পাতা:অতিথি (প্রথম বর্ষ ১৯৩০).pdf/৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করার সময় সমস্যা ছিল।
অতিথি
[১৩৭

অসীমতা বাদ দিয়াও এ-ভাবখানি হয়ত, অন্য কতকগুলি কথার সন্নিবেশে একই গভীরতা লইয়া আমাদের মনে তাহার দাবী জানাইয়া যাইতে পারে, কিন্তু এমন কতকগুলি ভাব আছে যে-গুলি উপমা ছাড়া আর কিছুতে প্রকাশ সম্ভবপর নয়। কালিদাসের ‘সঞ্চারিণী দীপশিখেব রত্রৌ যং যং ব্যতীয়ায়………… নরেন্দ্র মার্গাটদুষ্পাঠ্য বিবর্ণভাবং,’ বা রবীন্দ্রনাথের “তুমি যেন ওই আকাশ উদার, আমি যেন এই অসীম পাথার, মাঝখানে তা’র আকুল করেছে আনন্দ-পূর্ণিমা।’— আমাদের মনে যতখানি সঞ্চদুষ্পাঠ্য আনিয়া দিতে পারে, উপমা-বিহীন ভাষার মধ্যে ততখানি-ততখানি কেন, একটুও প্রকাশ আশা করিতে পারি না।

 উপমা আর-এক দিক্ দিয়া ভাব-সম্পদ্ বাড়াইয়া দেয় আগেরটী যেমন মাত্রার দিক্ দিয়া, শেষেরটী তেমনি সংখ্যার বহুলতায়। ব্রাউনিঙের কাব্যে যেমন নিক্ষিপ্ত-প্রয়োগ (Paranthesis), শেলীর কাব্যে সেই রকম, উপমাই অর্দ্ধেক সৌন্দর্য, সৌষ্ঠব, স্বষমা বহিয়া আনে। নূতন-নূতন রূপ চোখের সম্মুখে ভাসিয়া উঠে; স্বপ্ন-জগৎ খুলিয়া পড়ে; আমরা গহন ভুলে হারা হইয় স্বপ্ন রচনায় লাগিয়া পড়ি। এবং এই-খানে একটী ভাব অসংখ্য রূপের মধ্যে প্রকাশ পাইয়া আপনাকে অশেষ করিয়া তুলে। কাব্যের মধ্যে যে অতি’র ভাব বা immensity, যা’ প্রতিনিয়তই কাব্যকে জীবনের চেয়ে মহত্তর, বৃহত্তর, অধিকতর সুন্দর করিয়া তুলে, উপমাই সে-টুকুর অনেকখানি সহায়তা করিয়া থাকে। বৈষ্ণব কাব্যই তাহার প্রমাণ। নীচের উদ্ধৃত-অংশ-টুকু তাহারই একটা দৃষ্টান্ত।

‘যাঁহা যাঁহা পদযুগ ধরই।
তাঁহা তাঁহা সরোরুহ ভরই॥
যাঁহা যাঁহা ঝলকত অঙ্গ।
তাঁহা তাঁহা বিজুরি তরঙ্গ॥
...................

যাঁহা যাঁহা নয়ন বিকাশ।
তাঁহি কমল পরবাশ॥
যাঁহা যাহা লহু হাস সঞ্চার।
তাঁহা তাঁহা অমিঞা বিকার॥
যাঁহা যাঁহা কুটিল কটাখ।
তাঁহি মদন শর লাথ॥’

 এ পর্য্যস্ত জগতে জীব-জন্তু-তরু-লতা-বস্তুর মধ্যে স্পষ্ট কোনে বিভাগ-রেখা টানিতে পারা যায় নাই। একটীতে আর-একটার ছোঁয়াচ্ লাগিয়া থাকে। স্পঞ্জ জন্তু, না উদ্ভিদ?… জেলি তরল কি কঠিন?…আর একটু পরিচিত দৃষ্টাস্ত ধরা যাক্। সকাল, সন্ধ্যা ইহাদের, রাত্রি বা দিবস,—কাহার অন্তর্ভুক্ত করা যায়?…তন্দ্রা জাগরণের, কি ঘুমের?…এ গুলির মীমাংসা আজ পর্যন্ত হইল না। এ গুলি, না হয় মানিয়া লইলাম, প্রান্তোস্থিত দৃষ্টান্ত বা Marginal Instances! কিন্তু এমন্ কি বিজ্ঞান যাহা-দিগকে দুইটী বিভিন্ন জাতির অন্তর্গত বলিয়া নির্দেশ করিয়াছে, তাহদের একটীতে অপরের ছায়া পড়িতে দেখি। এমিবা (Amaeba) হইতে মানুষ পর্যস্ত, সব জীবই Cell দিয়া তৈয়ারি। এই ত গেল, শারীরিক দিকের কথা! আবার এভ্‌রিনফ্ (Evrienoff)’এর মতে, কীট-পতঙ্গ-উদ্ভিদ হইতে অসভ্য, সভ্য মামুষের Theatricality-র instinct-খানি অতি-ব্যাপক ভাবে কাজ করিয়া যায়।……বিভিন্ন সম্প্রদায়-ভুক্ত দুইটী কবির মধ্যে অনেক পার্থক্য-সত্বেও আমরা যথেষ্ট মিল খুজিয়া পাই। দুইটা বিশিষ্ট চরিত্রের মধ্যে আমরা একই দোষ গুণের স্পন্দন অনুভব করি। এ গুলির অর্থ কি?…মনে হয়, যেন জগতের রহস্য প্রত্যেকের মাঝে মিলিয়া মিশিয়া একাকার হইয়া রহিয়াছে। উপমা একটীতে আর একটীর ছায়া আনিয়া এই আশ্চর্য রহস্য খানি ভরিয়া দেয়। আমাদের মনের প্রতিনিয়ত অবস্থা (mood) হইতে অবস্থাস্তরে যাওয়ার যে বেগ, উপমা নূতন-নূতন