নূতনের সন্ধান/নিখিল বঙ্গীয় যুব-সম্মেলন

উইকিসংকলন থেকে



8

 “মনে রাখিবেন আমাদের সমবেত চেষ্টায় ভারতবর্ষে নূতন জাতি সৃষ্টি করিতে হইবে। পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের সমাজে ওতঃপ্রোতঃভাবে প্রবেশ করিয়া আমাদিগকে ধনে প্রাণে মারিতে চেষ্টা করিতেছে। আমাদের ব্যবসায় বাণিজ্য, ধর্ম্ম-কর্ম্ম, শিল্পকলা মরিতে বসিয়াছে। তাই জীবনের সকল ক্ষেত্রে আবার মৃতসঞ্জীবনী সুধা ঢালিতে হইবে। এ সুধা কে আহরণ করিয়া আনিবে?”


 হে আমার তরুণ ভাই ও ভগিনী সকল! আপনারা আমাকে এই তরুণ পরিষদের সভাপতি-পদে বরণ করিয়া যে প্রীতির নিদর্শন দেখাইয়াছেন তার জন্য আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি। আজ পৃথিবীর একপ্রান্ত হইতে অপরপ্রান্ত পর্য্যন্ত তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে জাগরণের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। এই বিশ্বব্যাপী জাগরণের প্রভাবে আমরাও আজ এখানে সমবেত হইয়া জীবনের সমস্যা সমাধানে ব্রতী হইয়াছি।

 প্রায় আড়াই বৎসর পরে কারার প্রাচীরের বাহিরে যখন পদার্পণ করি, তখন দেশের অবস্থা নিরীক্ষণ করিয়া সর্ব্বপ্রথমে এই কথাই মনে হইয়াছিল যে কতকগুলি দুর্ঘটনা ও দুর্দ্দৈব বশতঃ আমরা যেন আপাততঃ বড় কথা ভাবিবার এবং দূরের বস্তু দেখিবার ক্ষমতা হারাইয়াছি। ইহার ফলে আমাদের সমাজে নীচ চিন্তা, ক্ষুদ্র স্বার্থ ও পরস্পরের মধ্যে দলাদলি দেখা দিয়াছে, আমরা অসত্যকে সত্য মনে করিয়া, আসলকে ছাড়িয়া ছায়ার পশ্চাতে ছুটয়াছি। কিন্তু সুখের বিষয়, আমাদের এই সাময়িক মোহ ভাঙ্গিতেছে; আমরা আমাদের সহজ দৃষ্টি ফিরিয়া পাইতেছি। তরুণের হৃদয়ে আবার আত্ম-প্রত্যয় জন্মিতেছে। সে বুঝিতেছে―জীবনে তাহার উপর কত বড় দায়িত্ব ন্যস্ত হইয়াছে; সে উপলব্ধি করিতেছে যে ভবিষ্যৎ সমাজ গড়িয়া তোলার ভার তাহাকেই গ্রহণ করিতে হইবে। শুধু তাহাই নয়, আমাদের তরুণ-সমাজ আজ নিজের অন্তরে অনন্ত শক্তির সন্ধান পাইতেছে। সর্ব্বদেশে সর্ব্বকালে যে মৃত্যুঞ্জয় তরুণশক্তি মুক্তির ইতিহাস রচনা করিয়াছে, আমাদের দেশে আজ সেই তরুণশক্তিই নিজের অস্থিদান করিয়া বজ্র নির্ম্মাণের সাধনায় প্রবৃত্ত হইতেছে।

 আমাদের জাতীয় সমস্যা বিষয়ে আমার বক্তব্য অনেক আছে। একটী অভিভাষণে বা বক্তৃতায় তাহা ব্যক্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়―তাই আমি সে চেষ্টাও করিব না। বিস্তৃত আলোচনায় প্রবৃত্ত না হইয়া আমি মূল সমস্যা সম্বন্ধে কয়েকটী কথা বলিয়া ক্ষান্ত হইব।

 পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক সভ্যতার অভ্যুত্থান, ক্রমোন্নতি ও পতন হইয়াছে। আমরাও একদিন স্বাধীন ছিলাম। ধর্ম্মে কর্ম্মে, কাব্যে সাহিত্যে, শিল্পে বাণিজ্যে, যুদ্ধবিগ্রহে―ভারতবাসীও একদিন পৃথিবীর মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করিত। কালের চক্রবৎ পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা সে প্রাচীন গৌরব হারাইয়াছি। আজ আমরা শুধু পরাধীন তাহা নয়,―বিদেশী সভ্যতার সম্মোহন-বাণের আঘাতে আমরা আমাদের প্রাণ ধর্ম্ম হরাইতে বসিয়াছি। তবে আনন্দের বিষয় এই যে অজ্ঞান-নিশা প্রায় কাটিয়া গিয়াছে; আমরা জাতীয় চৈতন্য ফিরিয়া পাইতেছি।

 সকল জাতি বা সকল সভ্যতার যে পতনের পর পুনরভ্যুত্থান ঘটিয়া থাকে―এ কথা বলা যায় না। ভগবানের আশীর্ব্বাদে আমাদের দেশে কিন্তু পতনের পর পুরভ্যুত্থান আরম্ভ হইয়াছে। আমাদের এই জাতীয় আন্দোলন বাহ্যিক চাঞ্চল্যমাত্র নয়,―ইহা জাতীর আত্মার জাগরণ ও অভিব্যক্তি। আমার কথা যে সত্য তার প্রমাণ এই যে আমাদের দেশে নব জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নূতন সৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে। সৃষ্টিই জীবনের লক্ষণ, কাব্যে সাহিত্যে, শিল্পে বাণিজ্যে, ধর্ম্মে কর্ম্মে, কলা বিজ্ঞানে―নূতন সৃষ্টির যে পরিচয় ভারতবাসী দিতেছে―তাহা হইতে সপ্রমাণ হইতেছে যে ভারতের আত্মা জাগিয়াছে, ভারতীয় সভ্যতার নূতন অধ্যায় আমাদের চোখের সামনেই রচিত হইতেছে।

 বৈজ্ঞানিকেরা বলেন যে, কোনও সভ্যতার পতন হইলে সেই জাতির সৃষ্টি-শক্তি লোপ পায়, জাতির চিন্তাশক্তি ও কর্ম্মপ্রচেষ্টা গতানুগতিক পন্থা অনুসরণ করিতে থাকে। ব্যক্তি ও জাতির জীবনে adventure ও enterprise এর স্পৃহা হ্রাস পায়, কতকগুলি বাঁধা বুলির রোমন্থনের দ্বারা জাতি আত্মপ্রসাদ লাভ করে। এই অবস্থার পরিবর্ত্তন ঘটাইতে হইলে চিন্তা-রাজ্যে বড় রকমের ওলটপালটের প্রয়োজন এবং জীব-রাজ্যে (biological planeএ) রক্ত-সংমিশ্রণ আবশ্যক। আমি বৈজ্ঞানিক নহি, সুতরাং আমার পক্ষে জোর করিয়া কিছু বলা সম্ভব নয়। তবুও আমার মনে হয় যে নূতন সভ্যতা সৃষ্টির মূলে খানিকটা রক্ত-সংমিশ্রণের আবশ্যকতা আছে। তবে ভারতের বাহিরের জাতির সহিত ভারতবাসীর রক্ত-সংমিশ্রণের প্রয়োজনীয়তা নাই। এরূপ সংমিশ্রণ যদি বেশী হয় তবে তার ফল অহিতকর হওয়ার আশঙ্কাই বেশী। ইহার দৃষ্টান্ত ব্রহ্মদেশ। কিন্তু ভারতবর্ষের মধ্যে―বিশেষতঃ হিন্দু সমাজের মধ্যে―যে সব জাতি আছে—তাহাদের মধ্যে খানিকটা রক্ত সংমিশ্রণ হইলে ফল যে ভাল হইতে পারে তাহা মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে।

 আমাদের জাতীয় অধঃপাতের অনেক কারণ আছে―তন্মধ্যে একটা প্রধান কারণ এই যে, আমাদের দেশে ব্যক্তির ও জাতির জীবনে প্রেরণা বা initiative হ্রাস পাইয়াছে। আমরা বাধ্য না হইলে এবং কশাঘাত না খাইলে সহজে কিছু করিতে চাই না। বর্তমানকে উপেক্ষা করিয়া ভবিষ্যতের পানে তাকাইয়া যে অনেক সময়ে অনেক কাজ করা দরকার এবং বাস্তবের দৈন্যকে অগ্রাহ্য করিয়া আদর্শের প্রেরণায় জীবনটাকে অনেক সময়ে যে হাসিতে হাসিতে বিলাইয়া দেওয়া প্রয়োজন―এ কথা আমরা কার্য্যতঃ স্বীকার করিতে চাই না। এই জন্য প্রেরণা বা initiative এর অভাবের দরুণ, ব্যক্তি ও জাতির ইচ্ছা শক্তি ক্রমশঃ ক্ষীণ ও নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছে। ব্যক্তির ও জাতির জীবনে ইচ্ছাশক্তি পুনরায় জাগাইতে না পারিলে মহৎ কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর হইবে না। শুধু আদর্শের প্রেরণায়ই ইচ্ছাশক্তি জাগরিত হয়। আমরা আদর্শ ভুলিয়াছি বলিয়াই আমাদের ইচ্ছাশক্তি আজ এত ক্ষীণ। বর্ত্তমানের ভাব-দৈন্য বিদূরিত করিয়া নিজ নিজ জীবনে আদর্শের প্রতিষ্ঠা না করিতে পারিলে আমাদের প্রেরণাশক্তি জাগিবে না এবং প্রেরণাশক্তি না জাগিলে চিন্তাশক্তি ও কর্ম্মপ্রচেষ্টা পুনরুজ্জীবিত হইবে না।

 সমাজের পুনর্গঠনের জন্য আজকাল পাশ্চাত্যদেশে নানা প্রকার মতের ও কর্ম্ম প্রণালীর প্রচলন দেখিতে পাওয়া যায় যথা―Socialism, State Socialism, Guild Socialism. Syndicalism, Philosophical Anarchism, Bolshevism, Fascism, Parliamentary Democracy, Aristocracy, Absolute Monarchy, Limited Monarchy, Dictatorship ইত্যাদি। এই সব মতবাদের বিষয় আমি সাধারণ ভাবে ২/১টী কথা বলিতে চাই। প্রথমতঃ সকল মতের ভিতর অল্প বিস্তর সত্য আছে, কিন্তু এই ক্রমোন্নতিশীল জগতে কোনও মতকে চরম সত্য বা চরম সিদ্ধান্ত বলিয়া গ্রহণ করা বোধ হয় যুক্তিসঙ্গত কাজ নয়। দ্বিতীয়তঃ এ কথা ভুলিলে চলিবে না যে কোনও দেশের কোনও প্রতিষ্ঠানকে সমূলে উৎপাটন করিয়া আনিয়া বলপূর্ব্বক অন্য দেশে রোপন করিলে সুফল না ফলিতেও পারে। প্রত্যেক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি হয় সেই দেশের ইতিহাসের ধারা, ভাব ও আদর্শ এবং নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের প্রয়োজন হইতে। সুতরাং আমাদের মনে রাখিতে হইবে যে, কোনও প্রতিষ্ঠান গড়িতে হইলে ইতিহাসের ধারা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও বর্ত্তমানের আবহাওয়া অগ্রাহ্য করা সম্ভব বা সমীচীন নয়।

 আপনারা জানেন যে Marxianismএর তরঙ্গ এ দেশে আসিয়া পৌঁছিয়াছে; এই তরঙ্গের আঘাতে কেহ কেহ চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছেন। Karl Marxএর মতবাদ পূর্ণরূপে গ্রহণ করিলে আমাদের দেশ যে সুখসমৃদ্ধিতে ভরিয়া উঠিবে এ কথা অনেকে বিশ্বাস করেন এবং দৃষ্টান্ত স্বরূপ তাঁহারা রুসিয়ার দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করেন। কিন্তু আপনারা হয়তো জানেন যে রুসিয়াতে যে Bolshevism প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে―তার সহিত Marxian Socialismএর মিল যতটা আছে―পার্থক্য তদপেক্ষা কম নয়। রুসিয়া Marxian মতবাদ গ্রহণ করিবার সময়ে প্রাচীন ইতিহাসের ধারা, জাতীয় আদর্শ বর্তমানের আবহাওয়া এবং নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের প্রয়োজনের কথা ভুলিয়া যায় নাই। আজ যদি Karl Marx জীবিত থাকিতেন, তাহা হইলে তিনি রুসিয়ার বর্তমান অবস্থা দেখিয়া কতটা সুখী হইতেন সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে―কারণ আমার মনে হয় যে Karl Marx বিশ্বাস করিতেন যে তাঁহার সামাজিক আদর্শ একই ভাবে, রূপান্তরিত না হইয়া, সকল দেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। এ সব কথার অবতারণা করিবার উদ্দেশ্য এই যে, আমি স্পষ্ট করিয়া বলিতে চাই যে, আমি অন্য দেশের আদর্শ বা প্রতিষ্ঠান অন্ধভাবে অনুকরণ করার বিরোধী।

 আর একটা কথার উল্লেখ না করিলে আসল কথাই বলা হইবে না। পরাধীন দেশে যদি কোনও 'ism'―সর্ব্বান্তঃকরণে গ্রহণ করিতে হয়, তবে তাহা nationalism। যতদিন আমরা স্বাধীন না হইতেছি ততদিন আমরা সামাজিক ও অর্থ-নৈতিক (Social and Economic) পুনর্গঠনের অবসর ও সুযোগ পাইব না, এ কথা ধ্রুব সত্য। সুতরাং সর্ব্বাগ্রে আমাদের সমবেত চেষ্টায় স্বাধীনতা লাভ করিতে হইবে। দেশ, ব্যক্তিবিশেষ বা সম্প্রদায় বিশেষের সম্পত্তি নয়―এবং কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি শ্রমিক, কি ধনিক―কোনও সম্প্রদায় বিশেষের পক্ষে, সকলের সহযোগ ব্যতীত, স্বরাজলাভ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাহা হইলেও, সকল ব্যক্তির ও সকল সম্প্রদায়ের ন্যায্য দাবী আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে; কারণ সত্য ও ন্যায়ের উপর আমাদের জাতীয়তা যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় তবে সে জাতীয়তা একদিনও টিকিতে পারে না। এই জন্য আমি সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিক বা কৃষক সম্প্রদায়কে স্বরাজ-আন্দোলনের পরিপন্থী তো মনে করিই না―বরং আমি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিব যে তাহাদের সহযোগ ব্যতীত স্বরাজ-লাভের আশা দুরাশা মাত্র―এবং তাহারা যে পর্য্যন্ত সঙ্ঘবদ্ধ না হইতেছে ততদিন তাহাদিগের পক্ষে স্বরাজ আন্দোলনে অথবা সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে যোগদান করা সম্ভবপর হইবে না।

 এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে সকল দেশে, বিশেষতঃ আমাদের এই অভাগা দেশে, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়ই দেশের মেরুদণ্ড-স্বরূপ। তাহারা যে শুধু মুক্তিপথের অগ্রদূত তাহা নয়―গণ-আন্দোলনের অগ্রদূত। যতদিন পর্য্যন্ত জন-সাধারণের মধ্যে প্রকৃত জাগরণ না আসিতেছে, ততদিন পর্য্যন্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়কেই গণ-আন্দোলনের অগ্রদূত হইতে হইবে। এতদ্ব্যতীত যাবতীয় গঠনমূলক কাজে এই শিক্ষিত সম্প্রদায়কেই অগ্রণী হইয়া পথ-প্রদর্শকের কাজ করিতে হইবে। এই সকল কারণে আমি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অভাব অভিযোগের বিষয়ে ২/১টি কথা বলিতে ইচ্ছা করি।

 প্রথমতঃ তাহাদের ভাবের অভাবের কথা। আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে যে আদর্শপ্রেম ও আদর্শনিষ্ঠার অভাব আছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। এই ভাবদৈন্যের কারণ কি? কারণ এই, যে যাঁহারা আমাদিগকে শিক্ষা দেন তাঁহারা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আদর্শের বীজ আমাদের হৃদয়ে বপন করেন না। আমাদের ভাবদৈন্যের জন্য আমি আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষদিগকে প্রধানতঃ দায়ী করি। আমি জিজ্ঞাসা করি―আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় কি মুক্তির বায়ু খেলিতে পায়? যাহারা ঐ আঙ্গিনায় জ্ঞানাহরণের জন্য বিচরণ করে তাহারা কি মুক্তির আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়? আপনারা সকলে জানেন যে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে পূত আন্দোলন ফরাসী দেশের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত জাগরণের বন্যা আনিয়াছিল সেই আন্দোলনের অধিনায়ক ছিলেন―ফরাসী দেশের অধ্যাপক সম্প্রদায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাইলেই বুঝিতে পারা যায় আমাদের জাতীয় দুর্দ্দশা কতদূর পৌঁছিয়াছে। কিন্তু আমাদের হতাশ হইলে চলিবে না। অধ্যাপক সম্প্রদায় যদি নিজেদের কর্ত্তব্য না করেন―তাঁহারা যদি নিজ নিজ জীবনের আদর্শ ও শিক্ষার প্রভাবে মানুষ সৃষ্টি করিতে অক্ষম হন―তাহা হইলে ছাত্রদিগকে নিজের চেষ্টায় ও সাধনার দ্বারা মানুষ হইতে হইবে।

 ভাবের দৈন্যের পরই অন্নাভাবের কথা মনে পড়ে। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকার সমস্যা যে কিরূপ গুরুতর হইয়া দাঁড়াইয়াছে তাহা নানা কারণে আমার জানিবার সুযোগ হইয়াছে। এ কথা বোধ হয় অনেকে জানেন না যে আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের আর্থিক অবস্থা আমাদের কৃষক সম্প্রদায়ের আর্থিক অবস্থার চেয়েও অনেক বিষয়ে খারাপ। চাকুরীর দ্বারা যে তাহাদের অভাব মিটিতে পারে এ আশা নাই, কারণ শিক্ষিত যুবকের সংখ্যার অপেক্ষা চাকুরীর সংখ্যা অনেক কম। সুতরাং ইহা অনিবার্য্য যে আগামী ৩০/৪০ বৎসরে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেককেই অনাহারে মরিতে হইবে! কিন্তু আজ হইতে আমরা যদি চাকুরীর আশা-পরিত্যাগ করিয়া ব্যবসায়-বাণিজ্যে মন দিই, তাহা হইলে আমরা মরিয়াও আমাদের সন্তান-সন্ততিদের বাঁচিবার উপায় করিয়া যাইতে পারিব। কিন্তু এখনও যদি আমরা চাকুরীর আশায় ঘুরিতে থাকি তাহা হইলে আমরা তো মরিবই―সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের সন্তান-সন্ততিদের মরণের আয়োজন করিয়া যাইব। আমাদের মাড়োয়ারী ভাইরা ৪০/৫০ বৎসর পুর্বে যেরূপ নিঃসম্বল ও কপর্দ্দকহীন অবস্থায় ব্যবসায়-ক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়াছিলেন আমাদিগকেও ঠিক সেইভাবে ও সেই অবস্থায় ব্যবসায়ক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে হইবে এবং নিজেদের অধ্যবসায়, চরিত্রবল ও কষ্টসহিষ্ণুতার দ্বারা ব্যবসায়ক্ষেত্রে কৃতিত্ব লাভ করিতে হইবে। “নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়।”

 আমাদের বর্ত্তমান কর্ম্মপদ্ধতি সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা না করিয়া আমি মাত্র কয়েকটী কথা বলিব। আমাদের এখন দুই দিকে কাজ করিতে হইবে। প্রথমতঃ ভাবের দৈন্য ঘুচাইবার জন্য নূতন ভাবের ধারা প্রবাহিত করিতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ দেশের মধ্যে যতগুলি যুবক সমিতি ও যুবকদের আন্দোলন আছে বা ভবিষ্যতে হইতে পারে সে সকলের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করিতে হইবে।


 যাঁহারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃষ্টির কার্য্যে ব্যাপৃত আছেন তাঁহাদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান যাহাতে হয় তার জন্য একটা League of Young Intellectuals গঠন করা আবশ্যক। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বণিক, বৈজ্ঞানিক এবং সকল ক্ষেত্রের কর্ম্মী এই League এর সভ্য হইবেন। এক কথায় বলিতে গেলে, যাঁহারা “best brain of the entire nation” তাঁহাদের একত্র করিতে হইবে—তাঁহাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের সুযোগ করিয়া দিতে হইবে এবং তাঁহারা সকলে যাহাতে একই লক্ষ্য সম্মুখে রাখিয়া জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃষ্টি কার্য্যে আত্মনিয়োগ করিয়া সমগ্রজাতিকে সবল, সুস্থ ও কৃতী করিয়া তোলেন তাহার আয়োজন করিতে হইবে।

 দ্বিতীয়তঃ, যুবকদের কর্ম্ম প্রচেষ্টা যাহাতে ভিন্নমুখী ও পরস্পর বিরোধী না হয় এবং যাহাতে সকল চেষ্টা সংহত ও সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া একই আদর্শের দিকে পরিচালিত হয়, তার জন্য কেন্দ্রীয় সমিতির আবশ্যকতা। এই উদ্দেশ্য লইয়া কয়েক বৎসর পূর্ব্বে নিখিল বঙ্গীয় যুবক সমিতি গঠিত হইয়াছিল। নানা কারণে ঐ সমিতির কার্য্যকলাপ আশানুরূপ ফল প্রদান করে নাই। কিন্তু আমার মনে হয় যে আজ ঐ নিখিল বঙ্গীয় যুবক সমিতিকে পুনরুজ্জীবিত করিবার সময় আসিয়াছে। কোনও নূতন কেন্দ্রীয় সমিতি গঠন করিয়া আপনারা যদি ঐ পুরাতন নিখিল বঙ্গীয় যুবক সমিতির মধ্যে প্রবেশ করিয়া আবার প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন তাহা হইলে শীঘ্রই সুফল ফলিবে, একথা আমি বিশ্বাস করি।

 আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে বিস্তৃত কর্ম্মতালিকা দিবার চেষ্টা আমি করিব না। কি আদর্শ লইয়া এবং কি প্রণালীতে কাজ করা আবশ্যক সে বিষয়ে কিছু বলিলেই আমার কর্ত্তব্য সম্পাদিত হইবে। বাস্তবের দিক হইতে দেখিলে আমাদের অভাব প্রধানতঃ তিন প্রকার—(১) অন্নাদির অভাব (২) বস্ত্রাদির অভাব (৩) শিক্ষাদির অভাব। আমরা অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, শিক্ষা চাই। কিন্তু মূল সমস্যার দিকে দেখিলে প্রতীয়মান হইবে যে আমাদের জাতীয় দৈন্যের প্রধান কারণ—ইচ্ছাশক্তি ও প্রেরণার অভাব। সুতরাং যদি আমাদের National will বা ইচ্ছাশক্তি জাগরিত না হয় তাহা হইলে শুধু অন্ন, বস্ত্র ও শিক্ষার ব্যবস্থা করিলেই জাতীয় সমস্যার সমাধান হইবে না। Benevolent Despot এর মত সরকার বাহাদুর অথবা Local Bodyরা যদি জন-সাধারণের অন্ন, বস্ত্র ও শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়া দেন তাহা হইলেও আমরা মানুষ হইতে পারিব না। সকলের সাহায্য গ্রহণ করিতে দোষ নাই কিন্তু প্রধানতঃ নিজেদের সমবেত চেষ্টায় আমাদিগকে অন্ন, বস্ত্র ও শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। যদি আমরা সমবায় প্রণালীতে এই কাজ করিয়া যাইতে পারি তাহা হইলে আমাদের জাতীয় ইচ্ছাশক্তি ফিরিয়া আসিবে—এবং স্বরাজ-স্বাধীনতা অনায়াসে লভ্য হইয়া পড়িবে।

 পল্লী সংস্কারের কথা চিন্তা করিলে এই কথাই মনে হয়। আমাদের সর্ব্বদা লক্ষ্য রাখা উচিত যাহাতে গ্রামবাসীরা প্রধানতঃ নিজেদের চেষ্টায় অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যোন্নতির ব্যবস্থা করেন। প্রথম অবস্থায় গ্রামের বাহির হইতে সাহায্য পাঠানো দরকার হইতে পারে কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত যদি পল্লীবাসীরা স্বাবলম্বী ও আত্মনির্ভরশীল হইতে না পারেন তাহা হইলে সে পল্লীসংস্কারের কোনও সার্থকতা হইবে না। আমাদের মনে রাখিতে হইবে যে সাধারণ গ্রামবাসীর মধ্যে পরমুখাপেক্ষিতার ভাবই প্রবল সুতরাং স্বাবলম্বনের ভাব জাগাইতে হইলে বহুদিন ধরিয়া অক্লান্ত পরিশ্রম করিতে হইবে।

 আজকাল বন্যা ও দুর্ভিক্ষ নিত্য ঘটনায় পরিণত হইয়াছে। বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময়ে অনেক সমিতি সাধ্যমত এই সকল অভাব মোচনের চেষ্টা করেন এবং ধনিক সম্প্রদায়ও অনেক ভাবে সাহায্য করিয়া থাকেন। এ সকল সৎপ্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করা উচিত কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের মূল কারণ কি, সে বিষয়ে গবেষণা আরম্ভ করা প্রয়োজন। গবেষণা আরম্ভ করিলে একদিনেই যে আমরা একটা মীমাংসায় উপনীত হইব সে আশা আমি রাখি না। কিন্তু তথাপি অবিলম্বে এ বিষয়ে গবেষণা সুরু করা দরকার। আমি সকল চিন্তাশীল যুবককে এবং আমাদের বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে মনোনিবেশ করিতে অনুরোধ করি।

 আমাদের সমাজের মধ্যে যে সব অত্যাচার ও অনাচার ধর্ম্ম বা লোকাচারের নামে চলিতেছে সে বিষয়েও যুবকদের একটা কর্ত্তব্য আছে। আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাশয় অনেক সময়ে বলেন যে আমাদের যুবকেরা বিবাহের সময়ে হঠাৎ বাপ-মার বাধ্য হইয়া পড়ে। আমার নিজের মনে হয় যে শুধু বিবাহ কেন—আমরা অনেক সময়ে সুবিধা মত বাপ-মার বাধ্য হইয়া পড়ি। যুবকেরা যে বাপ-মা বা গুরুজনদের নামে মধ্যে মধ্যে অন্যায় কাজ করিয়া থাকেন—এ কথা অস্বীকার করিলে সত্যের অপলাপ করা হইবে। আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের যুবকেরা যদি সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া সামাজিক অত্যাচার দেশের ও অনাচার নিবারণের জন্য বদ্ধ পরিকর হন, তাহা হইলে অনতিবিলম্বে আমাদের সমাজে যুগান্তর উপস্থিত হইবে।

 আমার ভাই ও ভগিনি সকল, আজিকার মত আমার বক্তব্য শেষ করিতে চাই। মনে রাখিবেন যে আমাদিগকে সমবেত চেষ্টায় ভারতবর্ষে নূতন জাতি সৃষ্টি করিতে হইবে। পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের সমাজে ওতঃপ্রোত ভাবে প্রবেশ করিয়া আমাদিগকে ধনে প্রাণে মারিতে চেষ্টা করিতেছে। আমাদের ব্যবসায়-বানিজ্য, ধর্ম্ম-কর্ম্ম শিল্প-কলা মরিতে বসিয়াছে। তাই জীবনের সকল ক্ষেত্রে আবার মৃত-সঞ্জীবনী সুধা ঢালিতে হইবে। এ সুধা কে আহরণ করিয়া আনিবে? জীবন না দিলে জীবন পাওয়া যায় না। আদর্শের নিকট যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে বলিদান দিয়াছে―শুধু সেই ব্যক্তিই অমৃতের সন্ধান পাইতে পারে। আমরা সকলেই অমৃতের পুত্র, কিন্তু আমরা ক্ষুদ্র অহমিকার দ্বারা পরিবৃত বলিয়া অন্তর্নিহিত অমৃত সিন্ধুর সন্ধান পাই না। আমি আপনাদিগকে আহ্বান করিতেছি আসুন―আপনার আসুন―মায়ের মন্দিরে গিয়া আমরা সকলে দীক্ষিত হই! আসুন, আমরা সকলে এক বাক্যে এই প্রতিজ্ঞা করি, যে দেশসেবাই আমাদের জীবনের একমাত্র ব্রত হইবে―দেশমাতৃকার চরণে আমরা আমাদের সর্ব্বস্ব বলি দিব এবং মরণের ভিতর দিয়া অমৃত লাভ করিব। তাহা যদি আমরা করিতে পারি তবে নিশ্চয়ই জানিবেন—

"ভারত আবার জগৎ সভায়

শ্রেষ্ঠ আসন লবে।”