে তাকে সেদিন দেবতার মত দেখা গিয়াছিল। বাস্তবিক বিবাহের দিনে পুরুষ মানুষকে কত সুন্দরই না দেখায়। তাকেও কি খুব সুন্দর দেখাইয়াছিল না সেদিন! তিন চারি জনে ধরিয়া তাহাকে চুল আঁচড়ানো, তেল-সিন্দূর পরানো, চন্দন-তিলক লাগানো প্রভৃতি প্রসাধন কর্ম করিয়াছিল। একটা কলার ডিগা সে মানুষটার গালে বুলাইয়াছিল—সে তখন ছোট বালিকা মাত্র, বুকটা তার ভয়ে দুরু দুরু করিতেছিল। চাহিতে পারিতেছিল না লোকটার চোখের দিকে, অথচ চারি দিক হইতে লোকজনে চীৎকার করিয়া কহিতেছিল, চাও, চাও, চাও, দেখ, এই সময়ে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখ—চারিজনে পিঁড়ির চারিটা কোণা ধরিয়া তাহাকে উঁচু করিয়া তুলিয়াছিল—এই সময়ে সে একটুখানি চাহিয়া দেখিয়াছিল—মাত্র একটুখানি, আর চাহিতে পারে নাই, অমনি চোখ নত করিয়াছিল। সেদিন মোটে চাওয়া যায় নাই, তার দিকে। কিন্তু আজ! কতবার চাওয়া যায়, কোন কষ্ট হয় না, কিন্তু সেইদিনের একটুখানি চাওয়ার মত তেমন আর লাগে কি; সে চাওয়ার মধ্যে যে স্বাদ ছিল, সে-স্বাদ কোথায় গেল!

 ভাবিতে ভাবিতে উদয়তারা একসময় ফিক্‌ করিয়া হাসিয়া ফেলিল।

 কনেবৌ চুল বাঁধিতে বাঁধিতে বলিল, ‘কি লা উদি, হাসলি যে?’

 ‘হাসি পাইল, হাসলাম। আচ্ছা, আমি ত তোর বর হইলাম, আমার মুখের দিকে চাইতে তোর লাজ লাগে নাই?’

 ‘শুন কথা। সত্যের বিয়ার বরেরেই লাজ করলাম না, তুই ত আমার জালা বিয়ার বর।’

 ‘সত্যের বিয়ার বরেরে তোর লাজ করে নাই? ওমা কেনে, লাজ করল না কেনে?’

 ‘সেই-কথা এক পরস্তাবের মত। বর আমার বাপের কাছে মুনী খাট্‌ত। মা বাপ কেউ আছিল না তার। সুত। পাকাইত আর জাল বুনত। আমার বয়স আট বছর, আর তার বার বছর। সেইনা সময়ে বাপে দিল বিয়া। এক সঙ্গে খেলাইছি বেড়াইছি, মাছ ধরছি মাছ কাট্‌ছি, আমি নি ডরামু তারে!’

 ‘ও মা! সেই কথা ক।’

 ‘একটা মজার কথা কই, শুন্। বিয়ার কালে আমি ত ফুল ছিট্‌লাম তার মাথায়, সে যত ছিট্‌তে লাগল, কোন ফুলই আমার মাথায় পড়ল না। ডাইনে-বাঁয়ে কাঁধে-পিঠে পড়তে লাগল, কিন্তুক মাথায় পড়ল না। কারোরে আমি ছাইড়া কথা কই না, আর সে ত আম্‌রার বাড়িরই মানুষ।—খুব রাগ হইল আমার। তেজ কইরা কইলাম, ভাল কইরা ছিট্‌তে পার না? মাথায় পড়ে না কেনে ফুল? ডাইনে-বাঁয়ে পড়ে কেনে? কাজের ভাস্সি নাই, খাওনের গোঁসাই!’

 ‘বরেরে তুই এমুন গালি পাড়লি? তোর মুখ ত কম খরোধরো আছিল না? বর কি করল তখন?’

 ‘এক মুঠ ফুল রাগ কইরা আমার চোখেমুখে ছুঁইড়া মারল’—

 ‘খুব আস্পর্দা ত! তুই সইয়া গেলি?’

 ‘না।’

 ‘কি করলি তুই?’

 ‘এক ভেংচি দিলাম।’

 ‘তুই আমারে তেমুন কইরা একটা ভেংচি দে না!’

 ‘ধেৎ! তুই কি আমার সত্যের বর? তুই ত মাইয়া মানুষ!’

 ‘তবে আমি তোরে দেই!’

 ‘ধেৎ, আমরা কি আর অখন ছোট রইছি?’

 কি এমুন বড় হইয়া গেছি। বারোবছর বয়সে বিয়া হইছিল, তারপর ন’বছর—মোটে ত একুশ বছর। এর মধ্যেই বড় হইয়া গেলাম?’

 ‘বড় হইয়া গেলি কি গেলি না, বুঝতি যদি কোলে দুই একটা ছাও-বাচ্ছা থাক্‌ত। জীবনে একটারও গু-মুত কাচাইলি না, তোর মন কাঁচ শরীল কাঁচা, তাই মনে হয় বড় হইলি না; যদি পুলাপান হইত, বয়সও মালুম হইত।’

 ‘সেই কথা ক।’

 তারপর চারিদিক আঁধার হইয়া আসিল। শাদা শাদা অজস্র সাপলা ফুলে শোভিত, সর্পাসনা মনসা মূর্তিটি অনন্তর চোখের সামনে ঝাপসা হইয়া আসিল, অন্যান্য পূজাবাড়িগুলিরও গান ধুমধাম ক্রমে অস্পষ্ট হইয়া একসময় থামিয়া গেল।


 শ্রাবণ মাসের শেষ তারিখটিতে মালোদের ঘরে ঘরে এই মনসা পূজা হয়। অন্যান্য পুজার চাইতে এই পূজার খরচ কম, আনন্দ বেশি। মালোর ছেলেরা ডিঙ্গি নৌকায় চড়িয়া জলভরা বিলে লগি ঠেলিয়া আলোড়ন তোলে। সেখানে পাতাল ফুঁড়িয়া ভাসিয়া উঠে সাপের মতো লিক্‌লিকে সাপলা। শাদা শাদা ফুল ফুটিয়া বিল জুড়িয়া ছত্রাইয়া থাকে। যতদূর চোখ যায় কেবল ফুল আর ফুল—শাদা মাণিকের মেলা যেন। ঘাড়ে ধরিয়া টান দিলে কোন এক জায়গায় সাপলাটা ছিঁড়িয়া যায়, তারপর টানিয়া তোল—খালি টানো আর টানো, শেষ হইবে না শীঘ্র। এইভাবে তারা এক বোঝাই সাপলা তুলিয়া আনে। মাছেরা ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখে—মালোর ছেলেরা কেমন সাপলা তুলিতেছে। সাপলা তোলার ফাঁকে ফাঁকে মালোর ছেলেরাও চাহিয়া দেখে। জল শুকাইবে, বিলে বাঁধ পড়িবে, তখন বেঘোরে প্রাণ হারাইতে হইবে—এসব জানিয়া শুনিয়াও বোকা মাছেরা, কিসের মায়ায় যেন বিলের নিষ্কম্প জলে তিষ্ঠাইয়া আছে। তিতাসের স্রোতাল জলে নামিয়া পড়িলে, অত শীঘ্র ধরা পড়িবার ভয় থাকিবে না, ধরা যদি পড়েও, পড়িবে মালোদের জালে; সেখান থেকে লাফাইয়াও পালানো যায়। কিন্তু নমশুদ্রের বাঁধে পড়িলে হাজারবার লাফাইলেও নিস্তার নাই।

 মনসার পুষ্পসজ্জা শেষ হইলে পুরোহিত আসে! মালোদের পুরোহিত ডুমুরের ফুলের মত দুর্লভ। একজন পুরোহিতকে দশবারো গাঁয়ে একা একদিনে মনসা পূজা করিয়া বেড়াইতে হয়। গলায় একখানা চাদর ঝুলাইয়া ও হাতে একখানা পুরোহিত দর্পণ লইয়া আসিয়া অমনি তাড়া দেয়—শীঘ্‌গির। তারপর বারকয়েক নম নম করিয়া এক এক বাড়ির পূজা শেষ করে, দক্ষিণা আদায় করে। এবং আধঘণ্টার মধ্যে সারা গাঁয়ের পূজা শেষ করিয়া তেমনি ব্যস্ততার সহিত কোনো মালোকে ডাকিয়া বলে, ‘অ বিন্দাবন, তোর নাওখান্ দিয়া আমারে ভাটি-সাদকপুরে লইয়া যা।’


 শ্রাবণের শেষ দিন পর্যন্ত পদ্মাপুরাণ পড়া হয়, কিন্তু পুঁথি সমাপ্ত করা হয় না। লখিন্দরের পুনর্মিলন ও মনসা-বন্দনা বলিয়া শেষ দুইটি পরিচ্ছেদ রাখিয়া দেওয়া হয় এবং তাহা পড়া হয় মনসা পূজার পরের দিন সকালে, সেদিন মালোরা জাল বাহিতে যায় না। খুব করিয়া পদ্মাপুরাণ গায় আর খোল করতাল বাজায়।

 শেষ দিন বনমালীর গলাটা ভাঙ্গিয়া গেল। এক হাতে গাল চাপিয়া ধরিয়া, চোখ দুইটা বড় করিয়া, গলায় যথাসম্ভব জোর দিয়া শেষ দিশা তুলিল, ‘বিউনি হাতে লৈয়া বিপুলায়ে বলে, কে নিবি বিউনি লক্ষটেকার মূলে।’ কিন্তু সুরে আর জোর বাঁধিল না; ভাঙ্গা বাঁশের বাঁশীর মতো বেসুরো বাজিল। অন্যান্য যারা দোহার ধরিবে তাদের গলা অনেকের আগেই ভাঙ্গিয়া গিয়াছে তারাও চেষ্টা করিয়া দেখিল সুর বাহির হয় না। তারা পদ্মাপুরাণ পড়া শেষ করিল। বেহুল বিজনী বেচিতে আসিয়াছে, জায়েদের নিকটে গোপনে ডোমনীর বেশ ধরিয়া। শেষে পরিচয় হইল এবং চাঁদসদাগরের পরাজয় হইল; সে মনসা পূজা করিয়া ঘরে ঘরে মনসার পূজা খাওয়ার পথ করিয়া দিল।


 বন্দনা শেষ করিয়া পুঁথিখানা বাঁধা হইতেছে। এক বৎসরের জন্য উহাকে রাখিয়া দেওয়া হইবে। আবার শ্রাবণ আসিলে খোলা হইবে। একটা লোক ঝুড়ি হইতে বাতাস ও খই বিতরণ করিতেছে। লোকে এক একজন করিয়া খই বাতাসা লইয়া প্রস্থান করিতেছে। যাহাদের তামাকের পিপাসা আছে তাহারা দেরি করিতেছে। এদিকে পূজার ঘরের অবস্থা দেখিলে কান্না পায়। আগের দিন পূজা হইয়াছে। তখন দীপ জ্বলিয়াছিল, ধূপ জ্বলিয়াছিল; দশ বারোটি তেপায়ায় নৈবেদ্য সাজাইয়া রাখা হইয়াছিল। সদ্য রঙদেওয়া মনসামূর্তি যেন জীবন্ত হইয়া হাসিতেছিল; আর তার সাপ দুইটা বুঝিবা গলা বাড়াইয়া আসিয়া অনন্তকে ছোবলই দিয়া বসে—এমনি চক্‌চকে ঝক্‌ঝকে ছিল। আজ তাদের রঙ অন্যরকম। অনিপুণ কারিগরের সস্তায় তৈয়ারী একদিনের জৌলুস, রঙচটা হইয়া ম্লান হইয়। গিয়াছে। কোন্ অসাবধান পূজার্থীর কাপড়ের খুঁটে লাগিয়া একটা সাপের জিব্ ও আরেকটা সাপের ল্যাজ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। এখন তাহাদের দিকে চাহিলে অনুকম্পা জাগে। রাশি রাশি সাপলা ছিল মূর্তির দুই পাশে। ছেলেরা আনিয়া এখন খোসা ছাড়াইয়া খাইতেছে আর অটুট খোসাটার মধ্যে ফুঁ দিয়া বোতল বানাইতেছে। কেউ কেউ সাপলা দিয়া মালা বানাইয়া গলায় পরিতেছে। অনন্ত এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিল। একটি ছোট মেয়ে তেমনি কয়েক ছড়া মালা বানাইয়া কাহার গলায় পরাইবে ভাবিতেছিল। অনন্তর দিকে চোখ পড়াতে তাহারই গলায় পরাইয়া দিল। অনন্ত চট করিয়া খুলিয়া আবার মেয়েটির খোঁপায় জড়াইয়া থুইল। চক্ষুর নিমিষে এই কাণ্ডটি ঘটিয়া গেল। মেয়েটির দিকে চাহিলে প্রথমেই চোখ পড়িবে এই খোঁপার উপর। ছোট মেয়ের তুলনায় অনেক বড় সে-খোঁপা। সাত মাথার চুল এক মাথায় করিয়া যেন মা বাঁধিয়া দিয়াছে।

 খুশি হইয়া মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোনোদিন ত দেখি নাই তোমারে; তোমার নাম কি?’

 ‘অনন্ত। আমার নাম অনন্ত।’

 ‘দূর, তা কেম্‌নে হয়! ঠিক কইরা কও, তোমার নাম কি?’

 ‘ঠিক কথাই কই। আমার নাম অনন্ত।’

 তবে আমার মত তোমার খোঁপা নাই কেনে; আমার মত তুমি এইরকম কইরা শাড়ি পর না কেনে? তোমার নাক বিন্ধা নাই কেনে, কান বিন্ধাইয়া কাঠি দেয় নাই কেনে; গোধানি কই, হাতের চুড়ি কই তোমার?’

 ‘আরে, আমি যে পুরুষ। তুমি ত মাইয়া।’

 ‘তবে তোমার নাম অনন্ত না।’

 ‘না! কেনে?’

 ‘অনন্ত যে আমার নাম। তোমার এই নাম হইতে পারে না?’

 ‘পারে না? ওমা, কেনে পারে না?’

 ‘তুমি পুরুষ। আমার নাম কি তোমার নাম হইতে পারে?’

 ‘হইতে পারে না যদি, তবে এই নাম আমার রাখল কেনে। আমার মা নিজে এই নাম রাখছে। মাসীও জানে।’

 ‘কেবল মাসী জানে? আর কেউ না?’

 ‘যে-বাড়িতে আছি, তারা দুই ভাই-ভইনেও জানে।’

 ‘এই? আর কেউ না! ওমা, শুন’ তবে। আমার নাম রাখছে গণক ঠাকুরে। জানে আমার মায় বাবায়, সাত কাকায়, আর পাঁচ কাকীয়ে; আর ছয় দাদা আর তিন দিদিয়ে, চার মাসী দুই পিসিয়ে।’

 ‘ও বাব্বা!’

 ‘আরো কত লোকে যে জানে। আর কত আদর যে করে। কেউ মারে না আমারে।

 ‘আমারেও কেউ মারে না। এক বুড়ি মারত, মাসী তারে আটকাইত।’

 ‘মাসী আটকাইত, ত মা আটকাইত না?’

 ‘আমার মা নাই।’

 মেয়েটি এইবার বিগলিত হইয়া উঠিল, ‘নাই! হায়গো কপাল! মানুষে কয়, মা নাই যার ছাড় কপাল তার।’

 অনন্তর নিজেকে বড় ছোট মনে হইল। চট করিয়া বলিল, ‘মাসী আছে।’

 মেয়েটি ভুরু বাঁকাইয়া একটা নিশ্বাস ছাড়িল, ‘মাসী আছে তোমার, তবু ভালা। মানুষে কয়, তীর্থের মধ্যে কাশী ইষ্টির মধ্যে মাসী, ধানের মধ্যে খামা কুটুমের মধ্যে মামা।’—বলিয়া হঠাৎ মেয়েটি কোথায় চলিয়া গেল।

 অনন্ত মনে মনে ভাবিল, বাব্বা, খুব যে শিলোক ছাড়ে। উদয়তারার কাছে একবার নিয়া গেলে মন্দ হয় না।

 একটু পরেই পূজামণ্ডপের সামনে মেয়েটির সহিত আবার দেখা হইল।

 ‘আচ্ছা, আমারে তোমার মাসীর বাড়ি লইয়া যাইবা?’

 ‘কেমনে লইয়া যামু। অনেক দূর যে। নাওয়ে গেলে এক দুপুরের পথ।’

 ‘মানুষে কি মানুষেরে দূরের দেশে লইয়া যায় না?’

 ‘যায়। কিন্তু অখন যায় না। বৈশাখ মাসে তিতাসের পারে মেলা হয়। তখন লইয়া যায়। অনেক দূর থাইক্যা অনেক মানুষ তখন অনেক মানুষেরে লইয়া যায়!’

 ‘তখন আমরেও লইয়া যাইও। কেমুন?’

 ‘আমারত নাও নাই। আচ্ছা বনমালীরে কইয়া রাখুম। তার নাওয়ে যাইতে পারবা।’

 ‘পরের নাওয়ে বাবা যাইতে দিলে ত?’

 ‘খালের টেকের ভাঙ্গা নাওয়ের খোড়ল থাইক্যা সাতদিনের উপাসী মানুষেরে যে-জন বাইর কইরা আনল, তারে কও তুমি পর! কি যে তুমি কও।’

 মেয়েটির চোখমুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, ‘খালের টেকে ভাঙ্গা নাওয়ের খোড়লে তুমি থাকতা, ডর করত না তোমার? রাইতে দেও-দৈত্য যদি দেখা দিত। কও না, কি কইরা তুমি থাক্‌তা এক্‌লা—’

 ‘সে এক পরস্তাবের কথা। কইতে গেলে তিনদিন লাগব!’

 ‘তোমরার গাঁওয়ে আমারে লইয়া যাইবা? সেই নাওখান দেখাইবা?’

 ‘আচ্ছা নিয়া যামু।’

 ‘নিবা যে, তোমার মাসী আমারে আদর করব ত তোমার মত?’

 ‘হ, তোমারে করব আদর! আমারেই বইক্যা বাইর কইরা দিল।’

 ‘কও কি! বাইর কইরা দিল, আর ডাইক্যা ঘরে নিল না?’

 ‘না।’

 ‘তবে গিয়া কাম নাই। তুমি আম্‌রার বাড়িতেই চল। কেউ তোমারে বাইর কইরা দিব না। যদি দেয়ও, আমি তোমারে ডাইক্যা ঘরে নিমু।’

 কথাগুলি অনন্তর খুব ভাল লাগিল। একঘর ভরতি লোকের মধ্যে থাকিতে খুব ভাল লাগিবে। সেখানে দশটি লোকে দশ রকমের কথা বলিবে, বিশ হাতে কাজ করিবে, দশমুখে গল্প করিবে—একটা কলরবে মুখরিত থাকিবে ঘরখানা। তার মধ্যে এই চঞ্চল মেয়েটি তার সঙ্গে খেলা করিবে, জালবোনা মাছধরা খেলা। অনন্ত সত্যিকারের জেলে হইয়া নৌকাতে না উঠা পর্যন্ত তাকে এই খেলার মধ্য দিয়াই জাল ফেলা জাল তোলা আয়ত্ত করিতে হইবে।

 একটা করুণ সুর তার মনে গুণ গুণ করিয়া উঠিল। তার জগৎ বেদনার জগৎ। এ জগতে হাসি নাই, আমোদ নাই। আপনজন না থাকার ব্যথায় তার জগৎ পরিম্লান। আকাশে তারা আছে, কাননে ফুল আছে, মেঘে রঙ আছে। তিতাসের ঢেউয়ে সে-রঙের খেলা আছে, সব কিছু নিয়াও এই রূপোন্মত্ত বহির্বিশ্ব তার মনের ম্লানিমার সঙ্গে একাকার। একটার পর একটা সাগরের ঢেউয়ের মত কি যেন তার সারা মনটা ডুবাইয়া চুবাইয়া দেয়। তখন সে চাহিয়া দেখে, কূল নাই, সীমা নাই, খালি জল আর জল। দুই তীরের বাঁধনে বাঁধা তিতাসের সাধ্য কি সে জল আগলায়। এ যেন বার-দরিয়ার নোনা জল—ছোট তটিনীর সকল নৃত্যবিলাসকে তলাইয়া দিয়া জাগিয়া থাকে শুধু একটানা হাহাকার।

 অনন্ত ইহার কারণ বিশ্লেষণ করিতে চায় মনে মনে। দেখে এত বিশাল বিপুল সময়ের মহাস্রোতে সে বুঝি বা একখণ্ড দুর্বল কুটার মতই ভাসিয়া চলিয়াছে। কিছুদিন আগে একমাত্র মাকে আপন বলিয়া জানিত। তারপর মাসী। কিন্তু সে যে আসলে তার কেউ না, অনন্তর এ বোধ আছে। বনমালী উদয়তারা এরাও দুইদিনের পথের সাথী। এরা যেদিন মাসীর মতই তাকে পর করিয়া দিবে সেদিন সে কোথায় যাইবে!

 কোথায় আর যাইবে। একটা পান্থশালা জুটিয়া যাইবেই। যে ছাড়িতে পারে তার জুটিতেও বিলম্ব হয় না। পান্থশালারই মত এই মেয়েটির সংসারে ঢুকিয়া পড়িলে ক্ষতি কি?

 তিনটি নারী একযোগে অনন্তর সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। মাসী তার একান্তই অসহায়। তিক্তবিরক্ত বাপ মার অনাত্মীয় পরিবেশে সে নিতান্তই অসহায়। অতীতের সঙ্গে তার বর্তমানের যে যোগ-সূত্র আছে, ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াইয়া সে-সূত্র ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। একটা নগণ্য খড়কুটার মতই সেও সময়ের মহাস্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছে। তিতাসের জলে হাজারো খড়কুটা ভাসিয়া যায়; কিন্তু কোন না কোন মালোর জালে তারা আটকা পড়িবেই পড়িবে। কিন্তু মাসীর ভবিষ্যৎ কোন অবলম্বনের গায়েই আটকা পড়িবে না। আর উদয়তারা? অনেক বেদনা তার মনে জমা হইয়া আছে, কিন্তু বড় কঠিন এ নারী। হাস্য পরিহাসে, প্রবাদে শ্লোকে সব বেদনা ঢাকিয়া সে নারী সব সময়ে মুখের হাসি নিয়া চলে। তাহাকে জব্দ করিবে এমন দুঃখ বুঝি বিধাতাও সৃষ্টি করিতে পারে নাই। মাসী তার মত সকল দুঃখকে অগ্রাহ্য করিয়া চলিবার ক্ষমতা পাইল না কেন? হায়, তাহা যদি সে পাইত, অনন্তর মন অনেক ভাবনা হইতে নিষ্কৃতি পাইত। আর এই হাস্যচঞ্চল মেয়েটি। এর জীবন সবে শুরু হইয়াছে। সে নিজে যেমন চাঁদের রোশনি, তেমনি অনেক থমথমে আকাশের তারাকে সে কাননের ফুলের মত বোঁটায় আঘাত করিয়া ফুটাইয়া ছিটাইয়া হাসাইতে মাতাইতে সক্ষম। সে যদি সব সময় তার সঙ্গে সঙ্গে থাকিতে পারিত। তবে তার মনের ম্লানিমাটুকু একটু একটু করিয়া ক্ষয় হইয়া যাইত।

 মেয়েটি হঠাৎ হাসিতে ফাটিয়া পড়িল। অনন্ত চম্‌কাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘হাস কেনে?’

 মেয়েটির চোখ দুটি নাচিয়া উঠিল, ‘তোমার গলায় যে মালা দিলাম; কারো কাছে কইও না কইলাম।’

 ‘কইলে কি হইব?’

 ‘তোমারে বর বইল্যা মানুষে ঠাট্টা কর্‌ব।’

 ‘দূর। আমি কি শ্যামসুন্দর বেপারী, আমার কি ঐ রকম বড় বড় দাড়ি আছে যে আমারে বর কইব!’

 ‘বরের বুঝি লম্বা দাড়ি থাকে? মিথ্যুক।’

 ‘আমি নিজের চোখে দেখলাম। মা আমারে সাথে কইরা নিয়া দেখাইছিল। আরো কত লোকে দেখতে গেছিল। তারা কইল, এতদিন পরে বরের মত বর দেইখ্যা নয়ন সার্থক করলাম।’

 ‘ও, বুঝ্‌ঝি। বুড়া, বুড়া বর। সে ত বুড়া কিন্তু তুমি ত বুড়া না।’

 অনন্ত বুড়া কিনা ভাবিয়া দেখিতে গিয়া সব গোলমাল করিয়া ফেলিল। এমন সময় ডাক আসিল, ‘কইলো অনন্তবালা, ও সোণার-মা!’

 মায়ের আহ্বান। আদুরে মেয়ে। মা তাকে ডাকিতে দুইটি নামই ব্যবহার করেন। খাওয়ার সময় হইয়াছে। তার আগে নাইবার জন্য এই আহ্বান।

 অন্য একটি মেয়ে সাপলা চিরিয়া বোতল বানাইয়াছে, তাতে গ্রন্থি পরাইতেছিল। সে মাথা না তুলিয়াই ছড়া কাটিল ‘অনন্ত বালা, সোণার মালা, যখনি পরি তখনি ভালা।’

 ‘দেখলা ত, আমার নাম কতজনে জানে। আমার নাম দিয়া শিলোক বানাইছে। মা ডাক্‌তাছে। আমি যাই। যে-কথা কইলাম—কারো কাছে কইও না, কেমুন?’

 ‘না।’

 ‘আমি কিন্তু কইয়া দিমু।’

 ‘কি?’

 ‘তুমি আমার খোঁপায় মালা দিছ—এই কথা।’

 ‘কার কাছে?’

 ‘মার কাছে?’

 অনন্ত বিচলিত হইয়া উঠিল।

 ‘আরে না না। মা তোমারে বকব না। আদর করব। তুমিও চল না আম্‌রার বাড়িত!’

 অনন্ত বলিল ‘না।’

 মাসীর জন্য তার মনটা এই সময় বেদনায় টন্ টন্ করিয়া উঠিয়াছিল!

 এই সময় তিতাসের বুকে কিসের বাজনা বাজিয়া উঠিল। ছেলের দল পূজার বাড়ি ফেলিয়া দৌড়াইয়া চলিল নদীর দিকে। সকলেরই মুখে এক কথা—দৌড়ের নাও, দৌড়ের নাও।

 নামটা অনন্তর মনে কৌতূহল জাগাইল। অনেক নাও সে দেখিয়াছে, এ নাও ত কই দেখে নাই। ঘাটে গিয়া দেখে সত্যি এ দেখিবার জিনিসই বটে। অপূর্ব, অপূর্ব।

 রাঙা নাও। বর্ষার জলে চারিদিক একাকার। এদিকে ওদিকে কয়েকটি পল্লী যেন বিলের পানিতে সিনান করিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। তিতাসের বুক শাদা, তার পারের সীমার বাহিরে সাপলাসালুকের দেশ, অনেক দূরে ধানক্ষেত পাটক্ষেত, তাহাও জলে ভাসিতেছে। নৌকাটি তিতাস পার হইয়া দূরের একখানা পল্লীর দিকে রোখ করিয়াছে। গলুইটা জলের সমান নিচু। সরু ও লম্বা পাছাটা পেটের পর হইতে উঁচু হইয়া গিয়া আকাশে ঠেকিয়াছে; হালের কাঠিটা তির্যকভাবে আকাশ ফুঁড়িবার মতলবে যেন উঁচাইয়া উঠিয়াছে। তাহাতে ধরিয়া একটা লোক নাচিতেছে আর পাটাতনে পদাঘাত করিতেছে। লোকটাকে একটা পাখির মত ছোট দেখাইতেছে। ডরার উপর দাঁড়াইয়া একদল লোক খোল করতাল বাজাইয়া সারি গাহিতেছে। আর তাহারই তালে তালে দুই পাশে শত শত বৈঠা উঠিতেছে নামিতেছে, জল ছিটাইয়া কুয়াসা সৃষ্টি করিতেছে।

 কিন্তু অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতে পাওয়া গেল না। পল্লীর গাছপালা ঘরবাড়ির আড়ালে ঢাকা পড়িয়া গেল। ছেলেরা অনন্তকে সান্ত্বনা দিল, গাঁয়ের এই পাশ দিয়া আড়ালে পড়িয়াছে, ঐ-পাশ দিয়া নিশ্চয়ই বাহির হইবে।

 কিন্তু আর বাহির হইল না।

 কেন বাহির হইল না জিজ্ঞাসা করিতে ছেলেরা জানাইল, হয়ত ঐ-গাঁয়ের ঐ-পাশটিতে ওদের ঘরবাড়ি। নৌকা সাজাইয়া রঙ করাইয়া লোকজন লইয়া তালিম দিতে গিয়াছিল। পাঁচদিন পরেই বড় নৌকা-দৌড় কিনা। নাও কেমন চলে দেখিবার জন্য একপাক ঘুরিয়া আসিয়াছে। এখন ওদের ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া যে-যার বাড়ি খাইতে চলিয়া গিয়াছে।

 আর নয় তো ঐ-গাঁয়ের আড়াল দিয়া সোজা চলিয়া গিয়াছে দূরের কোন খলায় দৌড়াইবার জন্য।

 শেষের কথাটাই অনন্তর নিকট অধিক যুক্তিসঙ্গত মনে হইল। যেরকম সাপের মত হিস্ হিস্ করিয়া চলিয়াছিল, ঐ-গাঁয়ে উহা থামিতেই পারে না। সারাগায়ে লতাপাত। সাপ ময়ূরের ছবি লইয়া রঙিন দেহ তার একের পর এক পল্লীর পাশ কাটাইয়া আর হাজার হাজার ছেলেমেয়ের মন পাগল করিয়া ছুটিয়াই চলিয়াছে। সারাদিন চলিবার পর কোথায় রাত্রি হইবে কে জানে।