নেতাজী সুভাষ চন্দ্র/ব্যক্তিত্ব

উইকিসংকলন থেকে

দশ

ব্যক্তিত্ব

সর্ব্বত্যাগী—তেজস্বী—বাগ্মী—পরদুঃখকাতর—বন্ধুবৎসল—অতুলন স্বদেশ প্রেম—অসাম্প্রদায়িক—চির-অমর।

সুভাষচন্দ্রের নৈতিক চরিত্রে কখন কোন কলঙ্কে রেখা পড়ে নাই; তিনি নিষ্কলঙ্ক চরিত্র লইয়া চির-ব্রহ্মচারীর মত পরলোকে প্রস্থান করিয়াছেন।

 সুভাষচন্দ্র দেশ-সেবার জন্য যে স্বার্থত্যাগ করিয়া গিয়াছেন, তাহা প্রাচীন যুগে ভীষ্ম এবং ঐতিহাসিক যুগে রাণা প্রত্যাগের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয়। তিনি ইচ্ছা করিলে গভর্ণমেণ্টের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকিয়া সাধারণ বাঙালী জীবনের ভোগসুখে কালাতিপাত করিতে পারিতেন। নবীন যৌবন, সুন্দর-সৌম্য আকৃতি, পাণ্ডিত্য, অর্থোপার্জ্জনের সুযোগ-সুবিধা তিনি সমস্তই দেশ-মাতৃকার হোমানলে আহুতি দিলেন।

 তাঁহার এই ত্যাগের কথা পর্য্যালোচনা করিলে রঘুবংশে মহারাজ দিলীপের প্রতি সিংহের উক্তি মনে পড়ে—

“একাতপত্রং জগতঃ সভুত্বম্
নবং বয়ঃ কান্তমিদং বপুশ্চ।
অল্পস্য হেতোর্বহু হাতুমিচ্ছন্
বিচারমূঢ়ঃ প্রতিভাসি মে ত্বম্।”

 সিংহ যেন মহারাজ দিলীপকে “বিচারমূঢ়” বলিয়া তিরস্কার করিয়াছিল, সাধারণ লোকও হয়ত সুভাষচন্দ্রকে ঠিক সেইরূপ মনে করিবে। কিন্তু মহৎ যাঁহার উদ্দেশ্য, ক্ষুদে তাঁহার তৃপ্তি কোথায়? “নাল্পে সুখমস্তি।”

 সেইজন্য মহামানবেরা আত্মসুখের প্রয়াসী হইতে পারেন না—সুভাষচন্দ্রও পারেন নাই। আই. সি. এস্. পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করিয়াও তিনি দাস-মনোবৃত্তির বশীভূত হইতে পারিলেন না—হেলায় আই. সি. এস.-পদ পরিত্যাগ করিয়া অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করতঃ কারাবাস ও নির্ব্বাসনের দুঃখ-কষ্ট মাথায় তুলিয়া লইলেন।

 সুভাষচন্দ্রের চরিত্রের মহৎ গুণ তেজস্বিতা। জীবনের প্রথমভাগে প্রেসিডেন্সী কলেজে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল, পরবর্ত্তী জীবনে তাহাই কংগ্রেসে মহাত্মা গান্ধীর আপোষ-মীমাংসাকে অসার মনে করিয়া মহাত্মার বিরুদ্ধাচরণেও কুণ্ঠিত হয় নাই এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন পণ করিয়া ভারতীয় জাতীয় বাহিনী পরিচালনায় দাবানলের সৃষ্টি করে।

 বক্তৃতা দ্বারা লোককে মুগ্ধ করিবার অসামান্য শক্তি সুভাষচন্দ্রের ছিল। সহজ ও সরল ভাষায় তাঁহার মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা শুনিবার সৌভাগ্য যাঁহাদের হইয়াছে, তাঁহারাই সাক্ষ্য দান করিবেন যে, এমন বক্তৃতা করিবার শক্তি খুব কম লোকেরই থাকে।

 পরদুঃখে সুভাষচন্দ্রের কোমল হৃদয় কাঁদিয়া আকুল হইত। বহু বন্যা ও দুর্ভিক্ষ-পীড়িত নরনারীর সেবায় তাঁহার এই চিত্তবৃত্তির পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। যুদ্ধকালেও তাঁহার গভীর ভালবাসা ও স্নেহ-প্রবণ হৃদয় বহুবার আত্মবিকাশ করিয়াছে।

 আজাদ-হিন্দ ফৌজের অন্তর্গত ঝান্সীর রাণী-বাহিনীর মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বয়োবৃদ্ধা ছিলেন শ্রীযুক্তা চন্দ্রমুখী দেবী। তাঁহার বয়স ৫৪ বৎসর।

 ইনি আজাদ-হিন্দ ফৌজে যোগদান করিয়া নার্সের কার্য্য গ্রহণ করেন এবং শেষ পর্য্যন্ত ইহাতে ছিলেন। ইনি আজাদ-হিন্দ ফৌজের বিভিন্ন হাসপাতাল এবং এমন কি, সমরক্ষেত্রের কয়েকটি হাসপাতালেও কাজ করিয়াছেন। ইনি ঝান্সীর রাণী-বাহিনীতে সিপাহীর পদে ছিলেন। ইঁহার তিনটি পৌত্র বালসেনা-দলে যোগদান করিয়াছিল।

 নেতাজী সুভাষচন্দ্র এবং আজাদ-হিন্দ ফৌজের সকলেই তাঁহাকে ‘মাতাজী’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন।

 ‘মাতাজী’ আনন্দবাজার পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টোরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা-প্রসঙ্গে নেতাজী সুভাষচন্দ্র তাঁহার ফৌজের লোকদের কিরূপ গভীরভাবে ভালবাসিতেন এবং তাহাদের সেবার জন্য দারুণ বোমাবর্ষণের মধ্যেও কয়েক বার কিরূপভাবে নিজের জীবন বিপন্ন করিয়াছিলেন, তাহা ভাবাবেগে বর্ণনা করিয়াছেন।

 এরূপ ধরণের একটি দৃষ্টান্ত—যাহা তিনি স্বচক্ষে দেখিয়াছেন—বর্ণনা-প্রসঙ্গে মাতাজী বলেন যে, ব্রহ্ম-রণাঙ্গনে যুদ্ধের শেষ পর্য্যায়ে ব্রিটিশরা একবার রেঙ্গুণে মিয়ান হাসপাতালের উপর বোমাবর্ষণ করে। ইহা কতকটা কার্পেট-বোম্বিংয়ের ন্যায় হইয়াছিল; দুই বর্গমাইল স্থান জুড়িয়া বোমা বর্ষিত হয়। ঐ হাসপাতালের অতি নিকটেই মাতাজীর বাসগৃহ ছিল। শত-শত নাগরিক এবং আজাদ-হিন্দ ফৌজ এই বোমাবর্ষণের ফলে আহত হয়। নেতাজী আহতদের দেখিবার জন্য ছুটিয়া যান।

 এই সময় মাথার উপর আবার একদল বোমারু বিমান দেখা দেয় এবং ঐগুলি বোমাবর্ষণ করিতে থাকে। নেতাজীর গাড়ীটি একটি বোমার আঘাতে নষ্ট হইয়া যায়; কিন্তু নেতাজী তাহাতে কিছুমাত্র ভীত না হইয়া হাঁটিয়াই ঐ হাসপাতাল অভিমুখে অগ্রসর হন। তিনি তথায় উপস্থিত হইলে আহতগণ দারুণ বিপদের মধ্যেও উল্লসিত হইয়া উঠেন।

 নেতাজী সুভাষচন্দ্রের এই মধুর চরিত্রের জন্য আজাদ-হিন্দ ফৌজের প্রত্যেকটি সৈন্যও তাঁহাকে গভীরভাবে ভালবাসিত এবং তাঁহার শিক্ষা সকলে অন্তরের সহিত মানিত ও তাঁহাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করিত। লেঃ কর্ণেল চাটার্জ্জি তাহার একটি উদাহরণ দিয়াছেন।

 তিনি বলিয়াছেন, “ইম্ফল হইতে ফিরিবার সময় সৈন্যদিগকে অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করিতে হইয়াছে। এক জায়গায় একটি লোক মরণোন্মুখ হয়। ভাগ্যক্রমে তাহার ভাই তাহার কাছে আসে। অবস্থা দেখিয়া ভাই কাঁদিতে থাকে। তখন সে যোদ্ধা তাহার ভাইকে বলিল—‘তুমি কর্ত্তব্যহারা হইও না, আমার জন্য কাঁদিতেছ কেন? আমার দুঃখ হয় এইজন্য যে নিজের কর্ত্তব্য সম্পূর্ণরূপে করিতে পারিলাম না! তুমি আমার কাছে প্রতিশ্রুতি দাও যতদিন বাঁচিবে, ততদিন আমার অসমাপ্ত কার্য্য সম্পন্ন কবিতে চেষ্টা করিবে। নেতাজীকে বলিও— আমি আমার প্রাণ এখানে দিলাম কিন্তু বাসনা রহিয়া গেল—তাহা সম্পন্ন করিতে পারিলাম না!

 সুভাষচন্দ্রের প্রতিভা বহুমুখী, যদিও তাহা কেবল দেশের স্বাধীনতা-লাভের উপায়-উদ্ভাবনেই নিরত ছিল। দেশের শিল্প-বাণিজোর জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গল স্বদেশী লীগ’ দ্বারা তিনি দেশের অর্থনীতিক উন্নতির বিষয়েও মনোনিবেশ করিয়াছিলেন। দর্শনের ছাত্র হিসাবে জগৎকে নূতন কোন মতবাদ প্রদান করাও হয়ত তাঁহার পক্ষে অসম্ভব হইত না; কিন্তু যে দর্শন-শাস্ত্রের চর্চ্চায় তাঁহার জীবন আরম্ভ, সেই বিষয়ের মধ্যে ডুবিয়া থাকিবার অবকাশ তিনি পান নাই—নতুবা আজ পৃথিবী হয়ত সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, কাণ্ট, হেগেল, শঙ্কর, রামানুজ প্রভৃতি দার্শনিকগণের মত সুভাষচন্দ্রের নিকট হইতেও জীবনের ব্যাখ্যায় কোন নূতন তত্ত্ব লাভ করিতে পারিত।

 সুভাষচন্দ্রের রহস্যজনক অন্তর্দ্ধানে তাঁহার অপূর্ব্ব উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। মোগল-যুগে আওরঙ্গজেবের রাজধানী দিল্লী হইতে মহারাষ্ট্র-সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছত্রপতি শিবাজীর পলায়নের মত সুভাষচন্দ্রের পলায়নও অভিনব কৌশলের পরিচায়ক।

 সর্ব্বোপরি সুভাষচন্দ্রের স্বদেশপ্রেম অতুলনীয়। তাঁহার অতি বড় শত্রুকেও স্বীকার করিতে হইবে যে, তাঁহার স্বদেশপ্রেম জীবনে-মরণে, শয়নে-স্বপনে অবিরাম-গতিতে জলপ্রপাতের বারিরাশির মত উদ্দামবেগে ছুটিয়া চলিত— কোনরূপ বাধাবিঘ্ন মানিত না। দেশের পরাধীনতায় তাঁহার অন্তরলোকে যে বেদনার সুর ঝঙ্কৃত হইত, তাহাই তাঁহাকে অগ্নি-দগ্ধ খধূপের মত সুদূরের পথে লইয়া গিয়াছিল!

 ফিলিপাইনের স্বাধীনতা-শহীদ জোস্ রিজলের মর্ম্মরমূর্ত্তিতে সুভাষচন্দ্রের মাল্যদানের যে মর্ম্মস্পর্শী বিবরণ সাংবাদিক হাসিওয়ারার বিবৃতি হইতে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ উদ্ধৃত করিয়াছেন, নিম্নে প্রদত্ত সেই বিবরণ পাঠ করিলে স্পষ্টই হৃদয়ঙ্গম হইবে, পরাধীনতার মর্ম্মজ্বালা তাঁহার প্রাণে ছিল কত গভীর—আর যাঁহারা পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করিতে যাইয়া স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মবিসর্জ্জন দিয়াছেন, তাঁহাদের প্রতিও, সুভাষচন্দ্রের হৃদয়ের অন্তস্তলে যে কি বিপুল পরিমাণে শ্রদ্ধা সঞ্চিত ছিল! স্বদেশপ্রেমের সাধক সুভাষচন্দ্রের ইহা এক সবাক্ উজ্জ্বল চিত্র!

 “১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাস। চমৎকার একটি দিন—ম্যানিলার সমুদ্রোপকূলে লুনেটা পার্কে সুভাষচন্দ্র গেলেন জোস্ রিজলের মর্ম্মর-মূর্ত্তিতে মাল্যদান করিতে। এই মূর্ত্তিটি খুবই প্রসিদ্ধ, কেননা জোস্ রিজল ছিলেন ফিলিপাইনের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিসংগ্রামের শহীদ।

 মূর্ত্তির পাদদেশে শত-শত ভারতীয়ের এক বিরাট জনতা সুভাষচন্দ্র ঘিরিয়া ধরিল। ইহারা সবাই থাকে ম্যানিলা কিংবা তাহার চতুষ্পার্শ্ববর্ত্তী অঞ্চলে। জনতা ‘জয়-হিন্দ’ ধ্বনিতে বসুকে জানাইল তাহাদের অভিনন্দন। ফটোগ্রাফাররা ফটো তুলিবে—বসুও দাঁড়াইলেন জনতার সঙ্গে।

 ফটো লওয়া শেষ হইল, বহুক্ষণ কাটিয়া গেল; তিনি নড়েন না, জনতাও নিস্তব্ধ—গভীর নীরবতার মধ্যে মৌন, অচঞ্চল দৃষ্টিতে রিজলের মূর্ত্তির দিকে সুভাষচন্দ্র তাকাইয়া রহিলেন।

 স্বাধীন ভারতের প্রতীক অঙ্কিত আজাদ-হিন্দ পতাকা প্রভাত-সমীরণে ইতস্ততঃ আন্দোলিত, বিরাট্ মূর্ত্তির পাদদেশে সুভাষচন্দ্রের অর্পিত ফুলের রাশি—এক কথায় সমগ্র অনুষ্ঠানটি উৎসবে রূপ ধারণ করিয়াছিল। সাগ্রহে প্রতীক্ষমাণ নীরব জনতার সম্মুখে তিনি সতৃষ্ণ নয়নে মূর্ত্তির দিকে তাকাইয়া রহিলেন।

 এইরূপ ঘটনায় কেহ-কেহ হয়ত সুভাষচন্দ্রকে ভাবপ্রবণ বলিয়া মনে করিবেন; কিন্তু তাঁহার সহিত কখনও যদি কাহারও আলাপ হইয়া থাকে, তাহা হইলে এইরূপ ধারণা হইবে বলিয়া আমার মনে হয় না। পক্ষান্তরে, আমার বহু সহকর্ম্মী আমাকে বলিয়াছেন যে, তাঁহারা তাঁহার শান্ত সমাহিতভাব এবং গভীর চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হইয়াছেন। সাংবাদিক-সম্মেলনে তাঁহার আচরণ ধীর-স্থির অথচ অতীব দৃঢ়। তিনি কদাচিৎ হাসিতেন, কিন্তু হাসিলে মৃদু ও মধুর হাসি হাসিতেন। আমার মনে হয় যে, হৃদয়াবেগ ও ন্যায়যুক্তির মধ্যে তিনি অবিচলিত সাম্য রক্ষা করিতেন।”

 বিদেশে ভারতীয়দিগের হৃদয় সুভাষচন্দ্রের প্রতি কি পরিমাণে আকৃষ্ট হইয়াছিল, তাহা জব্বলপুর ক্যাম্প-জেল হইতে সদ্যমুক্ত সাতজন ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর সৈনিক, এলাহাবাদের বাদসাহীমণ্ডী কংগ্রেস-কমিটীর সম্বর্দ্ধনা-সভায় বিগত ৫ই নভেম্বর (১৯৪৫) সন্ধ্যাকালে বিবৃতিদান-প্রসঙ্গে বলিয়াছেন।

 তাহারা বলিয়াছেন, সুভাষচন্দ্রকে স্বর্ণ-পরিমাপে ওজন করা হইয়াছিল। এই স্বর্ণ দক্ষিণ-পূর্ব্ব এসিয়ায় প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ব্যাঙ্কের সম্পত্তিরূপে গণ্য হইয়াছিল। কেবল তাহাই নহে, বিদেশে সুভাষচন্দ্র এত গভীর সম্মান ও মর্য্যাদা লাভ করিয়াছিলেন যে, তাঁহার গলদেশের একটি সামান্য পুষ্পমাল্যও জনৈক ব্যবসায়ী তাঁহার যথাসর্ব্বস্ব ব্যয়ে, বারো লক্ষ টাকা মূল্যে ক্রয় করিয়া লইয়াছিলেন! আর কোন এক বক্তৃতা-সভায় নেতাজী সুভাষচন্দ্রের পাদমূলে যে ভক্তির অর্ঘ্য পড়িয়াছিল, তাহার মূল্য সামান্য দু’ একশত টাকা নহে—তাহার মূল্য আট কোটি টাকা!

 দিল্লীর সামরিক আদালতে ক্যাপ্টেন শা নওয়াজ প্রভৃতির বিচারকালে সুভাষচন্দ্রের কতকগুলি টেলিগ্রাম প্রামাণ্য দলিলরূপে গৃহীত হইয়াছিল। সেই সংরক্ষিত টেলিগ্রামগুলিতেও সুভাষচন্দ্রের দৃঢ়চিত্ততা ও স্বাধীনতার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা মূর্ত্ত হইয়া উঠিয়াছে।

 ৭।১১।৪৫ তারিখের অমৃতবাজার পত্রিকা হইতে উক্ত টেলিগ্রামগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে উদ্ধৃত হইল।—

 “১৯৪৪ খৃষ্টাব্দের ২১শে জুলাই তারিখে সুভাষচন্দ্র বসু জাপানের প্রধান মন্ত্রী জেনারেল কইসোকে জানাইয়াছেন যে, পূর্ব্ব-এসিয়ার ভারতবাসীরা জাপানের সহিত পাশাপাশি দাঁড়াইয়া জয়লাভ না হওয়া পর্য্যন্ত যুদ্ধ করিতে কৃতসঙ্কল্প।

 অন্য একখানি টেলিগ্রামে সুভাষচন্দ্র জাপানী-প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন-ব্রহ্মের শাসনকর্ত্তা ডক্টর বা-ম’কে ভারতের স্বাধীনতা অর্জ্জনের জন্য সংগ্রামে সাহায্য-হেতু অভিনন্দিত করিয়াছেন। ইহাতে তিনি আরও জানাইয়াছেন যে, যে-কোন অবস্থায় আমরা, ভারতীয়েরা—স্বাধীন-ব্রহ্ম ও জাপানের পাশে দাঁড়াইয়া যুদ্ধ করিতে দৃঢ়সঙ্কল্প, যতক্ষণ না আমাদের সাধারণ শত্রু চূর্ণ হইয়া যায় এবং আমাদের জয়লাভ হয়।

 অন্য একখানি টলিগ্রামে সুভাষচন্দ জাপানী বৈদেশিক মন্ত্রী সিগামিৎসুর রাষ্ট্রপরিচালনা-নীতি ও কৌশলের প্রশংসা করিয়া বলিতেছেন যে, আমাদের পুরোভাগে দুঃসময় সত্ত্বেও আমরা জাপানের পাশে দাঁড়াইয়া আমাদের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিব, যতক্ষণ না বিজয়লাভ করিতে পারি।”

 কিন্তু হতভাগ্য দেশ এই ভারতবর্ষ! নতুবা এত বড় একজন আদর্শ নেতা লাভ করিয়াও আমরা তাঁহাকে হারাইয়া বসিয়াছি। গতবারের জনশ্রুতির ন্যায়, এবারও যদি তাঁহার মৃত্যু-সংবাদ অচিরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তবেই যা কিছু আশা ও সান্ত্বনা!

 সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু-সংবাদ অবশ্য অনেকেই বিশ্বাস করেন না; বিভিন্ন জ্যোতিষীর গণনা যদি সতা বলিয়া গ্রহণ করা যায়, তাহা হইলেও বিশ্বাস করিতে হইবে যে, এখন তাঁহার মৃত্যু হওয়া অসম্ভব! কিন্তু নানা লোকের নানা বিশ্বাস ও মতবাদ, এবং নানা জ্যোতিষীর নানা ভবিষ্যদ্বাণী কি প্রামাণ্য বলিয়া আঁকড়াইয়া থাকা যায়? কাজেই সুভাষচন্দ্র আমাদের নাই, তাঁহাকে আমরা হারাইয়াছি, আজ এই কথাটাই যেন সত্য হইয়া বড় বেশী বেদনাদায়ক হইয়া উঠিয়াছে!

 আশার মধ্যে শুধু এইটুকু যে সম্প্রতি ভারতের নানাস্থান হইতে গুটিকয়েক সংবাদ রটিতেছে কেহ-কেহ নাকি নেতাজী সুভাষচন্দ্রকে ভারতবর্ষেই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অবস্থায় দেখিতে পাইয়াছেন! মার্কিণ সাংবাদিকও নাকি সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ শরৎচন্দ্রকে জানাইয়াছেন যে, নেতাজী জীবিত আছেন, ইহাই নাকি মার্কিন গোয়েন্দার অভিমত। যাঁহারা পূর্ব্বোক্তরূপ ঘোষণা করিয়াছেন, জানিনা তাঁহাদের সেই ঘোষণার মুল্য কতখানি! সুতরাং আশা ও নিরাশার দ্বন্দ্বে সমগ্র ভারতবর্ষ আজ বিভ্রান্ত ও মূহ্যমান! সকলেরই মনে এক প্রশ্ন—সুভাষচন্দ্র জীবিত কি মৃত?

 ইহার জবাব দিয়াছেন শ্রদ্ধাস্পদ সাহিত্যিক ও নেতাজী সুভাষচন্দ্রের গুণমুগ্ধ সুহৃদ্ শ্রীযুক্ত বিজয়রত্ন মজুমদার মহাশয়। তিনি বলিয়াছেন:—

 “সুভাষচন্দ্র জীবিত অথবা লোকান্তরিত, কেহ জানে না! আই. এন. এ.র (Indian National Army—আজাদ-হিন্দ ফৌজ) দৃঢ় বিশ্বাস, সুভাষচন্দ্র জীবিত; সুভাষচন্দ্রের দেশবাসী মনে করে, পরাধীন ভারতের চির-জাগ্রত আত্মার মত ভারতের মুক্তিকামী সুভাষচন্দ্র মৃত্যুঞ্জয়ী, অবিনশ্বর।

 কিন্তু তিনি জীবিত অথবা মৃত, তাহাতে কিছু আসে যায় না। গ্যারিবল্ডি কি মরিয়াছেন? শিবাজী কি মৃত? রাণা প্রতাপসিংহ চিরদিন অমর। জর্জ্জ ওয়াশিংটনের বিনাশ নাই। নেতাজী সুভাষচন্দ্রও চিরজীবী।

 শুধু ভারতের নয়, শুধু এসিয়ার নয়, পৃথিবীর যেখানে যে দেশে, যে কোন পরাধীন জাতি আছে, সেই খানেই, সেই দেশে, সেই মানব-সমাজের প্রত্যেকটি নরনারী সুভাষচন্দ্রের নামের পাদমূলে পুষ্পাঞ্জলি দিয়া ধন্য ও কৃতার্থম্মন্য হইবে।”

 আমরাও তাঁহাকে ভক্তিপ্লুত হৃদয়ে শ্রদ্ধানত শিরে আমাদের প্রণতি জানাইতেছি এবং তাঁহারই প্রদত্ত অমর বাণীতে তাঁহাকে সাদর সম্ভাষণ নিবেদন করিতেছি—“জয় হিন্দ! দিল্লী চলো!”

 কারণ, তাঁহার সেই দিল্লী-অভিযান আজও তো শেষ হয় নাই।

সমাপ্ত