পাতা:অতিথি (প্রথম বর্ষ ১৯৩০).pdf/৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



উপমা[১]

—শ্রীসত্যেন্দ্র কুমার রায়—

 ‘কোকিন্—শিউ’এর অবতরণিকায় ‘সুরায়ুকি’লিখিয়াছেন, বর্তমানে প্রেম মনুষ্য-হৃদয় প্রলুদ্ধ করিয়া অতিরিক্ত অলঙ্কারারানুরাগী করিয়া তুলিতেছে। তাই, অনুভূতির গভীরতা হারাইয়া কবিতা লঘু হইয়া উঠিতেছে।’ …………দ্বিজেন্দ্রলাল ‘কালিদাস ও ভবভূতি’-প্রসঙ্গে এক জায়গায় বলিয়াছেন, “………যেন উপমা একটা দিতেই হইবে। ………কালিদাসের হইয়া দাঁড়ায়াইছে one for sense and one for smile. ……… আর চিত্তরঞ্জন ‘কাব্যের কথা’য় স্পষ্টই জানাইয়াছেন,………যেখানে ভাবের দৈন্য, সেখানেই উপমার প্রাচুর্য্য।………আজকালকার দিনে, “এই হিয়া দগ্‌দগি পরাণ পোড়নি কি দিলে হইবে ভাল—” এই ভাবটী প্রকাশ করিতে হইলে নানারকম উপমার আবশ্যক হয়।… একটা ভাব কোনরকমে জোগাড় হইলেই তাহাতে ভাষার রং মাখাইতে বসি এবং সেই রঙ্গিন জিনিষটাকে লইয়া, বলখেলার মত তাহাকে আছড়াইয়া আছড়াইয়া খেলিতে থাকি। কবির হৃদয় হইতে কোন ভাবই সহজে, সরলভাবে পাঠকের মনে আসে না। কবি যেন তাহাকে তাহার মন হইতে নামাইয়া মাঠে ফেলিয়া তাহার সঙ্গে খেলা করেন, আর সেই অবসরে পাঠকেরা একটু একটু দেখিয় লয়, আর কবির ক্ষমতার ভূয়সী প্রশংসা করে।’…”এইখানে আশা করি, অভিযোগের চরম; আর বেণীদূর গড়াইবার কোনো দরকার নাই। কিন্তু, তবু দেখা যায়, দোষারোপের যভ বাড়াবাড়ি, ভাল কাব্যে উপমারও তত প্রাচুর্য। গেটের শেষের দিকের কবিতায় আমরা
simile’র বিরলতা দেখিলেও metaphor’র,— smile’রই রূপান্তর—কোন অভাব দেখি না।

 সেদিন কোন জাপানী গ্রন্থে একটা গল্প পড়িলাম। গল্পট এই: কবি ‘রিকিউ’ নিমন্ত্রিতদের জন্য পুত্র ‘শোন্’কে তাহার উদ্যানপানি পরিষ্কার করিতে বলিলেন। পুত্র তাহার অর্থ ঠিকমত ধরিতে না পারিয়া উদ্যানের আবর্জনা দুই-তিনবার সরাইয়া ফেলায় ‘রিকিউ’ ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, ‘আবর্জনা সরানো আর উদ্যান-পরিষ্কার একজিনিষ নয়।’ তাহার পর নিজহাতে মেপল্-তরুর পাতা ঝরাইয়া রেশমী কাপড় বিছাইয়া দিলেন।

 কাব্যের সম্বন্ধেও এই কথাটাই খাটে। আবর্জনা-হীন ভাবের প্রকাশে শুধু কাব্য হয় না। ভাষার অলঙ্কার তাহার সৌন্দর্যের অঙ্গ। এখানেও না হয়, সেই অলঙ্কারের প্রাচীন কথাটা রঙ ফিরাইয়া, ঘুরাইয়া বলা হইল।

 কিন্তু উপমার ইহা অপেক্ষা অনেক বৃহত্তর ও মহত্তর কারণ, উদ্দেশ্য আছে। প্রথমেই না হয়, উপমার জন্মকথা,—যেটুকু আমার মনে হয়—লইয়া আলোচনা করি।

 মানুষ চিরদিনই তাহার বাহিরের বিশ্বের মাঝে আপনার সাদৃশ্য চাহিয়া বলে: ‘Alastor’-এর তরুণ এই সাদৃশ্য-অনুসন্ধানেই নির্জন নদী বাহিয়া, গহন অরণ্য পার হইয়া শেষে কাশ্মীরের গুহায় আসিয়াছিলেন।

 আমাদের দৈনন্দিন, সাধারণ, সামাজিক জীবনেও ঠিক এই কথা। আমাদের ভুল, ক্রটি,—এমন কি গুণ

  1. আমার উপমার উদাহরণে যে-গুলি আনিয়াছি, সংস্কৃত বা ইংরাজী অলংকার শাস্ত্রের মাপ-কাঠীতে তাহাদের অনেকগুলি হয়তো উপমা নয়। যেমন, ‘যাঁহা যাঁহা পদ-যুগ ধরই। তাঁহা তাঁহা সরোরুহ ভরই॥’ যেখানেই একটী রূপ বা চিন্তা আর একটী বা অনেকগুলির রূপের সংযোগে প্রকাশে আপনাকে সফল করিতে চায়, তাহাদেরই উপমার অন্তভুক্ত করিয়াছি।