পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
◄  ৮৮
৯০  ►
৮৯
মান্দালয় জেল

 আপনি বোধ হয় ইতিপূর্ব্বে শুনিয়াছেন যে, আমাদের অনশনব্রত একেবারে নিরর্থক বা নিষ্ফল হয় নাই। গভর্নমেণ্ট আমাদের ধর্ম্ম বিষয়ে দাবী স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছেন এবং অতঃপর বাঙ্গলা দেশের রাজবন্দী পূজার খরচ বাবদ বাৎসরিক ত্রিশ টাকা allowance পাইবেন। ত্রিশ টাকা অতি সামান্য এবং ইহা দ্বারা আমাদের খরচ কুলাইবে না। তবে যে Principle গভর্ণমেণ্ট এতদিন স্বীকার করিতে চান নাই তাহা যে এখন স্বীকার করিয়াছেন, ইহাই আমাদের সব চেয়ে বড় লাভ—টাকার কথা সর্ব্বক্ষেত্রে সর্ব্বকালে অতি তুচ্ছ কথা। পূজার দাবী ছাড়া আমাদের অন্যান্য অনেকগুলি দাবীও গভর্ণমেণ্ট পূরণ করিয়াছেন। বৈষ্ণবের ভাষায় কিন্তু বলিতে গেলে আমাকে বলিতে হইবে “এহ বাহ্য”। অর্থাৎ অনশন-ব্রতের সব চেয়ে বড় লাভ, অন্তরের বিকাশ ও আনন্দ লাভ—দাবী পূরণের কথা বাহিরের কথা, লৌকিক জগতের কথা। Suffering ব্যতীত মানুষ কখনও নিজের অন্তরের আদর্শের সহিত অভিন্নতা বোধ করিতে পারে না এবং পরীক্ষার মধ্যে না পড়িলে মানুষ কখনও স্থির নিশ্চিন্তভাবে বলিতে পারে না, তাহার অন্তরে কত অপার শক্তি আছে। এই অভিজ্ঞতার ফলে আমি নিজেকে এখন আরও ভালভাবে চিনিতে পারিয়াছি এবং নিজের উপর আমার বিশ্বাস শতগুণে বাড়িয়াছে।

 * * *

 Social Service এর ভিতর দিয়া গৃহ-শিল্প প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আমাদিগকে করিতে হইবে। Commercial Museum, Bengal Home Industries Association প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান বা দোকান ঘুরিয়া দেখিলে আমাদের মনে নূতন ভাব আসিতে পারে। বাঙ্গলা গভর্ণমেণ্টের শিল্প-বিভাগের বাৎসরিক বিবরণী (Administration Report of the Department of Home Industries) কয়েক বৎসর পাঠ করিলেও উপকার হইতে পারে। সর্ব্বোপরি যেখানে গৃহশিল্প চলিতেছে সেখানে গিয়া স্বচক্ষে কার্য্যপ্রণালী দেখা ও শিক্ষা করা প্রয়োজন। কুটীর-শিল্প চালাইতে হইলে যে খুব বেশী টাকার প্রয়োজন হইবে তাহা আমার মনে হয় না। সর্ব্বপ্রথমে আমাদের দরকার সভ্যদের মধ্যে অন্ততঃ একজন ভদ্রলোক পাওয়া। যিনি শুধু এই বিষয়ে চিন্তা করিবেন, খবর লইবেন এবং পুস্তকাদি পড়িবেন। তারপর যে সব কুটীর-শিল্প চালাইবার কিছু সম্ভাবনা আছে, তিনি সেগুলি নিজে দেখিয়া আসিবেন। যখন শেষে কুটীর-শিল্প বিশেষ চালাইবার প্রস্তাব স্থির হইবে তখন কর্ম্মীকে পাঠাইয়া কাজ শিখাইয়া লইতে হইবে। Polytechnic Institute-এ আগাগোড়া কাহাকেও পড়াইবার প্রয়োজন দেখি না। Electroplating প্রভৃতি শিল্প সেখানে শিখিবার কোন প্রয়োজন আমি দেখি না। কারণ সেলাই-এর বিভাগ আমাদের নিজেদেরই আছে এবং কামারের কাজ অথবা Electroplating-এর কাজ আপাততঃ সমিতির কর্ম্মীকে শিখাইয়া কোনও লাভ হইবে না। আমার যতদূর স্মরণ আছে (আমি মাত্র একবার Polytechnic-এ গিয়াছি) Polytechnic-এর সমস্ত শিল্পের মধ্যে একমাত্র বেতের কাজ অথবা মাটীর পুতুলের কাজ আমরা কুটীর-শিল্প হিসাবে চালাইতে পারি—ইহার মধ্যেও আমি বেতের কাজ সম্বন্ধে কতকটা সন্দিহান, কারণ স্ত্রীলোকদের দ্বারা এ কাজ আমরা করাইতে পারিব কিনা ঠিক বলিতে পারি না। এখন যদি শেষে মাটির পুতুলের কাজ চালাইবার প্রস্তাব গৃহীত হয়, তবে যে-কোনও কর্ম্মী কয়েকদিনের মধ্যেই এ কাজ শিখিয়া আসিতে পারে। খরচ কিছুই লাগিবে না এবং আমরা যখন কুটীর-শিল্প আরম্ভ করিব তখন মাত্র রং-এর জন্য কিছু নগদ টাকা খরচ হইবে। ইহা ব্যতীত আর খুব কম খরচই লাগিবে। মোট কথা, একজনকে শুধু এই সমস্যা লইয়া পড়িয়া থাকিতে হইবে —He must become mad over it.

 আর একটা কথা আমার বার বার মনে আসে—পূর্ব্বেও বোধ হয় এ বিষয়ে লিখিয়াছি—ঝিনুকের বোতাম তৈরী করা। ঢাকা জেলার অনেক গ্রামে এই শিল্প ঘরে ঘরে চলিতেছে। গরীব গৃহস্থের বাড়ীর স্ত্রী-পুরুষেরা তাহাদের অবসর সময়ে এই কাজ করিয়া থাকে। একজন কর্ম্মীকে খুব অল্প দিনের মধ্যে এই কাজ শিখান যাইতে পারে। অথবা এই কাজ জানে এবং শিখাইতে পারে এমন একজন নূতন কর্ম্মীকে আপনার নিযুক্ত করািতে পারেন।

 খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়া আপনারা এরূপ কর্ম্মীকে আকর্ষণ করিতে পারেন। আমার নিজের মনে হয় যে, পাথরেব গায়ে ঘসিয়া বোতাম তৈরী করা যায়—আমরা নিজেরা ইচ্ছ করিলে তৈয়ার করিতে পারি। শুধু সরু যন্ত্র একটা থাকিলে গর্ত্ত করা যায় এবং হয় তো গোল করিয়া কাটিবার জন্য একটা ধারাল যন্ত্রের প্রয়োজন হইতে পারে। সমিতি হইতে কয়েকটা যন্ত্র এবং এক বস্তা ঝিনুক আনাইয়া দিলে কাজ আরম্ভ করিতে পারিবেন। কাজটা সাহায্য-প্রার্থীদের মধ্যে আবদ্ধ হইবে কিন্তু একবার কৃতকার্য্য হইলে দেখিবেন যে, সাধারণ গরীব গৃহস্থেরা নিজেদের আয় বাড়াইবার জন্য এই কাজ আরম্ভ করিবে। সমিতি শুধু সস্তা দরে raw materials প্রভৃতি জোগাইবে এবং প্রস্তুত জিনিষ বেশী দরে বিক্রয় করিবার ব্যবস্থা করিবে। এই বিষয়ে কাজ আরম্ভ করিতে হইলে প্রথম দিকটা খুব বেশী সময় দিতে হইবে। ইতি—