দুর্গেশনন্দিনী/প্রথম খণ্ড/ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে
উনবিংশ পরিচ্ছেদ
প্রেমিকে প্রেমিকে

 বিমলা যখন দেখিলেন যে, চতুর ওস্মান অন্যত্র গেলেন, তপন তিনি ভরসা পাইলেন যে, কৌশলে মুক্তি পাইতে পারিবেন। শীঘ্র তাহার উপায় চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 প্রহরী কিয়ৎক্ষণ দণ্ডায়মান থাকিলে বিমল তাহার সহিত কথোপকথন আরম্ভ করিলেন। প্রহরী হউক, আর যমদূতই হউক, সুন্দরী রমণীর সহিত কে ইচ্ছাপূর্ব্বক কথোপকথন না করে? বিমলা প্রথমে এ ও সে নানাপ্রকার সামান্য-বিষয়ক কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন। ক্রমে প্রহরীর নাম ধাম গৃহকর্ম্ম সুখদুঃখ-বিষয়ক নানা পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। প্রহরী নিজ সম্বন্ধে বিমলার এতদূর পর্য্যন্ত ঔৎসুক্য দেখিয়া বড়ই প্রীত হইল। বিমলাও সুযোগ দেখিয়া ক্রমে ক্রমে নিজ তুণ হইতে শাণিত অস্ত্র সকল বাহির করিতে লাগিলেন। একে বিমলার অমৃতময় রসালাপ, তাহাতে আবার তাহার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিশাল চক্ষুর অব্যর্থ কটাক্ষ-সন্ধান, প্রহরী একেবারে গলিয়া গেল। যখন বিমলা প্রহরীর ভঙ্গিভাবে দেখিলেন যে, তাহার অধঃপাতে যাইবার সময় হইয়া আসিয়াছে, তখন মৃদু মৃদু স্বরে কহিলেন, “আমার কেমন ভয় করিতেছে, সেখজী, তুমি আমার কাছে বসো-না!”

 প্রহরী চরিতার্থ হইয়া বিমলার পাশে বসিল। ক্ষণকাল অন্য কথোপকথনের পর বিমলা দেখিলেন যে, ঔষধ ধরিয়াছে। প্রহরী নিকটে বসিয়া অবধি ঘন ঘন তাঁহার পানে দৃষ্টিপাত করিতেছে। তখন বলিলেন, “সেখজী, তুমি বড় ঘামিতেছ; একবার আমার বন্ধন খুলিয়া দাও যদি, তবে আমি তোমাকে বাতাস করি, পরে, আবার বাঁধিয়া দিও।”

 সেখজীর কপালে ঘর্ম্মবিন্দুও ছিল না, কিন্তু বিমলা অবশ্য ঘর্ম্ম না দেখিলে কেন বলিবে? আর এ হাতের বাতাস কার ভাগ্যে ঘটে? এই ভাবিয়া প্রহরী তখনই বন্ধন খুলিয়া দিল।

 বিমলা কিয়ৎক্ষণ ওড়না দ্বারা প্রহরীকে বাতাস দিয়া স্বচ্ছনে ওড়না নিজ অঙ্গে পরিধান করিলেন। পুনর্ব্বন্ধনের নামও করিতে প্রহরীর মুখ ফুটিল না। তাহার বিশেষ কারণও ছিল; ওড়নার বন্ধনরজ্জুত্ব দশা ঘুচিয়া যখন তাহা বিমলার অঙ্গে শোভিত হইল, তখন তাঁহার লাবণ্য আরও প্রদীপ্ত হইল; যে লাবণ্য মুকুরে দেখিয়া বিমলা আপনা-আপনি হাসিয়াছিলেন, সেই লাবণ্য দেখিয়া প্রহরী নিস্তব্ধ হইয়া রহিল।

 বিমলা কহিলেন, “সেখজী, তোমার স্ত্রী তোমাকে কি ভালবাসে না?”

 সেখজী কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেন?”

 বিমলা কহিলেন, “ভালবাসিলে এ বসন্তকালে (তখন ঘোর গ্রীষ্ম, বর্ষা আগত) কোন্ প্রাণে তোমা-হেন স্বামীকে ছাড়িয়া আছে?”

 সেখজী এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিল।

 বিমলার তূণ হইতে অনর্গল অস্ত্র বাহির হইতে লাগিল।

 “সেখজী! বলিতে লজ্জা করে, কিন্তু তুমি যদি আমার স্বামী হইতে, তবে আমি কখন তোমাকে যুদ্ধে আসিতে দিতাম না।”

 প্রহরী আবার নিঃশ্বাস ছাড়িল। বিমলা কহিতে লাগিলেন, “আহা! তুমি যদি আমার স্বামী হ’তে!​”

 বিমলাও এই বলিয়া একটী ছোট রকম নিঃশ্বাস ছাড়িলেন, তাহার সঙ্গে সঙ্গে নিজ তীক্ষ-কুটিল-কটাক্ষ বিসর্জ্জন করিলেন; প্রহরীর মাথা ঘুরিয়। গেল! সে ক্রমে ক্রমে সরিয়। সরিয়া বিমলার আরও নিকটে আসিয়া বসিল, বিমলাও আর একটু তাহার দিকে সরিয়া বসিলেন। বিমলা প্রহরীর করে কোমল কর-পল্লব স্থাপন করিলেন। প্রহরী হতবুদ্ধি হইয় উঠিল:

 বিমল কহিতে লাগিলেন, “বলিতে লজ্জা করে, কিন্তু তুমি যদি রণজয় করিয়া যাও, তবে আমাকে কি তোমার মনে থাকিবে?”

প্র। তোমার মনে থাকিবে না?
বি। মনের কথা তোমাকে বলিব?
প্র। বল না—বল!
বি। না, বলিব না, তুমি কি বলিবে?
প্র। না না—বল, আমাকে ভৃত্য বলিয়া জানিও।
বি। আমার মনে বড় ইচ্ছা হইতেছে, এ পাপ স্বামীর মুখে কালি দিয়া তোমার সঙ্গে চলিয়া যাই।

 আবার সেই কটাক্ষ। প্রহরী আহ্লাদে নাচিয়া উঠিল

প্র। যাবে?

 দিগ্‌গজের মত পণ্ডিত অনেক আছে!

 বিমলা কহিলেন, “লইয়া যাও ত যাই!”

প্র। তোমাকে লইয়া যাইব না? তোমার দাস হইয়া থাকিব।

 “তোমার এ ভালবাসার পুরস্কার কি দিব? ইহাই গ্রহণ কর।”

 এই বলিয়া বিমলা কণ্ঠস্থ স্বর্ণহার প্রহরীর কণ্ঠে পরাইলেন, প্রহরী সশরীরে স্বর্গে গেল। বিমলা কহিতে লাগিলেন, “আমাদের শাস্ত্রে বলে, একের মালা অন্যের গলায় দিলে বিবাহ হয়।”

 হাসিতে প্রহরীর কাল দাড়ির অন্ধকার-মধ্য হইতে দাঁত বাহির হইয়া পড়িল; বলিল, “তবে ত তোমার সাতে আমার সাদি হইল।”

 “হইল বই আর কি?” বিমলা ক্ষণেক কাল নিস্তব্ধে চিন্তামগ্নের ন্যায় রহিলেন। প্রহরী কহিল, “কি ভাবিতেছ?”

বি। ভাবিতেছি, আমার কপালে বুঝি সুখ নাই, তোমরা দুর্গজয় করিয়া যাইতে পারিবে না।

 প্রহরী সদর্পে কহিল, “তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই, এতক্ষণ জয় হইল।”

 বিমলা কহিলেন, “উহুঁ, ইহার এক গোপন কথা আছে।”

 প্রহরী কহিল, “কি?”

বি। তোমাকে সে কথা বলিয়া দিই, যদি তুমি কোনরূপে দুর্গজয় করাইতে পার।

 প্রহরী হাঁ করিয়া শুনিতে লাগিল; বিমলা কথা বলিতে সঙ্কোচ করিতে লাগিলেন। প্রহরী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “ব্যাপার কি?”

 বিমলা কহিলেন, “তোমরা জান না, এই দুর্গপার্শ্বে জগৎসিংহ দশসহস্র সেনা লইয়া বসিয়া আছে। তোমরা আজ গোপনে আসিবে জানিয়া, সে আগে আসিয়া বসিয়া আছে; এখন কিছু করিবে না, তোমরা দুর্গজয় করিয়া যখন নিশ্চিন্ত থাকিবে, তখন আসিয়া ঘেরাও করিবে।”

 প্রহরী ক্ষণকাল অবাক্ হইয়া রহিল; পরে বলিল, “সে কি?”।

বি। এই কথা দুর্গস্থ সকলেই জানে; আমরাও শুনিয়াছি।

 প্রহরী আহ্লাদে পরিপূর্ণ হইয়া কহিল, “জান্! আজ তুমি আমাকে বড়লােক করিলে; আমি এখনই গিয়া সেনাপতিকে বলিয়া আসি; এমন জরুরি খবর দিলে শিরােপা পাইব, তুমি এইখানে বসো, আমি শীঘ্র আসিতেছি।”

 প্রহরীর মনে বিমলার প্রতি তিলার্ধ সন্দেহ ছিল না!

 বিমলা বলিলেন, “তুমি আসিবে ত?”

প্র। আসিব বই কি, এই অসিলাম।
বি। আমাকে ভুলিবে না?
প্র। না—না।
বি। দেখ, মাথা খাও।

 “চিন্তা কি?” বলিয়া প্রহরী উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া গেল।

 যেই প্রহরী অদৃশ্য হইল, অমনি বিমলাও উঠিয়া পলাইলেন। ওস্মানের কথা যথার্থ, “বিমলার কটাক্ষকেই ভয়।”