দুনিয়ার দেনা/বোঝা বওয়া
দুনিয়ার দেনা
বোঝা-বওয়া
১
বাড়িটি আমার পথের ধারেই। রাত্রি-দিন পথ দিয়ে পথিকেরা যাতায়াত করে আর আমি ব’সে ব’সে দেখি। ভাবি, এরা কোথায় যায়, কেন যায় কেন আসে!
আমার প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয় না। ছত্রিশ বৎসর হ’য়ে গেল এ প্রশ্নের মীমাংসা হ’ল না। সেই এক ভাবেই দিন কাটে। সেই পথের দিকে চেয়ে থাকা, পথ দেখা ও পথিক গোণা।
আমি বেকার, দিন-রাত্রির মধ্যে কোন কাজ নেই। পাড়ার লোকে বলে,—ওহে বিবাহ কর, সংসারী হও, এমন করে ক’দিন যাবে? আমি বলি সংসার আমাকে ডাক্ল কই? আমি ত তার পথের ধারে দিন-রাত্রি বসেই আছি, সে তো আমাকে একটিবারও ডাকেনি।
তারা কথা শুনে অবাক্ হয়, ভাবে লোকটা বলে কি!
সত্যি সত্যি সংসার আমায় একটীবারও ডাকে নি। একটি কাজও তার জন্যে করতে বলে নি। ডাক্ না পেলে যাই কি ক’রে এ কথাটা কেউ বোঝে না! সৃষ্টিছাড়া কাজের কথা সৃষ্টির অদ্ভুত জীব না হ’লে জানবেই বা কে!
কর্ম্মব্যস্ত লোকদের দ্রুত পথে চ’লতে দেখে কত সময় ইচ্ছা হ’য়েছে আমিও ওদের সঙ্গে যাই, ওদের মত কাজ করি, কিন্তু সে ইচ্ছায় গতি নেই আনন্দ নেই, তবে যাই কি ক’রে।
এই অকর্ম্মণয় জীবটী যখন গতিশূন্য হ’য়ে এমনি ভাবে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে তখন একদিন হঠাৎ তার ডাক প’ড়ল—“বোঝাটা নামিয়ে দাও তো বাবু”। ঘর্ম্মাক্ত দেহে প্রকাণ্ড এক মোট নিয়ে একটী ঝাঁকা মুটে পথ চ’লতে চ’লতে আমার দিকে চোখ প’ড়তেই ব’লে উঠল, “বোঝাটা নামিয়ে দাও তো বাবু”।
বোঝা নামালুম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম ক’রে নিজের মোট নিয়ে মুটে গেল চ’লে তার নিজের পথে, কিন্তু যে ডাক আমাকে ডেকে গেল তার আর শেষ হ’ল না।
সেই দিন থেকেই আমার কাজের সুরু।
২
প্রতিদিন খুব ভোরে, প্রায় রাত্রি চারটার সময় উঠে বড় রাস্তার চৌমাথায় গিয়ে আমি দাঁড়াতে আরম্ভ করলুম। পথ দিয়ে যে কোনো পথিক যায়, যার হাতে বেশী বোঝা দেখি তার কতকটা বোঝা নামিয়ে নিয়ে তাকে নির্দ্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আসি। এই আমার কাজ।
এইটুকু কাজ ক’রেই আমি বেশ সুখে আছি, মনের কোনখানে কোন কষ্ট কোন অভাব নেই।
প্রতিদিনই ঐ ভাবে আমি কাজ ক’রে চলেছি। ভোর থেকে বেলা বারটা পর্য্যন্ত আমার রাস্তার রাস্তার কাটে। বারটার পর বাড়ী এসে নেয়ে-খেয়ে বিশ্রাম করি। বৈকাল পাঁচটায় আবার গিয়ে চৌ-মাথায় দাঁড়াই, সামনে পথিক পেলেই তার বোঝা নামাই ও ব’য়ে নিয়ে যাই!
ভদ্রলোক পথিকেরা সময়ে সময়ে আমার উপর সন্তুষ্ট হ’য়ে কেউ দু’আনা, কেউ চার আনা, বকসিস দিতে আসেন। আমি বলি,—মশায় ক্ষমা করবেন, এটা আমার ব্যবসা নয়, নিজের পরিতৃপ্তির জন্যই এটা আমি ক’রে থাকি। কতকটা সহজে কতকটা স্বচ্ছন্দে আপনারা যে গম্য স্থানে পৌঁছবেন, এতেই আমার সুখ আমার আনন্দ। আপনারা বিশ্রাম করুন অমি ফিরে চল্লুম।
আমার কাণ্ড দেখে কেউ বলে লোকটা পাগল হে, কেউ বলে বেটার নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে, পাঁচ দিন সাধুগিরী দেখিয়ে এক দিন কারো ভাল রকম মাল হাতে পেলে নিশ্চয় চম্পট দেবে, এ যদি না হয় ত কোন শক্ত রকম পাপ ক’রেছে, শেষে অনুতপ্ত হ’য়ে এইভাবে তার প্রায়শ্চিত্ত সাধন করছে, লোকটাকে ভাল বলেই বোধ হয়। যে যা বলে বলুক আমি প্রতিদিন এই ভাবে কাজ ক’রে বাড়ী এসে সুখে নিদ্রা যাই।
৩
আমার কিছু পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। তাই আমার খাওয়া-পরার কোন ভাবনা ছিল না। নিশ্চিন্ত মনে তাই আমি কেবল রাস্তায় রাস্তায় বোঝা ব’য়ে দিন কাটাতে পারতুম। প্রত্যেক বেলা বাড়ী থেকে বার হবার সময় আমি একটি ক’রে টাকা সঙ্গে নিয়ে যেতুম, ফেরবার পথে তাই দিয়ে নানা রকম খাবার জিনিষ কিনে এনে বাড়ী এসে পাড়ার ছেলেদের ডেকে খাওয়াতুম এতেই আমার বোঝা-বওয়ার শ্রান্তিটুকু হেলায় দূর হ’য়ে অবকাশটুকু, ফাঁকটুকু আনন্দে ভ’রে উঠত।
ছেলেদের সঙ্গে সেই থেকে আমার এমন একটা যোগ হ’য়ে দাঁড়িয়েছিল যে, তারা নইলে আমার চলে না, আমি নইলে তাদের চলে না। আমার ঘরের সর্ব্বস্ব তাদের আর তাদের সব যেন আমার হ’য়ে পড়েছিল।
৪
দৈনিক বোঝা-বওয়া কাজটার মধ্যে একদিন এক পথিকের বোঝা ব’য়ে দিতে তিনি আমাকে এক টুকরী ফল উপহার দিলেন। ফল পেয়ে আমি বড় খুসী হলুম। এ রকম পুরস্কার আর কোন পথিকের বোঝা ব’য়ে আমি কোন দিন পাই নাই। ফলগুলো পেয়ে ভাবলুম, ছেলেরা আজ ফল পেয়ে বড় খুশী হবে।
ছেলেদের মুখ মনে পড়াতে ফলের দিকে চেয়ে আমার মনে কেমন একটা আনন্দ হ’ল। বুঝলুম এ রকম উপহার নেওয়া যেতে পারে।
মাসখানেক পরে দেখি, সেই পথিক আবার এক মস্ত বোঝা নিয়ে চৌমাথার রাস্তা ধরে চলেচেন। আমি দৌড়ে বোঝাটা নামিয়ে নিতে গেলুম, পথিক ব’ল্লেন, আজকের বোঝাটা বড় বেশী ভারী, তুমি বইতে পারবে না। আমি অত্যন্ত অনায়াসে বল্লুম, কোন চিন্তা নেই, বোঝা যত ভারী হবে আমার আনন্দ তত বেশী, তৃপ্তি তত পরিপূর্ণ হবে। দিন্ বোঝা আমার কাঁধে, চলুন আপনি।
বোঝাটা নামিয়ে নিতে নিতে আমি বল্লুম, “মশায় যে বোঝা আপনি নিয়ে চলছিলেন সেটা নিয়ে আমি চ’লতে পারব না এমনটা ভাবলেন কি ক’রে?”
পথিক বল্লেন, “ওহে তুমি বোঝো না, এটা যে আমার নিজের বোঝা, যেমন করেই হোক একে যে আমার বইতেই হবে, তুমি পরের এত বড় বোঝাটা বইবে কেমন ক’রে তাই ভাবছিলুম”। শুনে বুঝলুম আমার ডাকের খবর তিনি রাখেন না।
সেই সদাশয় পথিকের বোঝাটি নিয়ে তাঁকে যথাস্থানে পৌঁছে দিতে আগের দিনের মত তিনি আমায় আবার এক ঝুড়ি ফল দিলেন। ফলের বোঝা খোকাদের জন্যে ব’য়ে নিয়ে বাড়ী এলুম। ফলগুলো নামিয়ে দেখি, টুকরীর মধ্যে আজ এক তোডা মোহর। ভাবলুম পথিক ভুল ক’রে মোহরের তোড়াটা এর মধ্যে ফেলে রেখেছেন। যাই হোক্, কাল থেকে আবার এই মোহরের বোঝা নিয়ে আমাকে রাস্তার আনা-গোণা করতে হবে দেখছি। কর্ম্মভোগ আর বলে কাকে? যত দিন আবার না সেই পথিকের দেখা পাচ্চি, তাঁর মোহরের তোড়াটা তাঁকে যতদিন ফিরিয়ে দিতে না পারচি, তত দিন এই সোণার বোঝা বওয়া আমার আর একটা কাজ হ’ল দেখচি।
প্রায় মাস ছয়েক পরে পথিকের দেখা পেলুম। সেইভাবে পথিক আবার পথ দিয়ে যাচ্ছেন। বল্লুম, “মশায়, ছ’মাস ধ’রে আপনার এই মোহরের বোঝা বয়ে ফিরচি, নিন্ আপনার মোহরের তোড়া”।
পথিক একটু অবাক্ হ’য়ে আমার মুখের দিকে চাইলেন—বোধ হয়, যেন ভাবলেন লোকটা কি প্রকৃতির মানুষ!
তোড়া নিয়ে পথিক নিজের গন্তব্য পথে চ’লে গেলেন আমিও বাড়ী ফিরলুম।
সে দিন আর তাঁর মোহরের বোঝা নিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে যাই নি। সে বোঝা অনেক দিন ধরে বয়েছিলুম ব’লে আর বইবার ইচ্ছা ছিল না। তা ছাড়া পথিকের হাতে এবার আর অন্য বোঝা না থাকায় নিজের সোণার বোঝা তিনি অনায়াসে ব’য়ে নিয়ে যেতে পারবেন জানতুম।
৫
দিন দুই পরে একটা লোক এসে আমায় ব’ল্ল দেশের রাজা তোমায় ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি ত শুনে অবাক্! রাজা আমাকে ডেকেছেন, কি আশ্চর্য্য। রাজার আমায় কি দরকার? শেষে ভাবলুম, হয় ত বা সেখানেও বোঝা বইবার জন্যে কোন বেকার লোকের দরকার আছে।
যাই হোক্, আমি ত রাজ-সদনে যাত্রা ক’রলুম। গিয়ে দেখি, মহারাজ সিংহাসনে ব’সে—তিনিই আমার সেই সোণার তোড়া-ওয়ালা সদাশয় পথিক।
দেখে প্রথমটা আমি চমকে গিয়েছিলুম, ভাবলুম, না জানি কপালে কি আছে। পরে তিনি ব’ল্লেন, আমি তোমার সততায় বিস্মিত ও মুগ্ধ হ’য়েছি। তুমি আর রাস্তার লোকের বোঝা ব’য়ে দিন কাটিও না, আমার রাজ্যের কোন একটী উচ্চ বেতনের কর্ম্মভার গ্রহণ ক’রে আমাদের সকলকে সুখী ও আনন্দিত কর।
তখন আমি বুঝলুম,ব্যাপারটা কি? বল্লুম, “মহারাজ আমার ত কাজ ক’রে বেতন নেবার যো নেই, আমি যে আমার ভক্তির আজ্ঞায় কাজ করে থাকি। বেতন নিলেই আমি মারা প’ড়ব। মহারাজ এটা আমার দ্বারা হবে না”।
রাজা বল্লেন, “তবে তুমি বিনা বেতনেই আমার কোন একটা কাজ গ্রহণ কর। নতুবা আমরা সুখী হ’তে পারছি নে”।
“তাই হবে মহারাজ, কাল থেকে আমি প্রতিদিন আপনার দরবারের বড় দরওয়াজায় উপস্থিত থাকব, যে কেউ রাজদর্শনে আসবে তার সঙ্গে যদি কোন বোঝা থাকে তাই নামিয়ে নেওয়ার ভার আমার উপর রইল। আপনি যখন আমাকে নিজের মধ্যেই আটক রাখতে চাইছেন তখন এই কাজটুকু নিয়েই আমি নিজকে এখানে বেঁধে রাখব। বাঁধার মধ্যে আমার ঐটুকু ফাঁক, ঐ বোঝা-নামাটুকু দেখাতেই আমার আনন্দ।”
রাজা বল্লেন “তাই হবে”।
সেই থেকে বড় রাস্তার চৌমাথা ছেড়ে দিয়ে প্রতিদিন আমি রাজ-দরবারে হাজির থাকি! যে আসে, যে দরবারে ঢুক্তে যায় তার বোঝা নামাই এতে আমার শ্রান্তি নেই, ক্লান্তি নেই, শুধু কেবল তৃপ্তিই আছে।
দীর্ঘকাল পরে, প্রায় বিশ বৎসর ধ’রে একই ভাবে কাজ ক’রতে দেখে রাজা এক দিন আমাকে ডেকে বল্লেন “কি হে বাপু, তুমি নিত্যি নিত্যি পরের বোঝা নামিয়ে কি সুখ পাও বল ত?”
আমি বল্লুম, “মহারাজ, যখন বাড়ী ফিরি তখন এমন এক অগাধ শান্তির মধ্যে ডুবে যাই, তা কথায় প্রকাশ করা যায় না। আমার সেইটাই পাওয়া।”
রাজা আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। জানি না, আমার চোখের ভিতর দিয়ে তিনি শান্তির কোন রূপ ও ভক্তির কোন বিগ্রহ আমার মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন কি না। আমি কিন্তু সেই দিন থেকে তাঁর রাজদরবারের বড় দরজার সামনে হাজির থাকার বাঁধা নিয়ম থেকে অব্যাহতি পেয়েছি। এখন আমি নিজের ইচ্ছামত রাজ-দরবারের দরওয়াজায় গিয়ে দরবারী লোকের বোঝা নামাই, কখনো রাস্তার চৌমাথায় দাঁড়িয়ে সাধারণ পথিকদের বোঝা বই—যেমন আমার খুসী।