বিষয়বস্তুতে চলুন

দেওয়ানা/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

 সহস্র বৃশ্চিক দংশনের আলা, বুকে লইয়া, আনারউন্নিসা তাহার কক্ষ মধ্যে ফিরিয়া আসিল। নানাদিক দিয়া এই মাত্র পরদৃষ্ট দৃশ্যগুলি ভাবিয়া, তাহার আহত হৃদয়ের ব্যথা নিবারণের জন্য, সে অনেক চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না।

 স্বভাবতঃই আনারউন্নিসা বড়ই অভিমানিনী। অনেক সময় রাগিলে তাহার ধৈর্য্য থাকিত না। মাতৃহীনা কন্যা বলিয়া তাহার পিতা তাহাকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়া মানুষ করিয়াছিলেন। কাজেই সে অতিরিক্ত মাত্রায় অভিমানিনী হইয়া পড়িয়াছিল।

 স্ত্রীলোকে সব জিনিষের ভাগ ছাড়িয়া দিতে পারে, কিন্তু স্বামীর ভালবাসার অংশ সে কাহাকেও দিতে প্রস্তুত নহে। সুতরাং আনার উন্নিসার প্রাণে, সন্দেহের যে ধূমায়িত অগ্নি এত দিন ধরিয়া যে শক্তি সঞ্চয় করিতেছিল—সে দিনের ঘটনায় সহসা যেন তাহা প্রবল গর্জ্জনে জ্বলিয়া উঠিল। —

 কে এই বাহারবানু! এক কলঙ্কিতা, ঘৃণিতা স্বৈরিণি সে—তাহার এত স্পর্দ্ধা কেন? সে যে সহসা আসিয়া তাহার শুদ্ধান্তঃপুর কলঙ্কিত করিল, তৎসম্বন্ধে তাহাকে তিরস্কার না করিয়া এই মোহাচ্ছন্ন নবাব সুজাবেগ কিনা তাহারই তোষামোদ করিয়া, যেন তাহার পক্ষ সমর্থন করিলেন। তার উপর এই সারাদিনটা কাটিয়া গেল, তিনি তাহাকে শান্ত করিবার বা দুটা মিষ্ট কথা বলিবার জন্যও একটুও সময় পাইলেন না?

 প্রাণ ভরিয়া সর্ব্বস্ব সমর্পণ করিয়া ভালবাসার কি এই প্রতিদান! একান্ত ভাবে আত্মসমর্পণের কি এই পরিণাম! যাহার সুখ স্বচ্ছন্দের জন্য সে জীবন সমর্পণ করিয়াছে, এই কি তাহার এক প্রবণ হৃদয়। পত্নীর সহিত সঙ্গত ব্যবহার?

 যে স্বামী তাহার ইষ্ট, জীবনের ধ্রুবতারা, এ দুনিয়ার উজ্জ্বল ও পরিস্ফুট সুখ স্বপ্ন, তাহার এই কি ব্যবহার? এই কয় মাস যে নবাব সুজাবেগ যে তাহাকে কত মিষ্ট কথায়, কত মধুর প্রেম সম্বোধনে ভুলাইয়া রাখিয়াছিলেন! সে সবই কি কপটতাময়? সত্যই কি তিনি এই স্বৈরিণীর ক্রীতদাস?

 তার পর সে মনে মনে ভাবিল—“এই শয়তানী বাহারবানু যে তাহার বিবাহের পূর্ব্ব হইতেই তাহার সর্ব্বনাশের চেষ্টা করিয়া আসিতেছে। হায়! কেন সে তাহার স্বামীর নিকট বাহারবানুর সহিত পীরমহরমে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে, সমস্ত কথা গোপন করিয়া রাখিয়াছিল।”

 এই বাহারবানু যে নিশ্চয়ই কোন একটা সাংঘাতিক গোপনীয় ব্যাপারের জন্য—তাহার স্বামীর উপর এতটা আধিপত্য প্রকাশ করিতেছে, তাহা সে তাহাদের গুপ্ত কথোপকথনের শেষাংশ হইতেই বুঝিতে পারিয়াছিল। ভিতরের ব্যাপারটী যে কি, তাহা জানিবার জন্য তাহার বড়ই একটা কৌতুহল জাগিয়া উঠিল। আর এ কথাও সে ভাবিল, যে তাহার এই কৌতুহল নিবৃত্তির একমাত্র উপায়, তাহার স্বামী নবাব সুজাবেগ। কিন্তু তিনি কি তাহাকে সকল কথা সরলভাবে খুলিয়া বলিবেন?

 এই ভাবে নানাদিক দিয়া অনেক রকমের সমস্যা, তাহার ক্ষুদ্র হৃদয় খানিকে বড়ই ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল। সকল দিক দিয়া সে এই সমস্যাময় ব্যাপারের সমাধানের জন্য একটা চেষ্টা করিতে লাগিল— কিন্তু পারিল না।

 এই ভীষণ বিপদের সময় মীর লতিফের কথা সহসা তাহার মনে জাগিয়া উঠিল। সে মনে মনে ভাবিল—“হায়! মীর লতিফ্ যদি আজ আগরায় থাকিত, তাহা হইলে হয়ত সে এই বিপদ সময়ে তাহাকে একটা সৎপরামর্শ দিতে পারিত।”

 সন্ধ্যার পূর্ব্বে আনার উদ্যান ভ্রমণে বাহির হইল। অন্য দিন এই সময়ে জুমেলিকে সে সঙ্গে লয়। সে দিন সে অতি গোপনে—একাকিনীই উদ্যান মধ্যে চলিয়া গেল।

 তাহার স্বহস্ত রচিত গুলাববাগের সদ্য প্রস্ফুটিত গুলাববাসে সেই স্থান আমোদিত। আনার এই গুলাববাগের মধ্যে এক মর্ম্মরাসনে বসিয়া, নিজের অদৃষ্ট কথা চিন্তা করিতে লাগিল।

 এ চিন্তার কুল কিনারা নাই। তাহার ভবিষ্যৎ যেন বড়ই কুয়াসাচ্ছন্ন। তাহার হৃদয়ে মীর লতিফের যে একটা উজ্জ্বল ছায়া বাল্যকাল হইতে পড়িয়াছিল, যাহা তাহার হৃদয় হইতে মুছিবার কোন উপায়ই ছিল না,সে তাহাও মুছিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিয়া অনেকটা সক্ষম হইয়াছে। সুজাবেগ সম্বন্ধে সে ইতিপূর্ব্বে যে সমস্ত কুৎসার কথা শুনিয়াছিল, আর তৎসম্বন্ধে বিশ্বাসও কতকটা করিয়াছিল, সে বিশ্বাসও সে ধীরে ধীরে মুছিয়া ফেলিয়াছে। নারী জীবনের কর্ত্তব্য, পত্নীর কর্ত্তব্য পালনই, তখন তাহার শ্রেষ্ঠ ব্রত। এই ব্রত পালনের জন্য সে প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছিল।

 কত সুখের আশা, স্বপ্নের কল্পনা লইয়া, সে এই বৃহৎ পুরীর একাধিশ্বরী রাজরাণী রূপে দর্পভরে দিন কাটাইতে ছিল, কিন্তু আজ যে সে দর্প চূর্ণ হইয়াছে। নবাব সুজা খাঁর ব্যবহারে সে বুঝিয়াছে, যে তাহার স্বামীর উপর এই বিলাসিনী বাহারবানুর শক্তি তার চেয়েও বেশী।

 আনার মনে মনে বলিল— “হায়! কেন একটা নিষ্ঠুরতাবশে গোপনে থাকিয়া তাহাদের কথাবার্ত্তা শুনিলাম? কেন ইচ্ছা করিয়া প্রাণের অশান্তি ডাকিয়া আনিলাম? বাহারবানু আমার সুখের সংসারে আগুণ জ্বালাইতে আসিয়াছিল। হায়! কেন আমি বুঝিতে না পারিয়া, স্বেচ্ছায় ফুৎকার দিয়া তাহার কলুষিত চিত্তপ্রসূত সেই আগুণ জ্বালাইলাম! কেন নিজের চিত্ত মধ্যে স্বেচ্ছাসৃজিত অশান্তির সৃষ্টি করিলাম? জগতে—লোকের নেত্রান্তরালে যে কত কি ব্যাপার যে ঘটিয়া যায়। কেই বা চেষ্টা করিয়া সকল ঘটনার সংবাদ রাখে? এ ব্যাপারে এরূপ উপেক্ষার ভাব দেখাইলে ত আমি এতটা মনকষ্ট পাইতাম না।

 নারীর শক্তির কি কোন মূল্যই নাই? নারীর হৃদয়ে কি কোনই তেজোময় কার্য্যকরী শক্তি নাই? যদি থাকে, তাহা হইলে সেই শক্তির সহায়তায় আমি কি এই বাহারবানুর কবল হইতে; আমার স্বামীকে মুক্ত করিতে পারিব না?

 এই বাহারবানু অর্থের প্রয়াসিনী। আমার স্বামী আমাকে স্ত্রীধন রূপে প্রচুর অর্থ দিয়াছেন। এই অর্থবলেও কি আমি বাহারকে আমার পথ হইতে সরাইতে পারিব না?

 চেষ্টায় ক্ষতি কি? চেষ্টায় না হয় কি? বাহারবানু এই সহরের বাহিরে থাকে শুনিয়াছি। আমার কোন বিশ্বাসী গোলামকে দিয়া তাহাকে একখানি পত্র লিখিয়া পাঠাই। তাহাকে এখানে আসিতে আহ্বান করি। যদি আসে, তখন যাহা করা কর্ত্তব্য, স্বামীকে রক্ষার জন্য, পত্নীর কর্ত্তব্য পালন করিবার জন্য, তাহাই করিব।

 ঘোর অন্ধকারের মধ্যে—আলোকছটা দেখিতে পাইলে, অন্ধকারবেষ্টিত প্রান্তর পথবাহী পথিক যেমন আশান্বিত হয়, আনন্দিত হয়, আনারউন্নিসা, এই ভাবে চিন্তা করিয়া, তাহার ঘোরান্ধকারময় ভবিষ্যতের পথে যেন একটা আলো দেখিতে পাইয়া, সেইরূপ উৎফুল্লচিত্তা হইল।

 এমন সময়ে জুমেলি সেইখানে আসিয়া—বলিল—“ব্যাপার কি বেগম-সাহেবা? আমি যে তোমাকে চারি দিকে খুজিয়া বেড়াইতেছি। এখানে একলা বসিয়া কেন?”

 আনারউন্নিসা তাহার মুখের চিন্তাপূর্ণ ভাবটাকে পোপন করিয়া লইয়া, মৃদু হাস্যের সহিত বলিল—“কেন আমি কি কচি খুকী নাকি, যে জুজুতে আমায় ধরিয়া লইয়া যাইবে? এখন রাত কত হয়েছে জুমেলি?”

 জুমেলি বলিল—“ঘণ্টা- ঘর থেকে প্রথম প্রহরের ঘণ্টা যে অনেকক্ষণ বেজে গিয়েছে। এখন ঘরে চল।”

 আনার। নবাব সাহেব ফিরিয়া আসিয়াছেন কি?

 জুমেলি। তিনি এক বান্দাকে দিয়া সংবাদ পাঠাইয়াছেন, যে আজ তাঁর আসিতে একটু বেশী রাত্রি হইবে। শাহজাদার সঙ্গে তাঁর বিশেষ প্রয়োজনীয় কি একটা কাজ আছে, সেই জন্য।

 আনারউন্নিসার মুখখানা, এই কথাটা শুনিয়া অন্ধকারের মধ্যে একটু বিষণ্ণতামাখা হইয়া উঠিল। আনার পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল বলিয়া, জুমেলি তাহা দেখিতে পাইল না। এই জন্য রহস্য করিয়া বলিল, “একদিনের ঘণ্টা কয়েকের বিরহের জন্য অতটা কাতর হইলে চলিবে কেন? এখন— তোমার কক্ষে চল।”

 দুজনে সেই স্বল্পান্ধকার রাশি মথিত করিয়া ধীরে ধীরে প্রাসাদ মধ্যে প্রবেশ করিল।

 আনারউন্নিসা জুমেলিকে বলিল—“আজ আমার তবিয়ৎটা ভাল নয়। একটু সকাল সকাল শুইব। নবাব সাহেব ফিরিয়া আসিলে আমায় জাগাইয়া দিস্।”

 জুমেলি বলিল—“তাহাই হইবে। এর মধ্যে তোমার যদি কোন প্রয়োজন হয়, আমায় ডাকিও। আমি তোমার পার্শ্বের কক্ষেই রহিলাম।”

 জুমেলি চলিয়া গেল। আনারউন্নিসা, অন্ধকারময় হৃদয় লইয়া তাহার দীপালোকিত কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করিল। ধীরে ধীরে দ্বারটী বন্ধ করিয়া দিয়া, সেই দীপালোকের সম্মুখে একখানি গুলেস্তাঁ লইয়া পাঠ করিবার চেষ্টা করিল। পুস্তকে তাহার মন বসিল না। গ্রন্থখানি যথাস্থানে তুলিয়া রাখিয়া, সে চিত্তটীকে সরস করিবার জন্য তাহার বীণ‍্টা পাড়িয়া লইয়া চম্পকাঙ্গুলির সহায়তায় তাহার তারে দুই চারিবার মৃদু আঘাত করিল। কিন্তু বী‍ণ‍্টা বড়ই বেসুরা। তাহার ঝঙ্কার বড়ই কর্কশ। সে বীণ‍্টাকে অশ্রদ্ধার সহিত সোফার উপর রাখিয়া, শয্যায় শয়ন করিল। কিন্তু বোধ হয় ঘুমাইতে পারিল না।