পথের দাবী/১

উইকিসংকলন থেকে

 অপূর্ব্বর সঙ্গে তাহার বন্ধুদের নিম্নলিখিত প্রথায় প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক হইত।

 বন্ধুরা কহিতেন, অপু, তোমার দাদারা প্রায় কিছুই মানেন না; আর তুমি মানো না শোনো না সংসারে এমন ব্যাপারই নেই।

 অপূর্ব্ব কহিত, আছে বই কি। এই যেমন দাদাদের দৃষ্টান্ত মানিনে এবং তোমাদের পরামর্শ শুনিনে।

 বন্ধুরা পুরানো রসিকতার পুনরাবৃত্তি করিয়া বলিতেন, তুমি কলেজে পড়িয়া এম. এস্‌সি. পাস করিলে, কিন্তু তবু এখনও টিকি রাখিতেছ। তোমার টিকির মিডিয়ম দিয়া মগজে বিদ্যুৎ চলাচল হয় নাকি?

 অপূর্ব্ব জবাব দিত, এম. এস্‌সি.-র পাঠ্যপুস্তকে টিকির বিরুদ্ধে কোথাও কোন আন্দোলন নেই। সুতরাং টিকি রাখা অন্যায় এ ধারণা জন্মাতে পারেনি। আর বিদ্যুৎ চলাচলের সমস্ত ইতিহাসটা আজিও আবিষ্কৃত হয়নি। বিশ্বাস না হয়, বিদ্যুৎ-বিদ্যা অধ্যাপকদের বরঞ্চ জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিও।

 তাঁহারা বিরক্ত হইয়া কহিতেন, তোমার সঙ্গে তর্ক করা বৃথা।

 অপূর্ব্ব হাসিয়া বলিত, তোমাদের এই কথাটি অভ্রান্ত সত্য, কিন্তু তবু ত তোমাদের চৈতন্য হয় না।

 আসল কথা, অপূর্বর ডেপুটী-ম্যাজিস্ট্রেট পিতার বাক্যে ও ব্যবহারে উৎসাহ পাইয়া তাহার বড় ও মেজদাদারা যখন প্রকাশ্যেই মুরগি ও হোটেলের রুটী খাইতে লাগিল এবং স্নানের পূর্ব্বে গলার পৈতাটাকে পেরেকে টাঙ্গাইয়া রাখিয়া প্রায়ই ভুলিয়া যাইতে লাগিল, এমন কি ধোপার বাড়ি দিয়া কাচাইয়া ইস্ত্রি করিয়া আনিলে সুবিধা হয় কিনা আলোচনা করিয়া হাসি-তামাশা করিতে লাগিল, তখনও অপূর্বর নিজের পৈতা হয় নাই। কিন্তু ছোট হইলেও সে মায়ের গভীর বেদনা ও নিঃশব্দ অশ্রুপাত বহুদিন লক্ষ্য করিয়াছিল। মা কিছুই বলিতেন না। একে ত বলিলেও ছেলেরা শুনিত না, অধিকন্তু স্বামীর সহিত নিরর্থক কলহ হইয়া যাইত। তিনি শ্বশুরকুলের পৌরোহিত্য ব্যবসাকে নিষ্ঠুর ইঙ্গিত করিয়া কহিতেন, ছেলেরা যদি তাদের মামাদের মত না হয়ে বাপের মতই হয়ে উঠে ত কি করা যাবে! মাথায় টিকির বদলে টুপি পরে বলেই যে মাথাটা কেটে নেওয়া উচিত আমার তা মনে হয় না।

 সেই অবধি করুণাময়ী ছেলেদের সম্বন্ধে একেবারে নির্ব্বাক হইয়া গিয়াছিলেন, কেবল নিজের আচার-বিচার নিজেই নীরবে ও অনাড়ম্বরে পালন করিয়া চলিতেন। তাহার পরে স্বামীর মৃত্যুতে বিধবা হইয়া তিনি গৃহে বাস করিয়াও একপ্রকার গৃহ হইতে স্বতন্ত্র হইয়া গিয়াছিলেন। উপরের যে ঘরটায় তিনি থাকিতেন, তাহারই পার্শ্বের বারান্দায় খানিকটা ঘিরিয়া লইয়া তাঁহার ভাঁড়ার ও স্বহস্তে রান্নার কাজ চলিত। বধূদের হাতেও তিনি খাইতে চাহিতেন না। এমনি ভাবেই দিন চলিতেছিল।

 এদিকে অপূর্ব্ব মাথায় টিকি রাখিয়াছিল, কলেজে জলপানি ও মেডেল লইয়া যেমন সে পাসও করিত, ঘরে একাদশী-পূর্ণিমা-সন্ধ্যাহ্নিকও তেমনি বাদ দিত না। মাঠে ফুটবল-ক্রিকেট-হকি খেলাতেও তাহার যত উৎসাহ ছিল, সকালে মায়ের সঙ্গে গঙ্গাস্নানে যাইতেও তাহার কোনদিন সময়াভাব ঘটিত না। বাড়াবাড়ি ভাবিয়া বধূরা মাঝে মাঝে তামাশা করিয়া বলিত, ঠাকুরপো, পড়াশুনা ত সাঙ্গ হল, এবার ডোর-কোপ্‌নি নিয়ে একটা রীতিমত গোঁসাই-টোঁসাই হয়ে পড়। এযে দেখচি বামুনের বিধবাকেও ছাড়িয়ে গেলে!

 অপূর্ব্ব সহাস্যে জবাব দিত, ছাড়িয়ে যেতে কি আর সাধে হয় বৌদি? মায়ের একটা মেয়ে-টেয়েও নেই, বয়স হয়েছে, হঠাৎ অসমর্থ হয়ে পড়লে একমুঠো হবিষ্যি রেঁধেও ত দিতে পারবো? আর ডোর-কোপ্‌নি যাবে কোথা? তোমাদের সংসারে যখন আছি, তখন একদিন তা সম্বল করতেই হবে।

 বড়বধূ মুখখানি ম্লান করিয়া কহিত, কি করবো ঠাকুরপো, সে আমাদের কপাল!

 তা বটে! বলিয়া অপূর্ব্ব চলিয়া যাইত, কিন্তু মাকে গিয়া কহিত, মা, এ তোমার বড় অন্যায়। দাদারা যাই কেননা করুন, বৌদিরা কিছু আর মুরগিও খান না, হোটেলেও ডিনার করেন না, চিরকালটা কি তুমি রেঁধেই খাবে?

 মা কহিতেন, একবেলা একমুঠো চাল ফুটিয়ে নিতে ত আমার কোন কষ্টই হয় না বাবা। আর নিতান্তই যখন অপারগ হব, ততদিনে তোর বৌও ঘরে এসে পড়বে।

 অপূর্ব্ব বলিত, তাই কেন না একটা বামুন-পণ্ডিতের ঘর থেকে আনিয়ে নাও না মা? খেতে দেবার সামর্থ্য আমার নেই, কিন্তু তোমার কষ্ট দেখলে মনে হয় দাদাদের গলগ্রহ হয়েই না হয় থাকবো।

 মা মাতৃগর্ব্বে দুই চক্ষু দীপ্ত করিয়া কহিতেন, অমন কথা তুই মুখেও আনিসনে অপূ! তোর সামর্থ্য নেই একটা বৌকে খেতে দেবার? তুই ইচ্ছে করলে যে বাড়ির সবাইকে বসে খাওয়াতে পারিস।

 তোমার যেমন কথা মা! তুমি মনে কর ভূ-ভারতে তোমার মত এমন ছেলে আর কারও নেই। এই বলিয়া সে উদ্গত অশ্রু গোপন করিয়া তাড়াতাড়ি সরিয়া পড়িত।

 কিন্তু নিজের শক্তি-সামর্থ্য সম্বন্ধে অপূর্ব্ব যাহাই বলুক, তাই বলিয়া কন্যাভার-গ্রস্তের দল নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। তাঁহারা দলে দলে আসিয়া বিনোদবাবুকে স্থানে-অস্থানে আক্রমণ করিয়া জীবন তাঁহার দুর্ভর করিয়া তুলিয়াছিলেন। বিনোদ আসিয়া মাকে ধরিতেন, মা, কোথায় কোন নিষ্ঠে-কিষ্ঠে জপ-তপের মেয়ে আছে তোমার ছেলের বিয়ে দিয়ে চুকিয়ে ফেল, না হয় আমাকে দেখচি বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়। বাপের বড় ছেলে,—বাইরে থেকে লোকে ভাবে আমিই বুঝি বা বাড়ির কর্ত্তা।

 ছেলের কঠিন বাক্যে করুণাময়ী মনে মনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইতেন, কিন্তু এইখানে তিনি আপনাকে কিছুতেই বিচলিত হইতে দিতেন না। মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে কহিতেন, লোকে ত মিথ্যে ভাবে না বাবা, তাঁর অবর্তমানে তুমিই বাড়ির কর্তা, কিন্তু অপূর সম্বন্ধে তুমি কাউকে কোন কথা দিয়ো না। আমি রূপ চাইনে, টাকাকড়ি চাইনে,—না বিনু, সে আমি আপনি দেখেশুনে তবে দেব।

 বেশ ত মা, তাই দিয়ো। কিন্তু যা করবে দয়া করে একটু শীঘ্র করে কর। রাঙা মাকাল-ফল সামনে ঝুলিয়ে রেখে লোকগুলোকে আর দগ্ধে মেরো না। এই বলিয়া বিনোদ রাগ করিয়া যাইতেন।

 করুণাময়ীর মনে মনে একটা সঙ্কল্প ছিল। স্নানের ঘাটে ভারী একটি সুলক্ষণা মেয়ে কিছুদিন হইতে তাঁহার চোখে পড়িয়াছিল। মেয়েটি মায়ের সহিত প্রায়ই গঙ্গাস্নানে আসিত। ইঁহারা যে তাঁহাদের স্ব-ঘর এ সংবাদ তিনি গোপনে সংগ্রহ করিয়াছিলেন। স্নানান্তে মেয়েটি শিবপূজা করিত, কোথাও কিছু ভুল হয় কি না, করুণাময়ী অলক্ষ্যে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেন। তাঁহার আরও কিছু কিছু জানিবার ছিল, এবং সে পক্ষে তিনি নিশ্চেষ্টও ছিলেন না। তাঁহার বাসনা ছিল সমস্ত তথ্য যদি অনুকূল হয় ত আগামী বৈশাখেই ছেলের বিবাহ দিবেন।

 এমন সময় অপূর্ব্ব আসিয়া অকস্মাৎ সংবাদ দিল, মা, আমি বেশ একটি চাকরি পেয়ে গেছি।

 মা খুশী হইয়া কহিলেন, বলিস কি রে? এই ত সেদিন পাস করলি, এরই মধ্যে তোকে চাকরি দিলে কে?

 অপূর্ব্ব হাসিমুখে কহিল, যার গরজ! এই বলিয়া সে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিয়া কহিল, কহিল, তাহাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সাহেবই ইহা যোগাড় করিয়া দিয়াছেন! বোথা কোম্পানি বর্ম্মার রেঙ্গুন সহরে একটা নূতন অফিস খুলিয়াছে, তাহারা বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও সচ্চরিত্র কোন বাঙালী যুবককে সমস্ত কর্তৃত্ব ভার দিয়া পাঠাইতে চায়। বাসা ভাড়া ছাড়া মাহিনা আপাততঃ চারিশত টাকা, এবং চেষ্টা করিয়াও কোম্পানীকে যদি লাল বাতি জ্বালাইতে না পারা যায় ত ছয় মাস পরে আরও দুইশত। এই বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।

 কিন্তু বর্ম্মা মুল্লুকের নাম শুনিয়া মায়ের মুখ মলিন হইয়া গেল, তিনি নিরুৎসুককণ্ঠে কহিলেন, তুই কি ক্ষেপেচিস অপু, সে দেশে কি মানুষ যায়! যেখানে জাত, জন্ম, আচার-বিচার কিছুই নেই শুনেচি, সেখানে তোকে দেব আমি পাঠিয়ে? এমন টাকায় আমার কাজ নেই।

 জননীর বিরুদ্ধতায় অপূর্ব্ব ভীত হইয়া কহিল, তোমার কাজ নেই, কিন্তু আমার ত আছে মা। তবে তোমার হুকুমে আমি ভিখিরী হয়ে থাকতে পারি, কিন্তু সারাজীবনে কি এমন সুযোগ আর জুটবে? তোমার ছেলের মত বিদ্যে-বুদ্ধি আজকাল সহরের ঘরে ঘরে আছে, অতএব বোথা কোম্পানীর আটকাবে না, কিন্তু প্রিলিপ্যাল সাহেব যে আমার হয়ে একেবারে কথা দিয়ে দিয়েচেন, তাঁর লজ্জার অবধি থাকবে না। তা ছাড়া বাড়ির সত্যকার অবস্থাও ত তোমার অজানা নয় মা।

 মা বলিলেন, কিন্তু সেটা যে শুনেছি একেবারে ম্লেচ্ছ দেশ!

 অপূর্ব্ব কহিল, কে তোমাকে বাড়িয়ে বলেচে। কিন্তু এটা ত তোমার ম্লেচ্ছ দেশ নয়, অথচ যারা হতে চায় তাদের ত বাধে না মা।

 মা ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া কহিলেন, কিন্তু এই বৈশাখে যে তোর বিয়ে দেব আমি স্থির করেচি।

 অপূর্ব্ব কহিল, একেবারে স্থির করে বসে আছ মা? বেশ ত, দু-একমাস পেছিয়ে দিয়ে যেদিন তুমি ডেকে পাঠাবে সেই দিনই ফিরে এসে তোমার আজ্ঞা পালন করব।

 করুণাময়ী বাহিরের চক্ষে সেকেলে হইলেও অতিশয় বুদ্ধিমতী। তিনি অনেকক্ষণ নীরবে চিন্তা করিয়া অবশেষে ধীরে ধীরে কহিলেন, যখন যেতেই হবে তখন আর উপায় কি। কিন্তু তোমার দাদাদের মত নিয়ো।

 এই বর্ম্মাযাত্রা সম্পর্কে তাঁহার আর দুটি সন্তানের উল্লেখ করিতে করুণাময়ীর অতীত ও বর্ত্তমানের সমস্ত প্রচ্ছন্ন বেদনা যেন এককালে আলোড়িত হইয়া উঠিল; কিন্তু সে দুঃখ আর তিনি প্রকাশ পাইতে দিলেন না। তাঁহার পিতৃকুল গোকুলদীঘির সুবিখ্যাত বন্দ্যোপাধ্যায় বংশ এবং বংশ-পরম্পরায় তাঁহারা অতিশয় আচারপরায়ণ ও নিষ্ঠাবান হিন্দু। শিশুকাল হইতে যে-সংস্কার তাঁহার হৃদয়ে বদ্ধমূল হইয়াছিল, উত্তরকালে তাহা স্বামী ও পুত্রদের হস্তে যতদূর আহত ও লাঞ্ছিত হইবার হইয়াছে, কেবল এই অপূর্ব্বকে লইয়াই তিনি কোনমতে সহ্য করিয়া আজও গৃহে বাস করিতেছিলেন, সে ছেলেও আজ তাঁহার চোখের আড়ালে কোন অজানা দেশে চলিয়াছে। এ কথা স্মরণ করিয়া তাঁহার ভয় ও ভাবনার সীমা রহিল না; শুধু মুখে বলিলেন, যে ক’টা দিন বেঁচে আছি অপু, তুই কিন্তু আর আমাকে দুঃখ দিসনে বাবা। এই বলিয়া তিনি আঁচল দিয়া চোখ দুটি মুছিয়া ফেলিলেন।

 অপূর্ব্বর নিজের চোখ সজল হইয়া উঠিল; সে প্রত্যুত্তরে কেবল কহিল, মা, আজ তুমি ইহালোকে আছ কিন্তু একদিন স্বর্গ-বাসের ডাক এসে পৌঁছবে, সেদিন তোমার অপুকে ফেলে যেতে হবে জানি, কিন্তু, একটাদিনের জন্যেও যদি তোমাকে চিনতে পেরে থাকি মা, তা হলে সেখানে বসেও কখনো এ ছেলের জন্যে তোমাকে চোখের জল ফেলতে হবে না। এই বলিয়া সে দ্রুতবেগে অন্যত্র প্রস্থান করিল।

 সেদিন সন্ধ্যাকালে করুণাময়ী তাঁহার নিয়মিত আহ্নিক ও মালায় মনঃসংযোগ করিতে পারিলেন না, উদ্বেগ ও বেদনার ভারে তাঁহায় দুই চক্ষু পুনঃ পুনঃ অশ্রু আবিল হইয়া উঠিতে লাগিল, এবং কি করিলে যে কি হয় তাহা কোনমতেই ভাবিয়া না পাইয়া অবশেষে তাঁহার বড়ছেলের ঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া নিঃশব্দে দাঁড়াইলেন। বিনোদকুমার কাছারি হইতে ফিরিয়া জলযোগান্তে এইবার সান্ধ্য পোষাকে ক্লাবের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিতেছিলেন, হঠাৎ মাকে দেখিয়া একেবারে চমকিয়া গেলেন। বস্তুতঃ এ ঘটনা এমনি অপ্রত্যাশিত যে সহসা তাঁহার মুখে কথা যোগাইল না।

 করুণাময়ী কহিলেন, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে এসেছি বিনু।

 কি মা?

 মা তাঁহার চোখের জল এখানে আসিবার পূর্ব্বে ভাল করিয়াই মুছিয়া আসিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহায় আর্দ্রকণ্ঠ গোপন রহিল না। তিনি আনুপূর্ব্বিক সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করিয়া শেষে অপূর্ব্বর মাসিক বেতনের পরিমাণ উল্লেখ করিয়াও যখন নিরানন্দমুখে কহিলেন, তাই ভাবচি বাবা, এই ক’টা টাকার লোভে তাকে সেখানে পাঠাব কি না, তখন বিনোদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটিল। সে রুক্ষ-স্বরে কহিল, মা, তোমার অপূর্ব্বর মত ছেলে ভূ-ভারতে আর দ্বিতীয় নেই সে আমরা সবাই মানি, কিন্তু পৃথিবীতে বাস করে এ-কথাটাও ত না মেনে নিতে পারিনে যে, প্রথমে চার-শ এবং ছ’মাসে ছ’শ টাকা সে ছেলের চেয়েও অনেক বড়।

 মা ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিলেন, কিন্তু, সে যে শুনেচি একবারে ম্লেচ্ছ দেশ।

 বিনোদ কহিল, মা, জগতে তোমার শোনা এবং জানাটাই কেবল অভ্রান্ত না হতে পারে।

 ছেলের শেষ কথায় মা অত্যন্ত পীড়া অনুভব করিয়া কহিলেন, বাবা বিনু, এই একই কথা তোমাদের জ্ঞান হওয়া পর্য্যন্ত শুনে শুনেও যখন আমার চৈতন্য হ’লো না, তখন শেষ দশায় আর ও-শিক্ষা দিয়ো না। অপুর্ব্বর দাম কত টাকা সে আমি জানতে আসিনি, আমি শুধু জানতে এসেছিলাম অতদূরে তাকে পাঠান উচিত কি-না।

 বিনোদ হেঁট হইয়া ডান হাতে তাড়াতাড়ি মায়ের পা স্পর্শ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, মা, তোমাকে দুঃখ দেবার জন্য এ-কথা আমি বলিনি। বাবার সঙ্গেই আমাদের মিলত সে সত্যি, এবং টাকা জিনিসটা সংসারে দামী ও দরকারী এ তাঁর কাছেই শেখা। কিন্তু এক্ষেত্রে সে লোভ তোমাকে আমি দেখাচ্চিনে। তোমার ম্লেচ্ছ বিনুর এই হ্যাট-কোটের ভেতরটা হয়ত আজও ততবড় সাহেব হয়ে ওঠেনি যে, ছোট ভাইকে খেতে দেবার ভয়ে স্থান-অস্থানের বিচার করে না। তবুও বলি ও যাক। দেশে আবহাওয়া যা বইতে শুরু করেচে মা, তাতে ও যদি দিন কতক দেশ ছেড়ে কোথাও গিয়ে কাজে লেগে যেতে পারে ত ওর নিজেরও ভাল হবে, আর আমরাও সগোষ্ঠী হয়ত বেঁচে যাব। তুমি ত জানো মা, সেই স্বদেশী আমলে ওর গাল টিপলে দুধ বেরোত, তবু তারই বিক্রমে বাবার চাকরি যাবার জো হয়েছিল।

 করুণাময়ী শঙ্কিত হইয়া কহিলেন, না না, সে সব অপু আর করে না! সাত-আট বছর আগে তার কি বা বয়স ছিল, কেবল দলে মিশেই যা—

 বিনোদ মাথা নাড়িয়া একটু হাসিয়া কহিল, হয়ত তোমার কথাই ঠিক, অপূর্ব্ব এখন আর কিছু করে না; কিন্তু সকল দেশেই জনকতক লোক থাকে মা, যাদের জাতই আলাদা,—তোমার ছোট ছেলেটি সেই জাতের। দেশের মাটি এদের গায়ের মাংস, দেশের জল এদের শিরার রক্ত; শুধু কি কেবল দেশের হাওয়া-আলো—এর পাহাড়-পর্ব্বত বন-জঙ্গল, চন্দ্র-সূর্য্য, নদী-নালা যেখানে যা কিছু আছে সব যেন সর্ব্বাঙ্গ দিয়ে এরা শুষে নিতে চায়। বোধ হয় এদেরই কেউ কোন সত্যকালে জননী জন্মভূমি কথাটা প্রথম আবিষ্কার করেছিল। দেশের সম্পর্কে এদের কখনো বিশ্বাস করো না মা, ঠকবে। এদের বেঁচে থাকা আর প্রাণ দেওয়ার মধ্যে এই এতটুকু মাত্র প্রভেদ! এই বলিয়া সে তাহার তর্জ্জনীর প্রান্ত-ভাগটুকু বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা চিহ্নিত করিয়া দেখাইয়া কহিল, বরঞ্চ তোমার এই ম্লেচ্ছাচারী বিনুটিকে তোমার ওই টিকিধারী গীতা পড়া এম. এসসি. পাশ করা অপূর্ব্বকুমারের চেয়ে ঢের বেশী আপনার বলে জেনো।

 ছেলের কথাগুলি মা ঠিক যে বিশ্বাস করিলেন তাহা নয়, কিন্তু একসময়ে নাকি এই লইয়া তাঁহাকে অনেক উদ্বেগ ভোগ করিতে হইয়াছে, তাই মনে মনে চিন্তিত হইলেন। দেশের পশ্চিম দিগন্তে যে একটা মেঘের লক্ষণ দেখা দিয়াছে এ সংবাদ তিনি জানিতেন। তাঁহার প্রথমেই মনে হইল তখন অপূর্ব্বর পিতা জীবিত ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি পরলোকগত।

 বিনোদ মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বুঝিল, কিন্তু তাহার বাহিরে যাইবার ত্বরা ছিল, কহিল, বেশ ত মা, সে তো আর কালই যাচ্ছে না, সবাই একসঙ্গে বসে যা হোক একটা স্থির করা যাবে। এই বলিয়া সে একটু দ্রুতপদেই বাহির হইয়া গেল।