ধম্মপদ (সতীশচন্দ্র মিত্র)/তৃষ্ণাবর্গ
চতুর্ব্বিংশতিতম সর্গ―তৃষ্ণাবর্গ।
তত্ত্বজ্ঞান-বিরহিত যে মানব হয়,
লতার সমান তা’র তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায়;
ফললোভী কপি যথা বনের ভিতর
বৃক্ষ হ’তে বৃক্ষান্তরে ভ্রমে নিরন্তর,
কর্ম্মফল ভুঞ্জিবারে তেমতি সেজন
বারংবার জন্মান্তর করয়ে গ্রহণ॥১॥
বিষময়ী বুদ্ধিশীলা তৃষ্ণা একবার
অভিভূত করে ভবে মানস যাহার,
দুঃখ তা’র ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়,
মেঘের বর্ষণে যথা তৃণের উদয়॥২॥
দুর্দ্ধর্ষা বর্দ্ধনশীলা তৃষ্ণাকে যেজন
অভিভূত করিবারে পারেন কখন,
পদ্ম-পত্র হ’তে ভ্রষ্ট বারি বিন্দুপ্রায়
তাহার সকল দুঃখ দূরেতে পলায়॥৩॥
তাই বলি সমাগত মানব সকল
তোমাদের সকলের হউক মঙ্গল
উষীরার্থ তৃণমূল খনহ যেমন
সমূলে নির্ম্মূল কর তৃষ্ণায় তেমন;[১]
খরস্রোতা তরঙ্গিনী প্রবাহের ভরে
তীরজাত নলে যথা বক্রীভূত করে,
সেইরূপ তোমাদের পাপ প্রলোভন,
পুনঃ পুনঃ যেন নাহি করে আক্রমণ॥৪॥
বৃক্ষমূল থাকে যদি দৃঢ় অখণ্ডিত,
সে যেমন তাহাতেও হয় অঙ্কুরিত,[২]
সেইরূপ তৃষ্ণাধার উচ্ছিন্ন না হ’লে
পুনঃ পুনঃ পড়ে লোক দুঃখের কবলে॥৫॥
যাহার ছত্রিশ স্রোত সুখের লাগিয়া?[৩]
অবিরাম সুখ পথে যাইছে বহিয়া
তৃষ্ণোদ্ভব অভিলাষ-তরঙ্গ তেমন,
দৃষ্টিহীন ভ্রান্তে করে বিপথে চালন॥৬॥
তৃষ্ণাস্রোত সর্ব্বদিকে প্রবাহিত রয়,
তৃষ্ণালতা সর্ব্বক্ষণ অঙ্কুরিত হয়,
লতা যবে অঙ্কুরিত হইতে দেখিবে
প্রজ্ঞা দ্বারা মূল তা’র বিচ্ছিন্ন করিবে॥৭॥৩৪০॥
দেহীর নিকট সুখ প্রিয় অতিশয়
সর্ব্বত্র সে ভ্রমে তাই সুখের আশায়
তৃষ্ণাস্রোতে ভাসমান সুখান্বেষী নর
ধরাতলে জন্মজরা ভুঞ্জে বারংবার॥৮॥
তৃষ্ণাক্লিষ্ট মানবেরা ঘূর্ণমান হয়
জালবদ্ধ ব্যতিব্যস্ত শশকের প্রায়;
বিষয়-পঞ্চক ঘোর, পঞ্চেন্দ্রিয় আর,—
দশবিধ শৃঙ্খলেতে বদ্ধ নিরন্তর—
মানবেরা নানা দুঃখ ভুঞ্জে অনিবার
তৃষ্ণার নিঃশেষ বিনা নাহিক নিস্তার॥৯॥
তৃষ্ণামুগ্ধ মানবেরা ঘূর্ণমান হয়
জালবদ্ধ ব্যতিব্যস্ত শশকের প্রায়;
অতএব করিবারে তৃষ্ণা নিবারণ
হইবে বৈরাগ্যকামী যত ভিক্ষুগণ॥১০॥
বন হ’তে বহুযত্নে আসিয়া বাহিরে
পুনঃ সে প্রবেশ করে বনের ভিতরে,
ভাগ্যক্রমে মুক্তি পেয়ে সে মানব হায়
বন্ধনের পানে পুনঃ ভ্রমক্রমে ধায়।
সেইরূপ তৃষ্ণা হ’তে পাইয়া নিস্তার
তৃষ্ণায় যে অভিভূত হয় পুনর্ব্বার
সেজন প্রকৃত পক্ষে মুক্ত হয় নাই,
তাহাকে মোহেতে বদ্ধ দেখিবারে পাই॥১১॥
লৌহ কাষ্ঠ কিম্বা তৃণ নির্ম্মিত বন্ধন
দূঢ় বলি বিজ্ঞজনে না ধরে কখন,
মণিরত্ন পুত্রদারে আসক্তি যে হয়
সুদৃঢ় বন্ধন তা’য় বিজ্ঞজনে কয়।
ইতস্ততঃ আকর্ষণ করে যে বন্ধনে
শিথিল বলিয়া যাহা বোধ হয় মনে
যা’হতে সহজে কিন্তু না হয় মোচন
সে বন্ধন দৃঢ় বলি জানে বিজ্ঞজন।
সে বন্ধন ছিন্ন করি বিরাগী যেজন
কাম সুখ ত্যজি করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ॥১২-১৩॥
ঊর্ণনাভ নিজকৃত আনায় মাঝারে
বদ্ধ হ’য়ে অবিরত বিচরণ করে;
সেইরূপে সংসারেতে সমাসক্ত জন,
আত্মকৃত মোহজালে বদ্ধ অনুক্ষণ;
পণ্ডিতেরা এই জাল করিয়া ছেদন
করেন ত্যজিয়া দুঃখ, বৈরাগ্য গ্রহণ॥১৪॥
সম্মুখে পশ্চাতে কিম্বা মধ্যভাগে আর
ত্যাগ কর যাহা কিছু আছয়ে তোমার;
যা’ কিছু আসক্তি আছে করিয়া বর্জ্জন,
সংসারের পরপারে করহ গমন;
সর্ব্বভাবে মুক্তচিত্ত হইলে এ ভবে
জন্ম জরা আর তব লভিতে না হবে॥১৫॥
সন্দেহ দোলায় যা’র আন্দোলিত মন,
তীব্র অনুরাগে সদা আক্রান্ত যেজন
সুখের সন্ধানে চিত্ত ব্যন্ত যা’র রয়,
তৃষ্ণা তা’র অতিশয় বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়;
সুদৃঢ় করয়ে সেই নিজের বন্ধন
সাধ্য নাই সে বন্ধন করিবে খণ্ডন॥১৬॥
সন্দেহের নিবারণে নিরত যেজন
সর্ব্বদা আসক্তি সব করি বিসর্জ্জন—
দেহাদির মলিনতা যে করে চিন্তন,
সেজন ছেদন করে মোহের বন্ধন॥১৭॥৩৫০॥
তৃষ্ণা ভয় পাপশূন্য নিষ্ঠাবান নর
ত্যজিতে সংসার শল্য সতত তৎপর,
এইবার শেষ দেহ নিশ্চয় তাহার
শরীর ধরিতে তার হইবে না আর॥১৮॥
তৃষ্ণা আর মায়া যিনি করেন বর্জ্জন,
শব্দ কিম্বা অর্থ মর্ম্ম বুঝেন যেজন,
অক্ষরের সন্নিবেশ, পূর্ব্বাপর জ্ঞান
সম্যক্ যাহার আছে, সেজন প্রধান;
এইবার শেষ দেহ নিশ্চয় তাহার,
শরীর ধরিতে তা’র হইবে না আর।
মহাপ্রাজ্ঞ, নরশ্রেষ্ঠ লোকে তা’কে বলে—
এ হেন মানব ধন্য এই ধরাতলে॥১৯॥
সকল রিপুকে আমি করিয়াছি জয়,
অবগত আছি আমি সকল বিষয়,
সংসারে নির্লিপ্ত আমি সর্ব্বত্যাগী আর,
তৃষ্ণাক্ষয়ে মুক্তি লাভ হয়েছে আমার,
এ সকল বিষয় জানিয়া বিশেষ
বল দেখি কা'রে আমি করিব উদ্দেশ?[৪]॥২০॥
ধর্ম্মদান সর্ব্বদানে পরাভূত করে[৫]
ধর্ম্মরস সর্ব্বরস শ্রেষ্ঠ বলি ধরে;
ধর্ম্মজাত আনন্দের নাহিক তুলনা,
তৃষ্ণাক্ষয়ে নষ্ট হয় যতেক যাতনা॥২১॥
ভবপারে যেতে যা'র নাহিক মনন,
ভোগসুখে নষ্ট হয় দুর্ব্বুদ্ধি সেজন,
ভোগতৃষ্ণা সমাসক্ত হ'য়ে সে ধরায়
আপনাকে নাশ করে নির্ব্বোধের প্রায়॥২২॥
তৃণদোষে ক্ষেত্র হয় যেমন নিষ্ফল,[৬]
অনুরাগে নষ্ট হয় মানব সকল;
অনাসক্ত জনে তাই কর যদি দান
সে দানেতে মহাফল করিবে প্রদান॥২৩॥
তৃণের বাহুল্যে ক্ষেত্র যেমন নিষ্ফল,
বিদ্বেষের ফলে নষ্ট মানব সকল;
বিদ্বেষ বিহীনে তাই কর যদি দান,
সে দানে নিশ্চয় করে সুফল প্রদান॥২৪॥
তৃণদোষে ক্ষেত্র হয় যেমন নিষ্ফল,
মোহবশে নষ্ট হয় মানব সকল,
মোহহীন নরে তাই কর যদি দান,
সে দানেতে মহাফল করিবে প্রদান॥২৫॥
তৃণের বাহুল্যে ক্ষেত্র যেমন নিষ্ফল
আসক্তিতে নষ্ট হয় মানব সকল।[৭]
আসক্তি-বিহীন নরে কর যদি দান,
সে দানে নিশ্চয় করে সুফল প্রদান॥২৬॥৩৫৯॥
- ↑ উষীর = বীরণ বা বেণার মূল। তোমরা উষীরার্থী হইলে যেরূপ বেণার মূল উৎপাটিত করিয়া থাক, সেইরূপ যদি দুঃখ দূর করিতে চাও, তাহা হইলে তৃষ্ণার মূল উৎপাটিত কর।
- ↑ মূলে “দলহ” শব্দ আছে, উহার অর্থ দৃঢ়। চারুবাবুর পুস্তকের প্রথম সংস্করণে দলহ শব্দে “বৃক্ষের দল” এইরূপ অর্থ করিয়াছেন। বৃক্ষের মূল যদি দৃঢ় ও অখণ্ডিত থাকে, তাহা হইলে তাহার শাখা প্রশাখা ছিন্ন করিলেও যেমন বৃক্ষ মরে না, পরন্তু পুনঃ পুনঃ অঙ্কুরিত হয়, সেইরূপ কতকগুলি তৃষ্ণাকে বিনাশ করিলে তৃষ্ণার হস্তে নিস্তার পাওয়া যায় না, পরন্তু যাহা হইতে তৃষ্ণার উৎপত্তি সেই মূল বিনাশ করাই অবশ্য কর্ত্তব্য। এস্থলে ইহাই বিশদার্থ
- ↑ ছত্রিশটি দ্বারের মধ্যে ১৮টি বাহ্যদ্বার ও ১৮টি আন্তরদ্বার। পঞ্চেন্দ্রিয় ও মন, তদ্বিষয়ক ছয়টি বিজ্ঞান এবং রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ ও ধর্ম্ম―এই অষ্টাদশটি দ্বার। অন্তর্বাহ্যভেদে, ইহাই ছত্রিশটি হয়।
- ↑ অর্থাৎ কাহাকেও উদ্দেশ বা সন্ধান করিবার প্রয়োজন নাই। যে ব্যক্তি উপরোক্ত প্রকারে জ্ঞান লাভ করিয়াছেন, তাঁহার আর অন্য গুরুর আবশ্যকতা নাই।
- ↑ ধর্ম্মদান is the technical term for instruction in the Buddhist religion. See Buddhaghosa's Parables.
- ↑ তৃণদোষে = তৃণ-বাহুল্যে।
- ↑ মূলে “ইচ্ছা দোষে” কথা আছে; সে স্থলে ইচ্ছা শব্দের অর্থ—“আসক্তি” বা “লোভ” বলিতে হইবে। “Mankind is damaged by lust”―Max Müller.