পথের পাঁচালী/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ও পাড়ার দাসীঠাকরুন আসিয়া হাসিমুখে বলিল—পয়সা দুটোর জন্যি এয়েছিলাম বৌ, ইন্দির পিসি কাল আমার কাছ থেকে একটা নোনা নিয়ে এল, বল্লে, কাল দাম গিয়ে চেয়ে নিয়ে এস—
সর্ব্বজয়া ঘরের কাজকর্ম করিতেছিল, অবাক্ হইয়া বলিল—নোনা কিনে এনেছে তোমার কাছ থেকে?
দাসীঠাক্রুন ঘোর ব্যবসাদার মানুষ। সামান্য তেঁতুল আমড়া হইতে একগাছি শাক পর্যন্ত পয়সা না লইয়া কাহাকেও দেয় না। দাসীর অমায়িক ভাব অন্তহিত হইয়া গেল। বলিল—এনেচে কিনা জিজ্ঞেস্ করো না তোমার ননদকে? সকালবেলা কি মিথ্যে বল্তে এলাম দুটো পয়সার জন্যি? চার পয়সার কমে আমি দেবো না—বল্লে বুড়োমানুষ খাবার ইচ্ছে হয়েছে—তা যাক্ দুপয়সাতেই—
রাগে সর্ব্বজয়ার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। নোনার মতো ফল যাহা কিনা এত অপর্য্যাপ্ত বনে জঙ্গলে ফলে যে গরু বাছুরের পর্যন্ত খাইয়া অরুচি ধরিয়া যায়, তাহা আবার পয়সা দিয়া কিনিয়া খাইবার লোক যে পাড়াগাঁয়ে আছে, তাহা সর্ব্বজয়ার ধারণায় আসে না।
ঠিক এই সময় ইন্দির বুড়ী কোথা হইতে আসিয়া উপস্থিত হইল। সর্ব্বজয়া তাহার উপর যেন ঝাঁপাইয়া পড়িয়া বলিল—বলি হ্যাঁগা, তিন কাল গিয়েচে, এককালে তো ঠেকেচ, যার ব'সে খাই তার পয়সায় তো একটু দুখ দরদ করে চল্তে হয়? নোনা গিয়েচ কিন্তে? কোথা থেকে তোমায় বসিয়ে আজ নোনা কাল দানা খাওয়াব? সখের পয়সা নিজে থেকে নিয়ে দাওগে যাও, পরের ওপর দিয়ে সখ করতে লজা হয় না?
বুড়ীর মুখ শুকাইয়া গিয়াছিল, তবুও একটুখানি হাসি আনিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—তা দে বৌ—পাকা নোনাডা, তা ভাবলাম নিই খেয়ে, কড়া দিনই বা বাঁচবো? তা দিয়ে দে দুটো পয়সা—
সর্ব্বজয়া চতুগুণ চীৎকার করিয়া বলিল—বড় পয়সা সস্তা দেখেচ কিনা? নিজের ঘটি-বাটি আছে, বিক্রি করে নিয়ে দাও গিয়ে পয়সা—পরে সে ঘড়া লইয়া খিড়কি দুয়ার দিয়া ঘাটের পথে বাহির হইয়া গেল। দাসী খানিকটা দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল—আমার নাকে খৎ, কানে খৎ, জিনিস বেচে এমন হয়রান তো কখনও হইনি! তোমায়ও বলি ইন্দির পিসি, নিজের পয়সাই যদি না ছিল তবে তোমার কাল নোনাটা আনা ভালো হয়নি বাপু, ও রকম ধারে জিনিসপত্তর আর এনো না। তা তোমাদের ঝগড়া তোমরা কর, আমি গরিব লোক, ও বেলা আস্বো, আমার পয়সা দুটো বাপু ফেলে দিও—
দাসীর পিছু পিছু খুকী বাড়ীর বাহিরের উঠান পর্য্যন্ত আসিল। বলিতে বলিতে আসিল—পিসিমা বুড়ো মানুষ, একটা নোনা এনেচে, তা বুঝি বকে? খেতে ইচ্ছে হয় না, হ্যাঁ দাসীপিসি? বেশ নোনা, আমায় আধখানা কাল দিয়েছে—তোমার বাড়ী বুঝি গাছ আছে পিসি?—পরে সে ডাকিয়া কহিল—শোনো না দাসীপিসি, আমি একটা পয়সা দেবো এখন, পুতুলের বাক্সে আছে, মা ঘরে চাবি দিয়ে ঘাটে গেল, এলে নুকিয়ে দেবো এখন, মাকে বোলো না যেন পিসি।
দুপুরের কিছু পূর্ব্বে ইন্দির বুড়ী বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যাইতেছে। বাঁ হাতে ছোট একটা ময়লা কাপড়ের পুঁটুলি, ডানহাতে পিতলের চাদরের ঘটিটা বুলানো, বগলে একটা পুরোনো মাদুর, মাদুরের পাড় ছিঁড়িয়া কাঠিগুলি বুলিতেছে।
খুকী বলিল, ও পিসি, যাস্নে—ও পিসি, কোথায় যাবি? পরে সে ছুটে আসিয়া মাদুরের পিছনটা টানিয়া ধরিল। ··তুই চলে গেলে আমি কাঁদ্বো পিসি—ঠিক—
সর্ব্বজয়া ঘরের দাওয়া হইতে বলিল, তা যাবে যাও, গেরস্তর অকল্যাণ করে যাওয়া কেন? ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করি, এতকাল যার খেলে তার একটা মঙ্গল তো দেখতে হয়, অনত্থ সময়ে না খেয়ে চলে গিয়ে তারপর গেরস্তর একটা অকল্যেণ বাধুক, এই তোমার ইচ্ছে তো?···ঐ রকম কুচকুরে মন না হলে কি আর এই দশা হয়?···
বুড়ী ফিরিল না। খুকী কাঁদিতে কাঁদিতে অনেক দূর পর্য্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে গেল।
বুড়ী গিয়া গ্রামের ও-পাড়ার নবীন ঘোষালের বাড়ী উঠিল। নবীন ঘোষালের বউ সব শুনিয়া গালে হাত দিয়া বলিল—ওমা, এমন তো কখনও শুনিনি, হ্যাঁগা খুড়ী? তা থাকো তুমি, এইখানেই থাকো। মাস-দুই সেখানে থাকার পর বুড়ী সেখান হইতে বাহির হইয়া তিনকড়ি ঘোষালের বাড়ী ও তথা হইতে পূর্ণ চক্রবর্ত্তীর বাড়ি আশ্রয় লইল। প্রত্যেক বাড়িতেই প্রথম আপ্যায়নের হৃদ্যতটুকু কিছুদিন পর উবিয়া যাওয়ার পরে বাড়ীর লোকে নানা রকমে বিরক্তি প্রকাশ করিত। পরামর্শ দিত ঝগড়া মিটাইয়া ফেলিয়া বাড়ি ফিরিয়া যাইতে। বুড়ী আরও দু’এক বাড়ী ঘুরিল, সব সময়ই তাহার ভরসা ছিল বাড়ী হইতে আর কেহ না হয়, অন্তত হরিহর ডাকিয়া পাঠাইবে। কিন্তু তিনমাস হইয়া গেল, কেহই আগ্রহ করিয়া ডাকিতে আসিল না। দুর্গাও আসে নাই। বুড়ী জানে ও-পাড়া হইতে এ-পাড়া অনেক দূরে, ছোট মেয়ে এতদূর আসিতে পারে না। সে আশায় আশায় ও-পাড়ায় দু’একবার গেল, খুকীর সঙ্গে দেখা হইল না।
বারো মাস লোকের বাড়ী আশ্রয় হয় না। পূব-পাড়ার চিন্তে গয়লানীর চালা ঘরখানি পড়িয়া ছিল—মাস দুই পরে সকলে মিলিয়া সেই ঘরখানি বুড়ীর জন্য ঠিক করিয়া দিল এবং ঠিক করিল পাড়া হইতে সকলে কিছু কিছু সাহায্য করিবে। ঘরখানা নিতান্ত ছোট, ছিটে বেড়ার দেয়াল, পাড়া হইতে দূরে, একটা বাঁশবনের মধ্যে। লোকের মুখে শুনিত সর্ব্বজয়া নাকি বলিয়াছে—তেজ দেখুক পাঁচজনে, এ বাড়ী আর না, আমার বাছাদের মুখের দিকে যে তাকায়নি—তাকে আর আমার দোরে মাথা গলাতে হবে না, ভাগাড়ে পড়ে মরুক্ গিয়ে।যাহাদের সাহায্য করিবার কথা ছিল, তাহারা প্রথম দিনকতক খুব উৎসাহের সঙ্গে জোগাইল, ক্রমে কিন্তু তাহাদের আগ্রহও কমিয়া গেল। বুড়ী ভাবে, কেন সেদিন অত রাগ করে চলে এলাম? বৌ বারণ কল্লে, খুকী কত কাঁদলে, হাতে ধরে টানাটানি কল্লে—। নিজের উপর অত্যন্ত দুঃখে চোখের জলে দুই তোবড়ানো গাল ভাসিয়া যায়। বলে—শেষ কালডা এত দুঃখুও ছিল আদেষ্টে-আজ যদি মেয়েডাও থাকতো–
চৈত্র মাসের সংক্রান্তি। সারাদিন বড় রৌদ্রের তেজ ছিল, সন্ধ্যার সময় একটু একটু বাতাস বহিতেছে, গোসাঁইপাড়ায় চড়কের ঢাক এখনও বাজিতেছে, মেলা এখনও শেষ হয় নাই।
রৌদ্রে এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরিয়া ও দুর্ভাবনায় বুড়ির রোজ সন্ধ্যার পরে একটু একটু জ্বর হয়। সে মাদুর পাতিয়া দাওয়ায় চুপ করিয়া শুইয়া আছে, মাথার কাছে মাটির ভাঁড়ে জল। পিতলের চাদরের ঘটিটা ইতিমধ্যে চার আনায় বাঁধা দিয়া চাল কেনা হইয়াছে। জ্বরের তৃষ্ণায় মাঝে মাঝে একটু একটু জল মাটির ভাঁড় হইতে খাইতেছে।
–পিসিমা!…বুড়ি কাঁথা ফেলিয়া লাফাইয়া উঠিল, দাওয়ার পৈঠায় খুকি উঠিতেছে, পিছনে তাহাদের পাড়ার বেহারী চক্কত্তির মেয়ে রাজী। খুকির পরনে ফরসা কাপড়, আঁচলের প্রান্তে কি সব পোটলা-পুটলি বাঁধা। বুড়ির মুখ দিয়া বেশি কথা বাহির হইল না। প্রবল আগ্রহে সে শীর্ণ হাত বাড়াইয়া তাহাকে জ্বরতপ্ত বুকে জড়াইয়া ধরিল।
–বলিসনে কাউকে পিসি, কেউ যেন টের পায় না, চড়ক দেখে সন্দেবেলা চুপি চুপি এলাম, রাজীও এলো আমার সঙ্গে, চড়কের মেলা থেকে এই দ্যাখ, তোর জন্যে সব এনেচি–
খুকি। পুটলি খুলিল।
–মুড়কি পিসিমা, তোর জন্যে দু’পয়সার মুড়কি আর দুটো কদমা আর খোকার জন্যে একটা কাঠের পুতুল–।
বুড়ি ভালো করিয়া উঠিয়া বসিল। জিনিসগুলো নাড়িতে চাড়িতে বলিল–দেখি দেখি, ও আমার মানিক, কত জিনিস। এনেচে দ্যাখে। রাজরানী হও, গরিব পিসির ওপর এত দয়া! দেখি খোকার কাঠের পুতুলডা! বাঃ দিব্যি পুতুল-কডা পয়সা নিলে?…
এক ঝোঁক কথাবার্তার পরে খুকি। বলিল–পিসি, তোর গা যে বড্ড গরম?
–সমস্ত দিন টিউরে বেড়িয়ে এই রকমডা হয়েছে, তাই বলি একটু শুয়ে থাকি–
ছেলেমানুষ হইলেও দুর্গা পিসিমার রৌদ্রে ঘুরিবার কারণ বুঝিল। দুঃখে ও অনাহারে শীর্ণ পিসিমার গায়ে সে সস্নেহে হাত বুলাইয়া বলিল, তুই অবিশ্যি করে বাড়ি যাস-সন্দে বেলা গল্প শুনতে পাইনে, কিছু না-কাল যাবি—কেমন তো?
বুড়ি আনন্দে উচ্ছসিত হইয়া উঠিল, বলিল, বৌ বুঝি তোকে কিছু বলে দিয়েছে আজ?
রাজী বলিল–খুড়িমা তো কিছু বলে দেয়নি পিসিমা, ওকে তো এখানে খুড়িমা আসতে দেয় না। আমরা বললে বকে, তবে তুমিও যেয়ো পিসিমা। তুমি একটুখানি বোলো, তাহলে খুড়িমা আর কিছু বলবে না–
খুকি। বলিল-কাল তুই ঠিক যাস পিসি, মা কিছু বলবে না।–তাহলে এখন বাড়ি যাই পিসি, কাউকে যেন বলিসনে? কাল সকালে ঠিক যাস কিন্তু।
সকালে উঠিয়া বুড়ি দেখিল শরীরটা একটু হালকা। একটু বেলা হইলে ছোট্ট পুটুলিতে ছেড়া খোঁড়া কাপড় দুখানা ও ময়লা গামছাখানা বাঁধিয়া বুড়ী বাড়ীর দিকে চলিল। পথে গোপী বোষ্টমের বৌ বলিল, দিদি ঠাক্রুণ, তা বাড়ী যােচ্ছ বুঝি? বৌদিদির রাগ চলে গিয়েছে বুঝি! বুড়ী একগাল হাসিল, বলিল, কাল দুৰ্গা যে সন্দে বেলা ডাক্তে গিয়েছিল, কত কাঁদ্লে, বল্লে, মা বলেচে—চ’ পিসি বাড়ী চ’—তা আমি বল্লাম—আজ তুই যা, কাল সক্কাল বেলাডা হোক্, আমি বাড়ি গিয়ে উঠবো—মেয়ের আমার কত কান্না, যেতে কি চায়!···তাই সকালে যাচ্ছি—
বুড়ী বাড়ী ঢুকিয়া দেখিল কেহ বাড়ী নাই। কাল সারারাত জ্বর ভোগের পর এতটা পথ রৌদ্রে দুর্ব্বলশরীরে আসিয়া বোধ হয় অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, পুঁটুলিটা নামাইয়া সে নিজের ঘরের দাওয়ার পৈঠায় বসিয়া পড়িল।
একটু পরেই খিড়কী দোর ঠেলিয়া সর্ব্বজয়া স্নান করিয়া নদী হইতে ফিরিল। এদিকে চোখ পড়িলে বুড়ীকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সে বিস্ময়ে নির্ব্বাক্ হইয়া একটুখানি দাঁড়াইল। বুড়ী হাসিয়া বলিলসর্ব্বজয়াও বৌ, ভালো আছিস? এই অ্যালাম এ্যাদ্দিন পরে, তোদের ছেড়ে আর কোথায় যাবো এ বয়সে—তাই বলি—
সর্ব্বজয়া আগাইয়া আসিয়া বলিল—তুমি এ বাড়ী কি মনে করে?
তাহার ভাবভঙ্গী ও গলার স্বরে বুড়ীর হাসিবার উৎসাহ আর বড় রহিল না। সর্ব্বজয়া কথার উত্তর দিতে না দিয়াই বলিল—এ বাড়ি আর তোমার জায়গা কিছুতেই হবে না—সে তোমাকে আমি সেদিন বলে দিয়েচি—ফের্ কোন্ মুখে এয়েচ?—
বুড়ী কাঠের মতো হইয়া গেল, মুখ দিয়া আর কোন কথা বাহির হইল না। পরে সে হঠাৎ একেবারে কাঁদিয়া বলিল—ও বৌ, অমন করে বলিসনে—একটুখানি ঠাঁই দে আমারে—কোথায় যাবো আর শেষকালডা বল্ দিকিনি—তবু এই ভিটেটাতে—
—ন্যাও, আর ভিটের দোহাই দিতে হবে না, ভিটের কল্যাণ ভেবে তোমার তো ঘুম নেই, যাও এক্ষুনি বিদেয় হও, নৈলে আমি অনত্থ বাধাবো—
ব্যাপার এরূপ দাঁড়াইবে বুড়ী বোধ হয় আদৌ প্রত্যাশা করে নাই। জলমগ্ন ব্যক্তি যেমন ডুবিয়া যাইবার সময় যাহা পায় তাহাই আঁকড়াইয়া ধরিতে চায়, বুড়ী সেইরূপ মুঠা আঁকড়াইয়া আশ্রয় খুজিতে লক্ষ্যহীন ভাবে এদিক ওদিক চাহিল—আজ তাহার কেমন মনে হইল যে, বহুদিনের আশ্রয় সত্য সত্যই তাহার পায়ের তলা হইতে সরিয়া যাইতেছে, আর তাহাকে ধরিয়া রাখিবার উপায় নাই।
সর্ব্বজয়া বলিল—যাও আর বসে থেকে না ঠাকুরঝি, বেলা হয়ে যাচ্ছে আমার কাজকর্ম আছে, এখানে তোমার জায়গা কোনোরকমে দিতে পারবো না—
বুড়ি পুঁটুলি লইয়া অতিকষ্টে আবার উঠিল। বাহির দরজার কাছে যাইতে তাহার নজর পড়িল তাহার উঠান-ঝাঁটের ঝাঁটাগাছটা পাঁচিলের কোণে ঠেস্ দেওয়ানো আছে, আজ তিন-চারি মাস তাহাতে কেহ হাত দেয় নাই। এই ভিটার ঘাসটুকু, ওই কত যত্নে পোঁতা লেবু গাছটা, এই অত্যন্ত প্রিয় ঝাঁটাগাছটা, খুকী, খোকা, ব্ৰজ পিসের ভিটা···তার সত্তর বৎসরের জীবনে এ সব ছাড়া সে আর কিছু জানেও নাই, বুঝেও নাই।চিরকালের মতো তাহারা আজ দূরে সরিয়া যাইতেছে!
সজনেতলা দিয়া পুঁটুলি বগলে যাইতে পিছন হইতে রায়বাড়ির গিন্নী বলিল—ঠাক্'মা, ফিরে যাচ্ছ কোথায়? বাড়ী যাবে না? উত্তর না পাইয়া বলিল—ঠাক্'মা আজকাল কানের মাথা একেবারে খেয়েছে।
বৈকালে ও-পাড়া হইতে কে আসিয়া বলিল—ও মা ঠাক্রুণ, তোমাদের বুড়ী বোধ হয় মরে যাচ্ছে, পালিতদের গোলার কাছে দুপুর থেকে শুয়ে আছে, রোদ্দুরে ফিরে যাচ্ছিল, আর যেতে পারেনি—একবার গিয়ে দেখে এসো—দাদাঠাকুর বাড়ী নেই? একবার পাঠিয়ে দেও না।
পালিতদের বড় মাচার তলায় গোলার পাশে ইন্দির ঠাক্রুণ। মরিতেছিল একথা সত্য। হরিহরের বাড়ী হইতে ফিরিতে ফিরিতে তাহার গা কেমন করে, রৌদ্রে আর আগাইতে না পারিয়া এইখানেই শুইয়া পড়ে। পালিতেরা চণ্ডীমণ্ডপে তুলিয়া রাখিয়াছিল। বুকে পিঠে তেল মালিশ, পাখার বাতাস, সব করিবার পরে বেশী বেলায় অবস্থা খারাপ বুঝিয়া নামাইয়া রাখিয়াছে। পালিত-পাড়ার অনেকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। কেহ বলিতেছে—তা রোদ্দুরে বেরুলেই বা কেন? সোজা রোদ্দুরটা পড়েচে আজ? কেহ বলিতেছে—এখুনি সাম্লে উঠবে এখন, ভির্মি লেগেছে বোধহয়—
বিশু পালিত বলিল—ভির্মি নয়। বুড়ী আর বাঁচবে না, হরিজেঠা বোধহয় বাড়ী নেই, খবর তো দেওয়া হয়েচে, কিন্তু এতদূর আসে কে?
শুনিতে পাইয়া দীনু চক্রবর্ত্তীর বড় ছেলে ফণী ব্যাপার কি দেখিতে আসিল। সকলে বলিল—দাও দাদাঠাকুর, ভাগ্যিস এসে পড়েচ, একটুখানি গঙ্গাজল মুখে দাও দিকি। দ্যাখো তো কাণ্ড, বামুনপাড়া না কিছু না—কে একটু মুখে জল দেয়? ফণী হাতের বৈঁচিকাঠের লাঠিটা বিশু পালিতের হাতে দিয়া বুড়ীর মুখের কাছে বসিল। কুশী করিয়া গঙ্গাজল লইয়া ডাক দিল—পিসিমা!
বুড়ী চোখ মেলিয়া ফ্যাল্ ফ্যাল্ করিয়া মুখের দিকে চাহিয়াই রহিল, তাহার মুখে কোন উত্তর শুনা গেল না। ফণী আবার ডাকিল—কেমন আছেন পিসিমা? শরীর কি অসুখ মনে হচ্ছে? পরে সে গঙ্গাজলটুকু মুখে ঢালিয়া দিল। জল কিন্তু মুখের মধ্যে গেল না, বিশু পালিত বলিল—আর একবার দাও দাদাঠাকুর—
আর খানিকক্ষণ পরে ফণী বুড়ীর চোখের পাতা বুজাইয়া দিতেই কোটরগত অনেকখানি জল শীর্ণ গাল-দুটা বাহিয়া গড়াইয়া পড়িল।
ইন্দির ঠাক্রুণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে সেকালের অবসান হইয়া গেল।