দীর্ঘকেশী/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 উপরিতন কর্ম্মচারীর আদেশ বাহির হইবার পর, দুই তিন ঘণ্টার মধ্যেই শহর ও সহরতলীর সমস্ত লোকই জানিতে পারিল যে, একটী ছিন্নমস্তক কোন এক পুষ্করিণীর ভিতর পাওয়া গিয়াছে। ঐ মস্তকে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ সুদীর্ঘ কেশরাশী বর্ত্তমান। আরও সকলে অবগত হইল যে, যদি কোন গৃহস্থের ঐরূপ দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোক বাড়ীতে অনুপস্থিত থাকে, তাহা হইলে তিনি যেন তৎক্ষণাৎ থানায় সংবাদ প্রেরণ করেন।

 এই সংবাদ যে দিবস প্রচারিত হইল, সেই দিবস কোন স্ত্রীলোকেরই অনুপস্থিতি সংবাদ প্রাপ্ত হইলাম না; কিন্তু পর দিবস এক এক করিয়া তিনটী ও তৎপর দিবস দুইটী নিরুদ্দেশের সংবাদ প্রাপ্ত হইলাম।

 এদিকে ডাক্তার সাহেব স্পিরিট বা অপর কোন দ্রব্য দ্বারা যাহাতে ঐ মস্তকটী কিছু দিবস রক্ষা করিতে পারেন, তাহার সবিশেষ চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 এই পাঁচটী দীর্ঘকেশী স্ত্রীলোকের নিরুদ্দেশের সংবাদ যাহারা প্রদান করিয়াছিল, সর্ব্বপ্রথমে তাহাদিগকে আনাইয়া সেই দীর্ঘ কেশযুক্ত ছিন্ন মস্তক দেখাইলাম, কেহই সবিশেষ চিনিতে পারিল না। উহাদিগের মধ্যে কেহ কহিল, যে স্ত্রীলোকটী পাওয়া যাইতেছে না, তাহার চুল প্রায়ই ঐরূপ ছিল। কেহ কহিল, তাহার চুল অত দীর্ঘ ছিল না। কিন্তু আমাদের এখন প্রধান কার্য্য হইল, ঐ কয়জন স্ত্রীলোক সম্বন্ধে একটু বিশেষ অনুসন্ধান করা, ও যদি সম্ভব হয়, উহাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করা।

 যাহাদিগের স্ত্রী কন্যা বা ভগ্নী দুশ্চরিত্রা হইয়া আপনাপন স্বামী বা পিতা ও ভ্রাতার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া কুলের বাহির হইয়া গিয়াছে, অথচ অনুসন্ধান করিয়া এ পর্য্যন্ত যাহারা তাহাদিগের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারে নাই, এখন তাহারা এই সুযোগ সহজে পরিত্যাগ করিল না। পুলিসের সাহায্যে যাহাতে এখন উহাদিগের অনুসন্ধান হইতে পারে, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিল। যে স্ত্রীলোকের কেশ এক ফুটের অধিক নহে, তাহার কেশ ঐ ছিন্ন মস্তকের কেশের সমান লম্বা বলিয়া কেহ কেহ আমাদের নিকট প্রকাশ করিল। কাজেই আমাদিগকে ঐ সকল স্ত্রীলোকের অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইতে হইল। যে পাঁচটী স্ত্রীলোকের নিরুদ্দেশ-সংবাদ আমরা প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহাদিগের অনুসন্ধানের ভার যে কেবল আমার উপরই ন্যস্ত হইল তাহা নহে, অপরাপর কর্ম্মচারীগণও তাহাদিগের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত নিযুক্ত হইলেন। পূর্ব্বে আমরা যে উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করিয়া দীর্ঘকেশ স্ত্রীলোকের মস্তক প্রাপ্ত হইবার সংবাদ সহর ও সহরতলির ঘরে ঘরে প্রচারিত করিয়াছিলাম, এখন দেখিলাম, আমাদিগের সেই উদ্দেশ্যের বিপরীত ফল ফলিতে আরম্ভ হইয়াছে। পাঁচটী স্ত্রীলোককে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে প্রবৃত্ত হইয়া সেই কার্য্য শেষ হইবার পূর্ব্বেই আরও ত্রিশ, চল্লিশটী ঐরূপ সংবাদ আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন বুঝিলাম, আমাদিগের কার্য্য সিদ্ধ হউক আর না হউক, যাহাদিগের গৃহ হইতে স্ত্রীলোক সকল বাহির হইয়া গিয়াছে, তাহারা তাহাদিগের কার্য্য আমাদিগের দ্বারা সম্পন্ন করাইয়া লইতে প্রস্তুত। আরও বুঝিলাম, যে ব্যক্তি ঐ স্ত্রীলোকটিকে হত্যা করিয়া দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন পূর্ব্বক পুষ্করিণীতে নিক্ষেপ করিয়াছে, সে কখনই ঐ স্ত্রীলোকের নিরুদ্দেশ সংবাদ আমাদিগকে প্রদান করিবে না, আর যদি ঐ স্ত্রীলোকটী কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের হন, তাহা হইলে তিনি সর্ব্ব সাধারণের নিকট কখনই বাহির হইতেন না; সুতরাং সাধারণের নিকট হইতে ঐরূপ স্ত্রীলোকের সন্ধান পাওয়া নিতান্ত সহজ নহে।

 মৃত স্ত্রীলোকের কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যাউক বা না যাউক, অপরাপর স্ত্রীলোকদিগের অনুসন্ধানে যখন হস্তক্ষেপ করা হইয়াছিল, তখন তাহা শেষ করিতেই হইবে। এখন আমরা তাহাদিগকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করার চেষ্টা না করিয়া তাহাদিগের মস্তকের কেশ কিরূপ লম্বা ছিল কেবল তাহারই অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম, ও অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, তাহাদিগের কাহারও মস্তকের কেশ দুই বা আড়াই ফুটের অধিক নহে। তখন বুঝিতে পারিলাম যে, এই অনুসন্ধানে আমাদিগের বিশেষ কোনরূপ ফল লাভ হইবে না, সুতরাং সে অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিলাম।