পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৭৬

উইকিসংকলন থেকে
◄  ৭৫
৭৭  ►
৭৬

পরবর্ত্তী দুই খানি পত্র বাসন্তী দেবীকে লিখিত

শ্রীচরণেষু মা,

 আজ আপনার এই ঘোর বিপদের দিনে আমরা কয়েকজন প্রবাসী কারারুদ্ধ বাঙ্গালী আপনার নিকট সান্ত্বনার বাণী প্রেরণ করিতেছি, যে বিপদ আজ আপনাকে অভিভূত করিয়াছে তদপেক্ষা মহান বিপদ কোন মহিলার জীবনে ঘটিতে পারে না। যে শোক আজ আপনার হৃদয় আচ্ছন্ন করিয়াছে, তদপেক্ষা গভীর শোক কোনও হিন্দু নারীর জীবনে কল্পনা করা যায় না, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে আপনার এই দুর্দ্দিনে আমরা আপনার এবং আপনার পরিবারবর্গের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইতে পারিলাম না। বিপদের ঘন কুজ্ঝটিকায় শোকের রুদ্ধ দুয়ার ভেদ করিয়া আমাদের হৃদয়ের বাণী যদি আপনার চরণে পৌঁছায় তাহা হইলে আমরা ধন্য হইব।

 যিনি গিয়াছেন তিনি আমাদেরও খুব আপনার জন ছিলেন। আজ আবালবৃদ্ধ-বনিতা সকল ভারতবাসীই কাঁদিতেছে—কিন্তু সব চেয়ে বেশী কাঁদিতেছে বাংলার তরুণ সম্প্রদায়।

 তাঁহার আত্মীয়-স্বজন—তাঁহার বাল্য, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ের বন্ধুরা— আজ তাঁহার জন্য কাঁদিতেছেন। সাহিত্য ও কলা জগতের মহারথীরা—এমন কি সকল ক্ষেত্রের ভাবুক সম্প্রদায়—আজ তাঁহার জন্য অশ্রুপাত করিতেছেন। অভাগা তথাকথিত অস্পৃশ্য জাতিরা আজ তাঁহার জন্য রোদন করিতেছে। যাহাদের জন্য তিনি তাঁহার সঞ্চিত ধন ও যাবতীয় বিষয়সম্পত্তি মুক্তহস্তে বিতরণ করিয়া গিয়াছেন—যাহাদের সেবার জন্য তিনি তাঁহার প্রাণ, মান, স্বাস্থ্য ও আয়ু উৎসর্গ করিয়া গিয়াছেন—সেই দেশবাসীরা আজ তাঁহার শোকে অবসন্ন। কিন্তু বাঙ্গলার যে সব তরুণ প্রাণ তাহাদের ক্ষুদ্র জীবনের যৎকিঞ্চিৎ সম্পদ উৎসর্গ করিয়া তাঁহার উদ্ধৃত পতাকার তলে সমবেত হইয়াছিল—যাহারা সুখে দুঃখে আঁধারে আলোয় তাঁহার আদেশবাণী অনুসরণ করিয়াছে—সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া যাহারা কখনও বিজয়-গৌরবে গৌরবান্বিত হইয়াছে, কখনও বা কারার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়াছে—নৈরাশ্যের রজনীতে অথবা সফলতার প্রভাতে যাহারা কখনও তাঁহার পার্শ্ব ছাড়ে নাই—যাহারা তাঁহার মধ্যে পিতা সখা ও গুরুর অপূর্ব্ব সমাবেশ পাইয়াছিল—আজ সেই সব তরুণ প্রাণের অবস্থা কি কথায় বর্ণনা করা যায়?

 দেশবন্ধু গিয়াছেন। যশোরশ্মিমণ্ডিত পূর্ণরবির ন্যায় তিনি জীবন-মধ্যাহ্নেই অস্ত গিয়াছেন। সিদ্ধিদাতার বরপুত্র তিনি বিজয়মুকুট পরিয়াই ভারতের বিশাল কর্ম্মক্ষেত্র হইতে দিব্যলোকে যাত্রা করিয়াছেন। অত্যন্ত ত্যাগের মধ্য দিয়া তিনি আজ অমৃতত্ব লাভ করিয়াছেন। কিন্তু আজ আমাদের বাহিরে তিমির, অন্তরে শূন্যতা। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল মেঘের পর মেঘ জমাট বাঁধিয়া রহিয়াছে; সে তিমির-প্রাচীরের মধ্যে আলোক প্রবেশের তিলার্দ্ধ স্থানও নাই।

 আর একদিনের কথা মনে পড়ে—যেদিন বাঙ্গলার আকাশ ঘন ঘটায় আচ্ছন্ন, বাঙ্গলার বীরকেশরী কারাগৃহে নিক্ষিপ্ত। সেদিন নৈরাশ্যের আঁধার ভেদ করিয়া এক অপূর্ব্ব মোহনীয় মূর্ত্তি বরাভয়হস্তা মহাশক্তিরূপে বাঙ্গলার কর্ম্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিল। সেদিন বাঙ্গালী আপনার স্বরূপ চিনিয়াছিল; সেদিন বাঙ্গালী আপনাকে শুধু দেশনায়িকা নয়—দেশমাতৃকার আসনে বসাইয়াছিল। সেই গৌরবের, সেই আনন্দের, সেই উন্মাদনার দিন বাঙ্গলা ভুলে নাই, ভুলিতে পারে না। সেদিন বাঙ্গালী আপনাকে যে ভক্তি শ্রদ্ধা ও মানের সিংহাসনে বসাইয়াছিল, আজও বাঙ্গালীর হৃদয়ে আপনার সেই সিংহাসন অটুট রহিয়াছে। সেদিন হইতে আপনি শুধু চিররঞ্জন মাতা নন,—আপনি বঙ্গমাতা।

 তাই বলি আমাদের এই বিপদের দিনে আপনিই আমাদের শক্তি সাহস ও সান্ত্বনা দিন, যে নিবিড় নৈরাশ্যের ঘনান্ধকারে আজ সমগ্র দেশ নিমগ্ন—যে বিষাদ ও হাহাকারে আজ সোনার বাঙ্গলা শ্মশানপ্রায়—তার মধ্যে, নূতন আলোক বিকিরণ, নব শক্তির উন্মেষ ও নূতন উৎসাহ সঞ্চার —আপনি ভিন্ন আর কে করিতে পারে? যে আহ্বানে আপনি একদিন বাঙ্গালীর শিরায় শিরায় নব জীবন সঞ্চার করিয়াছিলেন, সেই আহ্বানে আপনি আর একবার বাঙ্গালীকে জাগান। যে মন্ত্র-বলে আপনি একদিন বাঙ্গলার ঘরে ঘরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন—সেই মন্ত্র লইয়া, মহাশক্তি রূপে, আপনি আর একবার আমাদের মধ্যে অবতীর্ণ হউন। মুহূর্ত্তেব মধ্যে অবসাদ ঘুচিবে— প্রাণে নূতন প্রেরণা, নূতন উদ্যম, নূতন উৎসাহ আসিবে—আশার অরুণ রাগে রঞ্জিত হইয়া দশদিক আবার সুখে হাসিয়া উঠিবে। বাঙ্গলার সকল তরুণ-প্রাণ আপনার চরণে ভক্তির অর্ঘ্য অর্পণ করিবে, আপনার আশীষ লভিয়া কর্ম্মক্ষেত্রে জয়যুক্ত হইবে এবং অর্জ্জিত জয়মাল্য আপনাকে ভূষিত করিয়া গাহিবে “বন্দে মাতরম্‌”।

ম্যাণ্ডেরলে সেণ্ট্রাল জেল
ইং ৬৷৭৷২৫

ইতি— আপনাব সেবকবৃন্দ
শ্রীসতে দ্রচন্দ্র মিত্র
শ্রীবিপিনবিহারী গাঙ্গুলী
শ্রীজ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ
শ্রীজীবনলাল চট্টোপাধ্যায়
শ্রীমদনমোহন ভৌমিক
শ্রীসুরেন্দ্রমোহন ঘোষ
শ্রীসতীশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী
শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু
শ্রীহবিকুমার চক্রবত্তী

To::Mrs. C. R. Das::148, Russa Road South::Calcutta