ধম্মপদ (সতীশচন্দ্র মিত্র)/মল বর্গ
অষ্টাদশ সর্গ—মলবর্গ।
সম্প্রতি রয়েছ তুমি জীর্ণপত্র প্রায়,
উপস্থিত যমদূত লইতে তোমায়;
আছ দাঁড়াইয়া তুমি গমনের দ্বারে
পাথেয় কিছুই নাই তোমার ভাণ্ডারে॥১॥২৩৫॥
আপনাকে কর দীপ্ত প্রদীপের প্রায়[১]
হও সুপণ্ডিত, কর উদ্যোগ ত্বরায়;[২]
হইবে নির্ধূতমল নির্দ্দোষ যখন
দিব্য আর্য্যলোকে তুমি করিবে গমন॥২॥
উপনীত হইয়াছ বার্দ্ধক্যে এখন
উপনীত হইয়াছ যমের সদন
নাহিক আশ্রয় স্থান পথের ভিতরে
পথের সম্বল কিছু নাহিক ভাণ্ডারে॥৩॥
আপনাকে কর দীপ্ত প্রদীপের প্রায়
সুপণ্ডিত হও, কর উদ্যোগ ত্বরায়,
হইবে নির্ধূতমল, নির্দ্দোেষ যখন
জন্ম জরা প্রাপ্তি তব না হবে কখন॥৪॥২৩৮॥
রজতের মলা দুর করে কর্ম্মকার,
সেরূপ মেধাবী জন মলা আপনার
ক্ষণে ক্ষণে অল্পে অল্পে করি বিদূরিত,
নির্দ্দোষ নির্ধূতমল হন সুপণ্ডিত॥৫॥
লৌহ হ'তে জাত মলা লৌহে নাশ করে,
লোকের কুকার্য্য তা'র দুর্গতির তরে॥৬॥২৪০
মন্ত্রের প্রকৃত মলা অনাবৃত্তি তা'র,
লোকের গৃহের মলা হয় অসংস্কার,
মানব দেহের মলা আলস্য অসার,
রক্ষকের মলা হয় প্রমাদ তাহার[৩]॥৭॥
স্ত্রীলোকের মলা হয় চরিত্র বিকার,
মাৎসর্য্য নিকৃষ্ট মলা জানিবে দাতার;
ইহলোক পরলোক,―যেখানেই হয়,
পাপধর্ম্ম ঘোর মলা জানিবে নিশ্চয়॥৮॥[৪]
এ সব অপেক্ষা আছে আরও ঘৃণিত
অবিদ্যা[৫] নিকৃষ্ট মলা জানিবে নিশ্চিত;
ভিক্ষুগণ! এই মল করিয়া বর্জ্জন,
নির্ম্মল পবিত্র শুদ্ধ হও সর্ব্বক্ষণ॥৯॥
নির্লজ্জ অহিত-কারী ভীরু দুরাচার
অসংসাহসিক আর প্রগল্ভ যে নর,
অদ্ভুত সংসারে তার নাহি বিড়ম্বন
স্বচ্ছন্দে কাটিয়া যায় তাহার জীবন॥১০॥
লজ্জাশীল, নিত্যশৌচী জ্ঞানপরায়ণ
অপ্রগল্ভ শুদ্ধাচারী নির্লিপ্ত যেজন,
অতি কষ্টে গত হয় জীবন তাহার
আশ্চর্য্য ভবের লীলা কি বলিব আর!॥১১॥
প্রাণনাশ করে কিম্বা মিথ্যা কথা কয়
না চাহিয়া পর দ্রব্য যেইজন লয়
পরদারে উপরত সুরাসেবী জন
নিজেই নিজের হয় ধবংসের কারণ॥১২-১৩॥
এবম্বিধ অসংযত যেই জন হায়!
হে মানব! পাপাচারী জানিবে তাহায়;
লোভ বা অধর্ম্ম হ’তে হও সাবধান
দেখিও তাহারা যেন না করে বন্ধন॥১৪॥
যথাসাধ্য যথেচ্ছায় লোকে করে দান।
অপরের পানাহার দেখিয়া যেজন,
ক্রুদ্ধ হ’য়ে দুঃখবোধ করে অনুক্ষণ
দিবানিশি শান্তি নাহি পায় সে কখন॥১৫॥
ক্রোধভাব উৎপাটিত সমূলে যাহার
পরম শান্তিতে যায় দিবা নিশি তা’র॥১৬॥২৫০
আসক্তির তুল্য নাই বিষম অনল,
দ্বেষ সম নাহি হিংস্র গ্রাহ মহাবল;
মোহের সমান জাল কে করে বিস্তার?
বেগবতী নদী কোথা, তৃষ্ণা যে প্রকার?॥১৭॥
অতি শীঘ্র পরদোষ স্পষ্ট দেখা যায়,
আপনার দোষ কেহ দেখিতে না পায়;
ভুষি যথা ধুনাইয়া বেশী করা যায়
চেষ্টা করি পরদোষ তেমতি বাড়ায়;
শঠ করে ক্রীড়কের পাশক হরণ
নিজদোষ তেম্নি লোকে করয়ে গোপন॥১৮॥
যেজন পরের ছিদ্র করে অন্বেষণ
অথচ ক্রোধের বাধ্য সদা যার মন,
তাহার সকল দোষ হয় সম্বর্দ্ধিত
দোষক্ষয় হ’তে সেই দূরে অবস্থিত॥১৯॥
আকাশে নাহিক পথ করিতে গমন[৬]
বাহ্যকর্ম্মে কোন লোক না হয় শ্রমণ।
সাধারণ লোকে সবে প্রপঞ্চে মোহিত
বুদ্ধগণ কভু তাহে নহে বশীভূত॥২০॥
আকাশে নাহিক পথ করিতে গমন
বাহ্যকর্ম্মে কোন লোক না হয় শ্রমণ;
সংস্কার সকল নহে নিত্য বর্ত্তমান
বুদ্ধগণ কভু নাহি বিচলিত হন॥২১॥
- ↑ স্বয়ং বুদ্ধের একটি নাম―দীপঙ্কর অর্থাৎ যিনি অন্যকে প্রদীপ্ত করেন।
- ↑ এখানে “উদ্যোগ কর” না বলিয়া কেহ কেহ “প্রয়াণ (depart) কর” বলিয়া অনুবাদ করেন।
- ↑ প্রমাদ=অনবধানতা, Carelessness। রক্ষক বা চৌকিদার সতত সতর্ক না হইলে কর্ত্তব্য পালন করিতে পারে না।
- ↑ পাপধর্ম্ম=দুষ্টস্বভাব।
- ↑ চীনদেশীয় গ্রন্থে এস্থলে “মোহ” শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে।
- ↑ মূলগ্রন্থে “আকাশে পথ নাই, বাহিরে শ্রমণ নাই” এইরূপ আছে। ইহা হইতে স্পষ্ট অর্থবোধ হওয়া দুষ্কর। বুদ্ধঘোষ “বাহিরে” শব্দ “বুদ্ধের শাসনের বাহিরে” (outside the Buddhist community) এই অর্থে গ্রহণ করেন। ফজ্বোল বেবর ও আল উইস্ এই অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু ইহাতে