দুনিয়ার দেনা/দুনিয়ার দেনা
দুনিয়ার দেনা
১
গাঁয়ের রাস্তা ধরে একটি প্রবীণ গোছের ভদ্রলোক চলেছেন; হাতে ছোট্ট একটি চামড়ার ব্যাগ, পরণে থানের ধুতি, গায়ে ফর্সা পাঞ্জাবী, কাঁধের উপর মট্কার চাদর একখানা ভাঁজ করে ফেলা, পায়ে সাধারণ দিশি জুতো, মাথায় একটা অল্প দামের ছাতা।
ভদ্রলোক ছাতাটি মাথায় দিয়ে ডান হাতে ছাতার বাঁটটি ধরে বাঁ হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাচ্ছেন।
দেখলেই মানুষটির উপর শ্রদ্ধা জন্মায়, দিব্যি সুন্দর, শান্ত, সৌম্য চেহারা, বয়স আন্দাজ ষাট বাষট্টি।
কাছেই স্টেশন। বোধ হল, তিনি ষ্টেশনে নেমে রাস্তা ধরেছেন। পথ দিয়ে একলাই চলেছেন, সঙ্গে কোন লোক নেই।
সরু লালমাটির রাস্তা এঁকে বেঁকে গাঁয়ের ভিতর পর্য্যন্ত চলে গেছে। যতদূর চোখ যায়, একপাশে বরাবর পানের ক্ষেত, আর একপাশে অনেকখানি পতিত জমি মাঝে ঐ সরু পথটি। কিছুদূর এগোতেই বাবুটি দেখতে গেলেন, একজন গেঁয়ো লোক মাথায় একটা বোচকা নিয়ে সেই পথ ধরে চলেছে। খালি গা, মোটা একখানা ধুতি পরা, পায়ে ভারি গোছের একজোড়া চটি, কাঁধে গামছা ফেলা, হৃষ্ট পুষ্ট, বলিষ্ঠ লোকটি নিজের মনেই এগিয়ে যাচ্ছে কোন দিকে দৃষ্টি নেই।
বাবুটি কাছাকাছি হতেই সে একটু থমকে দাঁড়াল। তাকে থামতে দেখে বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কতদূর যাবে হে?
সে বল্ল, এই গাঁটা ছাড়িয়ে বাবু, আপনি কদ্দুর যাবেন?
বা। এই গাঁয়েরই কেবলরাম সর্দ্দারের বাড়ী।
লো। ওঃ! আপনি বুঝি গাঁয়ের জমিদার পুরন্দর চক্রবর্ত্তী! প্রণাম হই, প্রণাম হই! কিছু মনে করবেন না মশায়—আগেই প্রণাম করা উচিত ছিল।
বা। তুমি আমায় জানলে কেমন করে?
লো। আপনার নাম না জানে কে? চোখেই আপনাকে দেখিনি নামতো শুনেছি।
বা। চিনলে কেমন করে?
লো। কেবল সর্দ্দারের বাড়ী যাবেন শুনে, আর ঐ চেহারা দেখে, চেহারাটা কি একেবারেই ঢাকা থাকে মশায়!
তিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বল্লেন, তোমার ঐ সদানন্দ মূর্ত্তিখানিও তো চমৎকার, নামটি শুন্তে পাই কি?
লো। আমার নাম সনাতন মুদি।
বা। বাড়ী কোথা?
লো। এই গাঁ খানা পেরিয়ে সামনের গাঁয়ে।
বা। গাঁয়ের জমিদার কে?
লো। হরশঙ্কর দে।
বা। গাঁ খানার অবস্থা কেমন?
লো। আর বলবেন না মশায় দুঃখের একশেষ, দুঃখের একশেষ।
বা। কিসের কষ্ট?
লো। জমিদার গাঁ খানার দিকে একবার ফিরে ও তাকায় না। প্রজারা রোগে ভুগে, না খেয়ে, পচা পুকুরে নেয়ে, দুবেলা জোড়া জোড়া মরছে, রাস্তার দুর্গন্ধে পথ চলা ভার। জল কষ্ট, অন্নকষ্ট কোন কষ্টের আর বাকি নেই।
বা। জমিদার মশায়কে জানান উচিত।
লো। জানাব কি, তিনি কি কখনো গাঁয়ে আসেন একি আপনি যে প্রজাদের ঘরে ঘরে ঘুরে দেখবেন কার কি কষ্ট কার কি অভাব, না আপনার মত গাঁয়ে স্কুল বসাবেন, কত গেঁয়ো চাষার ছেলে লেখা পড়া শিখে মানুষ হয়ে গেল আপনার কৃপায়। তাদের গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, ঘরে ঘরে মরাই বাঁধা, তার উপর তারা ডাক্তারী শিখছে, আইন পড়ছে— এটি রাম রাজ্য আপনার এটি রাম রাজ্য। কতলোক আমাকে বলে এ গাঁ ছেড়ে তুই পুরন্দর বাবুর গাঁয়ে গিয়ে বাস কর, সে কিন্তু আমি পারি না মশায় যে গাঁয়ে জন্মেছি সে গাঁ ছাড়তে পারিনে। মরতে হয় তো গাঁ শুদ্ধ সবাই মরব, বাঁচিতো সকলেই বাঁচব। একলা বাঁচতে চাইনা মশায় নইলে কবে আপনার জমিতে এসে ঘর বাঁধতুম।
জন্মস্থানের উপর সনাতনের টান দেখে জমিদার বাবু অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও একটু আশ্চর্য্য হয়ে বলে উঠলেন, “নমস্কার, সনাতন নমস্কার! তোমাকে পেয়ে তোমার জন্মস্থান ধন্য হয়েছে দেখছি।”
স। “ধন্য টন্য জানিনে মশায়, ছাড়তে পারিনে এই সোজা কথা। দেনা মশায় দেনা, বেজায় দেনা, গাঁয়ের কাছে আমার বেজায় দেনা ছাড়ি কেমন করে? বাবুটি ভাবলেন, মুদির বুঝি ঢের দেনা আছে, তাই তার গাঁ ছেড়ে আসা সম্ভব হয় না। তিনি বল্লেন, ‘কত দেনা হে চুকিয়ে দিলে আসতে পারত চুকিয়ে দেওয়া যায়।
মু। সে অনেক দেনা, বাবু, অনেক দেনা। সে চুকোবার নয়, শেষ হবার নয়। সে মায়ের দেনা, গাঁয়ের দেনা, দাইয়ের দেনা, গাইয়ের দেনা, ঘরের দেনা, বাইরের দেনা, জলের দেনা, মাটির দেনা, ছেলের দেনা, বুড়োর দেনা গাঁ শুদ্ধ লোকের দেনা হাওয়াটার পর্য্যন্ত দেনা, চাওয়াটার পর্য্যন্ত দেনা। এত দেনা কে চোকাবে? অসম্ভব অসম্ভব!
শেষের এই কথা গুলো শুনে জমিদার বাবুর কেমন কেমন ঠেকতে লাগল। একবার মনে হল লোকটা পাগল নয়ত এসব কি বলে? আবার মনে হল এসব কথার কোন গভীর অর্থ নেইত?—বোঝা শক্ত।
পথ ফুরিয়ে এল, সামনেই কেবল সর্দ্দারের বাড়ী। বাবুকে প্রণাম করে বিদায় নিয়ে নিজের মনে বক্তে বক্তে মুদি চলে গেল; পুরন্দর চক্রবর্ত্তী একটা পাড়ার মধ্যে গিয়ে ঢুকলেন।
পাড়াটা চাষাদের বেশী ভাগ লোকই চাষী। কয়েক ঘর তেলি মালি কুমর কামার কৈবর্ত্ত যারা আছে তারা নিজের নিজের জাত ব্যবসা করে থাকে।
পুরন্দর চক্রবর্ত্তীর বাপ আশুতোষ চক্রবর্ত্তী এই জমিদারী খানা কেনেন। তাঁর সময়ে ও তিনি এর যথেষ্ট উন্নতি করে গেছেন কিন্তু তাঁর ছেলে পুরুন্দর যেমন সব ছেড়ে এই নিয়েই রয়েছেন এমনটা পূর্ব্ব কখনো হয়নি। এখন এর এতটা উন্নতি হয়েছে যে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পুরন্দরের বাপ একালের সকল শিক্ষাই ছেলেকে দিয়েছেন। পুরন্দর হাইকোর্টের উকিল আবার মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষা পাস করা ডাক্তার কবিরাজীও কিছু কিছু জানেন। কিন্তু এসব ব্যবসার দিকে না গিয়ে জমিদারীর উন্নতি নিয়েই তিনি পড়ে আছেন। একখানি চিকিৎসার ও একখানি আইনের ছোট বই ছাপিয়ে গাঁয়ের ছেলে মেয়েদের স্কুলে পড়ানর ব্যবস্থা করেছেন যাতে এ বিষয়ে তারা অজ্ঞ না থাকে। নিজে সম্পূর্ণ একেলে হয়ে ও সেকালটিকে পুরন্দর ষোল আনা নিজের মধ্যে বজায় রেখেছেন। বেশভূষা চাল চলন দেখে তিনি সহুরে কি পাড়াগেঁয়ে বোঝা দায়। চার পুরুষ তাঁদের সহরে বাস গেঁয়ো আনাড়ী ভাব তাঁরা অনেক দিন ছাড়িয়ে গেছেন আবার সৌখিন সহুরে চাল চলনও ঢের মন্থন করে এসেছেন কোন দিকে তাঁর কমতি নেই; এখন তিনি এ দুয়ের উপর। গাঁয়ের লোক তাঁকে বাবা ঠাকুর বলে ডাকে।
ঝকঝকে তকতকে মেজেটা পাকা করে বাঁধানো, খোড়ো চালের একখানা বড় গোছের মাটির বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, দরজার বাইরে থেকে, পুরন্দর চক্রবর্ত্তী হাঁকলেন, কেবলরাম!
সাড়া পেয়ে আধাবয়সী চাষী কেবলরাম হরিণ চামড়ার একখানা আসন হাতে করে, ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কেবলরামের বয়স চল্লিশ বেয়াল্লিশ হবে, বেশ সুশ্রী সুন্দর চেহারা। রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, লম্বা, দোহারা গড়ন চাল চলন অত্যন্ত ভদ্র, নম্র ও শিষ্টাচার যুক্ত। একে দেখ্লে আর বলবার যো নেই যে, “গেঁয়ো চাষা ভুত।” বাড়ীতে তার গাইগরু দশটা, বাছুরও অনেকগুলো, বলদ তিন জোড়া। পঞ্চাশ বিঘে জমিতে চাষ। বাড়ীর লোক অভাব কাকে বলে জানে না।
ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে আসন খানা পাততে পাততে কেবলরাম বল্লে, “বাবা ঠাকুর, বসুন।” পুরন্দর বল্লেন, “না হে, এখন বস্বো না, আগে ঘুরে আসা যাক্, কাজ সারা হোক্ আগে।”
কেবলরাম তখন আসন খানা তুলে রেখে, হাতে একটা মোটা লাঠি নিয়ে, বেরলো। আগে পুরন্দর চক্রবর্ত্তী, পিছু কেবলসর্দ্দার।
পথে যেতে যেতে, পুরন্দর জিজ্ঞসা করলেন, “কেবলরাম সনাতন মুদিকে চেন হে?”
কে। তাকে আবার চিনিনে।” তাকে না চেনে কে? পাঁচখানা গাঁয়ের লোক সবাই তাকে চেনে। সে এক পাগল বাবা ঠাকুর! সকাল থেকে রাত পর্য্যন্ত বক্ছে ‘দেনা মশায় দেনা, আমার বেজায় দেনা, বেজায় দেনা।’ এ ছাড়া তার মুখে আর কথা নেই, সকল কথার শেষে এই কথাটা বল্বেই। আর নিজের মনেও অনেক সময় একলা একলাই বক্ছে দেখা যায় ‘দেনা মশায় দেনা, আমার বেজায় দেনা, মশায়, আমার বেজায় দেনা।’
পুরন্দর। লোকটা করে কি?
কে। মস্ত বড় একখানা মুদির দোকান আছে, তাই চালায়। দোকানখানা তিন পুরুষের, এবং তিন পুরুষ ধরে এই মুদির ব্যবসা করে আসছে।
পু। ওর কি কিছু দেনা আছে? হয়ত দেনার দায়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তাই দিনরাত ঐ রকম বকে বেড়ায়! খবর নেওয়া দরকার হে।
কে। না বাবা ঠাকুর, মোটেই তা নয়, ওর বাপ দাদা ব্যবসা করে ঢের সম্পত্তি করে রেখে গেছে কিছুরই অভাব নেই, ওটা ওর পাগলামী, ঐ রকম বকা ওর বাতিক। সনাতনের নিজের মা নেই’ দাই মা তাকে মানুষ করেছে। দাই মা বলে, ওর বয়েস যখন ষোল বছর, তখন এক সন্ন্যাসীর পাল্লায় পড়ে, ওর এই রকম মাথা খারাপ হয়ে যায়। বছর খানেক সন্নাসীর পিছু পিছু ঘুরে, যখন বাড়ী ফিরল, তখন দেখা গেল আপনার মনে দিনরাত বক্ছে “দেনা মশায় দেনা, বেজায় দেনা, মায়ের দেনা গাঁয়ের দেনা, দাইয়ের দেনা, গাইয়ের দেনা, ছেলের দেনা বুড়োর দেনা ইত্যাদি কত কি বকে। আপনি তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা কইলেই বুঝতে পারবেন, ব্যাপারটা কি!
পু। আমি তার সঙ্গে কথা কয়েছি।
কে। কোথায়?
পু। আজ, রাস্তায়।
কে। কেমন বুঝলেন?
পু। তোমরা যতটা পাগল তাকে ভাবছ, ততটা নয়।
কে। কিন্তু ঐ রকম বলাটা তো তার পাগলামী?
পু। তাও নয়।
কে। তবে কি?
পু। এর ভিতরে ওর একটা জ্ঞান আছে, কোন কারণে মাথাটা খারাপ হয়ে যাওয়ায়, তার সঙ্গে ঐ জ্ঞানটা জড়িয়ে গিয়ে, ওকে ঐ রকম বকিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু পাগলামী নয় হে।
কেবলসর্দ্দার খানিক চুপ করে থেকে বল্লে, “তা হতে ও পারে, সনাতন যতটা পাগলের মত বকে তার কাজ গুলো কিন্তু ততটা পাগলের মত নয়। কাজ যা করে, তা খুব উঁচুদরের বাবা ঠাকুর।
পু। “আমি তো বলেইছি ও ঠিক পাগল নয়।”
“ওদের সারা গাঁ খানাকে সনাতনই যা কিছু বাঁচিয়ে রেখেছে। জমিদার, নায়েব, গোমস্তা এক একটি ধুরন্ধর, কেবল প্রজার গলায় ফাঁসি দিয়ে টাকা আদায় করে, একবার ও প্রজার দুঃখের দিকে ফিরে দেখে না। সনাতন না থাকলে, গাঁ খানা এতদিন উজাড় হয়ে যেত।”
পু। “আমি তো বলেইছি ওর ভিতর জিনিষ আছে, জ্ঞান আছে হে ওর ভিতর জ্ঞান আছে।”
কে। “তা হতেই পারে, গাঁয়ের ছেলে বুড়ো যে অশক্ত যে দুঃখী, সারাদিন যে কোন কারণে খেতে পায়নি তেমন প্রত্যেককেই সনাতন রোজ সন্ধ্যার সময় সিধে মেপে দেয়। আর গাঁয়ের যার বাড়ীতে যত গরু আছে তারা খাওয়াতে না পারলে বিচালী ভূসী যা দরকার সব নিজের দোকান থেকে পাঠিয়ে দেয়। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলে গাইয়ের কাছে যে আমার অনেক দেনা’ তার দুধ খেয়ে মানুষ হয়েছি, জান না?”
পু। “দেখলে তো হে, আমি তো বলেইছি ওর জ্ঞান আছে।”
“সনাতনের জমি জায়গা ঢের। জমির উপর তার কি যত্ন। নিজে সমস্ত জমি তদারক করে, কোথাও এক ফোঁটা পচা জল দাঁড়াতে দেয় না, কোথাও একটু পচা গন্ধ বার হতে দেয় না, পাছে জমি খারাপ করে। বল্লে বলে, দেনা মশায় দেনা, মাটির কাছে আমার বেজায় দেনা সে আমাকে কত অন্ন খাইয়েছে, জান না?
পু। দেখলে, কি রকম জ্ঞান?
কে। আরো তার কত কি কাণ্ড কারখানা আছে সব জানতে গেলে তার বাড়ী যেতে হয়।
পু। যেতেই তো হবে, আজই যেতে হবে।
ক। কখন?
পু। এখুনি, তাড়াতাড়ি এখানকার কাজ সেরেই। এই বলে, সেদিনকার মত যা কিছু দেখবার শোনবার ছিল, তাড়াতাড়ি সব সেরে নিয়ে, কেবলসর্দ্দার সঙ্গে পুরন্দর সনাতন মুদির বাড়ীর দিকে চল্লেন।
ক্রোশ দুই গিয়ে পুরন্দর নিজের জমিদারীর এলাকা ছাড়ালেন। অন্য গাঁয়ে ঢুকে সনাতন, মুদির বাড়ী খুঁজে নিতে তাঁদের একটুও দেরী হল না। পথে একজন লোককে জিজ্ঞাসা করতেই, সে দেখিয়ে বলে “ঐ সনাতন মুদির দোকান।” দোকানের সামনে অত্যন্ত ভীড়, লোক ঠেলাঠেলি করছে। পুরন্দর বল্লেন, খুব তো খদ্দের হে! লোকটা বল্লে, “হবে না মশায় পাঁচখানা গাঁয়ের লোক এর দোকানে রোজ ভেঙ্গে পড়ে, বেজায় কাটতি, বেশী লাভ করে না কিনা? আর মেয়েরা কিনতে গেলে তো এক পয়সাও লাভ নেয় না, আসল দামে জিনিষ দেয়, জিজ্ঞাসা করলে বলে, ‘দেনা মশায় দেনা, বেজায় দেনা আমার মেয়েদের কাছে বেজায় দেনা। তাদের কাছে লাভ নিলে যে ডুবে মরব মশায় ভাবে মরব দোকান কি আর তাহলে থাকবে’?” পুরন্দর শুনে কেবলসর্দ্দারের দিকে চেয়ে বল্লেন “দেখলে হে কি রকম ওর আশ্চর্য্য জ্ঞান"! কেবলরাম বল্লে “হাঁ বাবাঠাকুর তাইত দেখছি, আশ্চর্য্য বটে।”
বলতে বলতে তাঁরা সনাতন মুদির বাড়ীর কাছে এসে পড়লেন। বাড়ীটার সামনের অংশে প্রকাণ্ড ঐ দোকানখানা; ভিতরের অংশটা ছোট, তাতে বড় কেউ থাকে না—এক বুড়ী দাইমা ও একটি গাই গরু, আর তাদেরই সেবা যত্নের জন্যে একটা ছোকরা চাকর।
জমিদার পুরন্দর চক্রবর্ত্তী ও কেবলসর্দ্দারকে সেখানে উপস্থিত দেখে, সনাতন শশব্যস্তে উঠে দাঁড়াল, বল্ল আসুন আসুন মশায়, ভিতরে আসুন, বসুন ঐ তক্তাখানার উপরে, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। দেনা মশায় দেনা আমার বেজায় দেনা, বেজায় দেনা মশায় আপনাদের কাছে।
পুরন্দর নত হয়ে সনাতনকে নমস্কার করে বললেন, আমাদের ফাঁকি দিলে চলবে না হে সনাতন, বলতে হবে এমন জ্ঞান তুমি কোথা থেকে পেলে।
স। জ্ঞান ট্যান জানিনে মশায়, দেনা কেবল দেনা। মশায় দেনা বেজায় দেনা।
পু। ওসব কোন কথা আমি শুনছিনা হে সনাতন এ জ্ঞান আমাকে দিতে হবে হে, দিতে হবে।
স। দেনা মশায় দেনা, আমার বেজায় দেনা, আমি আবার দেব কি, আমার কেবল দেনা।
তাঁরা কথাবার্ত্তা কইছেন এমন সময় হঠাৎ এক সন্ন্যাসী সেখানে এসে উপস্থিত হলেন, সঙ্গে এক চেলা। সন্ন্যাসীকে দেখেই সনাতন বলে উঠল, আসুন মশায় আসুন, বসুন এই তক্তাখানার উপরে। দেনা, মশায় দেনা বেজায় আমার দেনা, আপনার কাছে ও আমার মশায় বেজায় দেনা।
সন্ন্যাসী একটু তাবাক হয়ে তার মুখের দিকে চাইলেন। পুরন্দর সন্নাসীর মনের ভাব বুঝে বললেন ইনি পরম জ্ঞানী, কে জানে কেমন করে এঁর মাথাটা বিগড়ে গেছে, আমি এঁর কাছ থেকে জ্ঞান পাবার জনে এখানে এসে বসে আছি, আপনিও বসুন, অনেক কিছু জানতে পারবেন। সকলে তক্তার উপর উঠে বসলেন। পুরন্দর জিজ্ঞাসা করলেন, দেনা তোমার কার কার কাছে হে সনাতন?
স। মায়ের কাছে, গাঁয়ের কাছে, দাইয়ের কাছে গাইয়ের কাছে, মাটির কাছে, জলের কাছে, ছেলের কাছে বুড়োর কাছে, হাওয়ার কাছে, চাওয়ার কাছে, গাঁ সুদ্ধ লোকের কাছে সবার কাছে মশায় সবার কাছে। আপনার কাছে, সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে দেনা মশায় দেনা কেবল দেনা।
সন্ন্যাসী চুপ করে শুনছেন।
পু। মায়ের কাছে কিসের দেনা সনাতন?
স। জন্মের; মা না হলে জন্মাতুম কেমন করে?
পু। সে দেনা তুমি শোধো কি করে “হে?”
স। আসল দামে, জিনিষ গুলো মেয়েদের বিক্রি করে। তাদের কাছে খাঁটি থাকতে হবে যে মশায় এক পয়সা তাদের কাছে কি লাভ নিতে পারি? দেনা আমার দেনা বেজায় দেনা যে তাদের কাছে।
প। গাঁয়ের দেনা শোধো কি করে?
ন। গাঁয়ের জন্যে দুঃখ স্বীকার করে, দেনা বেজায় দেনা, বেজায় দেনা মশায় গাঁয়ের কাছে।
প। দাইয়ের দেনা?
ন। যেখানে যত বুড়ো স্ত্রীলোক আছে, খেতে না পেলে তাদের যেতে দিয়ে। তারা যে আমাকে বুকের রক্ত খাইয়েছে। দেনা মশায় দেনা, বেজায় দেনা তার কাছে।
প। গাইয়ের দেনা?
স। একই কথা মশায়, একই কথা, দাই আর গাই, খেতে না পেলে তাদের ও খেতে দিতে হয়। দেনা মশায় দেনা, বেজায় দেনা তার কাছে।
পু। “মাটির দেনা শোধের উপায়?”
স। “খেটে মশায় খেটে, সারাদিন তার জন্যে খেটে, পচা জল সরিয়ে, পচা গন্ধ মরিয়ে সার ঢেলে দেদার সার ঢেলে। দেনা মশায় দেনা তার কাছে বেজায় আমার দেনা।”
পু। “জলের দেনা সনাতন?”
স। “ভালো জল বাঁচিয়ে, পচা জল ছেঁচিয়ে, নূতন নূতন পুষ্করণী কেটে। দেনা মশায় দেনা জালের কাছে বেজায় আমার দেনা।”
পু। “ছেলের দেনা সনাতন কি করে শুধতে হবে?”
স। ছেলে গুলোকে শিখিয়ে, সোনার দরে বিকিয়ে দেখবে চেয়ে জগৎখানা, ছেলের গায়ে ফল্চে সোনা। দেনা মশায় দেনা, ছেলের কাছে আমার অনেক দেনা।”
পু। “বুড়োদের দেনা শোধের কি হবে?”
স। “ভক্তি চাই মশায়, ভক্তি চাই, তাঁদের উপর বিশেষ ভক্তি চাই। অনেক জ্ঞান তাঁরা দিয়েছেন। দেনা মশার দেনা, বেজায় আমার দেনা তাঁর কাছে।”
পু। “হাওয়ার দেনা চাওয়ার দেনা কি করে মেটাও সনাতন?
স। হাওয়া আমার প্রাণ, চাওয়া আমার দান, হাওয়াকে বইতে দিয়ে, মানুষকে চাইতে দিয়ে, মশায় চাইতে দিয়ে। দেনা মশায় দেনা বেজায় আমার দেনা তার কাছে।” পুরন্দর সন্ন্যাসীর দিকে চেয়ে বললেন “দেখালেন সন্ন্যাসী ঠাকুর, দেখলেন কি ব্যাপার, দেখলেন কি রকম পাগল!”
সন্ন্যাসী চুপ করে বসে, মুখে কথাটি নেই। কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে সন্ন্যাসী বললেন “সনাতন তোমার চাষে আমাকে খাটাতে দিতে হবে, খানিকটা জমি আমার জন্যে বরাদ্দ করে দাও, মাটির দেনা কেমন করে শুধতে হয় আমি শিখ্বো।
স। “নিন ঠাকুর নিন যতখানি জমী ইচ্ছা হয় নিন, চাষ আবাদ করুন, ফসল যা হবে সব আপনার, দেনা মশায় দেনা, আমার বেজায় দেনা মাটির কাছে, সে আমাকে কত ফসলই দেয়।”
সন্ন্যাসী। “না হে সনাতন ফসল আমি নেব না। ফসল যা হবে সব তোমার, আমি কেবল তোমার জমিতে চাষে খাটব।”
স। “দরদ চাই ঠাকুর, দরদ চাই, ফসল না নিয়ে মাটির জন্য খাটতে গেলে মাটির উপর বেজায় দরদ চাই। সন্ন্যাসীর কি মাটির উপর তত দরদ হবে?
সন্ন্যাসী। “হবে হে হবে, সন্ন্যাসী মাটির জন্যে খাটলে সন্ন্যাসটা তার পাকা হবে। দরদ না থাকে খাটতে খাটতে দরদ জন্মাবে। না জন্মায়, দেনার দায়ে ও তো খাটতে হবে। তুমি তো এখুনি শেখালে বেজায় দেনা আমাদের মাটির কাছে।”
স। বুঝতে পারলে হয় ঠাকুর, বুঝতে পারলে হয়, মাটি ফসল ও দেবে সন্ন্যাস ও পাকাবে এটা বুঝতে পারলে হয়। দেনা ঠাকুর দেনা, বেজায় দেনা আমাদের মাটির কাছে। পুবন্দর দুজনের কথা অবাক্ হয়ে শুনছিলেন সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করলেন, সন্ন্যাসটা কি তবে একবারেই মিথ্যে, সন্ন্যাসীর জীবনটা শুধুই কি তাহলে ব্যর্থ?”
সন্ন্যাসী। তা ঠিক নয়, সন্ন্যাসীর মধ্যেও একটা সাধনা আছে। নিজের অস্তিত্বকে আর সব কিছু থেকে ছাড়িয়ে আলাদা করে দেখার জন্যে তাঁরা সাধনা করেন, কেউ কেউ তাতে সিদ্ধি লাভও করে থাকেন, কিন্তু সে সিদ্ধি সার্থক হয় না, যদি না সেটা পৃথিবীকে দিতে পারা যায়। দিতে হবে মশায়, দিতে হবে, পৃথিবীকে সে সাধনার ফলটা দিতে হবে। তার তো একটা উপায় চাই। সনাতনের কাছে সেই উপায়টা আজ শিখলুম। সনাতনের চাষে খেটে সেই সাধনাটা আমার সার্থক করতে হবে। সনাতন ঠিকই বলেছে বেজায় দেনা মাটির কাছে। এই দেনার কথাটা আমি একেবারে ভুলেই গিয়েছিলুম, সনাতন সেটা মনে করিয়ে দিলে।
পু। “সন্ন্যাসী ঠাকুর! পূর্ব্বকালে মুনি ঋষিরা সে সাধনা করেছিলেন, তার কিছুই কি তাঁরা পৃথিবীকে দিয়ে যেতে পারেননি, সে সবই কি তাঁদের তাহলে বৃথা হয়েছে?
সন্ন্যাসী। “না বৃথা হয় নি, তাঁরা সূক্ষ্মদর্শী ঋষি ছিলেন, মাটি জল প্রভৃতির সূক্ষা রূপ গুলো তাঁরা দেখতে পেতেন, সেই সবের সঙ্গে নিজের সাধনাকে তাঁরা মিশিয়ে রেখে গেছেন—আকাশে ছড়িয়ে, বাতাসে উড়িয়ে আগুণে পুড়িয়ে, জলে গলিয়ে ধূলো মাটিতে মিলিয়ে নিজের সাধনাকে তাঁরা পৃথিবীর অস্থি মজ্জার সঙ্গে একে বারে মিশিয়ে দিয়ে গেছেন। পৃথিবীর সঙ্গে সেটা মিশে আছে বলেই আজও সনাতনের মত লোক একটা আধটা জন্মাচ্ছে। কিন্তু আমরা তো তাঁদের মত সূক্ষ্মদর্শী ঋষি নই, আমরা অন্য জাতের সন্ন্যাসী, আমাদের সাধনাটা আর এক ধাঁচের, আমরা সাধনাই করে যাচ্ছি, কিন্তু পৃথিবীকে সেটা দিতে পারছি না। দেওয়া চাই মশায় দেওয়া চাই। শুনলেন তো সনাতনের কাছে, দেনা মশায় দেনা, বেজায় আমার দেনা, সবার কাছে দেনা। নিজের দিকে চেয়ে দেখছি দুনিয়ার একটি দেনাও আমার শোধ করা হয়নি। আমাকে একেবারে গোড়া থেকে আরম্ভ করতে হবে মশায় গোড়া থেকে, তাই মাটি থেকে শুরু করবো ভেবেছি। সনাতন শিখিয়েছে “দেনা মশায় দেনা বেজায় দেনা মাটির কাছে।”
পু। “প্রণাম সন্ন্যাসী ঠাকুর, প্রণাম সনাতন ভায়া, তোমাদের দুজনের কাছে আজ আমি শিখলুম ‘দেনা আমার দেনা সবার কাছে দেনা, বেজায় আমার দেনা দুনিয়ার কাছে।
সনাতন এ সব কথায় কান দেয়নি, সে নিজের মনেই বকছে ‘দেনা আমার দেনা, বেজায় আমার দেনা, দেনা আমার সবার কাছে।