পসরা/জীবন-যুদ্ধে
জীবন-যুদ্ধে
ক
খুঁজিয়া খুঁজিয়া চাকুরি আর মিলিল না। তাহার বিদ্যার অভাব ছিল না; অভাব ছিল শুধু সুপারিসের। বিদ্যার অভাবে চাকুরি হয়। সুপারিসের অভাবে হয় না।
বড়সাধে পিতা, ছেলের অপূর্ব্ব নামকরণ করিয়াছিলেন,—কুবেরচন্দ্র। একালের রাজ্যশূন্য মহারাজের মত কুবেরও যে ঐশ্বর্য্যশূণ্য হইতে পারে, নামকরণের সময়ে পিতার সে খেয়াল আদোপেই ছিল না। বাঙ্গলাদেশে, পয়স। যদিও সুলভ নয়, কিন্তু ‘বিয়ের কনে’ বড় সুলভ। কুবেরচন্দ্রের এফ, এ পাশ করিবার পূর্ব্বেই রাঙ্গা-বউ ঘরে আসিল। এবং বছর-তিন যাইতে না যাইতেই শ্রীমান কুবেরচন্দ্র বেশ ভালরকমেই টের পাইলেন যে, ঊর্ব্বরা বঙ্গভূমির, কোলে মানুষ হইয়া তাঁহার স্ত্রী সরলাও বেশ সুফলা! ইতিমধ্যে কুবেরচন্দ্রের পিতাও নিশ্চিত্তমনে পৃথিবীর হাজিরা-বই হইতে নাম কাটাইয়া অনন্ত অবসর লইলেন। সারাজীবন চার্ব্বাক মুনির মতাবলম্বী হইয়া বৃদ্ধ, ঋণ করিয়া বিস্তর ঘৃতপান করিয়া ছিলেন। অতএব, তাঁহার মৃত্যুতে পাওনাদার-মহলে একটা বিষম হৈ-চৈ পড়িয়া গেল।
কিন্তু, উপায় নাই। তাগাদার জন্য, সাইলকেরা ঋণীর পিছনে উলুবেড়ে হইতে ‘হনোলুলু’তে গিয়াও হাজির হইতে পারে; কিন্তু তাহাদিগকে স্তব্ধ এবং জব্দ করিবার প্রধান উপায় হইতেছে, স্বর্গগমন। কুবেরের পিতা, এই চরম এবং পরম উপায় অবলম্বন করিয়া, পাওনাদারদের হাত হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিলেন।
কিন্তু তাহারাও ‘নাছোড়্-বান্দা’। অগত্যা, পিতার ‘ধার্ করিয়া ঘৃতপানের’ ফলে, পুত্র কুবেরচন্দ্রকে একমাত্র বসতবাড়ীখানি বিক্রয় করিয়া ফেলিতে হইল।
যুবতী স্ত্রী, দুটি সন্তান আর নেংটি ইঁদুর, আর্সুলা ও উইপোকা-ভরা তোরঙ্গসমেত কুবেরচন্দ্র ‘ভাড়াটে বাড়ী’তে গিয়া উঠিল। কিন্তু নিজের বাড়ীতে বাস করিয়া-করিয়া কুবেরের অভ্যাস এমনি খারাপ হইয়। গিয়াছিল যে, বাসাবাড়ীতে মাসের শেষে ভাড়া দিতে হয়, এ কথা তার মোটেই মনে থাকিত না।
কিন্তু বাড়ীওয়ালা সে কথা মনে করাইয়া দেওয়া দরকার বিবেচনা করিত। ফলে, কুবেরচন্দ্র অন্দরে আসিয়া, স্ত্রীকে ডাকিয়া বলিত, “ওগো, শুন্চো্?” সরলার দুইস্তনে, তখন হয়ত দুটি শিশু নীরা দোদুল্যমান, এবং তাহার বাট্নার হলুদমাথা হাতে ভাতের ‘কাটি’! সে উত্তর দিত,
“হুঁ!”
“বাড়ীওলা, ভাড়া চাইচে যে!”
“তা আমি কি কর্ব্ব?” কুবের অপ্রতিভ হইয়া কহিত, “হ্যাঁ— তা—না—কি জান, তাই বল্চি।”
“আমাকে বল্লে কি হবে?”
কি যে হবে, সেটা কুবেরও জানিত না। তবে, একটা কিছু হওয়া চাই, এটুকু সে বুঝিত।
সরলা ভাতের হাঁড়ীতে সরাখানা চাপা দিয়া ‘ন্যাতা’য় হাত পুঁছিয়া বলিত, “বেটাছেলে হয়ে, লেখাপড়া শিখে এমন করে বসে থাক্তে লজ্জা করে না তোমার! এই যদি মনে ছিল, তবে বিয়ে ক’রেছিলে কেন?”
কুবের আর সেখানে তিষ্ঠিতে পারিত না, সরলার কথায় বড় ‘ঝাঁঝ’! সে যে ইচ্ছা করিয়া বসিয়া নাই, এই সহজ সত্যটা সরলা কিছুতেই বুঝিত না। একটা ১৫ টাকা মাহিনারও চাকুরি পাইবার জন্য, সে কোথায় না গিয়াছে! কতনা সন্ধান, কতনা হাঁটাহাটি, কতনা খোসামুদি! কিন্তু চাকুরি মিলে না,—চাকুরি মিলে না! হায় চাকুরি!
পাওনাদারের তাগাদা, বাড়ীওয়ালার রক্তচক্ষু, অথচ হাতে একটি পয়সা নাই—এরূপ অবস্থায় বাহির হইতে ক্রমাগত ধাক্ক। পাইলে, মানুষের মন সহজেই একটা অবলম্বন খোঁজে, একটু হাঁফ্ ছাড়িবার জায়গা চায়, দুটি আশার কথা শুনিতে ইচ্ছা করে। যার সুগৃহিণী থাকে, সে আশ্রয় পায়। তখন প্রিয়ার মৃদুবাণী, উৎসাহভরা প্রেমপেলব চোখদুটি, সমবেদনামাখা সেবানিপুণ কোমল করের অমৃতস্পর্শ,—জীবনযুদ্ধে নমিতভগ্ন হতভাগার নিখিল ক্লান্তি অপনোদন করে। কিন্তু কুবের সুগৃহিণী পায় নাই। এর চেয়ে পোড়াকপালের কথা দুঃখীর ঘরে আর কি আছে!
আজ সকালে, কোন ঔষধের দোকানে কর্ম্মখালির একটি বিজ্ঞাপন পড়িয়া, কাক-চিল্ ডাকিবার আগেই, সে বিজ্ঞাপন-নির্দ্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়া হাজির হইয়াছিল।
বাহির হইতে ডাকিবামাত্র, জনৈক একচক্ষু মূর্ত্তি হুঁকা-হাতে জানালার ধারে আসিয়া দাঁড়াইল। খানিকক্ষণ কুবেরকে ‘আষ্টেপিষ্টে’ নিরীক্ষণ করিয়া সে কহিল, “কি চান মশায়?”
“এখানে কাজ খালি আছে শুনে এসেছি।”
লোকটা কলিকায় ফুঁ দিতে দিতে তার একমাত্র চোখ বুজিয়া কি-যেন ভাবিতে লাগিল; তারপর সহসা বলিয়া উঠিল, “ও হো-হো! বুঝিচি! তুমি বুঝি আমার বিজ্ঞাপন পড়ে এসেচ? আরে নিরেট, এটাও বোঝনি, যে কর্ম্মর্খালি আর লোক চাই বলে বিজ্ঞাপন না দিলে, কেউ সেটা পড়্বে না! বলি, ওষুধ-টষুধ কিন্বে কি,—খুব তাজা ওষুধ, ‘সর্ব্ববিধ জ্বর-হর’! কেনো ত’ ঘরের ভেতরে এস, নৈলে পথ দেখ বাবা, পথ দেখ।” বলিয়া, ক্ষণিকের জন্য সে একচক্ষুতে কুবেরের মুখের দিকে চাহিয়া হঠাৎ এমনি অট্টহাস্য করিয়া উঠিল যে, রাস্তার ধারে কুণ্ডলী পাকাইয়া একটা কুকুর শুইয়াছিল, সে কাণখাড়া করিয়া উঠিয়া, ল্যাজ গুটাইয়া একি হইল ভাবিল চোঁচা দৌড় দিল।
ম্রিয়মাণ হইয়া কুবের বাসার দিকে ফিরিল। বাসায় পৌঁছিয়া দেখিল, ছেলে আর মেয়ে দরজার চৌকাঠে বসিয়া কাঁদিতেছে।
কুবের রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “হয়েচে কি, কাঁদছিস্ বড় যে!”
মেয়ে বলিল, “মা মেরেচে, দুধ খেতে দেয় নি।” ছেলে-মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে দিতে কুবের বাড়ীর ভিতরে ঢুকিল। সরলা আসিয়া অবজ্ঞাভরে কহিল, “কাজের কি হল?” হতাশভাবে রোয়াকের উপরে বসিয়া পড়িয়া কুবের কহিল, “হল আর কি! রোজ যা হয়ে আস্চে, তাই।”
সরলা মুখ বাঁকাইয়া বলিল, “বেশ!”
তারপর, বালতিটা সশব্দে তুলিয়া নিয়া দুম্ করিয়া কলতলায় ফেলিয়া, কল খুলিয়া দিয়া বলিল, “শুনতে পাচ্চ, গয়লা আজ দুধবন্ধ করেছে, বলে গেছে, নালিশ করে দাম আদায় কর্ব্বে, তবে ছাড়বে।”
কুবের কোন জবাব দিল না, নীরবে স্ত্রীর মুখের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া রহিল।
“বাড়ীওলা এসেছিল। বলে গেল, জোচ্চর্ বাপের জোচ্চর বেটা, তিনদিনের মধ্যে বাড়ীখালি কর্ত্তে হুকুম দিয়ে গেছে। বল্লে, সে ভাড়া চায় না, আমরা এখান থেকে বিদেয় হলে বাঁচে।”
কুবের, আস্তে আস্তে উঠিয়া অধোবদনে সেখান হইতে চলিয়া গেল।
খ
খোলার বাড়ী। মেটে দেওয়াল। চালের ভিতর দিয়া সূর্য্যের আলো আসিয়া ঘরের ভিতরে পড়িয়াছে।
একদিকে একটি কাঠের তোরঙ্গ। তার উপরে কতকগুলা ভাঙ্গাচোরা আসবাব। তারই একটিপাশে বসিয়া কুবেরচন্দ্র আকাশপাতাল ভাবিতেছে।
মেঝের উপরে একখানা ‘শতচ্ছিন্ন’ মাদুর পাতা, তাহার উপরে শুইয়া সরলা ছোট মেয়েটিকে স্তন্যপান কারাইতেছে। পাশে বসিয়া ছেলেটা আর্ত্তকণ্ঠে চ্যাঁচাইতেছে।
তিনদিন হইল, কুবেরচন্দ্র কোঠাবাড়ী ছাড়িয়া এখানে উঠিয়া আসিয়াছে। আজ সকালে তাহাদের অন্ন পর্য্যন্ত জোটে নাই ৷
খোকার চীৎকার কিছুতেই থামিল না দেখিয়া সরলা তিক্তকণ্ঠে কহিল, “ওরে, আর যে পারি না, হাড় যে ভাজা ভাজা হয়ে গেল! তোরাও মর্ আমিও মরে জুড়োই। এমন কপাল করে এসেছিলুম যে, স্বামীও স্ত্রীলোকের অধম!”
কুবের তাড়াতাড়ি উঠিয়া বাহিরে গেল। সরলা বলিল, “আবার রাগটুকু আছে,—ফুলের ঘায়ে মূর্চ্ছা যান!”
তাহার এই রূপ, এই যৌবন, এই আশা—একটা গরীবের হাতে পড়িয়া সকলই ব্যর্থ! স্বামীর দারিদ্র্যকে যখন ধিক্কার দিত, সরলা তখন ভুলিয়া যাইত যে, সে নিজেও গরীবের মেয়ে! আর, স্বামীর অভাবকাতর মুখ দেখিয়াও সে আপনার কর্কশ কথা বন্ধ করিতে পারিত না। শুধু কুবের বলিয়া নয়, তাহার রূপকে ব্যর্থ করিয়াছেন বলিয়া বিধাতাকেও সে অমনি-অমনি ছাড়িয়া দিত না! “পোড়াকপালে বিধাতা! অদেষ্টে যদি এত ছিল, তবে এমন রূপ, এমন যৌবন কেন?” ঠিক কথা!
কুবেরচন্দ্র রাস্তায় বাহির হইয়া বরাবর চলিল। আজ এক বাল্যবন্ধুর কথা তাহার মনে পড়িয়াছে। ভাবিল, ভবেশ আমাকে বড় ভালবাসিত, আজ দুঃসময়ে হাত পাতিলে, নিশ্চয়ই সে অমনি ফিরাইয়া দিবে না।
মস্ত এক তেতলা বাড়ী। কুবের যখন সেই বাড়ীর ফটকের সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল, তখন ফটকের পাশে বসিয়া, বামকরতলে ‘শুকা’ দোক্তা পিষিতে পিষিতে দন্তকণ্টকিত বিরাট্ মুখ-বিবর উন্মুক্ত করিয়া হনুমান সিং গায়িতেছিল—
“দে নয়নমে তালা লাগায়ে—”
অনেক কষ্টে, দরোয়ানকে অনেক খোশামোদের পরে, তবে কুবের ভবেশের দেখা পাইল। ভবেশ, তখন একখানা আরাম-কেদারায় আড় হইয়া পড়িয়াছিল, তাহার বামহাতে একখানা ইংরাজী খবরের কাগজ, আর ডানহাতে অঙ্গুলধৃত একটি ইজিপ্সিয়ান সিগারেট। সামনের মার্ব্বেল টেবিলে রৌপ্যনির্ম্মিত পাণের ডিবা ও ‘অ্যাশট্রে’।
ঘরখানি য়ুরোপীয় কায়দায় সাজানো। গডফ্রে সিল্কের ভিত্তি-প্রচ্ছাদনী দিয়া দেওয়ালগুলি অলঙ্কত, শার্শির কাঁচে-কাঁচে রঙিন্ নিসর্গ-ছবি। জানালায় জানালায় পুঁতির পর্দ্দা। চারিদিকে রুবেন, কনষ্টেবল, রোম্নি, রেনল্ডস, ল্যাণ্ডসিয়র ও গেনস্বরো প্রভৃতি ওস্তাদ-শিল্পিগণের চিত্র-প্রতিলিপি। ঘরের কোণে কোণে লাঅকোঅন ও ভিনাস ডি মিলো প্রভৃতির প্রস্তর-মূর্ত্তি এবং আশেপাশে নানাধরণের সুখদ গদীমোড়া অসংখ্য চেয়ার, চীনামাটীর টবে করিয়া জাপানী “বামন গাছ” ও চিত্রিত বস্ত্রাবৃত মেজ।
ভবেশ প্রথমটা কুবেরকে চিনিতে পারে নাই। তারপর, যখন চিনিতে পারিল, তখন সহজস্বরে ডাকিল, “কে ও, কুবের নাকি? এস, এস, ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?”
কুবের সঙ্কোচের সহিত ধূলি-মলিন অনাবৃত পদে মূল্যবান্ কার্পেটের উপর পদচিহ্ন আঁকিয়া, ভবেশের সামনে গিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
সম্মুখের ভিত্তিবিলম্বিত প্রকাণ্ড দর্পণে তাহার মুর্ত্তি বিম্বিত হইল। সেদিকে নজর পড়াতে সে-যেন আরও সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। ভাবিল, তাইত’, এখানে আসিয়া কি অন্যায় কাজই করিয়াছি! এই সাজানো ঘরে আমাকে কি-রকম বে-মানান্ দেখাইতেছে!
ভবেশ বলিল, “কিহে, অমন করে জুজুর মত দাঁড়িয়ে রৈলে কেন? একি! তোমার পায়ে ন্যাক্ড়া বাঁধা যে? হয়েচে কি?
“কেটে গেছে।”
মিথ্যাকথা! তার জুতা ছিঁড়িয়া গিয়াছিল,—আবার যে নূতন জুতা কেনে, এমন পয়সা নাই। ধনী বন্ধুর বাড়ীতে না আসিলে নয়,—অথচ ভদ্রতার খাতিরে খালিপায়েও আসিতে পারে না। কাজেই পায়ে বস্ত্রখণ্ড বাঁধিয়াছিল। লোকে ভাবিবে, ক্ষতের ভয়ে পায়ে জুতা নাই।
ভবেশ বলিল, “ঐ চেয়ারে বসো। স্কুল ছেড়ে এই প্রথম তোমার সঙ্গে দেখা হল; এস, দুটো কথাবার্ত্তা কই।”
পুরাণো বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথনের জন্য ভবেশ কথায় আগ্রহপ্রকাশ করিল বটে, কিন্তু তার মুখ সম্পূর্ণ ভাবশূন্য। তার মুখ দেখিয়া বুঝিবার জো নাই, যে, সে আনন্দিত কিংবা বিরক্ত ৷
কুবের চেয়ারের উপরে আড়ষ্টভাবে বসিয়া বলিল, “কেমন, ভাল আছত, ভবেশ!” বলিয়াই, তার মনে হইল, এতক্ষণ পরে হঠাৎ এই কুশল-জিজ্ঞাসাটা বড়ই বেখাপ্পা হইয়া গেল।
ভবেশ সিগারেটের দগ্ধাবশেষটা অবহেলাভরে ‘অ্যাশ্ট্রে’র উপরে নিক্ষেপ করিয়া বলিল, “অমনি চলে যাচ্ছে দাদা! কিন্তু তোমায় অমন শুক্নো শুকনো দেখাচ্ছে কেন?”
ভবেশের অগোচরে, আপনার পরোনের কাপড়ের ছোঁড়া-দিকটা ঢাকা দিতে-দিতে ম্লানমুখে কুবের বলিল, “পেটের ধান্ধায় ভাই, পেটের ধান্ধায়! আমার অবস্থা, তুমি এই স্বর্গে ব’সে কল্পনাও কর্ত্তে পার্ব্বে না।”
কুবেরের কথার ভঙ্গী শুনিয়। ভবেশ একটু গম্ভীর হইয়া বসিল। তারপর চোখ বুজিয়া একটা ‘হাই’ তুলিয়া, হাতে তুড়ি দিতে-দিতে জড়িত কণ্ঠে বলিল, “আচ্ছ! কুবের, এতদিনপরে এ অধীনকে হঠাৎ স্মরণ হ’ল কেন?”
কুবের, এ-রকম প্রশ্নের প্রত্যাশা করে নাই। একটু থতমত খাইয়া মনে মনে ভাবিল, কি বলি? আমার আসার উদ্দেশ্যটা সরলভাবে খুলিয়া বলিব? না, না, যখন এসেছি, তখন একটু পরেই না হয় সকল কথা বলা যাবে। কথাটা এখনি পাড়্লে, বড় খারাপ শুনাবে।
প্রকাশ্যে বলিল, “কেন ভাই, বন্ধু’র কাছে কি আসাটাও নিষিদ্ধ?”
ভবেশ একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কুবেরের দিকে চাহিল। তারপর, একটা রূপার ছোট শলা দিয়া দাঁত খুটিতে-খুটিতে কহিল, “সে কি কথা,—তুমি এক্শোবার আস্তে পার, এখানে তোমার অবারিত দ্বার। ভাই, বন্ধু যদি বন্ধুর কাছে না আস্বে, তাহলে মানুষ কি বাঁচ্তে পারে? জগতে বন্ধুত্বের মত জিনিষ আর কি আছে? তোমরা রোজ আসবে, হুটো আমোদের কথা বলবে, দুটো সৎপরামর্শ দেবে, আমার বাড়ীকে তোমার নিজের বাড়ী মনে কর্ব্বে, —আমি ত’ এই চাই। কিন্তু এ-রকম বন্ধু আজকালকার বাজারে মেলা ভার। এই দ্যাখনা,—কাল একটা লোক এল,—ছেলেবেলায় কবে বুঝি তাঁর সঙ্গে পড়েছিলুম! আমার কাছে এসে সেই পরিচয় দিয়ে বল্লেন, তাঁর অবস্থা নাকি বড় খারাপ হয়েচে,—কিছু টাকা চাই। কি আর করি, দিলুম পাঁচটা টাকা! আচ্ছা বলদিকিন্ ভাই, এরকম বন্ধু কে চায়? আরে কেও, —রাজচন্দ্র যে! সেদিন বাজী জিতে ভারি পালিয়েছিলে, আজ এসত চাঁদ! একহাত থেলা যাক, দেখি কে হারে কে জেতে!”
কুবের পিছন ফিরিয়া দেখিল, ঘরের ভিতরে একজন নূতন লোক আসিয়াছে। একেত’ ভবেশের বক্তৃতার চোটে তাহার ‘তাগ’ লাগিয়া গিয়াছিল, তারপর এই তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাবে সে একেবারে জড়সড় হইয়া পড়িল।
রাজচন্দ্র বিনাবাক্যব্যয়ে দাবার ছক পাড়িল। কুবের উঠিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল, “আজ তাহ’লে আসি’ ভবেশ!”
ভবেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া, কোঁচাটা দুই-একবার ঝাড়িয়া, দাবার ছকের দিকে তাকাইয়া বলিল, “এরি মধ্যে! কিছু জলটল খেয়ে যাও!”
‘না ভাই, আজ মাফ করো,— সে আর একদিন হবে অখন।” বলিয়া, কুবের তাড়াতাড়ি প্রস্থান,—একরকম পলায়নই করিল।
ভবেশ ‘বোড়ে’ সাজাইতে সাজাইতে গমনশীল কুবেরের দিকে অপাঙ্গে চাহিয়া, তাহার অগোচরে বিদ্রূপের হাসি হাসিল।
রাজচন্দ্র কহিল “লোকটা কে হে?”
‘ভবঘুরে—আর কি?”
“এখানে কি কর্ত্তে এসেছিল?”
দাবার সামনের ‘বোড়ে’ টিপিয়া ভবেশ বলিল, “মধুর লোভে। তা এমন হুল ফুটিয়েছি, বাছা আর এ-মুখো হবেন না।”
গ
রাস্তায় আসিয়া, কুবের যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। এই বাল্যবন্ধু! ইহারই আশায় সে এখানে আসিয়াছিল? আসিয়া কি দেখিল? বড়মানুষী আর উদাসীনতা! আবার বলে কিনা, ‘জল খেয়ে যাও!’—কি পরিহাস!
খানিকদূর গিয়াই সে হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। ভাবিল, কোথাই যাই? বাসায়? কেন? কোন্ আকর্ষণে? স্ত্রী আমায় ভালবাসে না, দেখিলেই কটু বলিবে; ছেলে-মেয়ের পেটে ভাত নাই,— ক্ষুধায় তাহারা ক্রন্দন করিবে। দুই অসহ্য! তবে?—
ভাবিতে ভাবিতে, সে আবার চলিতে সুরু করিল। ভাবিল, জীবনে যার কোন লক্ষ্য নাই, মায়া নাই, সান্ত্বনা নাই,—কোন্দিকে যাইবে, এ ব থা সে কেন ভাবে?
দেখিল, সন্ধ্যা হইয়াছে, আলোর মালা পরিয়া নগর হাসিতেছে। পথে লোক, আর লোক, আর লোক,—কি জনতা! সবাই হাস্যমুখ, সবাই সুখী! হাসিবে না কেন? ঘরে তাদের স্নেহশীল পিতা, যত্নপরায়ণা মাতা, সেবাতৎপর। ভগ্নী, প্রেমবর্তী পত্নী! সবাই হাসে,—হাসিবে না কেন?
দেখিল, দিনমজুরেরা কাজের বোঝা ফেলিয়া নিশ্চিন্তপ্রাণে ঘরে ফিরিতেছে; মুখে তাদের আসন্ন অবসরের মধুর আনন্দ-আমোদের উচ্ছ্বাস! হা ভগবান্, ঐযে ভিখারী ভিক্ষা মাগিতেছে, ওর কাতরতার পিছনেও শান্তির আরাম আছে—ওর ঘরেও হয়ত’ শিশুর কান্না নাই ঈশ্বর! কেন আমায় পৃথিবীতে পাঠাইলে? পাঠাইলে ত, কেন ভদ্রঘরের ছেলে করিয়া, জীবনকে আমার তপ্ত অভিশাপে পরিণত করিলে? ওগো আমি যদি মজুর হইতাম! আমি যদি ভিখারী হইতাম! না, তা ত’ নই! আমি ভদ্রলোক! মজুরী করিলে আমার যে অপমান! ভিক্ষা মাগিলে, আমার যে মাথা কাটা যাইবে! ধিক্!
দেখিল, কুচরিত্রা স্ত্রীলোকের বাড়ীগুলি লোকে-লোকারণ্য! সেখানে গানের মূর্চ্ছনা, নূপুরের রিঞ্জনা, বাজনার ব্যঞ্জনা! পথ কাঁপাইয়া, দীনকে চাপা দিয়া, মৃতকে জাগাইয়া জুড়ী গাড়ীর পর গাড়ী আসিতেছে; মাথায় টেড়ী, চোখে চষমা, গলায় হীরার বোস্তাম্, বুকে সোণার চেন, হাতে ছড়ী, আঙ্গুলে আংটী, পরোণে মিহি কাপড়, পায়ে মকমলের পম্প্—বাবুর পরে বাবু গাড়ী হইতে নামিতেছেন, বাড়ীর উপরে উঠিতেছেন, উচ্চকণ্ঠে হাসিতেছেন, ঝমাঝম্ টাকা ফেলিতেছেন!
চারিআনা পাইলে আজ আমাদের প্রাণ বাঁচে, আর ওরা কিনা মিথ্যা, ঘৃণিত আমোদের জন্য, পাপকে প্রশ্রয় দিবার জন্য, অর্থকে ব্যর্থ করিবার জন্য, অবহেলায় টাকা উড়াইতেছে! বিশ্ব কি ওদের জন্য,— আমি কি কেউ নই, আমার কি কোন অধিকার নাই? আমরা কি এক আকাশের তলায় বাস করি না, আমরা কি এক প্রাণবায়ু গ্রহণ করি না, আমরা কি একই হাতের গড়া নই! হারে জগৎ!
নাঃ! আর ভাবিতে পারি না—এ ভাবনা, গভীর, অকূল, অসীম! কুবের হঠাৎ দাঁড়াইল। সাম্নে ও কি দেখা যায়?
গঙ্গা! গঙ্গা! তরঙ্গবলয়িতা, সঙ্গীতোচ্ছ্বসিতা, জ্যোৎস্নাধবলিতা গঙ্গা! তাঁহার উল্লোলনৃত্যের ছন্দে ছন্দে ভক্তসমর্পিত পুষ্পমাল্য মৌন উল্লাসে নাচিয়া উঠিতেছে এবং সঙ্গে-সঙ্গে স্তম্ভিত অম্বরের প্রতিবিম্ব বুকের উপরে শতধা হইয়া যাইতেছে।
সিকতাশয়নে শীতল কর বুলাইয়া, জলবেণী দুলাইয়া ধীরে ধীরে লীলায়িত গতিতে ফেণবিভূষণা সলিলরূপিণী মা আমার, বহিয়া যান আর বহিয়া যান, সাগরপানে বহিয়া যান!
“পতিত-পাবনী, তোর কোলে এ অভাগাকে ঠাঁই দে মা, সব জ্বালা জুড়িয়ে যাক্।”
কুবের প্রাণ ভরিয়া গঙ্গাজল পান করিল,—তার সকল ব্যথা যেন পলকে দূর হইয়া গেল।
ঘাটে জনমানব নাই। ভিজা মাটীর উপরে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া, কুবের এক্লা একমনে গঙ্গাকে দেখিতে লাগিল। দূরে শ্মশান। নিশীথ রাত্রি এবং গভীর অন্ধকার! সেই অন্ধকারে চিতার আগুন জ্বালাইয়া পরলোকের পথে অদৃশ্য যাত্রীরা যেন নিরুদ্দেশ যাত্রায় চলিয়াছেন!
সহসা সুদূরের নৌকায় মেঠোসুরে কে গান ধরিল:—
“মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে
আমি আর বাইতে পাল্লাম না।
সারা জনম বাইলাম বৈঠারে
ও তোর মনের নাগাল পালাম না।”
কি উদাস গান—কি হতাশসুর! সে সুরের ভিতরে প্রতিকথায় যেন কোন তাপিত প্রাণের নিখিল সমর্পণের স্বর ফুটিয়া উঠিতেছে এবং তাহার সঙ্গে গঙ্গাও যেন সলিলহস্তে কুবেরের দেহস্পর্শ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ওরে আয়, ওরে আয়! দুঃখ ভুলিবি ত আমার কোলে আয়! ওরে, আয় রে বাছা, আয়!”
কুবেরের মনও যেন সেই আহ্বানে সাড়া দিয়া উঠিল। উদ্ভ্রান্তের মত সে গঙ্গাকূলে উপুড় হইয়া পড়িল। সেখানে মাটীর ভিতর হইতেও যেন সেই আহ্বান সে কান পাতিয়া শুনিতে পাইল! “ওরে, আয় রে বাছা আয়, আমার কোলে আয়!”
হঠাৎ সে সোজা হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। ভাবিল, ঠিককথা। আমার ত বাঁচা-মরা দুই সমান!
সংসার আমাকে ঠেলিয়াছে, আমিও কেন এই অতলে সব বোঝা নামাইয়া দি না? জীবনে শান্তি পাইলাম না, দেখি, মরণে পাই কিনা?
সে জলে নামিল,—ক্রমে, আরও—আরও বেশী জলে। তার কোমর ডুবিল, বুক ডুবিল, গলা ডুবিল, মুখ ডুবিল, —তারপর, আঁধার-আঁধার!
নাঃ! বড় অন্ধকার গো! বড় গভীর! ভয় করে!
সে আবার ভাসিয়া উঠিল, সাঁতারিয়া আবার তীরে ফিরিয়া আসিল। তারপর একট। ‘জেটি’র উপরে উঠিয়া, আপনার ভিজা দেহকে সটান ছড়াইয়া দিল। তার মরা হইল না। সে চোখ মুদিল। এবং ঘুমাইয়া পড়িল।
ঘ
কতক্ষণ ঘুমাইল, সে তা জানে না।
হঠাৎ তাহার মনে হইল, কে যেন তাহাকে ধাক্কা দিতেছে। ধড়্মড়্ করিয়া, সে উঠিয়া বসিল। দুইহাতে ঘুমঝাপ্সা চোখদুটি কচ্লাইয়া ঊর্দ্ধদৃষ্টিতে চাহিল,—চাঁদ পশ্চিম আকাশে।
হঠাৎ পাশ হইতে কে জড়িতম্বরে কহিল, “কি বাবা কুম্ভকর্ণ, ঘুম কি ভাঙ্গল?”
অত্যন্ত চমকিয়া, পাশের দিকে চাহিয়া কুবের দেখিল, আসনপিঁড়ি হইয়া একটা লোক আদুড় গায়ে সেখানে বসিয়া আছে। তাহাকে চিনিতে না পারিয়া, সে অবাক্ হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিল।
লোকটা বিকট হাস্য করিয়া বলিল, “কি বাপ্ধন, চিন্তে পার্চ না, কিন্তু আমি তোমায় চিনেচি। তুমি আমারি মত একটা ভবঘুরে। কি বল? নইলে বাবা, এখানে এমন করে ঘরদোর ছেড়ে পড়ে আছ চাঁদ! আমি কে জান? আমার পরিচয়, এই!”
সে একটা জিনিষ উঁচু করিয়া, কুবেরের চোখের সামনে তুলিয়া ধরিল, সেটা মদের বোতল!
“মাতাল!” কুবেরের মুখ দিয়া আচম্কা কথাটা বাহির হইয়া গেল। সে সভয়ে উঠিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু লোকটা খপ্, করিয়া কুবেরের হাত চাপিয়া ধরিল। কহিল, “হুঁ”, আমি মাতাল। আমি চোর নই, জোচ্চর নই, আমি খুনে নই, বিশ্বাসঘাতক নই,—আমি মাতাল। দুনিয়ার সবাই আমাকে ঠেলে দিয়েছে, তাই আমি মাতাল! যন্ত্রণা আর সইতে না পেরে আমি মাতাল! এক্লাটি এখানে ব’সে মদ খাচ্ছিলুম, তোমাকে দেখে ভাব্লুম, যাহোক একটা সঙ্গী জুটে গেল। ব’স, ব’স,—পালিও না— ভয় পাও কেন বন্ধু!”
কুবের আপনার হাত টানিয়া ঘৃণাভরে বলিল, “ছাড়, ছাড়,—আমি মদ খাই না!”
“মদ খাও না?”
“না। আমার ছেড়ে দাও,— আর জ্বালার ওপর জ্বালা দিও না, সারাদিন আজ খাওয়া হয় নি, মাথার ভেতরে আমার আগুন জ্বল্চে।”
“আগুন নেবাও দাদা, আগুন নেবাও! এই মদ একটু মুখে ঢেলে দাও, আর দেখবে বুকের আগুন সব নিবে গেছে।”
মাতালের কথাগুলি সমবেদনায় ভরা! এমন আপনজনের মত কথা সে অনেকদিন শোনে নাই। সে আর চলিয়া যাইবার জন্য চেষ্টা করিল না,—আস্তে আস্তে বলিল, “মদে কি প্রাণের কষ্ট যায়?”
“যায় না? বল কি ভাই! এই মদ আছে তাই বেঁচে আছি। নাও, ঢোক্ ক’রে এই এক গেলাস গলায় ঢেলে দাওদিকিন্!”
মাতাল, পাত্রটা আগাইয়া দিল। কুবের অভিভূতের মত দেখিল, পাত্রভরা তরলধারা ঢল ঢল করিতেছে,—লইব, কি, লইব না? এখনও আমি সুচরিত্র। গরীব হইয়া, অনাহারে থাকিয়া, এখনও আমার চরিত্রকে মলিন হইতে দিই নাই,—আর আজ—
“কি বন্ধু! নাও—”
“না, না।”
“সেকি!”
“না, না—ঘরে আমার স্ত্রী-পুত্র আছে, আজ তাদের অন্ন জোটে নি। আমি যদি মাতাল হই, তাহলে তাদের কে দেখবে? তারা কি খাবে?”
“তুমি মাতাল না হয়েও, তাদের কি ভাল কর্ত্তে পেরেচ, ধন!”
কুবের ভাবিল, তা বটে!
“নাও হে নাও, জুড়িয়ে গেল! আমার কেমন যে বদ্-স্বভাব, একলা এক্লা মদ খেতে পারি নি!—নৈলে, তুমি খেলে না খেলে—আমার কি! নাও, চোখ-মুখ বুজে দাও-একটা চুমুক্! দেখবে দেহের মধ্যে যতটুকু এই সুধা যাবে ততটুকু খালি শান্তি!”
লোলুপ—অথচ সভয়নেত্রে, কুবের পাত্রের দিকে চাহিয়া জড়িত জিহ্বায় বলিল, “সত্যি বল্চ, মদ খেলে কোন জ্বালা থাকে না?”
“একদম না। বিশ্বেস না হয়, খেয়ে দেখ। কার জন্যে তুমি ভেবে মর্চো? তোমার মুখ কে চায় দাদা!”
সত্য! আমার মুখ কে চায়? আমি মাতাল হই আর না হই-তার জন্যে কার মাথাব্যথা? তবে আমিই বা মিছা কেন ভাবিয়া সারা হই?
কুবের কাঁপিতে-কাঁপিতে সুরাপাত্র ধরিল। চোখ মুদিয়া, আপনার শুষ্ক, বিবর্ণ ওষ্ঠের কাছে পাত্রটা তুলিল। তারপর, ধীরে ধীরে কহিল, “কি বল, খাই তা হ’লে—”
“হুঁ হুঁ—সোণারচাঁদ আমার!”
কুবের, পাত্রটা ওষ্ঠপার্শ্বে উপুড় করিয়া দিল,—সেই বিশ্ববিজয়িনী রক্তধারা তাহার উদরস্থ হইল এবং সেইসঙ্গে তাহার অসাড় হস্ত হইতে পাত্রটা স্খলিত হইয়া, সশব্দে পড়িয়া গেল।
“ছিঃ ছিঃ, এ কি করলে?” তার মনের ভিতর হইতে কে যেন এই ধিক্কার-বাক্য উচ্চারণ করিল।
অত্যন্ত বিমর্ষ হইয়া, কুবের স্তব্ধভাবে জ্যোৎস্নামাখা অল্পঅস্পষ্ট গঙ্গার চঞ্চল স্রোতের দিকে্ তাকাইয়া রহিল।
মাতাল, আর এক পাত্র গলায় ঢালিয়া দিয়া গান ধরিল:—
“আনন্দময়ী হয়ে গো মা,
আমায় নিরানন্দ ক’র না—”
গঙ্গার সুনির্জ্জন তটে, নীরবতার মাঝে সে সঙ্গীত বড় গম্ভীর শুনাইল। কুবের কান পাতিয়া গান শুনিতে লাগিল,—তাহার প্রাণমন যেন ভরিয়া উঠিল।
গান থামিল। কুবের আস্তে আস্তে কহিল, “তুমি কে?”
“বল্লুম ত, তোমারি মত এক হতভাগা।”
“তোমার কেউ নেই?”
“ছিল। সব ফাঁকি দিয়ে পালিয়েচে! থাক্বার মধ্যে আছি এখন আমি, আর এই বোতলটা। কিন্তু, তুমি কে?”
“শুনবে?”
“শুনবো বলেই ত জিজ্ঞেস কর্লুম।”
দরদের দরদী সবাই চায়। কুবেরও চাহিত, কিন্তু পাইত না। আজ বুঝি পাইয়াছে। এমন করিয়া আর কেহ কখনও তাহাকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করে নাই। তাই সে, প্রাণ খুলিয়া আপনার সকল দুঃখের কথা, এই অপরিচিতের কাছে প্রকাশ করিয়া বলিল।
মাতাল নীরবে সমস্ত শুনিল। তারপর, নিজে একপাত্র মদ্যপান করিয়া, কুবেরের সুমুখে পাত্রটা আবার ভরিয়া, তুলিয়া ধরিল!
কুবের ভয়ে-ভয়ে বলিল, “আবার!”
মাতাল কহিল, “হু—আবার! খাও, তোমার কথা শুনে বুঝলুম্— এ ভিন্ন তোমার দ্বিতীয় গতি আর নেই। আর একটু খাও, মাথা পরিষ্কার হবে। তখন সাফ্ বুঝ্বে, এই পৃথিবী তৈরি করাটা মস্ত একটা তামাসা! এখানে গরীবের ঠাঁই নেই বাবা,—তাকে থেৎলে বড়মান্ষের হাতী হামেসাই চলে যাচ্ছে। গরীবের মা-বাপ নেই। সে · বাঁচ্ল কি মর্ল কেউ দেখ্বে না। দেখ্ত, যদি তার টাকা থাক্ত! তা ত নেই! টাকাগুলি যে সব ধনীর সিন্দুকে। এই যে চাঁদ, দেশে এত লেক্চারের তুব্ড়ী, এই যে কামরূপে কাক মর্লে কাশীধামে হাহাকার ওঠে,—কিন্তু বাপ্ধন, আমরা গরীবেরা যে রোগে আর অনাহারে, ভুগে আর শুকিয়ে তিলে তিলে মর্চি, আমাদের একবার খোঁজটাও কেউ নিতে পার না! আরে ছোঁঃ! সব ভেল্ বাবা, সব ভেল্! কিছু ভেব না,—যত ভাব্না, তত কান্না,—দিন আপনি যাবে,—না যায়, মদ খাও! যতদিন না ওপারে গিয়ে ঠেক্চ, মদের গেলাসে দাও চুমুক্,—মস্ত জীবনটা এক্কেবারে ছোট্ট হয়ে যাবে!”
কুবের আর আপত্তি করিল না,—নীরবে মদ্যপান করিল।
হঠাৎ মাতাল তাহার হাত ধরিয়া টানিল; তারপর মৃদুস্বরে বলিল, “দেখ, একটা কথা বলি। টাকার জন্যে যা খুসি করো, কেবল বড়মান্ষের কাছে যেও না। গেলে হয় গলাধাক্কা পাবে,— নয় জাঁক দ্যাখাবার জন্যে তারা তোমায় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে একটু দয়া কর্ব্বে। ভাল মনে টাকা দেবে, তোমার দুঃখে কাতর হয়ে টাকা দেবে,—এমন বড়মানুষ এখন আর পাচ্চ না। বুঝ্লে বাবা, বড়মান্ষের ছায়া মাড়িও না— তারা ধাঙড়্। ছুঁলে নাইতে হয়।”
একটু ইতস্ততঃ করিয়া মাতাল আবার কহিল, “দেখ, কারুকে বোল না,—আমার ট্যাঁকে বিশেষ কিছু থাকে না,—তবে আজ গোটা তিনেক টাকা আছে দেখ্চি, তুমি নাও।”
কুবেরের নেশা হইয়াছে। কিন্তু তখনও তার বোধশক্তি বেশ প্রথর। সে আধ-ঘুমন্ত, আধ-জাগন্তের মত মাতালের দিকে চাহিল,—তাহার মনে হইল, একি অদ্ভুত মাতাল! যারা মদ খায়, তারা কি এমনি দেবতার মত হয়! তবে লোকে মাতালকে নিন্দা করে কেন?
ইহার পর তিনমাস কাটিয়াছে। কুবের এখন ঘোরতর মদ্যপ।
গঙ্গার ধারে, সেই অপূর্ব্ব মাতালের সঙ্গে তাহার রোজ দেখা হইত। মাতাল তাহাকে মদ দিত,—সে আগ্রহভরে পান করিত। পান করিয়া দেখিত, মাতালের কথা ঠিক্। মদ যেন সব জ্বালা ঘুচায়, মদ যেন দুঃখের স্মৃতির ভিতরে সুখের প্রীতি আনে। মদ শান্তির খনি।
মাঝে মাঝে, মাতাল তাহাকে টাকা দিত। কোথা হইতে সে টাকা আনিত, কুবের তাহা জানিত না। মাতালের পরিচয় কি, তাও সে জানিতে পারিত না।
জিজ্ঞাসা করিলে, একই উত্তর পাইত,—“আমি হতভাগা।”
মাতালের দেওয়া টাকায়, কতক সে মদ কিনিত, কতক সরলার হাতে দিত। সরলা, সন্দিগ্ধনেত্রে তাহার দিকে চাহিয়া কহিত, “টাকা কোথা পাও?”
“রোজ্গার্ ক’রে আনি।”
“বিশ্বাস ত’ হয় না।”
কুবের তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিত, “তোমার নাম সরলা রাখ্লে কে? তুমি গরলা।”
“তোমারও নাম ত কাঙ্গালীচরণ হওয়া উচিত ছিল; তার বদলে এ নাম কে রাখ্লে?”
নিরুত্তর ও ক্রুদ্ধ হইয়া কুবের সরিয়া পড়িত। এমনি করিয়া কিছুদিন গেল!
তারপর হঠাৎ একদিন মাতাল কোথায় অদৃশ্য হইল। তাহাকে খুঁজিতে কুবের কোন ঠাঁই বাকি রাখিল না! গঙ্গার ঘাটে বসিয়া বসিয়া সে রাত ভোর করিল। কিন্তু দিনের পর দিন যায়, মাতালের দেখা নাই; যেমন সহসা সে আসিয়াছিল, তেমনি সহসা আবার গা-ঢাকা দিল। কুবের চঞ্চল হইয়া উঠিল।
আরও কয়েকদিন কাটিল,—মাতাল আসিল না। কুবেরের সংসারে দারিদ্র্য এবং অনাহার, আবার আত্মপ্রকাশ করিল। এবারকার অভাবকষ্ট আরও অসহ্য! মদ কৈ? ভাত না পাই, ক্ষতি নাই— কিন্তু মদ, মদ কৈ? মাতাল কোথায়,—কে আমার শুক্নো গলায় মদ ঢালিয়া দিবে,—কে আমার বুক থেকে দারিদ্র্যের আগুন নিবাইয়া দিবে? আমি মদ খাব গো—সব জ্বালা ভুলিব। দাও মদ!
সরলা সামনে আসিল। বিনাইয়া-বিনাইয়া বলিতে লাগিল, “ওগো রোজগেরে মানুষ! ঘরে যে হাঁড়ি চড়্চে না! টাকা কোথা—”
“চুপ!” কুবের কর্কশকণ্ঠে বাধা দিল।
তাহার তেমন স্বর সরলা আর কখনও শুনে নাই। থতমত খাইয়া যে স্বামীর মুখের দিকে চাহিল।
“সরে যাও,—সরে যাও বলচি! সর্লে না? দেখবে—”
কুবের দুইহাতে ঘুষি পাকাইল। সরলা আর সেখানে দাঁড়াইতে সাহস করিল না।
মদ্! মদ! মদ্! ব্যাস্— কিছু আর চাই না আমি! খালি ঢাল্ব আর খাব, খাব আর ঢাল্ব! সংসার যাক্ ভেসে,—কে কার বাবা? চোখ, বুজ্লেই অন্ধকার—যতক্ষণ চেয়ে আছি—মদ, খালি মদ, খালি মদ চাই!
“বাবা!”—কুবেরের ছেলে আসিয়া কাতরস্বরে ডাকিল। দুধের ছেলে,—ভাল করিয়া এখনও কথা ফোটে নাই। এই বয়সে অনাহারে অযত্নে তার চোখ্ বসিয়া গিয়াছে, পেট পড়িয়া গিয়াছে ৷
“বাবা?”
“কি চাস্?”
“বাবা গো, ক্ষিদে!”
“হুঁ”, ক্ষিদে! ওরে হতভাগা, আমায় খাবি; মদ খাবি?”
“বাবা গো!”
“চোপ্ রাও!”
শিশু, ভয়ে এতটুকু হইয়া কাঁপিতে-কাঁপিতে পলাইয়া গেল।
কুবের দাড়াইয়া দাঁড়াইয়া খানিকক্ষণ পলায়নপর পুত্রকে দেখিল। তাহার পর ছুটিয়া গিয়া তাহাকে ধরিল, — ধরিয়া কোলে তুলিয়া নিল।
“ওরে যাদু—ওরে খোকা! আমি তোর বাপ নই! বাপ হলে, ছেলেকে খেতে দেবার ক্ষমতা থাক্ত। ভগবান্, মুখ তুলে চাও, দেখ, এখনও তোমার নাম ভুলিনি— এখনও তোমায় ডাক্চি!”
খোকার বুকে মুখ রাখিয়া কুবের কাঁদিতে লগিল।
কাঁদিতে-কাঁদিতে হঠাৎ কান্না থামাইয়া সে মুখ তুলিল। আপন মনে বলিল, “একি, কাঁদচি কেন? কাঁদলে কি মদ পাওয়া যায়? আরে দূর্—আরে দূর্! তুই আমার কোলে কেন? যাঃ—দুর্ হ!”
খোকাকে নামাইয়া দিয়া এলমেল পায়ে কুবের ঘর হইতে বাহির হইয়া রাস্তায় গেল।
চ
রাস্তার মোড়ে মদের দোকান। সেখানে মাতালদের আনন্দোৎসব হইতেছে। কেহ মাটির গেলাসে মদ নিয়া নাচিতেছে, কেহ ভূতলে লম্বা হইয়া পড়িয়া গান সুরু করিয়া দিয়াছে, কেহ হাসিতে হাসিতে হঠাৎ অকারণে কাঁদিয়া ফেলিতেছে, কেহ-বা আকস্মিক ভক্তিরসে আপ্লুত হইয়া বিকটস্বরে ‘তারা’ ‘তারা’ বলিয়া চ্যাঁচাইয়া উঠিতেছে।
কুবের লোলুপ দৃষ্টিতে রাস্তায় দাঁড়াইয়া সকলের মদ্যপান দেখিতে লাগিল। শেষটা আর থাকিতে পারিল না, আস্তে-আস্তে দোকানের ভিতরে ঢুকিয়া ‘শুঁড়ি’কে গিয়া বলিল, “হ্যাঁগো, একটু মদ দেবে?”
“পয়সা?”
“আজকের দিনটা ধারে দাও, পয়সা কাল পাবে।”
“না, না—দোকানের দরজায় কি লেখা আছে, দেখতে পাচ্ছিস্ না? ‘ধারে বিক্রয় নিষেধ’—ঐ দ্যাখ্!”
“একটুখানি দাও না, পায়ে পড়ি!”
“আরে মোলো, কোত্থেকে এ আপদ এসে জুট্ল! যা যা—মদ খেতে পয়সা লাগে, পয়সা আন্গে যা!”
শুঁড়ির কথার প্রতিধ্বনি করিয়া ঘরসুদ্ধ মাতাল একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, “যা, যা—মদ খেতে পয়সা লাগে, পয়সা আন্গে যা।”
কুবের দোকান হইতে বাহির হইল। একবার এ রাস্তা, একবার ও রাস্তা—এমনি লক্ষ্যহীনভাবে সারাদিন পথে-পথে ঘুরিয়া বেড়াইল। সন্ধ্যার আগে, তাহার শরীর একেবারে এলাইয়া পড়িল। সে আর চলিতে পারিল না। রাস্তার ধারে একটা বাড়ীর বিলাতী মাটীর ঠাণ্ডা রোয়াকের উপরে সে আস্তে-আস্তে দেওয়ালে ঠেশ্ দিয়া বসিয়া পড়িল। এবং সেই অবস্থায়, খানিক বসিয়া থাকিতে-থাকিতে তার চোখ ঘুমে ভারি হইয়া আসিল।
তন্দ্রাটা সবে একটু ঘোরালো হইয়া আসিয়াছে, এমন সময়ে হঠাৎ কে তাহার গলা ধরিয়া একটা প্রবল ঝাঁকানি দিয়া দিল। অত্যন্ত চমকিয়া কুবের চাহিয়া দেখিল, তাহার সামনে লালপাগ্ড়ীর মটুক্ পরিয়া, কালো দাড়ীর মেঘে চক্চকে দাঁতের বিদ্যুৎ খেলাইয়া, এক কনষ্টেবলের মূর্ত্তি! সংপ্রতি পাড়ায় উপরি-উপরি কতগুলি চুরি হওয়াতে উপরওয়ালার কাছে ধমক খাইয়া, পাহারাওয়ালাজী, সুচতুর চোরের উপরে বড়ই বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন! কাজেই, কুবেরকে এখানে, এমনভাবে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া, তাঁহার মনে সন্দেহ হইল, ইহার মৎলব নিশ্চয় খারাপ! অতএব, তিনি মহাবিক্রমে হতভাগ্য কুবেরের ঘাড়্ পরিয়া তাহাকে রোয়াকের উপর হইতে নামাইয়া দিয়া, সহরের যাবতীয় চোরের উদ্দেশে এমন কতগুলি সুমধুর শব্দপ্রয়োগ করিলেন, যাহা কোন অভিধানে পাওয়া যায় না বা ভাষায় লিখিয়া দশজনকে তাহা শুনাইতে গেলেও ভদ্রসমাজে লেখকের “কল্কে” পাওয়া দায় হইয়া উঠিবে!
“ভগবান, গরীবের— ঘরেও জ্বালা, পরেও জ্বালা, এ জীবন নিয়ে কি কর্ব্ব তবে? কোথা যাব? ওঃ! আর পারি না—আর পারি না- তবু প্রাণ যায় না! ছার প্রাণ!”
কুবের একটা গলির ভিতরে ঢুকিল। চোখের জল মুছিতে-মুছিতে অসাড় পায়ে একদিকে ধীরে ধীরে আপনমনে চলিয়া গেল।
ছ
মানুষের প্রাণ ত! সারাদিন পেটে ভাত নাই, বুকের ভিতরে অশান্তির আগুন ধিকি ধিকি জ্বলিতেছে,— কত আর সওয়া যায়? দুপা হাঁটিয়াই কুবেরের দেহের ভিতর কেমন করিতে লাগিল,—মস্তিষ্ক যেন অগ্নিপিণ্ড!
একটা বুকভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়| সে চলিতে-চলিতে দাঁড়াইয়া পড়িল; তাহার মনে হইতে লাগিল, পায়ের তলা থেকে মাটী যেন সরিয়া যাইতেছে, বুকের ভিতরে প্রাণ যেন মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িতেছে। তাড়াতাড়ি একটা বাড়ীর দেওয়ালে গা-ঠেসান্ দিয়া দাঁড়াইয়া, আপনার কাতর চোখদুটি মার্জ্জনা করিল। মনে-মনে বলিল, “আর যেন চোখ্ না খুল্তে হয়,— আর যেন চোখ্ না খুল্তে হয়!”
কিন্তু, মৃত্যু কোথায়? অনাদৃত হতভাগ্য মরে না! কুবেরও মরিল না! তেমনি করিয়া দেওয়ালে ভর্ দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল—কতকক্ষণ, সে জানে না।
হঠাৎ কচি-কচি গলায়-কে মধুর স্বরে ডাকিল, “ভিখিলি অ ভিখিলি!”
কুবের, ধীরে-ধীরে চক্ষু মেলিল। দেখিল, তার পাশেই একটি বাড়ীর দরজা। সেখানে, চৌকাঠের উপরে দাঁড়াইয়া, কোঁক্ড়া-চুলে ঢেউ খেলাইয়া গোলাপ ফুলের মত একটি ছোট্ট মেয়ে।
তাহাকে চোখ চাহিতে দেখিয়া, মেয়েটি তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বড়-বড় ডাগর চোখে অনেকক্ষণ ধরিয়া তাহাকে দেখিয়া, সে আবার কথা কহিল, “ভিখিলি, তোমাল কি হয়েছে?”
কি মিষ্ট কথা!
অন্য সময় হইলে, কুবের হয়ত এই অবোধ শিশুর কথা তুচ্ছজ্ঞান করিত,—কিন্তু তখন তাহার পাত্রপাত্রীর ভেদজ্ঞান মোটেই ছিল না! উচ্চস্থান হইতে পতনকালে, মানুষ দুহাত বাড়াইয়া শূন্যকেও জড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা করে।
অতএব ক্ষীণকণ্ঠে কুবের কহিল, “আমি খেতে পাই নি।”
“পয়তা নেবে?”
“নেব।”
সে ছুটিয়া বাড়ীর ভিতরে ঢুকিল। কুবের দেখিল, তাহার গলার কি চক্-চক্ করিয়া উঠিল। কি ওটা? হার? সোণার হার!
তাহার মুখ বুকের উপরে ঝুঁকিয়া পড়িল।
সকল মানুষেরই বুকের একদিকে ভগবান্ আর একদিকে সয়তান থাকে। একদিকে সৎবৃত্তি, আর একদিকে পিশাচবৃত্তি। কঠিন সমাজশাসনে, শিক্ষাগুণে, সৎবৃত্তির অনুশীলনে, সেই পিশাচবৃত্তিগুলি সাড়া দিবার ফাঁক্ পায় না।
কিন্তু “অবস্থাভেদে মানব পশুমাত্র।” চারিদিকে যার অভাব, তার সৎস্বভাব জলের আল্পনার মত পুঁছিয়া যায়, এবং সেইসঙ্গে মনের জ্ঞান-প্রদীপও নিবিয়া যায়।
কুবেরের মনের আলো এখন নিবিয়াছে। অন্ধকারে সেখানে সয়তান জাগিয়াছে।
মাথাহেঁট করিয়া, সে ভাবিতে লাগিল, “সোণার হার! সোণার-! কত দাম? কুড়ি টাকা? পনেরো টাকা? দশ টাকা? হুঃঁ! দশ টাকা এখন যদি পাই, কি করি? আগে মদ কিনি। তারপর! বাড়ীতে কিছু দি! ছেলে-মেয়ে খেতে পায় নি। তারা কাঁদ্চে, হয়ত মরে গেছে। মরে গেছে? আশ্চর্য্য কি? সোণার হার!
কুবের চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। কেউ কোথাও নাই। ঐযে,— মেয়েটা আস্চে না? বেশ মেয়েটি! দেখ্লে মায়া হয়।
হুঁ—মায়া! কিসের মায়া? আমাকে দেখে কেউত মায়াদয়া করে নি! কিসের মায়া? ঐ যে,—
গলায় হারটা দুলচে। সোণার হার! নিয়ে যদি পালাই, কেউ দেখ্তে পাবে না।
না—না—না! কি চমৎকার মুখ! আমাকে দেখে ওর দয়া হয়েছে,— আর, আমি ওর ওপরে ডাকাতি কর্ব্ব? তা কি হয়! কিন্তু, আমি যে মরি—আমার স্ত্রী-পুত্র যে মরে! মদ না পেলে আমি বাঁচ্ব না,—খেতে না পেলে তারা বাঁচ্বে না। সোণার হার! কি করি? তাইত—কি করি?
এমন সময়ে মেয়েটি সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। নির্ভয় মুখে তাহার সরল হাসির লীলা। ননীর মত একখানি নরম হাতে সে কুবেরের হাত ধরিয়া, অন্যহাতে একটি পয়সা দেখাইয়া, বাঁশীর মত মিঠে আধো-আধো স্বরে বলিল, “ভিখিলি,—মা পয়তা দিয়েতে।”
কুবেরের দৃষ্টি, হঠাৎ কঠিন হইয়া উঠিল। সে দৃষ্টি, কোন বুভুক্ষু শ্বাপদের মত ভয়ানক। সে প্রথমে শিশুর গলার হারের দিকে চাহিল।
কি প্রদীপ্ত স্বর্ণ! তারপর তাহার চোখ, মেয়েটির চোখের উপরে পড়িল। কি নির্দ্দোষ দৃষ্টি! শিশুর কোমল চাহনির সামনে, বুঝি পাষাণেও দরিয়া বহে! সেই নিষ্পাপ, শুভ্র আত্মার মহিমার সুমুখে কুবেরের মনের কুভাব যেন লজ্জায় ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িল। কিন্তু উপায় নাই—উপায় নাই! তাহাকে বাঁচিতেই হইবে, চুরি করিতেই হইবে! সে জোর করিয়া প্রাণপণে আপনার চোখ মুদিয়া রহিল। যেন শিশুর মায়াময় দৃষ্টি, তাহাকে তাহার সঙ্কল্প হইতে টলাইতে না পারে! তাহার পর হৃদয়ের চাঞ্চল্য দমন করিয়া, মনকে কঠিন করিয়া পলক-না-পালটিতে দুইহাতে সে, সেই স্বর্ণহার চাপিয়া ধরিল।
ছোট মেয়েটির মুখ ভয়ে সাদা হইয়া গেল। সে কাঁদিয়া উঠিবার উপক্রম করিল।
দন্তে-দন্ত ঘর্ষণ করিয়া কুবের চাপাগলায় কহিল, “চুপ্। কাঁদিস্নে। মেরে ফেলব—মেরে ফেলব।”
মেয়েটি, আপনার মোমের মত নরম হাতদুখানি দিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিল। তাহার কাপড়ের ভিতরে আপনার কচি মুখখানি গুঁজিয়া ফুপাইতে ফুপাইতে আধো-আধো স্বরে কহিল, “অ ভিখিলি, মাল্বে কেন ভাই, আমি তোমায় কত ভালবাতব—পয়তা দেব!”
কুবেরের দম্ যেন আট্কাইয়া যাইবার মত হইল। থর্থর্ করিয়া কাঁপিতে-কাঁপিতে, মেয়েটির মুখের কাছে মুখ আনিয়া সে কহিল,“ভালবাস্বি? অ্যাঁ! বলিস্ কিরে?”
“ভালবাতব—খুব ভালবাতব! আমায় মেল’ না ভাই।”
“নাঃ!”
কুবেরের শিথিল মুষ্টি হইতে হারছড়া পথের উপরে পড়িয়া গেল! এবং সেইসঙ্গে সে’ও একান্ত অবসন্ন হইয়া, মরণাহতের মত মাটির উপরে গড়াইয়া পড়িল। তাহার চেতনা লুপ্ত হইল।
যখন তাহার জ্ঞান হইল দেখিল, তাহাকে ঘিরিয়া অনেক লোক দাঁড়াইয়া আছে। প্রথমটা সে, কিছুই বুঝিতে পারিল না। ভাবিল, স্বপ্ন দেখিতেছি।
হঠাৎ একজন বলিল, “আবার মট্কা মেরে পড়ে আছেন! ওঠ্ ব্যাটা ওঠ,!”
সে আস্তে-আস্তে উঠিয়া বসিল। একি! এরা কারা?
আর একজন বলিল, “ব্যাটা চোর, মেয়েটাকে আর একটু হ’লে মেরে ফেলেছিল আর-কি! ভাগ্যে আমি দূর থেকে দেখ্তে পেয়ে ছুটে এলুম! পাহারাওলাজী, নিয়ে যাও ব্যাটাকে থানায়।”
পাহারাওয়ালা সেইখানেই দাঁড়াইয়াছিল। সে অগ্রসর হইয়া কুবেরকে রুলের এক গুঁতা দিয়া কহিল, “শালা বদ্মাস্! উঠ্ শালা উঠ্।”
জ
এক বৎসরের কারাবাস! সেযে কি যন্ত্রণা! স্বাধীন তাহা বুঝিবে না। আর, বুঝিবে না বলিয়া অভাগার সেই দৈনন্দিন যাতনাকাহিনী এখানে বলিয়া লাভ নাই। যাঁহার হৃদয় আছে, তিনি বুঝিয়া লউন।
এক বৎসর পরে, একদিন কুবের হঠাৎ দেখিল, চির-পরিচিত, দুঃখ সুখের স্মৃতি-দিয়া-ঘেরা, বিশাল বাহ্যজগৎ, আবার তাহার মস্তকে অনাহত আলোক-আশীর্ব্বাদ বর্ষণ করিতেছে। পিছনে কারাগার, আপনার আন্ধিয়ার হৃদয়ের উপরে আবার রুদ্ধ লৌহ কবাটের আবরণ দিয়াছে। কুবের দুইহাতে আপনার চোখ কচ্লাইয়া ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, এইমাত্র সে-যেন একটা সুদীর্ঘ দুঃস্বপ্ন দেখিয়া জাগ্রৎ হইয়া উঠিয়াছে!
সে চলিল। কারাগারের সংকীর্ণতায় তাহার প্রাণ যেন এতদিন জড় হইয়া, নিশ্চেষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল। এখন সহসা এই অবাধ স্বাধীনতার ভিতরে, এই অজস্রবৃষ্ট সূর্য্যকরধারার মাঝে পড়িয়া আবার সে দেখিল, চারিদিকে নূতন জীবন, নূতন উদ্যম, নূতন উৎসাহ্,—আলো, আর গান, আর হাসি!
সেই সংসার! সেই মানুষ! সংসারে তাহার বিতৃষ্ণা জন্মিয়াছিল, মানুষের উপরে তাহার ঘৃণা হইয়াছিল। কিন্তু আজ তাহার মনে হইতে লাগিল, এতদিন সে প্রবাসে, পরের কাছে পড়িয়া ছিল,—এই সংসার যে তাহার আপন ঘর, এই মানুষ যে তাহার আপন ভাই! আজ যেন বিশ্বের নিখিল আনন্দ, পুষ্পের নিখিল গন্ধ, সংসারের নিখিল ভালবাসা, শরীরী হইয়া তাহাকে আহ্বান করিতেছে!—নবলব্ধ মুক্ত স্বাধীনতার প্রেরণায় সে-যেন পাগল হইয়া উঠিল! ভাবিল, উচ্চে—আরও উচ্চে, ঐ যে নীলাব্জনীল নিথর আকাশ বিরাট্ অসীমতা এবং মৌনব্রত লইয়া অনাদিকাল ধরিয়া পড়িয়া আছে, সে যদি ইচ্ছা করে, তাহা হইলে, মাথার উপরকার ঐ অসীমতাকে এখনই আপনার মুঠোর ভিতরে চাপিয়া ধরিতে পারে! সে এখন স্বাধীন—সে এখন স্বাধীন!
এখন কি করিব, কোথায় যাইব? কেন, আপন আলয়ে? যেখানে আমার স্ত্রী আছে, আমার রক্ত দিয়ে গড়া পুলকের দুলালগুলি আছে! আহা, বাছারা না জানি “বাবা, বাবা” বলিয়া কত ডাকিয়াছে—কত কাঁদিয়াছে! ওরে আনন্দের কণা, মাণিকের টুক্রা, ওরে, তোদের কি আমি ভুলিতে পারি?—এই যে, এখনি গিয়া কোলে করিব, চুমা খাইব। আর সরলা? এতদিনের অদর্শনে নিশ্চয়ই তাহার মুখরতা দূর হইয়াছে।
আচ্ছা, তারপর? তারপর আর কি? ‘জেলার’ সাহেব আমাকে ভালবাসিতেন। আসিবার সময়ে আমার দুঃখের কথা শুনিয়া আমাকে কুড়িটা টাকা দিয়াছেন। আপাতত, ইহাতেই ত কিছুদিন চলিবে। ইহার ভিতরে একটা কাজের যোগাড় নিশ্চয়ই করিয়া লইব। এত কষ্ট পাইলাম, ভগবান্ এখনও কি মুখ তুলিয়া চাহিবেন না? আমি ত’ তাঁকে এখনও ভুলি নাই!
আমি চোর, আমায় কে কাজ দিবে? আমি চোর? কখনো না! ভগবান্ সাক্ষী, আমি চুরি করি নাই! বেশ,—কাজ না পাই, এবার দিনমজুরী করিয়া খাইব!
এমনি নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে, সে আপনার বাসাবাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু, কোথায় সরলা,— কোথায় ছেলেমেয়ে? দরজা যে বাহির হইতে বন্ধ! পাড়ার অনেকের কাছে সে খোঁজ নিল। কিন্তু সরলার সন্ধান কেহ দিতে পারিল না।
ওহো,—ঠিক্! সরলা নিশ্চয় তার ভায়ের কাছে গিয়াছে! এখানে একলাটি সে থাকিবে কেমন করিয়া? কে তাদের সংসার চালাইবে? হ্যাঁ, সেই ঠিককথা। সরলা তার ভায়ের কাছে গিয়াছে।
সরলার ভ্রাতার উদ্দেশে সে ছুটিল। কিন্তু সেখানে গিয়া শুনিল, সরলা সেখানে যায় নাই। তাহার ভ্রাতাও পরলোকে।
সরলা—আমার ছেলে—আমার মেয়ে!
কুবেরের মাথাটা যেন হঠাৎ কেমন গরম হইয়া গেল। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সে অনেক ভাবিল, —সরলা কোথায় গেল? মরিয়া গিয়াছে? তার ছেলে—তার মেয়ে? তারাও মরিয়াছে? সবাই মরিয়াছে? স্ত্রী-পুত্র—কন্যা,—ভগবান্—ভগবান্!
কুবের পাগলের মত একদিকে ছুটিয়া চলিল। সংসার আবার অন্ধকার, ভীষণ, শূন্যতাপূর্ণ!
যাইতে-যাইতে হঠাৎ দেখিল, পথের ধারে শুঁড়িখানা।
নিরাশায় আবার তাহার প্রাণে সয়তান জাগিল। এতক্ষণ সে ছিল, মুক্ত তুরঙ্গের মত! এখন, যেন কোন অজ্ঞাতকরধৃত অদৃশ্য রজ্জু, তাহাকে এক বিপুল অন্ধকারের দিকে আকর্ষণ করিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। কুবের, আত্মসংযম করিতে পারিল না। একটুও আগুপিছু না ভাবিয়া মন্ত্রমুগ্ধের মত, সে বরাবর মদের দোকানের ভিতর গিয়া দাঁড়াইল। হাতে ‘জেলার’ সাহেবের দেওয়া সেই কুড়ি টাকার নোট। ভাবিল, মদ খাই—সব দুশ্চিন্তা দূর হইবে।
সমস্তদিন সে, মদের দোকানে একদল মাতালের সঙ্গে পড়িয়া রহিল। মদ খাইয়া, পৈশাচিক আনন্দে ডুবিয়া, সে সকল দুর্ভাবনা ভুলিল।
সন্ধ্যার আগে, দলের একটা মাতাল কহিল, “খালি মদে বাবা, ফুর্ত্তি হয় না। দু’চারখানা মিঠে গলার গান, তার সঙ্গে নাচ আর তবলায় চাঁটি,—তবে ত’ ফুর্ত্তি জম্বে। চল বাপসকল, এ আলুনি নেশায় যার খুসি হয়, থাকুক,—এর মধ্যে আমি নেই ভাই!”
সকলের আগে কুবের দাঁড়াইয়া উঠিল; কহিল, “ঠিক্ বলেচ, চল।”
ঝ
তাহারা একটা জঘন্য পল্লীর ভিতরে প্রবেশ করিল।
দুপাশে সারি-সারি খোলার ঘর। রোয়াকের উপরে কতকগুলা কুৎসিত স্ত্রীলোক বসিয়া আছে। তাহাদের মুখে খড়ি মাখা। রাত্জাগা বসা-চোখের আসেপাশে কাজলআঁকা। তাহাদের স্নানদৃষ্টিতে কামের গন্ধমাত্র নাই,—আছে সুধু অভাবের মৌন হাহাকার, দারিদ্র্যের নীরব যাতনা! অন্ধকারে বসিয়া, হাঁটুর উপরে মলিন মুখ রাখিয়া, দুরন্ত শীতের কন্কনে হাওয়ায় তাহারা থর্ থর্ করিয়া কাঁপিয়া মরিতেছে।
মাতালদের সঙ্গে কুবের গলির ভিতরে ঢুকিল। মাতালেরা সবাই উল্লসিত, কিন্তু কুবেরের মুখে কোনরূপ ভাবাবেশ নাই। তুফানের টানে সে তখন হালভাঙ্গা নৌকার মত। তাহার কোন ভাবনা নাই!
সে চলিয়াছে, চলিয়াছে,—সংসারস্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছে, কোথায় গিয়া, কোন্ কূলে আছাড়িয়া তাহার ভাসিয়া চলার অবসান—সে তা জানে না, জানিতে চাহে না!
অন্ধকারের ভিতর হইতে আচম্কা একটা স্ত্রীলোক বাহির হইয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া টানিল। মিনতি করিয়া বলিল, “আমার ঘরে আসবে গা?”
হঠাৎ, কে-যেন চুলের মুঠি ধরিয়া কুবেরের হেঁট্করা মুখ সিধা করিয়া দিল। কে ডাকে,—এ কার গলা? তাহার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি রমণীর সহিত মিলিয়া স্থির হইল—ক্ষণিকের জন্য। এক পলকের ভিতরে তাহার মুখের মাংসপেশীর বিবিধরূপ পরিবর্ত্তন হইল। এবং পরপলকে তাহার মাথা, মড়ার মত কাঁধের উপরে ঝুলিয়া পড়িল।
রমণীও প্রথমে বজ্রাহতের মত স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল। তাহার পর; দুহাতে প্রাণপণে আপনার মুখ ঢাকিয়া, বেগে পলায়ন করিল। যেন, সে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখিয়াছে।
কুবেরকে দাঁড়াইয়া পড়িতে দেখিয়া, একজন তাহার গা-ধরিয়া নাড়া দিয়া কহিল, “ও হে, দাঁড়িয়ে পড়্লে যে! চল না!”
তাহাদের ডাকে কুবের শিহরিয়া উঠিয়া মুখ তুলিল। একবার সামনের অন্ধকারের দিকে চাহিল। কিন্তু যাহাকে খুঁজিতেছিল, তাহাকে দেখিতে না পাইয়া, সে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া-দাঁড়াইয়া যেন কি ভাবিতে লাগিল। যেন মনের ভিতরে, কি-একটা পুরাণো কথা হারাইয়া গিয়াছে, আর খোজ মিলিতেছে না। যেন স্মৃতির সূতা মাঝ্খানে কোথায় ছিঁড়িয়া গিয়াছে, আর জোড়া লাগিতেছে না!
মাতালেরা হাঁকিল, “তুমি কি-রকম বদ্রসিক হে! যাবে, কি যাবে না বল?”
সহসা উচ্চ, বিকট হাস্যে উচ্ছ্বসিত হইয়া কুবের চেঁচাইয়া উঠিল, “কোথা যাব,—সরলার বাড়ী? হাঃ হাঃ! সরলার বাড়ী!”