পঞ্চনদের তীরে/সপ্তম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

অখণ্ড ভারত-সাম্রাজ্যের স্বপ্ন

 ছুটে চলেছে তেজীয়ান ঘোড়া, যেন শরীরী ঝটিকা! পৃষ্ঠে আসীন সুবন্ধু, যেন তীব্র অগ্নিশিখা!

 কখনো জনাকীর্ণ নগর, কখনো শান্ত গ্রাম, কখনো রৌদ্রদগ্ধ প্রান্তর, কখনো দুর্গম অরণ্য এবং কখনো বা অসমোচ্চ পার্বত্য প্রদেশের মধ্য দিয়ে, পথ ও বিপথের উপর দিয়ে, সেতুহীন নদীর বুকের ভিতর দিয়ে সূবন্ধুর দুরন্ত ঘোড়া এগিয়ে চলল তুরন্ত গতিতে! দেখতে দেখতে সুদূরের মেঘস্পর্শী তুষারধবল পর্বতমালা দৃষ্টিসীমা থেকে মিলিয়ে গেল ক্ষীন হ’তে ক্ষীণতর স্বপ্নের মতো।

 সুবন্ধু যেতে যেতে লক্ষ্য করলে, ইতিমধ্যেই এ-অঞ্চলের হাটেমাঠে-বাটে নগরে গ্রামে বিষম উত্তেজনার সাড়া প’ড়ে গিয়েছে! অসংখ্য যবন সৈন্য নিয়ে বিদেশী দিগ্বিজয়ী আসছে ভারত-লুণ্ঠনে, এ দুঃসংবাদ এখানকার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে দাবানলের মতো।

 বীরত্ব-প্রকাশের নূতন অবসর পাওয়া গেল ব’লে নগরে নগরে বলিষ্ঠ ধুবকরা তরবারি, বর্শা, বাণ ও কুঠার নিয়ে শান দিতে বসেছে বিপুল উৎসাহে; এবং উচ্চকণ্ঠে প্রতিজ্ঞা করছে—একাধিক ভারতশত্রুকে বধ না ক’রে তাদের কেউ প্রাণ দেবে না।

 এক জায়গায় হঠাৎ অশ্ব থামিয়ে সুবন্ধু ব’লে উঠল, “না বন্ধু, না। তোমরা সকলেই যদি প্রাণ দিতে চাও, তাহ’লে ভারতের মঙ্গল হবে না।”

 জনৈক যুবক সবিস্ময়ে বললে, “দেশের জন্যে আমরা প্রাণ দিতে চাই। প্রাণের চেয়ে বড় কি আছে মহাশয়?”

 সুবন্ধু বললে, “পারস্য সম্রাট যখন ভারত আক্রমণ করেছিলেন, তখনো ভারতীয় বীরেরা দলে দলে প্রাণ দিতে পেরেছিল—ভারতে কখনো প্রাণ দেবার জন্যে লোকের অভাব হয় নি। কিন্তু তবু পারস্যের কাছে উত্তর-ভারত পরাজিত হয়েছিল।......তোমরা অন্য প্রতিজ্ঞা করো।”

 —“কি প্রতিজ্ঞা?”

 —“প্রতিজ্ঞা করো, যুদ্ধজয় না ক’রে, গ্রীকদের ভারত থেকে না তাড়িয়ে কেউ রণক্ষেত্র ত্যাগ করবে না। ভাই, প্রাণ দেওয়া সোজা, কিন্তু যুদ্ধজয় করা বড় কঠিন।”

 সুবন্ধু আবার ঘোড়াকে ছুটিয়ে দিলে।

 যেতে যেতে আরো দেখলে, বৃদ্ধ শিশু ও নারীর দল নগর ত্যাগ ক’রে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলেছে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে আছে বিলাসী ধনী, কৃপণ ও কাপুরুষের দলও! সুবন্ধুর দুই চক্ষে জাগল ঘৃণাভরা ক্রোধ! অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মনে মনে বললে, “বিলাসী ধনী, কৃপণ, কাপুরুষ! পৃথিবীর অভিশাপ!”

 মাঠে মাঠে দেখলে, দলে দলে চাষা ফসলভরা ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে হাহাকারে ভরিয়ে তুলেছে আকাশ-বাতাস!

 সুবন্ধুর মন করুণার বেদনায় ভ’রে উঠল। বললে, “হা হতভাগ্য চাষীর দল! এদের না আছে অর্থের শক্তি, না আছে অস্ত্রের শক্তি, না আছে বিদ্যার শক্তি! নাগরিক ধনী আর মহাজনরা এদের রাখে পায়ের তলায়, তবু এরা বিনিময়ে দেয় তাদের ক্ষুধার খোরাক। কঠিন পৃথিবীর শুক্‌নো ধূলোমাটিকে স্নিগ্ধ সুন্দর ক’রে রচনা করে শ্যামল মহাকাব্য এই দরিদ্র মহাকবির দল। কিন্তু দেশে যখন যুদ্ধ বাধে তখন কি বিদেশী আর কি স্বদেশী সৈন্যেরা চ’লে যায় এদেরই অপূর্ব রচনাকে নিঃশেষে ধ্বংস ক’রে। সারা বছরের শ্রম আর আশা বিফল হয়ে যায় একদিনের যুদ্ধযাত্রায়,—চোখে জাগে কেবল অনাহার আর দুর্ভাগ্যের ছবি।”

 পূর্বাকাশ ছেড়ে পশ্চিমের অস্তাচলে এসে সূর্যের রাঙামুখ ক্রমেই ম্লান হয়ে পড়ছে—আর অল্পক্ষণের মধ্যেই পাখীদের কণ্ঠে জেগে উঠবে বেলা-শেষের বিদায়ী সঙ্গীত।

 অশ্বের পিঠ চাপড়ে সুবন্ধু বললে, “চল্‌রে রাজার ঘোড়া, আরো একটু তাড়াতাড়ি চল রে ভাই। অন্ধকারে অন্ধ হবার আগে একটা আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে যে।”

 সন্ধ্যার কিছু আগেই পাওয়া গেল একটি গ্রামের প্রান্তে এক পান্থশালা। সুবন্ধু জানত, পনেরো ক্রোশের মধ্যে আর কোনো পান্থশালা বা নগর নেই। সুতরাং এইখানেই রাত্রিযাপন করবে ব’লে সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়ল।

 সেকালে সৈনিকের সব-চেয়ে প্রিয় ছিল অসি ও অশ্ব। নিজের শ্রান্তিকে আমলে না এনে সূবন্ধু আগে তাই তার অতি-শ্রান্ত ঘোড়ার পরিচর্যায় নিযুক্ত হ’ল। জল এনে তার সর্বাঙ্গের ধূলোকাদ। ধুয়ে দিলে, তারপর তাকে দলন-মর্দন করতে লাগল।

 পান্থশালার সমুখ দিয়ে যে প্রশস্ত রাজপথ চ’লে গিয়েছে তা এই গ্রামের নিজস্ব পথ নয়, কারণ মহারাজা পুরুর রাজ্য থেকে সীমান্তে যাবার জন্যে এইটিই হচ্ছে প্রধান পথ।

 হঠাৎ দূর থেকে অনেকগুলো ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনে লুবন্ধু চমকে মুখ তুলে দেখলে, পথের উপরে ধূলিমেঘের সৃষ্টি হয়েছে। সে কৌতূহলী চোখে সেইদিকে তাকিয়ে রইল।

 তারপরই দেখা গেল একদল অশ্বারোহীকে। সংখ্যায় তারা পঞ্চাশজনের কম হবে না। কে এরা?

 অশ্বারোহীর দলও পান্থনিবাসের সামনে এসে থামল। দলের পুরোভাগে ছিল যে অশ্বারোহী, ঘোড়া থেকে নেমে সে গম্ভীর স্বরে বললে, “কে এই পান্থশালার অধিকারী?” তার কণ্ঠস্বর শুনলেই বোঝা যায়, এ ব্যক্তি আজন্ম আদেশ দিতে অভ্যস্ত।

 অধিকারী সসম্ভ্রমে কাছে ছুটে গিয়ে নত হয়ে অভিবাদন করলে।

 অশ্বারোহী তার দিকে তাকিয়েও দেখলে না। তেমনি হুকুমের স্বরে বললে, “আজ রাত্রে আমি এখানে থাকবো। আমার আর আমার লোকজনের থাকবার ব্যবস্থা করো।”

 অধিকারী মৃদু স্বরে বললে, “আজ্ঞে, হঠাৎ এত লোকের ব্যবস্থা করি কি ক’রে?”

 অশ্বারোহী মুহূর্তের জন্যে অধিকারীর মুখের দিকে তাকালে, অত্যন্ত অবহেলা-ভরে। সেই দুই চক্ষের দীপ্তি দেখেই অধিকারীর দেহ ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল।

 পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা বার ক’রে অধিকারীর দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অশ্বারোহী অধীর স্বরে বললে, “যাও! নিজের মঙ্গল চাও তো প্রতিবাদ কোরো না।”

 স্বর্ণমুদ্রাগুলি তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নিয়ে অধিকারী সেখান থেকে দ্রুতপদে স’রে পড়ল।

 সুবন্ধু সবিস্ময়ে অশ্বারোহীকে লক্ষ্য করতে লাগল। বয়স বোধহয় বিশ-বাইশের বেশী হবে না, কিন্তু তার দেহ এমন দীর্ঘ, বলিষ্ঠ ও পরিপুষ্ট যে, সহজে ধরা যায় না। উজ্জ্বলশ্যাম বর্ণ। ভাব-ভঙ্গি অসাধারণ সম্ভ্রান্তজনের মতো এবং মুখেচোখে অতুলনীয় প্রতিভা, বীরত্ব ও ব্যক্তিত্বের আভাস।

 অশ্বারোহীর দৃষ্টি এতক্ষণ পরে লুবন্ধুর দিকে আকৃষ্ট হ’ল। কয়েক মুহূর্ত´ তীক্ষ্ণনেত্রে তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে তিনি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বললেন, “বন্ধু দেখছি তুমি সৈনিক।”

 সুবন্ধু অভিবাদন ক’রে হেসে বললে, “আজ্ঞে, আমাকে কেউ সুধু বন্ধু ব’লে ডাকে না, কারণ আমার নাম সুবন্ধু!”

 —“তুমি সুবন্ধু কি কুবন্ধু জানিনা, কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি বীর। আমার চোখ মিথ্যা দেখে না। কিন্তু তোমার কি আর কোন পরিচয় নেই?”

 —“আমি ভারতসন্তান।”

 —“সে গর্ব আমিও করতে পারি!”

 -“আমার ব্রত ভারতকে জাগানো।”

 —“আমারও ঐ ব্রত।”

 —“তাই যদি হয়, তবে সীমান্তের দিকে না গিয়ে আপনি ফিরে আসছেন কেন? আপনি কি জানেন না, ভারতের রক্তপান করবার জন্যে সীমান্তে এসে হাজির হয়েছে যবন দিগ্বিজয়ী?”

 মৃদু হাস্যে ওষ্ঠাধর রঞ্জিত ক’রে অশ্বারোহী বললেন, “জানি কারণ আমি আলেকজাণ্ডারের বন্ধুরূপে গ্রীক শিবিরেই ছিলুম!”

 —সুবন্ধু সচমকে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে ক্ষিপ্র হস্তে অসি কোষমুক্ত করতে উদ্যত হ’ল।

 অশ্বারোহী হাস্যমুখে শান্ত স্বরে বললেন, “সুবন্ধু, তোমার তরবারিকে অকারণে ব্যস্ত কোরো না। আমি আলেকজাণ্ডারের বন্ধু হ’তে পারি কিন্তু ভারতের শত্রু নই! আমার নাম চন্দ্রগুপ্ত, নন্দবংশে জন্ম।

 সুবন্ধু বিপুল বিস্ময়ে বললে, “মহারাজা নন্দ—”

 বাধা দিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, “ও নাম আমার সামনে উচ্চারণ কোরোনা! তুমি কি জানো না, দুরাত্মা নন্দ প্রাচীন, পবিত্র নন্দ-বংশের কেউ নয়? সে ক্ষৌরকার-পুত্র, ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের ফলে মগধের সিংহাসন লাভ করেছে?”[১]

 সুবন্ধু থতমত খেয়ে বললে, “শুনেছি, রাজকুমার! কিন্তু—”

 উত্তেজিত চন্দ্রগুপ্ত আবার তাকে বাধা দিয়ে বললেন, “হাঁ, সেই পাপিষ্ঠ আমার প্রাণদণ্ডের হুকুম দিয়েছিল—কারণ আমি আসল রাজবংশের ছেলে আর প্রজারা আমাকে ভালোবাসে। তারই জন্যে আজ আমি ভবঘুরের মতো দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি! মগধের রাজ-সিংহাসন ক্ষৌরকার-পুত্রের কবল থেকে উদ্ধার করবার জন্যে আমি গিয়েছিলুম গ্রীক দিগ্বিজয়ী আলেকজাণ্ডারের কাছে সাহায্য চাইতে।”

 সুবন্ধু ক্ষুব্ধ স্বরে বললে, “অর্থাৎ আপনি বিদেশী দস্যুকে যেচে দেশে ডেকে আনতে গিয়েছিলেন?”

 চন্দ্রগুপ্ত দুই ভুরু সঙ্কুচিত ক’রে বললেন, “সুবন্ধু, আগে আমার সব কথা শোনো, তারপর মত প্রকাশ কোরো। ভেবে দেখো, নন্দের অধীনে আছে বিশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য, দুই লক্ষ পদাতিক সৈন্য, দুই হাজার যুদ্ধরথ আর চার হাজার রণহস্তী। এদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি আমার এমন সহায় সম্পদ নেই। তাই আমি আগে গ্রীকদের সাহায্যে আমার পূর্বপুরুষদের সিংহাসন উদ্ধার করতে চেয়েছিলুম। মহাপদ্ম নন্দের যে পুত্র এখন মগধের রাজা সে বিলাসী, অত্যাচারী, কুচরিত্র। তার উপরে নীচ বংশে জন্ম ব’লে প্রজারা তাকে ঘৃণা করে। বর্তমান নন্দ-রাজা যুদ্ধ-নীতিতেও অজ্ঞ। কাজেই গ্রীকদের সঙ্গে মগধের ন্যায্য রাজা আমাকে দেখলে সমস্ত প্রজা আর সৈন্যদল আমার পক্ষই অবলম্বন করত, নন্দ যুদ্ধ করলেও জিত্‌তে পারত না। তারপর একবার সিংহাসনে বসতে পারলেই আমি আমার স্বাধীনতা ঘোষণা করতুম। তখন স্বদেশ থেকে অত দূরে— পূর্বভারতের প্রায় শেষ-প্রান্তে গিয়ে প’ড়ে, আমার বিপুল বাহিনীর সামনে গ্রীকদের কি শোচনীয় অবস্থা হ’ত, বুঝতে পারছ কি? আমি কেবল ভারতীয় যুদ্ধরীতিতে নয়, গ্রীক যুদ্ধরীতিতেও অভিজ্ঞ। গ্রীকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হ’লে আমি তাদের রীতিই গ্রহণ করতুম। আরো একটা ভাববার কথা আছে। আজ গ্রীকরা দলে ভারি বটে, কিন্তু তারা যখন কাবুল থেকে সুদূর মগধে গিয়ে পৌঁছত, তখন পথশ্রমে আর ধারাবাহিক যুদ্ধের ফলে তাদের অর্ধেকেরও বেশী সৈন্য মারা পড়ত। সে অবস্থায় ইচ্ছা থাকলেও তারা আমার স্বাধীনতায় বাধা দিতে সাহস করত না।......এখন বুঝলে সুবন্ধু, কেন আমি গ্রীক দস্যুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গিয়েছিলুম? আমি চেয়েছিলুম কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে!”

 সুবন্ধু বললে, “আপনার অসাধারণ বুদ্ধি দেখে বিস্মিত হচ্ছি। কিন্তু আলেকজাণ্ডার কি আপনাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে?”

 —“আলেকজাণ্ডার অত্যন্ত চতুর ব্যক্তি, বোধহয় আমার মনের কথা ধ’রে ফেলেছেন। গর্বিত স্বরে আমাকে বলেছেন ‘চন্দ্রগুপ্ত, আমি যখন মগধ আক্রমণ করবো, নিজের ইচ্ছাতেই করবো। তোমার সাহায্য অনাবশ্যক।’ ধূর্ত যবন ফাঁদে পা দিলে না।”

 —“এখন আপনি কোথায় চলেছেন?”

 —“মগধের রাজধানী পাটলি পুত্রে।,,

 —“পাটলিপুত্রে!”

 -“হাঁ। শত্রুর কাছে যাচ্ছি ব’লে বিস্মিত হোয়ো না। এক গুপ্তচরের মুখে খবর পেলুম, মগধের প্রজারা নন্দের অত্যাচার আর সইতে না পেরে প্রকাশ্য বিদ্রোহের জন্যে প্রস্তুত হয়েছে। তাদের পরামর্শদাতা হচ্চেন বিষ্ণুগুপ্ত (চাণক্য) নামে এক কূটনীতিতে অভিজ্ঞ শক্তিশালী ব্রাহ্মণ। বিষ্ণুগুপ্ত আমাকে বিদ্রোহীদের নেতা হবার জন্যে আহ্বান করেছেন। তাই আমি দেশে ফিরছি আর পথে যেতে যেতে সাধ্যমত সৈন্য সংগ্রহ করছি। সুবন্ধু, এই অল্প পরিচয়েই আমি বুঝেছি তুমি বীর, বুদ্ধিমান, স্পষ্টবক্তা। তোমার মতন সৈনিক লাভ করা সৌভাগ্য। তুমিও আমার সঙ্গী হবে?”

 সুবন্ধু আবার অভিবাদন ক’রে বললে, “মগধের ভবিষ্য নরপতি, আমি আপনার জয় কামনা করি। কিন্তু ক্ষমা করবেন, আপাতত মগধের গৃহযুদ্ধে যোগ দেবার অবসর আমার নেই। আমার সামনে রয়েছে এখন মহত্তর কতব্য!”

 —“কর্তব্য সুবন্ধু?

 —“গ্রীকদের আগমন-বার্তা নিয়ে আমি চলেছি দেশ জাগাতে জাগাতে মহারাজা পুরুর কাছে। সীমান্তে গ্রীকদের বাধা দেবার জন্যে মহারাজা হস্তী আলেকজাণ্ডারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, মহারাজা পুরুর কাছে তিনি সাহায্য চান।”

 চন্দ্রগুপ্ত বললেন, “তাহ’লে যাও সুবন্ধু, তুমি তোমার কর্তব্য পালন করো। কিন্তু তুমি আমার একটি ভবিষ্যদ্বাণী শুনে রাখ।”

 —“আদেশ করুন।”

 —“এই গ্রীক দিগ্বিজয়ীকে তুমি চেনো না। তিনি কেবল লক্ষাধিক সৈন্যের নেতা নন, রণনীতিতে তাঁর অসাধারণ প্রতিভা। তিনি কিছুতেই মহারাজা পুরুর সঙ্গে মহারাজ হস্তীর মিলন ঘটতে দেবেন না। মহারাজা পুরু প্রস্তুত হবার আগেই তিনি তাঁর বিরাট বাহিনী নিয়ে যেমন ক’রে পারেন মহারাজা হস্তীকে পরাস্ত করবেনই। তারপর তিনি করবেন মহারাজ পুরুর পঞ্চাশ হাজার সৈন্যকে আক্রমণ— আমি মহারাজার সৈন্যবল জানি। লক্ষাধিক গ্রীকের সামনে পঞ্চাশ হাজার ভারতবাসী কতক্ষণ দাঁড়াতে পারবে?”

 —“তাহলে আপনি কি বলেন রাজকুমার, ভারতবাসীরা নিশ্চেষ্ট ভাবে ব’সে ব’সে করুণ নেত্রে দেখবে, তাদের স্বদেশের বুকের উপর দিয়ে বিদেশী যবনদের উম্মত্ত বিজয়-যাত্রা? সে দৃশ্যটা খুব জম্‌কালো হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের মনুষ্যত্বের — আমাদের পুরুষত্বের মর্যাদা কোথায় থাকবে?

 চন্দ্রগুপ্ত বললেন, “না সুবন্ধু, আমি তা বলি না। নিশ্চেষ্টভাবে দাসত্ব-শৃঙ্খল পরার চেয়ে মানুষের বড় কলঙ্ক আর নেই। চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। আমার চোখের সামনে যদি একটা উজ্জ্বল স্বপ্ন না থাকত, তাহ’লে আমিও আজ বীরের মতন প্রাণ দেবার জন্যে মহারাজ পুরুর পাশে গিয়ে দাঁড়াতুম।”

 “—সে কী স্বপ্ন রাজকুমার?”

 সুদূর দিকচক্রবাল-রেখায় যেখানে পশ্চিম আকাশের আলোকনেত্র ধীরে ধীরে মুদ্রিত হয়ে আসছে, সেই দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে চন্দ্রগুপ্ত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপর পরিপূর্ণ দৃপ্ত স্বরে বললেন, “অখণ্ড ভারত-সাম্রাজ্যের স্বপ্ন। এই গ্রীক ঝটিকা থেকে যদি আত্মরক্ষা করতে পারো তাহ'লে তুমি দেখে নিও সুবন্ধু, মগধের সিংহাসন অধিকার করতে পারলে আমার বাহু বিস্তৃত হবে হিন্দুকুশের শিখর পর্যন্ত। মগধের অগাধ সৈন্য-সাগরের মধ্যে মুষ্টিমেয় গ্রীক দস্যুরা যাবে অতলে তলিয়ে। সমগ্র বিচ্ছিন্ন ভারতকে আমি একত্রে দাঁড় করাবো এক বিশাল রাজছত্রতলে।”

 —“আপনার উজ্জ্বল স্বপ্ন সত্য হোক্ সার্থক হোক। কিন্তু তার আগেই মহারাজা পুরু যদি গ্রীকদের পরাজিত করেন?”

 —“তাহ’লে অসম্ভবকে সম্ভবপর করেছেন ব’লে মহাবীর পুরুকে আমি অভিবাদন করবো।”

  1. প্রাচীন সংস্কৃত নাটক “মুদ্রারাক্ষসে” ও আধুনিক বাংলা নাটক “চন্দ্রগুপ্তে” প্রকাশ, চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন শূদ্র বা দাসী-পুত্র। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকরা এ মতে সায় দেন না। তাঁরা বলেন চন্দ্রগুপ্ত আসল নন্দ-বংশেরই ছেলে এবং যে-নন্দকে তিনি রাজ্যচ্যুত করেছিলেন, শূদ্রের ঔরসে জন্ম হয়েছিল তাঁরই। ইতি— লেখক।