দুনিয়ার দেনা/দশের দোসর
দশের দোসর
১
সমুদ্রতীরে এক মস্ত বড় শহর। প্রকাণ্ড জঙ্গল কেটে সহরটি পত্তন করা হয়। গোড়ায় কবে যে এর পত্তন হয়েছিল, কেউ তা বলতে পারে না। সে সময়কার কোন খবরই কেউ জানে না। তবে এক কালে এ সহরে যে ভালো ভালো লোকের জন্ম হয়েছিল, উঁচুদরের জ্ঞান এখান থেকে প্রকাশ পেরেছিল, এর বুকের মধ্য থেকে গভীর আনন্দ জেগে উঠেছিল, সমস্ত প্রকৃতি নিজের একটি বড় রকমের সাম্রাজ্য এর বুকে স্থাপন করেছিলেন, ছয় ঋতু পালা করে এখানে আনন্দের সহজ গতিতে নৃত্য ক’রে ফিরত, এ কথা সকলেই স্বীকার করেন।
সেই পুরাণো বুড়ো চমৎকার সহরটির এখন যা দুর্দ্দশা, দেখলে বুক ফেটে চোখে জল আসে, ব্যথায় হৃদয় মুসড়ে পড়ে। সব গেছে। জ্ঞান লুকিয়ে পড়েছে পুঁথির মধ্যে, আনন্দের জায়গা জুড়ে বসেছে ভয় আর কান্না, প্রকৃতি বিকৃত হয়ে প্রতিনিয়ত বিপ্লব বাধিয়ে তুলছেন, ঋতুগুলি ভাঙ্গা পালায় যখন তখন যেখানে সেখানে এলোমেলো পা ফেলছে, গতিতে তাদের জীবন নেই আনন্দ নেই।
সব চেয়ে দুর্দ্দশা হয়েছে সহরের মানুষগুলোর। রোগে মরে, না খেয়ে মরে, ভাঙ্গা বাড়ী মাথায় চাপা প’ড়ে মরে, ঘর নেই যার সে মাঠে দাঁড়িয়ে বর্ষায় ভিজে মরে, রৌদে পুড়ে মরে; আর মরে পাড়া প্রতিবেশীর কিল চড গুঁতোয়। গায়ে নেই জোর যে তাদের ঠেকায়, হাতে নেই অস্ত্র, যে তাদের ভাগায়;
কুঁড়ে গুলোর চালে নেই খড় দেয়ালে নেই মাটির লেপ; ঘরের ভিতরে খালি হাঁড়ি ঠনঠন করছে। পাকা বাড়ী আগাগোড়া ফাটলে ভরা, ফাটল ফুঁড়ে মাথা তুল্ছে মস্ত মস্ত গাছ, তাদের মোটা মোটা শিকড়গুলো মাটি পর্য্যন্ত লম্বা। আর দেয়ালের চারদিক জুড়ে ফাটলের মধ্যে বাসা করেছে চামচিকে, ইঁদুর, আরসোলা, আর মাকড়সা।
সহরের এই রূপটির সঙ্গে অবিকিল খাপ খেয়েছে তার রোগে জীর্ণ না খেয়ে শীর্ণ অধিবাসীগুলি। তাদের মূর্ত্তি দেখলেই মনে হবে মরণ যেন তাদের বুকের উপর খেলা করে বেড়াচ্ছে।
এ হেন পতনোন্মুখ সহর তার মরণোন্মুখ মানুষগুলিকে নিয়ে সমুদ্রতীরে তবু কিন্তু বেঁচে আছে। নিঃশেষে তবু তার মরণ হচ্ছে না, কে জানে কেন?
সমুদ্রের বুকের উপর দিয়ে কত বড় বড় বাণিজ্য জাহাজ রাতদিন আসা যাওয়া করে। যাবার পথে কত দেশের কত লোক, সমুদ্রতীরের এই বুড়ো সহরটা দেখতে দেখতে যায়। দেখে কেউ মুখ ফেরায়, কেউ ঠাট্টার ভাবে হাসে, কেউ গলা ছেড়ে গাল দেয়, “সহরটার এমন ছিরি ছি ছি সহরের লোকগুলো কি মরেছে? একবার চোখ মেলে নিজেদের সহরটার দিকে কেউ চেয়ে দেখে না।
যে যা বলে বলুক, যে যা ভাবে ভাবুক, সহরের লোকেরা এ সব কোন কিছু গায়েই মাখে না, এ সব কোন কথা কানেই তোলে না। অলস হয়ে একই রকমে তারা দিনের পর দিন কাটায়। ভাবে পূর্ব্ববপুরুষ তপের জোরে সহরটাকে কায়েমি করে রেখে গেছেন কোনো কালে এর আর মার নেই। কারো সাধ্য নেই যে সেখান থেকে তাদের তাড়ায়। এমন কি স্বয়ং রাজাও তা পারেন না।
এইটুকু নিয়েই, এর অহঙ্কারেই তারা মত্ত। ওদিকে শকুনি গৃধিনী এসে মৃতদেহগুলোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, সহরে মড়া ফেলার লোক নেই সেদিকে কারো চোখ পড়ে না।
৩
ঝকঝকে পোষাক পরা একদল বণিক, সমুদ্রতীরের এই পুরানো সহরটি দেখবার জন্যে, একদিন যাওয়ার পথে জাহাজ থামিয়ে তীরে নামল।
সামনেই শ্রীনিবাস তার ভাঙ্গা অট্টালিকার বারন্দায় বসে। বণিকেরা জিজ্ঞাসা করলে “তুমি কে হে, তোমার নাম কি, এ বাড়ীখানা কি তোমার?”
শ্রীনিবাস বলে, “আমার নাম শ্রীনিবাস ঠাকুর। অনেক পুরুষ থেকে এ সহরে আমার বাস। প্রায় দুহাজার বছর হল আমার পূর্ব্বপুরুষ এ ভিটাখানা তৈরী করে গেছেন। মশায়, এ আজকের জিনিষ নয়। অতি প্রাচীন, মশায়! অতি প্রাচীন।”
শুনে বণিকেরা হো হো করে হেসে উঠে বল্লে “প্রাচীন তো বুঝলুম হে, কিন্তু প্রাচীনের উপর কি নূতন করে সংস্কার হতে নেই? শুধু কেবল প্রাচীন হয়ে থেকেই চরম সুখ, হাঃ হাঃ হাঃ বল কি হে? ওদিকে প্রাচীন অট্টালিকা যে মাথায় ভেঙ্গে পড়ে, তার কিছু ঠিক আছে? সংস্কার চাই হে, সংস্কার চাই। দেশের রাজা হুকুম করেছেন তাঁর রাজ্যের সব জায়গা এখন নূতন হবে, পুরণো ভাঙ্গা ফাটা একচুল কোথাও থাকতে পারবে না। তোমরা যদি তোমাদের ঘর বাড়ী সহর নূতন করে তৈরী না কর তবে আমরা তোমাদের সহর কেড়ে নিয়ে নূতন করে গড়ে তুলব। মাল মসলা সব আমরাই দেব, সহরটা তাহলে আমাদেরই হয়ে যাবে।”
শ্রীনিবাস বল্লে “আমাদের পূর্ব্বপুরুষ স্বয়ং রাজার হাত থেকে এ সহর কিনে ছিলেন, এবং এমনতর মাল মসলা দিয়ে সহরটা গড়েছিলেন যে, তোমাদের মাল মসলা তার সঙ্গে মিশ খাবে না, একটাও বাড়ী জোড় খাবে না হে, তোমাদের মসলায় একটাও বাড়ী জোড় খাবে না”।
বণিকেরা বল্ল, “জোড় না খায়, প্রাচীন সব ভেঙ্গে ফেলে আগাগোড়া আমরা নূতন করে গড়ব।”
শ্রীনিবাস বল্লে, “পারবে না হে, পারবে না। একেবারে এ সহর ভেঙ্গে ফেল্তে পারবে না। এ সহর আগুন দিয়ে গাঁথা, জল দিয়ে বাঁধা, বাতাস দিয়ে ছাপা, আকাশ দিয়ে মাপা। এ ভাঙ্গবার নয়! ফাটবে চটবে, কিন্তু একেবারে ভাঙ্গবে না হে, একেবারে ভাঙ্গবে না। হাজার তোমরা জোর দেখাও, তাড়াতে আমাদের পারছ না।”
বণিকেরা বল্ল, “ভাঙ্গা ফাটা কিছু তো আর দেশে রাজা রাখবেন না, হুকুম করেছেন পৃথিবী তাঁর নূতন হবে। সংস্কার না কর, রাজা নিজেই সহর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দেবেন, তখন কি করবে?”
শ্রীনিবাস বলল, “বছর বছর রাজার খাজনা আমরা গুণে দিচ্ছি, রাজা আমাদের তাড়াবেন কোন্ আইনের জোরে?”
পথের ধারে কোথায় রাজপেয়াদা বসে ছিল। কথাটি শ্রীনিবাসের মুখ থেকে বের হওয়া মাত্র সে রুখে তার সামনে এসে বল্লে, “কি বলছ ঠাকুর, বছর বছর রাজার খাজনা তোমরা গুণে দিচ্ছ? দেখ তো, তোমার দলিল খানা বের ক’রে কত বছর খাজনা দাও নি।”
খাজনা যে অনেক কাল দেওয়াই হয় নি, একথা শ্রীনিবাসের মনেই ছিল না। সে জোর দেখিয়ে দলিল আনতে ঘরে গিয়ে ঢুকল, রাস্তায় পেয়াদা আর বণিকেরা দাঁড়িয়ে রইল।
দলিলের বাক্স মাকড়সার জালে ঢাকা, কতকাল সে বাক্স খোলাই হয়নি। ভয়ে শ্রীনিবাসের বুকটা ধড়াস বড়াস করতে লাগল, দেখা গেল তিনশো বছরের খাজনা বাকি। ভিটাখানা কবে বাকি খাজনার দরুন রাজসরকার ভুক্ত হয়ে গেছে, তার ঠিকানাই নেই।
শ্রীনিবাসের বড় দরদ ঐ ভিটাখানার উপর। ভিটায় আর দখল নেই জেনে চোখ দিয়ে তার দরদর ধারায় জল পড়তে লাগল। বল্লে, “পেয়াদা, তবেত রাজা এখন সহরটা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবেন, আর তো আমাদের জোর নেই, দাবী নেই, আমরা তো বহু বছর খাজনা দিই নি, সহর তো আমদের অনেক কাল সরকারভুক্ত হয়ে গেছে। এখন আমরা দাঁড়াই কোথা”? রাজপেয়াদা বল্লে, “সহর এখন রাজার, দাও ছেড়ে তাঁর হাতে সহরের ভার। রাজা আসছেন, তোমাদের সঙ্গে নিয়ে এ সহর তিনি নিজেই গড়ে তুলবেন। তাঁর আসার খবর দিতে ও তোমাদের দিয়ে কাজ শুরু করিয়ে দিতেই আমাকে আগে পাঠিয়েছেন। এই নাও মাল মসলা, শুরু করে দাও কাজ, ঠাকুর এখুনি সব বদলাতে শুরু করে দাও। ভিটে সহর সব নতুন করে তুলতে হবে, আগাগোড়া নতুন। প্রাচীনকে যে নিত্যি নতুন করে তোলা চাই, তাকি জান না? স্বয়ং ভগবানই যে নিত্য নূতন হয়ে দেখা দেন, রূপটা তো বদলান চাই ঠাকুর।
শ্রীনিবাস অবাক্ হয়ে রাজপেয়াদার মুখের দিকে চেয়ে রইল ও ব্যাকুল দৃষ্টিতে তার হাতের রাজদত্ত মাল মসলাগুলির দিকে বার বার চেয়ে দেখতে লাগল।
পেয়াদা বল্লে “অন্য সব সহর, রাজ্য, রাজা আর পাঁচ জনকে ভাগ করে দিয়েছেন কেবল এই সহরটি রেখেচেন নিজের জন্য, এখানে রাজার নামেই সব কাজ হবে, অন্য কারো নামে এখানকার কোন কাজ হতে পারবে না।”
রাজপেয়াদার কথা শুনে শ্রীনিবাস দৌড়ে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করে বলে উঠল, “নিন রাজা নিন, সব নিন্, আসুন তিনি এ রাজ্যে, তাঁর রাজ্য তিনি করুন, আমরা তাঁর চিরদাস হয়ে কেবল তাঁর কাজে জীবন ধারণ করে থাকি।”
এই বলে শ্রীনিবাস দুই হাত তুলে উচ্চৈঃস্বরে রাজার নামে জয়ধ্বনি করতে লাগল।
এদিকে রাজ্যময় সাড়া পড়ে গেল রাজা আসছেন, রাজা আসছেন। পথে ঘাটে লোক ধরে না, সবাই কাজে ব্যস্ত, ভাঙ্গা-চোরা মেরামত, অপরিষ্কার জায়গা পরিষ্কার করা, চামচিকা বাদুড় ব্যাঙ তাড়ান, মাটির দেয়াল নিকানো, পাকা দেয়ালের ফাটাল বোজান, পুরণো বাসনপত্র মাজা-ঘসার ধূম পড়ে গেল সহরময়। রাজা আসছেন।
সকলেই কাজে মহা ব্যস্ত, এমন সময় সাদা ঘোড়ায় চড়ে রাজা এসে উপস্থিত। রাজার মুখের সোণার আলোয় দিক্ ভরে উঠল, বাতাস সুগন্ধে ভরে গেল, চারিদিকে আনন্দ কোলাহল উঠল।
রাজা ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। পরণে তাঁর সাধারণ বেশ। রাজাকে দেখার জন্যে পথে লোকের কি ভীড়, রাস্তায় চলা ভার। ভীড় ঠেলে একটি ছোট মেয়ে এগিয়ে রাজার হাত ধরে রাজাকে বল্লে, “তুমিই কি রাজা, তুমিত আমাদেরই মত মানুষ, তবে তোমাকে লোকে মানুষ না বলে রাজা বলে কেন?” রাজা বল্লেন, “সেটা লোকের ভুল, আমি রাজা নই, আমি সত্যিকার মানুষ।” মেয়েটি বল্ল, “বাঃ! তবে তুমি আমাদের সঙ্গে না থেকে আলাদা থাক কেন?” রাজা বল্লেন, “লোকে আমাকে রাজা খেতাব দিয়ে ঠেলে আলাদা করে রেখেছে, কাছে আসতে দেয় না,—সেই তো আমার দুঃখু।”
মেয়েটি বল্ল, “তাই বুঝি তুমি আমাদের কাছে এসেছ আমাদের মধ্যে থাকবে বলে; তাই বুঝি ঘোড়া থেকে নামলে আমাদের সঙ্গে হাঁটবে বলে? বাঃ! কি মজা! রাজা আর আমরা এক হয়েছি, কি মজা!”
রাজা বল্লেন “আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘোড়াব পিঠে চড়ে চলতে, আর রাতদিন একলা থেকে কেবল বিশ্রাম করতে। তোমাদের মাঝে এসে পড়ে আজ আমি বাঁচলুম, রাজা হওয়ার দুঃখু থেকে নিষ্কৃতি পেলুম, এখন আমি তোমাদের দশেরই একজন।
মেয়েটি বল্ল, তুমি যদি রাজা নও, এ সহর তবে কার?
রাজা বলেন, “দশের”।