দুর্গেশনন্দিনী/দ্বিতীয় খণ্ড/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ
দিগ্গজ-সংবাদ
ভৃত্যসঙ্গে গজপতি বিদ্যাদিগ্গজ কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলে রাজকুমার জিজ্ঞাসিলেন, “আপনি ব্রাহ্মণ?”
দিগ্গজ হস্তভঙ্গী সহিত কহিলেন,―
যাবৎ মেরৌ স্থিতা দেবা যাবৎ গঙ্গা মহীতলে,
অসারে খলু সংসারে সারং শ্বশুরমন্দিরং।”
জগৎসিংহ হাস্য সংবরণ করিয়া প্রণাম করিলেন। গজপতি আশীর্ব্বাদ করিলেন, “খোদা খাঁ বাবুজীকে ভাল রাখুন।”
রাজপুত্র কহিলেন, “মহাশয়, আমি মুসলমান নহি, আমি হিন্দু।”
দিগ্গজ মনে করিলেন, “বেটা যবন, আমাকে ফাঁকি দিতেছে; কি একটা মতলব আছে; নহিলে আমাকে ডাকিবে কেন?” ভয়ে বিষণ্ণবদনে কহিলেন, “খাঁ বাবুজী, আমি আপনাকে চিনি; আপনার অন্নে প্রতিপালন, আমায় কিছু বলিবেন না, আপনার শ্রীচরণের দাস আমি।”
জগৎসিংহ দেখিলেন, ইহাও এক বিঘ্ন। কহিলেন, “মহাশয়, অপনি ব্রাহ্মণ; আমি রাজপুত, আপনি এরূপ কহিবেন না; আপনার নাম গজপতি বিদ্যাদিগ্গজ?”
দিগ্গজ ভাবিলেন, “ঐ গো! নাম জানে! কি বিপদে ফেলিবে?” করযোড়ে কহিলেন, “দোহাই সেখজীর। আমি গরিব! আপনার পায়ে পড়ি।”
জগৎসিংহ দেখিলেন, ব্রাহ্মণ যেরূপ ভীত হইয়াছে, তাহাতে স্পষ্টতঃ উহার নিকট কোন কার্য্যসিদ্ধি হইবে না। অতএব বিষয়ান্তরে কথা কহিবার জন্য কহিলেন, “আপনার হাতে ও কি পুতি?”
“আজ্ঞা এ মাণিকপীরের পুতি!”
“ব্রাহ্মণের হাতে মাণিকপীরের পুতি?”
“আজ্ঞা,—আজ্ঞা, আমি ব্রাহ্মণ ছিলাম, এখন ত আর ব্রাহ্মণ নই।”
রাজকুমার বিস্ময়াপন্ন হইলেন, বিরক্তও হইলেন। কহিলেন, “সে কি? আপনি গড়মান্দারণে থাকিতেন না?” .
দিগ্গজ ভাবিলেন, “এই সর্ব্বনাশ করিল! আমি বীরেন্দ্রসিংহের দুর্গে থাকিতাম, টের পেয়েছে! বীরেন্দ্রসিংহের যে দশা করিয়াছে, আমারও তাই করিবে।” ব্রাহ্মণ ত্রাসে কাঁদিয়া ফেলিল। রাজকুমার কহিলেন, “ও কি ও!”
দিগ্গজ হাত কচলাইতে কচলাইতে কহিলেন, “দোহাই খাঁ বাবা! আমায় মের না বাবা! আমি তোমার গোলাম বাবা! তোমার গোলাম বাবা!”
“তুমি কি বাতুল হইয়াছ?”
“না বাবা! আমি তোমারই দাস বাবা! আমি তোমারই বাবা!”
জগৎসিংহ অগত্যা ব্রাহ্মণকে সুস্থির করিবার জন্য কহিলেন, “তোমার কোন চিন্তা নাই, তুমি একটু মাণিকপীরের পুতি পড়, আমি শুনি।”
ব্রাহ্মণ মাণিকপীরের পুতি লইয়া সুর করিয়া পড়িতে লাগিল। যেরূপ যাত্রার বালক অধিকারীর কাণমলা খাইয়া গীত গায়, দিগ্গজ পণ্ডিতের সেই দশা হইল।
ক্ষণেক পরে রাজকুমার পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি ব্রাহ্মণ হইয়া মাণিকপীরের পুতি পড়িতেছিলেন কেন?”
ব্রাহ্মণ সুর থামাইয়া কহিল, “আমি মোছলমান হইয়াছি।”
রাজপুত্র কহিলেন, “সে কি?” গজপতি কহিলেন, “যখন মোছলমান বাবুরা গড়ে এলেন, তখন আমাকে কহিলেন যে, ‘আয় বামন্ তোর জাতি মারিব।’ এই বলিয়া তাহারা আমাকে ধরিয়া লইয়া মুরগির পালো রাঁধিয়া খাওয়াইলেন।”
“পালো কি?”
দিগ্গজ কহিলেন, “আতপ চাউল ঘৃতের পাক।”
রাজপুত্র বুঝিলেন, পদার্থটা কি। কহিলেন, “বলিয়া যাও!”
“তার পর আমাকে বলিলেন, ‘তুই মোছলমান হইয়াছিস’; সেই অবধি আমি মোছলমান।”
রাজপুত্র এই অবসরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর সকলের কি হইয়াছে?”
“আর আর ব্রাহ্মণ অনেকেই ঐরূপ মোছলমান হইয়াছে” রাজপুত্র ওস্মানের মুখপানে দৃষ্টি করিলেন। ওস্মান রাজপুত্র কৃত নির্ব্বাক্ তিরস্কার বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, “রাজপুত্র; ইহাতে দোষ কি? মোছলমানের বিবেচনায় মহম্মদীয় ধর্ম্মই সত্য ধর্ম্ম; বলে হউক, ছলে হউক, সত্য-ধর্ম্ম-প্রচারে আমাদের মতে অধর্ম্ম নাই, ধর্ম্ম আছে!”
রাজপুত্র উত্তর না করিয়া বিদ্যাদিগ্গজকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন, “বিদ্যাদিগ্গজ মহাশয়!”
“আজ্ঞে, এখন সেই দিগ্গজ।”
“আচ্ছা তাই; সেখজী, গড়ের আর কাহারও সংবাদ আপনি জানেন না?”
ওস্মান রাজপুত্রের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া উদ্বিগ্ন হইলেন। দিগ্গজ কহিলেন, “আর অভিরামস্বামী পলায়ন করিয়াছেন!”
রাজপুত্র বুঝিলেন, নির্ব্বোধকে স্পষ্ট স্পষ্ট জিজ্ঞাসা না করিলে কিছুই শুনিতে পাইবেন না! কহিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহের কি হইয়াছে?”
ব্রাহ্মণ কহিলেন, “নবাব কতলু খাঁ তাহাকে কাটিয়া ফেলিয়াছেন!”
রাজপুত্রের মুখ রক্তিমবর্ণ হইল। ওস্মানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি? এ ব্রাহ্মণ অলীক কথা কহিতেছে?”
ওস্মান গম্ভীরভাবে কহিলেন, “নবাব বিচার করিয়া রাজবিদ্রোহী জ্ঞানে প্রাণদণ্ড করিয়াছেন।”
রাজপুত্রের চক্ষুতে অগ্নি প্রোজ্জ্বল হইল।
ওস্মানকে জিজ্ঞাসিলেন, “আর একটা নিবেদন করিতে পারি কি? কার্য্য কি আপনার অভিমতে হইয়াছে?”
ওস্মান কহিলেন, “আমার পরামর্শের বিরুদ্ধে।”
রাজকুমার বহুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। ওস্মান সুসময় পাইয়া দিগ্গজকে কহিলেন, “তুমি এখন বিদায় হইতে পার।”
দিগ্গজ গাত্রোত্থান করিয়া চলিয়া যায়, কুমার তাহার হস্তধারণপূর্ব্বক নিবারণ করিয়া কহিলেন, “আর এক কথা জিজ্ঞাসা; বিমলা কোথায়?”
ব্রাহ্মণ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিল, একটু রোদনও করিল। কহিল, “বিমলা এখন নবাবের উপপত্নী।”
রাজকুমার বিদ্যুদ্দৃষ্টিতে ওস্মানের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, “এও সত্য?”
ওস্মান কোন উত্তর না করিয়া ব্রাহ্মণকে কহিলেন, “তুমি আর কি করিতেছ? চলিয়া যাও।”
রাজপুত্র ব্রাহ্মণের হস্ত দৃঢ়তর ধারণ করিলেন, যাইবার শক্তি নাই। কহিলেন, “আর এক মুহূর্ত রহ; আর একটা কথা মাত্র।” তাঁহার আরক্ত লোচন হইতে দ্বিগুণতর অগ্নি-বিস্ফূরণ হইতেছিল, “আর একটা কথা। তিলোত্তমা?”
ব্রাহ্মণ উত্তর করিল, “তিলোত্তমা নবাবের উপপত্নী হইয়াছে। দাসদাসী লইয়া তাহারা স্বচ্ছন্দে আছে।”
রাজকুমার বেগে ব্রাহ্মণের হস্ত নিক্ষেপ করিলেন, ব্রাহ্মণ পড়িতে পড়িতে রহিল।
ওস্মান লজ্জিত হইয়া মৃদুভাবে কহিলেন, “আমি সেনাপতি মাত্র।”
রাজপুত্র উত্তর করিলেন, “আপনি পিশাচের সেনাপতি।”
―――
.