পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৫০

উইকিসংকলন থেকে
৫০
Cambridge
সোমবার
১৯শে জানুয়ারী (১৯২০)

হেমন্ত,

 তোমার পত্র পেয়ে সুখী হইলাম। আমার মনে হয় তুমি একসঙ্গে বড় বেশী কাজ হাতে নিয়েছ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা কাজে মানুষের যথেষ্ট শক্তি ব্যয় হয়—তার উপরে দোকান এবং তার উপরে আরও কত কি! তুমি যখন বুঝিতে পারিতেছ যে শরীর দিন ২ খারাপ হচ্ছে— তখন এইরূপ আচরণের কোন কারণ থাকিতে পারে না। আমাদের দেশের জলবায়ুর দোষ যে যাহারা কোন কাজ করে না তাহারা কিছুই করে না আর যাহারা করে তাহারা বড় বেশী করিতে চেষ্টা করে এবং একদিনের ভিতরে সব কাজ করিতে গিয়া শরীর এবং সব হারাইয়া বসে। তোমার যখন পূর্ব্বেকার প্রস্তাব ছিল P. R. S.-এর জন্য চেষ্টা করা এবং তৎসঙ্গে শিক্ষকতা করা তখন বোধ হয় দোকানের ব্যাপারে হাত না দিলেই ভাল করিতে। মানুষ যদি কোন স্থায়ী কাজ করিতে বাসনা করে তাহা হইলে তাহাকে বহু বৎসর ধরিয়া সেই কাজে নিযুক্ত থাকিতে হইবে—২।১ বৎসরে তাহা সম্ভবপর নয়। অতএব তোমার যদি কোন বাসনা থাকে দেশের জন্য কোন স্থায়ী কাজ করিতে—তবে তোমার এরূপ ভাবে কাজ করা উচিত—যাহাতে বহু বৎসর ধরিয়া কাজ করিবার শক্তি থাকিবে। অবশ্য কোন দিন কাহার যাবার ডাক আসিবে কেহ বলিতে পারে না—কিন্তু তা বলে আগে থেকে গলায় ছুরি দিয়ে কোন লাভ নাই বা অতিশয় পরিশ্রম করিয়া শরীর নষ্ট করে কোন লাভ নাই। আমার লেখা বড় কড়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস তুমি আমাকে ভুল বুঝিবে না। দুঃখের বিষয় তুমি বড় বেশী কাজ হাতে নাও এবং সময়ে ২ শরীর সমর্থ না হইলেও মনের জোরের দ্বারা সম্পন্ন কর। এরূপ অবস্থা মোটেই বাঞ্ছনীয় নহে।

বুধবার, ২১শে জানুয়ারী

 তোমার পরীক্ষার বিস্তৃত খবর পেয়ে সুখী হইলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ কাজ পেয়েছ শুনে আরও আনন্দিত হইলাম। তুমি ঐ সব কাজে কৃতিত্ব লাভ করিতে পারিবে আমার বিশ্বাস—তবে আমার একমাত্র আশঙ্কা তোমার স্বাস্থ্যের জন্য।

 এ দেশের “নেটিভদের” কতগুলি গুণ আছে যার জন্য এত বড় হতে পেরেছে। প্রথমতঃ—এর ঘড়ির মত ঠিক সময়ে সব কাজ করিতে পারে, দ্বিতীয়তঃ এদের একটা robust optimism আছে—আমরা জীবনের দুঃখের বিষয় বেশী ভাবি, এরা জীবনের সুখের এবং আলোর বিষয় বেশী ভাবে। তারপর এদের strong common sense আছে—এবং নিজের জাতীয় স্বার্থ খুব ভাল বুঝে। এখন মোটের উপর দাঁড়িয়েছে আমাদের জলবায়ুর দোষ—আমাদের দেশের হাওয়াটা বদলাইতে হইবে।

 তোমার নিজের বিষয় এবং শরীরের বিষয় অযত্নের প্রধান কারণ দাঁড়িয়েছে—ঐ প্রাচ্যদেশের ঔদাসীন্য। “কি হবে শরীরের যত্ন নিয়ে, দু দিনের শরীর দু দিন পরে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে!” এরূপ ঔদাসীন্য কর্ম্মবীরের পক্ষে মোটেই বাঞ্ছনীয় নহে। তোমার একটু প্রতীচ্যের হাওয়া দরকার তবে যদি robust optimism আসে।

 বেণীবাবুকে একখানা পত্র দিয়েছি। দত্তগুপ্ত মহাশয়কে এখনও দিই নাই।

 * * *

 আমার আর বেশী কিছু বলিবার নাই। নিজ অবহেলার জন্য যদি অল্প বয়সে তোমার শরীর নষ্ট হয়—সে অপরাধ তোমারই। অনেক ঘটনার উপর মানুষের হাত থাকে না—কিন্তু তাহা ছাড়া শরীরের অযত্ন করা একটা অপরাধ—সে অপরাধ শুধু নিজের কাছে নয়—পাঁচ জনের কাছে এবং সর্ব্বোপরি দেশের কাছে। আমাদের দেশের যুবকবৃন্দের শারীরিক সামর্থ্য যদি অল্প বয়সে নষ্ট হয়—তাহা হইলে বলিতে হইবে যে তাহাদের আদর্শের ভিতরে একটা গলদ বা সঙ্কীর্ণতা রয়ে গেছে। তোমার শরীর তোমার নয়—তুমি trustee মাত্র। এইজন্য আমি এত নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করিতেছি। আমার বিশ্বাস তুমি সে trust অবহেলা করিবে না।

 আমার বিস্তৃত পত্র লেখা হয়ে উঠে নাই—বোধ হয় হয়ে উঠ্‌বে না। আমার ভুল হয়েছে যে জাহাজে মনে করেছিলাম যে বিলাতে পঁহুছিয়া সময়মত বিস্তৃত পত্র লিখিব। সে সময় আজকাল পাওয়া বড় মুস্কিল।

 এখনও বুঝিতে পারি নাই—আমি আদর্শভ্রষ্ট হয়েছি কি না। আমি আত্মপ্রতারণা করিয়া নিজেকে বুঝাইতে চাহি না যে Civil Service-এর জন্য পড়াটা ভাল। চিরকাল ঐ জিনিষটাকে ঘৃণা করিতাম—এখনও বোধ হয় করি—এ অবস্থায় Civil Service-এর জন্য চেষ্টা করা আমার দুর্ব্বলতার নিদর্শন অথবা কোন দূরবর্ত্তী মঙ্গলের সূচক তাহা ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না। আমার একমাত্র প্রার্থনা যে আমার হিতৈষীরা আমার সম্বন্ধে কোনও hasty opinion না form করেন।

 অনেক ঘটনার শেষে এসে না পৌঁছালে তার অর্থ ঠিক বুঝিতে পারা যায় না। আমার সম্বন্ধেও কি তাহা হইতে পারে না?

ইতি— 
সুভাষ