বিষয়বস্তুতে চলুন

দেনা-পাওনা/আঠার

উইকিসংকলন থেকে

আঠার

 অলকা।

 বলুন।

 তোমার এখানে তামাক-টামাকের ব্যবস্থা নেই বুঝি?

 ষোড়শী একবার মুখ তুলিয়াই আবার অধোমুখে স্থির হইয়া রহিল।

 জবাব না পাইয়া জীবানন্দ সজোরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করিয়া বলিল, ব্রজেশ্বরের কপাল ভাল ছিল; দেবী-রানী তাকে ধরে আনিয়াছিল সত্যি, কিন্তু অম্বুরী তামাক খাইয়েছিল, এবং ভোজনান্তে দক্ষিণা দিয়েছিল। বিদায়ের পালাটা আর তুলব না, বলি, বঙ্কিমবাবুর বইখানা পড়েচ ত?

 ষোড়শী স্থির করিয়াছিল এই পাষণ্ড আজ তাহাকে যত অপমানই করুক সে নিরুত্তরে সহ্য করিবে, কিন্তু জীবানন্দের কণ্ঠস্বরের শেষ দিকটায় হঠাৎ কেমন যেন তাহার সঙ্কল্প ভাঙ্গিয়া দিল; বলিয়া ফেলিল, আপনাকে ধরে আনলে সেইমত ব্যবস্থাও থাকত―অনুযোগ করতে হতো না।

 জীবানন্দ হাসিল, কহিল, তা বটে। টানা-হেঁচড়া দড়িদড়ার বাঁধাবাঁধিই মানুষের নজরে পড়ে। ভোজপুরী পেয়াদা পাঠিয়ে ধরে আনাটাই পাড়াসুদ্ধ সকালে দেখে; কিন্তু যে পেয়াদাটিকে চোখে দেখা যায় না—হাঁ অলকা, তোমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে তাঁকে কি বলে? অতনু, না? বেশ তিনি।

 ষোড়শী আরক্ত অধোমুখে নির্বাক হইয়া রহিল।

 জীবানন্দ কহিল, যৎসামান্য অনুরোধ ছিল, কিন্তু আজ উঠি। তোমার অনুচরগুলো সন্ধান পেলে ঠিক জামাই-আদর করবে না, এমন কি শ্বশুরবাড়ি এসেচি বলে হয়ত বিশ্বাস করতেই চাইবে না―ভাববে প্রাণের দায়ে বুঝি মিথ্যেই বলচি।

 ষোড়শী কোন কথাই কহিল না; এই কদর্য পরিহাসে অন্তরে সে যে কিরূপ লজ্জা বোধ করিল, মুখ তুলিয়া তাহা জানিতেও দিল না।

 জবাব না পাইয়া জীবানন্দ মুহূর্তকয়েক তাহার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া সত্যই উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, অম্বুরী তামাকের ধুঁয়া আপাততঃ পেটে না গেলেও চলত; কিন্তু ধুঁয়া নয় এখন কিছু একটা পেটে না গেলে আর ত দাঁড়াতে পারিনে। বাস্তবিক নেই কিছু অলকা?

 ষোড়শী চুপ করিয়াই থাকিত, কিন্তু তাহার নাম ধরিয়া শেষ প্রশ্নটা তাহাকে মৌন থাকিতে দিল না, মুখ তুলিয়া বলিল, কিছু কি? মদ?

 জীবানন্দ হাসিয়া মাথা নাড়িল। কহিল, এবারে ভুল হলো। ওর জন্যে অন্য লোক আছে, সে তুমি নয়। তোমাকে বুঝতে পাবার যথেষ্ট সুবিধে দিয়েচ―আর যা অপবাদ দিই, অস্পষ্টতার অপবাদ দিতে পারব না। অতএব তোমার কাছে যদি চাইতেই হয় ত চাই এমন কিছু, যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, মরণের দিকে ঠেলে দেয় ন? ডাল-ভাত, মেঠাই-মণ্ডা, চিঁড়ে-মুড়ি যা হোক দাও, আমি খেয়ে বাঁচি। নেই?

 ষোড়শী স্থিরচক্ষে চাহিয়া রহিল। জীবানন্দ বলিতে লাগিল, সকালে আজ মন ভাল ছিল না। শরীরের কথা তোলা বিড়ম্বনা, কারণ সুস্থ দেহ যে কি, আমি জানিনে। সকালে হঠাৎ নদীর তীরে বেরিয়ে পড়লাম―ধারে ধারে কতদুর যে হাঁটলাম বলতে পারিনে―ফিরতে ইচ্ছেই হলো না। সূর্যদেব অস্ত গেলেন, একলা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি যে ভাল লাগল বলতে পারিনে! কেবল তোমাকে মনে পড়তে লাগলো। ফেরার পথে তাই বোধ হয় আর বাড়ি গেলাম না, ক্ষিদে-তেষ্টা নিয়েই এসে দাঁড়ালাম ওই মনসা গাছটার পেছনে। দেখি দোর খোলা, আলো জ্বলছে। পিস্তল ছাড়া আমি এক পা বাড়াইনে—ওটা পকেটেই ছিল, তবু গা ছমছম করতে লাগিল। জানি ত বাবাজীবনরা আড়ালে আবডালে কোথাও আছেন নিশ্চয়। হঠাৎ পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি মেঝের ওপর তুমি চুপ করে বসে। আপনাকে আর সামলাতে পারলাম না। বাস্তবিক নেই কিছু?

 ষোড়শী একমুহূর্ত ইতস্ততঃ করিয়া কহিল, কিন্তু বাড়ি গিয়ে ত অনায়াসে খেতে পারবেন।

 জীবানন্দ কহিল, অর্থাৎ আমার বাড়ির খবর আমার চেয়ে বেশী জানো। বলিয়া সে একটু হাসিল। কিন্তু সে হাসি না মিলাতেই ষোড়শী হঠাৎ বলিয়া উঠিল, আপনি সারাদিন খাননি, আর বাড়িতে আপনার খাবার ব্যবস্থা নেই, এ কি কখনো হতে পারে?

 একজনের কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার আভাস গোপন রহিল না, কিন্তু আর একজন নিতান্ত ভালমানুষটির মত শান্তভাবে বলিল, পারে বৈ কি। আমি খাইনি বলে আর একজন উপোস করে থালা সাজিয়ে পথ চেয়ে থাববে, এ ব্যবস্থা ত করে রাখিনি।

 আজ খামকা রাগ করলে চলবে কেন অলকা। বালিয়া সে তেমনি একটু মৃদু হাসিয়া কহিল, আজ আসি! কিন্তু সত্যি সত্যি থাকতে না পেরে যদি আর কোনাদিন এসে পড়ি ত রাগ করতে পাবে না বলে যাচ্ছি।

 এই লোকটির একান্ত বিশৃঙ্খল জাবনযাত্রার যে চেহারা একদিন ষোড়শী নিজের চোখে দেখিয়াছিল তাহা মনে হইল। মনে হইল, কদাচারী, মদোন্মত্ত, নিষ্ঠুর মানুষ এ নয়; যে জমিদার মিথ্যা দিয়া তাহার সর্বনাশ করিতে উদ্যত হইয়াছে, সে আর কেহ। সে আর কেহ যে সেদিন মন্দির হইতে বিদায় দিতে তাহাকে অসঙ্কোচে হুকুম দিয়াছিল। তবু একবার দ্বিধা করিল, কিন্তু পরক্ষণেই অস্ফুটে কহিল, দেবীর প্রসাদ সামান্য কিছু আছে, কিন্তু সে কি আপনি খেতে পারবেন?

 পারব না? তাই বল! বলিয়া সে আসনে ফিরিয়া গিয়া চাপিয়া বসিয়া পড়িয়া কহিল, প্রসাদ খেতে পারব না? শিগগির নিয়ে এসো, ঠাকুর-দেবতার প্রতি আমার কিরূপ অচলা ভক্তি একবার দেখিয়ে দিই!

 তাহার সুমুখের স্থানটুকু ষোড়শী জল-হাত দিয়া মুছিয়া লইল, এবং রান্নাঘরে গিয়া শালপাতায় করিয়া ঠাকুরের প্রসাদ যাহা কিছু ছিল, বহিয়া আনিয়া জীবানন্দের সম্মুখে রাখিয়া দিয়া বলিল, দেখুন যদি খেতে পারেন।

 জীবানন্দ ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সে দেখতে হবে না, কিন্তু এ ত তোমার জন্যে?

 ষোড়শী কহিল, অর্থাৎ আপনার জন্যে আলাদা করে এনে রেখেছিলাম কি না তাই জিজ্ঞাসা করচেন?

 জীবানন্দ হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, না গো না, তা জিজ্ঞাসা করিনি, আমি জিজ্ঞেসা করচি, আর নেই ত?

 ষোড়শী কহিল, না।

 তা হলে এ যে পরের মুখের গ্রাস এক রকম কেড়ে খাওয়া অলকা?

 ষোড়শী কহিল, পরের মুখের গ্রাস কেড়ে খেলে কি আপনার হজম হয় না?

 এ কথার উত্তর জীবানন্দ আর হাসিমুখে দিতে পারিল না। কহিল, কি জানি, নিশ্চয় কিছুই বলা যায় না অলকা। কিন্তু সে যাক, তুমি খাবে কি? বরঞ্চ অর্ধেকটা রেখে দাও।

 ষোড়শী কহিল, তাতে আমারও হবে না, আপনারও পেট ভরবে না!

 জীবানন্দ জিদ করিয়া কহিল, না ভরুক, কিন্তু তোমাকে ত সারা রাত্রি অনাহারে থাকতে হবে না।

 আজ খাবার কথা ষোড়শীর মনেও ছিল না―জীবানন্দ না আসিলে ও সকল পড়িয়াই থাকিত, সে হয়ত স্পর্শও করিত না। কিন্তু সে কথা না বালিয়া কহিল, ভৈরবীদের অনাহার অভ্যাস করতে হয়। তা ছাড়া আমার একটা রাত্রির কষ্টের ভাবনা ভেবে আপনি কষ্ট না-ই পেলেন। বরঞ্চ মিথ্যে দেরি না করে বসে যান; ঠাকুর-দেবতার প্রসাদের প্রতি অচলা ভক্তির সাফাই প্রমাণ দিন।

 তা দিচ্ছি, কিন্তু তোমাকে বঞ্চিত করছি জেনে সে উৎসাহ আর নেই―

 বেশ, কম উৎসাহ নিয়েই শুরু করুন। বলিয়া ষোড়শী একটু হাসিয়া কহিল. আমাকে বঞ্চনা করায় নতুন অপরাধ আর আপনার হবে না। কিন্তু যা নিয়ে তর্ক চালিয়েচেন তাতে আমারি লজ্জা করচে! এবার থামুন।

 জীবানন্দ আর কথা না কহিয়া খাইতে আরম্ভ করিল। মিনিট-দুই পরে হঠাৎ মুখ তুলিয়া তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, প্রায় পনর বছর হলো, না? আজ একটা বড়লোক হতে পারতাম।

 ষোড়শী নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল। প্রায় বছর পনর পূর্বের ইঙ্গিতটা সে বুঝিল কিন্তু শেষের কথাটা বুঝিল না।

 জীবানন্দ কহিতে লাগিল, আর সমস্ত ছেড়ে দিয়ে মদের কথাটাই ধরি। মরতে বসেচি―সে ত নিজের চোখেই দেখে এসেচ, কিন্তু এমন একটা শক্ত লোক কেউ নেই যে আমাকে মুক্ত করে দেয়। হয়ত আজও সময় আছে, হয়ত এখনো বাঁচতে পারি―নেবে আমার ভার অলকা?

 ষোড়শী অন্তরে কাঁপিয়া উঠিয়া চোখ বুজিল। সেখানে হৈম, তাহার স্বামী, তাহার ছেলে, তাহার দাসদাসী, তাহার সংসারযাত্রার অসংখ্য বিচিত্র ছবি ছায়াবাজির মত খেলিয়া গেল।

 জীবানন্দ কহিল, আমার সমস্ত ভার তুমি নাও অলকা―

 আত্মসমর্পণের এই আশ্চর্য কণ্ঠস্বর ষোড়শীকে চমকাইয়া দিল। এ জীবনে এমন করিয়া কেহ তাহাকে ডাকে নাই, ইহা একেবারে নূতন। কিন্তু ভৈরবী-জীবনের সংযমের কঠোরতা তাহাকে আত্মবিস্মৃত হইতে দিল না। সে একমুহূর্ত থামিয়া কহিল, অর্থাৎ আমার যে কলঙ্কের বিচার করেছেন, আমাকে দিয়ে তাকেই প্রতিষ্ঠিত করিয়ে নিতে চান। আমার মাকে ঠকাতে পেরেছিলেন, কিন্তু আমাকে পারবেন না।

 কিন্তু সে চেষ্টা ত আমি করিনি। না জেনে আমি তোমার প্রতি দুর্ব্যবহার করেচি তা সত্যি। তোমার বিচার করচি, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। কেবলি মনে হয়েচে, এতবড় কঠিন মেয়েমানুষটিকে অভিভূত করেছে, সে মানুষটি কে?

 ষোড়শী আশ্চর্য হইয়া কহিল, তারা আপনার কাছে তার নাম বলেনি?

 জীবানন্দ কহিল, না। আমি বার বার জিজ্ঞাসা করেছি, তারা বার বার চুপ করে গেছে।

 আপনি খান, বলিয়া ষোড়শী স্তব্ধ হইয়া রহিল।

 দুই-চারি গ্রাস আহারের পর জীবানন্দ মুখ তুলিয়া বলিল, আম বেশী খেতে পারিনে―

 বেশি খেতে আপনাকে বলিনে। সাধারণ লোকে যা খায়, তাই খান।

 আমি তাও পারিনে। খাওয়া আমার শেষ হয়ে গেছে।

 ষোড়শী কহিল, না, হয়নি। প্রসাদের ওপর অভক্তি দেখালে বাবাজীবনদের ডেকে দেব?

 জীবানন্দ হাসিয়া বলিল, সে তুমি পারবে না। তোমার জোর আমি জানি। পুলিশের দল থেকে মায় ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবাটি পর্যন্ত একদিন তার নমুনা জেনে গেছেন। তোমার মা যে একদিন আমার হাতে তোমাকে সঁপে দিয়ে গেছেন এ অস্বীকার করবার সাধ্য তোমার নেই।

 ষোড়শী চুপ করিয়া রহিল, জীবানন্দ হাতমুখ ধুইয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিল, কহিল, আমি যখন একলা থাকি, সে রাত্রের কথা মনে মনে আলোচনা করে কোথা দিয়ে যে সময় কাটে বলতে পারিনে। বিশেষ করে চাকরদের ঘরে পাঠানোর ভয়ে তোমার সেই হাতজোড় করে কান্না! ভোলনি বোধহয়?

 ষোড়শী কহিল, না।

 জীবানন্দ বলিল, তার পরে সেই শুলব্যথা; একলা ঘরে তুমি আর আমি! শেষে তোমার কোলেই মাথা রেখে আমার রাত কাটল। তারপরের ঘটনাগুলো আর ভাবতে ভাল লাগে না। তোমাকে ঘুষ দিতে যাবার কথা মনে হলে আমার পর্যন্ত যেন লজ্জায় গা শিউরে উঠে। এই সেদিন পুরীতে যখন মর-মর হলাম, প্রফুল্ল বললে, দাদা, অলকাকে একবার আনিয়ে নিন। আমি বললাম, সে আসবে কেন? প্রফুল্ল বললে, গায়ের জোরে। আমি বললাম, গায়ের জোরে ধরে এনে লাভ হবে কি? সে উত্তর দিলে, ঠাকরুন একবার আসুন ত, তার পরে এর লাভ-লোকসানের হিসেব হবে। তাকে তুমি জানো না, কিন্তু এতবড় ভক্ত তোমার আর নেই।

 এই লোকটির পরিচয় জানিতে ষোড়শীর কৌতূহল হইল, কিন্তু সে ইচ্ছা সে দমন করিয়া রাখিল।

 জীবানন্দ কহিল, রাত অনেক হলো, তোমাকে আর বসিয়ে রাখতে পারিনে। এবার আমি যাই, কি বল?

 ষোড়শী কহিল, আপনার কি একটা যে কাজের কথা ছিল?

 কাজের কথা? কিন্তু বিশেষ কি কথা ছিল আমার আর মনে পড়চে না। এখন কেবল একটা কথাই মনে পড়চে, তোমার সঙ্গে কথা কহাই আমার কাজ। বড্ড খোশামোদের মত শোনাল, না? কিন্তু এরকম খোশামোদ করতেও যে পারি, এর আগে তাও জানতাম না। হাঁ অলকা, তোমার কি সত্যি আবার বিয়ে হয়েছিল?

 ষোড়শী মুখ তুলিয়া কহিল, আবার কি রকম? সত্যি বিয়ে আমার একবার মাত্রই হয়েছে।

 জীবানন্দ বলিল, আর তোমার মা যে আমাকে দিয়েছিলেন, সেটাই কি সত্যি নয়?

 ষোড়শী তৎক্ষণাৎ অসঙ্কোচে কহিল, না, সে সত্যি নয়! মা আমার সঙ্গে যে টাকাটা দিয়োছলেন আপনি তাই শুধু নিয়েছিলেন, আমাকে নেননি। ঠকানো ছাড়া তার মধ্যে লেশমাত্র সত্য কোথাও ছিল না।

 জীবানন্দ স্থির হইয়া বসিয়া রহিল, কোনপ্রকার উত্তর দিবার চেষ্টা পর্যন্ত করিল না। মিনিট-পাঁচেক যখন এইভাবে কাটিয়া গেল, তখন ষোড়শী মনে মনে চঞ্চল হইয়া উঠিল, এবং ম্লান দীপশিখা উজ্জ্বল করিয়া দিবার অবসরে চাহিয়া দেখিল, সে যেন হঠাৎ ধ্যানে বসিয়া গেছে। এই ধ্যান ভাঙ্গিতে তাহার দ্বিধা বোধ হইল, কিন্তু ক্ষণেক পরে সে নিজেই যখন কথা কহিল, তখন মনে হইল কে যেন কতদূর হইতে কথা কহিতেছে।

 অলকা, এ কথা তোমার সত্য নয়।

 কোন্‌ কথা?

 জীবানন্দ কহিল, তুমি যা জেনে রেখেচ। ভেবেছিলাম সে কাহিনী কখনো কাউকে বলব না, কিন্তু সেই কাউকের মধ্যে আজ তোমাকে ফেলতে পারচিনে। তোমার মাকে ঠকিয়েছিলাম, কিন্তু তোমাকে ঠকাবার সুযোগ ভগবান আমাকে দেননি। আমার একটা অনুরোধ রাখবে!

 বলুন।

 জীবানন্দ কহিল, আমি সত্যবাদী নই, কিন্তু আজকের কথা আমার তুমি বিশ্বাস কর। তোমার মাকে আমি জানতাম, তাঁর মেয়েকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করার মতলব আমার ছিল না―ছিল কেবল তাঁর টাকাটাই লক্ষ্য, কিন্তু সে রাত্রে হাতে হাতে তোমাকে যখন পেলাম, তখন না বলে ফিরিয়ে দেবার ইচ্ছেও আর হলো না।

 তবে কি ইচ্ছে হলো?

 জীবানন্দ কহিল, থাক, সে তুমি আর শুনতে চেয়ো না। হয়ত শেষ পর্যন্ত শুনলে আপনিই বুঝবে, এবং সে বোঝায় ক্ষতি বৈ লাভ আমার হবে না, কিন্তু এরা তোমাকে যা বুঝিয়েছিল তা তাই নয়, আমি তোমাকে ফেলে পালাইনি!

 ষোড়শী এই ইঙ্গিত বুঝিল, এবং ঘৃণায় কণ্টকিত হইয়া কহিল, আপনার না-পালানোর ইতিবৃত্ত এখন ব্যক্ত করুন।

 তাহার কঠোর কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করিয়া জীবানন্দ মুচকিয়া হাসিল। কহিল, অলকা, আম নির্বোধ নই, যদি ব্যক্তই করি, তার সমস্ত ফলাফল জেনেই করব। তোমার মায়ের এতবড় ভয়ানক প্রস্তাবেও কেন রাজি হয়েছিলাম জানো? একজন স্ত্রীলোকের হার আম চুরি করি; ভেবেছিলাম টাকা দিয়ে তাকে শান্ত করব। সে শান্ত হলো, কিন্তু পুলিশের ওয়ারেণ্ট তাতে শান্ত হলো না। ছ’মাস জেলে গেলাম―সেই যে শেষ রাত্রে বার হয়েছিলাম, আর ফেরবার অবকাশ পেলাম না।

 ষোড়শী নিঃশ্বাস রুদ্ধ করিয়া কহিল, তার পরে?

 জীবানন্দ তেমনি মৃদু হাসিয়া বলিল, তার পরেও মন্দ নয়। জীবানন্দবাবুর নামে আরও একটা ওয়ারেণ্ট ছিল। মাসখানেক পূর্বে রেলগাড়িতে একজন বন্ধু সহযাত্রীর ব্যাগ নিয়ে তিনি অন্তর্ধান হন। ফলে আরও দেড় বৎসর। একুনে এই বছর-দুই নিরদ্দেশের পর বীজগাঁয়ের ভাবী জমিদারবাবু আবার যখন রঙ্গমঞ্চে পুনঃপ্রবেশ করলেন, তখন কোথায় বা অলকা, আর কোথায় বা তার মা।

 জীবানন্দের আত্মকাহিনীর এক অধ্যায় শেষ হইল। তার পরে দু’জনেই নিঃশব্দে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।

 রাত কত?

 বোধহয় আর বেশী বাকী নেই।

 তা হলে এ অন্ধকারে বাড়ি গিয়ে আর কাজ নেই।

 কাজ নেই? তার মানে?

 ষোড়শী কহিল, কম্বলটা পেতে দিই, আপনি বিশ্রাম করুন।

 জীবানন্দের দুই চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া উঠিল, কইল, বিশ্রাম করব? এখানে?

 ষোড়শী কহিল, ক্ষত কি?

 কিন্তু বড়লোক জমিদারের যে এখানে কষ্ট হবে অলকা?

 ষোড়শী বলিল, হলেও থাকতে হবে। গরীবের দুঃখটা আজ একটুখানি জেনে যান।

 জীবানন্দ চুপ করিয়া রহিল। তাহার চোখের কোণে জল আসিতেছিল, ইচ্ছা হইল বলে, আমি জানি সব, কিন্তু বুঝিবার মানুষটা যে মরিয়াছে। কিন্তু এ কথা না বলিয়া কহিল, যদি ঘুমিয়ে পড়ি অলকা?

 অলকা শান্তভাবে জবাব দিল, সে সম্ভাবনা ত রইলই।