দুর্গেশনন্দিনী/প্রথম খণ্ড/নবম পরিচ্ছেদ
জগৎসিংহ পিতৃচরণ হইতে সসৈন্যে বিদায় হইয়া যে যে কার্য্য করিলেন, তাহাতে পাঠান সৈন্যমধ্যে মহাভীতি প্রচার হইল। কুমার প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, পঞ্চ সহস্র সেনা লইয়া তিনি কত খাঁর পঞ্চাশৎ সহস্রকে সুবর্ণরেখা পার করিয়া দিবেন; যদিও এপর্য্যন্ত ততদূর কৃতকার্য্য হইবার সম্ভাবনা দেখাইতে পারেন নাই, তথাপি তিনি শিবির হইতে আসিয়া দুই সপ্তাহে যে পর্য্য়ন্ত যোদ্ধপতিত্ব গুণের পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ করিয়া মানসিংহ কহিয়াছিলেন, “বুঝি আমার কুমার হইতে; রাজপুত-নামের পূর্ব্বগৌরব পুনরুদ্দীপ্ত হইবে।”
জগৎসিংহ উত্তমরূপে জানিতেন, পঞ্চ সহস্র সেনা লইয়া পঞ্চাশৎ সহস্রকে সম্মুখ-সংগ্রামের বিমুখ করা কোনরূপেই সম্ভব নহে; বরং পরাজয় বা মৃত্যুই নিশ্চয়। অতএব সম্মুখ-সংগ্রামের চেষ্টায় না থাকিয়া, যাহাতে সম্মুখ-সংগ্রাম না হয়, এমন প্রকার রণপ্রণালী অবলম্বন করিলেন। তিনি নিজ সামান্যসংখ্যক সেনা সর্ব্বদা অতি গোপনে লুক্কায়িত রাখিতেন; নিবিড় বনমধ্যে বা প্রদেশে সমুদ্র-তরঙ্গবৎ—কোথাও নিম্ন, কোথাও উচ্চ—যে সকল ভূমি আছে, তন্মধ্যে এমন স্থানে শিবির করিতেন যে, পার্শ্ববর্ত্তী উচ্চ ভূমিখণ্ড সকলের অন্তরালে, অতি নিকট হইতেও কেহ তাঁহার সেনা দেখিতে পাইত না। এইরূপ গোপনভাবে য়া, যখন কোথাও স্বল্পসংখ্যক পাঠান-সেনার সন্ধান পাইতেন, তরঙ্গ-প্রপাতবৎ বেগে তদুপরি সসন্যৈ হইয়া তাহা একেবারে নিঃশেষ করিতেন। তাঁহার বহুসংখ্যক চর ছিল; তাহারা ফলমূল-মৎস্যাদিবিক্রেতা বা ভিক্ষুক উদাসীন ব্রাহ্মণ-বৈদ্যাদির বেশে নানা স্থানে ভ্রমণ করি, পাঠান-সেনার গতিবিধির সন্ধান আনিয়া দিত। জগৎসিংহ সংবাদ পাইবামার অতি সাবধানে অথচ দ্রুতগতি, এমন স্থানে গিয়া সৈন্য সংস্থাপন করিতেন যে, যেন আগন্তুক পাঠান-সেনার উপরে সুকৌশলে এবং অপূর্ব্বদৃষ্ট হইয়া আক্রমণ করিতে পারেন। যদি পাঠান-সেনা অধিক-সংখ্যক হইত, তবে জগৎসিংহ তাহাদিগকে আক্রমণ করার কোন স্পষ্ট উদ্যম করিতেন না, কেন না তিনি জানিতেন, তাঁহার বর্তমান অবস্থায় এক যুদ্ধে পরাজয় হইলে সকল নষ্ট হইবে; তখন কেবল পাঠান-সেনা চলিয়া গেলে, সাবধানে তাহার পশ্চা পশ্চাৎ গিয়া তাহাদিগের আহারীয় দ্রব্য, অশ্ব, কানান ইত্যাদি অপহরণ করিয়া লইয়া চলিয়া আসিতেন। আর যদি পাঠান-সেনা প্রবল না স্বল্পসংখ্যক হইত, তবে যতক্ষণে সেনা নিজ মনোমতস্থান পর্য্যন্ত না আসিত, সে পর্য্যন্ত স্থির হইয়া গোপনীয় স্থানে থাকিতেন; পরে সময় বুঝিয়া ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের ন্যায় চীৎকার-শব্দে ধাবমান হইয়। হতভাগ্য পাঠানদিগকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতেন। সে অবস্থার পাঠানেরা শত্রুর নিকটস্থিতি অবগত থাকিত না; সুতরাং রণজন্য প্রস্তুত থাকিত না। অকস্মাৎ শত্রুপ্রবাহমুখে পতিত হইয়া প্রায় বিনা যুদ্ধেই প্রাণ হারাইত।
এইরূপে বহুতর পাঠান-সৈন্য নিপাত হইল। পাঠানেরা অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত হইল; এবং সম্মুখ-সংগ্রামে জগৎসিংহের সৈন্য বিনষ্ট করিবার জন্য বিশেষ সযত্ন হইল; কিন্তু জগৎসিংহের সৈন্য কোথায় থাকে, কোন সন্ধান পাওয়া যায় না; কেবল যমদূতের ন্যায় পাঠান-সেনার মৃত্যুকালে একবার দেখা দিয়া মৃত্যুকার্য্য সম্পাদন করিয়া অন্তর্ধান করে। জগৎসিংহ কৌশল ময়; তিনি পঞ্চ সহস্র সেনা সর্ব্বদা একত্র রাখিতেন না; কোথায় সহস্র, কোথায় পঞ্চশত, কোথায় দ্বিশত, কোথায় দ্বিসহস্র এইরূপে ভাগে ভাগে, যখন যথায় যেরূপ শক্রর সন্ধান পাইতেন, তখন সেইরূপ পাঠাইতেন; কার্য্য সম্পাদন হইলে আর তথায় রাখিতেন না। কখন কোন্ খানে রাজপুত আছে, কোন্ খানে নাই, পাঠানেরা কিছুই স্থির করিতে পারি না। কতলু খাঁর নিকট প্রত্যহই সেনানাশের সংবাদ আসিত। প্রতে, মধ্যাহ্নে, সকল সময়েই অমঙ্গল সংবাদ আসিত। ফলে, যে কার্য্যই হউক না, পাঠান সেনার অল্প সংখ্যা দুর্গ হইতে নিষ্ক্রান্ত হওয়া দুঃসাধ্য হইল। লুঠপাঠ একেবারে বন্ধ হইল; সেনা সকল দুর্গমধ্যে আশ্রয় লইল। অধিকন্তু আহার আহরণ করা সুকঠিন হইয়া উঠিল। শত্রুপীড়িত প্রদেশ এইরূপ সুশাসিত হওয়ার সংবাদ পাইয়া মহারাজ মানসিংহ পুত্ত্রকে এই পত্র লিখিলেন,—
“কুলতিলক! তোমা হইতে রাজাধিকার পাঠানশূন্য হইবে জানিলাম; অতএব তোমার সাহায্যার্থ আর দশ সহস্র সেনা পাঠাইলাম।”
যুবরাজ প্রত্যুত্তর লিখিলেন,—
“মহারাজের যেরূপ অভিপ্রায়; আর সেনা আইসে ভাল; নচেৎ ও শ্রীচরণাশীর্ব্বাদে এ দাস পঞ্চ সহস্রে ক্ষত্রকুলোচিত প্রতিজ্ঞাপালন করিবেক।”
কুমার বীরমদে মত্ত হইয়া অবাধে রণজয় করিতে লাগিলেন। শৈলেশ্বর! তোমার মন্দিরমধ্যে যে সুন্দরীর সরল দৃষ্টিতে এই যোদ্ধা পরাভূত হইয়াছিলেন, সে সুন্দরীকে সেনাকোলাহল-মধ্যে কি তাঁহার একবারও মনে পড়ে নাই? যদি না পড়িয়া থাকে, তবে জগৎসিংহ তোমারই ন্যায় পাষাণ।