বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/১৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
১০৩

বিভাগে ও নৌবিভাগে তাহার প্রবেশ করিবার সুযোগ থাকে না। বাংলার মস্তিষ্ক এ পর্যন্ত কেবল আইন ব্যবসায়ে স্ফূর্তিলাভ করিবার সুযোগ পাইয়াছিল, সেই কারণে বাঙালীদের মধ্যে বড় বড় আইনজ্ঞের উদ্ভব হইয়াছিল। যাঁহারা নব্যন্যায়ের জন্ম দিয়াছিলেন, এবং তর্কশাস্ত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাঁহাদেরই বংশধরেরা স্বভাবত আইন ব্যবসায়ে নিজেদের প্রতিভার পরিচয় দিয়াছিলেন। তর্ক-শাস্ত্র এবং আইনের কূট আলোচনার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। সুতরাং গাঙ্গেয় উপকূলের মেধাবী অধিবাসীরা ইংরাজ আমলে স্থাপিত আইন আদালতে আইন ব্যবসায়কে যে তৎপরতার সহিত গ্রহণ করিয়াছেন তাহা কিছুই আশ্চর্যের বিষয় নহে। সমস্ত তীক্ষ্ণ ঝদ্ধি মেধাবী ছাত্রই এই পথ অবলম্বন করিত। যদিও আইন ব্যবসায় শীঘ্রই জনাকীর্ণ হইয়া উঠিল এবং নব্য উকীলেরা বেকার অবস্থায় কালযাপন করিতে লাগিল, তথাপি শীর্ষস্থানীয় মুষ্টিমেয় আইন ব্যবসায়ীরা প্রভূত অর্থ উপার্জন করিতেন বলিয়া, এই ব্যবসায়ের প্রতি লোকে বহ্ণিমুখে পতঙ্গের মত আকৃষ্ট হইত। প্রায় ২০ বৎসর পূর্বে “বাঙ্গালীর মস্তিষ্কের অপব্যবহার” নামক পুস্তিকায় আমি দেশবাসীর দৃষ্টি এই দিকে আকৃষ্ট করি; এবং দেখাইয়া দেই যে কেবলমাত্র একটি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উন্মাদের মত ধাবিত হইয়া এবং জীবনের অন্য সমস্ত বিভাগ উপেক্ষা করিয়া বাংলার যুবকরা নিজেদের এবং দেশের কি ঘোর সর্বনাশ করিতেছে! একজন বিখ্যাত আইন ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতা—বাংলা কাউন্সিলে একবার বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, আইন এদেশের বহু প্রতিভার সমাধি ক্ষেত্র স্বরূপ হইয়াছে।

 বাঙালী প্রতিভার ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে বসুর আবিষ্ক্রিয়া সমূহ বৈজ্ঞানিক জগতে সমাদর লাভ করিল। বাঙালী যুবকদের মনের উপর ইহার প্রভাব ধীরে ধীরে হইলেও, নিশ্চিতরূপে রেখাপাত করিল। এযাবৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকরা শিক্ষাবিভাগকে পরিহার করিয়াই চলিত। শিক্ষাবিভাগের উচ্চস্তর ইউরোপীয়দের একচেটিয়া ছিল। দুই একজন ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারী প্রসিদ্ধ ভারতীয় প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া উহাতে প্রবেশ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। শিক্ষাবিভাগকে এখন পুনর্গঠন করা হইল এবং একটি স্বতন্ত্র নিম্নস্তরের শাখা ভারতবাসীদের জন্য সৃষ্ট হইল। কিন্তু উচ্চস্তর কার্যত ইউরোপীয়দের জন্যই সুরক্ষিত থাকিল। ইহার ফলে প্রতিভাশালী মেধাবী ভারতবাসীরা শিক্ষাবিভাগ যথাসাধ্য বর্জন করিতে লাগিল। আমি এখানে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিব।

 আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাধারণ কৃতী ছাত্র ছিলেন। অল্পবয়সেই গণিত শাস্ত্রে তিনি প্রতিভার পরিচয় দেন। সেই কারণে শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর স্যার আলফ্রেড ক্রফ্‌ট তাঁহাকে ডাকিয়া একটি সহকারী অধ্যাপকের পদ দিতে চাহেন। উহার বেতন মাসিক ২০০ হইতে ২৫০ টাকা। স্থানীয় গবর্ণমেণ্টের উহার বেশি মঞ্জুর করিবার ক্ষমতা ছিল না। আশুতোষ যদি মুহূর্তের দৌর্বল্যে ঐ পদ গ্রহণ করিতেন, তবে তাঁহার ভবিষ্যৎ উন্নতির পথ রুদ্ধ হইত। তিনি যথানিয়মে প্রাদেশিক সার্ভিসের উচ্চতম স্তর পর্যন্ত উঠিতে পারিতেন। ২৫ বৎসর কাজ করিবার পর, মাসিক সাত আট শত টাকা মাহিয়ানাও হইত। কিন্তু বেতনের পরিমাণ এখানে বিবেচনার বিষয় নহে। সরকারী কর্মচারী হিসাবে তাঁহার স্বাধীনতা প্রথম হইতেই সঙ্কুচিত হইত এবং প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত সুযোগ মিলিত না। পরবর্তী জীবনে তিনি যে পৌরুষ ও তেজস্বিতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হইত। বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আমলাতন্ত্রের প্রভাব হইতে যেটুকু স্বাতন্ত্র্য ভোগ করিতেছে, তাহা ভবিষ্যতের স্বপ্নে পর্যবসিত হইত। বিজ্ঞান কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য পোষ্ট গ্রাজুয়েট বিভাগ, এ সমস্ত সম্ভবপর হইত না।