বিষয়বস্তুতে চলুন

দায়ে খুন/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

 পরদিবস সময় মত বালমুকুন্ আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন, আমিও তাঁহার সহিত রাজার কাটরায় গমন করিলাম। বালমুকুন্ পূর্ব্বে আমার নিকট যেরূপ বর্ণনা করিয়াছিলেন, সেই স্থানে গমন করিয়া আমিও সেইরূপ দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম, বাস্তবিকই তাহার ঘরের সম্মুখে পরদার বাহিরে দ্বারবান‍্বেশী একটী লোক বসিয়া রহিয়াছে। বালমুকুন্ পূর্ব্বের পরামর্শানুযায়ী সেই দ্বারবানকে কিছু না বলিয়া, সেই পরদা উঠাইয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘরের ভিতর গমন করিলাম। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখি, যে ব্যক্তি মাণিকচাঁদ বলিয়া পূর্ব্বে বালমুকুন‍্কে আত্ম-পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, তিনি সেই গৃহের মধ্যে পূর্ব্ব-বর্ণিত অবস্থায় আপন কার্য্যে অতি মনোযোগের সহিত রত রহিয়াছেন। টেবিলের উপর কতকগুলি কাগজ-পত্র ছড়ান রহিয়াছে; কিন্তু তিনি সেই সকল কাগজ-পত্র লইয়া যে কোনরূপ কার্য্য করিতেছেন, তাহা আমার বোধ হইল না। আমার বোধ হইল, তিনি একখানি পত্র লিখিতেছেনমাত্র। পত্র লিখিতেছেন সত্য; কিন্তু মধ্যে মধ্যে তাঁহার সম্মুখস্থিত একখানি সংবাদ-পত্রের দিকে এক একবার লক্ষ্য করিতেছেন। সংবাদ-পত্রখানি দেখিয়া বোধ হইল, উহা এদেশীয় সংবাদ-পত্র নহে, বোম্বাই প্রদেশের কোন একখানি সংবাদপত্র; কিন্তু ইংরাজীতে লেখা।

 আমরা সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই, যে পত্রখানি তিনি লিখিতেছিলেন, তাহা নিতান্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে ছিঁড়িয়া সেই স্থানে ফেলিয়া দিলেন, এবং সংবাদপত্রখানির উপর অপর কতকগুলি কাগজ-পত্র স্থাপিত করিয়া আমাদিগের দিকে একবার লক্ষ্য করিলেন ও কহিলেন, “কে? বালমুকুন্ আসিয়াছ? তোমার সঙ্গে এই যে বাবুটী আসিয়াছেন, ইনি কে?”

 মাণিকচাঁদের কথার উত্তর করিবার পূর্ব্বই বালমুকুন্ সেই স্থানে একখানি চৌকির উপর উপবেশন করিলেন, এবং আমাকে আর একখানি চৌকি দেখাইয়া দিয়া, সেই স্থানে আমাকে বসিতে কহিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, বালমুকুন্ মাণিকচাঁদের কথার উত্তরে কহিলেন, “আমি ইহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি, ইনি আমার একজন বিশ্বাসী বন্ধু, এবং ব্যবসা-কার্য্যে ইনি সবিশেষ নিপুণ; কিন্তু আজকাল ইনিও বেকার অবস্থায় বসিয়া আছেন, ইহার হস্তে কোন কর্ম্ম-কার্য্য নাই। বঙ্গদেশের নানাস্থানে আমাদিগের শাখা-কার্য্যালয় খুলিতে হইলে, অনেক লোকের প্রয়োজন হইবে, তাই আমি ইঁহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি। আমি ত ইহাকে সবিশেষ উপযুক্ত লোক বলিয়া জানি। এখন আপনি ইহার সহিত প্রয়োজন মত কথাবার্ত্তা কহিয়া দেখুন, আপনার বিবেচনায় যদি ইনি আমাদিগের কার্য্যোপযোগী মনে করেন, তাহা হইলে ইহাকেও আপনাদিগের কার্য্যে নিযুক্ত করিতে পারেন।”

 বালমুকুনের এই কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদ আমার প্রতি লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “কেমন মহাশয়! আপনি আমাদিগের ব্যবসাকার্য্যে আমাদিগের সহিত মিলিত হইতে ইচ্ছা করেন কি?”

 মাণিকচাঁদ আমাকে এই কয়েকটী কথা কহিলেন সত্য; কিন্তু আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি তাঁহার অন্তরের ভাব আমার নিকট প্রকাশ করিতে সমর্থ হইলেন না। তাঁহার মুখ দিয়া তাঁহার কথা বেশ স্পষ্টরূপে বাহির হইতেছে না, মুখশ্রী যেন বিবর্ণ হইয়া আসিয়াছে, চক্ষুতে যেন স্বাভাবিক জ্যোতিঃ নাই, হস্তপদ যেন অল্প অল্প কাঁপিতেছে। মাণিকচাঁদের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমার বেশ প্রতীয়মান হইল, তাঁহার অন্তরে যেন কোন একটী ভয়ানক ভাবের উদয় হইয়াছে। তিনি মনের সেই ভাব গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু কোনরূপে পারিয়া উঠিতেছেন না।

 মাণিকচাঁদের কথার উত্তরে আমি কহিলাম, “যখন অনুগ্রহ করিয়া আপনি আমাকে প্রতিপালন করিতে ইচ্ছুক হইয়াছেন, তখন আপনাদিগের নিকট কার্য্য না করিব কেন? আমাকে কি কার্য্য করিতে হইবে আদেশ করুন, অদ্য হইতেই আমি আপনাদিগের কর্ম্মে নিযুক্ত হই।”

 আমার কথা শুনিয়া মাণিকাচাঁদ কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। বোধ হইল, যেন তিনি আমাকে কিছু বলিতে চাহিতেছেন, অথচ বলিতে পারিতেছেন না; তাঁহার মুখ দিয়া তাঁহার মনের এরূপ ভাব বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে।

 একটু চিন্তা করিয়া পরিশেষে তিনি আমাকে কহিলেন, “আচ্ছা, আপনি যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে এখন আপনি গমন করিতে পারেন। কোন্ কোন্ স্থানে আমাদিগের কার্য্যালয় স্থাপিত করিতে হইবে, তাহা স্থির হইবামাত্রই আমি বালমুকুনের দ্বারা আপনাকে সংবাদ প্রদান করিব। সেই সময় আপনি আসিয়া আমাদিগের কার্য্যে নিযুক্ত হইতে পারিবেন। কেমন বালমুকুন্! ইহাই উত্তম পরামর্শ নহে?”  বালমুকুন্। আপনি যেমন বিবেচনা করেন।

 মাণিক। অদ্য আমি আপনাকে গোপনে দুই চারিটী কথা কহি।

 বালমুকুন্। তাহা বলিতে পারেন। ইঁহার নিকট আমার কোন কথা গোপনীয় নাই, ইনি আমার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু। ইঁহার সমুখেই আমাকে সমস্ত কথা বলিতে পারেন।

 মাণিক। ইনি আপনার অতিশয় বিশ্বাসী সত্য; কিন্তু আমার সহিত ইহার সবিশেষরূপ পরিচয় নাই। সুতরাং অদ্য প্রথম দিবসের আলাপের পরই, আমি ইহার সম্মুখে আমাদিগের ব্যবসার সকল কথা বলিতে পারি না।

 বালমুকুন্। ইঁহার সম্মুখে যদি আপনি একান্তই কোন কথা বলিতে সম্মত না হন, তাহা হইলে ইনি একটু এই স্থানে অপেক্ষা করুন, আমি আপনার সহিত কোন নির্জ্জন স্থানে গমন করিতেছি, সেই স্থানে সকল কথা হইতে পারিবে। আপনার পার্শ্বের এই ঘরের ভিতর চলুন না কেন?

 এই বলিয়া বালমুকুন্ তাঁহার কথার উত্তর পাইবার অগ্রেই সেই ঘরের ভিতর গমন করিলেন। মাণিকচাঁদ আমাকে সেই স্থানে বসিতে বলিয়াই তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন।

 মাণিকাচাঁদকে দেখিয়াই তাহার উপর অনেক বিষয়ে আমার পূর্ব্বেই সন্দেহ হইয়াছিল; আমরা সেই ঘরের ভিতর প্রথম প্রবেশ করিবার সময় সংবাদ-পত্রখানি লুকাইয়া রাখায় আমার মনে আরও সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়। তিনি বালমুকুনের সহিত অপর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই, আমি তাঁহার টেবিলের উপর হইতে তাঁহার সেই লুক্কায়িত সংবাদপত্রখানি বাহির করিলাম, এবং উহার দুই একস্থানে লক্ষ্য করিবামাত্রই একটা বিষয়ের উপর আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল।

 সংবাদপত্রের এই স্থানটী পাঠ করিয়াই আমার মস্তক ঘূরিয়া গেল, আমি যেন চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিলাম। মনে হইল—আমি যাহার সহিত এই স্থানে আসিয়াছি, তাহার নামই ত বালমুকুন্, তিনিই বোম্বাই সহরে সেই প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ীর কর্ম্মে প্রথমে নিযুক্ত হন। কিন্তু মাণিকচাঁদের কথায় ভুলিয়া তিনি সেই কার্য্য পরিত্যাগ করেন। আমার আরও মনে হইল, বোম্বাই সহরের এই ভয়ানক চুরি ও হত্যাকাণ্ডের সহিত মাণিকচাঁদের কোনরূপ সংস্রব নাই ত?

 মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি যেস্থানে বসিয়াছিলাম, সেই স্থান হইতে নিঃশব্দে গাত্রোথান করিলাম, এবং যে ঘরের ভিতর মাণিকচাঁদ ও বালমুকুন্ প্রবেশ করিয়াছিলেন, যতদূর সম্ভব সেই ঘরের নিকটে গমন করিয়া তাঁহাদের মধ্যে কিরূপ কথোপকথন হইতেছিল, তাহা শুনিবার মানসে তাঁহাদিগের অলক্ষিতে দ্বারের অন্তরালে দণ্ডায়মান হইলাম।

 আমি যেস্থানে দাঁড়াইলাম, সেই স্থান হইতে উহাদের কথোপকথন উত্তমরূপে শুনা যাইতে লাগিল। উভয়ের কথোপকথন আমি যতদূর শুনিতে পাইলাম, তাহার সারমর্ম এইরূপ;—

 মাণিক। তুমি আমাকে কেন মিথ্যা বলিতেছ? উনি আমাকে চিনুন বা না চিনুন, আমি উঁহাকে চিনি; উনি ডিটেক‍্টিভ-পুলিসের একজন কর্ম্মচারী।

 বালমুকুন্। না মহাশয়! আমি মিথ্যা বলিব কেন, উনি ডিটেক‍্টিভ-পুলিসের কর্ম্মচারী নহেন; কিন্তু অনেক পুলিসকর্ম্মচারীর সহিত উঁহার আলাপ-পরিচয় আছে, এবং অনেক সময় উনি তাহাদিগের নিকট গমন করিয়াও থাকেন। কোন সময় তাহা দেখিয়া বোধ হয়, আপনার এইরূপ ধারণা হইয়াছে।

 মাণিক। আমি বুঝিতে পারিতেছি, তুমি প্রকৃত কথা বলিবে, এবং তোমাদিগের মনে যে কি দুরভিসন্ধি আছে, তাহাও প্রকাশ করিবে না। দেখ বালমুকুন্! আমি তোমাকে বিশ্বাস করিয়াছি, আমার সাধ্যমত কিছু উপকারও করিয়াছি, এবং যাহাতে তোমার ভাল হয়, সে বিষয়ও চেষ্টা করিতেছি। এরূপ অবস্থায় ইহা তোমার কর্তব্য কার্য্য যে, আমার নিকট কোন কথা গোপন করিবে না।

 বালমুকুন্। আমি আপনার নিকট কি কথা গোপন করিব? আমি আপনার কোন কথাই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আপনি আমার অন্নদাতা, আপনি আমাকে আপনাদিগের অধীনে একটী কর্ম্ম করিয়া দিয়া আমাকে যেরূপ উপকৃত করিয়াছেন, তাহা কি আমি সহজে ভুলিয়া গিয়া আপনার অনিষ্ট করিতে প্রবৃত্ত হইব? আর যাহাতে আপনার কোনরূপ অনিষ্ট হয়, তাহার নিমিত্তই বা আমি কিরূপে চেষ্টা করিতেছি? যে ব্যক্তি কর্ম্ম-প্রার্থী, তাহাকে আমি সঙ্গে করিয়া আপনার নিকট আনয়ন করিয়াছি। বিশেষতঃ আপনি অনেক লোকও নিযুক্ত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। এরূপ অবস্থায় আপনার মনে যদি কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয়, তাহা হইলে আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলুন, এখনই আমি উঁহাকে এই স্থান হইতে বিদায় করিয়া দিতেছি, এবং উঁহাকে বলিয়া দিতেছি, ‘এই স্থানে আপনার চাকরী হইবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই।’

 মাণিক। তুমি এখনও আমাকে এই বলিয়া বুঝাইতে চাহ যে, উনি ডিটেকটিভ-পুলিসের একজন কর্ম্মচারী নহেন, এবং আমার কোনরূপ অনিষ্ট করিবার মানসে এখানে আগমন করেন নাই? আমি কিন্তু তাহা বুঝিতে পারি না।

 বালমুকুন। ডিটেক‍্টিভ-পুলিস-কর্ম্মচারীগণের সহিত উঁহার আলাপ-পরিচয় আছে, তাহা আমি জানি; কিন্তু উনি স্বয়ং কর্ম্মচারী কি না, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি যে, আপনার কোনরূপ অনিষ্ট-সাধন করিবার মানসে উনি এখানে আগমন করেন নাই। আর যদিই উনি ডিটেক‍্টিভ-কর্ম্মচারী হয়েন, তাহা হইলে আপনি এমন কি দুষ্কার্য্য করিয়াছেন যে, উঁহার দ্বারা আপনার কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা?

 মাণিক। আচ্ছা, আপনি আপনার বন্ধুর সহিত ক্ষণকাল অপেক্ষা করুন, আমি এখনই আসিতেছি।

 মাণিকাচাঁদের এই শেষ কথা শুনিয়া, আমি নিঃশব্দে আসিয়া আপন স্থানে উপবেশন করিলাম। বসিবামাত্রই বালমুকুন সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া যেমন আমার নিকট আগমন করিলেন, অমনি আমি তাঁহাকে কহিলাম, “ইহারা হত্যাকারী। আমি মাণিকচাঁদকে যেমন ধৃত করিব, অমনি আপনি দ্বারবানকে ধরিবেন, কোনরূপে যেন আপনার হাত ছাড়াইয়া সে পলায়ন করিতে না পারে। ইহার সমস্ত ব্যাপার পরে আমি আপনাকে বলিতেছি।”

 বালমুকুনকে এই কথা বলিয়াই আমি সেই গৃহ হইতে দ্রুতপদে বাহির হইলাম। দেখিলাম, আমি মনে যাহা ভাবিয়াছিলাম, মাণিকচাঁদ ঠিক তাহাই করিতেছে। পূর্ব্ব-কথিত ঘর, যাহার দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ ছিল, তাহার একটী দরজা খুলিয়া মাণিকাচাঁদ সেই স্থান হইতে সবেগে প্রস্থান করিবার উদ্যোগ করিতেছে। ইহা দেখিয়াই দ্রুতবেগে আমি গিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিলাম, এবং আমার অঙ্গস্থিত উড়ানিদ্বারা তাহাকে উত্তমরূপে বাঁধিয়া তাহারই আফিস-ঘরের ভিতর তাহাকে আনিলাম। বালমুকুনের সাহায্যে দ্বারবানও ধৃত হইল, তাহাকেও উত্তমরূপে বাঁধিয়া তাহার মনিবের নিকট রাখিলাম।

 তখন উভয়কেই উত্তমরূপে বাঁধিয়া আমি মাণিকচাঁদকে কহিলাম, “দেখ মাণিকাচাঁদ! তুমি যাহা অনুমান করিয়াছিলে, তাহা প্রকৃত; আমি তোমাকে প্রকৃতই ধৃত করিতে আসিয়াছি। সুতরাং এখন যে কেন তোমাকে ধৃত করিলাম, তাহা তুমি এখন বেশ বুঝিতে পারিয়াছ। এখন তুমি আমাকে সমস্ত প্রকৃত কথা বলিতে প্রস্তুত আছ কি না?

 মাণিক। আমি আপনার কথা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না, এবং কেনইবা আপনি আমাদিগকে এরূপে ধৃত করিলেন, তাহারও কিছু অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

 আমি। যে ব্যক্তি হত্যা করিবার সহায়তা করিতে পারে, ও চুরি করিবার নিমিত্ত নানাবিধ উপায় উদ্ভাবন করিয়া অপরের দ্বারা সেই কার্য্য সমাধা করিয়া লইতে পারে, সে যে কেন ধৃত হইল, তাহা তাহার বুঝিতে না পারিবারই কথা। সে যাহা হউক, তুমি এখন প্রকৃত কথা বলিবে, কি না?

 আমার এই প্রকার কথা শুনিয়া বালমুকুন কেবল আমার মুখের দিকেই একদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার ভাবগতি দেখিয়া অনুমান হইতে লাগিল, আমার এই অবস্থা দেখিয়া বালমুকুন যেন একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িয়াছেন, ভালমন্দ কিছুই যেন বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। বালমুকুনের এই অবস্থা দেখিয়া আমি তাঁহাকে কহিলাম, “আপনি এরূপ বিস্মিত হইতেছেন কেন? ইহারা আপনাকে মধ্যে রাখিয়া একটী ভয়ানক চুরি করিয়াছে, এবং আপন প্রাণ লইয়া পলায়ন করিবার মানসে একটী হত্যা করিতেও পরাজুখ হয় নাই।”

 মাণিক। এ মিথ্যা কথা। ইহা আপনাকে কে বলিল?

 আমি। আমাকে অপরে যাহা কিছু বলুক, বা অপর কোন স্থান হইতে আমি যেরূপে সংবাদ পাই, আর না পাই, তোমারই সংবাদ-পত্রে কি সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাই কেন একবার পড়িয়া দেখ না। তাহা হইলেই ত আমাকে তোমার আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হইবে না। এই বলিয়া মাণিকচাঁদের টেবিলের উপর যে সংবাদ-পত্রখানি আমি প্রাপ্ত হইয়া পাঠ করিয়াছিলাম, সেই সংবাদ-পত্র হইতে সেই বিষয়টী আমি পাঠ করিলাম। উহার সারমর্ম্ম এইরূপ—

“ভয়ানক হত্যা ও অদ্ভুত চুরি।”

 অপরাধী ধৃত হইয়াছে; কিন্তু কে যে তাহার এই বিষয়ে সবিশেষরূপে সাহায্য করিয়াছে, তাহার সন্ধান এখনও পর্য্যন্ত হয় নাই।”

 “বালমুকুন্ নামক এক ব্যক্তি কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, বোম্বাই সহরের একজন প্রধান ধনীর অধীনে একটি কার্য্যে নিযুক্ত হয়। চাকরী করা তাহার উদ্দেশ্য ছিল না, তাহার ইচ্ছা, চাকরের ভানে কিছুদিবস সেই স্থানে কার্য্য করিয়া, ধনীর ধনভাণ্ডার প্রভৃতির উত্তমরূপ অনুসন্ধান লয়। এইরূপে সেই মহাজনের কোন্ কোন্ স্থানে কিরূপ অর্থ আছে, তাহা যেমন জানিতে পারিল, অমনি সুযোগমত ক্রমে ক্রমে সেই সকল স্থান যে সকল তালার দ্বারা বন্ধ থাকে, একে একে তাহার সমস্ত চাবি প্রস্তুত করিয়া লয়, এবং সুযোগমত একদিবস রাত্রিকালে সেই সমস্ত তালা খুলিয়া নোট, টাকা, সুবর্ণ-অলঙ্কার ও জহরতআদিতে প্রায় লক্ষাধিক টাকা অপহরণ করিয়া সমস্ত তালা পুনরায় আবদ্ধ-পূর্ব্বক যেমন বাহির হইবার চেষ্টা করে, সেই সময় একজন দ্বারবান্ উহা জানিতে পারিয়া বালমুকুন‍্কে ধরিবার চেষ্টা করে, এবং চোর চোর বলিয়া ভয়ানক গোলযোগ করে। বালমুকুন্ সেই সময় অনন্যোপায় হইয়া আপনার প্রাণ লইয়া পলায়ন করিবার মানসে সেই দ্বারবানের উপর সবিশেষরূপ বলপ্রয়োগ করে; কিন্তু যখন কোনরূপেই তাহার হস্ত হইতে পরিত্রাণ না পায়, সেই সময় একখানি অস্ত্র দ্বারা বালমুকুন্ তাহাকে সাংঘাতিকরূপ আঘাত করিয়া পলায়নের চেষ্টা করে। সেই অস্ত্রখানি বোধ হয়, বালমুকুন্ সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিল। দ্বারবান সেই অস্ত্রাঘাতেই হতজ্ঞান হইয়া সেই স্থানে পতিত হয়, এবং পরিশেষে ইহজীবন সম্বরণ করে। দ্বারবানকে হত্যা করিয়াও বালমুকুন্ সেই স্থান হইতে পলায়ন করিতে সমর্থ হয় নাই, অপরাপর কতকগুলি লোক সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াছিল, পরিশেষে বালমুকুন তাহাদিগের দ্বারা ধৃত হইয়াছে। বালমুকুন যে কে, তাহা এ পর্য্যন্ত সবিশেষরূপে স্থিরীকৃত হয় নাই। পুলিস সবিশেষরূপ যত্নসহকারে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছেন। কেহ কেহ বলিতেছেন, বালমুকুন অপর আর কেহই নহে; বোধ হয়, মধ্য-প্রদেশীয় সেই ভয়ানক দস্যু “হীরালাল।” যাহা হউক, এ বিষয়ের সমস্ত রহস্য বাহির হইয়া পড়িলে, ইহার আনুপূর্ব্বিক সংবাদ আমরা পাঠকগণকে প্রদান করিতে চেষ্টা করিব।”

 সংবাদ-পত্রখানি পাঠ করা সমাপ্ত হইলে আমি মাণিকচাঁদকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেমন মাণিকচাঁদ! তোমার এখন আর কোন কথা জিজ্ঞাস্য আছে?”

 তখন মাণিকচাঁদ আমার কথার আর কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতে পারিল না; মস্তক নত করিয়া কেবলমাত্র একটী দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিল।

 বালমুকুন্ কহিলেন, “কি মহাশয়! আমি এই হত্যা করিয়াছি? দোহাই মহাশয়! আমি সেই স্থানে গমন করি নাই, এই কলিকাতা আমি পরিত্যাগ করি নাই। সেই ফারমে আমার কর্ম্ম হইয়াছিল সত্য; কিন্তু সেই কর্ম্ম আমি পরিত্যাগ করিয়াছি। যখন আমি সেই স্থানে গমন করি নাই, তখন সেই চুরি ও হত্যা আমার দ্বারা সম্পন্ন হইবে কি প্রকারে?”

 আমি। বালমুকুন‍্! ইহাতে তোমার ভীত হইবার কোন কারণ নাই। যে ব্যক্তি তোমার নাম গ্রহণ করিয়া, সেই স্থানে কর্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, তাহার প্রকৃত নাম বোধ হইতেছে “হীরালাল।” মাণিকচাঁদ এখন সমস্ত কথা পরিষ্কার করিয়া আমাদিগকে বলিবে, এবং তাহারই বা প্রকৃত নাম কি, তাহাও বোধ হয়, এখন আর সে গোপন করিবে না।

 আমার কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদ কহিল, “মিথ্যা আপনি আমাকে লইয়া পীড়াপীড়ি করিতেছেন। হীরালাল যে কে, তাহা আমি জানি না, বা এই সংবাদ-পত্রে বর্ণিত চুরি বা হত্যার বিষয় আমি কিছুমাত্র অবগত নহি।”

 “অবগত আছ কি না, তাহা পরে জানিতে পারিবে।” এই বলিয়া আমি সেই গৃহের দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দিলাম, এবং মাণিকচাঁদ ও দ্বারবানকে লইয়া আমি আমার থানায় গমন করিলাম। থানা হইতে একটী পাহারার বন্দোবস্ত করিয়া পাঠাইয়া দিলাম। যে পর্য্যন্ত সমস্ত গোলযোগ মিটিয়া না গেল, সেই পর্য্যন্ত সেই গৃহের উপর পাহারা রহিল।

 থানায় গিয়া মাণিকচাঁদ ও সেই দ্বারবানকে আবদ্ধ অবস্থায় রাখিলাম, এবং সমস্ত বিষয় সবিশেষরূপে বিবৃত করিয়া বোম্বাইপুলিসের নিকট একখানি জরুরি টেলিগ্রাম পাঠাইয়া দিলাম। পরদিবস সেই টেলিগ্রামের উত্তর আসিল; তাহার সারমর্ম্ম এইরূপ:—

 “আপনার টেলিগ্রাম পাইয়াছি। যে বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমরা এখানে অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, এবং কিরূপ উপায়ে হীরালাল বালমুকুন্ পরিচয়ে এই স্থানে কর্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হয়, তাহার কিছুই এ পর্যন্ত ঠিক করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। আপনা-কর্ত্তৃক তাহার সমস্তই প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে, এবং আপনি হীরালালের সহায়তা-কারীগণকে ধৃত করিয়া আমাদিগের যে কি উপকার করিয়াছেন, তাহা বলিতে পারি না। আপনি তাহাদিগকে যেন কোনরূপেই ছাড়িয়া দিবেন না। আমরা আপনার নিকট গমন করিতেছি, সাক্ষাৎ হইলে সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিবেন। আমরা অদ্যই মেল ট্রেণে রওনা হইব।”

 এই সংবাদ পাইয়া মনে মনে অতিশয় আনন্দিত হইলাম। কেবলমাত্র সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া যে কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলাম, দেখিলাম, তাহার সুফলই ফলিয়াছে।

 সময় মত দুইজন পুলিস-কর্ম্মচারী বোম্বাই হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা সেই চোর ও হত্যাকারী হীরালালকেও তাঁহাদিগের সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় আনিলেন। হীরালাল প্রথমতঃ কোন কথাই বলিয়াছিল না; কিন্তু কলিকাতায় আসিয়া মাণিকচাঁদ ও দ্বারবানকে বন্ধনাবস্থায় দেখিতে পাইবার পরই সমস্ত কথা স্বীকার করিল। সে যাহা কহিল, বোম্বাই-পুলিস-কর্মচারীদ্বয় তাহা লিখিয়া লইলেন। উহা আমার লিখিবার প্রয়োজন না থাকিলেও, আমার অভ্যাসের দোষে আমি তাহা লিখিয়া লইলাম। হীরালাল যাহা বলিয়াছিল, তাহার সারমর্ম্ম এইরূপ:—

 “আমার নাম হীরালাল। আমার জন্মস্থান মধ্য ভারতে; কিন্তু আমার থাকিবার নির্দিষ্ট কোন স্থান নাই। ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান সহরমাত্রেই আমার একটী না একটী আড্ডা আছে। যখন যে স্থানে গমন করি, তখন সেই স্থানেই দুই চারিদিবস অতিবাহিত করিয়া থাকি। আমি বাল্যকালেই আমাদিগের ভাষায় একরূপ শিক্ষিত হইয়াছিলাম, এবং সকল প্রকার কর্ম্মকার্য্যই আমি করিতে জানি। কিন্তু চুরি ভিন্ন কখনও অপর কোন কার্য্য করি নাই। চুরি করিয়াই এতকাল কাটাইয়া আসিয়াছি, ও অনেকবার ধরা পড়িয়া জেলেও গিয়াছি সত্য; কিন্তু কখনও কোন গরিবের দ্রব্য অপহরণ করি নাই, বা অল্প মূল্যের দ্রব্যে কথনও হস্তার্পণ করি নাই। যখন যে স্থানে যে কার্য্যে হস্তার্পণ করিয়াছি, তখন সেই কার্য্যে দশ বিশ হাজারের কম লইয়া সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করি নাই; কিন্তু একটীমাত্র পয়সাও কখনও রাখিতে পারি নাই। যেরূপ ভাবে আয় করিয়াছি, ব্যয় করিয়াছিও সেইরূপে।

 “বোম্বাইয়ের যে মহাজনের গদিতে আমি চুরি করিয়া ধৃত হইয়াছি, অনেকদিবস হইতে সেই গদিতে চুরি করিবার আমার নিতান্ত ইচ্ছা ছিল; কিন্তু এ পর্য্যন্ত কোনরূপেই সুযোগ করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। কিরূপ অবস্থায় ও কোথায় যে উঁহার ধনভাণ্ডার স্থাপিত, তাহা এ পর্যন্ত জানিতে পারিয়াছিলাম না বলিয়াই, এতদিবস আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারি নাই। যে সময় উঁহার গদিতে একজন গোমস্তার প্রয়োজন হইল, সেই সময় আমি অন্তরালে থাকিয়া, যাহাকে আপনারা এখন মাণিকাচাঁদ বলিয়া জানিতে পারিয়াছেন, তাহাকে সেই কার্য্যে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত অনেকরূপ চেষ্টা করিয়াছিলাম; কিন্তু কোনরূপেই কৃত-কার্য্য হইতে পারি নাই। লাভের মধ্যে মাণিকচাঁদ সেই স্থানে দুই চারিবার যাতায়াত করাতে তাঁহারা উহাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন। নতুবা আমি নিজে প্রকাশ্যরূপে এই কার্য্যে কখনই থাকিতাম না। মাণিকচাঁদ যে কার্য্য করিয়াছিল, আমি তাহাই করিতাম, আমার কার্য্য মাণিকচাঁদের দ্বারা সম্পন্ন হইত।

 “যখন মাণিকচাঁদকে কোনরূপেই সেই কার্য্যে নিযুক্ত করাইতে পারিলাম না, তখন সেই কার্ষ্যে যে নিযুক্ত হইতেছে, তাহারই অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম, এবং পরিশেষে জানিতে পারিলাম যে, কলিকাতা হইতে বালমুকুন্ নামক এক ব্যক্তি সেই কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছেন, ও শীঘ্রই তিনি কলিকাতা হইতে আগমন করিয়া সেই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবেন। কর্ম্মচারী হইয়া উহাদিগের কার্য্যের মধ্যে প্রবেশ করিতে না পারিলে, কোন্ স্থানে উঁহাদিগের অর্থাদি রক্ষিত হয়, তাহা জানিতে পারিবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই দেখিয়া, সেই দিবসেই মাণিকচাঁদকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলাম। কলিকাতায় আসিয়া তাহার প্রধান কার্য্য এই হইল যে, যেরূপ উপায়েই হউক, বালমুকুনের সন্ধান করিয়া তাহাকে হস্তগত করিতে হইবে, এবং যাহাতে বালমুকুন সেই কার্য্যে নিযুক্ত হইতে না পারে, বিধিমতে তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। অথচ এদিকে যে পর্য্যন্ত আমি আপন কার্য্য উদ্ধার করিয়া না লইতে পারি, সেই পর্য্যন্ত বালমুকুনকে আপন হস্তে রাখিয়া যাহাতে সে বোম্বাই সহরে না আসিতে পারে, তাহার বন্ধোবস্তও করিতে হইবে। মাণিকচাঁদকে এইরূপ উপদেশ দিয়া, তাহাকে দ্রুতগতি কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলাম। মাণিকচাঁদ বড় বুদ্ধিমান্ ও সবিশেষ কৌশলী। তিনি কলিকাতায় আসিয়া অনায়াসেই বালমুকুনকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিলেন, এবং তাঁহাকে অধিক বেতন প্রদানপূর্ব্বক প্রলোভিত করিয়া যে কার্য্যে তিনি নিযুক্ত হইয়াছিলেন, সেই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতে তাঁহাকে স্থগিত করিলেন। তিনি সেই কার্য্য পরিত্যাগ করিতেছেন, এই মর্ম্মে একখানি পত্র তাঁহার নিকট হইতে লিখাইয়া লইয়া মাণিকচাঁদ সেই ফারমে পাঠাইয়া দিবার ভানে কোনরূপে হস্তগত করিয়া পরিশেষে উহা আমার নিকট প্রেরণ করিলেন। যে টেলিগ্রামে বালমুকুন্ তাঁহার কার্য্যে নিয়োজিত হইবার আদেশ পাইয়াছিলেন, সেই টেলিগ্রাম খানি পর্য্যন্ত হস্তগত করিয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দিলেন, এবং কোন না কোন কৌশল অবলম্বন করিয়া বালমুকুন যাহাতে বোম্বাই সহরে আসিয়া উপস্থিত হইতে না পারেন, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এদিকে আমি সেই টেলিগ্রাম দেখাইয়া, আমাকে বালমুকুন নামে পরিচয় দিয়া, অনায়াসেই সেই কার্য্যে নিযুক্ত হইয়া সবিশেষ মনোযোগের সহিত নির্দ্দিষ্ট কার্য্য করিতে লাগিলাম। এইরূপে ক্রমে দশ বারদিবস অতিবাহিত হইতে না হইতেই যে যে স্থানে অর্থাদি বা বহুমূল্য অলঙ্কারাদি রক্ষিত থাকে, তাহা জানিতে পারিলাম, এবং সুযোগ মত ক্রমে ক্রমে সেই সকল স্থান যে সকল তালা দ্বারা আবদ্ধ ছিল, তাহার চাবি প্রস্তুত করাইয়া লইলাম। আমার ইচ্ছা ছিল, সুযোগমত একদিবস রাত্রিতে চাবি খুলিয়া সমস্ত অর্থাদি অপহরণ করিব, এবং পূর্ব্বের ন্যায় তালাবদ্ধ করিয়া দিয়া সেই স্থানেই কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত থাকিব। চুরির বিষয় প্রকাশ হইয়া পড়িলে, এবং পুলিসের অনুসন্ধান ক্রমে শেষ হইয়া গেলে, চাকরী পরিত্যাগ করিয়া আপন ইচ্ছানুযায়ী স্থানে গমন করিব ও সেই স্থানে সেই সকল অর্থ ব্যয় করিয়া কিছুদিবস বাবুগিরি করিয়া কাটাইব। আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, ঈশ্বর কিন্তু তাহা হইতে দিলেন না। চুরি করিয়া বহির্গত হইবার কালীনই সমস্ত অপহৃত দ্রব্যের সহিত ধৃত হইলাম, এবং পরিশেষে আত্মরক্ষা করিবার মানসে নরহত্যা পর্য্যন্ত করিতেও কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হইলাম না। এখন আমার অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা হইবেই হইবে। তাহার নিমিত্ত আমি কিছুমাত্র দুঃখিত নহি, বা আমার প্রধান সঙ্গী, যিনি এখন আপনাদিগের নিকট মাণিকাচাঁদ নামে পরিচিত, তাঁহার নিমিত্তও আমি দুঃখিত নহি। কারণ, আমরা উভয়ে পরামর্শ করিয়া যেরূপ কার্য্যে হস্তার্পণ করিয়াছি, তাহার ফল ভোগ করাই আমাদিগের কর্ত্তব্য। কিন্তু এই দ্বারবানের নিমিত্ত আমি আন্তরিক দুঃখিত। কারণ, এ ব্যক্তি আমাদিগের সহিত কখনও কোন অসৎ কার্য্যে প্রবৃত্ত হয় নাই, বা এ আমাদিগের নিকট পরিচিতও নহে। সামান্য অর্থের লোভে যে এইবার এই ব্যক্তি মাণিকচাঁদকে কিছু সাহায্য করিয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু সে যে ইহার ভিতরের বিষয় অবগত আছে, তাহা আমার বোধ হয় না।”

 দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “মহাশয়! আমি পূর্ব্ব হইতে মাণিকচাঁদকে বা এখন যিনি বোম্বাই সহর হইত ধৃত হইয়া আসিয়াছেন, উঁহাদিগের কাহাকেও চিনিতাম না। মধ্যভারতে বা বোম্বাই সহরে আমি কখনও গমন করি নাই। আমার বাসস্থান আরা জেলার অন্তর্গত কোন একখানি ক্ষুদ্র পল্লীতে। আমি কয়েকবার আরায় গিয়াছিলাম, এবং পরিশেষে পেটের দায়ে কলিকাতায় আসিয়াছি। এই দুইটী স্থান ব্যতীত অপর কোন সহরে আমি আর গমন করি নাই। মাণিকচাঁদের সহিত এই কলিকাতা সহরেই আমার প্রথম পরিচয় হয়। তিনি আট টাকা বেতনে আমাকে চাকুরী প্রদান করেন, এবং আমাকে এক মাসের বেতনও অগ্রিম দেন। তিনি যে জুয়াচোর, তাহা আমি জানিতাম না। আমাকে যখন যেরূপ কার্য্য করিতে তিনি আদেশ প্রদান করিতেন, আমি সেই আদেশ-অনুযায়ী সমস্ত কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া যাহাতে আপন মনিবকে সর্ব্বদা সন্তুষ্ট রাখিতে পারি, কেবল তাহারই চেষ্টা করিতাম। আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।”

 দ্বারবান্ এবং হীরালালের এই কথা শুনিয়া মাণিকাচাঁদও পরিশেষে সমস্ত কথা স্বীকার করিল। বোম্বাইয়ের কর্ম্মচারীদ্বয়, এখানকার আর যে সকল অনুসন্ধান করিবার বাকী ছিল, তাহা সম্পন্ন করিয়া, সেই তিনজনকেই সঙ্গে লইয়া বোম্বাই সহরে প্রস্থান করিলেন।

 সেই স্থানে বিচারে হীরালালের যাবজ্জীবন, এবং মাণিকচাঁদের দশ বৎসরের নিমিত্ত কারাবাসের আজ্ঞা হয়; দ্বারবান পরিত্রাণ পায়। *

সম্পূর্ণ।


* চৈত্র মাসের সংখ্যা,

“চেনা দায়।”

(অর্থাৎ কলিকাতার জুয়াচোরগণকে চেনা ভার!)

যন্ত্রস্থ।