ধ্রুববাদী অগস্ত্ কোম্ত
AUGUSTE COMTE,
THE POSITIVIST.
ধ্রুববাদী
অগস্ত্ কোম্ত।
কলিকাতা।
বেন্টিক্ষ্ট্রীট্, ৮০ নং, কলিকাতা প্রেস।
শ্রীমহেন্দ্রনাথ ঘােষালের দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
সন ১২৮১ সাল।
বিজ্ঞাপন।
প্রায় চার বৎসর অতীত হইল কলিকাতাস্থ ফ্রিচার্চ্চ্ বিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব্ব অধ্যাপক মান্যবর শ্রীযুক্ত রেবরেণ্ড্ ম্যাক্ডোনাল্ড্ সাহেব ক্যানিঙ্ ইনিষ্টিটিউটে “অগস্ত কোম্ত দি পজিটিবিষ্ট্” নামক প্রস্তাব পাঠ করিয়াছিলেন। কোম্তের জীবনবৃত্তান্ত উপলক্ষে তদীয় মতের দোষ ও অপ্রামাণিকতা দর্শনই তাঁহার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। এতদভিপ্রায়ে তিনি বিস্তর আয়াস ও যত্ন স্বীকার করিয়া মিল্, হার্সেল্, হিউএল্, লিউইস্ প্রভৃতি কয়েক জন প্রসিদ্ধ পণ্ডিতের ধ্রুববাদ বিষয়ক মত সংগ্রহ করিয়া সংক্ষেপে উক্ত প্রস্তাবনার মধ্যে লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। কোম্তের দর্শন ও সমাজশাস্ত্র হইতেও কয়েকটি পরস্পর বিসংবাদিত ও বিরুদ্ধ বচন বহিষ্কৃত করিয়া উহাতে উদ্ধৃত করা হইয়াছিল। এতদ্ভিন্ন যে সকল বিষয় কোম্তের গ্রন্থ পাঠ করিয়াও সচরাচর লোকের উপলব্ধি হওয়া সুকঠিন তাহাও তিনি তন্মধ্যে প্রাঞ্জলভাবে ব্যক্ত করিয়াছিলেন। আমি কতিপয় মান্য ব্যক্তির উৎসাহে, অনুরোধে ও অনুকূল্যে উহা বঙ্গভাষায় অনুবাদ করিলাম।
ইংরাজী বিজ্ঞান বা দর্শনশাস্ত্রের সম্যক্ মর্ম্মবোধক শব্দ বঙ্গভাষায় অতি বিরল। এই অসঙ্গতি প্রযুক্ত ইংরাজী কথার অর্থ ও তাৎপর্য্য গ্রহণ করত বঙ্গভাষায় প্রতিরূপ নূতন শব্দ সঙ্কলিত করিতে হইয়াছে। যে যে শব্দ নূতন সঙ্কলিত হইয়াছে তাহাদের ইংরাজী অর্থসম্বলিততালিকা এই পুস্তকের শেষ ভাগে সমন্বিত করা হইল। কিন্তু সঙ্কলিত শব্দগুলি কত দূর পরিশুদ্ধ ও অবিসংবাদিত হইয়াছে তাহা পরিতৃপ্ত চিত্তে বলিতে পারি না। যাঁহারা অনুগ্রহ করিয়া শব্দ সঙ্কলন ও রচনা সংশোধন বিষয়ে সহায়তা করিয়াছেন, এস্থলে তাঁহাদিগের নাম উল্লেখ করিতে পারিলে আনুবিধিৎসার কার্য্য হইত বটে কিন্তু পাছে এই ক্ষুদ্র পুস্তকে তাঁহাদিগের নামোল্লেখ করিলে মর্য্যাদার হানি হয়়, আমি এই আশঙ্কায় এবম্বিধ অবশ্যকর্ত্তব্যে নিরস্ত হইলাম।
বঙ্গভাষায় ইংরাজী গ্রন্থের অবিকল অনুবাদ করা অতি দুরূহ। পরস্পর রচনা-প্রণালী সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতরাং, বহু পরিশ্রম ও যত্ন করিলেও অনুবাদিত গ্রন্থে অর্থ প্রতীতির বৈলক্ষণ্য এবং প্রকৃতির বৈষম্য ঘটিয়া থাকে। আমি তজ্জন্য স্থানে স্থানে অবিকল অনুবাদ করি নাই। কোন কোন স্থল একবারেই পরিত্যক্ত এবং স্থল বিশেষে পাঠকদিগের বোধসৌকার্য্যার্থে বর্ণনা বিস্তারিত হইয়াছে। কোম্তের মূলগ্রন্থে দৃষ্টি না থাকিলে যে যে বিষয় বোধগম্য হওয়া সুকঠিন সেই সেই স্থলে জি. এচ্ লিউইসের অনুবাদিত “বিজ্ঞানদর্শন” হইতে স্থূল মর্ম্ম গ্রহণ করত এতন্মধ্যে নিবেশিত করা হইল। এক্ষণে এবিষয়ে কতদুর কৃতকার্য্য হইয়াছি বলিতে পারি না; কিন্তু যাঁহাদিগের উৎসাহে ও আনুকূল্যে ইহা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইল তাঁহারা সন্তুষ্ট হইলেই শ্রম সফল জ্ঞান করিব।
কলিকাতা, |
|
অনুবাদক |
ধ্রুববাদী।
অগস্ত্ কোম্ত।
ইদানীন্তন সুবিখ্যাত নৈয়ায়িক পণ্ডিতবর জন্য জন্ ইষ্টুয়ার্ট্ মিল্ মহোদয় “কোম্ত ও ধ্রুববাদ” বিষয়ক কয়েকটি উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ রচনা করিয়া প্রসিদ্ধ “ওয়েস্ট্ মিনিষ্টর্ সমালোচনে” ক্রমশঃ প্রকাশ করেন। উক্ত প্রবন্ধ সমূহের মুখবন্ধে তিনি এই মর্ম্মে লিখিয়াছেন;—“ইউরোপীয় পণ্ডিত-মণ্ডলীর মধ্যে কোম্ত অধুনা যেরূপ প্রভূত খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছেন, এবং তাঁহার প্রধান গ্রন্থখানি বিদ্বৎসমাজে উত্তরোত্তর যেরূপ সমাদৃত,প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিপন্ন হইয়া উঠিতেছে, তাহাতে আপাততঃ তাঁহার দোষ ও অযৌক্তিকতা দর্শান অতিশয় আবশ্যক ও সর্ব্বতোভাবে বিধেয়।” কোম্তের গ্রন্থ এবং চরিত্র বিষয়ে দোষাদোষ বা সদসদ্ সমালোচনায় যে তিনি সম্প্রতি প্রবৃত্ত হইলেন, উহার এপ্রকার অভিপ্রায় কখনই নহে। কোম্তের মতের ও চরিত্রের দোষ উল্লেখ করিতে গেলে, পাছে তদীয় বিশ্ববিস্তৃত-যশোরাশি-বিমোহিত সাধারণের অশ্রদ্ধেয় ও উপহাসাস্পদ হইতে হয়, তিনি, এই আশঙ্কায়, এবম্বিধ গরিষ্ঠ ও ন্যায্য কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে, এক্ষণে আর কোন ক্রমেই নিরস্ত, সঙ্কুচিত বা ক্ষান্ত হইতে পারেন না, ইহাই উহার প্রকৃত তাৎপর্য্য। তিনি যে যথার্থ বুভূৎসুভাবে এবং বিদ্বেষহীন ও নিরপেক্ষ চিত্তে সাতিশয় অভিনিবেশ পূর্ব্বক পর্য্যবেক্ষণ করত কোম্তের চরিত্রের এবং দর্শনশাস্ত্রের বিস্তর দোষ ও ভ্রম নিরাকরণ করিয়াছিলেন, তাহার আর অনুমাত্র সন্দেহ নাই; এবং তত্তাবৎ অপ্রকাশ রাখিলে সমাজের যে বিশেষ অনিষ্টপাতের সম্ভাবনা, ও স্পষ্ট বাক্যে ব্যক্ত করিলে, উদ্দেশ্য বিফল হইলেও যে, কাহারও লেশমাত্র হানি হইবার কোন সংশয় নাই, তাহা তাঁহার বিলক্ষণ হৃদয়ঙ্গম হইয়াছিল। আমিও তৎসঙ্কল্পে সঙ্কল্পিত ও তদ্বিশ্বাসে আশ্বস্ত হইয়া অদ্য শুভ সায়ংকালে ভবাদৃশজনগণসম্মুখে মুদ্রচিত এই প্রস্তাবটি পাঠ করিতে অভিলাষ করিয়াছি। কেবল সাধারণের সুগোচরার্থে আমি আপনাদিগকে তাঁহার ভ্রমানুসন্ধান বিষয়ে অনর্থক আয়াস স্বীকারে অনুরোধ, কিম্বা তাঁহার অযথাভূত ভ্রান্তিসঙ্কুল দর্শন ও নীতিশাস্ত্র আপনাদিগকে অন্ধের ন্যায় অনুমোদন করিতে দেখিয়া এক মূহর্ত্তকালের জন্যও মৌনাবলম্বন, করিতে নিতান্ত অসমর্থ, কারণ উভয়েই অশেষ অমঙ্গলের সম্ভাবনা; সুতরাং উভয়সঙ্কটাপন্নের ন্যায় আমি আপনাদিগকে কোন দিকেই অগ্রসর হওয়ায় পরামর্শ দিতে সম্যক্ সাহসী নহি।
১৭৯৮ খৃঃ অব্দের ১৯এ জানুয়ারি, জগদ্বিখ্যাত ধ্রববাদী অগস্ত্ কোম্ত ফান্স্ দেশের অন্তর্গত মণ্টপিলিযারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি অত্যন্ত বিপর্য্যস্ত ও কদর্য্য সময়ে অবনীমণ্ডলে আসিয়াছিলেন। তৎকালীন সমস্ত ফ্রেঞ্চ সাম্রাজ্য ভয়ঙ্কর রাজবিপ্লবে আপ্লুত হইয়া দৈশিক রাজনীতি, সামাজিক সৌশৃঙ্খল্য ও চিরপ্রচলিত প্রথায় একেবারে জলাঞ্জলি দিয়া নিরতিশয় শোচনীয়াবস্থায় পর্য্যবসিত হইয়াছিল। ঘোরতর মাৎসর্য্য, জিঘাংসা ও জিগীষাপরতন্ত্র হইয়া সমস্ত ফ্রেঞ্চজাতি, আবালবৃদ্ধবনিতা, অবিকল রাক্ষস ও পিশাচের মত উগ্র, উদ্ধত ও ক্রূরস্বভাবাপন্ন হইয়াছিল এবং অনবরত যথেচ্ছাচারে ব্রতী হইয়া জন্মভূমির অপরিসীম অমঙ্গল সাধন করিয়াছিল। নিরবচ্ছিন্ন বিবাদবিসংবাদে ধর্ম্মকর্ম্মসত্যতত্ত্বাদি সমুদয় তিরোহিত এবং একতা, ন্যায়প্রিয়তা, সৌহৃদ্য, সৌজন্য, দয়া, দাক্ষিণ্য প্রভৃতি পরম রমণীয় গুণগ্রাম সমূলে উম্মূলিত হইয়াছিল। তাঁহার ভূমিষ্ঠ হইবার অনতিপূর্ব্বেই ফ্রেঞ্চ ব্যবস্থাপক সভা অধিকাংশ জাতীয় ঋণ অস্বীকার করায় দেশের মানসন্ত্রম একান্ত বিলুপ্ত ও বাণিজ্য নিঃশেষে নিপাতিত হয়। এতাদৃশ ভীষণ গৃহ-নিগ্রহে ও অরাজকতায় আর্ত্ত এবং সর্ব্ববিষয়েই বিধিগত প্রকারে বিসঙ্কুল হইয়াও বীরপ্রসবিনী ফ্রান্স্ সাধারণ বৈরনির্যাতনে এক নিমেষের জন্যও ভগ্নোৎসাহ বা হতোদ্যম হয় নাই। তখনও তাহার সিংহনাদে সুবিস্তৃত ইউরোপ খণ্ড একেবারে শশব্যস্ত ও কম্পিত হইয়াছিল। ইটালী হতদর্প ও নিতান্ত তাহার পদানত, রণপরাজিত অষ্ট্রিয়া অশেষ প্রকারে নিপীড়িত হইয়া পরিশেষে বেল্জিয়ম প্রদেশ প্রদান পুরঃসর যেনতেন প্রকারে তাহার সহিত সন্ধি সংস্থাপনে ব্যতিব্যস্ত, এবং ব্রিটেন্ ষট্ত্রিংশসহস্র রণবিশারদ সৈন্যপূর্ণ চারিশত ফ্রেঞ্চ রণপোতদ্বারা আক্রান্ত হইবে, এই ভয়ানক বার্ত্তা শ্রবণে যৎপরােনাস্তি ত্রস্ত, হইয়াছিল। কোম্তের জন্মকালীন তদীয় জন্মভূমিতে যে তুমুল হুলস্থূল ব্যাপার উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা পরপর সংবর্দ্ধিত হইয়া তাঁহার পরিণতাবস্থায় অতীব ঘােরতর বিকট ভাব ধারণ করে। সুকুমার শৈশবকালে তাঁহার সরল ও নির্ম্মল চিত্তক্ষেত্রে ঐ দুর্নিবার দুর্যোগের প্রতিকৃতি অতি প্রগাঢ় রূপেই প্রতিফলিত হয়, এবং সময়ানুক্রমে পরিপুষ্ট হইয়া তাঁহার পরিবর্ত্তনশালিনী প্রবৃত্তিকে এতাধিক উত্তেজিত করে যে, উহাই তাঁহার দর্শনশাস্ত্রপ্রণয়ন-কল্পে প্রকৃত অধিষ্ঠাত্রী বলা নিতান্ত বাহুল্য নহে। তিনি স্বয়ং কহিয়াছেন যে “আমি চতুর্দ্দশ বর্ষ বয়ঃক্রমে পদার্পণ করিবামাত্র স্বেচ্ছাবশতঃ রাষ্ট্রবিপ্লবানুরাগের যথাবিহিত সীমার আদ্যোপান্ত তন্ন তন্ন করিয়া পর্য্যালােচনায় প্রবৃত্ত হই, এবং ঐ সুলক্ষণযুক্ত মঙ্গলকর বিপর্য্যস্ত উপপ্লবসুযােগে এককালীন দর্শন, নীতি প্রভৃতি শাস্ত্র সমুদায়ের সংস্করণ অতিশয় আবশ্যক ও স্বল্পায়ামসসিদ্ধ রলিয়া, স্থির সিদ্ধান্ত করি, যাহার চিরস্মরণীয় বিরাট মূর্ত্তি আমার শরীর পরিগ্রহ করিবার প্রাক কালীন প্রকাশ পায়”।
কোম তের ইংলণ্ডীয় প্রধান অভিবাদক জি এচ্ লিউইস্ সাহেব কহিয়াছেন যে কোম ত বাল্যাবস্থায় অতিশয় দুর্দ্দম্য ও দুর্ব্বিনীত ছিলেন; কিন্তু পরিণামে অনুশিষ্টাচারের ও বিনয়গুণের প্রচুর প্রশংসা করিতেন। তাঁহার জনকজননী তাঁহাকে ধর্ম্ম ও নীতি বিষয়ক যে কোন উপদেশ দিতেন এবং সাধ্যমতে আচারব্যবহারদ্বারা ঐ সকল দীক্ষিত বিষয় তাঁহার বিশেষ হৃদয়ঙ্গম করিবার জন্য, যে কোন চেষ্টা পাইতেন, তৎসমুদায়ই তাঁহার দুর্ব্বৃত্ত ও চঞ্চল স্বভাব প্রযুক্ত নিতান্ত নিস্ফল হইয়াছিল।
গৃহে শাসন করা দুসাধ্য বিবেচনায়, তাঁহার পিতা মাতা তাঁহাকে তন্নগরস্থ কোন পাঠশালায় অন্তেবাসী রূপে নিয়োজিত করেন। তথায়ও তাঁহার পুর্ব্ববৎ দুঃশীল ও দুষ্ট স্বভাব সম্পূর্ণই বিদ্যমান ছিল; কিন্তু তাঁহার অসাধারণ শিক্ষানৈপুন্য ও প্রতিভাশক্তি দেখিয়া সকলেই সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিলেন। “তিনি দারুণ দুর্দ্দান্ত, উপদ্রবী ও তর্ক-প্রিয় ছিলেন।” পাঠাভ্যাসে ও বিদ্যানুশীলনে তিনি সকলকেই সবিশেষ সন্তুষ্ট করিতেন; কিন্তু তাঁহার অবাধ্যতা ও বিদ্রোহাচরণে সকলেই বিষম বিরক্ত হইতেন। বিদ্যালয়ের শাসকেরা তাঁহার দৌরাত্মে ক্রুদ্ধ হইয়া সর্ব্বদা তাঁহাকে অযত্ন ও পীড়ন, এবং শিক্ষকেরা তাঁহার অবিচলিত অধ্যবসায়, শিক্ষাদক্ষতা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সন্দর্শনে তাঁহাকে নিয়ত মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা ও সাধুবাদ, করিতেন। স্বপাঠিদিগের আমোদবর্দ্ধনার্থে কখন কোন যত্ন স্বীকার করেন নাই বটে, তত্রাচ তাহারা সকলেই তাঁহাকে আন্তরিক স্নেহ ও সমাদর করিত। ক্ষীণ ও কোমলকলেবর কোম্ত সবল, অকুতোভয়, স্পর্দ্ধাযুক্ত এবং বিদ্রোহী ছিলেন।
দ্বাদশ বৎসর বয়ঃক্রম কালে তিনি বিদ্যালয়ান্তরে প্রেরিত হইয়াছিলেন। তথায়ও তাঁহার প্রাগ বৎ দুষ্টাচারের ও অসদ্ব্যবহারের বিলক্ষণ পরিচয় পাওয়া গিয়াছিল। কিন্তু তথাকার অধ্যাপকেরা তাঁহার অলোকসামান্য মেধাশক্তি, বিদ্যার্জ্জনে অভূতপূর্ব্ব অধ্যবসায় দেখিয়া নিরতিশয় চমৎকৃত হইয়াছিলেন, এবং তাঁহাতে আপনাদিগের শ্লাঘা জ্ঞান করিতেন। চারি বৎসর কালমধ্যে তিনি তথাকার নিয়মিত পঠিতব্য সমুদয় অধ্যয়ন করিয়া এতাদৃশ ব্যুৎপন্ন হইয়া উঠিলেন যে, তাঁহার রুগ্ন ও বৃদ্ধ কৃতবিদ্য অধ্যাপকের আসন গ্রহণে সম্যক্ সমর্থ হইয়াছিলেন। “ছাত্রাবস্থাতেই তিনি স্বীয় অধ্যাপক মহামান্য গণিতবিদ্যাবিৎ পণ্ডিতবর ম. এঁকঁতারের পার্শ্বে উচ্চাসন পরিগ্রহ পূর্ব্বক, ঐ পাঠশালাস্থ বিদ্যার্থীদিগকে গণিতবিদ্যা বিষয়ে কয়েকটি জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিয়া স্বীয় পাণ্ডিত্যের সমুচিত ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন।” তাঁহার পিতা মাতা প্রগাঢ় রাজভক্ত ও ক্যাথলিকধর্ম্মাবলম্বী ছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁহাদিগের মতের. অণুমাত্রও অনুসরণ করিতেন না। সপ্তদশবর্ষীয় কোম ত অবলীলাক্রমে চিরপ্রচলিত বিশুদ্ধ রাজনীতি, ধর্ম্মনীতি ও আত্মতত্ত্ব একেবারে বিসর্জ্জন দিয়া সেচ্ছাচারে ও স্বকপোলকল্পিত ধর্ম্ম যাজনে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইলেন। ম. লিউইস্ বলেন যে “তৎকালীন কোম ত রাজানুগত এবং আস্তিক বা নাস্তিকদিগের সহিত কোন সংশ্রবই রাখিতেন না।” বিদ্যালয়ের কোন বালক কোন শাসককর্ত্তৃক কঠিন রূপে শাসিত হওয়ায় সমধিক ক্ষুব্ধ ও লজ্জিত হইয়া তদ্বৃত্তান্ত সহধ্যায়ীদিগকে অবগত করে। শাসকের এতাদৃশ আচরণ শ্রবণে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া এবং স্বপাঠীর অবমানে অবমানিত জ্ঞানে, কোম ত আপনার ও কয়েক জন সমকক্ষী বিদ্যার্থীদিগের স্বাক্ষরিত এই পশ্চাল্লিখিত বিজ্ঞাপন প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিলেন;—“মহাশয়, (শাসককে সম্বোধন করিয়া) আপনি এই বিদ্যালয়ের এক জন অতি প্রাচীন ভূতপূর্ব্ব ছাত্র, আপনার সহিত এরূপ ব্যবহার করা ক্লেশকর বোধেও আমরা নিষেধ করিতেছি আপনি যেন ইহার ত্রিসীমায় আর না পদার্পণ করেন।” উক্ত অপরাধেই তিনি পাঠশালা হইতে দুরীকৃত হইয়া গৃহে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন; কিন্তু তথায়ও স্বীয়স্বভাবসুলভ দোষবিশেষবশতঃ তাঁহাকে কিয়দ্দিবস শান্তিরক্ষকদিগের তত্ত্বাবধানের অধীনে অবস্থান করিতে হইয়াছিল।
আশ্রমযন্ত্রনা অসহ্য বোধে তিনি অনতিবিলম্বে, হতভাগ্য জনক জননীর নিবারণ অবহেলা করিয়া নিস্বই প্যারিস্ রাজধানীগমনে স্থিরসংকল্প হইলেন। রিক্ত হস্ত, এমন কি, একটি কপর্দ্দক মাত্রের ও সঙ্গতি নাই, সহায়হীন, বান্ধববিহীন, একাকী, কিশোর বয়সে, গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া, গোপনে ঐ বিষয় রসপরায়ণ নগরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। কি করিবেন, কাহার নিকট যাইবেন, কেইবা তাঁহাকে আশ্রয় দিবে ও কিরূপেইবা আপন উদরান্ন আহরণ করিবেন, তাহার কিছুই স্থিরতা ছিল না; কেবল ভাবীশুভবাদিনী আশামাত্র পথের সম্বল লইয়া তিনি অকস্মাৎ তথায় উপনীত হইলেন। তাঁহার কোন শিক্ষক ও বন্ধুর সাহায্য তিনি তন্নগরীতে কয়েকটি ছাত্র সংগ্রহ করিয়া গণিতশাস্ত্রাধ্যাপনের দ্বারা কষ্টেসৃষ্টে গ্রাসাচ্ছাদন নির্ব্বাহ হইতে পারে, এই রূপ যৎসামান্য অর্থোপার্জ্জন করিতে লাগিলেন। তৎকালীন কেরিগ্ণের রাজপুত্র তাঁহার জনৈক বিদ্যার্থী শিষ্যমধ্যে পরিগণিত হইয়াছিলেন। কিছুদিন পরে তিনি কেসিমস্ পেরিয়ারের গৃহসম্পাদকের পদে নিযুক্ত হইলেন, ও প্রায় তিন সপ্তাহ কাল উক্ত পদগত কার্য্য সমস্ত যথামত নির্ব্বাহ করিলেন; কিন্তু পরিশেষে উহা মনঃপূত না হওয়ায় একেবারে পরিত্যাগ করেন। বোধহয়, কোম্তের ঐ ভাবী রাজামাত্যের সহিত কোন বিষম আন্তরিক বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল, নতুবা তাঁহাকে এত স্বল্প দিনের মধ্যে সহসা স্থানান্তরিত হইতে হইত না।
১৮১৮ খৃঃ অব্দে তিনি আধুনিক প্রসিদ্ধ স্বমতোন্মন্তু দার্শনিক ও চিরাগত রীতিনীতিব্যবহারধর্ম্মতত্ত্বাদিবিপ্লাবক সেণ্ট্ সিমনের শিষ্যমধ্যে পরিগণিত হইয়া তাঁহার গৃহসম্পাদকের কার্য্যও করিতে লাগিলেন। মনে মনে এই স্থিরনিশ্চয় করিয়াছিলেন যে, এতাদৃশ বিদ্যালোকসম্পন্ন, উন্নতশীল, প্রশস্তকল্প মহামতির আশ্রয়ে থাকিলে, অনায়াসেই অজাতশত্রু হইয়া নিরন্তর বিদ্যালাপদ্বারা সুখস্বচ্ছন্দে কালক্ষেপ করিতে পারিবেন। কিন্তু দুরাদৃষ্ট তাঁহাকে এস্থলপর্য্যন্তও অনুগমন করিয়াছিল। ছয় বৎসর অতিবাহিত না হইতেই গুরুশিষ্যমধ্যে দারুণ দ্বন্দ উপস্থিত হইয়া উভয়কে একেবায়ে জন্মের মত বিচ্ছিন্ন করিল। অনন্তর কোম্ত নিজ দর্শনশাস্ত্র প্রস্তুত করিলেন, কিন্তু, বলিতে কি, উহাতে, স্থানে স্থানে তাঁহার গুরুর মতের অনেক আভাস স্পষ্টই প্রতীয়মান আছে। উভয়ের শিষ্যেরা পরস্পর প্রভূত দোষারোপ ও গ্লানি করিয়া থাকে। কোম্ত যে সমস্ত মত বা ব্যবস্থা স্ব প্রতিভোদ্ভাবিত বলিয়া সাধারণের প্রতিষ্ঠাভাজন হইয়াছেন, সিমনের শিষ্যেরা তৎসমুদায়ই আপনাদিগের গুরুর বলিয়া প্রতিপন্ন, এবং তাঁহাকে দুষ্ট মতাপহার বলিয়া নিরতিশয় অনুযোগ ও ভর্ৎসনা, করে। কোম্তপক্ষীয়েরা তৎসমুদায়ই তাঁহার আপনার বলিয়া বদ্ধপরিকরে প্রকৃত বাক্-যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়, এমন কি, উক্ত অপবাদকে নিতান্ত অন্যায় ও ঈর্ষ্যাপরতন্ত্রের কার্য্য বলিয়া, যৎপরোনাস্তি কুৎসা করিয়া প্রতিবাদ করে। সিমনের নিকট শিষ্যভাবকে অতিশয় “অনিষ্টকর” ও “সাংঘাতিক” বলিয়া কোম্ত নিজেই ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ম. লিউইস্ বলেন যে “কোম্তের সঞ্চিকীর্ষা যে সিমন্ কর্ত্তৃক সমধিক উত্তেজিত হইয়াছিল, একথা বাস্তবিক অমূলক নহে।” —“আর তাঁহার সহিত সতত একত্র বসবাসবশতঃ যদিও কোম্তের অন্তঃকরণে কোন বিশেষ সংস্কার বা তন্মতের আভাস বর্ত্তে নাই,কিন্তু ঐ যথার্থ পরিবর্দ্ধমানাবস্থায় তাঁহার উন্নতিশালী চিত্তক্ষেত্রে উক্ত সঞ্চিকীর্ষাবৃত্তি যে বিশিষ্ট রূপে গ্রথিত হইয়াছিল, তাহার আর সন্দেহ কি? তিনি স্থানান্তরে কহিয়াছেন যে কোন ভয়ানক অপরাধী যাবজ্জীবন কারাবাসে আদিষ্ট হয়। ঐ হতভাগার সহধর্ম্মিণীর সহিত কোম্তের প্রগাঢ় আসক্তি জন্মে। ঐ রমণীর প্রতি অবিচলিত অনুরাগই তাঁহার “ধ্রুববাদানুবর্ত্তী নীতিশাস্ত্র” ও “ধ্রুববাদ সন্ধীয় প্রশ্নোত্তরিক।” এই দুই খানি গ্রন্থের মূল কারণ। অনতিপরিস্ফুট রূপে যে সকল মত তাঁহার অন্তঃকরণে প্রথমতঃ উদ্বোধ হইয়াছিল তাহা এক্ষণে সেণ্ট্ সিমনের নিকট কয়েক বৎসর অবস্থিতি করায় বিশিষ্ট অবয়ব অবলম্বন করে, অর্থাৎ, তাঁহার পরিবর্ত্তনানুরাগানুবর্ত্তী মত সমস্ত ঐ সময় বিশেষ ব্যবস্থায় পরিণত বা প্রবর্ত্তিত হয়। সেণ্ট্ সিমনের সহিত প্রথম পরিচিত হইবার চারি পাঁচ বৎসর কালমধ্যেই তিনি ধ্রুববাদের মূল সূত্র সমুদায় সমাজসংস্করণের সার আদর্শ নামক প্রাঞ্জল প্রবন্ধে প্রকাশ করেন। ১৮২৪ খৃঃ অব্দে সেণ্ট্ সিমনের সহিত তাঁহার মর্ম্মান্তিক বিবাদ উপস্থিত হয়; ১৮২৫ খৃঃ অব্দে তিনি “বিদ্বান্ ও বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় ন্যায্য ব্যবস্থা” মূদ্রিত ও প্রচারিত করেন। তদনন্তর তিনি অনন্যমনা ও অনন্যকর্ম্মা হইয়া স্বীয় এই নবোবিত দর্শন এবং ধর্ম্ম বিবৃতি ও প্রচার করিতে জীবন সর্ব্বস্ব সমর্পণ করিয়াছিলেন।
স্বাভিপ্রেত সম্পাদনে কৃতকার্য্য হইবার আশয়ে তিনি যেরূপ অপর্য্যাপ্ত পরিশ্রম, অপ্রতিহত উৎসাহ, অলৌকীক সহিষ্ণুতা এবং প্রগাঢ় অধ্যবসায় প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাহা স্মৃতিপথারূঢ় হইলে সর্ব্ব শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠে। বহুতর দুর্বিষহ নিগ্রহ ও দারিদ্র্যনিবন্ধন অশেষ ক্লেশ পরম্পরা সহ্য করিয়াও সংকম্পিত বিষয়ে ক্ষণকালের জন্যও নিরস্ত বা শিথিলযত্ন হন নাই। রচনাকার্য্য সমাপ্ত হইলে স্বকৃত দর্শন ও স্বোদ্ভাবিত অভিনব তত্ত্বানুসন্ধান-প্রণালী প্রচার করাই তাঁহার চিত্তের একমাত্র চিন্তা, হৃদয়ের একমাত্র বাসনা এবং জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হইয়া উঠিল। যাহাতে তদীয় মত পণ্ডিত-সমাজে লব্ধ প্রতিষ্ট এবং দেশবিদেশে অখণ্ডনীয় বলিয়া আরাধ্য ও পরিগৃহীত হয়, তাহাতেই তিনি আগ্রহাতিশয় সহকারে, অকুতোভয়ে, সর্ব্বসুখে জলাঞ্জলি দিয়া একান্ত অভিনিবিষ্ট থাকিতেন। কিন্তু সর্ব্বমত্যন্ত গর্হিতম্। তিনি তদ্গতচিত্ত হইয়া স্বীয় মতের উৎকর্ষ সাধনে ও প্রতিপত্তি স্থাপনে এতাদৃশ ব্যগ্র ও বিব্রত হইয়া উঠিলেন যে সমুদায় সদ্বিবেচনার সীমা অতিক্রম করত, উদ্যমাতিশয্য প্রযুক্তি যথাবিহিত নিত্য নৈমিত্তিক কার্য্যে দৃষ্টি হারাইয়া, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া, একেবারে উন্মাদাবস্থায় পর্য্যবসিত হইলেন। কোম্তের সহিত ম. গিজোর প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল, এস্থলে তল্লিখিত এই বিবরণটি অবিকল অনুবাদিত হইল;—“তাঁহার অত্যন্ত ভয়ানক আত্মনিষ্ঠা ছিল। মনে মনে তাঁহার এই স্থিরপ্রত্যয় বদ্ধমূল ছিল যে, কেবল তদীয় ব্যবস্থাগুণে সমস্ত মানবজাতির ও বিজ্ঞানশাস্ত্রের ঔৎকর্ষ্য ও সংস্কার সাধনেই যেন তিনি ধরাতলে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। মনুষ্যমাত্রই স্বভাবতঃ, কিয়ৎ পরিমাণে অহমিকার পরবশ; কিন্তু যাঁহারা যথার্থ প্রতিভাসম্পন্ন, আবিষ্কার-নিপুন ও অভিনবব্যবস্থা-সংস্থাপন-প্রিয়, তাঁহারা প্রায় আমাদিগের স্বভাবসুলভক্ষুদ্রতা ব্যতীত আর অধিকতর মদমাৎসর্য্যের বশীভূত। তাঁহারা আপনাদিগের বুদ্ধিবলকে নিতান্ত অসাধারণ ও আপনাদিগের কার্য্যকলাপকে অভূতপূর্ব্ব বোধে নিরন্তর দম্ভে স্ফীত হইয়া থাকেন, এবং সমধিক গৌরবাকাঙ্ক্ষায় অভিভূত হইয়া আপনাদিগের মতকে যথাযোগ্য আদর না করিয়া দিগ্বিদিগ্জ্ঞানশূন্য অর্ব্বাচীনের মত একেবারে সর্ব্বোৎকৃষ্ট ও অসীম ফলদ বলিয়া, সর্ব্বদা অপর্য্যাপ্ত শ্লাঘা করেন। ম. অগস্ত্ কোম্ত ইহার একটি চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত-স্থল। যদিও তিনি যথার্থ অসামান্য ধীশক্তিসম্পন্ন ছিলেন বটে, তথচ তাঁহাকে তদভিমানী এক জন অতিশয় জঘন্য দাম্ভিক বলিয়া, স্বীকার করিতে হইবে,—যদ্রূপ বিবিধগুণালঙ্কৃত ও উৎকৃষ্টবুদ্ধিবিশিষ্ট তদ্রূপ নিতান্ত নিকৃষ্টগর্ব্বপরতন্ত্র, এমন কি, তাঁহাকে সাক্ষাৎ মূর্ত্তিমান অহঙ্কার বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। খৃষ্টীয় ধর্ম্মের প্রেরিত ব্যক্তি, যাজক, আচার্য্য ও প্রচারক আছেন, যাঁহারা আপনাদিগের প্রভু যীশুর মহিমা সর্ব্বত্রে কীর্ত্তন করেন ও তাঁহারই প্রভুত্ব পরিজ্ঞপ্ত ও প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত অবিরত প্রাণপণে সচেষ্ট থাকেন, এবং যে ধর্ম্ম তাঁহারা প্রচার করেন তাহা তাঁহাদিগের স্বোদ্ভাবিত বলিয়া, কখনই অস্ফালন করেন না। ম. অগস্ত্ কোম্ত আপনিই স্বয়ং অবতার, আপনিই আপনার প্রেরিত ব্যক্তি, আপনিই আপনার ধর্ম্মের সৃষ্টিকর্ত্তা, আপনিই যাজক এবং আপনিই প্রচারক ছিলেন। দুরাশাগ্রস্ত হইয়া তিনি দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে আত্মসমর্থের উপর নির্ভর করিয়া প্রশস্ত, সরল ও নিস্বার্থ চিত্তে সমস্ত মানব-মনীষার উপর আধিপত্য সংস্থাপনে অসীম ঔৎসুক্য প্রকাশ করিয়াছিলেন, অর্থাৎ, যাহাতে সকলে তাঁহার অনুগামী হইয়া স্ব স্ব উন্নতি সাধনে তৎপর হয়, তাহাই তিনি কায়মনোবাক্যে চেষ্টা করিতেন; এবং আপনাপনি এই স্থিরসিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, সামাজিক রীতিনীতির ঔৎকর্ষ,বিদ্যাধর্ম্মের উন্নতি, সমস্ত মানবজাতির মেধামর্য্যাদার আতিশয্য, পৃথিবীর সমৃদ্ধি সাধন ও শ্রীসংবর্দ্ধন প্রভৃতি যাবতীয় হিতকর ব্যাপার উপলব্ধি-কল্পে, তাঁহার নিজ ব্যবস্থার বা মতের প্রভূত্ব ও প্রতিপত্তি সংস্থাপন ব্যতীত উপায়ান্তর নাই। তিনি একাগ্রচিত্তে আপন মত প্রচারে অহর্নিশি ব্যাপৃত থাকিতেন ও যে কোন প্রকারে তদীয় মত-সংস্থাপনী একটা চিরস্থায়িনী বর্দ্ধিষ্ঠা সভা সংস্থাপিতা হইয়া ক্রমশঃ উহা দেশবিদেশে প্রচারিত ও সাদরে পরিগৃহীত হয়, যাহাতে তাঁহার অভিনব দর্শন-পদ্ধতি লোকে মান্য ও অনুসরণ করে, এবং যাহাতে আবহমানকাল তাঁহার জয়পতাকা জগতীতলে নিরবচ্ছিন্ন উড্ডীয়মান থাকে, তাহাই তাঁহার জীবন-কল্প হইয়া উঠিয়াছিল। স্বীয় বুদ্ধিবৃত্তি সর্ব্বাপেক্ষা প্রখর জ্ঞানে অপরাপর জনগণের উপর আপনার প্রভুত্বের ক্ষমতা বা অধিকার আছে বলিয়া,তাঁহার অন্তঃকরণে এক প্রকার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিয়াছিল এবং সময়ে সময়ে স্বাভাবিক নিষ্কপটচিত্তে ঐ আত্মভক্তি সপষ্টই ব্যক্ত করিতেন। একদা তদানীন্তন “ন্যাসানাল্” পত্রিকার সম্পাদক ম. আরমদ্ মেরাস্ত্কে বিচারে পরাজয় করত স্বমতাবলম্বী করিয়াছেন ভাবিয়া তিনি আপন ভার্য্যাকে এই মর্ম্মে এক খানি পত্র লিখিয়াছিলেন;—“মেরাস্ত্ অবশ্যকর্ত্তব্য আমার বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্য স্বীকারে এক্ষণে আর পরাঙ্মুখ নহে। স্পষ্ট বলিতে কি, আপাততঃ কুসংস্কারবর্জ্জিত বিদ্যালোকসম্পন্ন জনগণের নিকট আমার যেরূপ প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি উপলব্ধি হইয়াছে তাহাতে অভিপ্রেত বিষয়ে কৃতকার্য্য হইবার জন্য আর কোন বিশেষ যত্ন পাইবার আবশ্যক নাই, অন্ততঃ কিছুদিন জীবিত থাকিতে পারিলেই যথেষ্ট হইবে। এত দিনের পর আমি এক প্রকার নিশ্চিন্ত হইলাম, বোধ হয়, আমার বহুদিন-বাঞ্ছিত মত প্রচলন ও ব্যবস্থানুষ্ঠান আপামর সাধারণে অচিরাৎ দেখিতে পাইব।”
১৮২৫ খৃঃ অব্দে তিনি দার পরিগ্রহ করেন। গণিতবিদ্যায় উপাচার্য্য-বৃত্তিদ্বারা একটিমাত্র ছাত্র হইতে যৎকিঞ্চিৎ উপার্জ্জন হইত তাহাতে ভরণপোষণ নির্ব্বাহ হওয়া অতি দুরূহ দেখিয়া তিনি এমন কোন রমণীর অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, যিনি কেবল তাঁহার চিত্তবিনোদন ও গৃহসুখসংবর্দ্ধন করিবেন,এমন নহে,অর্থ বিষয়েও বিশেষ সহায়তা করিতে পারিবেন। তিনি তদনুযায়ী কেরোলাইন্ মিসিন্ নাম্নী একজন চতুর্বিংশতিবর্ষীয়া পুস্তক ব্যবসায়িনীর সংবিদ্ বিবাহের প্রথানুসারে পাণিগ্রহণ করিলেন। অতঃপর তিনি পত্নীর ব্যয়ে কয়েকটি গৃহ ভাড়া লইয়া যথাবিহিত সজ্জীকৃত, ও আবশ্যকীয় সমস্ত দ্রব্যসামগ্রী আয়োজন করিয়া, আপনাদিগের বন্ধুবর্গকে অন্তেবাসী ছাত্রভার লইবার অভিপ্রায় বিজ্ঞাপন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ একটিও ছাত্র উপস্থিত হইল না; সুতরাং ক্রমে ক্রমে তাঁহার স্ত্রীর যৎসামান্য সঙ্গতি ব্যয়িত হওয়াতে ঐ দ্রব্যসামগ্রী সমস্ত বিক্রয় করিয়া তাঁহাদিগকে স্থানান্তরে হীনাবস্থায় অবস্থিতি করিতে হইয়াছিল। ইতিমধ্যে কোম্ত সংবাদ পত্রে লিখিয়া কিঞ্চিৎ আয়বৃদ্ধির চেষ্টা পাইয়াছিলেন। পরিণয় করিয়া পর্য্যন্ত তিনি এক মূহুর্ত্তের জন্যও সুখী হয়েন নাই। স্ত্রীপুরুষের বিবাদবিসম্বাদেই দিবারাত্র অতিবাহিত হইত, বোধ হয়, কোম্তের উগ্রস্বভাব ও নৃশংস ব্যবহারই উহার মূল কারণ। পতিপত্নী উভয়ের চিত্তবাদ, সংস্কার, আন্তরিক ভাব, প্রবৃত্তি, নিবৃত্তি প্রভৃতি প্রায় সম্পূর্ণই বিভিন্ন ছিল। কোম্ত দিবানিশি বিজ্ঞানানুশীলনে নিমগ্ন এবং ঐশ্বর্য্যাদি যাবতীয় অকিঞ্চিৎকর পার্থিব পদার্থে নিতান্ত বিরত ছিলেন। কিন্তু কেরোলাইন্ ইহার অবিকল বিপরীত, তিনি যৎপরোনাস্তি বিষয়রসপরায়ণা ছিলেন,—বেশভূষা, ধনসম্পত্তি এবং ভোগবিলাসাদিতে একান্ত তৎপর। ভার্য্যার স্বার্থপরতা মূঢ়তা ও নীচাশয় তাঁহার উন্নতশীল, বিদ্যোৎসাহী, বিশাল হৃদয়ের নিতান্ত বিরুদ্ধ, সুতরাং দাম্পত্যপ্রণয় বা সদ্ভাব হইবার সম্ভাবনা অতি বিরল। কেরেলাইনের অপরাপর যতই দোষ থাকুক না কেন, তিনি যে যথার্থ পতিপ্রাণা রমণী ছিলেন তাহার ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। তিনি সতত স্বামির সেবায় ও পরিচর্য্যায় একান্ত অধ্যবসায়িনী থাকিতেন। কখন পতিপ্রতি অযত্ন বা অপ্রিয়বাক্যপ্রয়োগ করেন নাই, এবং যাহাতে পতির ঘৃণা বা তাচ্ছল্য জন্মে এমন কোন কার্য্যে কদাচ প্রবৃত্ত হইতেন না। ভর্ত্তার যাহাতে দারিদ্র-দুঃখ নিবারণ করিতে পারেন এতাদৃশ বিষয়ে সাধ্যমতে কোন উপেক্ষা করিতেন না। কোম্ত স্বয়ং এসমস্ত মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন। কি সম্পত্তি, কি বিপত্তি, সর্ব্ব সময়েই কেরোলাইন্ অবিচলিত চিত্তে তাঁহার শুভানুধ্যান করিতেন, এবং স্বামির সুখসম্পাদন, স্বাস্থ্যসংবর্দ্ধন, যশোবৃদ্ধিকরণ প্রভৃতি যাবতীয় মঙ্গলাভিপ্রায় তাঁহার সমস্ত কার্য্যকলাপেই দেদীপ্যমান ছিল। তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া কোম্ত অপরকে প্রণয়ভাজন করিলেও তিনি স্ত্রীস্বভাবসুলভ আক্রোশ বা প্রতিহিংসার পরবশ হইয়া এক দিনের জন্যও তাঁহার অপ্রিয় বাসনা করেন নাই, বরং পূর্ব্ববৎ তাঁহার সর্ব্বাঙ্গীন কুশলই অনবরত চিন্তা করিতেন। পতির পরলোকগমনান্তেও কেরালাইন্ তদ্রুপই তাঁহার শুভানুধ্যায়িনী ছিলেন। উভয়ে দাম্পত্যভাবে একত্র জীবন যাপন করিলে, বোধ হয়, কোম্তের স্বাভাবিক বিপর্য্যয় ব্যগ্রতা ও ঔদ্ধত্য বহু পরিমাণে উপশম হইতে পারিত, এবং পত্নীর প্রিয় ব্যবহারে ও প্রণয়-পূরিত প্রযত্নে তাঁহার স্বাভাবিক দৈনন্দিন চর্য্যায় ও সামান্য লৌকীক ব্যাপারে মনশ্চাঞ্চল্যও নিরাকৃত হইবার অনেক সম্ভাবনা ছিল।
১৮২৬ খৃঃ অব্দে তিনি নিজ নিকেতনে দর্শনশাস্ত্র সম্বন্ধীয় দ্বাসপ্ততি বক্তৃতা করিবার অভিপ্রায় সর্ব্বসাধারণকে বিজ্ঞাপন করেন। ইহাতেই সামান্যতঃ তাঁহার দুরাকাঙ্ক্ষার ও অসীম লোকানুরাগ-প্রিয়তার বিলক্ষণ প্রমান পাওয়া যায়। প্রথমতঃ তাঁহার শ্রোতৃবর্গের মধ্যে জগন্মান্য হামবোলট্, পঁইসো, ডি ব্লেন্ ভিল মণ্টিবেলো প্রভৃতি কয়েক জন মহামহোপাধ্যায় বিজ্ঞানবিৎ পণ্ডিতগণ তথায় উপস্থিত ছিলেন। এবম্বিধ বিজ্ঞানবিশারদ মহামতি পণ্ডিতগণের সমাগমে যে তাঁহার যথেষ্ট গৌরব বৃদ্ধি হইয়াছিল, তাহার আর সন্দেহ কি? দর্শন বিষয়ক কতকগুলি গরিষ্ঠ ও অত্যাবশ্যকীয় অভিনব তত্ত্ব ব্যাখা বা বিবৃতি করিবেন বলিয়া, তিনি পণ্ডিত-মণ্ডলীতে যে প্রকার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাইয়াছিলেন, তাহার এবং তদ্বিষয়ে তাঁহার সমধিক স্পর্দ্ধার ও প্রচূর মর্য্যাদা এই শুভসংযোগেই প্রতিপাদিত হইয়াছিল। বাস্তবিক তিনি কয়েকটি নূতন, স্বরূপ, কৌশলপূর্ণ ও সুদূরপরাহত বিষয় বিবৃতি করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, কিন্তু তৎসমুদায় যে কতদূর জ্ঞানগর্ভ, উৎকৃষ্ট এবং পরিশুদ্ধ তাহা এ পর্য্যন্ত সমালোচিত হয় নাই।
আমরা এক্ষণে যত দূর পর্য্যন্ত তাঁহার চরিতাখ্যায়িকা পর্য্যালোচনা করিলাম তাহাতে তাঁহার জীবনের দ্বিবিধ প্রতিরূপ প্রত্যক্ষ প্রতীয়মান হইতেছে। প্রথমতঃ, তিনি স্বভাবতঃ উদ্ধত, উগ্র ও কলহ-প্রিয় ছিলেন, প্রতিবেশবাসী, বন্ধু, বান্ধব, প্রিয়জন, পরিজন এবং পরিচিতের সহিত সর্ব্বদা বিবাদ করিতেন; দ্বিতীয়তঃ, তিনি অলোকসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী ছিলেন, বিশ্বরাজ্যের কৌশলানুশীলনে ও নব নব তত্ত্বনির্ণয়-কল্পে অহর্নিশি ব্যাসক্ত থাকিতেন। ম. লিউইস্ বলেন যে “কোম্তের অপর্য্যাপ্ত মানসিক পরিশ্রম, সার্ব্বক্ষণিকচিত্তব্যাসঙ্গ, বিবিধ দুশ্চিন্তা এবং, বিশেষতঃ, নিরন্তর দ্বন্দ্বনিগ্রহ ভাঁহার পক্ষে ভয়ানক হানিজনক হইয়া উঠিয়াছিল।” তাঁহার প্রতিশ্রুত বক্তৃতাবলীর তৃতীয়টি কি চতুর্থটি সমাপ্ত হইবা মাত্রই তিনি অকস্মাৎ উম্মত্ত হইয়া উঠিলেন। কয়েক সপ্তাহ পূর্ব্বে তিনি এতাদৃশ উগ্রতা, বিরক্তি ও রুষ্টতা প্রদর্শন করিয়াছিলেন যে তাঁহার হতভাগিনী বনিতা যৎপরেনাস্তি ভীতা ও ব্যাকুলা হইয়াছিলেন। অনবরত স্বামির অসদ্ব্যবহারের পরিচয় পাওয়ায়, বিশেষ তত্ত্বাবধান ব্যতীত, তাঁহার বর্ত্তমান ভাব দর্শনে কেরোলাইন্ সামান্যতঃ উহাকে “দুষ্টাচার বলিয়াই স্থির করিয়াছিলেন, কিন্তু বস্তুতঃ উহা বায়ুরোগের পূর্ব্বলক্ষণ।” কিন্তু আমরা এস্থলে কেবল বায়ুরোগ বলিয়া লিউইসের ন্যায় কোন মতেই ক্ষান্ত হইতে পারি না। ফলতঃ উহা রোগ ব্যতীত আর কি হইতে পারে!—উহা শারিরীক ও মানসীক রোগ—অধর্ম্মাচরণ ও অসাধুতা যে রোগের প্রতিকারণ—যে রোগের প্রতিকার নাই—যে রোগের জন্য রোগগ্রস্ত ব্যক্তিই অশেষ দোষের দোষী এবং ইহলোকে ও পরলোকে সর্ব্বতোভাবে দণ্ডার্হ। তিনি কখনই আপন উগ্রস্বভাব পরিবর্ত্তন বা ক্রোধ সম্বরণহেতু কোন যত্ন পান নাই, বরং একেবারে বৃদ্ধির দ্বার উদ্ঘাটিত রাখিয়া ক্রমশঃ উহার পুষ্টি সাধন করিয়াছিলেন, ও জোনার মত “আমার ক্রোধ করা কর্ত্তব্য” এই অভিপ্রায়ে উহাকে সতত সম্পূর্ণ রূপেই উত্তেজিত করিতেন, এবং তজ্জন্য পশ্চাৎ পাপের অবশ্যম্ভাবী সমুচিত শাস্তিও পাইয়াছিলেন।
১৮২৬ খৃঃ অব্দের ২৪এ এপ্রেল শুক্রবারে কোম্ত সহসা অদৃশ্য হইয়া সোমবার প্রাতঃকালাবধি নিরুদ্দিষ্ট ছিলেন। পরে তিনি সেণ্ট্ ডেনিসে আছেন এবম্বিধ সমাচার পাইবামাত্র কেরোলাইন্ ত্বরায় তাঁহার অনুসন্ধানে যাত্রা করিলেন, এবং তাঁহাকে মণ্ট্ মরেন্সাইয়েতে অতিশয় দীন ও শোচনীয়াবস্থায় দেখিতে পাইলেন। কথঞ্চিৎ সুস্থ ও শান্ত হইলে পর কোম্ত বহির্দ্দেশ-বিহারে অভিলাষ প্রকাশ করায় কেরোলাইন্ তাঁহাকে সমভিব্যহারে লইয়া সন্নিহিত কোন প্রান্তরে গমন করিতেছেন, এমন সময়ে দৈবাৎ পথিমধ্যে কোন একটি জলাশয়ের নিকটবর্ত্তী হইবা মাত্র কোম্ত সহসা বলিয়া উঠিলেন যে ‘আমি পদব্রজে এই হ্রদোপরি অবলীলা ক্রমে বিচরণ করিতে পারি, এবং যদিও সন্তরণ বিষয়ে আপারগ তথাপি আমার জলমগ্ন হইবার কোন আশঙ্কা নাই।’ এই বলিয়াই তিনি একেবারে তদভিমুখে গমনোদ্যত হইলেন। হতভাগিনী বনিতা তাঁহাকে নানা মতে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই ক্ষান্ত না হইয়া উক্ত পরিক্ষায় নিতান্ত উদ্ধত হইলেন এবং স্বীয় সহধর্ম্মিণীকে সবলে সেই জলাশয়াভিমুখে আকর্ষণ করিতে লাগিলেন। পতিপরায়ণা কেরোলাইন্ যৌবনাবস্থা প্রযুক্ত বিলক্ষণ বলিষ্ঠা ও বুদ্ধিমতী ছিলেন, কিন্তু ছলে, বলে, কৌশলেও তাঁহাকে তদ্বিষয়ে নিরস্ত করিতে পারিলেন না। কোম্ত ভার্য্যার হস্ত কঠিন রূপে ধারণ করিয়া বেগে সেই হ্রদাভিমুখে ধাবিত হইলেন। অসহায় কুলকামিনী ভাগ্যক্রমে কোন একটি বৃক্ষের সমীপবর্ত্তিনী হইবা মাত্র প্রাণদায়ে উহাকে এতাধিক কঠিন রূপে অবলম্বন করিলেন যে কোম্ত ক্রমশঃ অধিকতর বল পূর্ব্বক আকর্ষণ করিয়া তাঁহাকে সেই বৃক্ষ হইতে বিযুক্ত করিতে পারিলেন না। প্রীতিপ্রদর্শনার এই কৌশলে উভয়েরই প্রাণরক্ষা হইল। অতঃপর তাঁহার দুঃখিনী সহধর্ম্মিণী বহু আয়াশ ও ক্লেশ পরম্পরায় স্বীকার করিয়া আরোগ্য হেতু তাঁহাকে বাতুলালয়ে উপস্থিত করিলেন। কিন্তু এক বৎসর অতীত হইল, রােগের উপশম হওয়া দূরে থাকুক, বরং পরপর বৃদ্ধি হইতে দেখিয়া কেরােলাইন্ সাতিশয় অনুতাপিত হইয়া নিজ পরিচর্য্যায় আরােগ্যের প্রত্যাশায় প্রাণ বল্লভকে গৃহে আনিলেন। ইত্যবসরে কোম্ত জনকজননীর নির্বন্ধাতিশয় অনুরােধপরতন্ত্র হইয়া সর্ব্ব অপার্ষ্যমাণে, ভক্তি ও শ্রদ্ধার একান্ত অসদ্ভাব থাকিলেও, ক্যাথলিক ধর্ম্মাবলম্বী কোন পুরােহিতের দ্বারা পূর্ব্বকৃত সংবিদ্বিবাহ বৈধ করিয়া লইতে অগত্যা সন্মত হইলেন। তাঁহার পিতা মাতা মনে মনে এই স্থির সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে কোম্তের বিবাহ-কার্য্য ধর্ম্মমত নির্ব্বহ না হওয়ায় তিনি এতাদৃশ দুঃসহ দুখঃযন্ত্রণা ভােগ করিতেছেন; যেহেতু নাস্তিকবুদ্ধির পরতন্ত্র হইয়া ধর্ম্মের প্রতি বিদ্বেষ প্রদর্শন করিতে দেখিয়া জগদীশ্বর নিতান্ত রুষ্ট হইয়া তাঁহাকে বিধিমতে ক্লেশ দিতেছেন; এবং আপাততঃ তাঁহাদিগের পুরােহিতের দ্বারা পুনরপি তাহার উদ্বাহ-কার্য্য বৈধরূপে সম্পাদিত হইলে, হয়ত তিনি তাঁহার সকল অপরাধ মার্জ্জনা, ও তাঁহাকে সকল শাস্তি হইতে মুক্ত করিবেন। ঔপযমপত্রে কোম্ত নিজ নাম স্বাক্ষর করিয়া পুরাতন ও অধুনাতন প্রধান রাষ্ট্রবিপ্লবকারী “ব্রূটস্ ও বােনাপার্টির” নাম সন্নিবেশিত করিয়াছিলেন।
জননী ও পত্নীর ঐকান্তিক যত্নে ও অক্লিষ্ট পরিচর্য্যায় তিনি ত্বরায় রােগমুক্ত হইলেন। ঐ পতিপ্রাণা ভার্য্যা ও স্নেহময়ী মাতা উভয়ে যে তদুপলক্ষে কীদৃশ ক্লেশ ও যন্ত্রণা সহ্য করিয়াছিলেন, তাহা অপর কেহ, বাক্যদ্বারা প্রকাশ করা দূরে থাকুক, তিলার্দ্ধ অনুমান করিতেও সক্ষম নহে। তিনি বনিতার প্রতি কয়েকবার ছুরিকা নিক্ষেপ করত ভয় প্রদর্শন করিয়া স্বীয় অভিষ্ট সাধনে যত্ন পাইয়াছিলেন, এবং অপেক্ষাকৃত সুস্থাবস্থায় আপন উন্মত্ততা উত্তেজিত করিয়া মধ্যে মধ্যে আত্মহত্যায় উদ্যত হইতেন। একদা আত্মজিঘাংসায় সীন্ নদীর উচ্চ সেতু হইতে তিনি জলে ঝাঁপ দিয়াছিলেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে কোন এক জন সৈনিক পুরুষ তথা দিয়া যাইতেছিল সে তাঁহাকে জলমগ্ন দেখিয়া ত্বরায় জল হইতে উদ্ধার করত তাঁহার প্রাণ দান দিল। পত্নীকে স্বজ্ঞানকৃত বা অজ্ঞানকৃত যত ক্লেশ এবং যন্ত্রণা দিয়াছিলেন তিনি তন্নিমিত্ত পরিণামে নিতান্ত ক্ষুব্ধ, পরিতাপিত ও লজ্জিত হইয়াছিলেন। নিদারুণ অনুতপ্ত ও খিন্ন হইয়া তিনি বিনীত ও কাতর ভাবে কেরােলাইনের নিকট আপন অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছিলেন। ইহাতে বিলক্ষণ প্রতীত হইতেছে যে কেরােলাইনের অকৃত্রিম প্রণয়, সাধুতা ও সুশীলতা যথার্থই তাঁহার হৃদয়ঙ্গম হইয়াছিল। যাঁহারা তৎকালীন কোম্তের উদ্ধত স্বভাব, নৃশংস ব্যবহার ও কলহপ্রিয়তাগুণ সবিশেষ অবগত ছিলেন তাঁহারা সকলেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতেন যে তাঁহার মৃত্যু ঐ চিরদুঃখিনী রমণীর পক্ষে শতগুণে শ্রেয়স্কর ছিল। ঐরূপ প্রগাঢ় পরিতাপ পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ তাঁহার পক্ষে নিরতিশয় হিতকর হইয়া উঠিল এবং সত্বরই তিনি এ ভয়ানক পীড়া হইতে মুক্তি লাভ করিলেন। আমরাও তাঁহার অন্যান্য জীবিতাখ্যায়কদিগের ন্যায় এই শােচনীয়াবস্থার সবিশেষ বিবরণ করিলাম; কারণ তাঁহার চরিত্রের বা গ্রন্থের দোষাদোষ অনুধাবন করিতে হইলে এতদ্বিষয় আদ্যোপান্ত অবগত হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক।
১৮২৮ খৃঃ অব্দের গ্রীষ্মান্তে তিনি সম্পূর্ণ আরােগ্য লাভ করেন ও অনতিবিলম্বেই তৎকালীয় কোন সংবাদ পত্রে স্বীয় এই দুর্দৈব ক্ষিপ্তাবস্থার একটি বিস্তৃতবৃত্তান্ত-পূর্ণ সন্দর্ভ প্রকাশ, এবং পূর্ব্বপ্রস্তাবিত বক্তৃতাবলী পুনর্ব্বার আরম্ভ, করিয়াছিলেন। ১৮৩০ খৃঃ অব্দে তাঁহার বক্তৃতাবলীর প্রথম খণ্ড মুদ্রিত ও প্রচারিত হয়। ঐ বৎসর তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রসম্ভূত কতিপয় অত্যুৎকৃষ্ট প্রকাশ্য বক্তৃতা করেন, এবং ১৮৩৪ খৃঃ অব্দে তত্ত্বাবৎ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। তাঁহার দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক বক্তৃতাগুলির দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৩৫ খৃঃ অব্দে ও পরিশিষ্ট, অর্থাৎ, ষষ্ঠ খণ্ড ১৮৪২ খৃঃ অব্দে মুদ্রিত ও প্রচারিত হয়। তাঁহার ইংলণ্ডীয় অনুসারী ও অভিবাদকদিগের মতে ১৮২৫ খৃঃ অব্দ হইতে ১৮৪২ খুঃ অব্দ পর্য্যন্ত এই সপ্তদশ বৎসর তাঁহার জীবনের সারাংশ। বাস্তবিক তিনি ঐ কয়েক বৎসর এক প্রকার সুখস্বচ্ছন্দে দিনপাত করিয়াছিলেন। তৎকালে তিনি পলিটেকনিক নামক রাজকীয় বিদ্যালয়ের অধস্তন অধ্যাপকের পদে অধিরূঢ় এবং অন্যত্র অপর একটি পদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত কোন একটি সামান্য পাঠশালায় গণিতশাস্ত্রাধ্যাপনাদ্বারা সমধিক আয় বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। সর্ব্বসমেত প্রায় ৩৩০ টাকা তাঁহার মাসিক আয় হইয়াছিল। অপেক্ষাকৃত অর্থের সাচ্ছল্য প্রযুক্ত তিনি প্রায়ই সুবিধামতে ইটালীয় লঘুরূপক সন্দর্শনে গমন করিতেন। সঙ্গীতবিদ্যায় রীতিমত শিক্ষিত থাকায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি জন্মে নাই বটে, কিন্তু তথাচ তদ্বিষয়ে তাঁহার বিলক্ষণ রসবোধ ছিল। তিনি সাতিশয় সঙ্গীত-প্রিয় ছিলেন ও তাঁহার কণ্ঠস্বর অতীব সুশ্রাব্য ও সুমিষ্ট ছিল; এবং তানমানলয় সংযােগে তিনি কোন কোন গীত পরম পরিপাটি ও সুমধুর রূপে গাহিতে পারিতেন।
আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে এতাদৃশ তৌর্য্যত্রিক-প্রিয় এবং লঘুরূপকসন্দর্শনামােদী কোম্ত রসাভাস বা উপহাসরসাস্বাদনে নিতান্ত বঞ্চিত ছিলেন। তাঁহার ইদানীন্তন গ্রন্থ সমস্তই ইহার প্রমাণ-স্থল। ম. মিল্ বলেন যে “কৌতুক বা পরিহাস কাহাকে বলে,বোধহয়,কোম্ত তাহার বিন্দুবিসর্গও জানিতেন না। তৎপ্রণীত গ্রন্থগুলির মধ্যে এমন স্থল অতি বিরল যাহা পাঠ করিলে তাঁহার রসিকতার কোন পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁহার মতে মলিয়র্ এক জন যথার্থ সুরসিক লেখক; কিন্তু তাঁহার বিশুদ্ধ বিদ্যা ও জ্ঞানের নিমিত্তই তিনি ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন, প্রকৃত বাক্পটুতার জন্য কোন কথাই উল্লেখ করেন নাই। বস্তুতঃ তদ্রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে মধ্যে স্থল বিশেষ একাধিক নীরস ও কর্কশ ভাবে বিরচিত হইয়াছে যে, তৎসমুদায় সমালোচনে স্পষ্টই প্রতীত হয় যে ঐ ঐ স্থলের রচয়িতা জন্মাবচ্ছিন্নে কখন মুহূর্ত্তৈকের জন্যও হাস্য করেন নাই।”
ম. গিজো বলেন;—“ম. অগস্তু্ কোম্তের সহিত আমার চাক্ষুষ পরিচয় ছিল। ১৮২৪ খৃঃ অব্দ হইতে ১৮৩০ খৃঃ অব্দ পর্য্যন্ত এই ছয়বৎসরকালমধ্যে তাঁহার সহিত আমার কয়েক বার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। আমি তাঁহার প্রখর বুদ্ধিশক্তি এবং সমুন্নত অভিপ্রায় দেখিয়া সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছিলাম। একদা ১৮৩২ খৃঃ অব্দের অক্টোবর্ মাসে, আমি রাজকীয় বিদ্যালয় সমূহের অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত হইবা মাত্র, তিনি আমার নিকট সহসা উপনীত হইলেন, এবং আমাকে, তাঁহার নিজের জন্য, “কলেজ্ অব্ ফান্সে,” একটি পদার্থ ও গণিতবিদ্যা সম্বন্ধীয় সাধারণ ইতিবৃত্তের অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করিতে, সদম্ভে অনুরোধ করিলেন। তাঁহার সহিত কথোপকথনে এবং তাঁহার আচারব্যবহার সন্দর্শনে আমার অন্তঃকরণে তৎকালীন যে যে ভাবের উদয় হইয়াছিল আমি তৎসমুদায় মদ্রচিত “জীবন চরিত” গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিয়াছি, কিন্তু এক্ষণে অকস্মাৎ সেইসকলের অন্যথা লিখিবার নিমিত্ত কোন বিশেষ কারণ দেখিতে পাওয়া যায় নাই। তিনি আমার নিকট মনুষ্য, সমাজ, সভ্যতা, ধর্ম্ম, দর্শন এবং ইতিহাস বিষয়ক স্বীয় মত অতি অস্পষ্ট ও কদর্য্য রূপে ব্যাখ্যা করিলেন। তিনি একমনা,স্পষ্টবাদী,অমায়িক, স্বাবলম্বী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, স্বেচ্ছাচারী, এবং বাহ্যিক দৃশ্যে অতি শান্ত ও নম্র, কিন্তু বাস্তবিক ভয়ানক দাম্ভিক,ছিলেন। তাঁহার আন্তরিক বিশ্বাস ছিল যে, ভুমণ্ডলে মানবজাতির সামাজিক ও মানসিক উন্নতি সাধন করিয়া যুগান্তর উপস্থিত করাই যেন তাঁহার যথার্থ ব্যবসায়। আমি তাঁহার সমস্ত কথাবার্ত্তা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া মনে মনে তখন এই আন্দোলন করিতে লাগিলাম যে, এতাদৃশ প্রশস্ত ও সমুন্নতবুদ্ধিজীবী ব্যক্তি কি প্রকারে এমন ক্ষুদ্র ও অকিঞ্চিৎকর হইলেন যে জিগীষার বশবর্ত্তী হইয়া বিচারকালে নিজ মত সমর্থন করিবার জন্য এত ভয়ানক ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন যে যথার্থ তত্ত্বনির্ণয় পক্ষে দৃষ্টিপাত মাত্র রহিল না, এবং আলােচিত বা প্রস্তাবিত বিষয় যুক্তিযুক্ত বা ন্যায়ানুগত, কি না, তাহার কিছুই অবধারণ করিতে পারিলেন না, এবং সদর্পে যে কোন্ প্রশ্নের কি মীমাংসা করিলেন তাহার কিঞ্চিন্মাত্রও স্থিরতা নাই—যে ঈদৃশ নিস্বার্থ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি আপন মতানুবর্ত্তী প্রসঙ্গ না করিয়া অনবধানবশতঃ কতই তদ্বিরুদ্ধ উক্তি করিলে,এবং মধ্যে মধ্যে তাহা জানিতে পারিয়াও নিঃসৃত বিরোধােক্তিই সমর্থন হেতু অম্লানবদনে আপনার মতের প্রতি বারম্বর বিদ্বেষ প্রদর্শন করিয়া তাহার ঘোরতর প্রতিপক্ষ হইয়া উঠিলেন—যাহা ভ্রমাত্মক ও অস্থির সত্তেও কিয়ৎপরিমাণে নীতিগর্ভ ছিল। আমি তাঁহার সহিত তর্কবিতর্ক করিতে কোন যত্ন পাই নাই। তাঁহার সরলতা, দৃঢকল্প, স্বমতোশ্মত্তি এবং ভ্রমান্ধকতা দেখিয়া আমি নিতান্ত ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত চিত্তে নিস্তব্ধ হইয়া কেবল অপর্য্যামাণে তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিয়া ছিলাম, উত্তর প্রত্যুত্তর উপলক্ষে একটিও বাক্ব্যয় করি নাই। উপরােক্ত অধ্যাপকের পদ প্রস্তুত করিতে উপযােগী বা আবশ্যক বিবেচনা করিলেও, বােধ হয়, তাঁহাকে তৎপদে বৃত করিব বলিয়া, আমি কখন মুহূর্ত্তৈকের জন্য স্বপ্নেও চিন্তা করিতাম না। তিনি ইতিপূর্ব্বে যে বিষম বায়ুগ্রস্ত হইয়াছিলেন আমি তাহার আভাস মাত্র জানিলে তখন বরং অধিকতর ক্ষুদ্ধ হইয়া তদ্রূপ মৌনীই থাকিতাম।”
যে শাসনপ্রণালী রক্ষা করা “জাতীয় রক্ষকদিগের” অভিপ্রায় সাধ্য থাকিলে তিনি নিজেই তাহা আক্রমণ করিতেন, এই হেতুবাদে ১৮৩০ খৃঃ অব্দে উহাদিগের দলভুক্ত হইতে অস্বীকার করায় কোম্ত তিনদিবসকাল কারাধিবাসে আদিষ্ট হইয়াছিলেন।
ইতিপূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে ১৮২৫ খৃঃ অব্দ কোম্তের জীবনের মধ্যে সবিশেষ স্মরণীয়; কারণ ঐ বৎসর তিনি কেরােলাইনের পাণিগ্রহণ করেন, এবং স্বীয় দর্শনশাস্ত্র প্রস্তুত করিয়া তদ্বিবৃতিতে প্রবৃত্ত হয়েন। অধিকন্তু ইহাও কথিত হইয়াছে যে, তাঁহার ইংলণ্ডীয় অভিবাদকদিগের বিবেচনায় ১৮২৫ খৃঃ অব্দ হইতে ১৮৪২ খৃঃ অব্দ পর্য্যন্ত এই কয়েক বৎসর তাঁহার জীবনের সারাংশ। ১৮২৫ খৃঃ অব্দে যেমন তিনি দার পরিগ্রহ করেন এবং তাঁহার দর্শনশাস্ত্রের রচনাকার্য্য পরিসমাপ্ত হইলে তদ্বিবৃতি বিষয়ে ব্যাসক্ত হয়েন; ১৮৪২ খৃঃ অব্দও তাঁহার জীবনমধ্যে সেই রূপ দ্বিবিধ কার্য্যদ্বারা খ্যাত আছে। ঐ বৎসর তিনি স্বীয় পত্নীকে পরিত্যাগ করেন, এবং পূর্ব্বপ্রস্তাবনানুযায়ী তাঁহার দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক দ্বাসপ্ততি বক্তৃতা সম্পূর্ণ হয়। পরিবারের সহিত অহরহঃ এরূপ ভয়ঙ্কর কলহ আরম্ভ করিলেন যে, পরস্পর পৃথক্ হওয়া নিতান্ত আবশ্যক হইয়া উঠিল। সহধর্ম্মিণীর সহিত তিনি যে কি প্রকার ব্যবহার করিতেন, তাহা তাঁহার তৎসাময়িক বিবাহ ও সংসারধর্ম্ম সংক্রান্ত ব্যবস্থা পর্য্যবেক্ষণ করিলেই অনায়াসে প্রতীয়মান হইবে। ম. মিল্ বলেন ষে কোম্তের মতে “দাম্পত্যবন্ধন অখণ্ডনীয়;— অর্থাৎ, উদ্বাহিত স্ত্রীপুরুষ কোন মতেই আর পরিণয়-পাশ অপনীত করিতে পারিবে না, এবং উক্ত বন্ধন অপনয়ন করা, যে কোন কারণেই হউক না কেন, নিতান্ত অব্যবস্থআ গর্হিতকর্ম্ম। জায়া স্বামীর সম্পূর্ণ বশবর্ত্তীনী এবং সমস্ত স্ত্রীজাতি সম্যক প্রকারে পুরুষ জাতির আয়ত্তাধীন হইয়া গৃহধর্ম্ম সম্পাদন করিবে।” তদন্তর তিনি আর কহিয়াছেন যে “এক জন প্রসিদ্ধ দার্শনিক দিবানিশি পত্নীর সহিত বিবাদ করিতেন, একথা আপামরসাধারণে ব্যক্ত করা অত্যন্ত দুঃখজনক বটে, কিন্তু তাঁহার জীবিতাখ্যায়কেরা তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধীয় যে সকল ব্যাপার বা ঘটনা প্রকাশ করিয়াছেন তাহাতে উল্লিখিত কোন না কোন মতটির বিশেষ ব্যাখ্যা করা হইয়াছে।”
স্ত্রীপুরুষে পৃথক্ হইবার অব্যবহিতকাল পরেই ম. ক্লোটিল্ড্ ডিভোঁ নাম্নী কোন রমণীর প্রতি তাঁহার প্রগাঢ় অনুরাগ জন্মে। কথিত হইয়াছে যে, উক্ত কামিনীর স্বামী কোন গুরুতর অপরাধ হেতু যাবজ্জীবন কারাবাসে আদিষ্ট হইয়াছিল। অতঃপর কোম্ত তাঁহার বিবাহ বিষয়ক পূর্ব্বপ্রকাশিত মত রা ব্যবস্থা সমস্ত আদ্যোপান্ত পরিবর্ত্তন করেন; এবং এমনকি,তাঁহার সমস্ত দর্শনশাস্ত্র ও সেই সময়ে একেবারে সমূলে পরিবর্ত্তিত ও নবীকৃত হইয়াছিল, বলিলেও বলা যায়। “বিবাহ-বন্ধন অখণ্ডনীয়” অকস্মাৎ এই বচনের বিলক্ষণ বৈলক্ষণ উপস্থিত! ইহা সপ্রমান করিবার জন্য পুনশ্চ মিল্ মহাশয়ের কয়েক পংক্তি অবিকল অনুবাদ করিয়া এস্থানে সন্নিবেশিত করা হইল;—“কোন একটি বিশেষ কারণ ব্যতীত পরিণয়-পাশ অখণ্ডনীয়। যিনি সমস্ত পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে এক জন ভয়ানক নিষেধবাদী, যিনি ইংলণ্ড প্রভৃতি অপরাপর সম্ভ্রান্ত জনপদের ব্যবস্থা সংহিতায় কোন কোন অত্যাবশ্যকীয় কারণ বশতঃ বর্জ্জনপ্রথা সুপ্রশস্ত-কল্প বা বিধেয় সাব্যস্ত করায় তৎসমুদায়ের নিরতিশয় গ্লানি ও কুৎসা, এবং এবম্বিধ দেশাচারকে যৎপরোনাস্তি গর্হিত বলিয়া ব্যাখ্যা, করিয়াছিলেন, তিনি আপনিই আবার যে কারণে অন্যান্য সভ্যদেশীয় ব্যবস্থানুসারে স্ত্রীপুরুষ পৃথক হওয়া অন্যায়, নীতিবিরুদ্ধ ও অপ্রশস্ত কল্প,সেই কারণেই পরিত্যাগপ্রথা যুক্তিযুক্ত বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন।—যথা, কোন স্ত্রী বা পুরুষ দুষ্কর্ম্ম নিবন্ধন যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ বা নির্ব্বাসিত হইলে তাহার ভর্ত্তা বা পত্নী তাহাকে ইচ্ছামতে পারি ত্যাগ করিতে পারে, তদ্ব্যতীত অন্য কোন কারণেই পরিত্যাগ করিতে পারে না। এ ব্যবস্থা এতদ্দেশে কুত্রাপি প্রচলিত নাই—এই নিয়মটি তিনিই নূতন প্রবর্ত্তিত করেন। অবশ্য, কোম ত যে কেবল উক্ত হেতুবাদে এই অভিনব ব্যবস্থা সঙ্গত বা ন্যায়ানুগত বলিবেন তার আর আশ্চর্য্য কি! যে হেতু তাঁহার প্রণয়িনী ক্লোটিল ড্ দুরদৃষ্ট বশতঃ তদবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তদবধি তাঁহার স্ত্রীজাতি সম্বন্ধীয় ব্যবস্থা ও চিত্তবাদ অযৌক্তিক এবং নীতিবিরুদ্ধ সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত বহু পরিমাণে কোমল হইয়া উঠিয়াছিল। তাঁহার পরিশিষ্ট সমাজশাস্ত্রে উহাদিগকে অবাধে প্রকৃত দেবীপদারূঢ় করত পূজা, মর্য্যাদা, আধিপত্য, প্রভৃতি অশেষ প্রকার গৌরব প্রয়োেগ, ও সকলের আরাধ্য বস্তু বলিয়া বিধিবদ্ধ, করা হইয়াছে; কিন্তু তথাপি সামান্য সামান্য ন্যায্য বিষয়ে বঞ্চিত রাখিয়া উহাদিগের যথোচিত অধিকার অপলাপ করিতে কোন যত্নের ত্রুটি করা হয় নাই।”
ম. লিউইস বলেন;—“যিনি তাঁহাকে স্বচক্ষে ঐ স্বল্পদিনস্থায়ী প্রণয়-সুখ সম্ভোগ করিতে দেখিয়াছেন, তিনি অনায়াসেই বলিতে পারিবেন যে, কোম্ত ক্লোটিল্ডের প্রেমে কিরূপ অভিভূত হইয়াছিলেন, এবং অহর্নিশি কতই অনির্ব্বচনীয় আনন্দ সহকারে, প্রেমাশ্রুপুর্ণলোচনে ও গদ্গদ বচনে তাঁহার অসীম গুণগান করিতেন। যতই তিনি স্বমুখে ঐ সদাশয়া রমনীর প্রকৃতি বর্ণনা করিতেন ততই তাঁহার হৃদয়কন্দর আনন্দপ্রবাহে উচ্ছলিত হইত, এবং নয়নযুগলবিগলিত অশ্রুনীরে তাঁহার বক্ষস্থল প্লাবিত হইতে থাকিত। ক্লোটিল্ডের প্রতি তাঁহার এতাদৃশ আসক্তি জন্মিবার প্রাক্কালীন আমি তাঁহাকে দর্শন করি, এবং তিনি আমার নিকট এত বিস্তৃত রূপে ঐ গুণবতী রমণীর অশেষ গুণগ্রাম কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন যে তচ্ছ্রবণে আমার অন্তঃকরণে নিরতিশয় প্রীতির ও আনন্দের উদ্রেক হইয়াছিল।” —“যখন আমি তাঁহার সহিত পুনর্ব্বার সাক্ষাৎ করি, তখন তিনি ক্লোটিল্ডের দুর্বিষহ বিরহাধিকাতর হইয়া অবিশ্রান্ত বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছিলেন। এবম্প্রকার বিষমবিরহবিধুর কোম্ত যতই তাঁহার স্বর্গীয় প্রণয়িনীর অলোকসামান্য গুণরাশি বর্ণনা করিতেছিলেন ততই তাঁহার লোচনযুগল হইতে অনবরত বাষ্পবারি মহা বেগে প্রবাহিত হইতেছিল; এবং তাঁহার অন্তরস্থ দুর্নিবার শোকসিন্ধু ক্রমশঃ উত্তলিত হইয়া তাঁহাকে সময়ে সময়ে সংজ্ঞাশূন্য করিতেছিল। অধিক কি বলিব, তিনি ডিভোঁর শোকে নিতান্ত বিহ্বল ও ম্রিয়মাণ হইয়াছিলেন। এক বৎসর কাল মাত্র তিনি ঐ অনির্ব্বচনীয় পরম প্রণয় সুখ উপভোগ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। ক্লোটিল্ডের লোকান্তর প্রাপ্তির পরেও তৎপ্রতি তাঁহার পূর্ব্বতন প্রগাঢ় প্রীতি এবং অনুরাগের লেশ মাত্রও শৈথিল্য হয় মাই। ক্লোটিল্ড্ কেবল রূপান্তর প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। কোম্তের প্রেমাভিভূত অন্তঃকরণে তাঁহার প্রেমময়ী প্রতিমা নিরন্তর জাগরুক ছিল, এবং ঐ কাল্পনিক প্রতিমূর্ত্তিতেই তিনি যেন প্রত্যক্ষ বিরাজমানা ছিলেন, তাঁহার এই রূপ উপলব্ধি হইত।” ম. কোম্ত স্বয়ং কহিয়াছেন;—“আমি তাঁহারই প্রভাবে পরিশেষে মানবজাতির শুভ সাধনে প্রকৃত দ্বিবিধ কল্প হইয়া উঠিয়াছিলাম। যিনি যথার্থ স্ত্রীজনবিভাবিত পবিত্র প্রণয়সুখ সম্ভোগে সমর্থ হইয়াছেন তিনি অবলীলাক্রমেই তদবস্থা প্রাপ্ত হইতে পারেন। যদ্যপি ক্লোটিল্ডের সহিত আমার শুভদৃষ্টি না হইত, যদ্যপি আমি তাঁহার পরম পবিত্র প্রেমে বঞ্চিত থাকিতাম, যদ্যপি তাঁহার অনির্ব্বচনীয় ও পরম প্রতিপ্রদায়িনী ঐশিক শক্তি আমার হৃদয়ে স্ফূর্ত্তি না পাইয়া আমার চিত্তবৃত্তির ঔৎকর্ষ সম্পাদিত না হইত, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই আজন্ম কাল এরিসটট্লের ন্যায় কেবল বিজ্ঞানানুশীলনেই একাদিক্রমে অভিনিবিষ্ট থাকিয়া দেহযাত্রা সম্বরন করিতাম, এবং কোন ক্রমেই সেণ্ট্ পলের সদৃশ ধর্ম্মযাজন-স্পৃহা আমার চিত্তে উদীপিত হইত না। বিশুদ্ধ বিজ্ঞানশাস্ত্র সমস্ত হইতে আমি নিগূঢ় ও অতর্কিতচর দর্শন নিঃসৃত করিয়াছি এবং ক্লোটিল্ডের প্রভাবে সেই দর্শনশাস্ত্র অবলম্বন করিয়া সর্ব্বজনােপযােগী বিশ্বধর্ম্ম সংস্থাপনে কৃতকার্য্য হইয়াছি।” বর্ত্তমান শতাব্দীর স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বভণ্ড এরিস্টট্লের বিনয় ও নম্রতার সীমা কি! সগর্ব্বিত বিশ্বধর্মসূষ্টিকর্তার শীলতা ধন্য! যাহা হউক, তাঁহার ঔদার্য্যগুণে যে তিনি তাঁহার শক্তিরূপ ক্লোটিল্ড্কে এস্থলে বিস্মৃত হন নাই, ইহাই পরম আনন্দের বিষয়! “অদ্যাবধি আমাদিগের উভয়ের অভেদ কীর্ত্তি। তাঁহার গৌরবেই আমার যথেষ্ট গৌরব, এবং তাঁহার পুরস্কারেই আমার যথেষ্ট পুরস্কার। এক্ষণে আবহমানকালের জন্য তিনি যথার্থ সর্ব্বশরণ্য বরেণ্য পরমসতে বিলীন হইয়াছেন,এবং তাঁহার প্রেমময়ী প্রতিমূর্ত্তি আমার হৃদয়মন্দিরে যেন উহার সর্ব্বোৎকৃষ্ট প্রতিনিধিস্বরূপ নিয়ত আবির্ভূত রহিয়াছে।” এস্থলে স্মরণ রাখা কর্ত্তব্য যে তাঁহাদিগের দেবতা পরমসতকে সদ্ব্যক্তিরাই জীবনান্তে প্রাপ্ত হয়েন;— অর্থাৎ, যথার্থ গুণবান ও সাধুলােকেরাই জীবনান্তে তাহাতে মিলিত হয়েন—তৎপ্রাপ্তিও মানসিক অনুধ্যান মাত্র—এবং তদ্ব্যতীত অন্যান্য সকলেই একেবারে ধ্বংস বা লুপ্ত হইয়া যায়। কোম্তের মতে স্বার্থশূন্য হইয়া পরােপকারব্রতে ব্রতী হওয়াই আমাদিগের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। সমস্ত মনুষ্যজাতিকে সাক্ষাৎ উপাস্য দেবতা ভাবিয়া তাহার সেবাশুশ্রূষায় অহর্নিশি তৎপর থাকা কর্ত্তব্য। এই দেবতার নাম পরমসৎ তিনি বলেন কালে সকলে অন্যান্য সমগ্র দেবের পূজার্চ্চণা পরিত্যাগ করিয়া পরমসতের আরাধনা করিবে। মনুষ্যের উপচিকীর্ষা-বৃত্তি ক্রমশঃ প্রবল হইয়া যতদূর স্বার্থপরতাকে নিরাকরণ করিবে এবং যত দুর আমরা নিস্বার্থ ও আত্মবিস্মৃত হইয়া অন্যের শুভসাধনে ঐকান্তিক যত্ন স্বীকার করিব ততই পরমসতের সেবা ও উপাসনা হইতে থাকিবে এবং তদানুষঙ্গিক চরমে আমাদিগের পরম পুরুষার্থও লাভ হইবে। প্রেম, ভক্তি ও স্নেহ ব্যতীত কেবল দয়া বা করুণা দ্বারায় মনুষ্যের সম্যক উন্নতি হওয়া কোন ক্রমেই সম্ভাবিত নহে। তাঁহার মতে ভক্তিরূপা মাতা, প্রীতিরূপা পত্নী এবং স্নেহরূপা কন্যা আমাদিগের প্রত্যক্ষ গৃহদেবতা। লিউইস্ বলেন যে কোম্ত সদাসর্ব্বদা দাঁতের একটি শ্লোক বিশেষ তাঁহার ক্লোটিল্ডে প্রয়ােগ করিতেন, আমরা নিম্নে তাহার অনুবাদ করিলাম,——
যাঁহার পবিত্র প্রেমে প্লাবিত জীবন,
মনের মালিন্য মম হরিল সে জন।
পূর্ব্বে কোম্ত কেবল প্রমিত এবং প্রমেয় প্রদার্থে বিশ্বাস করিতেন। যাহা আমাদিগের বুদ্ধিগম্য;— অর্থাৎ, যে সকল বিষয় বুদ্ধিদ্বারা উপলব্ধি হইতে পারে, তাহাই তিনি মানিতেন। কিন্তু ডিভোঁর প্রতি তাঁহার বিশুদ্ধ প্রেম সঞ্চার হওয়ায় তাঁহার ধর্ম্মপ্রবৃত্তি পরিবর্দ্ধিত এবং সমুত্তেজিত হইয়াছিল। তদবধি বুদ্ধিবৃত্তি অন্তঃকরণের (ধর্ম্মপ্রবৃত্তির) কিঙ্করী—তাহার কৃতদাসীনহে— তাঁহার মনে এই দৃঢ় সংস্কার জন্মিল। ম. কোম্ত আপনার তৎকালিক মতান্তর প্রাপ্তিকে উন্নতিজনিত চিত্তৌৎকর্ষ বা নীতিসংস্করণ বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ক্লোটিল্ডের ঐশিক শক্তি এবং তৎপ্রতি তাঁহার প্রগাঢ় প্রেমই উহার প্রধান কারণ। তাঁহার ইদানীন্তন গ্রন্থ সমূহে ঐ প্রভাবশালিনীর ও তাঁহার শুভদায়িনী শক্তির বিষয় তিনি ভূয়োভূয়ঃ উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি আর কহিয়াছেন যে ক্লোটিল্ড কর্ত্তৃক “তাঁহার হৃদাকাশে যে অলৌকিক সুখাশা সমুদিত ইয়াছিল তাহা তিনি কখন ক্ষণকালের জন্যও যথার্থ উপভোগ করিতে পারেন নাই,কেবল কল্পনাধারায় অনুভব করিয়া ক্রমাগত চিত্তকে পরিতৃপ্ত রাখিয়াছিলেন।”
উক্ত পরিবর্ত্তনকে উৎকৃষ্ট বলা দূরে থাকুক, অনেকে তাঁহার স্বীয় পত্নীকে পরিত্যাগ ও অপরকে গ্রহণ করায় তাঁহার মতের সম্পূর্ণ বৈলক্ষণ্য হইয়াছে বলিয়া, প্রতিপাদন করিয়াছেন;—অর্থাৎ, উক্ত আচরণে তাঁহার ধ্রুববাদ সমূলে পরিত্যাগ, এবং অপর তত্ত্বপ্রণালী অবলম্বন করা হইয়াছে বলিয়া, নির্দ্ধারিত করিয়াছেন। ম. মিল্ বলেন যে বিজ্ঞান-দর্শন দুইটি প্রধান অঙ্গে বিভক্ত;—যথা, তত্ত্বানুসন্ধান-রীতি এবং প্রমাণানুগত ধর্ম্ম। প্রথমটি উপপত্তি বা সিদ্ধান্ত পক্ষে আমাদিগের প্রতিভাশক্তির পথদর্শক এবং অপরটি তৎসম্বন্ধীয় প্রমাণ-পরিক্ষক। প্রথমটি সম্পূর্ণ ও নির্দ্দোষ হইলে আমরা অভিনব আবিষ্কারে কৃতকার্য্য হইতে পারি, এবং অপরটি সুসম্পাদিত ও অসংশয়িত হইলে আবিষ্কৃত বিষয় প্রামাণিক, কি না, তাহা নিরূপন বা স্থির নিশ্চয় করিবার (অর্থাৎ, তৎসম্বন্ধে প্রমাণ দর্শাইবার বা দর্শিত প্রমাণ সঙ্গত, কি না, তাহা জানিবার) প্রধান উপায়। যদ্যপি আমরা দর্শনশাস্ত্রের এই রূপ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উৎকৃষ্ট বলিয়া গণ্য করি, তাহা হইলে,স্ত্রীকে পরিত্যাগ করায় কোম্তের যে আদৌ ধ্রুববাদ অমান্য করা হইয়াছে, ইহা আমাদিগকে অবশ্যই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে, সন্দেহ নাই। যে রমণী তাঁহার নিমিত্ত অসীম ক্লেশ ও ভক্তাচ্ছদনরহিত দারিদ্র্যদুঃখ পরম্পরায় সহ্য করিয়াও প্রাণপণে তাঁহার সুখসংবর্দ্ধনে যত্ন পাইতেন, নিরপরাধিনী সেই স্বাধ্বী কামিনীকে পরিত্যাগ করায় “বিবাহ-বন্ধন অখণ্ডনীয়” তাঁহার এই বচনের যে নিতান্ত ব্যতিক্রম জন্মিয়াছিল, ইহা দৃঢ়বাদী ও নিরপেক্ষ লোক মাত্রই অঙ্গীকার করিবেন। আমরা যত দূর পর্য্যন্ত পরিচ্ছন্ন রূপে অবগত আছি তাহাতে ঐ পতিপ্রাণা রমণীর কোন বিশেষ দোষ দেখিতে পাই নাই,কেবল কোম্ত আপনি কখন কখন বলিতেন যে তাঁহার পত্নী তাঁহাকে “অশ্রদ্ধা ও অযত্ন করে;” কিন্তু উহা যে কি পর্য্যন্ত সঙ্গত তদ্বিষয়ে যথার্থ অনুসন্ধিৎসু হইলে কোম্তের ঐ কথাটি ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না যাহাতে তদনুযুক্ত অপরাধ সপ্রমাণ হইতে পারে। ম. লিউইস্ বলেন যে ১৮৪২ খৃঃ অব্দে “তাঁহার পূর্ব্বতন তত্ত্বানুসন্ধানপ্রণালীর সম্পূর্ণ ব্যত্যয় ঘটিয়াছিল,—বস্তুতঃ তিনি তৎপরিবর্ত্তনে বাধিত হইয়াছিলেন। মতভেদের সহিত তাঁহার চিত্তেরও ভাবান্তর উপস্থিত হইয়াছিল;—অর্থাৎ, তৎকালীন তাঁহার চিত্তহারিণী ক্লোটিল্ডের প্রতি তাঁহার সাতিশয় প্রগাঢ় আশক্তি জন্মিয়াছিল। প্রমেয়গত বা ধ্রুববাদানুবর্ত্তী প্রথা পরিত্যাগ করিয়া তিনি জগদ্গুরু পোপের মত প্রমাতৃগত বা কাল্পনিক অনুধ্যানানুষায়িক সামাজিক এবং প্রাতিপুরুষিক নিয়ম ও ব্যবস্থা সংস্থাপন করিতে সাহংকারে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন;—অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ প্রমাণ পরিত্যাগ, এবং আনুমানিক প্রমাণ অবলম্বন, করিয়া তিনি সদর্পে সর্ব্ব বিষয়ের মীমাংসা করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন”[১] তিনি পুনশ্চ কহিয়াছেন যে কোম্তকৃত নীতিশাস্ত্রের অনুসন্ধান-রীতির এবং সিন্ধান্তকলাপের প্রতি তাঁহার সবিশেষ আক্রোশ বা বিদ্বেষ থাকাতে তিনি বহুদিবসাবধি উক্ত গ্রন্থ খানি (কোম্তের এক খানি বিশিষ্ট গ্রন্থ, ১৮৪২ খৃঃ অব্দের পরে প্রচারিত হয়) ধ্রুববাদ হইতে যৎকুৎসিত ভ্রষ্ট বলিয়া গণ্য করিতেন।
কোম্তকৃত দর্শনের প্রথমার্দ্ধ যে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর এবং অপ্রামাণিক তাহা, বােধ হয়, এক্ষণে সবিশেষ প্রতিপন্ন হইল। ম. মিল্ বলেন যে, তাঁহার দর্শনের শেষার্দ্ধ (প্রমাণানুগত ধর্ম্ম) যে কেবল ছিল না, এমন নহে, বরং তিনি প্রকারান্তরে তদ্বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছেন।
ম. লিউইস্ বলেন যে ১৮৪২ খৃঃ অব্দের পরে তিনি যে সকল গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন প্রায় তৎসমুদায়ই অত্যাশ্চর্য্য অলীকপ্রসঙ্গে পরিপূর্ণ। তিনি প্রকৃত সর্ব্বজ্ঞের ন্যায় অসম্ভাবনীয় অনুভব দ্বারায় অনাগতকালগর্ভনিদ্রিত বিষয়ের মীমাংসা করিতে অসঙ্কুচিত চিত্তে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। আপামরসাধারণের উপর কোম্তের স্বীয় প্রাধান্য সংস্থাপনাকাঙ্ক্ষা এতাদৃশী বলবতী দেখিয়া তাঁহার (লিউইসের) ঐ সকল গ্রন্থের উপর এক প্রকার ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা জন্মিয়ছিল। “উক্ত গ্রন্থ গুলির মধ্যে যে সকল বিষয়লিপি বন্ধ করা হইয়াছে তত্তাবৎ নিতান্ত জঘন্য ও ভ্রান্তিমূলক; কারণ উহাদিগের স্বীকৃত তত্ত্ব সমূহ যৎপরােনাস্তি অযৌক্তিক ও দোষাবহ। যদ্যপি ঐ স্বীকৃত তত্ত্ব গুলিন যথার্থ বা প্রামাণিক হইত, তাহা হইলে তাঁহার উপ- পত্তি বা ব্যাপ্তি সমগ্রই, এক্ষণে যে পরিমাণে উপহাস্য ও অশ্রদ্ধেয় হইয়াছে, সেই পরিমাণে সর্ব্বত্র আদরনীয় ও প্রতিপন্ন হইত, সন্দেহ নাই”। “ঐ অমূলক গ্রন্থ- গুলিন আদ্যন্ত কেবল প্রকল্পনাপূর্ণ, সুতরাং কোন বিশেষ মতপ্রতিপাদক নহে।” “যাঁহাৱা বুভুৎসা সহকারে এবং অপক্ষপাতী হৃদয়ে তাঁহার দর্শন খানি একবার আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়াছেন তাঁহারা বিলক্ষণ অবগত আছেন যে কোমত কতই আপনার প্রভুত্বসংস্থাপন লােভের দুরাশাগ্রস্ত হইয়াছিলেন ও আমাদিগের লক্ষনি- চয়ের সাধারণসংস্থাপন করিবার প্রবৃত্তি তাঁহার অন্তঃক- রণে দিন দিন কি ভয়ঙ্কর বলবতী হইয়া উঠিয়াছিল (ম.মিল যথার্থ টিপ্পনী করিয়াছেন যে, তদ্রুপ একবৰ্গতাপাদন বা এক প্রণালীতে পরিণত করা আবশ্যক, কি না, তদ্বিষয়ে কোন মীমাংসাই করেন নাই),এবং প্রমেয়গত বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ নিরপেক্ষ আনুমিতক সিদ্ধান্তের প্রতি তাঁহার কিদৃশ বিপর্যয় ঔৎসুক্য ও অনুরাগ জন্মিয়াছিল!” “তাঁহার আত্মনিষ্ঠ। ক্রমশঃ এতাদৃশ ঘােরতর পরিবর্ধিত হইয়াছিল যে পরিণামে আপনার মত বা সিদ্ধান্ত অখণ্ডনীয় বলিয়া তাঁহার অন্তঃকরণে প্রগাঢ় ভক্তি ও বিশ্বাস বদ্ধমুল হইয়াউঠিয়াছিল,সুতরাং,অপর কেহ তদ্বিরােধােক্তি করিলে, তাহার কথায় কর্ণপাত করা দূরে থাকুক, তিনি তৎক্ষণাও তাহার প্রতি খড়গহস্ত হইয়া উঠিতেন। তিনি আপনি যাহা মীমাংশা করিতেন তাহাতেই তাঁহার ধ্রুবজ্ঞান হইত। এবম্বিধ আত্মাভিমান উত্তরােত্তর তাঁহার পক্ষে নিতান্ত অনিষ্টকর হইয়া উঠিয়াছিল। সকলের উপর তাঁহার আপন আধিপত্য সংস্থাপন লােভের দুরাকাঙ্ক্ষার ইয়ত্তা ছিল না যাহা তাঁহার নিজের বিবেচনায়- যথার্থ বােধ হইত, তাহাই তিনি প্রকৃত সিদ্ধান্ত বলিয়া স্থির করিতেন, এবং স্বীয় কল্পনাই তৎসম্বন্ধে অতর্কিত চর প্রমাণ বা প্রতিভূ বলিয়া অবধারিত করিয়া অবশেষে অশেষ দোষের দোষী হইয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি নিরবচ্ছিন্ন নির্জনে উপ- বিষ্ট হইয়া নিবিষ্ট চিত্তে বিশ্বরাজ্যের কৌশল চিন্তা করি- তেন, এবং স্বীয় কল্পনাজনিত সুদূরপরাহত অনুমানতত্ত্ব সমূহের অলৌকিক ও অশ্রুতপূর্ব্ব শোভাসৌন্দর্য্য সন্দর্শনে বিমােহিত হইয়া তৎসমুদায় অসঙ্গত বল। দূরে থাকুক এক- বার সন্দিগ্ধ মনে অনুধাবন করাও তাঁহার পক্ষে বিষম দুরূহ ব্যাপার হইয়া উঠিয়াছিল। প্রতিভাসম্পন্নজনগণ সুলভ আনুমিতক সিদ্ধান্ত উপলব্ধি করিবার ব্যগ্র তা নিবন্ধন তিনি অভিনব তত্ত্বানুসন্ধানেই অনবরত অভিনিবিষ্ট থাকি- তেন,সুতরাং,আবিস্কৃত বা উদ্ভাবিত বিষয়ের দোষাদোষ পর্যালোচনায় সুযোগ পাইতেন না। অধিকন্তু,ধর্মযাজন- স্পৃহা। ঘোরতর বলবতী হইয়া যথার্থ ন্যায়ানুরাগী ও দৃঢ়- বাদী ব্যবস্থাপককে একেবারে পাযুক্ত এবং প্রভুত্ব- বিলাসী পােপের পদে শীঘ্রই অভিষেক করিয়াছিল।” এস্থলে স্পষ্টই প্রতীত হইতেছে যে তিনি প্রমাণানুগতধর্ম;—অর্থাৎ, বিজ্ঞান-দর্শনের শেষার্দ্ধের প্রতি কখন মনোযােগ করেন নাই।
ফ্রেজর নামক এক খানি সাময়িক পুস্তিকায় কোমতের তৎকালিক মতভেদ বিষয়ক একটি চমৎকার রূপক প্রকাশিত হইয়াছিল। উহাতে সচরাচর দর্শন- শস্ত্র লইয়াই আন্দোলিত হইয়া থাকে। অবসর অনুসারে ম. মিল্ প্রভৃতি কতিপয় অসামান্যবিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্ন মহাত্মাগণ তৎসম্পাদন বিষয়ে প্রায়ই সহায়তা করিয়া- থাকেন। কোমত ধ্ৰুবাদের কোণ্ট (দলপতি) সর্ব্বতন্ত্র বিজ্ঞান শাস্ত্রের সৈন্যদল সমভিব্যাহারে লইয়া আন্ধী- ক্ষিকীর রাজ্ঞী 'আত্ম তত্ত্বের সহিত তুমুল সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছেন বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। গ্রহবৈগুণ- বশতঃ তাঁহার নীতিণাস্ত্র বিষয়ক প্রধান গ্রন্থ খানি প্রকা- শিত হইবার কয়েক বৎসর পরে, সহদা কোন কার্য্যদোষে তাঁহার পূর্ব্বোপার্জ্জিত অসীম যশােরাশি এবং বিজ্ঞান- শাস্ত্রোপরি লব্ধাধিপত্য বহু পরিমাণে বিলুপ্ত হইয়া যায়। কোন বিশেষ হেতু প্রদর্শন না করিয়া প্রচ্ছন্ন। ভাবে আপন পূর্ব্বতন মতের অন্যথাচরণ। করাতেই অকস্মাৎ তাঁহার এতাদৃশ দুরবস্থা উপস্থিত হইয়াছিল। অস্বীক্ষিকীর এবং তাহার রাজ্ঞী আত্মতত্ত্বের প্রতি তিনি সতত যে প্রকার বিরুদ্ধ ভাব অবলম্বন করিয়াছিলেন। তাহাতে ঐ সমস্ত রাজপরিবারবর্গের নিতান্ত ঘৃণা ও। সংশয়পদ হইয়া উঠিয়াছিলেন, এবং তাহারাও তাঁহার নিকট তদতিরিক্ত প্রতিশোধ পাইবার আশঙ্কা করিত; ফলতঃ, পুনর্বিশ্বস্ত হইবার আর কোন সম্ভাবনা ছিল না। যখন তাঁহার আত্মীয়বন্ধুগণ লোক প্রমুখাৎ শুনিতে পাইল যে তিনি আত্মতত্ত্বের কোন স্বল্পবয়স্কা দুহিতাকে লইয়। প্রস্থান করত সংগোপনে তাহার সহিত আপন উদাহকার্য্য নির্বাহ করিয়াছেন, তখন তাঁহাকে অতি নীচ প্রবঞ্চক জ্ঞানে তাহাদের অন্তঃকরণে কতই ভয়, কতই বিস্ময় এবং কতই সংশয় উপস্থিত হইয়াছিল! আক্ষেপের বিষয় এই যে উক্ত জনবাদ ত্বরায় স্বরূপ বলিয়া প্রতিপন্ন হইল, এবং তজ্জন্য উক্ত সর্ব্বতন্ত্রবাদী মাত্রই তাঁহাকে তদবধি অনবরত ধিক্কার ও নিন্দাবাদ করিতে লাগিল। উক্ত শাঠ্যকাপট্যের জন্য তিনি এই ভয়ানক প্রতিফল প্রাপ্ত হইয়াছিলেন যে নিতান্ত অন্তরঙ্গদিগেরও সহিত তাঁহার ঐক্যমত্যচ্যুত হইয়া যায়, এবং উহাদিগের মধ্যে কেহ উক্ত আচরণের প্রতিকারণ দর্শাইবার নিমিত্ত তিনি (কোম্ত) ঐ সময়ে অবশ্যই বায়ুগ্রস্ত হইয়াছিলেন বলিয়া, সাব্যস্ত করিয়াছেন। যাহা হউক, উক্ত রমণীর সহিত যে তাঁহার পরিণয় সম্পাদিত হইয়াছিল, তদ্বিষয়ে আর অনুমাত্র সংশয় নাই। ঐ ভার্য্যার গর্ভে তাঁহার একটি কন্যা জন্মে। ঐ কন্যাটি স্বভাবতঃ সাতিশয় রুগ্না ও কোমলঙ্গী ছিল। পিতামাতার নামানুযায়িক ধ্রুবধর্ম্ম (সদ্ধর্ম্ম) নামে জনসমাজে পরিচিতা হইল। এই অবধি ধ্রুববদিপতির দুরভিসন্ধির ও অসদ্ব্যবহারের শেষ হয় নাই; জন্মাবচ্ছিন্ন নির্ব্বিবাদে বিজ্ঞানশাস্ত্রের সাধারণ অধিকারে বাস করিয়া, ঐ অশুভ দুর্লক্ষণাক্রান্ত বিবাহের অব্যবহিতকাল পরেই তিনি শেষ দশায় অম্বীক্ষিকীর রাজ্যে গমন করিলেন এবং তথায় কিয়দ্দিবশ অবস্থিতি করিয়া লোকান্তর প্রাপ্ত হইলেন।”
কোম্তের পূর্ব্বতন মত হইতে ইদানিন্তন মতের এতধিক প্রভেদ যে তাঁহার সর্ব্বপ্রধান প্রকাশ্য অনুসারী ম. লিতর্, তিনি (কোম্ত) বারান্তর ক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন এবং তদবস্থায় শেষ কয়েক খানি গ্রন্থ বিরচিত হওয়ায় তাঁহার পূর্ব্বতন মতের সহিত অধুনাতন মতের এতাদৃশ বৈলক্ষণ জন্মিয়াছে বলিয়া, সপ্রমাণ করিতে বিশেষ যত্ন পাইয়াছিলেন। ম. লিতর্ এক জন অতি সন্ত্রান্ত ও সর্ব্ববিদ্যাবিশারদ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আপনিই আপনাকে কোম্তের শিষ্য বলিয়া জনসমাজে পরিচয় দিতেন। কোম্তের প্রকাশ্য অনুসারিদিগের মধ্যে তিনি সর্ব্বতোভাবে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি কোম্তকৃত দর্শনশাস্ত্র খানি স্থানে স্থানে দূষ্য ও যুক্তিবহির্ভূত জানিয়াও এক প্রকার অনুমোদন করিতেন, এবং কেবল উহাতেই কোম্তের নিকট উপদিষ্ট ছিলেন; তদ্ব্যতীত তিনি তাঁহার অন্য কোন গ্রন্থই মান্য করিতেন না।
কোম্তের উল্লিখিত মতভেদ বিষয়ে ম.লিতর্ যে কারণ নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন তদুপলক্ষে ম. লিউইস্ যে কিরূপ আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন তাহা জানিবার জন্য অনেকে কৌতূহলাক্রান্ত হইতে পারেন। তাঁহার আপত্তি ত্রিবিধ; ১ম,—কোম্ত দ্বিতীয় বার যে প্রকার বায়ুগ্রস্ত হইয়াছিলেন তদপেক্ষা তাঁহার প্রথম বারের আক্রমণ কঠিন এবং বহুদিনস্থায়ী ছিল। যখন তাঁহার প্রথম গ্রন্থ খানি ঐ ভয়ানক ক্ষিপ্তাবস্থায় সম্পাদিত হইয়াও দোষাবহ হয় নাই, তখন অপেক্ষাকৃত স্বল্পদিনস্থায়ী সামান্য আক্রমণ বশতঃ তাঁহার পরিশিষ্ট গ্রন্থ খানি ভ্রমাত্মক হইয়াছে বলা, কি প্রকারে সঙ্গত হইতে পারে? ২য়,—লিতর্ কোম্তের দ্বিতীয় গ্রন্থে যে সকল দোষ বা অলীক প্রসঙ্গ উপলব্ধি করিয়াছেন, তৎসমুদায় হইতে, তিনি বারান্তর ক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন, এই হেতুবাদে তাঁহাকে কোন মতেই রক্ষা করা যাইতে পারেনা। কারণ, যাঁহারা তাঁহার প্রথম গ্রন্থ খানি ভ্রান্তিসঙ্কুল বলিয়া উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করেন তাঁহারাও, যে যে স্থল তাঁহাদিগকে দূষ্য ও ভ্রমাত্মক বোধ হয়, তৎসমুদায় লিতরের ন্যায় অকাতরে প্রলাপ বলিলেও কোন ক্রমেই অযৌক্তিক বা অসঙ্গত বলা যাইতে পারে না। অধিকন্তু, কোম্তের শিষ্য বলিয়া তদীয় প্রথম গ্রন্থ খনির (দর্শনশাস্ত্রের) মধ্যে এইরূপ অলীক ও ভ্রান্তিমূলক তত্ত্বের বা উন্মত্তপ্রলাপবৎ প্রসঙ্গের সূত্রপাৎ স্পষ্টাক্ষরে দেখিয়াও ম. লিতরের ক্ষমা বা সংগোপন করা কখনই যুক্তিযুক্ত হয় নাই। “পরিশেষে আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে কোম্তের দর্শনমধ্যে যে প্রকার প্রগাঢ় তত্ত্বনৈপুণ্য ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়;—অর্থাৎ, যে রূপ অশ্রুতপূর্ব্ব পরিশ্রম, অপ্রতিহত পর্য্যালোচনা ও গভীর গবেষণা সহকারে তিনি অভিনব তত্ত্ব উদ্ভাবন করিয়া তন্মধ্যে লিপিবদ্ধ করিআছেন এবং ঐ সুদূরপরাহত তত্ত্ব সমুদায় এক শৃঙ্খলাবদ্ধ (সামান্যতাপাদন) করিবার জন্য যে রূপ অসীম ধীসক্তির ও অলোকসম্পন্ন গুণপনার প্রমাণ দর্শাইয়াছেন যে সমস্ত সন্দর্শনে ঐ গ্রন্থখানির প্রতি তাঁহার (লিতরের)এত প্রগাঢ় ভক্তি, কোম্তের পরিশিষ্ট গ্রন্থেও তদ্রপ অসাধারণ বিদ্যা, বুদ্ধি, অধ্যবসায় ও অনুসন্ধানচাতুর্য্যের সবিশেষ পরিচয় অবশ্যই প্রাপ্ত হইয়াছেন, সন্দেহ নাই; সুতরাং,অকারণে তাঁহার নীতি-শাস্ত্র উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করা লিতর্ সদৃশ ব্যক্তির কোন মতেই উচিত নহে।”
ম. লিউইস্ ম. লিতরের প্রসঙ্গের প্রত্যুত্তর ছলে যে কয়েকটি আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন তাহার গূঢ়ার্থ এই যে, কোম্তের ‘সমাজশাস্ত্র’ এবং ‘প্রশ্নোত্তরিক’ এই দুই খানি গ্রন্থ ক্ষিপ্তাবস্থায় বিরচিত হইয়াছে বলিয়া, ভ্রমাত্মক ও প্রলাপপূর্ণ বলিলে তাঁহার দর্শন খানিকে তাদৃশ দোষ হইতে কোন মতেই রক্ষা করা যাইতে পারে না; যে হেতু তদ্রচনা কালে তিনি বরং আর অধিকতর উন্মত্ত হইয়াছিলেন।
যিনি কোম্তকে একবার সর্ব্ববিদ্যাবিশারদ এবং অভূতপূর্ব্ব প্রতিভাসম্পন্ন বলিয়া, যৎপরোনাস্তি সাধুবাদ করিয়াছিলেন, যিনি তাঁহাকে একবার আধুনিক পণ্ডিতচূড়ামণি ও অদ্বিতীয় দার্শনিক বিবেচনায় ভূয়সী প্রতিষ্ঠা প্রদান করিয়াছিলেন এবং তাঁহার মতকে বেকনের মতাপেক্ষ। উৎকৃষ্ট ও শুভকর বলিয়া, অপর্য্যপ্ত শ্লাঘা করিয়াছিলেন, স্থানান্তরে তিনিই আবার তাঁহাকে অতীব জঘন্য ও কদর্য্য লোক বলিয়া অবলীলাক্রমে ব্যক্ত করিয়াছেন, ও যে গ্রন্থকে তিনি একবার কোম্তের কীর্ত্তিস্তম্ভ বলিয়া, অসীম প্রশংসা করিয়াছিলেন, সেই গ্রন্থকেই পুনর্ব্বার কোম্তের অরুন্তুদ শত্রু অপেক্ষায় ঘোরতর যশোনাসক ও মতহন্তা বলিয়া, তিনিই অশেষ বিধ দোষারোপ করিতে ক্রটি করেন নাই। যিনি এক সময়ে তাঁহার (কোম্তের) দর্শনশাস্ত্রের পূর্ব্বতন অনুসন্ধান-প্রণালী পরিবর্ত্তিত হওয়া সাতিশয় আবশ্যক ও উৎকৃষ্ট বলিয়া প্রতিপন্ন করিয়াছিলেন, তিনিই আবার নিরুদ্বেগে কহিয়াছেন যে, ঐ রীত্যন্তর হওয়াতেই তাঁহার অনুসারী ও ঐক্যমত্য ব্যক্তি মাত্রই তাঁহাকে পরিত্যাগ করিতে বাধিত হইয়াছিল। যখন বর্ত্তমান শতাব্দীর এই শ্রেষ্ঠতর বেকন্ পৃথিবীর পঞ্চ সম্ভ্রান্ত ও উন্নততর জাতিকে আপনার অনৈক্য, বিরোধবিশিষ্ট এবং ভ্রান্তিপ্রবর্ত্তক নীতি ও ধর্ম্ম বিষয়ক উপদেশ প্রদানে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তখন আমি অবাধে কহিতেছি যে, যদি তিনি বেকন্ই হয়েন, তাহা হইলে তাঁহাকে অবশ্য সাঁপভ্রষ্ট বেকন্ বলিতে হইবে,—যিনি বিধাতার বিপাকে পড়িয়া এতাদৃশ ভয়ঙ্কর দুঃখযন্ত্রণায় জীবন অতিবাহিত করিয়াছেন—মনুষ্যকে বিনষ্ট করিবার অভিপ্রায়েই জগদীশ্বর এ প্রকার বিড়ম্বনা করিয়া থাকেন।
কোম্তের দর্শনে উচ্ছৃঙ্খলতার কোন লক্ষণই নাই। মানবজাতিকে ধর্ম্মশৃঙ্খলে বন্ধ করাই ইহার মুখ্য উদ্দেশ্য। কথিত আছে যে স্পিনোজা নিরতিশয় ঈশ্বরানুরাগী ছিলেন, এমন কি, তাঁহাকে প্রকৃত ভগবৎপ্রেমে উন্মত্ত বলিলেও বলা যায়; কোম্ত তদ্রুপ নীত্যরানুগী ছিলেন, কিন্তু ধ্রুববাদের ঔৎকর্ষ ও উন্নতি সাধন করাই তাঁহার নীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, এবং, বোধ হয়, সর্ব্বমঙ্গলালয় অখিলব্রহ্মাণ্ডের নীতিনির্দ্দেষ্টা পরম কারুণিক পরমেশ্বরবিবর্জ্জিত নিত্যনুরাগের আতিশয্যই তাঁহার উন্মত্ততার এক মাত্র কারণ।
তিনি স্বীয় দর্শন প্রণয়ন ও প্রচার বিষয়ে কখন ক্ষণকালের জন্য আলস্য বা ঔদাস্য প্রকাশ করেন নাই; এমন কি, তাঁহাকে কখন কোন ক্রীড়া বা আমোদার্থে সময়ক্ষেপ করিতে দেখা যাইত না। যখন নিদারুণ গৃহ-নিগ্রহে নিপিড়ীত অথবা সহকারী ও আত্মীয়বন্ধুবান্ধবদিগের সহিত বিবাদবিসম্বাদে একান্ত বিব্রত হইতেন, এবং যখন সংসারধর্ম্মসুলভ দৈনন্দিন দারুণ দুশ্চিন্তায় সর্ব্বশরীরের শোণিতশুষ্ক প্রায় হইত, তখন উহাই তাঁহার প্রধান আশ্রয়-স্থল ও এক মাত্র চিত্ত বিনোদনোপায় ছিল। আপন মত বা ব্যবস্থার প্রতি তাঁহার এতাদৃশ ভয়ঙ্কর অনুরাগ জন্মিয়াছিল যে, তিনি নির্ব্বাচন করিয়া কেবল তৎপ্রতিপোষক গ্রন্থই আলোচনা করিতেন; সুতরাং, প্রায় অন্য কোন গ্রন্থেই তাঁহার দৃষ্টি ছিল না। এস্থলে কোম্তের স্বরচিত বিবরণ পাঠ করা আবশ্যক; কিন্তু স্থানাভাব প্রযুক্ত উহা উদ্ধৃত করিতে পারিলাম না।
কথিত হইয়াছে যে ১৮৪২ খৃঃ অব্দাবধি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আপনার ইদানীন্তন গ্রন্থ প্রণয়নে ব্যাপৃত ছিলেন। তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে ম. লিউইসের আর কয়েকটি কথা উদ্ধৃত না করিয়া ক্ষান্ত হইতে পারিলাম না। আমাদিগের পর্য্যালোচিত বা প্রসঙ্গাধীন কালের প্রারম্ভে ম. এরাগো নামক জনৈক সহকারি অধ্যাপকের সহিত কলহ করায় কোম্ত পলিটেক্নিক্ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পদ হইতে দূরীকৃত হইয়ছিলেন। তিনি পুনর্ব্বার গণিতবিদ্যায় উপাচার্য্যের বৃত্তি অবলম্বন করেন; কিন্তু তদ্বারা গ্রাসাচ্ছাদন নির্ব্বাহ হয়,এরূপ উপার্জ্জন না হওয়াতে কিয়দ্দিবস তাঁহাকে দুঃসহ দারিদ্র্যদুঃখে দিনপাত করিতে হইয়াছিল; বলিতেকি, তাঁহার অবস্থার ব্যবস্থা ছিল না। “মিল্ সাহেব দয়ার্দ্র হইয়া তাঁহার আনুকূল্য হেতু কয়েক জন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে সবিশেষ নির্ব্বন্ধ সহকারে অনুরোধ করেন। তাঁহার আগ্রহে ও অনুরোধে ম. গ্রোট্.ম. রেকস্কারি ও সর্ ডব্লিউ মলেসোয়ার্থ নামক ইংলণ্ড নিবাসী তিন জন সম্পন্ন ব্যক্তি কোম্তকে অর্থদ্বারা সাহায্য করিতে লাগিলেন। তাঁহারা তাহাকে এক বৎসরের নিমিত্ত উক্ত বিদ্যালয়ের বেতননুসারে সহায়তা করিতে এই অভিপ্রায়ে স্বীকার করিয়াছিলেন যে, তিনি,হয় ঐ সময়ের মধ্যে তথায় পুনরভিসিক্ত হইবেন, নচেৎ উপায়ান্তর অবলম্বন করিয়া আপন ভরণপোষণকার্য্য আপনিই নির্ব্বাহ করিবেন। বৎসর অতীত হইল, কিন্তু তত্রত্য অধ্যক্ষেরা তাঁহাকে পুনরায় তাঁহার পূর্ব্বতন পদে বৃত করিল না। প্রথমতঃ তিনি এক প্রকার নিশ্চিন্ত ছিলেন। তিনি স্থির জানিতেন যে তাঁহার অভিবাদক ও অনুসারিগণ তদীয় ভরণপোষণের ভার গ্রহণ করিবে,এবং কোন ক্রমেই এরূপ অবশ্যকর্ত্তব্যে শৈথিল্য প্রকাশ করিতে পারিবেক না। কোম্তের মতে পণ্ডিতগণকে অর্থদ্বারা সাহায্য করা ধনাঢ্য ব্যক্তিদিগের সর্ব্বতোভাবে উচিত। কারণ তাঁহাদিগকে যদ্যপি নিরবচ্ছিন্ন উদরচিন্তায় ব্যতিব্যস্ত না হইতে হয়, তাহা হইলে তাঁহাৱা সতত অনন্যকর্ম্মা ও অনন্যমনা হইয়া ভূমণ্ডলের যে কিদৃশ অনির্ব্বচনীয় উন্নতি ও ঔৎকর্ষ সাধিতে পারেন, তাহা বলা বাহুল্য মাত্র। সে যাহা হউক, ইংলণ্ডে কেহই তাঁহাকে তদুপলক্ষে বৃত্তি দানে প্রবৃত্ত হয়েন নাই। ম. গ্রোট্ অঙ্গীকৃত অর্থের অতিরিক্ত দুইশত পঞ্চাশ টাকা প্রদান পূর্ব্বক বারান্তর সাহায্য অস্বীকার করেন। কোম্ত সহসা এরূপ বার্ত্তা শ্রবণ করিয়া সাতিশয় ক্ষুন্ন ও ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন। ব্যয়কুণ্ঠ হইয়া তাঁহার বৃত্তি বিলুপ্ত করায় তৎপ্রতি যেন কোন দারুণ দুরভিসন্ধি বা চক্রান্ত চেষ্টা পাওয়া হইয়াছে, এই ভাবে তাঁহাকে সর্ব্বসমক্ষে ঐ সদাশয় বদান্যব্যক্তিত্রয়কে শ্লেষ ও অসূয়া করিতে আমি স্বকর্ণে শ্রবণ করিয়াছি। যত দূর ব্যাখ্যা করা সম্ভব আমি তাঁহার বন্ধুবর্গের অভিপ্রায় আপন বুদ্ধ্যনুমানানুসারে ব্যক্ত করিলাম ও তাঁহাদিগের ঔদাস্যের প্রতিকারণ দর্শাইবার জন্য যথোচিত যত্ন করিলাম এবং সাধ্যমতে তাঁহাকে প্রবোধ দিতেও ত্রুটি করি নাই; কিন্তু তিনি নিতান্ত রাগান্ধ হইয়া আমার কথায় কর্ণপাত না করিয়া অবলীলাক্রমে তাঁহাদিগকে অপর্যাপ্ত কটুকাটব্য বলিতে লাগিলেন। অতুল ঐশ্বর্য্য প্রাপ্ত হইয়া যাহার বহুমঙ্গলহেতুভূত তত্ত্ব-পরায়ণ বিদ্যাবান্ ব্যক্তির সহায়তা করে তাহাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত নাই,এই কুসংস্কার তাঁহার অন্তঃকরণে এতাদৃশ বদ্ধমূল হইয়া উঠিয়াছিল যে, আমি কিছুতেই তাহা নিরাকরণ করিতে পারিলাম না।”
“কেবল যে মৌখিক অনুসারিদিগকে গ্লানি ও ভর্ৎসনার ভয় প্রদর্শন করত স্বীয় উপজীবিকা যাচাঞা করিতেন, এমন নহে, কখন কখন বিরুদ্ধমতাবলম্বি লোককেও আপনার প্রশংসা করিতে শুনিলে প্রকৃত সহায় বলিয়া নির্দ্ধরিত করিতেন। আমেরিকা নিবাসি কোন এক জন মেথডিষ্টকে (খৃষ্ট্রীয় সম্প্রদায় বিশেষ) প্রশংসাসূচক বাক্যে তাঁহার দর্শনখানি সমালোচনা করিতে দেখিয়া তিনি নিরুদ্বেগে তাঁহার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। কিন্তু ঐ ব্যক্তি এরূপ অসঙ্গত যাচঞায় সামান্যতঃ কোন মনযোগই করেন নাই। কোম্ত আপন “সমাজ শাস্ত্রের” দ্বিতীয় খণ্ডের উপক্রমণিকায় তদ্বিষয় এরূপ অকপটভাবে লিখিয়াছেন যে তাহা এক প্রকার নিন্দনীয় বলিতে হইবে।”
ইতি পূর্ব্বে কখিত হইয়াছে যে, তিনি আপন মতপ্রতিপোষক গ্রন্থ ভিন্ন অন্য কোন গ্রন্থই অনুশীলন করিতেন না; ফলতঃ অন্যান্য বিষয়ে বিশেষ ব্যুৎপন্নও ছিলেন না। তাঁহার গ্রন্থ সমস্তই নিতান্ত ভ্রমাত্মক; কারণ তিনি যে যে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন তাহাতে তিনি সর্ব্বতোভাবে অনভিজ্ঞ ছিলেন, এবং যে সকল আবিস্কার আপন গবেষণাসমুদ্ভূত বলিয়া, অপর্যাপ্ত শ্লাঘা করিতেন তৎসমুদায় আবিষ্কারই নহে। একথা আমাদিগের স্বকপোলকল্পিত বিবেচনা করিবেন না। কোম্ত যে যে বিষয় আপনার আবিষ্কার বলিয়া সদর্পে নিরতিশয় আস্ফালন করিতেন সর্ জন্ হর্শেল তত্তাবৎ অলীক ও প্রাগল্ভ্যপূর্ণ বলিয়া প্রতিপন্ন করিয়াছেন। ডাক্তর হিউএল্ বলেন যে “জ্যোতিষ্ ভিন্ন বর্ত্তমান দৃষ্টিবিজ্ঞান প্রভৃতি অন্যান্য শাস্ত্র বিষয়ে তিনিযে প্রকার কথাকৌশলে নিজ মত ব্যক্ত করিয়াছেন তাহা নিতান্ত হীন ও দাম্ভিক প্রতারকের চাতুরী মাত্র;— সামান্য সামান্য বাক্যবিন্যাস করত সেই সকলকে জ্ঞানগর্ভ বচন বলিয়া জনসমাজে পরিচয় দেওয়াই তাঁহার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল।” তিনি স্থানান্তরে কহিয়াছেন যে “আমি বোধ করি কোম্ত সকল শাস্ত্রেই যৎসামান্য স্থূলদর্শী ছিলেন,কোন বিষয়েই গভীর জ্ঞান বা পারদর্শীতা লাভ করিতে পারেন নাই;বরং শান্ত্র বিশেষে তাঁহার যৎকুৎসিত অপ্রকৃত বোধ ছিল।” কোম্ত অর্থব্যবহারশাস্ত্রকে “সমাজশাস্ত্র” বলিয়া সংজ্ঞা করিয়াছেন এবং উহাই স্বীয় কীর্ত্তির সোপান জ্ঞানে নিয়ত অপরিসীম শ্লাঘা করিতেন। “সমাজশাস্ত্র” ধ্রুববাদানুবর্ত্তী করিবার, প্রবৃত্তি তাঁহার হৃদয়ে পটদ্দশাবধি বলবতী ছিল, এমন কি, উহাই তাঁহার সমস্ত দর্শনচর্চ্চার উদ্দীপনী শক্তি বলিলেও বলা যায়। কিন্তু ঐ প্রিয়শাস্ত্রে যে তাঁহার কিদৃশ জ্ঞান ছিল তাহা প্রতিপন্ন করিবার নিমিত্ত ম.মিলের কয়েক পংক্তি নিম্নে উদ্ধত করা হইল;—“যিনি অর্থব্যবহার শাস্ত্রকারদিগের গ্রন্থ সমস্ত অভিনিবেশ পূর্ব্বক আলোচনা করিয়াছেন, তাঁহার কোম্তকৃত এই কয়েক পৃষ্ঠা প্রতিবাদ আনুপূর্ব্বক পাঠ করা কর্ত্তব্য; কারণ তাহা হইলে তিনি বিলক্ষন বুঝিতে পারিবেন যে কোম্ত সময়ে সময়ে কত দুর স্বীয় স্বল্প জ্ঞানের পরিচয় দিয়াছেন। তিনি (কোম্ত) বলেন যে এডাম্ স্মিথের আদিম অধিদৃষ্টি অপেক্ষা এই সকল গ্রন্থে কোন নূতন ব্যাপার লক্ষিত হয় না যাহাতে ঐ শাস্ত্রের পর পর উন্নতি হইতেছে বলা যাইতে পারে। কিন্তু যাঁহারা যথার্থ নিরপেক্ষ চিত্তে তৎসমুদায় আদ্যোপান্ত পর্যালোচনা করিয়াছেন, তাঁহারা অবশ্যই স্বীকার করিবেন যে, উক্ত গ্রন্থ সকলের মধ্যে একাধিক অভিনবোদ্ভাবিত তত্ত্ব বিবৃত হইয়াছে যে অর্থব্যবহারশাস্ত্র একবারেই পরিবর্ত্তিত ও নবীকৃত হইয়াছে বলিলেও অত্যুক্তি হয়না।” মিস্ মার্টিনিয়োও, যিনি কোম্তকে ইদানীন্তন অদ্বিতীয় দার্শনিক বলিয়া, যৎপরোনাস্তি প্রশংসা করিয়াছেন,তাঁহাকে সর্ব্ববিষয়ে অনভিজ্ঞ দেখিয়া নিতান্ত ক্ষান্ত হইতে পারেন নাই। তিনি কোম্তের জ্যোতিষ্শাস্ত্র বিষয়ক প্রবন্ধগুলি, যাহা হিউএল্ প্রশংসা করিয়াছেন, “নিতান্ত অসম্পূর্ণ,” এবং তাঁহার পদার্থবিদ্যা বিষয়ক সন্দর্ভ গুলিন “তাঁহার রচনামধ্যে সর্ব্বনিকৃষ্ট,” বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন।
কোম্ত কি হিন্দুদিগের বিষয় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিলেন, নতুবা তাঁহার পণ্ডিত-তালিকায় আর্য্যকুলোদ্ভব কোন মহানুভবের নাম লিপিবদ্ধ করা হয় নাই কেন? কেহ এতদ্বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু বা জিজ্ঞাসু হইলে আমরা এই প্রত্যুত্তর প্রদানে সমর্থ যে, তিনি অবশ্যই ভারতবর্ষ সংক্রান্ত কিছুই অবগত ছিলেন না। এতৎপ্রমাণার্থে আমরা এস্থলে একটি উদাহরণ দিতেছি; যথা,—বিবাহিতা নারী বা কৃতদার ব্যক্তি, অন্য কোন কারণ দূরে থাকুক, স্বামীর বা পত্নীর জীবনান্তেও অপর পুরুষকে পুনরায় পতিত্বে বরণ, বা দ্বিতীয় সহধর্ম্মিণী গ্রহণ, করিতে পারিবেক না,এই নিয়মটি তাঁহার মতে তদীয় প্রতিভাপ্রসূত। ইহা ধ্রুববাদে প্রথম উদ্ভাবিত ও বিধিবদ্ধ হইয়াছে বলিয়া,গৌরবাকাঙ্ক্ষা করা যে নিতান্ত দুরাশা মাত্র তাহা সকল হিন্দুধর্ম্মজ্ঞ লোকেই মুক্তকণ্ঠে অঙ্গীকার করিবেন। তিনি আর বলেন যে “এপর্যন্ত কোন ধর্মই এতাদৃশ বিশুদ্ধ বা উন্নত হয় নাই যে এই প্রণালী অবলম্বনে সম্যক্ সমর্থ। ধ্রুবাদিগণ যাহাকে পরিণয়ের নিগুঢ় তাৎপর্য্য বলিয়া স্থিরসিদ্ধান্ত করিয়াছেন, উক্ত বিধি তাহা হইতেই বিনিঃসৃত হইয়াছে।” একবিবাহ এবং জীবনান্তে সমাধিমধ্যে স্ত্রীপুরুষ উভয়ের পুনর্ম্মিলন পূর্ব্বতন কোন ধর্ম্মেই বিধিবদ্ধ ছিল না; কিন্তু বস্তুতঃ তদুভয় ব্যতীত স্ত্রীপুরুষ অভিন্নহৃদয় হইবার সম্ভাবনা নাই, সুতরাং পাতিব্রত্যও রক্ষা হওয়া সুকঠিন। এস্থলে এই অতিনব দর্শন প্রাচীন অজ্ঞানতিমিরাবৃত মূঢ়জন বা কুসংস্কারাবিষ্ট নীচ নিন্দুককে এই কথায় নিরুত্তর ও নিরস্ত করিতে পারে যে, মনুষ্যের চিত্তৌৎকর্ষের সহিত উন্নতিজনিত নবনব নীতিরও উদ্ভাবন হইয়া থাকে।” তিনি যে কেবল অনভিজ্ঞতা বশতঃ অসীম মহিমান্বিত হিন্দু বুধগণের নাম স্বীয় পণ্ডিত-তালিকায় উল্লেখ করেন নাই, এমন নহে, বরং তাঁহাদিগকে স্বভাববাদী বা ব্রহ্মবাদী বলিয়া অতীব হেয় জ্ঞানেই তন্মধ্যে স্থান দান করেন নাই, ইহাই সম্ভব। সঙ্করাচার্য্য, কপিল, কণাদাদি যাবতীয় জগদ্বিখ্যাত হিন্দুকুলোদ্ভব মহাপুরুষেরা প্রকারান্তরে সকল পদার্থেরই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র অধিষ্ঠাতা আছে বলিয়া, কল্পনা করিতেন, এই অনুমানে তিনি এতাদৃশ অসামান্যবিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্ন আর্য্যকুলমুখোজ্জ্বলক মহানুভবদিগকে নিতান্ত উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করিয়ছেন, যাঁহাদিগের অলোকসামান্য প্রতিভা জ্যোতিতে অদ্যাবধি ভূমণ্ডলের সমস্ত সভ্যজাতির ধীশক্তি প্রতিফলিত হইতেছে, যাঁহাদিগের যশোরবি সমুজ্জ্বল প্রভাপুঞ্জে অতি প্রাচীনকালাবধি নিরবকাশে সত্যকেন্দ্রে অভ্যুদিত রহিয়াছে এবং অনন্ত কর বিস্তার করিয়া সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত স্বতঃসিদ্ধ আর্য্যজাতির অসীম মহিমা প্রকাশ করিতেছে, যাঁহাদিগের দিগন্তব্যাপী গৌরবসৌরভে নিখিল ভুবন চিরন্তন একাদি ক্রমে আমেদিত রহিয়াছে, এবং, অধিক কি বলিব, যাঁহাৱা আদৌ বিদ্যাবুদ্ধি, দয়াদাক্ষিণ্য, ধর্ম্মকর্ম্ম, সত্যতত্ত্ব, প্রভৃতি অনন্ত আস্পদের দ্বার উদ্ঘাটন করত মনুষ্যের মনুষত্বই উদ্ভাবন করিয়াছিলেন——যখন প্রায় সমস্ত অখণ্ড ভূখণ্ড ঘোরঅজ্ঞানতিমিরাবৃত কালগর্ভে একান্ত অভিভূত হইয়া অনন্ত নিদ্রায় নিদ্রিত ছিল, যখন পশুপক্ষী প্রভৃতি ইতর জন্তু সদৃশ বিশালললটি আত্মবিস্মৃত মনুষ্য বনে বনচর হইয়া অকিঞ্চিৎকর দেহ ভার লইয়া বিব্রত, এবং যখন ইদানীন্তন অসংখ্যজনাকীর্ণ মহাসমৃদ্ধিশালিঅমরাবতী সকল, হয়ত অগাধ উত্তালতরঙ্গ সমুদ্রের গভীর গহ্বরমধ্যে অন্তর্হিত, অথবা ঘোরঘনঘটা সদৃশ নিবিড় অরণ্যচ্ছন্ন হইয়া মনুষ্য ও ইতর হিংস্র পশুর সাধারণ অধিকারে পরিগণিত এবং অনাগত কালকন্দরে অবসন্ন প্রায় প্রোথিত ছিল। অদ্যাবধি যাঁহাদিগের অমোঘ কীর্ত্তিমন্দিরে বিচরণ করিয়া বিদ্যোৎসাহী মহামতিগন অনবরত অনির্ব্বচনীয় আনন্দ উপভোগ করিতেছেন এবং যাঁহাদিগের পবিত্র পদাঙ্ক অনুগমন করিয়া নব নব বিষয় আবিষ্কার করত পৃথিবীর সম্যক্ সমৃদ্ধি ও ঔৎকর্ষ সাধন করিতেছেন। কোম্তের মতে বালক, মূর্খ ও অসভ্যজাতিরাই উক্ত ধর্ম্ম অনুমোদন করে; ইহাতে যে তিনি হিন্দুশাস্ত্রকারদিগকে নিতান্ত উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করিবেন, তাহার আর আশ্চর্য্য কি?
এস্থলে জিজ্ঞাস্য এই যে, যদ্যপি কোম্তের গ্রন্থ সমুদায়ই প্রমাদ ও অপলাপে পরিপূর্ণ তবে তিনি কি প্রকারে কতিপয় স্বদেশীয় ও বিদেশীয় প্রধান প্রধান পণ্ডিতের নিকট ভূয়সী খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন? তাঁহার গ্রন্থগুলির মধ্যে যে প্রকৃত প্রলাপবাক্যবৎ প্রসঙ্গ দৃষ্টিগোচর হয়, একথা নিতান্ত অমূলক নহে; কিন্তু তাহাতে তাঁহার প্রখর বুদ্ধির ও মহীয়সী কল্পনাশক্তির কিঞ্চিন্মাত্রও ন্যূনতা বা হ্রাস হয় নাই। মাদকসেবিত ব্যক্তির, হিতাহিত জ্ঞান না থাকিলেও, দুষ্টবুদ্ধির ও অমূলক কল্পনার যেরূপ বৃদ্ধি হইয়া থাকে, তাঁহারও অবিকল তদ্রূপাবস্থা ঘটিয়াছিল। অধিকন্তু, তিনি স্বভাবতঃ অনুমানচতুর ও লোকরঞ্জক ছিলেন, এমন কি, কেহ তাঁহার সন্নিকৃষ্ট হইলে তিনি কৌশলক্রমে তাহার সহিত এরূপ কথোপকথন করিতেন যে সেই ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ তাঁহার বশবর্ত্তী বা অনুগত হইয়া যাইত। তাঁহার যতগুলিন বিখ্যাত অনুসারী দেখিতে পাওয়া যায় তাঁহারা সকলেই এক কালে তাঁহার প্রিয় সুহৃদমধ্যে পরিগণিত ছিলেন। ম. লিতর্ বলেন যে তিনি এক সময়ে কোম্তেরমতে এতদূর নীত হইয়াছিলেন যে পরে তাঁহার স্থির বিবেচনায় তত দূর অনুমোদন করা নিতান্ত অসঙ্গত বলিয়া বোধ হইয়াছিল। কোম্তের ইংলণ্ড নিবাসি অনুসারিদিগেরও এককালীন তদবস্থা ঘটিয়াছিল। তাঁহাদের পূর্ব্বতন গ্রন্থের সহিত অধুনাতন গ্রন্থ সমুদায়ের তুলনা করিলেই ইহা কপষ্ট প্রতীয়মান হইবে। ম. লিউইস্ ও ম. মিল্ ইহার প্রধান দৃষ্টান্ত-স্থল। এক্ষণে প্রায় সমস্ত প্রথম শ্রেণীস্থ পণ্ডিতগণ তাঁহার ভ্রমজাল হইতে মুক্ত হইয়াছেন; কেবল অপেক্ষাকৃত স্বল্পবুদ্ধিজীবী দ্বিতীয়শ্রেণীস্থ পণ্ডিতেরাই অদ্যাবধি তাঁহার মতের বিন্দুবিসর্গ পর্য্যন্ত প্রামাণিক বলিয়া অনুমোদন করেন ও তাঁহাকে যৎপরোনাস্তি ভক্তি করিয়া থাকেন— যাহা কোম্ত স্বীয় ন্যায্য প্রাপ্য বলিয়া সকলের নিকট প্রত্যাশা করিতেন। যে কোন অবস্থার লোকই হউক না কেন, তাঁহার মতাবলম্বী হইলেই তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁহার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিতেন ও কাহাকেও স্বীয় মতের বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস করিতে দেখিলে, তাহাকে অমনি নিরতিশয় নির্ব্বন্ধ সহকারে আপনার সমস্ত ভ্রমপ্রমাদাদি অনুমোদন করতে অনুরোধ করিতেন।
“যিনি তাঁহার মত ও ব্যবস্থা অনার্য্য বলিয়া অমান্য করিতেন, তিনি তাহাকে মুর্খ, কুসংস্কারাবিষ্ট হীনমতি পাষণ্ড, অত্মাম্ভরি মৎসর, কিম্বা মর্ম্মান্তিক শত্রু বলিয়া, অবধারিত করিতেন। কেহ যদ্যপি কখন এক দিনের জন্যও তাঁহার কোন না কোন মতের বর্ণমাত্রও মান্য করিতেন, তাঁহাকে তিনি তৎক্ষণাৎ কৃতদাস বা নিজ সম্পত্তি ভাবিতে লাগিলেন; সুতরাং, লোকতঃ ধর্মতঃ চিরদিনের জন্য সেই তদীয় গুরুর ভরণপোষণে এবং সেবাশুশ্রূষায় বাধ্য; কিন্তু যদ্যপি কখন তাহাকে ঐ অবশ্যকর্ত্তব্যানুষ্ঠানে বিমুখ দেখিতেন, তাহা হইলে, অমনি তৎক্ষণাৎ বিধর্ম্মী, বিদ্রোহী বলিয়া তৎপ্রতি খড়্গহস্ত হইয়া উঠিতেন, এবং এক মুহূর্ত্ত পুর্ব্বে তাহার সহিত যে রূপ আন্তরিক সম্প্রীতি ও সদ্ভাব ছিল তাহা তৎক্ষণাৎ একবারেই মর্ম্মান্তিক আক্রোশে পর্য্যবসিত হইয়া যাইত।” —গিজো
মিল্, গ্রোট্, লিউইস্, লিতর্, প্রভৃতি কয়েক জন প্রসিদ্ধ পণ্ডিতেরা পরিশেষে তাঁহার অধিকাংশ মত পরিহারে কৃতকার্য্য হইয়াছিলেন, এবং তজ্জন্যই তিনি পরিণামে তাঁহাদিগের সহিত কলহ করিয়াছিলেন। কন্গ্রিভ্, ব্রিজেস্ এবং রবিনেট্ প্রভৃতি কয়েক জন দ্বিতীয় শ্রেণীস্থ বিদ্যাবিৎ লোকেরাই কেবল তাঁহার ঐন্দ্রজালে পতিত হইয়া এখন পর্যন্ত তাঁহার অযথাভূত গ্রন্থ সমস্ত আদ্যোপান্ত মান্য করেন। বঙ্গদেশেও সম্প্রতি তাঁহার মত প্রাদুর্ভূত হইতেছে। এতর্দ্দেশীয় যুবকদিগের চিত্তক্ষেত্র হইতে তদ্গত ভক্তি অপসূত করাই আমার অদ্যকার বক্ততার প্রধান উদ্দেশ্য; কারণ তাঁহাদিগকে অনপনীয় ভ্রান্তিকুহকে ভ্রাম্যমান দেখিয়া কোন্ সুহৃদয়, লোক নিশ্চিন্ত থাকিবেন? কোম্ত যতই মহিমান্বিত হউন না কেন, আমি হিউএল্ ও সর্ উইলয়ম্ হেমিল্টনের কথা প্রমাণ কহিতেছি যে, তাঁহাকে বিহিত সম্মানাপেক্ষা শতগুণে অধিকতর গৌরব প্রদান করা হইয়াছে; কিন্তু যদিও তিনি তাঁহার অভিবাদকদিগের অভিলষিত গৌরবের উপযুক্তই হয়েন, তথাপি তিনি কখন যুবা অদূরদর্শী ব্যক্তিদিগের যথার্থ উপযুক্ত পথদর্শক হইবার যোগ্য পাত্র নহেন। তাঁহার উৎকৃষ্ট গ্রন্থ খানিও ভয়ঙ্কর দোষবহ ও ভ্রান্তিসঙ্কুল যে সকল ভ্রম ও দোষ উন্মত্ত ও অসাধু জীবনের ফল।
তিনি আর যত দিন জীবিত থাকিতেন ততই তাঁহার দম্ভ ও ব্যাপকতা উত্তরোত্তর পরিপুষ্ট হইত, এবং ততই স্বোম্ভাবিত নীতি ও ধর্ম্ম প্রচার করিবার আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাইত। স্বীয় মত ও ব্যবস্থার প্রতি অনুরাগ ক্রমশঃ এত ভয়ানক হইয়া উঠিত, যে কেহ তদ্বিপরীত উক্তি করিলে তাঁহার নিতান্ত অসহ্য বোধ হইত। বিদ্যার্জ্জন বিষয়ে সাধারণ নিয়ম নিরূপণ করিবার স্পর্ধারও তাঁহার অবধি থাকিত না। আত্মনিষ্ঠা, আত্মশ্লাঘা, জিগীষা, কুতর্কপ্রিয়তা প্রভৃতি অন্যান্য জঘন্য প্রবৃত্তিও তাঁহার হৃদয়ে পর পর বলবতী হইতে থাকিত; সুতরাং, ভ্রমপ্রমাদাদিরও দিন দিন ভয়ঙ্কর বৃদ্ধি হইত, সন্দেহ নাই। কিন্তু এতদানুষঙ্গিক তাঁহার অসাধারণ বুদ্ধি ও অমানুষিক কল্পনাশক্তি উত্তরোত্তর প্রকাশ পাইত, এবং স্বীয় অনুমান-সিদ্ধ তত্ত্ব সমুদায় একশৃঙ্খলাধীন করিবার অদ্ভুত ক্ষমতাও ক্রমশঃ পরিবর্দ্ধিত হইতে থাকিত,—অর্থাৎ, সামান্যতাপাদন বা একবর্গতপাদনে তিনি সবিশেষ পটু হইয়া উঠিতেন। আপনার এবং কয়েক জন প্রিয়শিষ্যের বিবেচনায় তিনি বর্ত্তমান শব্দের অদ্বিতীয় দার্শনিক ও ব্যবস্থাপক ছিলেন। তাঁহার মত ও ব্যবস্থা আবহমানকালের জন্য অসীম গৌরব ও ভক্তি পরম্পরায় সমস্ত মানবমণ্ডলীর মুখোজ্জ্বল করিবেক। তিনি সর্ব্বধর্মোৎকৃষ্ট অভ্রান্ত বিশ্বধর্ম্মের প্রধান আচার্য্য ছিলেন যাহা সত্য, উপচিকীর্ষ। এবং করুণা-প্রভাবে অচিরাৎ সর্ব্ব প্রচলিত ধর্ম্মকে সমূলে উচ্ছেদ করত মহাসমারোহে ধরায় একাধিপত্য স্থাপন করিবেক। এস্থলে তাঁহার “প্রশ্নোত্তরিকার” অনুক্রমণিকার প্রথম কয়েক পংক্তি অনুবাদ করত উদ্ধত করা হইল;—“অতীত ও অনাগতে গৌররবসংবর্দ্ধনার্থে পরমসতের দাস ধ্রুববাদিগন, কি দার্শনিক, কি ব্যবহারী, সকলেই পৃথিবীর সমস্ত কার্যাধ্যক্ষতাতার আপনাদিগের হস্তগত করিতে অগ্রসর হইয়াছেন,— বস্তুতঃ উহা তাঁহাদিগেরই যথার্থ প্রাপ্য। অতএব কি কায়িক,কি মানসিক, কি বাচিক, কি নিত্যনৈমিত্তিক,সংসারের সকল বিভাগেই তত্ত্বাবধান করা তাঁহাদিগের প্রকৃত উদ্দেশ্য। ফলিতার্থ, ক্যাথলিক্, প্রটেষ্টেণ্ট্ ডিইষ্ট্, প্রভৃতি অন্যান্য যাবতীয় উপাসক সম্প্রদায় নিতান্ত ভণ্ড এবং সমস্ত বাদবিতণ্ডা বা গোলযোগের মূল কারণ, সুতরাং রাজকার্য্য সম্পাদনে নিতান্ত অযোগ্য, এই হেতু অদ্যাবধি তাহারা সকলেই রাজকার্য্য সংক্রান্ত প্রধান পদবী হইতে দুরীকৃত হইল।”
আমাদিগের ধ্রুববাদিদিগের বিনয় ও নম্রতা যে কত দুর, তাহা, বোধ হয়, এক্ষণে আপনাদিগের বিলক্ষণ অনুভূত হইল! যখন তাঁহাদের বর্ত্তমান হীনাবস্থাতেই এতাদৃশ আস্ফালন, তখন তাঁহার যথার্থ রাজকার্য্যের কর্তৃত্ব লাভ করিলে ভিন্নমতাবলম্বিদিগের সহিত যে কি প্রকার ব্যবহার করিতেন, তাহা বলা যায় না।
কোন অনুগত ছাত্র কোম্তের শেষাবস্থার বিষয় এই রূপ বিবরণ করিয়াছেন;— “তিনি প্রত্যহ অতি প্রত্যুষে শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিতেন ও প্রাতঃকৃত্য সমাপ্ত হইলে রচনাকার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেন। দুই বার আহারাদি নির্ব্বাহার্থে যে কয়েক দণ্ড আবশ্যক, তদ্ব্যতীত তিনি প্রায় সমস্ত দিবসই উপাসনা,অনুধাবনা,অধ্যায়ন, অনুধ্যান এবং রচনাকার্য্যে অভিনিবিষ্ট থাকিতেন। প্রতিদিন “খৃষ্টীয়ের অনুকরণের” একাধ্যায় এবং প্রসিদ্ধ ইটালীয় কবি দাঁতের কাব্যের এক পরিচ্ছেদ পাঠ করিতেন। জগন্মান্য হোমারের কাব্যও তিনি পুনঃপুনঃ আলোচনা করিতেন। ব্যায়াসামর্থ প্রযুক্ত লঘুরূপক সন্দর্শনে গমন করিতে না পারায় কাব্যালোচনাই তাঁহার ইদানী অবকাশ-বিলাস হইয়া উঠিয়াছিল। প্রত্যহ প্রাতঃকালে সাত ঘটিকা হইতে নয় ঘটিকা পর্য্যন্ত এবং রবিবার অপরাহ্নে কয়েকদণ্ড তিনি তাঁহার দর্শনাভিলাষী আগন্তুক ব্যক্তিদিগের অভ্যর্থনার্থে নিরূপিত করিয়াছিলেন। সামান্য সামান্য শিল্পকারদিগের মধ্যে তাহার বিস্তর শিষ্য ছিল, এবং তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্যই বিশেষতঃ ঐরূপ সময় নির্দ্ধারিত ছিল। প্রতি বুধবার অপরাহ্নসময়ে তিনি ডিভোঁর সমাধিস্থান সন্দর্শনে গমন করিতেন। পুনরায় রাত্র দশ ঘটিকার সময় উপাসনাদি সমাপন করিয়া তিনি শয্যায় গমন করিতেন। উপাসনাকালে যে তিনি এক প্রকার কি অত্যাশ্চর্য্য অনির্ব্বচনীয় পরম রমণীয় বিশুদ্ধ আনন্দোপভোগ করিতেন তাহা অন্যের অনুভূত হইবার নহে। তিনি অতি স্বল্পাহারী ছিলেন, কখন তাঁহাকে নানাবিধ উপাদেয় দ্রব্যসামগ্রী লইয়া আহার করিতে দেখা যায় নাই। প্রাতঃকালে কেবল দুগ্ধমাত্র পান এবং মধ্যাহ্নে যৎসামান্য রূপ ভোজন করিয়া তিনি জীবন ধারণ করিতেন। ভেজনান্তে (দেশীয় রীত্যনুসারে) ফলাহারের পরিবর্ত্তে একখণ্ড শুষ্ক রুটিকা লইয়া ধীরে ধীরে চর্ব্বন করিতেন এবং বারংবার তৎপ্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া মনে মনে এই চিন্তা করিতে থাকিতেন যে, হায়! কত শত দীনদরিদ্র লোক অহর্নিশি অবিশ্রান্ত ক্লেশ ও পরিশ্রম পরম্পরায় স্বীকার করিয়াও দিনান্তে এতদাহরণে অসমর্থ।”
১৮৫৭ খৃঃ অব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর্, উনপঞ্চাশৎ বর্ষ বয়ঃক্রম কালে কোম্ত মানবলীলা সম্বরণ করেন। তাঁহার এমন কোন উন্নত শিষ্য ছিল না যে তদীয় পদাভিসিক্ত হইবার উপযুক্ত। তিনি বর্ত্তমান শতাব্দের মধ্যে বর্ষ নির্দ্ধারিত করিয়াছিলেন যখন ধ্রুববাদীর সমস্ত ঐহিক ও পারত্রিক কর্ত্তৃত্ব লাভ করিবেক এবং সমস্ত মানবজাতির উন্নতাবস্থার সূত্রপাত হইবেক! এয়োত্রিংশৎ বৎসরান্তে তাঁহার নীতিশাস্ত্র প্রাবল্য লতি করিবেক। ঐ ত্রয়োত্রিংশৎ বৎসর ৭, ৫, ২১, এই তিন ভাগে বিভক্ত,—এই কয়েকটি পবিত্র সংখ্যা। ৭ সাত বৎসর পরে ফ্রান্সের রাজকীয় বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষতাভার তাঁহার হস্তে ন্যস্ত হইবেক, এবং তিনি ঐ সুযোগে পূর্ব্বপ্রস্তাবনুযায়িক একশত ধ্রুববাদ প্রতিপোষক গ্রস্থ ব্যতীত অপরাপর সমস্ত পুস্তকই একবারে ভস্মসাৎ করিবেন, এবং যে সকল প্রাণী ও বৃক্ষলতাগুল্মাদি তাঁহার বিবেচনায় বিদ্যার্থীদিগের অনুশীলন করা অনাবশ্যক বোধ হইবেক তৎসমুদায় নির্ব্বাচন করিয়া অনতিবিলম্বেই শিক্ষাপ্রণালী হইতে বহিস্কত করিবেন। কি আশ্চর্য! তিনি যেন ত্রিকালজ্ঞের ন্যায় উহাদিগের ভূত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান অবস্থার বিষয় সবিশেষ পরিজ্ঞাত হইয়াছিলেন। ইহার পাঁচ বৎসর পরেই নেপলীয়ান্ তিন জন প্রসিদ্ধ ধ্রুববাদীর হস্তে ফ্রান্সের রাজকার্য্য সমর্পণ করিবেন। অতঃপর ঐ তিন জন অবশিষ্ট ২১বৎসরের মধ্যে ফ্রান্সকে তদীয়ব্যস্থার উপযোগী করিয়া তুলিবেন, এবং তদন্তে তাঁহারা অপর তিন জন স্থির ও প্রকৃষ্ট ধনাধ্যক্ষের হস্তে সমস্ত কর্তৃত্ভার প্রত্যর্পণ করিবেন, যাঁহারা তাঁহাদিগের প্রধান আচার্য্যের সাহায্যে একবারেই যুগান্তর উপস্থিত করিবেন। কোম্ত এইরূপ কল্পনা করিয়াছিলেন, কিন্তু দরিদ্রের মনোরথের ন্যায় তাঁহার মনের বাসনা মনেই বিলীন হইয়াছিল। এই সপ্তদ্বীপা পৃথিবীর মধ্যে মনুষ্যের সাধ্যসুলভ কি আছে? ইচ্ছা মতে আমরা কিছুতেই পূর্ণমনোরথ হইতে পারি না। কোন প্রসিদ্ধ কবি এই মর্ম্মে লিখিয়াছেন,—
“যতই আমরা কেন করি না যতন,
জগদীশ বিনা কিছু না হয় সাধন।”
এক্ষণে ফ্রান্সে ধ্রুববাদিদিগের একটি উচ্চতর বিদ্যালয় আছে এবং এক জন ধ্রুববাদীও তৎকর্তৃত্বভারাপন্ন আছেন; কিন্তু এক্ষণে তহাদিগের কেহই প্রধান আচার্য্য নাই।
উপসংহার কালে আমার বক্তব্য এই যে, যদিও আমরা সামান্যতঃ এতাবৎকাল পণ্ডিতাভিমানী ও অনপনীয়ভ্রান্তিকুহকে ভ্রাম্যমান অগস্ত্ কোম্তকে অসাধ্যসাধনে কায়মনোবাক্যে প্রয়াস পাইয়া আপনার অলোকসামান্য ধীশক্তিকে নিরর্থক বিনষ্ট করিতে দেখিয়া অজশ্র আমুক্তকণ্ঠে এবং বিস্তারিত রসনায় শ্লেষ ও উপহাস করিয়াছি; কিন্তু এক্ষণে স্থিরচিত্তে বিবেচনা করিলে সকলেই বিলক্ষণ প্রতীত হইবেন যে,পরিহাসরসিক ও ব্যঙ্গোক্তি-প্রিয় লোক ব্যতীত প্রাজ্ঞ এবং উদারস্বভাব বক্তি মাত্রই হাস্য সম্বরণ করিবেন। কারণ এতাদৃশ অসামান্য মেধাসম্পন্ন, নিস্পৃহ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং তত্ত্ব-পরায়ণ মহাত্মাকে পণ্ড শ্রমে জীবন সর্ব্বস্ব সমর্পন করিতে দেখিয়া সদাশয় লোক মাত্রই যে অশ্রু বিসর্জ্জন করিবেন, ইহার আর অণুমাত্র সন্দেহ নাই। তিনি যে কিদৃশ মহীয়সী অধ্যবসায়, গভীর গবেষণা, অপরিসীম পরিশ্রম, এবং অপার যত্ন পরম্পরায় স্বীকার করিয়া আপন অতুল প্রতিভাশক্তিকে অনর্থক অপ্রশস্ত কল্পে নিয়োজিত করিয়াছিলেন, তাহা শ্রুতিপথারূঢ় হইলে সর্ব্ব শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠে, যাহার শতাংশের একাংশ জ্ঞানলোকসম্পন্ন বিশুদ্ধ সত্যপথে,—অর্থাৎ, শাস্ত্রানুমত, ন্যায়ানুগত ও বিচারসঙ্গত বিষয়ে প্রবর্ত্তিত হইলে ভূমণ্ডলের অশেষ মঙ্গল সাধিত হইতে পারিত; কিন্তু হায়! মনুষ্যের স্বভাব সুলভ এমন প্রমাদাদি দোষে পতিত হইয়া তিনি যে আপনাকে জন্মের মত বিনষ্ট করিয়াছেন, ইহা কি সামান্য আক্ষেপের বিষয়!
সমাপ্ত।
সঙ্কলিত শব্দ সমূহের ইংরাজী অর্থ।
অর্থব্যবহারশাস্ত্র |
Political Economy. |
অধিদৃষ্টি |
Apercus. |
অনুসন্ধান-রীতি |
Method of Investigation. |
অনুসারী |
Follower. |
অন্তেবাসী |
Boarder. |
অভিবাদক |
Admlrer. |
অরাজকতা |
Anarchy. |
আত্ম-তত্ত্ব |
Theology. |
আনুমিতক |
Deductive. |
আম্বীক্ষিক |
Inductive. |
আম্বীক্ষিকী |
Metaphysics. |
উপপ্লব |
Crisis. |
উপাচার্য্য |
Private Tutor. |
একবর্গতাপাদন |
Co-ordination. |
ঔপষমপত্র |
Marriage Register. |
গৃহসম্পাদক |
Private Secretary. |
জীবিতাখ্যায়ক |
Biographer. |
দৃষ্টিবিজ্ঞান |
Optics. |
ধ্রুববাদ |
Positivism. |
নীতি |
Polity. |
পরমসৎ |
Humanity. |
প্রকল্পনা |
Hypothesis. |
প্রমাণানুগতধর্ম্ম |
Requisites of Proof. |
প্রমাতৃগত |
Subjective. |
প্রমেয়গত |
Objective. |
প্রশ্নোত্তরিকা |
Catechism. |
বাতুলালয় |
Lunatic Asylum. |
ব্যবস্থাপকসভা |
Directory. |
ভাব |
Emotion. |
মত |
Doctrine. |
মতোন্মত্ত |
Enthusiast. |
রাজনীতি |
Politics. |
রাজবিপ্লব |
Revolution. |
রাজভক্ত |
Royalist. |
রাষ্ট্র বিপ্লবানুরাগী |
Revolutionist. |
লঘুরূপক |
Opera. |
শাসক |
Master. |
সংবিদ্বিবাহ |
Civil Marriage. |
সর্ব্বতন্ত্র |
Republic. |
সমাজশাস্ত্র |
Sociology. |
সমাধিস্থান |
Tomb. |
সামান্যতাপাদন |
Generalization. |
স্বীকৃততত্ত্ব |
Datum. |
শুদ্ধিপত্র।
পৃষ্ঠা | … ১৭ …পংক্তি | অশুদ্ধ | … শুদ্ধশুদ্ধ |
২ | … ১৭ … | মুহুর্ত্ত | … মুহূর্ত্ত |
৩ | … ১১ … | বসংবাদে | … বিসম্বাদে |
৪ | … ৫ … | ষট্ত্রিংশসহস্র | … ষট্ত্রিংশৎসহস্র |
৫ | … ১১ … | নিস্ফল | … নিষ্ফল |
৫ | … ১৩ … | দুসাধ্য | … দুঃসাধ্য |
৭ | … ১১ … | সহধ্যায়ী | … সহাধ্যায়ী |
৮ | … ১৬ … | কষ্টেসৃষ্টে | … কষ্টসৃষ্টে |
৯ | … ১৪ … | দুরাদৃষ্ট | … দুরদৃষ্ট |
৯„ | … ১৬ … | দ্বন্দ | … দ্বন্দ্ব |
১০ | … ২১ … | সন্ধীয় | … সম্বন্ধীয় |
১১ | … ১১ … | মূদ্রিত | … মুদ্রিত |
১২ | … ২১ … | নিপুন | … নিপুণ |
১৮ | … ২১ … | প্রচূর | … প্রচুর |
২১ | … ৫ … | আপারগ | … অপারগ |
২১„ | … ২২ … | আয়াশ | … আয়াস |
২৪ | … ১৩ … | দুর্দৈব্য | … দুর্দৈব |
২৫ | … ১৭ … | গাহিতে | … গায়িতে |
২৭ | … ২২ … | নিস্বার্থ | … নিঃস্বার্থ |
৩০ | … ২ … | আর | … আরও |
৩৩ | … ২৩ … | প্রতিপ্রদায়িনী | … প্রীতিপ্রদায়িনী |
৩৩„ | … ২৩„ … | স্ফর্ত্তি | … স্ফূর্ত্তি |
৩৪ | … ৬ … | উদিপীত | … উদ্দীপিত |
৩৫ | … ৭ … | পরমসৎ | … পরমসৎ। |
৩৫„ | … ৮ … | পূজার্চ্চণা | … পূজার্চ্চনা |
৩৬ | … ১ … | প্রদার্থে | … পদার্থে |
৩৬„ | … ১৬ … | ইয়াছিল | … হইয়াছিল |
৩৬„ | … ২১ … | আর্থাৎ | … অর্থাৎ |
৩৭ | … ১৫ … | ভক্তাচ্ছদন | … ভক্তাচ্ছাদন |
৩৮ | … ২৩ … | অনুসুনা | … অনুসূচনা |
৩৯ | … ১৭ … | কেমুত | … কোমৃত |
৪০ | … ৩ … | আদরনীয় | … আদরণীয় |
৪০ | … ১০ … | লক্ষ | … লক্ষ্য |
৪১ | … ১ … | মীমাংশা | … মীমাংসা |
৪৩ | … ১৯ … | অনুমাত্র | … অণুমাত্র |
৪৫ | … ২৩ … | সূত্রপাৎ | … সূত্রপাত |
৪৭ | … ২০ … | শতাব্দীর | … শতাব্দের |
৪৮ | … ১১ … | নীত্যরানুগী | … নীত্যনুরাগী |
৪৯ | … ১৫ … | সহকারি | … সহকারী |
৫২ | … ১ … | নিবাসি | … নিবাসী |
৫৩ | … ১১ … | পটদ্দশা | … পঠদ্দশা |
৫৩„ | … ১৪ … | কিদৃশ | … কীদৃশ |
৫৬ | … ৬ … | করিয়ছেন | … করিয়াছেন |
৫৬„ | … ১৬ … | মনুষত্বই | … মনুষ্যত্বই |
৬১ | … ১০ … | অদভু | … অদ্ভুত |
৬১ | … ২৩ … | অনাগতে | … অনাগতের |
৬৩ | … ৬ … | ব্যায়াসমর্থ | … ব্যয়াসমর্থ |
৬৪ | … ৩ … | চর্ব্বন | … চর্ব্বণ |
৬৬ | … ৯ … | বক্তি | … ব্যক্তি |
- ↑ কোম্ত স্বয়ং সংজ্ঞা করিয়াছেন যে, “মানসিক ঐ অবস্থাকে ক্ষিপ্তাবস্থা বলে যে অবস্থায় প্রমেয়গত জ্ঞান বা বিবেচনা অপেক্ষা কাল্পনিক ধ্যান বা প্রমাতৃগত অনুসূনা অধিকতর প্রবল হইয়া উঠে।”
এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।